ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০২ জুলাই ২০২৫, ১৮ আষাঢ় ১৪৩২

মতামত

মতামত বিভাগের সব খবর

নিয়ত বিব্রত বিপন্ন

নিয়ত বিব্রত বিপন্ন

হাঁটা পথের ইংরেজি শব্দই হলো ফুটপাত। রাজধানী শহরে প্রথম ফুটপাতের সৃষ্টি এবং ব্যবহার শুরু হলেও বর্তমানে মহানগর এবং জেলা শহরগুলোতেও জনবহুল স্থানে সড়কের দুপাশে ফুটপাত রয়েছে। সড়কে চলে যানবাহন আর ফুটপাতে চলে পায়ে হাঁটা মানুষ। সড়কের দুপাশেই থাকে ফুটপাত। ফুটপাত প্রশস্ত নয়। সড়কের দুপাশের ফুটপাতের প্রশস্ততা যোগ করলে মূল সড়কের অর্ধেকের চেয়েও কম হবে। কিন্তু মূল সড়কের চেয়ে তার গুরুত্ব কম নয়। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে বেশি।  রাজধানীতে ফুটপাতে হকার ও বিভিন্ন ধরনের দোকানপাটে বিকিকিনি বহু আগে থেকেই সব সময়ই ছিল এবং আছে। কিন্তু মহানগর ও জেলা শহরগুলোতে এমনকি উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ জনবহুল স্থানগুলোতে ফুটপাত ও সড়কের পাশে কাঁচামালের দোকান/ভ্রাম্যমাণ ভ্যানে করে পণ্য বিক্রি শুরু হয় ২০২০ ও ২০২১ সালে কোভিড-১৯ করোনা মহামারির সময় থেকে। তখন করোনা মহামারির সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হাট-বাজার বন্ধ করে দেওয়া হয়। মানুষের ক্রয়-বিক্রয়ের চাহিদা পূরণের জন্য রাস্তার দু’ধারে এবং ফুটপাতে কাঁচাবাজার বসিয়ে দেয় যা এখনো চলছে। কিন্তু তা বর্তমানে চলতে পারে না বা চলা উচিত নয়। যাকে যে কাজের জন্য তৈরি করা হয়েছে তাকে সে কাজে ব্যবহার করা উচিত। ফুটপাত তৈরি করা হয়েছে পায়ে হাঁটা মানুষের নির্বিঘ্ন পথ চলার জন্য, যেন যানবাহন বা অন্য কিছু তাদের বিব্রত না করে। কিন্তু ফুটপাত দেখার কেউ যেন এদেশে নেই। আমি বয়স্ক মানুষ। হাঁটা আমার প্রতিদিনের থেরাপি। কিন্তু হাঁটতে হয় সড়কের ওপর দিয়ে। কারণ ফুটপাতে দোকানপাট বসছে, পণ্য কেনাকাটা হচ্ছে। ফুটপাত দিয়ে হাঁটার কোনো উপায় নেই। ফুটপাত হকার ও কাঁচামালের ভ্যান গাড়ির অবৈধ দখলে চলে যাচ্ছে। আমাদের রাস্তার দু’ধারের ফুটপাত অবৈধ দখলমুক্ত হয়ে আমাদের হাঁটার পথ সুগম হোক। মোক্তারপাড়া, নেত্রকোনা থেকে

বেহাল বেদখল

বেহাল বেদখল

পথচারী নিরাপদে চলার পথ ফুটপাত। বড় বড় ব্যস্ততম শহরগুলোতে ফুটপাত ব্যবস্থা রাখা হয় দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য। যাতে লোকজন রাস্তা ধরে না হেঁটে ফুটপাত দিয়ে নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে। ফুটপাত শুধু পথচারী চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করার কথা থাকলেও বাস্তবে দেখা যায় এর ভিন্ন চিত্র। ফুটপাত দখল করে পণ্যের পসরা সাজিয়ে অবৈধভাবে ব্যবসা করে যাচ্ছেন কতিপয় ব্যবসায়ী। উচ্ছেদ করে দিলেও আবার তারা ফুটপাত দখল করে ব্যবসাবাণিজ্য পরিচালনা করেন। অভিযোগ রয়েছে পুলিশ কিংবা দলীয় নেতা-কর্মীদের হাতে কিছু উপঢৌকন ধরিয়ে দিলে ফুটপাতে ব্যবসা তাদের জন্য সহজ ও নিরাপদ হয়ে যায়। আর এতে করে ভুক্তভোগি হয় সাধারণ জনগণ। ফুটপাত হয়ে পড়ে পথচারী চলাচলের অনুপযোগী। যার ফলস্বরূপ পথচারীদের পড়তে হয় নানাবিধ বিড়ম্বনায়। ফুটপাত ব্যবসায়ীদের দখলে থাকায় জনসাধারণকে ফুটপাত ব্যতিরেকে মূল রাস্তা দিয়ে হাঁটতে গিয়ে নানাবিধ দুর্ঘটনার কবলে পতিত হতে হয়। শুধু তাই নয় ফুটপাতে অবৈধ স্থাপনাও গড়ে তুলে কেউ কেউ। ফলে রাস্তার পরিধি ছোট হয়ে যায় সৃষ্টি হয় যানজট। ফুটপাত থেকে এ ব্যবসায়ীদের সকালে তুলে দিলে বিকালে আবার তারা পণ্যের পসারা সাজিয়ে বসে যান। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার ফুটপাতের স্থায়ী ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত, যারা স্থানীয় প্রভাবশালী মহলকে দৈনিক অথবা মাসিক চাঁদা দেওয়ার মাধ্যমে ব্যবসা করে যাচ্ছেন দিনের পর দিন। আর যারা ফুটপাতের অস্থায়ী ব্যবসায়ী তাদেরকে সবসময় থাকতে হয় একটা দৌড়ানোর ওপর। আজ এক জায়গায় তো কাল আরেক জায়গায়। নিম্ন আয়ের এসকল মানুষ পেটের দায়ে ফুটপাতে ব্যবসা করে দিনশেষে চাল ডাল নিয়ে ঘরে ফিরে। তাদের প্রতি মানুষের একটা সহানুভূতি কাজ করে বিধায় ক্ষোভ প্রকাশ করলেও  ক্রোধান্বিত হওয়া যায় না। কারণ ফুটপাতে যারা ব্যবসা করেন তারা কোনো এলিট শ্রেণি নয়। এরা সমাজের খেটে-খাওয়া  লোকজন। এদের পুঁজি সামান্য। দোকান ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করার ক্ষমতা সামর্থ্য তাদের অনেকেরই নেই। তাই প্রশাসন কিংবা সরকারের উচিত তাদেরকে একটা নিদিষ্ট জায়গা বা এলাকা নির্ধারণ করে দেওয়া যাতে সেখানে তারা নির্বিঘ্নে ব্যবসা করতে পারেন। এতে  করে তারা নিজেরা যেমন  নিরাপদ থাকবে তেমনি জনসাসাধারণকেও দুর্ভোগ পোহাতে হবে না। 

অনিয়ম দুর্নীতি

অনিয়ম দুর্নীতি

ফুটপাত বলতে যা বোঝায় তা হলো, রাস্তার দুই পাশে পথচারীদের চলাচলের উপযোগী জায়গা বা আইল্যান্ড। এখান দিয়েই নিরাপদে নির্বিঘ্নে পথচারীরা চলাচল করেন। নগর-মহানগরের পাকা রাস্তাগুলোর দুপাশের আইল্যান্ড নির্মাণ করা হয় পথচারীর চলাচলের তাগিদেই। পথচারীর চলাচলের জায়গাগুলো বেদখল করে ব্যবসা করছে এক শ্রেণির হোমরাচোমরা ব্যবসায়ী। ফুটপাত দখল করে নানান পসরা সাজিয়ে ব্যবসা করছে হাজারো মানুষ। নগর-মহানগরে ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করে, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, স্থানীয় মাস্তান, স্থানীয় দলীয় ক্যাডার ও পুলিশ প্রশাসন। এছাড়াও যত্রতত্র গড়ে ওঠা দোকানদারদের ভালো-মন্দ দেখার জন্য সাইনবোর্ডসর্বস্ব ব্যবসায়ী সংগঠন নগর-মহানগরে বিদ্যমান। এ সকল সংগঠন ফুটপাত ব্যবসায়ীদের জায়গা বরাদ্দের ব্যবস্থাসহ চাঁদার হার নির্ধারণ করে থাকেন। ফুটপাত ব্যবসায়ীদের দৈনিক-সাপ্তাহিক-মাসিক ভিত্তিতে চাঁদার হার নির্ধারিত হয়। রাজনৈতিক নেতার চাঁদা তোলেন দলীয় কর্মী। মাস্তান-ক্যাডারের চাঁদা আদায় করেন উঠতি বয়সের মাস্তান অথবা ক্যাডার। পুলিশের চাঁদা তোলেন অলিখিত পদবিধারী ক্যাশিয়ার পদ-পদবিধারী ব্যক্তিরা। টু পাইস ইনকামের জন্য নগর-মহানগরে ফুটপাত ইজারা প্রথা চালু করে দোকান পসরার ব্যবস্থা করছে মহল্লার রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও লোকাল পুলিশ প্রশাসন। নগর-মহানগরের হাজারো ফুটপাতের দোকানগুলো থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে স্থানীয় নেতা ও পুলিশ প্রশাসন। নগর-মহানগরের রাস্তায় ফুটপাতগুলোর পাশে বিভিন্ন সরকারি-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের বাউন্ডারী ওয়ালসংলগ্ন ফুটপাতের জায়গাগুলোতে ছোট ছোট পিলার তুলে সার্টার ব্যবহার করে স্থায়ীভাবে দোকান ভাড়া দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানের মহল্লার নেতা ও পুলিশ প্রশাসন। সম্প্রীতি গুলিস্তান ফার্মগেট এলাকায় ফুটপাত উচ্ছেদের অভিযান চালানো হলেও ফুটপাত দখলমুক্ত হয়নি। সংশ্লিষ্ট বিভাগ ফুটপাত দখলমুক্ত করতে ভ্রাম্যমাণ অভিযান চালালেও ফুটপাত হকারদের পুনরায় দখলে চলে যায়। ফুটপাত হকারদের কবল থেকে উদ্ধার করার একমাত্র উপায় হলো নগর মহানগড়ের স্ব-স্ব মহল্লার রাজনৈতিক নেতাদের স্বদিচ্ছাই পারে নগর মহানগড়ের ফুটপাত হকারমুক্ত করতে।ফুটপাত কমতে কমতে পথচারীর চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ফুটপাত দিয়ে চলাচল করতে পথচারীদের সাপের মতো এঁকে বেঁকে চলাচল করতে হচ্ছে। ফুটপাতের পথচারীর জায়গা সঙ্কুচিত হচ্ছে। এর মধ্যে খরার ঘা সৃষ্টি করেছে মোটরসাইকেল আরোহীরা। রাজধানীর ঢাকা শহরে এ ঘটনা এখন নিত্যদিনের। ঢাকা শহরে প্রতিদিন বিভিন্ন জেলা থেকে লাখ লাখ লোকজন আসা-যাওয়া করেন। এরা ফুটপাত দিয়ে চলার সময় আহত হলে তেমন কোনো অসুবিধা হয় না। অতিথি পাখি যেমন আসা ও ফেরত যাবার সময় পাখি শিকারিদের জালে আটকা পড়ে তেমন অবস্থাই সৃষ্টি হচ্ছে পথচারীদের বেলায়। ফুটপাত দখল করে ব্যবসা বন্ধে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি প্রয়োজন। এ অবস্থায় পরিবর্তন চায় নগরবাসী। ফুটপাত দখলমুক্ত করার জন্য নগর ভবন থেকেও বিভিন্ন সময় উদ্যোগ করা হয়েছে। দোকানপাট তুলে দেওয়া হয়েছে। কিছুদিন পর আবার ব্যবসায়ীরা ফুটপাত বেদখল করে দোকানে পসরা সাজিয়ে চুটিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে ব্যবসায়ীরা। ফুটপাত মুক্ত করতে নগর ভবন, স্থানীয় সরকার বিভাগ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো থেকে পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। ফুটপাত দখলমুক্ত করার দাবি পথচারীদের।  সিরাজগঞ্জ থেকে

হাঁটাপথের হাট

হাঁটাপথের হাট

বাঙালির গ্রামীণ ও শহরতলির জীবনে হাঁটাপথের বিকিকিনি এক অনন্য সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতীক। এই হাঁটাপথের দোকানপাট, হকারদের হাঁকডাক, আর ক্রেতা-বিক্রেতার চেনা মুখের গল্প গড়ে তোলে এক জীবনচিত্র। আধুনিক বাজার ব্যবস্থার দ্রুত বিস্তার হলেও হাঁটাপথের বিকিকিনি এখনো টিকে আছে স্বকীয়তা নিয়ে। হাঁটাপথের বিকিকিনি সাধারণত সকালে অথবা বিকেলে জমে ওঠে। কোথাও সাপ্তাহিক হাট, আবার কোথাও প্রতিদিনই বসে  ছোটখাটো দোকান। কেউ বিক্রি করছে তাজা শাকসবজি, কেউ ফলমূল, আবার কেউ হাঁড়ি-পাতিল, কাপড়চোপড় বা হস্তশিল্পের জিনিসপত্র। নগরীর ফুটপাত থেকে শুরু করে গ্রামের মাটির রাস্তা। সবখানেই চোখে পড়ে এই প্রাণচাঞ্চল্যময় বিকিকিনি। হাঁটাপথের বিকিকিনি শুধু কেনাবেচার জায়গা নয়, বরং মানুষের সামাজিক মেলবন্ধনের ক্ষেত্রও বটে। এখানে পণ্যদ্রব্যের দামদর ঠিক করার মধ্যেই তৈরি হয় সম্পর্কের উষ্ণতা। গ্রামের মানুষ  যেমন বাজারে এসে গল্পগুজব করে, তেমনি শহরের ব্যস্ত মানুষও হাঁটাপথের দোকানে একটু দম নেওয়ার সুযোগ খুঁজে পায়। তবে হাঁটাপথের বিকিকিনির সুবিধার পাশাপাশি কিছু সমস্যা ও চ্যালেঞ্জও আছে। হকারদের অনিয়মিত বসা, যানজটের সৃষ্টি, আর কখনো কখনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্ছেদ অভিযান এই বিকিকিনিকে অনিশ্চয়তার মুখে ফেলে দেয়। তবু জীবনের প্রয়োজনে, জীবিকার তাগিদে এই বিকিকিনি প্রতিদিন নতুন করে বেঁচে ওঠে। পরিশেষে বলা যায়, হাঁটাপথের বিকিকিনি কেবল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নয়; এটি আমাদের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আধুনিক নগরায়নের সঙ্গে সমন্বয় করে এই বিকিকিনিকে টিকিয়ে রাখা এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সকলের জন্য নিরাপদ ও উপকারী করে তোলা জরুরি। ফেনী থেকে

জীবিকার যুদ্ধ

জীবিকার যুদ্ধ

‘হকারমুক্ত শহর’- এই বাক্যটি যেন এক আধুনিক স্বপ্নের মতো। নগর পরিকল্পনার কাগজে-কলমে এটি সৌন্দর্য ও শৃঙ্খলার প্রতীক। প্রশাসনের চোখে ফুটপাত শুধু পথচারীর চলাচলের পথ, আর নাগরিকের চোখে তা শহরের শৃঙ্খলার ব্যাঘাত। কিন্তু বাস্তবের ঢাকা শহর আমাদের অন্য এক গল্প শোনায় যেখানে ফুটপাতের প্রতি বর্গফুট জুড়ে আছে জীবিকার যুদ্ধ, ক্ষুধার বিরুদ্ধে প্রতিদিনের এক নীরব অথচ দৃঢ় প্রতিরোধ। ঢাকার প্রতিটি ব্যস্ত এলাকায় তাকালেই দেখা যায়, ফুটপাতজুড়ে বসা হকারদের মুখ। কারও সামনে শীতলপাটি, কারও গলায় ঝোলানো মোবাইল কাভারের মালা, কোথাও পুরানো বইয়ের স্তূপ, কোথাও আবার গরম চা আর সিঙ্গাড়ার কড়াই। এদের সবার ভেতরেই লুকিয়ে আছে একটি জীবন যেখানে নেই চাকরি, নেই মাসিক বেতন, নেই কোনো নিরাপত্তা। আছে শুধু বিকিকিনির মধ্য দিয়ে প্রতিদিনের লড়াই টিকিয়ে রাখার চেষ্টা। প্রশাসনের চোখে এটি অনধিকার প্রবেশ, দখল। তাই হকার উচ্ছেদ একটি নিয়মিত অভিযান। কিন্তু প্রতিটি উচ্ছেদের দৃশ্যের পেছনে থাকে কান্না, অনিশ্চয়তা আর বেঁচে থাকার সংগ্রাম। দোকান গুটিয়ে চলে যাওয়া মানে কারও সন্তান স্কুলে না যাওয়া, কারও অসুস্থ মায়ের ওষুধ বন্ধ হয়ে যাওয়া, আবার কারও মাসের ঘর ভাড়ার টাকা জোগাড় না হওয়া। অথচ এসব মানুষের কেউই শহরের বোঝা নয়, তারা বরং শহরের বিকল্প অর্থনীতির এক বড় চাকা। প্রতিদিন লাখ থেকে কোটি টাকা ঘোরে এই ফুটপাত-বাজারে, যা অনেকের জন্য সাশ্রয়ী কেনাকাটার ভরসাও বটে। রাজনীতি এখানে বড় চরিত্র। অনেক সময় হকারদের পেছনে থাকে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, আবার উচ্ছেদের সময় সেই একই রাজনীতি মুখ ঘুরিয়ে নেয়। চাঁদা, নীরব চুক্তি, পুনরায় বসে পড়া- সব মিলে এই জীবন যেন এক চক্রের নাম, যেখান থেকে বের হওয়ার পথ নেই, শুধু ঠেকে ঠেকে এগোনোর চেষ্টা আছে। আমরা কি পারি না এই বাস্তবতাকে স্বীকার করে একটি মানবিক সমাধানের কথা ভাবতে? শহরের সৌন্দর্য অবশ্যই প্রয়োজন, পথচারীর নির্বিঘ্ন চলাচলও জরুরি। কিন্তু সেই সৌন্দর্য যদি কারও পেটের ভাত কেড়ে নেয়, তবে সে শৃঙ্খলার মধ্যে মানবিকতা কোথায়? পরিকল্পিত ‘হকার জোন’, বিক্রির সময়সীমা, অথবা নির্দিষ্ট এলাকায় বৈধভাবে বসার সুযোগ- এসব বাস্তবায়নই হতে পারে সহাবস্থানের উপায়। বিদেশের অনেক নগরে এসব পদ্ধতি কাজ করছে ভালোভাবেই।শহরকে শুধুই পাথরের শহর ভাবলে চলবে না। প্রতিটি ফুটপাত, প্রতিটি ছায়া, প্রতিটি বিকিকিনি- সবই আসলে মানুষের গল্প। এই শহরের নিচে আজ যে জীবনগুলো চাপা পড়ে আছে, আমাদের দায়িত্ব সেই জীবনের শব্দ শুনে নেওয়া। নইলে একদিন এই শহরই হয়ে উঠবে শুধু ইট-পাথরের কাঠামো- জীবনহীন, নীরব, অথচ নিখুঁত। যশোর থেকে

নাগরিক জীবন চিত্র

নাগরিক জীবন চিত্র

আধুনিক নগর জীবনে হাঁটা পথে বিকিকিনির প্রচলন একটি উল্লেখযোগ্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক ঘটনা হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে, বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের মতো বড় শহরগুলোতে, রাস্তার ধারে, ফুটপাতে এবং ব্যস্ত সড়কের পাশে বিকিকিনির ঢেউ দেখা যায়। এই বিকিকিনি শুধু পণ্য বিক্রির মাধ্যম নয়, বরং একটি জীবনধারা, সংগ্রাম এবং উদ্যোক্তা মনোভাবের প্রতিফলন। হাঁটা পথে বিকিকিনির প্রধান আকর্ষণ হলো এর সহজলভ্যতা ও বৈচিত্র্য। ফল, সবজি, কাপড়, জুতা, খাবার, পানীয় থেকে শুরু করে ছোটখাটো ইলেকট্রনিক পণ্য- সবকিছুই এখানে পাওয়া যায়। সাধারণ মানুষের কাছে এটি সময় ও অর্থ সাশ্রয়ী একটি কেনাকাটার মাধ্যম। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের কাছে ফুটপাতের এই দোকানগুলো অত্যন্ত জনপ্রিয়। তবে এই বিকিকিনির পেছনে রয়েছে হাজারো মানুষের জীবন-জীবিকার গল্প। এই পথচলতি ব্যবসায়ীদের অধিকাংশই গ্রাম থেকে শহরে আগত। জীবিকার তাগিদে তারা ফুটপাতে ব্যবসা শুরু করেন। তবে তাদের জীবন সংগ্রামে ভরা। ফুটপাতে জায়গা পাওয়া, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের হয়রানি, আবহাওয়ার প্রতিকূলতা এবং অনিশ্চিত আয় তাদের প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করে। এরপরও তারা হাল ছাড়েন না। তাদের উদ্যম ও পরিশ্রম শহরের অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। হাঁটা পথে বিকিকিনির কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে। ফুটপাত দখলের কারণে পথচারীদের চলাচলে সমস্যা হয়, যা শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় বাধা সৃষ্টি করে। এছাড়া অনেক সময় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার বিক্রি এবং নকল পণ্যে বাজার সয়লাব হওয়া গ্রাহকদের জন্য উদ্বেগের কারণ। এই সমস্যা সমাধানে স্থানীয় সরকারের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট বাজার ব্যবস্থাপনা ও নিয়মকানুন প্রয়োজন। হাঁটা পথে বিকিকিনি শুধু একটি ব্যবসা নয়, এটি আমাদের সমাজের একটি জীবন্ত চিত্র। এটি সংগ্রামী মানুষের জীবনযাত্রা এবং শহরের গতিশীলতার প্রতীক। তবে এই ব্যবস্থাকে আরও সংগঠিত ও নিরাপদ করতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন, যাতে বিক্রেতা ও ক্রেতা উভয়েই উপকৃত হতে পারেন।

ফুটপাত হোক পথচারীর

ফুটপাত হোক পথচারীর

ফুটপাত পথচারীর- এই কথাটি আমরা ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি, বইয়ে পড়েছি, আইনেও তার স্বীকৃতি রয়েছে। কিন্তু ঢাকার রাস্তায় নামলে এই কথাটি যেন এক দুর্লভ কল্পনা বলেই মনে হয়। বাস্তবতা হলো, রাজধানীর প্রায় প্রতিটি প্রধান সড়কের পাশে ফুটপাত এখন হকার, দোকানদার এবং নানা প্রভাবশালী গোষ্ঠীর দখলে চলে গেছে। কোথাও সাময়িকভাবে, আবার কোথাও দীর্ঘদিন ধরে স্থায়ী দোকান হিসেবেও গড়ে উঠেছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। গুলিস্তান, পল্টন, নিউমার্কেট, মিরপুর, মতিঝিল কিংবা ফার্মগেট যে এলাকাই ধরি না কেন, ফুটপাত এখন পথচারীর নয়, বরং ক্ষুদ্র ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছে। এমনকি এমন কিছু স্থান রয়েছে যেখানে রিক্সাও ফুটপাতের ওপর দিয়ে চলে, অথচ একজন সাধারণ মানুষ তার দুই পা ফেলার জন্য জায়গা খুঁজে পায় না। ফুটপাত দখলের এই চিত্র শুধু নাগরিক ভোগান্তির প্রতীক নয়, এটি এক ধরনের নাগরিক অধিকারের হরণও বটে। একজন পথচারী যে নিরাপদে, নির্বিঘ্নে হাঁটবেন- তা যেন আজ একটি বিলাসিতার নামান্তর। বিশেষ করে নারী, শিশু, বৃদ্ধ বা শারীরিকভাবে অক্ষম মানুষদের জন্য এই পরিস্থিতি রীতিমতো ভয়াবহ। অনেক সময় তাদের বাধ্য হয়ে গাড়ির চলাচলের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হয়, আর এতে দুর্ঘটনার আশঙ্কাও বাড়ছে। নগর কর্তৃপক্ষ মাঝেমধ্যে কিছু অভিযান চালায়। হকারদের উচ্ছেদ করা হয়, দোকান সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এসব পদক্ষেপ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অস্থায়ী ও লোকদেখানো। কারণ কয়েক দিনের মধ্যেই একই জায়গায় আবার বসে যায় সেই পুরনো দোকান, ফেরত আসে হকাররা। এটি যেন এক চক্রাকার প্রক্রিয়া যেখানে উচ্ছেদ, দখল, পুনরায় উচ্ছেদ চলতেই থাকে। এই পরিস্থিতির জন্য এককভাবে হকারদের দায়ী করাও যুক্তিযুক্ত নয়। ঢাকার মতো একটি ঘনবসতিপূর্ণ, কর্মসংস্থান সংকটময় শহরে বহু মানুষ জীবিকার প্রয়োজনে ফুটপাতে বসে। এই অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত লাখো মানুষের জীবন-জীবিকা। তাদের প্রতি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকা দরকার। কিন্তু সেই মানবিকতা যেন অন্যের অধিকার হরণ না করে- এ বিষয়েও আমাদের সংবেদনশীল হতে হবে।সুতরাং এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন বাস্তবসম্মত ও সমন্বিত পরিকল্পনা। একদিকে যেমন হকারদের জন্য নির্দিষ্ট বিকল্প স্থান নির্ধারণ করতে হবে, তেমনি প্রয়োজন সময়ভিত্তিক বাজার ব্যবস্থাপনা (যেমন সন্ধ্যার পর নির্দিষ্ট স্থানে বসতে দেওয়া), কঠোর আইনি ব্যবস্থাপনা এবং পর্যাপ্ত নজরদারি। পাশাপাশি রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা না থাকলে কোনো ব্যবস্থাই দীর্ঘস্থায়ী হবে না। এছাড়া নাগরিক সচেতনতাও জরুরি। আমরা নিজেরাই যদি দখলদার ফুটপাতে কেনাকাটা করি, তাহলে সমস্যার অংশ হয়ে যাই। গণমাধ্যমকে এই ইস্যুতে সোচ্চার থাকতে হবে এবং নাগরিক অধিকার রক্ষার প্রশ্নে প্রভাব তৈরি করতে হবে। ফুটপাত কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়- এটি একটি নাগরিক অধিকার ও নিরাপত্তার প্রতীক। এই অধিকার যাতে ক্ষুণ্ন না হয়, সেই দায়িত্ব কেবল নগর কর্তৃপক্ষের নয়, বরং পুরো সমাজের। রাষ্ট্র, প্রশাসন, রাজনীতি, নাগরিক- সবাইকে একসঙ্গে পথ খুঁজতে হবে, যেন পথচারী ফিরে পায় তার ন্যায্য ‘পথ’। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা থেকে

রাজস্ব খাতকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ

রাজস্ব খাতকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ

কথায় আছে যে, ‘জনগণের টাকায় সরকার চলে’। আসলে তাই। জনগণ যদি সরকারকে ট্যাক্স না দেয়, তবে রাষ্ট্রের খরচ আর উন্নয়ন হবে না। এটা শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা বিশ্বের নিয়ম। রাজস্ব খাত রাষ্ট্রের খুবই গুরুত্বপূর্ণ খাত। আর সেই রাজস্ব খাতেই চলেছে দীর্ঘ আন্দোলন। এতে করে সরকারের আর্থিক খাতে বড় ধরনের বিপন্নতা এসেছে। রাজস্ব আদায় চরমভাবে বাধার সম্মুখীন হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ধরনের রাজস্ব ঘাটতির মুখে পড়েছিল সরকার। গত প্রায় দুই মাসের আন্দোলনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চলমান অচলাবস্থা দেশের বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে ভয়াবহ প্রভাব পড়েছিল। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ডাকে ধারাবাহিক কর্মসূচির ডাকে নানা ধরনের কর্মসূচি চলে। তবে ব্যবস্যা বাণিজ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব কর্মসূচির ফলে স্থবির হয়ে পড়ে আমদানি-রপ্তানি ও পণ্য চালানের শুল্কায়ন কার্যক্রম, ব্যাহত হয় প্রতিদিন প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য। যাহোক, শেষ পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত হয়েছে। দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে জানান, প্রতিদিনের অচলাবস্থায় দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছিল। প্রতিদিন ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হয়। ফলে চলমান অচলাবস্থা নিরসনে আলোচনা করে এর সমাধান চেয়েছিলেন তারা। এনবিআরের অচলাবস্থায় দৈনিক আড়াই হাজার থেকে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ক্ষতির মুখে পড়েছে। তুলনামূলক ছোট কারখানা বন্ধ হয়ে পড়ার শঙ্কায়। দেশের আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। পোর্টে, বিমানবন্দরে আমদানি ও রপ্তানিযোগ্য পণ্য পড়ে থাকায় বৃষ্টি-রোদে নষ্ট হয়েছে। ব্যবসায়ী নেতারা আরও বলেছেন, কানো সমস্যা টেবিলে বসে সমাধান করা যায় না- সেটা আমরা বিশ্বাস করি না। বসতে হবে, কথা শুনতে হবে, কিছু ছাড় দিতে হবে। কিন্তু এনবিআরের সংস্কার হতে হবে।  আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল-জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন সরকারের একটি স্বতন্ত্র ও বিশেষায়িত বিভাগের মর্যাদায় উন্নীত করতে হবে। বিসিএস (কাস্টমস ও এক্সাইজ) ও বিসিএস (কর) ক্যাডারের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড শক্তিশালীকরণ এবং একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান গঠনের মাধ্যমে রাজস্ব নীতি পৃথকীকরণের কাঠামো কি রূপে প্রণীত হবে তা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, রাজস্ব সংস্কার বিষয়ক পরামর্শক কমিটি ও গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত করতে হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড শক্তিশালীকরণ এবং রাজস্ব নীতি প্রণয়ন কার্যক্রম পৃথকীকরণের লক্ষ্যে জারিকৃত অধ্যাদেশে প্রয়োজনীয় সব সংশোধনী আনতে হবে। সেই সঙ্গে তারা এনবিআর চেয়ারম্যানে অপসারণ দাবিও তুলে। ব্যবসা-বিনিয়োগে আস্থাহীনতা। উৎপাদন, সরবরাহ ও বিপণনে ধীরগতি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ। ব্যবসা প্রসার ও নতুন বিনিয়োগ নিয়ে নির্বাচিত সরকারের অপেক্ষা। সেই সঙ্গে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে চাহিদা কমায় এর প্রভাব পড়েছে রাজস্ব আয়ে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে ঘাটতি ছাড়িয়েছে ৭০ হাজার কোটি টাকার বেশি। চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। পরে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রায় তা কমিয়ে চার লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হয়েছে। সে হিসাবে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বছরে ৩৬৫ দিনের প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার ২৭০ কোটি টাকা আদায় করতে হতো। তবে প্রথম ৯ মাসে আদায়ের ক্ষেত্রে বিরাট রাজস্ব ঘাটতি দেখা দেওয়ায় তা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে, যা আদায়ের কাছাকাছি যাওয়াকেও খুবই চ্যালেঞ্জিং বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। দিনপ্রতি আরও ১ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত আদায় করা সম্ভব কি না, জানতে চাইলে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘রাজস্ব মূলত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নির্ভর করে। আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে গেছে, বড় ব্যবসায়ীরা অনেকেই ব্যবসাবাণিজ্য রেখে পালিয়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এটা তো স্বাভাবিক।’ সংস্থাটির তথ্য বলছে, ৯ মাসে মোট রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৫৬ হাজার ৪৮৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। যদিও এনবিআরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রায় ৯ মাসে মোট ৩ লাখ ২২ হাজার ১৫২ কোটি ৬৪ লাখ টাকা রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল। অর্থাৎ এখন বাকি তিন মাসে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে প্রতিদিন রাজস্ব আদায় করতে হবে দুই হাজার ২৭৫ কোটি টাকা, যা অর্থবছরের দৈনিক গড় আদায়ের চেয়ে এক হাজার কোটি টাকা বেশি। লক্ষ্য পূরণে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে কি না, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কর ফাঁকি রোধ, নন-কমপ্লায়েন্ট করদাতাদের নোটিস দিয়ে সর্বোচ্চ রাজস্ব আদায়ের জন্য মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। গত বছরের তুলনায় মোটামুটি প্রবৃদ্ধি আছে। তবে লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি যাওয়া খুবই চ্যালেঞ্জিং।’ আলোচ্য এ সময়ে আমদানি শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) ও আয়কর- এই তিন খাতের কোনোটিতেই লক্ষ্য পূরণ হয়নি। তিন খাতেই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রাজস্ব আদায় কমেছে। আলোচ্য সময়ে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি হয়েছে আয়কর খাতে। এ খাতে ঘাটতি ২৯ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকার মতো। আয়কর খাতে ঘাটতির পেছনে মূল কারণ এই সময়ে আয়ের সুযোগই তৈরি হয়নি। ব্যবসাবাণিজ্য সীমিত থাকায় এই খাতে তার প্রভাব পড়েছে। এছাড়া আমদানি কমে যাওয়ায় অগ্রিম আয়কর আদায়ও কমেছে। রাজস্ব আদায়ে বড় অবদান রাখে ভ্যাট খাত। আমদানি, স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন, সরবরাহ, জোগানদার পর্যায় পর্যন্ত এই খাতের বিস্তৃতি। এর সর্বশেষ ধাপ ক্রেতা বা ভোক্তা। আমদানি, উৎপাদন, সরবরাহের পাশাপাশি উৎপাদন কমে যাওয়ার ফলে এই খাত বড় ধাক্কা খেয়েছে। এছাড়া ব্যাংকে টাকা রাখার ওপর আবগারি শুল্ক আদায় করে এনবিআর। তবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যাংকে গচ্ছিত টাকার পরিমাণ কমায় আবগারি শুল্কেও পড়েছে এর প্রভাব। কমেছে উৎপাদনও। শিল্প কাঁচামাল ও পণ্য আমদানি কমে যাওয়ায় আমদানি শুল্ক আদায়ে ঘাটতি দেখা গেছে। ব্যবসাবাণিজ্য পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আমদানি সহজে বাড়বে না। কিছু ভোগ্যপণ্য আমদানিতে শুল্ক ছাড় দেওয়ায়ও এ খাতে আদায় কমেছে। যদিও এতে দেশের মানুষ উপকৃত হয়েছে। গত বছর জুলাই মাসের শুরু থেকে আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত দেশজুড়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন হয়। তখন প্রায় সব কিছু বন্ধ ছিল বললেই চলে। সাধারণ ছুটির পাশাপাশি কারফিউও ছিল বেশ কয়েক দিন। এসবের প্রভাব পড়ে শুল্ক-কর আদায়ে। আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে সরকার পরিবর্তনের পরও আবার ব্যবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়, যার প্রভাব এখনো রয়ে গেছে। ‘রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে ত্রুটি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বেশকিছু খাতে নতুন করে করছাড়, আমদানি কমে যাওয়াই রাজস্ব ঘাটতির মূল কারণ। তবে এই সমস্যা মূলত কাঠামোগত। কর ফাঁকি রোধে বেশি উন্নতি হয়নি। পরামর্শক কমিটির সুপারিশকে ভিন্নভাবে এনে ক্যাডারভিত্তিক করায় একটা দোটানা তৈরি হয়েছে। সংস্কারপ্রক্রিয়াও ধাক্কা খেয়েছে। এখন এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন মাথায় রেখে পর্যায়ক্রমে করছাড় কমিয়ে আনা, দুর্নীতি রোধ করা, সম্পত্তিসহ যেসব জায়গা থেকে কর আদায় হয় না সেখান থেকে আদায় করা এবং বিভিন্ন ডেটাবেইস একসঙ্গে করতে হবে।’ রাজস্ব খাতকে শক্তিশালী করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে সরকারের আয় বাড়ে, যা বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড এবং জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা যায়। রাজস্ব খাতকে শক্তিশালী করতে হলে, সরকারের আয় বাড়ানোর জন্য নতুন নতুন উৎস খুঁজে বের করতে হবে, সেই সঙ্গে কর ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করতে হবে। লেখক : সাবেক কর কমিশনার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন

সংকটে ইলিশের অভয়াশ্রম

সংকটে ইলিশের অভয়াশ্রম

দিন দিন দখল-দূষণে অস্তিত্ব সংকটের মুখে ইলিশের অভয়াশ্রমখ্যাত আন্ধারমানিক নদী। বর্তমানে নদীটিতে জোয়ারেও থাকছে না স্রোতের ধারা। পলির আস্তরণে তলদেশ ভরাট হওয়ার পাশাপাশি ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে নদীর দুই পাড়। কোথাও কোথাও জেগেছে ডুবোচর। দুই তীরের প্লাবন ভূমি দখল করে বাড়িঘর, পুকুর, মাছের ঘের, ইটভাঁটিসহ অসংখ্য স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। এছাড়া প্রতিদিন মণকে মণ পলিথিন, প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য নদীতে ফেলা হচ্ছে। পৌরবাসীর পারিবারিক বর্জ্য সব ভেতরের খাল থেকে নদীতে যাচ্ছে। ফলে দখলের পাশাপাশি নদী দূষণও চলছে সমানতালে। এক কথায় ঐতিহ্যবাহী এককালের স্রোতস্বিনী এই নদী এখন চরম সংকটাপন্ন।  উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর আন্ধারমানিক নদীকে ইলিশের অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়। তখন ইলিশের যথেষ্ট বিচরণ ছিল এই নদীতে। অসংখ্য জেলের জীবিকার উৎস ছিল ইলিশ শিকার। এখন নদীটি একেবারে ইলিশশূন্য হয়ে গেছে। কালেভদ্রেও মিলছে না ইলিশ। ফলে বর্তমানে আন্ধারমানিক নদী শুধু নামেই ইলিশের অভয়াশ্রম। জেলেরা এই নদীতে সবশেষ কবে ইলিশ পেয়েছেন তা বলা মুশকিল। এখন বৈঠাচালিত ছোট নৌকায় বড়শি কিংবা চরে সূক্ষ্ম ফাঁসের জাল দিয়ে বিভিন্ন ধরনের মাছের পোনা ধরতে দেখা যায় স্থানীয় খণ্ডকালীন জেলেদের। আন্ধারমানিকে এক সময় জেলেরা ইলিশের পাশাপাশি অনেক মাছ ধরতেন। জীবিকার প্রয়োজন মেটাতেন। কিন্তু মাছের তীব্র সংকটে অনেক জেলে পরিবার ইতোমধ্যে বিকল্প পেশা বেছে নিয়েছেন। এমতাবস্থায়, জেলেসহ পরিবেশ সংগঠকদের শঙ্কা, অদূর ভবিষ্যতে আন্ধারমানিক নদী ইলিশের অভয়াশ্রমের সুখ্যাতি চিরতরে হারাতে পারে। এই পরিস্থিতির জন্য তারা নানাবিধ কারণের মধ্যে নদীর নাব্য সংকটকে প্রধান সমস্যা হিসেবে মনে করছেন। পাশাপাশি নদী দখল-দূষণ-ভরাটও বহুলাংশে দায়ী। অবশ্য বর্তমানে আন্ধারমানিকে বাস্তব অবস্থা নিরূপণে কাজ করছে মৎস্য অধিদপ্তর। আন্ধারমানিকে ইলিশের বিচরণসহ বর্তমান বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে, যা আশাব্যঞ্জক।   অর্থনৈতিক দিক থেকে জাতীয় পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে ইলিশ। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আসে ইলিশ থেকে। ইলিশ উৎপাদনকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যতিরেকে অন্য ১০টি দেশেই কমেছে ইলিশের উৎপাদন। একমাত্র বাংলাদেশেই প্রতি বছর ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে ৯-১০ শতাংশ হারে। বিশ্বের ৬৫ শতাংশ ইলিশের জন্ম হয় বাংলাদেশে। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, আগে দেশের ২১টি উপজেলার নদ-নদীতে পাওয়া যেত ইলিশ। বর্তমানে ১২৫টি উপজেলার নদী-নদীতে ইলিশের সন্ধান মিলছে। কাজেই ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি ও সংরক্ষণে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে বাংলাদেশের ইলিশের অনেক চাহিদা। তাই ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে পারলে উল্লেখযোগ্য পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হবে। মৎস্য বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

রিজার্ভ চুরির মহানায়ক

রিজার্ভ চুরির মহানায়ক

সাইবার জালিয়াতির মাধ্যমে নিউইয়র্কে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যাংকে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮১ মিলিয়ন ডলার ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি চুরি হয়। রিজার্ভ চুরির এ ঘটনা দেশ-বিদেশে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। চুরির সঙ্গে বাংলাদেশসহ ৬ দেশের অপরাধীরা জড়িত। এই সাইবার ডাকাতির মহানায়ক তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান, যিনি বর্তমানে কানাডায় পলাতক।বাংলাদেশ ব্যাংকের ১১ জনের একটি দুষ্টচক্রের সহযোগিতায় সাইবার ডাকাতি হয়েছে। এই চক্রের হোতা পদচ্যুত ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান এবং বাংলাদেশ ব্যাংক রাজশাহী অফিসের বর্তমান নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক। দেশি চক্রটির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে, ভারতীয় দুই মাস্টারমাইন্ড, নীলা ভান্নান ও রাকেশ আস্তানা। খুবই উদ্বেগজনক ঘটনা, একটি স্বাধীন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও নিরাপদ নয় প্রতিবেশী হায়েনা দেশের ছোবল থেকে। একজন মেষ পালক, রাখাল বালক থেকে জীবনের বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হওয়া, ইতিহাসের পাতায় নাম লেখানো প্রান্তিক জনপদের ড. আতিউর রহমানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হওয়ায় দেশবাসী খুশি হন, কিন্তু তিনি ছিলেন খুবই অযোগ্য, অদূরদর্শী,  তোষামোদকারী এবং স্তুতিপ্রিয়। নিজের প্রশংসা শুনতে ভালোবাসতেন। তার চারপাশে অসাধু কর্মকর্তাদের একটি চক্র গড়ে উঠেছিল। তারা তেলবাজি করে স্বার্থ হাসিল করে নিত। গভর্নর আতিউর রিজার্ভ চুরির ঘটনা ২৯ দিন লুকিয়ে রাখেন। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকেও জানাননি। গভর্নরের অনুগত দেশীয় ও ভারতীয় চক্র রিজার্ভ চুরির ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করলেও ২০১৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি ম্যানিলার ‘দ্য ইনকোয়ারার’ পত্রিকায় ঘটনাটি প্রকাশ পায়। ফলে দুনিয়ার সব মানুষ জানতে পারে। বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বের আর্থিক খাতে ঘটনাটি তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিশ্বের সব কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের আর্থিক নিরাপত্তা ও লেনদেন ব্যবস্থার ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে এবং কীভাবে ‘সাইবার হ্যাকিং’ থেকে আর্থিক খাতকে রক্ষা করা যায় তা নিয়ে তৎপরতা শুরু করে। ব্যাংকিং খাতের এত বড় দুর্ঘটনার পরও ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের তেমন কোনো পদক্ষেপ, দেশবাসী দেখতে পায়নি। উল্লেখ্য, সব কিছুই হয়েছে মাস্টার প্লান অনুযায়ী। গভর্নর আতিউর তার পছন্দের, ভারতীয় দুজন নাগরিককে বাংলাদেশ ব্যাংকে নিয়োগ দিয়ে রিজার্ভ চুরির পথ সুগম করে দিয়েছিলেন। নীলা ভান্নান রিজার্ভ চুরির ঠিক আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফট সিস্টেমের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে ফেলে চুরির দুয়ার খুলে দেন এবং রাকেশ আস্তানা রিজার্ভ চুরির পর সব তথ্য ও ডকুমেন্ট মুছে ফেলেন, যা ‘আলীবাবা চল্লিশ চোরের’ কাহিনীকেও হার মানায়। সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা এবং সিআইডির তদন্তের সর্বশেষ অগ্রগতি বিষয়ে জানা যায়, রিজার্ভ চুরির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন, ফিলিপাইন, চীন, শ্রীলঙ্কা ও জাপানের নাগরিক। সহযোগিতা করেছে, বাংলাদেশ ও ভারতের নাগরিকরা।

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবানে ফল উৎপাদনের জন্য এক অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ গড়ে উঠেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের উঁচু পাহাড়, টিলা এবং সমতল জমিতে বিভিন্ন প্রজাতির ফল জন্মায়। গ্রীষ্মকালীন মৌসুমে এই এলাকার সমতল ও উঁচু স্থানে আম, কাঁঠাল, পেঁপে, কলা এবং আনারসের ফলন হয়। সারাবছর মৌসুমি ফল উৎপাদনে পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এ অঞ্চলের স্থানীয় বাজারগুলো এখন মৌসুমি ফল বিক্রয়ের জন্য উপযোগী হয়ে উঠেছে। সবুজে ঘেরা পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রায় এক লাখ হেক্টর জমিতে মৌসুমি ফলের বাগান গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে কিছু ফল সারাবছর পাওয়া যায়। যার মধ্যে রসালো আম, মিষ্টি কাঁঠাল আর সুস্বাদু আনারসের প্রাচুর্য চোখে পড়ার মতো। শুধু তাই নয়, এ অঞ্চলের মাটি বিদেশি ফল উৎপাদনেও দারুণ উপযোগী। ম্যাংগোস্টিন, রাম্বুটান, রসকো (স্থানীয় ভাষায় তাইথাক বা রক্তফল নামে পরিচিত), চিন্দিরা, আমড়া, আনোনা, মারফা, লংগান, প্যাশন ফ্রুট- এ নামগুলো দেশি ফলগুলোর সঙ্গে মিশে পার্বত্যাঞ্চলের মানুষের কাছে সমাদৃত হয়েছে। এ ফলগুলো এখন পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক ফলন হচ্ছে এবং স্থানীয় বাজারগুলোতে পাওয়া যাচ্ছে। বলা যায়, সারাদেশে বছরজুড়ে বাজারে যে পরিমাণ ফল উৎপাদিত হয়, তার সিংহভাগের জোগান দেয় পার্বত্যাঞ্চল। পার্বত্য চট্টগ্রামে উৎপাদিত ফলগুলো পরিবেশবান্ধব ও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক ও টেকসই কৃষি উদ্যোগ হিসেবে ক্রমেই জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। এর উৎপাদন ব্যয় তুলনামূলকভাবে কম হলেও আর্থিক লাভ বেশ উল্লেখযোগ্য, যা পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে গ্রামীণ অর্থনীতির জন্য এক নতুন গতি সৃষ্টি করছে। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জন্য ফল চাষ শুধু খাদ্যনিরাপত্তার মাধ্যম নয়, বরং আয় ও জীবিকা নির্বাহের একটি নির্ভরযোগ্য উৎসে পরিণত হয়েছে। কৃষিজ সম্পদ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বাড়ার ফলে নিয়মিত আয় নিশ্চিত হচ্ছে, যা স্থানীয় পরিবারগুলোর জীবনমান উন্নয়নে সহায়ক হচ্ছে। পাহাড়ি অঞ্চলে উৎপাদিত মৌসুমি ফলগুলো শুধু স্বাদে অনন্য নয়, বরং পুষ্টিগুণেও ভরপুর- যা জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এই ফলগুলো পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর খাদ্যাভ্যাসের অংশ হয়ে উঠেছে এবং স্থানীয়ভাবে প্রক্রিয়াজাত করে বিক্রির মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের নারীরা এখন ফল চাষে কেবল সহায়ক শক্তি নন, বরং একটি আত্মনির্ভরশীল, গতিশীল অংশীদারে পরিণত হয়েছেন। রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলার নানা পাহাড়ি অঞ্চলে নারীরা তাদের নিজেদের উদ্যোগে আম, লিচু, কাঁঠাল, কমলা, আনারস, কলা, পেঁপে ও ড্রাগন ফলসহ নানাবিধ মৌসুমি ফল চাষ করছেন। তারা শুধু ফল উৎপাদনেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, বরং ফল রক্ষণাবেক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বাজারজাতকরণের প্রতিটি ধাপেই সক্রিয়ভাবে জড়িত। স্থানীয় নারী উদ্যোক্তারা জ্যাম, জেলি, আচার, শুকনো ফল প্রক্রিয়াজাত করে স্থানীয় বাজার ছাড়াও শহরের সুপারশপ ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিক্রয় করে তাদের নিজেদের আয় এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হচ্ছেন। এছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সহায়তায় প্রশিক্ষণ নিয়ে নারীরা আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি, জৈব সার ব্যবহার এবং সঠিক সংগ্রহ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফলের মানোন্নয়ন ঘটাচ্ছেন। এভাবে তারা শুধু পরিবার ও সমাজে অবদান রাখছেন না, বরং নারীর ক্ষমতায়ন, স্বনির্ভরতা এবং স্থানীয় অর্থনীতির অগ্রযাত্রায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে উৎপাদিত অর্গানিক ফলসমূহ রাসায়নিকমুক্ত ও প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত হওয়ায় অত্যন্ত স্বাস্থ্যসম্মত এবং মানবদেহের পুষ্টির জন্য উপযোগী। স্থানীয় বাজারে সরবরাহ ছাড়াও শহরাঞ্চল ও আন্তর্জাতিক বাজারে অর্গানিক ফলের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে, যা এই খাতকে রপ্তানিমুখী শিল্পে রূপান্তরের সুযোগ এনে দিয়েছে। এসব ফল বিভিন্ন জটিল রোগ প্রতিরোধেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে পার্বত্যাঞ্চলে ফল চাষের প্রসার উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে। পাশাপাশি, পরিবেশবান্ধব চাষ প্রথা ও সামাজিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রেও এটি এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। টেকসই কৃষি কৌশল এবং পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন অর্গানিক ফলের ভান্ডার হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। অ্যাগ্রো ইকো ট্যুরিজম এমন একটি পর্যটন মডেল যেখানে কৃষি, পরিবেশ ও সংস্কৃতির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে পর্যটন পরিচালিত হয়। এতে বনাঞ্চল সংরক্ষণ, জৈব কৃষি চর্চা এবং স্থানীয় সংস্কৃতির প্রচার হবে-যা টেকসই উন্নয়নের সহায়ক। পাহাড়ি জনগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব ফল বাগান, হস্তশিল্প ও সংস্কৃতিকে পর্যটনের অংশ করে তুলতে পারেন। এতে তারা শুধু আয়ই করবেন না, বরং নিজেদের ঐতিহ্য ও পরিবেশ রক্ষায়ও ভূমিকা রাখতে পারবেন। পর্যটনের মাধ্যমে স্থানীয় ফলের পরিচিতি বাড়লে দেশের বাইরেও এর চাহিদা তৈরি হতে পারে। এতে রপ্তানির সুযোগ বাড়বে এবং কৃষকদের আয়ও বৃদ্ধি পাবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ফল বাজারজাতকরণে বেশ কিছু কাঠামোগত ও পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা এই খাতের সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে বাধা সৃষ্টি করছে। দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল, নৌপথের ওপর নির্ভরতা এবং কাপ্তাই হ্রদের পানির স্তর কমে যাওয়ায় অনেক সময় ফল পরিবহণ ব্যাহত হয়। আধুনিক কোল্ড স্টোরেজ বা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানার অভাবে ফল দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়, ফলে কৃষকরা তাদের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না। অনেক কৃষক শহরের বড় বাজারে সরাসরি পৌঁছাতে পারেন না, ফলে মধ্যস্বত্বভোগীদের ওপর নির্ভর করতে হয়। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় পরিকল্পিত অবকাঠামো উন্নয়ন, সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা, প্রশিক্ষণ ও বাজার সংযোগ জোরদার করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। রাস্তাঘাট উন্নয়ন, পরিবহনের সহজলভ্যতা এবং ফলভিত্তিক শিক্ষা চালু হলে পার্বত্যাঞ্চল হয়ে উঠবে আরও সজীব। ফলভিত্তিক শিক্ষা (আউটকাম বেজড এডুকেশন) চালু হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে ফল সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণে বেশ সহজ হবে। ফলভিত্তিক শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ফল চাষ, সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিপণনের বাস্তব জ্ঞান অর্জন করবে, যা সরাসরি কৃষি ও উদ্যোক্তা খাতে কাজে লাগবে। শিক্ষার্থীরা স্থানীয় ফলের বৈচিত্র্য ও পুষ্টিগুণ বুঝে নতুন পণ্য উদ্ভাবনে আগ্রহী হবে- যেমন জ্যাম, জেলি, শুকনো ফল ইত্যাদি। শিক্ষার্থীরা বিপণন কৌশল, ব্র্যান্ডিং ও ডিজিটাল মার্কেটিং শিখে স্থানীয় ফলকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে পৌঁছে দিতে পারবে। ফলভিত্তিক শিক্ষা নারীদের ও তরুণদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলবে, বিশেষ করে পাহাড়ি নারীদের জন্য এটি হবে একটি টেকসই বিকল্প। এই শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তব জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত হলে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আত্মনির্ভরতা অর্জনে এটি একটি কার্যকর হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ফল উৎপাদন ও এর সুষ্ঠু ব্যবহারে বাংলাদেশ সরকার গত দুই দশকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ, প্রকল্প ও নীতিমালা বাস্তবায়ন করেছে, যা এ অঞ্চলের কৃষি ও অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে ফল চাষে আগ্রহী কৃষকদের প্রশিক্ষণ, চারা বিতরণ ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। বর্তমান সরকার পার্বত্যাঞ্চলে জুমচাষ থেকে সরে এসে স্থায়ী ফল বাগান গড়ে তোলায় উৎসাহ দিচ্ছে। কৃষকদের জন্য মাঠ দিবস, কৃষক সমাবেশ ও প্রশিক্ষণ আয়োজন করা হচ্ছে। পার্বত্য শান্তিচুক্তির পর তিন জেলায় ১২০০ কিলোমিটার পাকা রাস্তা, ৯৮০০টি ব্রিজ ও ১৪০টি কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। এর ফলে ফল পরিবহন সহজ হয়েছে এবং কৃষকরা ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন। উদ্যোক্তারা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে সরাসরি ফল বিক্রি করছেন, যা মধ্যস্বত্বভোগীদের নির্ভরতা অনেকটা কমিয়ে এনেছে। সরকার তিন পার্বত্য জেলায় ফল চাষের অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। বর্তমানে তিন পার্বত্য জেলায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট ফল চাষের জমি ছিল প্রায় ১ লাখ ৭ হাজার ৭২৯ হেক্টর। যেখানে ৪৫ প্রজাতির ফল উৎপাদিত হচ্ছে, যা দেশে মোট ফল উৎপাদনের প্রায় ১৫ শতাংশ। বান্দরবানেই বছরে ৮ দশমিক ৫ লাখ টন ফল উৎপাদিত হয়, যার বাজারমূল্য প্রায় ৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। প্রায় ১৬ লাখ মানুষের মধ্যে ২৪ শতাংশ মানুষ এখন ফল উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল। পাহাড়ি নারীরা ফল চাষ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে নারী ক্ষমতায়নের দৃষ্টান্ত স্থাপন করছেন। এই সাফল্যগুলো আরও টেকসই করতে হলে প্রয়োজন হবে সেচ সুবিধা বৃদ্ধি, সমন্বিত টোল ব্যবস্থা, সহজ শর্তে ঋণ এবং ফলভিত্তিক শিল্প স্থাপন। পার্বত্য চট্টগ্রামের রঙিন পাহাড় যেমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মোহিত করে, তেমনি এখানকার মৌসুমি ফলের বৈচিত্র্য ও পুষ্টিমূল্য আমাদের স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির জন্য এক অনন্য সম্পদ। এই অঞ্চলের কৃষকেরা, বিশেষ করে নারীরা, ফল উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিপণনের প্রতিটি ধাপে অংশ নিয়ে নিজেদের শুধু অর্থনৈতিকভাবে নয়, সামাজিকভাবেও আত্মপ্রত্যয়ী করে তুলছেন। সরকার, বেসরকারি সংস্থা এবং স্থানীয় জনগণের সমন্বিত প্রয়াস এই সম্ভাবনাকে আরও সুদৃঢ় করতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে পারে ফলভিত্তিক টেকসই উন্নয়ন ও কৃষিভিত্তিক পর্যটনের অনন্য উদাহরণ। তাই প্রয়োজন সংরক্ষণে সহনশীলতা, উৎপাদনে উদ্ভাবন, আর বাজারে সাহসী অংশগ্রহণ।

আওয়ামী প্রশ্রয়ে ভারতীয় সম্পৃক্তি এবং সুনিতা পালের প্রশ্ন

আওয়ামী প্রশ্রয়ে ভারতীয় সম্পৃক্তি এবং সুনিতা পালের প্রশ্ন

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব দুর্বল ও দেশের সামরিক বাহিনীকে মেধাশূন্য করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদর দপ্তর পিলখানায় সংঘটিত হয় ইতিহাসের নারকীয়, নির্মম হত্যাযজ্ঞ। বিডিআর বিদ্রোহের এ ঘটনায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনার পর হত্যা ও বিস্ফোরণ আইনে করা মামলায় ১৩৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আদালত। এছাড়া আরও অন্তত ২২৮ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। সশস্ত্র বিদ্রোহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে হয়ে থাকে, এর আগে বাংলাদেশেও হয়েছে, ১৯৯৪ সালে আনসার বিদ্রোহ অন্যতম। কিন্তু কোথাও কখনো, কোন সশস্ত্র বিদ্রোহের পেছনে শুধু দাবি-দাওয়া কিংবা ভাগবাটোয়ারার বিষয় মুখ্য ছিল না। এ হত্যাকাণ্ড ছিল একাত্তরের পর দেশের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় ষড়যন্ত্র। এ নারকীয় ঘটনার মাধ্যমে দেশের সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। সেদিন শুধু চৌকস সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করে মাটি চাপা দেওয়া হয়নি। প্রকৃতপক্ষে সেদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে। দেশি-বিদেশি জাতীয় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের আলোকে নির্দিধায় বলা যায়, ‘পিলখানার নারকীয় হত্যাকাণ্ডের জন্য উপমহাদেশের মাফিয়া দল আওয়ামী লীগ এবং তাদের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষক ভারতের বিরুদ্ধেও অভিযোগের তীর রয়েছে। এ দায় তারাও এড়াতে পারে না। দেশের জনগন পিলখানা হত্যাকাণ্ডের কুশীলব হিসেবে জানে, আওয়ামী লীগ এমপি মির্জা আজম, হাজী সেলিম, জাহাঙ্গীর কবীর নানক, ফজলে নূর তাপস এবং মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে। তারা ওই সময়ে কয়েকটি বৈঠকে মিলিত হন। জানা যায়, বিডিআর জওয়ান তোরাব আলী তাপস, নানক, আজম ও সোহেল তাজের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করেন। ২৫ ফেব্রুয়ারির পিলখানা হত্যাযজ্ঞ ঘটানোর মূল উদ্দেশ্যই ছিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে পঙ্গু করে দেওয়া। ওই নির্মম হত্যাকাণ্ডের কুশীলব কারা ছিল জাতি আজও জানতে পারেনি। তাদেরকে কেনইবা বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করায়নি আওয়ামী লীগ। পিলখানা হত্যাকাণ্ড এক দিনের পরিকল্পনায় হয়নি, অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী পরিকল্পানা নিয়ে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ মনে করেন, পিলখানার ঘটনা, ১৯৭১-এ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যাতনকেও হার মানিয়েছে।  দেশের আম জনতার মনে আজও একটি প্রশ্ন সদা ঘুরপাক খাচ্ছে! ঠিক কি কারণে এই বিডিআর বিদ্রোহ হয়েছিল? নিশ্চয়ই আমাদের স্মরণে আছে, ২০০১ সালের এপ্রিল মাসে কুড়িগ্রামের রৌমারি সীমান্তে বিডিআর বিএসএফের মুখোমুখি যুদ্ধে ১৫০ জন বিএসএফ জোয়ান নিহত হয়। এর আগে পদুয়ায় ১৫ জন বিএসএফ নিহত হয়। এ ঘটনার পর ভারতের ডিফেন্স মিনিষ্টার জসবন্ত সিং উত্তপ্ত লোকসভায় জানান দেন এ ঘটনার বদলা নেওয়া হবে। দেশের সিংহভাগ মানুষ মনে করে, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর প্রত্যক্ষ মদদে এবং তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান মঈন ইউ আহমেদের পরোক্ষ সহায়তায় এ হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়, যার কারণে, নিহত সেনা অফিসারদের জানাজা পড়তে গেলে কয়েকজন অফিসার জেনারেল মঈনকে মারতে আসে। এছাড়া বড়ইবাড়ি সীমান্তে বিএসএফ ও তৎকালীন বিডিআরের সঙ্গে তুমুল সংঘর্ষ হয়েছিল। সবগুলোই ছিল বিএসএফের পরিকল্পিত ঘটনা। অভিযোগ রয়েছে ২০০৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জোট নিরঙ্কুশ বিজয় লাভের পর চৌকস সেনা অফিসারদের হত্যার জন্য বিডিআরে বদলি করে এনে এক জায়গায় তাদের জড়ো করা হয়। এরপর তাদের হত্যা করা হয়। পদুয়া এবং রৌমারীর যুদ্ধে বিএসএফ হত্যার পর থেকেই বিডিআর ধ্বংসে নিয়োজিত হয় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’। রৌমারীর ঘটনার নেতৃত্ব দেন রংপুরের তৎকালীন সেক্টর কমান্ডার পরবর্তী সময়ে বিডিআর ডিজি মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ। বিএসএফ শোচনীয় পরাজয়ের কারণে তারা ক্ষুব্ধ ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় পিলখানা হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, এমনটাই বিশ্বাস করে বাংলাদেশের জনগণ। পিলখানা হত্যাকাণ্ড নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অংশ। এটি শুধুই ব্যর্থতা নাকি ষড়যন্ত্রের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছিলেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা। এটা তো হঠাৎ করে ঘটেনি বা আকস্মিক পরিকল্পনার অংশ নয়। দীর্ঘদিন ধরে এটা নিয়ে পরিকল্পনা হয়েছে। গোয়েন্দারা কেন বিষয়টি জানতে পারেননি, নাকি তারাও জড়িত। কিন্তু আরও তো গোয়েন্দা সংস্থা ছিল, তাহলে তারা কী করেছে? এটা কিন্তু বিচারিক প্রক্রিয়াতেও জানা গেল না। নেপথ্যে থেকে কারা ষড়যন্ত্র করেছিলেন তাদের পরিচয় অজানাই থেকে গেল। এটি ভবিষ্যতের ষড়যন্ত্রকে উৎসাহিত করতে পারে। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পিলখানার সিসি টিভি ফুটেজসহ গুরুত্বপূর্ণ আলামত ধ্বংস করে দেন ঘটনার পরপর দায়িত্ব পাওয়া বিডিআর ডিজি লে. জেনারেল মইনুল ইসলাম। অভিযোগ রয়েছে পিলখানা হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে জড়িত ছিল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’। ঢাকায় আনা হয়েছিল প্রশিক্ষিত কিলার বাহিনী। একটি অংশকে খেলোয়াড় বেশে বিডিআরের পিকআপ ভ্যানে করে, আরেকটি অংশকে রোগী সাজিয়ে নম্বরবিহীন অ্যাম্বুলেন্সে পিলখানায় ঢোকানো হয়। অপারেশন শেষে, রাতে অ্যাম্বুলেন্সে নিরাপদে তারা পিলখানা ত্যাগ করে। সংশ্লিষ্ট সূত্রের ধারণা ভারতীয় কিলার গ্রুপটিকে ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে বিমানের দুবাইগামী ফ্লাইটে তুলে দেওয়া হয়। ভারতীয় কিলার গ্রুপের জন্য ফ্লাইটটি দুই ঘণ্টা বিলম্বে ছাড়ে। পিলখানা হত্যা ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন মেজর জেনারেল (অব.) তারেক সিদ্দিক, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিম, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম, শেখ ফজলে নূর তাপস এবং সেনাবাহিনী ও পুলিশের কিছু কর্মকর্তা। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর লোকজন ও কিলার গ্রুপের সদস্যরা এ অপারেশন চালাতে ফার্মগেটে অবস্থিত তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের হোটেল ইম্পেরিয়াল ব্যবহার করেছে। পিলখানা হত্যাকাণ্ডকে ‘বিডিআর বিদ্রোহ’ হিসেবে চালানো হলেও এটি ছিল একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। সেনাপ্রধান হিসেবে বিডিআর হত্যা মোকাবিলা তথা সেনা কর্মকর্তাদের বাঁচাতে ব্যর্থ হয়েছেন জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ। হত্যাকাণ্ডের দায় তিনি এড়াতে পারেন না। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে বিরোধিতার মুখে পড়ে। এর কারণ বিডিআরের কথিত বিদ্রোহের আড়ালে সেনা অফিসারদের হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে ভারতীয় কলামিস্ট, বুদ্ধিজীবী সুনিতা পাল প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু লিখেছিলেন। সুনিতা পালের অনুসন্ধানী রিপোর্টগুলোর নিখুঁত বিশ্লেষণে বেরিয়ে আসছে, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরকার ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের বেশ ক’জন রাঘব-বোয়াল’ সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিল। রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পর্যায়ে চাকরিরত কারো কারো ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। ধরিয়ে দিয়েছেন তথ্যসূত্রও। দিন-তারিখ ও সময় ধরে ধরেই এসব তথ্য সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে চলেছেন তিনি। ইন্টারনেটের কল্যাণে তার রিপোর্টগুলো বিভিন্ন ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হওয়ায়  সারাবিশ্বের মানুষের কাছেই মুহূর্তে পৌঁছে যায়। সুনিতা পালের বিরুদ্ধে সুসংগঠিত প্রচারণা চালানোর পাশাপাশি, সে সময়ে আওয়ামী লীগের তরফ থেকে সুনিতা পালকে আর্থিক সুবিধার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল অনৈতিক পন্থায় সমঝোতা করার জন্য। এ কথাটা সুনিতা পাল নিজেই জানিয়েছে তার ওয়েবসাইটে। সুনিতা পালের ৩০টি প্রশ্ন আমাদেরকে ভাবিয়ে তুলছে নতুন করে। ১. ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে প্রধানমন্ত্রীর কাছে কি গোয়েন্দা তথ্য পাঠানো হয়েছিল? ২. বিডিআরের নিহত মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ কি কথা হয়েছিল? ৩. প্রধানমন্ত্রী কেন ২৬ ফেব্রুয়ারির ডিনারে যেতে অস্বীকার করেছিলেন? ৪. ২৫ এবং ২৬ ফেব্রুয়ারি কার নির্দেশে বিডিআর হেডকোয়ার্টারের আশপাশের লোকজনকে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে বলা হয়েছিল? ৫. ২৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় কেন লে. কর্নেল মুকিত বিডিআর সদর দপ্তর থেকে সেনাবাহিনী এবং বিডিআর মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে ফ্যাক্স বার্তা পাঠিয়েছিলেন? ৬. বিডিআর সদর দপ্তরের ৫ নম্বর গেটে সেদিন কেন পুলিশ এবং র‌্যাব সদস্যদের মোতায়েন করা হয়নি? ৭. প্রধানমন্ত্রী কেন ঘটনা জানার ৪ ঘণ্টা পর নানক এবং মির্জা আজমকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন? ৮. বিডিআর বিদ্রোহীদের যে প্রতিনিধি দলটি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন, তাদের নাম-ঠিকানা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে ঢোকার সময় কেন রেজিস্ট্রী করা হয়নি? ৯. প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বিদ্রোহীদের নেতা ডিএডি তৌহিদ জানিয়েছিলেন বিডিআর ডিজিসহ কয়েকজন অফিসারকে হত্যা করা হয়েছে-এ বিষয়টি কেন ২৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা পর্যন্ত গোপন করা হলো? ১০. বাংলাদেশ টেলিভিশন সেদিন বিদ্রোহের ঘটনা কেন প্রচার করেনি? ১১. বিদ্রোহীরা কেন প্রধানমন্ত্রীকে আমাদের নেত্রী’ বলে উল্লেখ করেছিল? ১২. কিছু বিদ্রোহী কেন আওয়ামী লীগের দলীয় স্লোগান জয় বাংলা’ বলে স্লোগান দিয়েছিল? ১৩. ঘটনার সময় বিডিআর হেডকোয়ার্টারে দেশের বাইরে থেকে একাধিক ফোন কল এসেছিল। তদন্তকারীরা কি এগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন? ১৪. প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ২৭ ফেব্রুয়ারি কেন পালিয়ে যাওয়া কিছু বিদ্রোহীর সঙ্গে দেখা করতে দুবাই এসেছিলেন? ১৫. জয় দুবাই এয়ারপোর্টে কেন পালিয়ে যাওয়া বিদ্রোহীদের হাতে একটি করে ইনভেলপ দিয়েছিলেন? ১৬. আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় দেয়া বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে জয় কেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সমালোচনা করে বিদ্রোহের জন্য সেনাবাহিনীকে দায়ী করলেন? ১৭. তদন্ত শেষ হওয়ার আগে জয়কে কেন তার মা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে আসতে নিষেধ করেছেন?  ১৮. সরকারের কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি কেন নির্দিষ্ট একটি দেশের সরকারের কাছে, ফোন করে ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর বিদ্রোহ ঠেকাতে সাহায্য চান? ১৯. আওয়ামী লীগ নেতা মহীউদ্দীন খান আলমগীর কেন ২৭ ফেব্রুয়ারি দেশ থেকে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন?  ২০. মন্ত্রী ফারুক খান কেন বললেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী এবং র‌্যাব ফোর্সের মধ্যে জঙ্গিদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে? ২১. সরকার কেন পুলিশের আইজিকে তদন্ত প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করছে? ২২. কারণ ছাড়াই কেন নবনিযুক্ত ঢাকার পুলিশ কমিশনার ইংরেজি মাধ্যমের স্কুুলে জঙ্গি হামলার আশঙ্কা প্রকাশ করলেন? ২৩. প্রধানমন্ত্রী বিডিআর সদর দপ্তরে সেনা কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের উদ্ধারে সেনাবাহিনীকে অভিযান চালাতে দিলেন না? ২৪. তথ্য সংগ্রহের নামে সিআইডি দল বিডিআর সদর দপ্তর থেকে কি সরিয়েছে? ২৫. বিডিআর সদর দপ্তরে পাহারারত পুলিশ সদস্যরা ৩০ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে কি ধরনের তথ্য-প্রমাণাদি সেখান থেকে সরিয়েছে? ২৬. ২৬ মার্চ আত্মসমর্পণের পর রাতের অন্ধকারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীন দলের অন্যান্য নেতা কেন বিডিআর সদর দপ্তরে গিয়েছিলেন? ২৭. ঘটনার পর থেকে সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি লিয়াকত সিকদার কেন লুকিয়ে ছিলেন? ২৮. আওয়ামী লীগ এবং এর নেতারা কেন হত্যাকারী এবং তাদের সহযোগীদের বিচার সামরিক আদালতের পরিবর্তে বেসামরিক আদালতে দাবি করছেন? ২৯. আওয়ামীপন্থি একদল সাংবাদিক কেন অব্যাহতভাবে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছেন এবং বেসামরিক আদালতে বিচার দাবি করছেন? ৩০. ভারতীয় গণমাধ্যমে যে ধরনের বক্তব্য আসছে, বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের কণ্ঠে কেন একই ধরনের বক্তব্য? ২০২৪ সালের ২৫ আগস্ট তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ তার ইউটিউব চ্যানেলে ২৯ মিনিটের একটি ভিডিও বার্তা দেন। তিনি সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে বলেন, ‘২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ছিল জিএসপিসি মিটিং। এই মিটিংয়ের মাধ্যমে সেনাবাহিনী সিদ্ধান্ত নেয় আগামী বছরে কী কী জিনিস প্রকিউর করবে। আমি জিএসপিসি মিটিংয়ে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আনুমানিক সকাল পৌনে ৯টায় সিজিএস লেফটেন্যান্ট জেনারেল সিনা ইবনে জামালী আমার অফিসে আসেন এবং বলেন, আমাদের কাছে কিছু ৮১ মিলিমিটার মর্টার আছে, যেটা সেনাবাহিনী ব্যবহার করে না। এটার গুদামজাত ও রক্ষণাবেক্ষণ আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছে। বিডিআর ৮১ মিলিমিটার মর্টার ব্যবহার করে তারা যদি হেড ট্রান্সফার করে নিয়ে যায়, আমাদের অনেক উপকার হবে।’ তিনি জানান, সে ব্যাপারে বাহিনীটির তৎকালীন মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের (হত্যাকাণ্ডে নিহত) সঙ্গে সকালে তার কথা হয়। শাকিল অস্ত্রগুলো নিতে রাজি হন। ‘কথোপকথনে মনে হয়েছে, তখন পর্যন্ত বিদ্রোহ সম্পর্কে তিনি (বিডিআরের ডিজি) কিছুই জানতেন না বলেই আমার বিশ্বাস। যদি জানতেন, নিশ্চিয়ই তিনি আমাকে অবহিত করতেন।’ সাবেক এই সেনা প্রধান বলেন, জিএসপিসি মিটিং চলাকালে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে আমার প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি কর্নেল ফিরোজ সভাকক্ষে প্রবেশ করেন এবং আমার কানে কানে বলেন, পিলখানায় গণ্ডগোল হচ্ছে। আপনার দিকনির্দেশনা প্রয়োজন। 

বিশ্ব রাজনীতিতে যুদ্ধের বাস্তবতা

বিশ্ব রাজনীতিতে যুদ্ধের বাস্তবতা

কিছু রাষ্ট্রের জন্য যুদ্ধ যেন এখন খেলায় পরিণত হয়েছে। তারা সুযোগ পেলেই আগ বাড়িয়ে নিজের সামরিক ক্ষমতা দেখাতে উঠে পড়ে লাগে। আর এই যুদ্ধ শুরু করার জন্য ২টি জিনিস প্রয়োজন। প্রথমত সন্ত্রাসী ট্যাগ দেওয়া। আর দ্বিতীয় বিষয় হলো নিউক্লিয়ার বা পারমাণবিক শক্তি সমৃদ্ধ করার অজুহাত দেওয়া। এই দুই ধরণের ট্যাগ কোনো দেশে লাগিয়ে দিতে পারলেই যেন সেসব দেশকে যুদ্ধের নামে ধ্বংস করার বৈধতা পাওয়া যায়।  আমরা প্রতি বছর এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের আর্মড কনফ্লিক্ট এর সাক্ষী হই। সেটা ভারত-পাকিস্তান, চীন-ভারত, চীন-তাইওয়ান, রাশিয়া-জর্জিয়া, চীন-জাপান কিংবা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তসহ বিভিন্ন স্থানে হয়ে থাকে। ২০০০ সালের পর থেকে আমরা এমন কিছু যুদ্ধ দেখেছি যা শুধু নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে চালানো হয়েছে। যেমন-  ২০০১ সালে আফগানিস্তান যুদ্ধ, ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও গাজা-ইসরায়েল দেখছি। এই যুদ্ধগুলো  বিশ্ববাসীকে কিছু বার্তা দিয়ে গেছে, যে তুমি যদি পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রের নাগরিক না হও তাহলে তোমার মানবাধিকার শুধু বিভিন্ন নামে বেনামের চুক্তি এবং কনভেনশন এর পাতায় আবদ্ধ থাকবে।   কথা হচ্ছে কোনো দেশ চাইলেই কি যুদ্ধে জড়াতে পারে? নিঃসন্দেহে এর উত্তর হলো না। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে কিছু ক্ষেত্র বিশেষে একটি দেশ অন্য দেশকে আক্রমণ করার বৈধতা পায়, তার মধ্যে জাতিসংঘ সনদ (UN charter) এর ৫১ নং অনুচ্ছেদ অনুসারে যদি কোনো দেশ সশস্ত্র আক্রমণের শিকার হয়, তাহলে সেই দেশ নিজের আত্মরক্ষার নিমিত্তে যুদ্ধ করতে পারে। অন্যদিকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন (UNSC Authorization) কর্তৃক যদি কোনো দেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা হুমকি বিবেচনায় সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয় তাহলে সেই দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যাবে। অন্য ক্ষেত্রে কোনো প্রকার যুদ্ধ মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু এখন যে চিত্র দেখা যায়, তা হচ্ছে এক দেশের সশস্ত্র গোষ্ঠী যদি অন্য দেশে আক্রমণ করে তাহলে সেই দেশ জাতিসংঘ সনদের ৫১ নং অনুচ্ছেদকে পুঁজি করে ঐ দেশে হামলা করে।   যা মোটেও কাম্য নয় এবং এই বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। এখানে ৫১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আক্রান্ত দেশ সেই সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নিজের আত্মরক্ষার অধিকারী হয়। আমরা যদি গাজা কিংবা কিছুদিন আগের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের দিকে তাকাই তাহলে এখানে অস্পষ্ট একটি গোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে নিরীহ মানুষ হত্যা করা ছাড়া আর কিছুই নয়। উল্লেখ্য যে, এমন ঘটনা মোটেও নতুন নয়। অপরদিকে জাতিসংঘ সনদের ২(৪) অনুচ্ছেদের দিকে নজর দিলে দেখা যাবে, যদি কোনো দেশ অন্য আরেকটি দেশের ওপর নিছক অজুহাতে আক্রমণ করে তাহলে তা আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ যুদ্ধ বা 'war of aggression' বলে বিবেচিত হবে। এর যথাযথ একটি উদাহরণ হতে পারে ২০০৩ সাল যুক্তরাষ্ট্রের ইরাকের ওপর আক্রমণ, যা নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছিল। চিন্তার বিষয় হলো, ধরনের যুদ্ধ একের পর এক লেগেই আছে কেন? বা এর সমাধান কি হতে পারে? সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, এর অনেক কারণ রয়েছে। যার মধ্যে অর্থনৈতিক স্বার্থ ও প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি লোভ, রাজনৈতিক ক্ষমতা ও আধিপত্য বিস্তার করতে, জাতি, ধর্মীয় ও আদর্শগত বিভাজন, অস্ত্র ব্যবসা ও যুদ্ধ অর্থনীতি এবং দুর্বল রাষ্ট্রব্যবস্থা বা কূটনীতি, যার ফলে বিশ্বে কোনো না কোনো প্রান্তে একের পর এক যুদ্ধ বা আর্মড কনফ্লিক্ট লেগেই থাকে। এখানে আরও গুরুত্বপূর্ণ কারণ হতে পারে আইসিজে কর্তৃক প্রদত্ত করা রায় বাস্তবায়ন না হওয়া, যুদ্ধ বন্ধে জাতিসংঘের কার্যকর ভূমিকার অভাব।   এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোকে তাদের বিতর্কিত নীতি থেকে ফিরে আসতে হবে। যেমন- আমেরিকা এই নীতি অনুসরণ করে যে, কোনো দেশ যদি সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে আক্রান্ত দেশ সেই ভূখন্ডে সামরিক পদক্ষেপ নিতে পারবে। যুদ্ধের চেয়ে মানবিকতাকে প্রাধান্য দেয়া, আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করা, আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (ICJ)  এর এর রায় বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলোকে তাগাদা দিতে হবে এবং যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই জাতিসংঘকে আগভাগে পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলেই হয়তো বিশ্বে শান্তির হাওয়া বইতে পারে। যুদ্ধ কখনোই দীর্ঘমেয়াদি শান্তির পথ নয়, সামরিক ক্ষমতা নয় বরং আন্তর্জাতিক সংগতি, ন্যায়বিচার ও মানবিক মূল্যবোধই হতে পারে সত্যিকারের বিশ্বশান্তির ভিত্তি। 

বাংলাদেশে শিক্ষা ‘গবেষণা’

বাংলাদেশে শিক্ষা ‘গবেষণা’

একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন জানায়, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাথমিক স্তরে শতকরা ৭৫ ভাগ শিক্ষার্থী ভালোভাবে শিখছে না। তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বেশির ভাগ শিক্ষার্থী বাংলাই ভালোভাবে পড়তে পারে না, গণিত ও ইংরেজির অবস্থা আরও খারাপ। পঞ্চম শ্রেণির শতকরা মাত্র ২৫ ভাগ শিশু বাংলায় এবং ৩৩ ভাগ গণিতে আশানুরূপ দক্ষতা অর্জন করতে পারছে, যার অর্থ শতকরা ৭৫ ভাগ ও ৬৭ ভাগ শিশু আশানুরূপ দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। এর চেয়ে ভয়াবহ তথ্য হলো এর পরও এসব শিশুর অনেকে উপরের শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হচ্ছে। প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংকের শিক্ষাবিষয়ক পর্যবেক্ষণের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, যেসব শিক্ষার্থীর শেখার মাত্রা খারাপ তাদের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ না করেই ঝরে পড়ার ঝুঁকি বেশি। ঝরে পড়ার পর এক পর্যায়ে তারা অনানুষ্ঠানিক কর্মবাজারে প্রবেশ করে। সঙ্গত প্রশ্ন জাগে- কেন তারা ঝরে পড়ে অনানুষ্ঠানিক কর্মবাজারে প্রবেশ করে? ‘শিক্ষাই জীবনের মূল, ঝরে পড়া বিরাট ভুল।’ কার ভুল? বক্তব্যের ধরনে মনে হয় শিক্ষার্থীর। বিদ্যাশিক্ষার গুরুত্ব না বুঝে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয় ছেড়ে মাঠে গিয়ে কৃষক বাবা, রাস্তায় গিয়ে দিনমজুর বা কারখানার শ্রমিক বাবার সঙ্গে কাজ করছে। ঝরে পড়া বা ড্রপআউট নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের পরিসংখ্যান গবেষণা ইত্যাদি হয়েছে। সে সবের জন্য বিদেশ থেকে কোটি কোটি টাকাও এসেছে। শোনা যায়, একবার পাশ্চাত্যের এক পশু মনস্তত্ত্ববিদ এসেছিলেন এদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অধ্যয়নরত মানব শিশুদের ওপর শিক্ষাবিষয়ক গবেষণা করতে। এখন অবশ্য দেশেই প্রচুর বিশেষজ্ঞ আছেন। যারা প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে নতুন নতুন নিরীক্ষা করছেন। নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করছেন। এক পদ্ধতি ঢাক ঢোল পিটিয়ে চালু হল- কয়েক বছর চলল। তারপর আরেক দল আরেক পদ্ধতি আবিষ্কার করে চালালেন আরও কয়েক বছর। দেখা গেল এ পদ্ধতি তেমন ফল দিচ্ছে না সুতরাং আবার বদল। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর। বলার অপেক্ষা রাখে না এর সঙ্গে রাজনৈতিক ওঠানামা বা ক্ষমতা বদলের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। কথা হচ্ছে এত গবেষণা পরীক্ষা নিরীক্ষা, এত অর্থব্যয়ের পরও ঝরে পড়া বন্ধ হয়নি কেন? কারণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যারা পড়ে তাদের বেশির ভাগের জীবন আবর্তিত হয় প্রচণ্ড অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায়। ঝরে পড়া এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা একে অন্যের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। এদের জীবনের অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার স্থায়ী সমাধানের কথা দেশি বিদেশি কোনো গবেষকই বলেন না। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর না করে ঝরে পড়া সম্পর্কে যত সদুপদেশ দেওয়া হোক কাজের কাজ কিছুই হবে না। আমাদের দুর্ভাগ্য, উনিশ শতকে সেই যে টমাস ব্যাবিংটন মেকলে বাঙালি শিক্ষিত ভদ্রলোকের চরিত্র বৈশিষ্ট্য ডিজাইন করে দিয়েছিলেন হুবহু সে অনুযায়ী আজও চলছে শিক্ষিত ভদ্রলোকের সমাজ। যারা গণমানুষ থেকে নিজেদের সব সময় বিচ্ছিন্ন মনে করে। ঔপনিবেশিক কূটবুদ্ধি খাটিয়ে এই শিক্ষিত এলিট শ্রেণির হাতে নিম্নবিত্তের শিক্ষার ভার ছেড়ে দিয়েছিলেন মেকলে। কিন্তু শিক্ষায় জ্ঞান গরিমায় বিকশিত হয়ে নিজেদের যারা দেশের অধিকাংশ মানুষ থেকে উন্নত জাতের মানুষ ভাবে তারা তাচ্ছিল্য ভরে সে দায়িত্ব প্রত্যাখ্যান করে। যাদের দেখে নাক সিটকে দশ হাত দূরে থাকেন তাদের শিক্ষিত করা এদের পক্ষে সম্ভব নয় জেনেই মেকলে এ দায়িত্ব ওই শিক্ষিত এলিটদের ওপর দিয়েছিলেন। এখানকার এলিট শ্রেণির জন্ম সমাজ বিকাশের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হয়নি। ঔপনিবেশিক প্রভুর উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য এদের জন্ম হয়েছিল। চিরকাল তারা প্রভুভক্ত থেকেছে। সেই যে ব্রেনওয়াশ হয়েছিল তা থেকে বেরোতে পারেনি আজকের স্বাধীন বাংলাদেশও। বিচ্ছিন্নতার সেই ধারাটি এখনো সমান বহমান। একটি  সমাজ কাঠামো গঠনের জন্য যতটুকু দক্ষতা প্রজ্ঞা শিক্ষা ও উদারতা  প্রয়োজন তা আজও অর্জিত হলো না। ভিন্ন ফর্মে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থাই চলছে। এক দিকে উচ্চশিক্ষার লাভজনক ব্যবসার উচ্চকিত আলোয় চোখ ঝলসে যায়, অন্যদিকে শিক্ষাব্যবস্থার ভিত তলিয়ে আছে গভীর অন্ধকারে। বদ্ধ ডোবার মতো অবস্থা তার। মাঝে মাঝে নিরীক্ষার ঢিল পড়ে সামান্য ঢেউ ওঠে। দ্রুতই মিলিয়ে যায় তা। তারপর আবার ঘোর অন্ধকার। এমন অদ্ভুত  শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে একটি দেশের পক্ষে কতটুকু এগুনো সম্ভব? অল্প কিছু মানুষ, যাদের হাতে প্রচুর টাকা তারা তা দিয়ে সন্তানের জন্য শিক্ষা কিনছে। তারা জনসংখ্যার কতভাগ? হয়তো দশ ভাগ কিংবা আরেকটু বেশি। বাকি বিশাল জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ নিয়ে সত্যিই কি ভাবনা আছে কারো?  শুরুতে যে প্রতিবেদনের উল্লেখ করেছি সেখানে এ বিষয়ে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীরা কী শিখছে, কী করে শিখছে এবং সামগ্রিকভাবে কতটুকু বুঝতে পারছে, তা প্রবলভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন শিক্ষকরা। এ শিক্ষকদেরও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ নেই। তারা বাধা ধরা পদ্ধতিকে মুখস্থ পড়ান। পড়ানোর বিষয়ে তাদের জ্ঞানের অপ্রতুলতা শিক্ষার্থীদের শেখার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।  শিক্ষকদের গুণগতমানের প্রশ্ন তো আছেই, প্রশ্ন আছে শিক্ষার্থীদের মান নিয়েও। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মূলত কারা? অশিক্ষিত নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা। এদের মধ্যে কেউ কেউ মাধ্যমিক স্তর পেরিয়ে কলেজ পর্যন্ত পৌঁছতে পারলেও বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চতর স্তরে পৌঁছানো এদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত পৌঁছানো তো সুদূরপ্রসারী ঘটনা, প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পৌঁছতেই ঝরে যায় অনেকে। সামান্য সচ্ছল অভিভাবকও সন্তান নিয়ে কিন্ডারগার্টেন বা ওই মানের অন্য স্কুলে ছোটেন। তারা সন্তানের প্রতিদিনের পড়াশোনা তদরকির বিষয়ে প্রখর সচেতন। শিক্ষকরাও অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি সচেতন। সন্তানকে উচ্চশিক্ষার শিখর পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েই অভিভাবকরা তার শিক্ষার ভিতের প্রতি মনোযোগী হন। কিন্তু অশিক্ষিত নিম্নবিত্ত যে অভিভাবক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিজের সন্তানকে পাঠান তার সচেতনতা ওই পাঠানো পর্যন্তই। তিনি জানেন না, সন্তান স্কুলে কি পড়ছে। ভুল শিখছে কিনা। শিক্ষককে ভুলের জন্য অভিভাবকের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর মতো বিদ্যা বা অর্থের জোর তার নেই। দেশ ভাগের পর ১৯৪৭ সাল থেকে স্বাধীনতা পর্যন্ত দেশের প্রাথমিক শিক্ষার ধারাবাহিক ইতিহাস নিম্নমুখী। সাতচল্লিশ সালে সে সময়ের পূর্ব পাকিস্তানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ২৯ হাজার ৬৩৩টি। ১৯৭০ সালে তা নেমে আসে ২৯ হাজার ২৯টিতে। একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি প্রাথমিক শিক্ষা। সেখানে ঘাটতি থাকলে উচ্চ শিক্ষায় যত চাকচিক্য থাক শিক্ষাব্যবস্থাটা ঠিক মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর অবস্থা এখনো করুণ। বেসরকারি প্রাথমিকের অবস্থা তো ভয়াবহ।  ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষাকে পুরোপুরি জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অতগুলো প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে সরকারি করা সম্ভব নয় বলে সে সময় ধাপে ধাপে করার জন্য কয়েক বছর সময় নেওয়া হয়েছিল। প্রথম পাঁচশালা পরিকল্পনায় পাঁচ হাজার নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছিল। চুয়াত্তর সালে কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে বাড়িয়ে আট বছর করা এবং তিরাশি সালের মধ্যে তা বাস্তবায়নের সুপারিশ করে। তাদের প্রস্তাব ছিল, আট বছরের প্রাথমিক শিক্ষা হবে সার্বজনীন বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক। গত আওয়ামী শাসন আমলের প্রথম দফায় শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও জাতীয় শিক্ষানীতিতে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলেছিলেন। কিন্তু প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র বলেছিল এ প্রস্তাব বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব। তাদের মতে, এটা করতে হলে সরকারি-বেসরকারিসহ প্রায় ৮০ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নতুন করে শিক্ষক নিয়োগ এবং অবকাঠামো সুবিধা বাড়াতে হবে। এ সংক্রান্ত যেসব প্রস্তাব ছিল তা বাস্তবায়ন করতে যে টাকা ও অবকাঠামো সুবিধা প্রয়োজন তা নিশ্চিত করতেই তাদের মতে ছ’সাত বছর লাগবে। ছ’সাত বছরের বেশি সময় তারা পেয়েছিল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। অন্য সব সেক্টরের মতো লুটাপাটই হয়েছে শুধু।

বাণিজ্য চাপে আবাসিক এলাকা

বাণিজ্য চাপে আবাসিক এলাকা

ঢাকার কিছু আবাসিক এলাকায় এত বেশি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে যে, আবাসিক এলাকা তার বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদা হারিয়েছে। রাজধানীর আবাসিক এলাকা থেকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের সক্রিয় তৎপরতা তেমন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এক দশক আগে মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও দৃশ্যমান কোনো ইতিবাচকতা লক্ষ্য করেনি ঢাকাবাসী। রাজধানীর আবাসিক এলাকায় কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ঢালাওভাবে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে এবং তা এখনো অব্যাহত রয়েছে। এ অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার নিরসন জরুরি। এ বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) বিশেষ অভিযান পরিচালনা জোরদার করুক- এমনটা প্রত্যাশিত ছিল। সেটি হয়নি। রাজধানীর ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকার আবাসিক বৈশিষ্ট্য ও রূপ অক্ষুণ্ন রাখতে সরকারের ওপর মহল ছাড়াও ২০১২ সালে এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। তারপরও রাজউকের ব্যর্থতার কারণে শুধু ধানমণ্ডি নয়, গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরাসহ সব আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। তাই এসব এলাকায় নবাগত লোকদের মনে দ্বন্দ্ব জাগতেই পারে- এলাকাগুলো আবাসিক নাকি বাণিজ্যিক! ধানমণ্ডির মতো বৃহত্তম আবাসিক এলাকায় হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর সবই লাগবে। তবে পরিমিত মাত্রায়। সব হতে হবে প্রাণ, প্রকৃতি ও প্রতিবেশবান্ধব। বর্তমানে এসবের কিছুই হচ্ছে না। ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকা তার চরিত্র বহু বছর আগেই হারিয়েছে। এখানে যে ভবনগুলোতে হাসপাতাল চালু রয়েছে, সেগুলো মূলত আবাসিক ভবন। ধানমণ্ডির স্থায়ী বাসিন্দাদের এমনটাই অভিমত। লালমাটিয়ার আবাসিক ভবনগুলোতে গড়ে উঠেছে বাণিজ্যিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এর ফলে এক সময়ের নিরিবিলি আবাসিক এলাকা হিসেবে পরিচিত লালমাটিয়ায় এখন যানবাহনে গিজগিজ করে। এ দুই এলাকার বাসিন্দাদের জন্য রয়েছে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, নান্দনিক লেক, খেলার মাঠ ও প্রশস্ত রাস্তা। কিন্তু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের দাপটে এ দুই আবাসিক এলাকার যে সুনাম, তা ক্ষুণ্ন হচ্ছে। আবাসিক এলাকার বাণিজ্যিকীকরণ ঠেকাতে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। তারা কী ভূমিকা রেখেছে? গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরের মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী আবাসিক এলাকার প্লটগুলোতে নির্দিষ্ট কার্যক্রমের বাইরে বাণিজ্যিক ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালা-২০২৩ খসড়ায় বলা আছে, কোনো ইমারত/স্থাপনা বসবাস বা ব্যবহারের সনদপত্রে উল্লিখিত ব্যবহারের উদ্দেশ্যবহির্ভূত অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না। অন্যথায় ইমারত নির্মাণ আইন ও অন্যান্য আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ইতোমধ্যে ৩ হাজার ১৯২টি অবৈধ ভবন চিহ্নিত করেছে। এই অবৈধ ভবনগুলোর উচ্ছেদ কার্যক্রম রাজউক কবে শুরু করতে পারবে? জনমনে প্রশ্ন, দশকের পর দশক ধরে এমন সব অপকর্ম কীভাবে বিস্তার লাভ করল?