ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৫ জুন ২০২৫, ১ আষাঢ় ১৪৩২

মতামত

মতামত বিভাগের সব খবর

২৮ বছরেও ক্ষতিপূরণ আদায় হয়নি

২৮ বছরেও ক্ষতিপূরণ আদায় হয়নি

১৪ জুন  মাগুরছড়া ট্রাজেডি দিবস । ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন রাত ১টা ৪৫ মিনিটে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ থানার পাহাড়ে এলাকা মাগুরছড়া গ্যাসকূপে বিস্ফোরণ সংঘটিত হয়। প্রচন্ড শব্দে কেঁপে ওঠে  গোটা মৌলভীবাজার জেলা। আগুনের লেলিহান শিখা দাউ দাউ করে জ্বলছিল। দীর্ঘদিন রাতের বেলা লাল হয়ে থাকতো মৌলভীবাজার জেলার সুনীল আকাশ। ভীত-সন্ত্রস্থ লোকজন ঘরের মালামাল রেখে প্রাণভয়ে এদিক ওদিক ছুটছিল। প্রায় ৫০০ ফুট উচ্চতায় লাফিয়ে উঠা আগুনের লেলিহান শিখায় লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল বিস্তীর্ণ এলাকা। সুদূর ভৈরব (১১০ কি:মি:) থেকে আকাশের দিকে তাকালে বিস্ফোরণের লেলিয়ান শিখা দেখা যেত। আগুনের লেলিহান শিখায় গ্যাসফিল্ড সংলগ্ন লাউয়াছড়া রিজার্ভ ফরেষ্ট, মাগুরছড়া খাসিয়াপুঞ্জি, জীববৈচিত্র্য, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন, ফুলবাড়ী চা বাগান, সিলেট-ঢাকা ও সিলেট- চট্টগ্রাম রেলপথ এবং কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল সড়কে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। দেশের ইতিহাসে ভয়াবহতম অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্থ হয় ঘনগভীর বন ও এর সাহচর্যে থাকা বিপুল সংখ্যক প্রাণীবৈচিত্র্য। ক্ষতির মুখোমুখি হয় রেল ও সড়কপথ, পানজুম, বিদ্যুৎ লাইনসহ এই অঞ্চলের অসংখ্য স্থাপনা।  দুর্ঘটনার জন্য দায়ী মার্কিন গ্যাস উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান অক্সিডেন্টাল ক্ষয়ক্ষতির আংশিক পরিশোধ করলেও কোন ক্ষতিপূরণ পায়নি বন বিভাগ। ফিরে আসেনি প্রাকৃতিক বনের স্বাভাবিকতা। পূর্ণ ক্ষতিপূরণ না দিয়েই ইউনিকলের কাছে হস্তান্তরের পর সর্বশেষ শেভরনের কাছে বিক্রি হয়েছে এই গ্যাসক্ষেত্র। শেভরন ২০০৮ সালে ওই বনে ত্রি-মাত্রিক ভূতাত্ত্বিক জরিপ কাজ সম্পন্ন করে। এতেও স্থানীয়ভাবে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন।  তৎকালীন সময়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে যে, ৬৩ প্রজাতির পশু-পাখির বিনাশ সাধন হয়।  রাজধানী ঢাকা ও বন্ধন নগরী চট্টগ্রাম রেল স্টেশন থেকে শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত ট্রেন যোগাযোগ ছিল। সিলেটের সঙ্গে ঢাকা ও চট্টগ্রামের রেল যোগাযোগ ১৬৩ দিন বন্ধ ছিল। মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছিল প্রায়  ১৪ হাজার কোটি টাকা। মার্কিন অক্সিডেন্টাল ক্ষয়ক্ষতির আংশিক পরিশোধ করলেও বন বিভাগ কোন ক্ষতিপুরণ পায়নি।  ২০১২ সনে শেভরন মৌলভীবাজার ১৪ নং ব্লকের অধীনে নূরজাহান, ফুলবাড়ি এবং জাগছড়া চা বাগানের সবুজ বেষ্টনি কেটে কূপ খননের পর এসব কূপ থেকে চা বাগানের ভেতর দিয়ে ড্রেন খনন করে পাইপ লাইনের মাধ্যমে উত্তোলিত গ্যাস কালাছড়ার মাধ্যমে রশীদপুর গ্রীডে স্থানান্তর চলছে। বিভিন্ন সংগঠন মাগুরছড়া দুর্ঘটনার যথাযথ ক্ষতিপূরণ আদায়ের দাবিতে আন্দোলন পরিচালনা করে এলেও দীর্ঘ ২৮ বছরেও ক্ষতিগ্রস্থদের দাবিকৃত ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিষয়টি এখনো অমীমাংসিত রয়েছে। গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধানের জন্য গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আজ পর্যন্ত জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি। তৎকালীন সরকার ক্ষতিপূরণ আদায়ের জোরালো ভূমিকা পালন করেনি। ফলে মাগুরছড়া দুর্ঘটনার ২৮তম বার্ষিকী পূর্ণ হলেও ক্ষতিপূরণ আদায় নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার কারণে আজো ক্ষতিপূরণ না পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্তরা হতাশায় ভুগছেন ।  গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের পরিত্যক্ত এলাকার উত্তর টিলায় সবুজায়ন করা হয়েছে। মূল কূপটি এখনো পুকুরের মতো আকৃতি ধারণ করে টিকে আছে। চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরী করা হয়েছে। টিলার ওপর সবুজ বনায়নের উদ্যোগ নিলেও মাঝে মধ্যে আগুনের পোড়া ডালপালাবিহীন কালো রঙের গাছগুলো অগ্নিকান্ড দুর্ঘটনায় সাক্ষী এখনো দাঁড়িয়ে আছে। কমলগঞ্জ উপজেলার সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভিতরে লাউয়াছড়া ফরেষ্ট বিটের অভ্যন্তরে মাগুরছড়া এলাকায় ১৯৮৪-৮৬ ও ১৯৯৪ সালে সাইসলিক সার্ভেতে গ্যাস মজুদের সন্ধান পাওয়া যায়। এ প্রেক্ষিতে উৎপাদন ভাগাভাগির চুক্তিতে ১৯৯৫ সালের ১১ জানুয়ারী মার্কিন বহুজাতিক তেল ও গ্যাস উত্তোলণকারী কোম্পানী অক্সিডেন্টাল এর সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং গ্যাস উত্তোলনের জন্য ৬৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে অনুমতি প্রদান করা হয়। দায়িত্ব গ্রহণের পর অক্সিডেন্টাল কোম্পানী মাগুরছড়ায় গ্যাস ফিল্ডের ড্রিলিং কাজের জন্য সাবলিজ প্রদান করেছিল ডিউটেক নামের জার্মান কোম্পানীর কাছে। গ্যাস উত্তোলনে ১৪ নং ব্লকের মাগুরছড়ার মৌলভীবাজার-১ গ্যাসকূপের খননকালে ৮৫০ মিটার গভীরে যেতেই ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মধ্যরাতে  ভয়াবহ বিষ্ফোরণ ঘটে।  তৎকালীন সংবাদপত্রের তথ্য অনুসারে, ঐ সময়ে শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ ১৫ কি.মি. (৩৩ হাজার কেভি) উচ্চতাপ বৈদ্যুতিক লাইন পুড়ে নষ্ট হয়। কুলাউড়া, বড়লেখা ও কমলগঞ্জ উপজেলার ৫০ টি চা বাগানে দীর্ঘদিন স্থায়ীভাবে বিদ্যুৎ সংকট দেখা দেয়। ৬৯৫ হেক্টর বনাঞ্চলের বৃক্ষ সম্পদ, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এছাড়া ২৪৫ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পুড়ে নষ্ট হয়, যার বাজার মূল্য দাঁড়ায় ৫০ কোটি ডলার। গ্যাস বিস্ফোরনের পর অক্সিডেন্টাল তাদের  ইউনোকলের কাছে দায়িত্ব দিয়ে এ দেশ ত্যাগ করলে দুই বছর পর ফুলবাড়ি চা বাগান, পার্শ্ববর্তী মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জির বাড়ি-ঘর, পান জুম এলাকার ক্ষয়ক্ষতি বাবদ আংশিক টাকা প্রদান করে ইউনোকল। অন্যদিকে দূর্ঘটনাস্থলের কাছাকাছি কমলগঞ্জ - শ্রীমঙ্গল সড়ক ধারে সামাজিক বনায়নের রোপিত গাছের জন্য ৩ ব্যক্তিকে ১০ লাখ টাকা ক্ষতি পূরণ প্রদান করা হয়। দীর্ঘ ৬ মাস কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকার কারণে ক্ষতি পূরণ বাবত বাস মালিক সমিতিকে ২৫ লাখ টাকা প্রদান করা হয়। এছাড়াও বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে কিছু ক্ষতিপুরন দেয়া হয় । কিন্তু পরিবেশ ও গ্যাস বাবত কোন ক্ষতিপূরণ করা হয়নি এবং কোন সরকারই ক্ষতিপূরণ আদায়ে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি বলে জনগণের গুঞ্জন রয়েছে। দুর্ঘটনার পর তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তদন্ত কমিটি ১৯৯৭ সালের ৩০ জুলাই মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট পেশ করে। তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী অক্সিডেন্টালের দায়ীত্বহীনতাকেই দায়ী করা হয়। তৎকালীন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিশেষ করে ওয়ার্কার্স পার্টি, বামগণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, ন্যাপ, জাসদ, বাসদ, গণতন্ত্রী পার্টি, সিপিবিসহ বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন-এর উদ্যোগে শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ- মৌলভীবাজার সমগ্র সিলেট বিভাগসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল, পদযাত্রা আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু নানা কারণে  জনগণের সম্পদ ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ আদায় করা সম্ভব হয়নি।  মাগুরছড়া মৌলভীবাজার জেলার অন্তর্গত শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের একটি জায়গার নাম। ১৯৯৭ সালের জুন মাসে স্থানটি রাতারাতি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদ শিরোনামে পরিণত হয়। এখনো প্রতি বছর ‘মাগুরছড়া দিবস’- ছাড়াও মাঝে মাঝে সংবাদ শিরোনামে মাগুরছড়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে জনগণের সামনে আবির্ভূত হয়। তৎকালীন সময়ের বিভিন্ন সংবাদপত্রের তথ্য থেকে জানা গেছে, এ ঘটনার মধ্যদিয়ে প্রাকৃতিক বনের যে কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা কেউ বুঝতে পারবে না। যারা এই বনে বসবাস করেন তারা তা বুঝতে পারেন। বনের ১৭৭ কোটি টাকার ক্ষতি নিরূপন করে দেয়া হলে এ পর্যন্ত কিছুই পাওয়া যায়নি। প্রাকৃতিক বনের ক্ষতি কোন সময়ে পুষিয়ে উঠার নয় বলে জানা গেছে। 

রক্ত দিলে হয় না ক্ষতি, জাগ্রত করে মানবিক অনুভূতি

রক্ত দিলে হয় না ক্ষতি, জাগ্রত করে মানবিক অনুভূতি

সৃষ্টিকর্তার সেরা প্রাণীর শরীরে বয়ে চলা সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের নাম হচ্ছে রক্ত, যা একটি প্রাণীর বাহ্যিক কাঠামোর অভ্যন্তরে প্রবাহিত হওয়ার মাধ্যমে শারীরকার্য সম্পন্ন করে থাকে। এই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান একজন সুস্থ ব্যক্তির শরীরের অভ্যন্তরে থাকাটা যতটা অপরিহার্য ঠিক তেমনি একটি অসুস্থ ব্যক্তির শরীরকে সুস্থ করার অভিপ্রায়ে সুস্থ ব্যক্তির শরীর হতে রক্ত নিয়ে অসুস্থ ব্যক্তির শরীরে প্রদান করাও ততখানি-ই অপরিসীম। রক্ত প্রদান করা মানেই হচ্ছে একজন ব্যক্তির নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা। বছরের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ দিবসের মধ্যে অন্যতম দিবসের নাম হচ্ছে- ‘বিশ্ব রক্তদাতা দিবস।’ যেদিনটিকে ঘিরে সমগ্র দেশে ঐক্যতার সহিত উৎযাপিত হয় বিশ্ব রক্তদাতা দিবস এবং খুবই গর্বের সাথে সম্মান প্রদর্শন করা হয়ে থাকে সেই অজানা বীরদের যারা এই দিবসটিকে তাঁদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান (রক্ত) দান করার মাধ্যমে অলংকৃত করেছেন।

বাবা মানে আত্মত্যাগ ও ভালোবাসা

বাবা মানে আত্মত্যাগ ও ভালোবাসা

ভোরের প্রথম আলো ফুটে ওঠার আগেই একজন বাবা ঘুম ছেড়ে ওঠে পরিশ্রম শুরু করেন পরিবারের জন্য। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে তার মনে চিন্তা আর দুশ্চিন্তা থাকে কিভাবে তার পরিবারকে আরেকটু ভালো রাখা যায়। একজন বাবার চোখে হয়তো ক্লান্তির চিহ্ন দেখায়। কিন্তু সেই ক্লান্তির আড়ালে লুকিয়ে থাকে এক অমলিন ভালোবাসার গল্প। যে গল্পের বুনিয়াদ পরিবারের সুরক্ষা, খাদ্য, আশ্রয় এবং ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি। তারা হয়তো মুখে কম কথা বলেন, তবুও তাদের কাজ তাদের ভালোবাসার গন্ধ ছড়ায়। বাবা হয়তো খুব কমই বলে ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’। কিন্তু তার প্রতিটি কাজই সেই ভালোবাসার নিদর্শন। আর তাই তো একজন বাবা ভোরের অন্ধকারে উঠে চলে পড়েন কর্মস্থলে, যেন তার সন্তান স্বপ্ন পূরণে সক্ষম হয়। এমন বাবারাই কখনো কল-কারখানায় কঠোর পরিশ্রম করেন, শরীর কষ্টে ভোগে, তবু মন থেকে কখনো হাল ছাড়েন না। আবার কেউ কেউ একাধিক কাজ করেন, আর্থিক সংকটের মধ্যে দিয়ে পরিবারকে চালিয়ে নিয়ে যেতে। বাবারা শুধু অর্থায়ন করে নয় বরং পরিবারকে মানসিক শক্তি, ধৈর্য এবং আশা দেন। আর এই নিঃশব্দ ভালোবাসা অনেক সময় চোখে পড়ে না। বাবা ও সন্তানের মধ্যে থাকে একটি অদৃশ্য, অজানা বন্ধন থাকে, যা কথায় প্রকাশ হয় না। এটি গড়ে ওঠে একসঙ্গে কাটানো মুহূর্ত, সংগ্রাম ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার ওপর। আমরা এই বন্ধন হৃদয়ে বহন করি। একটি নিঃশব্দ সূত্র যা অতীত থেকে বর্তমান, বাবা থেকে সন্তান, হৃদয় থেকে হৃদয়ে যুক্ত করে। আমরা বড় হওয়ার পরেও এই সংযোগ মুছে যায় না। যার ফলে আমরা তার অভ্যাসগুলো অনুকরণ করি, তার কথা পুনরাবৃত্তি করি এবং তার পরামর্শ চাই। এমনকি তিনি যখন পরলোকগত হন হতাশার সময়ে তার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে তার কাছে পরামর্শ চাই। বাবাদের ভালোবাসা প্রকাশ পায় নির্ভরযোগ্য উপস্থিতি, স্থায়িত্ব ও নীরব উৎসাহের মাধ্যমে। আর এই ভালোবাসা আমাদের ধৈর্য, সম্মান ও করুণা শেখায়, কথার মাধ্যমে নয়, কাজের মাধ্যমে। আর এই জন্য মানুষটি কথা কম কিন্তু তার সন্তানের হাত ধরে রাখে আর নীরব বার্তা দেয় ‘তুমি এখানে নিরাপদ আছো।’ শৈশবে বাবারা যেমন নীরব রক্ষক এর ন্যায় দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখতেন আর বলতেন ‘আমি আছি, তুমি নিরাপদ’ সেই সুরক্ষা ও বিশ্বাসের জাল আমাদের জীবনের ঝড় থেকে বাঁচায়।  কিন্তু বর্তমান সমাজে মায়েদের সম্মান ও ভূমিকার গুরুত্ব বাবাদের চেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। পরিবারে অর্থনৈতিক ও নৈতিক স্তম্ভ হওয়া সত্ত্বেও অনেক সময় তাদের অবদানকে তুচ্ছ করে দেখা হয়। বাবারা সারা জীবন পরিশ্রম করে সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়ে তুললেও, সেই ত্যাগ ও ভালোবাসা খুব কমই ভাষায় প্রকাশ পায়। অনেক সন্তান মায়ের যত্ন ও স্নেহকে কেন্দ্র করে আবেগ প্রকাশ করলেও, বাবার নিঃশব্দ আত্মত্যাগকে ‘দায়িত্ব’ বলে মনে করে, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না। বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে অনেক বাবাই একাকিত্ব, মানসিক চাপ ও অবহেলার মধ্যে পড়ে যান। তারা কথা বলা ও শোনার মানুষ পান না, ভালোবাসার ভাষা পান না। এমনকি অনেক সময় সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের মতামতকেও গুরুত্ব দেওয়া হয় না। সমাজে পিতৃত্বের প্রতি এই অবহেলা কেবল ব্যক্তিগত পর্যায়ে কষ্টের জন্ম দেয় না, বরং বৃহৎ পরিসরে একটি অসন্তুষ্ট প্রজন্ম তৈরি করে। যেখানে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতার ভারসাম্য হারিয়ে যেতে বসেছে। তাই বাবা দিবসে আমরা বাবার নীরব ভালোবাসা এবং আমাদের অজানা বন্ধন স্মরণ করি। সেই মানুষটিকে সম্মান জানাই, যিনি কথা কম বলেও আমাদের হাত ধরে রেখেছিলেন। তাকে কেবল তার কাজের জন্য নয়, তার অস্তিত্বের জন্য সম্মান দেই। চলুন প্রতিজ্ঞা করি বাবাদের নীরব শক্তিকে ভুলে যাব না। তাদের আত্মত্যাগ, নীরব নির্দেশনা এবং অসীম ভালোবাসার জন্য কৃতজ্ঞ থাকব। কারণ প্রতিটি সফল সন্তানের পেছনে থাকে এমন একজন বাবা, যিনি নীরব ভালোবাসায় গড়েছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ ভালোবাসা। ভবিষ্যতের পিতাদের জন্য এটি মনে রাখা জরুরি যে, বাবা হওয়া শুধু একটি সম্পর্ক নয়, এটি একটি দায়িত্ব ও মূল্যবোধ। বাবা হওয়া সহজ নয়। এটি ধৈর্য, আত্মত্যাগ, ভালোবাসা ও নির্বিচারে পাশে থাকার এক দীর্ঘ যাত্রা। একজন বাবাকে শুধু উপার্জনকারী নয়, সন্তানের জীবনে আদর্শ চরিত্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, যিনি নৈতিকতা শেখান, আবেগ বোঝেন এবং সন্তানের প্রতিটি সাফল্য ও ব্যর্থতায় ছায়ার মতো পাশে থাকেন। ভবিষ্যতের পিতারা যদি তাদের সন্তানদের সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চান, তবে তাদের আগে নিজেকে গড়তে হবে- সহানুভূতিশীল, মনোযোগী এবং ইতিবাচক চিন্তাধারার একজন মানুষ হিসেবে। নতুন প্রজন্মের পিতৃত্ব আর কেবল কর্তৃত্বের নয়, এটি হবে সহানুভূতির, বোঝাপড়ার এবং সত্যিকারের ভালোবাসার এক নতুন অধ্যায়। নতুন প্রজন্মের বাবাদের জন্য পিতৃত্ব একটা ‘রোল মডেল’ হওয়ার সুযোগ। নতুন বাবাদের উচিত পুরানো ধারণা ভেঙে সন্তানদের সঙ্গে খোলামেলা সম্পর্ক গড়ে তোলা, তাদের অনুভব করা এবং শেখানো, কীভাবে একজন ভালো মানুষ হওয়া যায়। সন্তানকে শুধু পথ দেখান না, বরং সেই পথ একসঙ্গে হেঁটে পাশে থাকাই হোক নতুন বাবাদের অঙ্গীকার। 

সিএফসি গ্যাসে মহাবিপর্যয়ে জলবায়ু

সিএফসি গ্যাসে মহাবিপর্যয়ে জলবায়ু

শিল্পোন্নত দেশগুলোর খামখেয়ালিপনার কারণে সিএফসি গ্যাস, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইড গ্যাসের নির্গমন বেড়ে গেছে। গ্যাস নিঃসরণের কারণে পৃথিবীর ফিল্টার নামে খ্যাত ওজোনস্তর ক্রমশ পাতলা হয়ে ভূপৃষ্ঠ তপ্ত হচ্ছে। তাতে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধি পাচ্ছে বছর বছর। গ্রীষ্মে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে যেমন, তেমনি শীতে তাপমাত্রা মাইনাসের কাছাকাছি চলে যাচ্ছে কোথাও কোথাও। শীতপ্রধান দেশগুলোর কথা ভিন্ন। তবে শীতপ্রধান দেশ মাইনাসের কারণে নয়, তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যার প্রভাবে হিমবাহের চাঁই গলে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে যেমন, তেমনি সমুদ্রের জলের উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়ে জলস্ফীতি হয়ে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে ২০১৬ সালে এন্টার্কটিকার ৯৬৫ বর্গ কিলোমিটারের হিমবাহের চাঁইয়ে চিড় ধরতে দেখেছেন গবেষকরা। ২০২০ সালের এক রিপোর্টে জানা যায়, এক বছরে প্রায় ৫৩২ বিলিয়ন টন বরফ গলেছে গ্রীনল্যান্ড থেকে। ২০১৯ সালে গ্রীনল্যান্ডে তিন কিলোমিটারের বরফের চাঁই ভেঙ্গে পড়েছে। তাতে স্বাভাবিকের চেয়ে ৪০ শতাংশ জল বৃদ্ধি পেয়েছিল। বরফের চাঁই গলতে শুরু করায় সেখানকার পরিস্থিতি ভয়াবহতার দিকে মোড় নিয়েছে। সমুদ্রে প্রতি সেকেন্ডে ৬টি অলিম্পিক সুইমিং পুলের সমপরিমাণ জল পড়ছে। তাতে দেখা গেছে প্রতিদিন প্রায় ৩০ লাখ টন জলের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্রীনল্যান্ডের বরফের চাঁই গলার পরিমাণ পর্যবেক্ষণ করে ব্রিটেনের ‘ইউনিভার্সিটি অব লিনকন’ এক গবেষণায় জানিয়েছে, ‘গ্রীনল্যান্ডের বরফ গলার কারণেই ২১০০ সাল নাগাদ বিশ্বের সমুদ্রস্তরের উচ্চতা ১০-১২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পাবে।’ অন্যদিকে ‘নেচার ম্যাগাজিন’-এ প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা গেছে, আর্কটিক মহাসাগরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বরফ যুগেও দেখা গিয়েছিল। উল্লেখ্য, সমুদ্র জলের তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিগত ৪০-১০০ বছরের মধ্যে দেখা গেছে গ্রীনল্যান্ডের তাপমাত্রা ১০-১২ ডিগ্রি বৃদ্ধি পেয়েছে। আরেকটি দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুতেই উত্তর মেরুর পূর্বাঞ্চলের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়েছিল। সেখানকার তাপমাত্রা তখন ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উঠেছিল। অন্যদিকে অন্যান্য বছরের তুলনায় ২০২৪ সালের জুন মাসে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ১.৬৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। যাতে করে বরফ গলার পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। জর্জিয়া ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এভাবে বরফগলা অব্যাহত থাকলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। ফলে বিশ্বের নিম্নাঞ্চলগুলো প্লাবিত হবে ব্যাপকভাবে। সেই তালিকার মধ্যে রয়েছে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের নামও। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং শৈত্যপ্রবাহের ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিনই কোনো না কোনো ধরনের দুর্যোগ সংঘটিত হচ্ছে। সেটি হতে পারে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, খরা, বন্যা, সাইক্লোন, টর্নেডো, ভূমিকম্প ও নদীভাঙনসহ নানান দুর্যোগ। তার মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধিই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলছে পৃথিবীকে। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন, লবণাক্ততার কারণে। যার প্রমাণ আমরা বার কয়েক পেয়েছিও। সিডর, আইলা, বুলবুল, আমফান ও ইয়াসের তাণ্ডবলীলায় মারাত্মক দুর্যোগের শিকার হয়েছিল বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ।  এসব প্রাকৃতিক তাণ্ডব ঘটছে শুধু বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলেই। যার মূল কারণই হচ্ছে গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণ। গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণের জন্য বিজ্ঞানীরা মানুষকেই দায়ী করেছেন। যার জন্যই মূলত বৈশ্বিক উষ্ণায়ন অব্যাহত রয়েছে আর পরিবর্তন ঘটছে জলবায়ুর। ২০২৪ সাল  তার প্রমাণও আমরা পেয়েছি। ১৮ মে, ২৪ সালে রাজশাহীতে ৪৫.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ওঠার খবরও জেনেছিলাম। অবশ্য ২০২৫-এর তাপমাত্রা সেই রেকর্ড এখনো ভাঙ্গেনি। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বন্যা, খরা, তাপপ্রবাহ এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, এই সমস্ত প্রাকৃতিক বিপর্যয় মানবজীবনে ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। অথচ এসব সংকট মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলোর কার্যকর উদ্যোগ এখনো দৃশ্যমান নয়। গবেষণায় জানা গেছে, বর্তমানে বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ঘনত্ব প্রান্তিসীমা ৩৫০ পিপিএম ছাড়িয়ে অত্যন্ত বিপজ্জনক ৩৯৮.৫৮ পিপিএম ঘনমাত্রায় পৌঁছে গেছে, যা পৃথিবীর অস্তিত্বের প্রতি মারাত্মক হুমকিই বলা যায়। গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশের কারণে মানুষকে বাস্তুচ্যুত হতে হচ্ছে।  জানা গেছে, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ইতোমধ্যেই লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়ে মানুষের জীবন ও জীবিকায় মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলেছে। যার কারণে বাধ্য হয়ে বাস্তুহারা হতে হচ্ছে বিশাল জনগোষ্ঠীকে। জানা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইতোমধ্যে প্রায় ৬০ লাখ বাংলাদেশি বাস্তুহারা হয়েছেন, আর তাদের অধিকাংশই এখন শহরমুখী হচ্ছেন। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের অভিমত আর মাত্র ৪৫ সেন্টিমিটার সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলেই উপকূলীয় অঞ্চলের ১০ শতাংশ ভূমি জলে তলিয়ে যাবে। তবে এই অভিমত অপ্রতিষ্ঠিত হিসেবে ধরে নিচ্ছেন অন্য গবেষকদল। কারণ ইতোমধ্যে জানা গেছে, ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে এমন জায়গাগুলোতে ভারসাম্য বজায় থাকবে সমুদ্রে উচ্চমাত্রার পলির আগমনে। ইতোমধ্যে তার কিছুটা প্রমাণও মিলেছে। যেমন- হাতিয়া অঞ্চলসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বিশাল আয়তনের চর জেগেছে। অন্যদিকে ২০০৫ সালে ‘আইপিসিসি’ জানিয়েছে যে, ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ২১ শতাংশ লবণাক্ত জলে সয়লাব হয়ে যাবে। নানা ধরনের তর্ক বিতর্কের ফলে সর্বশেষ যা আমরা অবগত হয়েছি তা হচ্ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ মহাদুর্যোগের মুখোমুখি হবে, যা অবধারিত সত্যকথা। আর এ মহাদুর্যোগের জন্য দায়ী হচ্ছে শুধু শিল্পোন্নত দেশের খামখেয়ালিপনা। শিল্পোন্নত দেশগুলো গ্রীনহাউস গ্যাস অধিকহারে নিঃসরণ করে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বাড়িয়ে হিমবাহর চাঁই গলতে ত্বরান্বিত করছে। ফলে বাংলদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার আরও কিছু দেশ বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে বাংলাদেশ। সেই বিপর্যয় থেকে আদৌ উত্তরণ মিলবে কী না তা নিয়ে সংশয় কাটছে না আমাদের। যদি বিশ্ববিবেক জাগ্রত হয় তবে আমরা এই মহাদুর্যোগ থেকে উত্তরণ পাব হয়তোবা।  লেখক : পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক লেখক

ভূমি মালিকানায় প্রতারণা এড়াতে করণীয়

ভূমি মালিকানায় প্রতারণা এড়াতে করণীয়

বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় ভূমি মালিকানা একটি সংবেদনশীল, জটিল ও বহুমাত্রিক বিষয়। আমাদের দেশের মানুষের সঙ্গে ভূমির সম্পর্ক এক ধরনের আবেগ, নিরাপত্তা এবং উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ঐতিহ্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফলে ভূমি ক্রয়-বিক্রয় কিংবা মালিকানা প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াটি শুধু একটি সাধারণ লেনদেন নয়; এটি হয়ে দাঁড়ায় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোর একটি। তবে দুঃখজনকভাবে, এই ক্ষেত্রটিই সবচেয়ে বেশি প্রতারণা, জালিয়াতি ও দীর্ঘমেয়াদি মামলার আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ প্রতিদিনকার বাস্তবতা। জাল দলিল তৈরি, ভুয়া ওয়ারিশ সাজানো, মৃত ব্যক্তির নাম ব্যবহার করে দলিল রেজিস্ট্রি, একাধিকবার বিক্রি, দলিল ও খতিয়ানে অমিল, ভূসম্পত্তি দখল, এমনকি একই জমি একাধিক ব্যক্তিকে বিক্রির মতো প্রতারণার ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব সমস্যার শিকার হন সাধারণ মানুষ, যঁরা প্রয়োজনীয় আইনগত জ্ঞান কিংবা সতর্কতা অবলম্বন না করে কেবল বিশ্বাসের ভিত্তিতে জমি ক্রয় করে থাকেন। এ অবস্থায় ভূমি ক্রয়ের পূর্বে সঠিক তথ্য যাচাই, প্রামাণ্য দলিল পর্যালোচনা, আইনি পরামর্শ গ্রহণ এবং নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে অনুসন্ধান করা একান্ত প্রয়োজন। একজন সচেতন ক্রেতা হিসেবে দায়িত্বশীল আচরণই আপনাকে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা, অর্থনৈতিক ক্ষতি ও দীর্ঘমেয়াদি আইনি জটিলতা থেকে রক্ষা করতে পারে। এই প্রবন্ধে আমরা ভূমি মালিকানা সম্পর্কিত প্রতারণার সাধারণ কৌশলসমূহ, আইনি প্রতিকার এবং সচেতনতা অবলম্বনের করণীয় বিষয়ে বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা উপস্থাপন করব। আশা করি, বিষয়গুলোর প্রতি সুস্পষ্ট ধারণা ও সতর্কতা একজন সম্ভাব্য জমি ক্রেতাকে একটি নিরাপদ ও বৈধ মালিকানার পথে এগিয়ে যেতে সহায়তা করবে। বাংলাদেশে ভূমি ক্রয় একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং জটিল প্রক্রিয়া। অনেক সময় সামান্য অসতর্কতা কিংবা প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাই না করার কারণে একজন ক্রেতা পড়তে পারেন বছরের পর বছর ধরে চলা মামলা, প্রতারণা কিংবা মালিকানা জটিলতার মধ্যে। ভূমি হচ্ছে একাধারে অর্থনৈতিক বিনিয়োগ এবং সামাজিক নিরাপত্তার প্রতীক। তাই জমি কেনার পূর্বে, সময়ে এবং পরে কিছু গুরুত্বপূর্ণ করণীয় অনুসরণ করলে প্রতারণার ফাঁদে পড়ার ঝুঁকি অনেকাংশেই কমে আসে। ভূমি ক্রয়ের প্রাথমিক ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো মালিকানা যাচাই। যিনি নিজেকে জমির মালিক দাবি করছেন, তিনি আসলেই বৈধ মালিক কি না-তা নিশ্চিত করাটা বাধ্যতামূলক। যদি বিক্রেতা জমির মালিক হন ক্রয়সূত্রে, তাহলে অবশ্যই তার দলিল, হাল ও পুরানো খতিয়ান, মৌজা ও প্লট নকশা এবং খারিজ রেকর্ড মিলিয়ে দেখা জরুরি। যদি তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে মালিক হন, তাহলে সংশ্লিষ্ট ওয়ারিশ সনদ, বাটোয়ারা দলিল এবং সম্পত্তিতে তার সুনির্দিষ্ট অংশের তথ্য যাচাই করতে হবে। জমিতে অন্য কেউ বর্গাদার হিসেবে বসবাস করছেন কি না, জমি বন্ধক দেওয়া আছে কি না, বা জমিটি পূর্বে অন্য কাউকে বিক্রি করা হয়েছে কি না-এসব তথ্য জানাও গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় জমির দাগ ও পরিমাণ দলিলের সঙ্গে মিল থাকে না; ফলে সরেজমিন পরিদর্শন করে জমির প্রকৃত অবস্থা, দখল কার হাতে আছে, প্রতিবেশীদের বক্তব্য কী-এসব বিষয় জেনে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। প্রয়োজনে সহকারী কমিশনার (ভূমি), তহসিল অফিস এবং সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে গিয়ে সংশ্লিষ্ট রেকর্ড যাচাই করে নেওয়া উচিত। দলিলে কোনো ধরনের উকিল নোটিস বা চলমান মামলা আছে কি না-তা কোর্ট বা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হতে হবে। ভূমি কেনার সময় কিছু প্রক্রিয়াগত ও আইনগত পদক্ষেপ অনুসরণ করলে ভবিষ্যতে জটিলতা এড়ানো সম্ভব হয়। দলিলের স্ট্যাম্প অবশ্যই ক্রেতার নামে ক্রয় করতে হবে এবং দলিল রেজিস্ট্রির সময় উভয় পক্ষের ছবি, স্বাক্ষর ও টিপসই যথাযথভাবে নিশ্চিত করতে হবে। দলিল রেজিস্ট্রির রসিদ সংরক্ষণ করা এবং বিক্রেতার ২৫ বছরের মালিকানা ইতিহাস যাচাই করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতামূলক পদক্ষেপ। দলিলের সঙ্গে বিক্রেতার নামজারি কপি, আরএস পর্চা (সর্বশেষ রেকর্ড) এবং হাল খাজনার রশিদ সংযুক্ত রাখা ভবিষ্যতের বিরোধ ও দাবি-দাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। এ সময় একজন অভিজ্ঞ আইনজ্ঞ বা জমি সংক্রান্ত অভিজ্ঞ আইনজীবীর পরামর্শ গ্রহণ করলে পুরো লেনদেন প্রক্রিয়াটি আরও সুরক্ষিত হয়। দলিল রেজিস্ট্রির পরপরই জমির দখল গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দখলহীন জমি ভবিষ্যতে নানা সমস্যার উৎস হতে পারে। রেজিস্ট্রিকৃত দলিল হাতে পাওয়ার পর যথাশীঘ্রই সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিসে গিয়ে নিজের নামে নামজারি সম্পন্ন করতে হবে। নামজারি ছাড়াই শুধু দলিলের ভিত্তিতে সম্পূর্ণ মালিকানা প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। নামজারির পর থেকে খাজনা নিয়মিতভাবে পরিশোধ করা উচিত এবং খাজনার রসিদ, মূল দলিল ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র আলাদা ফাইলে সংরক্ষণ করা উচিত, যাতে ভবিষ্যতে প্রমাণ হিসেবে সহজেই উপস্থাপন করা যায়। ভূমি ক্রয় কখনোই শুধু আর্থিক লেনদেনের বিষয় নয়-এটি ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, পারিবারিক ভবিষ্যৎ এবং দীর্ঘমেয়াদি সম্পত্তির মালিকানা সুরক্ষার সঙ্গে জড়িত। একটি ভুল সিদ্ধান্ত বা অবহেলার কারণে একজন মানুষকে বছরের পর বছর ধরে মামলা-মোকদ্দমার ঘানি টানতে হতে পারে। আমাদের দেশে ভূমি নিয়ে প্রতারণা, জাল দলিল, ওয়ারিশ বিভ্রান্তি, দখলবাজি এবং অবৈধ দখল অত্যন্ত সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বাস্তবতায় ভূমি ক্রয়ের প্রতিটি ধাপে জ্ঞান, সতর্কতা এবং আইনগত সহায়তা অত্যাবশ্যক। যাদের ভূমি সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা নেই, তারা প্রায়ই প্রয়োজনীয় নথিপত্র যাচাই না করে বা দলিলের ভাষা বুঝে ওঠার আগেই লেনদেন চূড়ান্ত করে ফেলেন। এতে করে প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা বহুগুণ বেড়ে যায়। তাই একজন অভিজ্ঞ আইনজীবী, ভূমি পরামর্শক বা জমি বিশেষজ্ঞের সহায়তা গ্রহণ করা হবে বুদ্ধিমানের পরিচায়ক। অনেক সময় ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বা পরিচিতজনের কথায় ভরসা করে দলিল যাচাই না করেই জমি কেনা হয়, যা ভবিষ্যতে মারাত্মক জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। ভূমি ক্রয়ের ক্ষেত্রে সর্বদা মনে রাখতে হবে, একটি সহজ কিন্তু কার্যকর নীতি- ‘সতর্কতা, যাচাই ও বিবেচনা’। এই তিনটি পদক্ষেপকে আমরা বলতে পারি ভূমি লেনদেনের ‘স্বর্ণসূত্র’ (এড়ষফবহ জঁষব)। ১. সতর্কতা রাখুন প্রতিটি কাগজপত্র, দখল ও রেকর্ড বিষয়ে। ২. যাচাই করুন জমির মালিকানা, রেকর্ড, মামলা ও খাজনার তথ্য নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে। ৩. বিবেচনা করুন ভবিষ্যতের প্রয়োজন, পারিবারিক চাহিদা এবং জমির অবস্থানগত গুরুত্ব। একটি জমি যদি শতভাগ বৈধভাবে এবং আইনগত সুরক্ষা নিশ্চিত করে কেনা যায়, তবে সেটি কেবল একটি সম্পত্তি নয়, বরং এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের বিরুদ্ধে একটি সুরক্ষা বলয় তৈরি করে। আপনার সামান্য সতর্কতা আপনাকে ভবিষ্যতের অনাকাক্সিক্ষত বিরোধ, প্রতারণা ও হয়রানি থেকে মুক্ত রাখতে পারে। কাজেই, ভূমি ক্রয়ের প্রতিটি পদক্ষেপ হোক সচেতন, আইনি সহায়তাপুষ্ট এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাইনির্ভর। তাহলেই নিশ্চিত হবে একটি সুরক্ষিত, স্বচ্ছ ও শান্তিপূর্ণ ভূমি মালিকানা। লেখক : আইনজীবী ও গবেষক

সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ

সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ

দেশে এমন অনেক শিশু রয়েছে যাদের নেই কোনো জন্মপরিচয়, নেই কোনো অভিভাবক। এরা পথশিশু নামে পরিচিত। তারা চরম দারিদ্র্যের কশাঘাতে এরা অত্যন্ত বিপন্ন জীবনযাপন করে। এসব শিশু সামাজিকীকরণের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠার সুযোগ পায় না। যত্নের অভাবে এসব শিশু দেশের জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে ওঠে। কিন্তু সঠিক সুযোগ-সুবিধা পেলে এরাই দেশের কল্যাণ বয়ে আনবে।  জন্মের পর থেকেই সুবিধাবঞ্চিত এসব শিশু হয় ছন্নছাড়া প্রকৃতির। প্রচণ্ড অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করার ফলে এদের অধিকাংশই থাকে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। নোংরা খাবার খাওয়ার ফলে এরা সাধারণত নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। বেশিরভাগ শিশুরা ভোগে অপুষ্টিতে। অযত্নে, অবহেলায় অনেক শিশু চিকিৎসার অভাবে মারা যায়। সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক এনহান্সমেন্ট প্রোগ্রাম নামের একটি সংস্থার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পথশিশুদের প্রায় ৪১ শতাংশ শিশুর ঘুমানোর কোনো বিছানা নেই, ৪০ শতাংশ শিশু গোসল করতে পারে না, ৩৫ শতাংশ খোলা জায়গায় মলত্যাগ করে, ৫৪ শতাংশ অসুস্থ হলে দেখার কেউ নেই এবং ৭৫ শতাংশ শিশু অসুস্থ হলে ডাক্তারের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করতে পারে না। অবহেলিত এসব শিশুর লেখাপড়ার কোনো সুযোগ নেই বললেই চলে। পারিবারিক ও নৈতিক শিক্ষারও কোন সংস্পর্শ পায় না এরা। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৯৫ দশমিক ৫ শতাংশ পথশিশু প্রাতিষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক কোনো ধরনের শিক্ষাগ্রহণ করছে না। জন্মের পর থেকে এরা শেখে ভিক্ষাবৃত্তি, চুরি, ছিনতাই, মাদক কারবারি ইত্যাদি। এছাড়া পরবর্তীতে অনেকে ডাকাতি, খুন প্রভৃতি বড় ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। কিশোর অপরাধের মূল হোতা এসব পথশিশুই। এছাড়া অনেক কুচক্রী মহল এদেরকে নানা অপরাধমূলক কাজে লাগায়। এদের মধ্যে অনেকে আবার ভয়ানকভাবে শিশুশ্রমের শিকার হয়ে পড়ে। অনেক শিশু হয় অমানুষিক নির্যাতনের শিকার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পথশিশুদের জরিপ ২০২২ -এর তথ্য মতে, নির্যাতনের শিকার পথশিশুর হার প্রায় ৯৬ শতাংশ। তাদের মধ্যে প্রায় ৬১ দশমিক ৭ শতাংশ পথশিশু শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয় বা মার খায় এবং প্রায় ৪৪ দশমিক ৮ শতাংশ শিশু মৌখিক হুমকি পায়।  জনবহুল এই দেশে এমনিতেই বেকারত্বের হার উপচে পড়া। তার উপর ক্ষতিকর নাগরিক তৈরি হলে এ দেশকে কোনোভাবেই উন্নত করা সম্ভব হবে না। কথায় আছে, আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাই দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে দেশের প্রতিটি শিশুকেই অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে। সঠিক যত্ন পেলে সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা একসময় জনসম্পদে পরিণত হবে এবং দেশের উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। সংবিধানের ২৮(৪) অনুচ্ছেদে শিশুদের অগ্রগতির বিশেষ বিধানের উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে শিশুদের জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা সহ মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা, সুযোগের সমতা, অধিকার-কর্তব্য, স্বাস্থ্য এবং নৈতিকতার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। শিশু মানবাধিকারের সর্বজনীন দলিল হচ্ছে ‘জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ-১৯৮৯’। বাংলাদেশ এ সনদে সই করে ১৯৯০ সালের ২৬ জানুয়ারিতে। এ সনদের ৫৪ টি ধারার মধ্যে ২৪ টি ধারা সরাসরি শিশু সুরক্ষা সংশ্লিষ্ট। এ সনদের মূলনীতিসমূহ হলো- ১. পূর্ণ মাত্রায় বেঁচে থাকার অধিকার, ২. পূর্ণ মাত্রায় বিকাশের অধিকার, ৩. নির্যাতন ও শোষণ হতে নিরাপদ থাকার অধিকার, ৪. সামাজিক জীবনে পূর্ণ মাত্রায় অংশগ্রহণের অধিকার। বাংলাদেশের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে জাতিসংঘের উদ্যোগ শুরু হয় ১৯৯৯ সালে। তবে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারকে জাতিসংঘ ও বহিঃরাষ্ট্রের সহায়তায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন উদ্যোগে কাজ শুরু করতে হবে। এসব শিশুর সমস্যা নিরসনের জন্য স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন। অবহেলিত এসব শিশুর স্বাভাবিক জীবন গঠনের পথ তৈরি করা অতটা সহজ নয়। তবে পরিকল্পনামাফিক ব্যবস্থা নিলে দ্রুত এবং কার্যকরভাবে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। এজন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দেশব্যাপী জেলাভিত্তিক সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য আলাদাভাবে প্রতিষ্ঠান নির্মাণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ কাজে দেশ ও বিদেশের সহযোগী সংস্থা এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সহায়তাও প্রয়োজন হবে। সর্বোপরি, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ ও তাদের প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে এবং এসব শিশুর উন্নয়নের লক্ষ্যে দেশের সচেতন মহলের অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখতে হবে।  সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা মেধা ও মননের দিক থেকে দেশের অন্যান্য স্বাভাবিক শিশুদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়, শুধু সঠিক পরিবেশ ও চর্চার অভাবে তারা পিছিয়ে আছে। অবহেলিত শিশুদের জন্য স্থায়ী সুযোগ-সুবিধা তৈরি হলে ভবিষ্যতে এসব শিশুই হবে দেশের দক্ষ নাগরিক। যার ফলে দেশ একদিকে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচবে, অন্যদিকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে।

ছোট ও নিরুত্তাপ বাজেট

ছোট ও নিরুত্তাপ বাজেট

বৈষম্যহীন ও টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ার প্রত্যয় নিয়ে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য নয়া বাজেট পেশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। এটি তার এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট। এর আগে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাজেটের আকার দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে মোট বাজেটের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। ১৫ বছর পর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা ৬২১ দশমিক ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকায়। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের বাজেটের তুলনায় তা ৭ হাজার কোটি টাকা বা শূন্য দশমিক ৮৮ শতাংশ কম। আর সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৪৬ হাজার কোটি বা ৬ দশমিক ১৮ শতাংশ বেশি।। এ বাজেটের আকার হচ্ছে জিডিপির ১২ দশমিক ৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ছিল জিডিপির ১৪.২০ শতাংশ। স্বাধীনতার পর দেশের প্রথম বাজেটের পরিমাণ ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত নয়া বাজেট ওই বাজেট থেকে ১০০৫ গুণ বেশি। এবারের বাজেটে আনুষ্ঠানিকতা কম। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই বললেই চলে। পক্ষে-বিপক্ষে কোনো মিছিল, সেøাগান নেই। বলা যায়, এটি উত্তাপহীন বাজেট। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাজেট দ্রুত সম্প্রসারিত হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হয়েছে বাজেট বাস্তবায়নে। এর প্রধান কারণ, কাক্সিক্ষত মাত্রায় রাজস্ব আহরণে ঝুঁকি। এবারের বাজেট অনেকটা সংকোচনমূলক। এতে কৃচ্ছ্রসাধনের চেষ্টা করা হয়েছে। অন্যান্য বছর ১২-১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হয় বাজেটে। এবার তা ঋণাত্মক শূন্য দশমিক ৮৮ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির হার গড়ে প্রায় ১০ শতাংশ ধরে নিলে বাজেটের প্রবৃদ্ধি হবে আরও বেশি নেতিবাচক। দেশের উচ্চ মূল্যস্ফীতির কথা বিবেচনায় নিলে অযৌক্তিক ব্যয় কমানোর মাধ্যমে একটি আঁটসাঁট বাজেট প্রস্তাবই এবার কাক্সিক্ষত ছিল। বাজেট বাস্তবায়নের গুণগত মান নিশ্চিত করা সম্ভব হলে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে বর্তমান চড়া মূল্যস্ফীতি অবদমনে প্রস্তাবিত বাজেট সহায়ক হবে।  প্রস্তাবিত বাজেটে মোট রাজস্ব প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআর উৎস থেকে আসবে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। এ লক্ষ্য অর্জন করতে হলে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি  হতে হবে এবারের সংশোধিত লক্ষ্য মাত্রার ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ এবং মূল লক্ষ্য মাত্রার ৩ দশমিক ৯৬ শতাংশ বেশি। সাম্প্রতিক আর্থিক সংকট, নিম্ন জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে এ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা খুব কঠিন হবে। কর ও ভ্যাটের আওতা ও হার বৃদ্ধি এবং করছাড়ের মাত্রা হ্রাসের কারণে মানুষের ওপর আর্থিক চাপ বাড়বে। তবে এ চাপ জনগণকে সইতে হবে। বর্তমানে আমাদের কর-জিডিপি অনুপাত ৭ শতাংশের মতো। এটি এশিয়ার সর্বনিম্ন। ক্রমাগত বাজেট ঘাটতি হ্রাস এবং দেশি ও বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরতা কমানোর জন্য কর-জিডিপির অনুপাত বাড়িয়ে ন্যূনপক্ষে ২০ শতাংশে উন্নীত করা দরকার। প্রস্তাবিত বাজেটে কর-জিডিপির অনুপাত হবে ৯ শতাংশ। নয়া বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ কোটি ২৬ লাখ টাকা, যা জিডিপির ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। অন্যান্য বছরের তুলনায় তা কম। এ ধারা অব্যহত থাকলে বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরতা হ্রাস পাবে এবং স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ার লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে। গত বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। পরে তা নামিয়ে দেওয়া হয় ৬ দশমিক ৫ শতাংশে। সংশোধিত বাজেটে আরও নামিয়ে করা হয় ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। প্রাথমিক হিসাবে অর্জনের পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রাক্কলন হলো ৩ দশমিক ৩ থেকে ৩ দশমিক ৯ শতাংশ। আগামী বছরের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। তবে আগামী বাজেট বাস্তবায়নের হার ও গুণগত মান সন্তোষজনক না হলে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য মাত্রা অর্জন সম্ভব নাও হতে পারে। প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। বাস্তবে এটা হয়তো আরও বেশি হবে। বর্তমানে গড় মূল্যস্ফীতির হার প্রায় ১০ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে। গত মে মাসে ছিল ৯ দশমিক ৫ শতাংশ, এপ্রিলে ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ। জুন শেষে এ হার ৮ শতাংশে নেমে আসবে বলে ধারণা করছে সরকার। গত মে মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ, এপ্রিলে যা ছিল ৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ। সম্প্রতি দেশে কৃষির উৎপাদন বিশেষ করে বোরো ধানের উৎপাদন ভাল হওয়ায় আগামী দিনগুলোতে মূল্যস্ফীতির হার নমনীয় থাকবে বলে আশা করা যায়। প্রস্তাবিত বাজেটে মোট উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৩১ শতাংশ। পরিচালন বা অনুন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৯৮ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৬৯ শতাংশ। এটি ভারসাম্যপূর্ণ নয়। এবার পরিচালন ব্যয় বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা খাতে বেশি বরাদ্দ রাখা। উদ্দেশ্য বিশেষ প্রণোদনা প্রদান। বর্তমানে সচিবালয় ও এনবিআরের স্থাপনাগুলোতে যা ঘটছে, দেশবাসী তা প্রত্যক্ষ করছেন। তাদের সেবার মান সম্পর্কেও করদাতারা অবহিত আছেন। এমতাবস্থায় পুরনো কর্মচারীদের আর্থিক সুবিধা আর না বাড়িয়ে নতুন কর্মসংস্থানের উদ্যোগ গ্রহণ করাই যুক্তিপূর্ণ নয় কী? দেশের শতকরা ৯০ ভাগ বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য সরকারের কোন প্রণোদনা থাকবে কী? অনেকে মনে করেন, সরকারি কর্মচারীদের ৫-১০ শতাংশ হারে মহার্ঘ ভাতা কিংবা বিশেষ প্রণোদনা প্রদানের প্রস্তাব বৈষম্যমূলক এবং মূল্যস্ফীতির সহায়ক। প্রস্তাবিত কৃষি বাজেট গতানুগতিক। আগামী অর্থবছরে কৃষি বিষয়ক ৫টি মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪৫ হাজার ২০৮ কোটি টাকা। এ টাকা মোট বরাদ্দের ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ। এর মধ্যে শস্য কৃষি খাতের জন্য রাখা হয়েছে ২৭ হাজার ২২৪ কোটি টাকা। যা মোট বরাদ্দের ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। বাকি ২ দশমিক ৪১ শতাংশ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, বন ও পরিবেশ, ভূমি ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়গুলোর জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। এটা অপ্রতুল। দিনের পর দিন বাজেটে বৃহত্তর কৃষি খাতের হিস্যা হ্রাস পেয়েছে। ২০১১-১২ সালে বৃহত্তর কৃষি খাতের হিস্যা ছিল মোট বাজেটের ১০ দশমিক ৬৫ শতাংশ। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে তা নেমে এসেছে ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল ৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা ১ দশমিক ৭৯ শতাংশ নেমে এসেছে। উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতি হ্রাস ও এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে খাদ্য এবং পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য কৃষি খাতে ন্যূনপক্ষে মোট বাজেটের ১০ শতাংশ অর্থ নিয়োজিত করা উচিত। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ফসল খাতে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ২৪,৯৩৫ কোটি টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১৭,২৬১ কোটি টাকা। এবার নয়া বাজেটে কৃষি ভর্তুকির পরিমাণ ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ২৪১ কোটি টাকা। যা গত বছরের মূল বাজেট থেকে ২০ কোটি টাকা কম। এভাবে কৃষি ভর্তুকির ক্রম হ্রাস অনাকাক্সিক্ষত। তাতে বিঘ্নিত হবে কৃষির উৎপাদন। খাদ্যনিরাপত্তা ব্যাহত হবে। কৃষি খাতে কাক্সিক্ষত মাত্রায় উৎপাদন বাড়িয়ে যেতে হলে কৃষি ভর্তুকি খাতে মোট বাজেটের কমপক্ষে ৫ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ করা উচিত। কৃষিখাতে করমুক্ত আয় সীমা ৫ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। এটি খুবই যৌক্তিক মনে হয়েছে। কোল্ড স্টোরেজ স্থাপনে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আমদানিতে রেয়াতি শুল্ক সুবিধা প্রদান করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তাছাড়া স্থানীয়ভাবে কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদনকে উৎসাহিত করতে কম্বাইন্ড হারভেস্টার তৈরির যন্ত্রাংশ আমদানিতে বিদ্যমান শুল্কহার হ্রাসের কথা বলা হয়েছে। এগুলো কৃষি উন্নয়নে সহায়ক হবে। প্রস্তাবিত বাজেটে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। এ খাতে মোট বরাদ্দ ৮,৩২২ কোটি টাকা, বেড়েছে ১,৬৮৪ কোটি টাকা। বর্তমানে দেশে খাদ্য গুদামের ধারণক্ষমতা খুবই কম, ২১ দশমিক ৮৬ টন। নতুন অর্থবছরে তা ৩৭ লাখ টনে উন্নীত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। তাতে খাদ্যশস্যের বাজারে সরকারের নিয়ন্ত্রণ সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং পণ্যমূল্যে স্থিতিশীলতা আসবে। বর্তমানে দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ৫ কোটি টন। এর ন্যূনতম ১০ শতাংশ অর্থাৎ ৫০ লাখ টন খাদ্যশস্য সংরক্ষণের জন্য গুদামের ধারণক্ষমতা নিরন্তর বাড়িয়ে যাওয়া প্রয়োজন। বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে জোর দেওয়ার কথা বলা হলেও বরাদ্দ বেড়েছে স্বল্পই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগে এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৯৫ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা। এটি মোট বাজেটের ১২ দশমিক ১ শতাংশ। গত বাজেটের তুলনায় তা মাত্র শূন্য দশমিক ২৩ শতাংশ বেশি। এ বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৭২ শতাংশ। ইউনেস্কোর সুপারিশ মতে জিডিপির ৪-৬ শতাংশ এবং জাতীয় বাজেটের ১৫-২০ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন। স্বাস্থ্যসেবা খাতের দুটো বিভাগে মোট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪১ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা। এটি মোট বরাদ্দের ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। আগের বাজেটের তুলনায় তা ৫০০ কোটি টাকা বা শূন্য দশমিক ১ শতাংশ বেশি। স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের মতে, জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশ বা জিডিপির ৫ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ করা উচিত। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বেড়েছে মাত্র ১ হাজার ৮৭৫ কোটি টাকা। এটা যথেষ্ট নয়। প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা ও সমাজকল্যাণ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪৫ হাজার ৮৩ কোটি টাকা। গত সংশোধিত বাজেটে ছিল  ৪৩ হাজার ২০৮ কোটি টাকা। বরাদ্দ বৃদ্ধির হার ৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ। এ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে একত্রে, ৫টি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে (সমাজকল্যাণ, মহিলা ও শিশু, খাদ্য, দুর্যোগব্যবস্থাপনা ও মুক্তিযুদ্ধ)। এক্ষেত্রে বর্তমানে বয়স্ক ভাতা প্রতি মাসে দেওয়া হচ্ছে ৬০০ টাকা আর বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা নারী ভাতা ৫৫০ টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটে যথাক্রমে ৫০ ও ১০০ টাকা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। এ ভাতার পরিমাণ ন্যূনপক্ষে ১০০০ টাকা হওয়া উচিত। মোট উপকার ভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর যে প্রস্তাব করা হয়েছে তা অপ্রতুল। ইতোপূর্বে টিসিবির বাদ পড়া ৪৩ লাখ পরিবারের কার্ড কবে হবে তারও কোনো নিশ্চয়তা দেয়া হয়নি। এ বাজেটের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে সামাজিক বৈষম্য হ্রাস। তবে এ সম্পর্কে তেমন কর্মসূচির উল্লেখ নেই। আগামী অর্থবছর হতে প্র্রস্তাবিত বাজেটে ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। মহিলা ও ৬৫ বছরের বা তদূর্ধ্ব বয়সের করদাতাদের করমুক্ত আয় সীমা বেড়ে হবে ৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা। সর্বোচ্চ কর হার আগের মতো ৩০ শতাংশ রাখা হলেও কর ধাপ ৭টি থেকে কমিয়ে ৬টি করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে বেশি আয়ের করদাতাদের ওপর কর প্রদানের চাপ বেড়ে যাবে। তবে নতুন নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর আগামীতে এ বিষয়ে ভিন্ন ঘোষণাও আসতে পারে।  বাজেটের আকার ছোট। তবে অলীকতা বিবর্জিত ও বাস্তবসম্মত। এতে ব্যক্তির খেয়ালের চেয়ে অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মূল্যস্ফীতি হ্রাস ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন বাজেটের মূল লক্ষ্য। এটি বাস্তবায়নে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হলে ইস্পিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে। ত্বরান্বিত হবে সার্বিক উন্নয়ন।  লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত কৃষি অর্থনীতিবিদ, সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং সাবেক উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ