আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যাংকগুলো থেকে ঋণের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। বর্তমানে ওই সকল ব্যাংক চরম সংকটের মধ্যে রয়েছে। এই সংকট সমাধানে বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল করতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে ৫টি ইসলামী ব্যাংকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একীয়ভূতকরণের চেষ্টা চলছে।
আমানতকারীদের উদ্দেশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জনকন্ঠকে জানান, দুর্বল ব্যাংকগুলোর সংস্কার বা একীয়ভূতকরণের বিষয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। ব্যাংক মার্জার বা একীয়ভূতকরণ মানেই ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়া নয়। আগে একা চলতাম এখন অন্যজনকে সঙ্গে নিয়ে চলছি। তখন ওই ব্যাংকটি কিন্তু আরও দ্বিগুণ শক্তিশালী হবে।
তিনি বলেন, একজন গ্রাহক যে ব্যাংকে আমানত জমা রাখে সে কিন্তু ওই ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডিকে তা কিন্তু জানার চেষ্টার করে না। তাই গ্রাহকদের বলব, আপনাদের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই, কেন্দ্রীয় ব্যাংক আপনাদের সঙ্গে আছে। আপনাদের আমানত সুরক্ষিত থাকবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানান, বেসরকারি খাতের পাঁচটি ইসলামী ব্যাংককে খুব শীঘ্রই একীভূত করা হবে। সবগুলোকে মিলিয়ে একটি ব্যাংক করা হবে। তবে এই ব্যাংকগুলোর কর্মীদের আপাতত চাকরি হারানোর ভয় নেই। আমানতকারীদেরও কোনো ভয় বা শঙ্কা নেই। একীয়ভূতকরণ হলে ব্যাংকগুলো আরও শক্তিশালী হবে।
জানা যায়, চলতিবছরের শেষের দিকে এই নতুন ব্যাংকের উদ্বোধন করা হবে। ব্যাংকটির নাম এখনো নির্ধারণ করা হয়নি। নতুন আইনে নতুন নিয়মে করা ব্যাংকটির ডিপোজিটরদের জন্য থাকছে ব্যাপক সুযোগ সুবিধা। সরকারের পক্ষ থেকে থাকছে ২০ হাজার কোটি টাকা ক্যাপিটাল সুবিধা। তবে প্রথম ধাপে ১০ কোটি টাকা। পরের ধাপে বাকি ১০ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, আর্থিক সংকটে পড়া পাঁচ শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের সম্মিলিত আমানত ১ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা, অথচ বিনিয়োগ ছাড়িয়ে গেছে ২ লাখ ১৫ হাজার কোটি এর মধ্যে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা খেলাপি, যা মোট ঋণের ৭৬ শতাংশ। ইউনিয়ন ব্যাংকের খেলাপি ৯৮ শতাংশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে ৯৭, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে ৯৫, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে ৬২ এবং এক্সিম ব্যাংকে ৪৮.২০ শতাংশ। ৭৭৯টি শাখা, ৬৯৮ উপশাখা, ৫১১টি এজেন্ট আউটলেট, ৯৭৫ এটিএম বুথ এবং ১৫ হাজারের বেশি জনবল নিয়ে এই পাঁচ ব্যাংক এখন বিশাল এক দায় ও ঝুঁকির পাহাড়ে দাঁড়িয়ে।
ব্যাংকগুলোর একীভূত করার বিষয়ে গভর্নর বলেন, ব্যাংক কর্মকর্তাদের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। প্রয়োজনে শাখাগুলো স্থানান্তর করা হবে। যেসব ব্যাংকের শাখা শহরে বেশি, সেসব ব্যাংককে গ্রামে পাঠানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। নির্বাচনের সঙ্গে ব্যাংক মার্জারের কোনো সম্পর্ক নেই। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। আমরা আশা করব পরবর্তী সরকার এসে এই প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তবে নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা না করে আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই পাঁচটি ইসলামী ব্যাংক মার্জার করা হবে।
এছাড়া অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে সংকটে পড়া আরো ১১ ব্যাংকের সম্পদের গুণগত মান যাচাইয়ে (অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ- একিউআর) উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে বিদেশি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান ধারা একিউআর করা হবে।
ব্যাংকগুলো হলো- এবি ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স, আল আরাফাহ্, আইএফআইসি, ইসলামী ব্যাংক, মেঘনা, ন্যাশনাল, এনআরবি, এনআরবিসি, প্রিমিয়ার ও ইউসিবি ব্যাংক।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠন করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে গত সরকারের আমলে ইসলামী ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ছিল বিতর্কিত ব্যবসায়ী গ্রুপ এস আলমের হাতে। এস আলম ইসলামী ব্যাংক থেকে এক লাখ পাঁচ হাজার কোটি টাকা নামে-বেনামে ঋণ নিয়েছেন বলে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) এক তদন্তে উঠে এসেছে।
গত মে মাসে দুর্বল ব্যাংক নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ‘ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি হয়। এই অধ্যাদেশের আলোকে আগামী জুলাই থেকে শুরু করে ১৫ অক্টোবরের মধ্যে একীভূতকরণের প্রথম ধাপের প্রক্রিয়া শেষ হবে। এ সময় ব্যাংকগুলোকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাঁচটি টিম।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জনকন্ঠকে বলেন, আরো কিছু ব্যাংকের সম্পদের গুণগত মান যাচাই করা হবে। সম্পদ মান যাচাই করা মানে একীভূত নয়। আসলে ব্যাংকগুলোর সম্পদের মান কী অবস্থায় আছে তা দেখার জন্য একিউআর করা।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আমরা শুনেছি এই ব্যাংকগুলো থেকে আমানতকারিরা টাকা তুলে নিচ্ছে, এটি উদ্বগের বিষয়। আপাতত দৃশ্যমান কিছু কাজ করে গ্রাহকদের মাঝে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।