ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৬ মার্চ ২০২৫, ২ চৈত্র ১৪৩১

মতামত

মতামত বিভাগের সব খবর

ছাফিনা আরব জাহাজের বিদ্রোহ থেকে মুক্তিযুদ্ধে

ছাফিনা আরব জাহাজের বিদ্রোহ থেকে মুক্তিযুদ্ধে

রাজশাহী জেলার তৎকালীন নাটোর মহকুমার বাসুদেবপুর ইউনিয়নের বিপ্রবেলঘরিয়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম মোহাম্মদ আজাদ একাত্তর সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লাহোর ফ্রট ব্যাটালিয়নে কর্মরত ছিলেন। তাকে বদলি করা হয় পূর্ব পাকিস্তানের রংপুর ক্যান্টনমেন্টের ৩৩ এমসি ব্যাটালিয়নে। ২ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি বন্দর থেকে পরিবার নিয়ে অন্যদের সঙ্গে ছাফিনা আরব জাহাজে আসার সময় ৬ মার্চ কলম্বো বন্দরে জাহাজটি তেল নেওয়ার জন্য থামলে পরের দিন ৭ মার্চ ওয়্যারলেসের মাধ্যমে শুনতে পেলেন ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীনতার পক্ষে দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। জাহাজটিতে থাকা অফিসারসহ সৈনিকদের আশিভাগই ছিলেন স্বাধীনতাকামী বাঙালি। এ জাহাজে ছিলেন মেজর আবদুল লতিফ খান, লেফটেন্যান্ট রফিক, লেফটেন্যান্ট হারিছ, লেফটেন্যান্ট গোলাম মুক্তাদিরসহ অনেকেই। বিশেষ বার্তায় তখনই তাদের পশ্চিম পাকিস্তান ফেরার নির্দেশ দেওয়া হলে বাঙালি অফিসার ও সৈনিকেরা। বিদ্রোহ ঘোষণা করে জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে নেওয়ার জন্য মেজর আবদুল লতিফ খানের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। ১৭ মার্চ জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে পৌঁছালে অসহযোগ আন্দোলনকারীরা জাহাজে বাঙালিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র-গোলাবারুদ আনা হয়েছে অভিযোগ দিয়ে জাহাজটি বন্দরে আসতে বাধা দিয়ে পাহারা দিতে থাকে। কিছু সৈনিক জেলেদের নৌকা করে চলে যায়। আবুল কালাম আজাদ ও কয়েকজন পরিবার নিয়ে জাহাজের মধ্যেই অবস্থান করেন। ২২ মার্চ রাত তিনটার দিকে জাহাজের কাছে ট্রলার এলে মেজর লতিফ খান খালি হাতে সাধারণ পোশাকে সকলকে পরিবার নিয়ে ট্রলারটিতে নামতে বলেন। চট্টগ্রাম বন্দর ট্রানজিট ক্যাম্পে পৌঁছানোর পরের দিন সকালে মেজর আবদুল লতিফ খান সাদা কাগজে সই করে এক সপ্তায় ছুটি মঞ্জুর করে সকলকে বিদায় দেন। আবুল কালাম মোহাম্মদ আজাদ পরের দিন ২৩ মার্চ চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন থেকে বগুড়া সান্তাহারগামী ট্রেনে ওঠেন। তিনি দেখেন, বিভিন্ন রেলওয়ে স্টেশনে অসহাযোগ আন্দোলনকারীদের ট্রেনে তল্লাশি চালাচ্ছে। ২৫ মার্চ দুপুরে সান্তাহারে পৌঁছে তিনি তার পরিবারকে নওগাঁয় রেখে রংপুর ক্যান্টনমেন্টে না গিয়ে দেখা করেন নওগাঁ ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) ৭নং উইং হেড কোয়ার্টারের বাঙালি মেজর নাজমুল হকের সঙ্গে। তাকে জানান স্বাধীনতার পক্ষে তার অবস্থানের কথা। মেজর নাজমুল হকের নেতৃত্বে কিছু বাঙালি ইপিআর ছাত্র তরুণ যুবকদের ঐক্যবদ্ধ করা শুরু করেন। ট্রেনিং নেওয়া তরুণ-যুবকদের সঙ্গে নিয়ে অ্যাকশন করেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আর্মস স্টোর রুমে। সংগ্রহ করে নেন কিছু অস্ত্র। নিহত হয় বেশকিছু পাকিস্তানি সেনা। বাকিরা আত্মসমর্পণ করে। গড়ে তোলেন প্রতিরোধ। ১৯ এপ্রিল ঢাকা থেকে আসা পাকিস্তানি সৈন্যরা নাটোর-নওগাঁ অঞ্চল দখল করে নিলে আবুল কালাম আজাদ একটি ট্রাকে স্কুল-কলেজের কয়েকজন ছাত্র-তরুণ যুবকদের নিয়ে বিকেলে জলঘর সীমান্ত দিয়ে পৌঁছান ভারতের পশ্চিম দিনাজপুরের বালুরঘাটে। সেখানে কংগ্রেস অফিসে দেখা গেলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক নওগাঁর রাজনৈতিক বাক্তিত্ব এমএ জলিলের। তিনি তাকে নির্দেশ দেন সীমান্তের ওপারে শিববাটি প্রাইমারি স্কুলে দায়িত্ব পালনের। নির্দেশ দিলেন, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, নওগার তরুণ যুবকরা স্লিপ নিয়ে তার কাছে গেলে তিনি যেন তাদের দোতলায় থাকার ব্যবস্থা করেন। নিচে থাকবে বগুড়া জয়পুরহাট হিলি অঞ্চল থেকে যাওয়া তরুণ-যুবক ও অন্যারা। কড়া নির্দেশ দিলেন দোতলা থেকে কেউ যেন নিচে না নামে। কেউ আইন অমান্য করলে যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী শাস্তি দেওয়ার জন্য। এও জানান, বালুরঘাট ক্যাম্প থেকে এ ক্যাম্পে খাদ্যসামগ্রী পাঠানো হবে। শেষ রাতের দিকে কয়েকজন স্কুলটির নিচতলায় বগুড়া ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে নিয়ে যাওয়া টাকাগুলো মেঝেতে ঢেলে দিতে থাকলে আবুল কালাম মোহাম্মদ আজাদ  খবরটি বালুরঘাটে পৌঁছে দেন। শেখানে সতর্কতা জারি করা হয়। এ ক্যাম্পে স্থান সংকুলান না হওয়ায় বালুমাটি থেকে বারোমাইল দূরে বাঙালিপুর প্রাইমারি স্কুলে আরও একটি ক্যাম্প খুলে আবুল কালাম মোহাম্মদ আজাদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কামারপাড়ায় ৭ নং সেক্টরের ছেড কোয়ার্টার স্থাপন করে মেজর নাজমুল হক ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরীকে তার টুআইডি করে আবুল কালাম মোহাম্মদ আজাদকে ট্রেনিং সুপারভাইজারের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হলো পতিরাম ইয়ুথ ক্যাম্পে। মিত্র বাহিনীর ক্যাপ্টেন এসএস সিরোহীর তাঁবুতে আবদুল জলিল তাকে ডেকে পাঠিয়ে অনুরোধ করলেন সীমান্তের এপারে থাকা তার বাবা ফয়েজ মিয়াকে ভারতে নিয়ে যেতে। খরচের টাকা ঠিকানা ও চিঠি লিখে দেওয়ার পর আবুল কালাম আজাদ অস্ত্র ও নক্সা নিয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে বালুরঘাট পৌঁছালে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টুও তাকে অনুরোধ করল তার স্ত্রী ছেলেমেয়েদের ভারতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। পাকিস্তানি সৈন্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে দুদিন পর আবুল কালাম আজাদ উত্তর গ্রামের চেয়ারমানের বাড়িতে দেখা পেলেন জাকারিয়া পিন্টুর স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের। রামপুরে দাদার বাড়িতে দেখা পেলেন মা বাবা চাচা-চাচিসহ অন্যদের। শেল্টার নেন এ বাড়ির মুরগির খামারে। আবদুল জলিলের চিঠি ও দেওয়া ঠিকানা নিয়ে বড় ভাই আবদুল খালেক ও দুলাভাই সোলেমান আলী মোল্লার সঙ্গে দীঘলি বিলের বোয়ালি গ্রামে দেখা পেলেন আবদুল জলিলের বাবা ফয়েজ মিঞা ও চাচাতো ভাই হারুনের। আবুল কালাম মোহাম্মদ আজাদের সঙ্গে কথা বলে তারা মহিষের গাড়ি করে তাকে তাদের কাছে নিয়ে আসেন। এরপর এক সঙ্গে নওগাঁর নিয়ামতপুরের থানার শীসোলের সোনপুর গ্রামে গিয়ে আবুল কালাম আজাদ দেখা পেলেন স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের। তাদেরও সঙ্গে নিয়ে গেলেন জাকারিয়া পিন্টুর স্ত্রী, ছেলেমেয়েদের কাছে। দুইশত টাকায় এক সাহায্যকারীর মাধ্যমে মধ্যরাতে পৌঁছালেন ঠসা হাজির বাড়িতে। তার সহযোগিতায় পরের দিন সন্ধ্যায় ১০০ টাকায় এক সাহায্যকারীর সাহায্যে বিলের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় ডাকাতরা হামলা করলে তিনি গ্রেনেড ও স্টেনগান ব্যবহার করলে ডাকাতরা পালিয়ে যায়। পরের দিন সকাল ৯টায় রাজা হরিশচন্দ্রপুর মন্দিরে কিছু খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে বিকেল ৫টার দিকে বালুরঘাটে পৌঁছে আবদুল জলিল ও জাকারিয়া পিন্টুর সঙ্গে দেখা করে শেষ করেন তাকে দেওয়া দায়িত্ব। স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের পতিরামপুরের চেয়ারম্যান পরেশ উল্লার বাড়িতে রেখে টিএস হিসেবে যোগ দেন পতিরামপুর ক্যাম্পে। ১৪ আগস্ট রাত ৩টায় কমান্ডার নওগার শফিক খান, কমান্ডার রাজা কবিরাজ, আলমগীর কবীর, নাটোরের হাসানুজ্জামান ভুলু, তাহের, ফারুক, কার্তিকসহ অন্যদের নিয়ে বাগমারা থানায় অ্যাকশন করে বারোটি রাইফেল সংগ্রহ করেন। অংশ নিতে থাকেন বিভিন্ন অ্যাকশন অপারেশনে। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি পাকিস্তানি সৈন্যরা নওগাঁর ধানকুড়িতে তার চাচার শ্বশুর বাড়িতে চল্লিশ জনকে হত্যা করে। লেখক : সাংবাদিক

হাইব্রিড ধানের বীজের বিড়ম্বনা

হাইব্রিড ধানের বীজের বিড়ম্বনা

ভূখন্ড ছোট হলেও বৈচিত্রে ভরপুর কৃষির এই বাংলাদেশ। কৃষির সিংহভাগ দখল করে আছে ধান। বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য হিসেবে আমাদের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এর প্রভাব অত্যন্ত প্রবল। প্রকৃতপক্ষে, ধান আমাদের জীবনের নিত্য অনুষঙ্গ এবং বলা যায় গ্রামে এখনো ‘ধানই ধন’ বলে মনে করা হয়। এদেশে বছরব্যাপী বিভিন্ন পরিবেশ ও বিভিন্ন  মৌসুমে নানা প্রকারের ধান চাষ হয়ে থাকে। মোটাদাগে বলতে গেলে ৫৬ লাখ হেক্টর জমিতে রোপা আমন, ৪৭ লাখ হেক্টরে বোরো, ৯ লাখ হেক্টরে আউশ এবং ৪ লাখ হেক্টরে জলি আমন ধানের আবাদ হয়। জলি আমন ধানের পুরো এলাকাই বপন পদ্ধতির আওতায় রয়েছে। তাছাড়া আউশ   মৌসুমের ধান চাষেও প্রায় এক-চতুর্থাংশ জমিতে বপন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এই দুটি অঙ্ক বাদ দিলে বাকি প্রায় ১১০ লাখ হেক্টর জমিতে ধান চাষের ক্ষেত্রে একমাত্র রোপণ পদ্ধতিই ব্যবহার করা হয়। সফলভাবে ধান উৎপাদনের জন্য প্রতি হেক্টর জমিতে ৩ লাখ গুছি প্রয়োজন হয়। বীজ কৃষির প্রথম এবং প্রধান ভিত্তি। ফসল উৎপাদনের অন্য সব কৃষি উপকরণের কমতি, ঘাটতি বা অনুপস্থিতিতেও ভিন্নমাত্রায় ফলন আসে। কিন্তু বীজ ব্যতীত কোনো ফলনই আশা করা যায় না। কাক্সিক্ষত ফসল উৎপাদনে বীজের স্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণ অন্যতম প্রধান শর্ত। আমাদের দেশের কৃষকরা প্রচলিত ধারায় ফসল উৎপাদন করে এবং এর সঙ্গে উৎপাদিত ফসলের একটি অংশ বীজ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কিন্তু বিশেষ যত্ন ও পরিচর্যা সুনিশ্চিত করে বীজ উৎপাদন কৌশল সম্পর্কে আপামর কৃষক এখনো তেমন সচেতন নন। গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিএডিসির ডিলার/ বিশুদ্ধ কোম্পানি/ ডিলার/ নিকটাত্মীয়/ বিশ^স্ত বীজ উৎপাদনকারী থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। বীজতলায় সঠিক প্রযুক্তি অনুসরণ করে চারা উৎপাদন করলে একটি চারাই একটি গুছির জন্য যথেষ্ট হয়। সুতরাং এক হেক্টর জমি রোপণের জন্য ৩ লাখ চারা ব্যবহার করলেই চলে। সে হিসেবে ৩ লাখ বীজধান বীজতলায় বপন করতে হবে। বর্তমানে যেসব জাতের ধান চাষ করা হয়, সেগুলোতে একটি বীজের ওজন সর্বোচ্চ ২৫ মিলি গ্রাম হয়ে থাকে। তাই উল্লিখিত প্রয়োজনীয় বীজের পরিমাণ দাঁড়ায় ৭.৫ কেজি। মাঠপর্যায়ে ংধভবঃু ধষষড়ধিহপব হিসেবে সাধারণত ২০ শতাংশ অতিরিক্ত বীজ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এক হেক্টর জমিতে ধান রোপণ করতে সর্বোচ্চ ৭.৫দ্ধ১.২০ = ৯ (নয়) কেজি বীজ প্রয়োজন। এখন জাতীয় পর্যায়ে সারা দেশের চিত্র অবলোকন করা যেতে পারে। প্রতি হেক্টর জমিতে ধান রোপণের জন্য বীজতলায় যে পরিমাণ বীজ বপন করা হয়, তার পরিমাণ গড়পড়তা ন্যূনতম ৫০ কেজি। প্রচলিত পদ্ধতিতে উৎপাদিত চারা অত্যন্ত ক্ষীণ ও দুর্বল হয়। তাই প্রতি গুছিতে ৪-৭ টা চারা রোপণ করা হয়। এতে করে প্রতি হেক্টরে ৪১ কেজি বীজ অতিরিক্ত ব্যবহার করে শুধুই অপচয় করা হচ্ছে। সারা দেশে ১১০ লক্ষ হেক্টর জমিতে ধান রোপণ করতে ৪.৫১ লাখ টন বীজ ধান অযথাই মাটির নিচে পুঁতে ফেলা হচ্ছে। দেশে চাল আমদানির পরিসংখ্যানে সর্বশেষ বার্ষিক আমদানির পরিমাণ ৩ লাখ টন। পক্ষান্তরে অপচয়কৃত বীজ ধান থেকে ঠিক ৩ লাখ টন চাল পাওয়া সম্ভব ছিল। অর্থাৎ অপচয় এবং আমদানির পরিমাণ একেবারেই সমান সমান। এ অপচয় রোধ করতে পারলে দেশে আপাতত চাল আমদানি করা দরকার হবে না। এখন প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, এ অপচয় কেন করা হচ্ছে। উত্তর খুবই সহজ। ধানের বীজ অত্যন্ত সহজলভ্য ও সস্তা বিধায় কৃষক ভাইয়েরা এটাকে কিছুই মনে করেন না এবং এটা যে অপচয় তা মেনে নিতেও নারাজ। এটি হচ্ছে সাধারণ চিত্র। দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, এ অপচয় রোধ করা কি সম্ভব? এ পশ্নের উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ। তবে প্রথম প্রশ্নের মতো এত সহজ নয়। একজন কৃষকের জন্য ব্যক্তিগত পর্যায়ে এ চিন্তা করার দরকার নেই এবং তার দায়িত্বের মধ্যেও পড়ে না। এ ভাবনাটি জাতীয় পর্যায়ের। গবেষক, সম্প্রসারণ কর্মী এবং নীতিনির্ধারক গোষ্ঠী থেকে সম্মিলিতভাবে এ প্রয়াস চালাতে হবে। এ প্রস্তাবনা শুধুই একটি কল্পনাবিলাসী গাণিতিক মডেল নয়। এটি যে বাস্তব এবং কৃষকগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এ প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন, তা সহজেই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানো যেতে পারে। কিছু কিছু হাইব্রিড ধানের বিভিন্ন জাতের চাষ হচ্ছে দেশের প্রায় সর্বত্রই। উৎপাদনকারী কোম্পানি তাদের বীজ বিপণন করার স্বার্থে এ স্লেøাগান সার্থকভাবে প্রয়োগ করেছেÑ ‘একটি মাত্র বীজ থেকে একটি সুস্থ সবল চারা, আর একটি মাত্র চারা থেকে একটি গুছি’। হাইব্রিড ধানের বীজ যেহেতু অনেক চড়া দামে বিক্রির টার্গেট নেওয়া হয়েছে, তাই চাষীগণকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য আগেভাগেই তারা এ প্রযুক্তির সফলতা প্রমাণ করেছে। আর সুকৌশলে কৃষককে একটি অশুভ বার্তাও পৌঁছে দিয়েছে যে, এ প্রযুক্তি শুধুই হাইব্রিড ধানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। দুঃখজনকভাবে এ বার্তাটিকে কৃষকসহ সর্বস্তরের সংশ্লিষ্ট মহল খুব ভালোভাবেই গিলেছে। কোম্পানির পক্ষে  স্লোগান দেওয়ার জন্য তো বুদ্ধিজীবীর কোনো অভাব হয় না। দেশ ও জাতির পক্ষে এ বিষয়টি দেখার জন্য কি কেউ দাঁড়াবে?   লেখক : সিনিয়র সাইন্টিফিক অফিসার, রাইস ফার্মিং সিস্টেমস বিভাগ, ব্রি, গাজীপুর

রোগ ব্যাধি থেকে মুক্ত রাখে রোজা

রোগ ব্যাধি থেকে মুক্ত রাখে রোজা

(প্রথম পাতার পর) আলোকোজ্জ্বল আমেজ-অনুভূতির চর্চা হয়, তা রমজানের রোজা ছাড়া অন্য কোনোভাবে লাভ করা যায় না। তাই রোগাক্রান্ত অবস্থায়ও অনেকেই রোজা রাখতে চান। অনেকে এমনও বলেন, ‘মরি মরব, বাঁচি বাঁচব, তবু রোজা ছাড়ব না’। আসলে রোজাদারের দৃঢ়তা আর মনোবল অবশ্যই রোজা রাখতে সহায়ক হয়। রমজানে বিশেষ করে যারা ডায়াবেটিস, পেপটিক আলসার বা গ্যাস্ট্রিক আলসার, শ্বাসকষ্ট, হার্টের রোগ, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদিতে ভুগছেন, তাদের সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে রোজা রাখা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলেও রোজা রাখতে তারা প্রবল আগ্রহী। তারা যদি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রোজার মাসের জন্য ওষুধ সেবনবিধি ঠিক করে নিতে পারেন, তবে সহজেই রোজা রাখতে পারেন। এতে রোজা ভাঙার বা রোজা থেকে বিরত থাকার কোনো প্রয়োজন হয় না। ডায়াবেটিক রোগী : রোজা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে রোগীদের জন্য এক সুবর্ণ সুযোগ ও রহমতস্বরূপ। ডায়াবেটিক রোগীরা সঠিক নিয়মে রোজা রাখলে নানা রকম উপকার পেতে পারেন। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মূল উপায় হলো খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, আর রোজা রাখা হতে পারে এক অন্যতম উপায়। এতে খাদ্য নিয়ন্ত্রণ সহজ ও সুন্দরভাবে করা যায়। যারা ইনসুলিনের ওপর নির্ভরশীল নন, তাদের ক্ষেত্রে রোজা রাখা হতে পারে আদর্শ চিকিৎসাব্যবস্থা। যারা ইনসুলিন নেন বা মুখে অন্য ওষুধ খান, তাদের ক্ষেত্রেও রোজা অবস্থায় ওষুধের মাত্রা কমাতে সহায়ক। তবে ডাক্তারের নির্দেশমতো ইনসুলিন বা মুখে খাওয়ার ওষুধ সমন্বয় করে নিতে হবে। শুধু রক্তের গ্লুকোজই নয়, রক্তের চর্বি নিয়ন্ত্রণেও রোজা মোক্ষম, উপকারী।  এর সঙ্গে সঙ্গে রোজা ডায়াবেটিক রোগীকে সংযম, পরিমিতিবোধ ও শৃঙ্খলার শিক্ষা দেয়, যা ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় অপরিহার্য। রক্তের কোলেস্টারল : যাদের শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি, রোজা তাদের কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সহায়তা করে। রোজা ভালো কোলেস্টেরল (এইচডিএল) বাড়াতে এবং মন্দ কোলেস্টেরল (এল ডি এল) ও ট্রাইগ্লিসারাইড কমাতে সাহায্য করে। ধূমপান : যারা ধূমপান ও নেশাজাতীয় দ্রব্য ব্যবহার করেন, রোজায় এগুলো পরিহার করার সুবর্ণ সুযোগ। এর ফলে ক্যান্সার, হৃদরোগ রোগ, স্ট্রোকসহ বহু জটিল রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। অতিরিক্ত ওজন : যাদের ওজন অতিরিক্ত, তাদের ক্ষেত্রে রোজা ওজন কমানোর জন্য এক সহজ ও সুবর্ণ সুযোগ। ওজন কমে যাওয়ায় বিভিন্ন রোগ থেকে বেঁচে থাকা যায় যেমনÑ উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগসহ শ্বাসকষ্টজনিত রোগ, বাতের ব্যথা, অস্টিওআরথ্রাইটিস, গাউট ইত্যাদি। আবার ওজন কমাতে পারলে কোলেস্টেরলের মাত্রাও কমে আসে। হৃদরোগ এবং উচ্চ রক্তচাপ : রোজার মাধ্যমে ডায়াবেটিস ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ হওয়ার ফলে যারা হৃদরোগে অথবা উচ্চ রক্তচাপে ভোগেন, তাদের জন্য রোজা অত্যন্ত উপকারী। এতে শরীরের, বিশেষ করে রক্তনালীর চর্বি হ্রাস পায়, রক্তনালীর এথারোসক্লেরোসিস কমাতে সাহায্য করে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় এবং উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। তবে ডাক্তারদের নির্দেশমতো ওষুধ চালিয়ে যেতে হবে। পেপটিক আলসার : একসময় ধারণা ছিল, পেপটিক আলসারে আক্রান্ত রোগীরা রোজা রাখতে পারবেন না। তাদের ঘন ঘন খেতে হবে, অনেকক্ষণ পেট খালি রাখা যাবে না। অনেকে মনে করেন, রোজা পেপটিক আলসারের ক্ষতি করে এবং অ্যাসিডের মাত্রা বাড়ায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এসব ধারণা ঠিক নয়। রোজায় নিয়ন্ত্রিত খাওয়া-দাওয়ার ফলে অ্যাসিডের মাত্রা কমে যায়। তাই সঠিকভাবে রোজা রাখলে এবং সঠিক খাবার দিয়ে  সেহরি ও ইফতার করলে রোজা বরং আলসারের উপশম করে, অনেক সময় আলসার ভালো হয়ে যায়। এছাড়া রোজা গ্যাস্ট্রাইটিস, আই.বি.এস ইত্যাদি রোগেও উপকারী। প্রয়োজনে গ্যাস্ট্রিক-আলসারের ওষুধ রাতে একবার বা দুবার ব্যবহার করা যায়। শ্বাসকষ্ট বা এজমা রোগী : যারা এইসব রোগে ভোগেন, তাদেরও রোজা রাখতে কোনো অসুবিধা নেই। রোজায় এ ধরনের রোগ সাধারণত বাড়ে না, বরং চিন্তামুক্ত থাকায় এবং আল্লাহর প্রতি সরাসরি আত্মসমর্পণের ফলে এই রোগের প্রকোপ কমই থাকে। প্রয়োজনে রাতে এক বার বা দুইবার ওষুধ খেয়ে নেবেন, যা দীর্ঘক্ষণ শ্বাস নিয়ন্ত্রণে রাখে। প্রয়োজনে ইনহেলার বা নেবুলাইজার জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা যায়। দিনের বেলায় জরুরি প্রয়োজনে ইনহেলার বা নেবুলাইজার ব্যবহার করা যায়, তাতে রোজা ভাঙবে না। কিডনি রোগ : যারা কিডনির রোগে আক্রান্ত তাদের রোজা রাখা যাবে না, এমন কোনো কথা নেই। যে সমস্ত রোগী ক্রনিক কিডনি ফেইলুরে আক্রান্ত তাদের সুনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করতে হয়, নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়, এমনকি পানি খাওয়ার ক্ষেত্রেও সতর্কতা ও পরিমাণ অনুযায়ী খেতে হয়। তাই রোজা রাখার ক্ষেত্রে তাদের বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। যাদের কিডনি ফেইলুরের মাত্রা একেবারে শেষ পর্যায়ে তাদের পক্ষে রোজা রাখা সম্ভব নয়। তেমনি যারা ডায়ালাইসিসের রোগী অথবা ইতোমধ্যে কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন, তাদের পক্ষেও রোজা রাখা প্রায় অসম্ভব। অল্প থেকে মধ্যম মাত্রার কিডনি ফেইলুর রোগীরা রোজা রাখলে কোনো ক্ষতি হয় না। তবে কিডনি আক্রান্ত রোগীদের শারীরিক অবস্থা যা-ই থাকুক না কেন, সর্বাবস্থায় একজন কিডনি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে রোজা রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়াই শ্রেয়। লিভারের অসুখ : লিভারের রোগীদের রোজা রাখা নির্ভর করে রোগটির ধরনের ওপর। কেউ যদি ভাইরাল হেপাটাইটিস নামক রোগে আক্রান্ত হন, তারা খেতে পারেন না, ঘন ঘন বমি হয়, রুচি নষ্ট হয়, জন্ডিস দেখা দেয়। অনেক সময় তাদের শিরায় স্যালাইন বা গ্লুকোজ দিতে হয়। তাদের পক্ষে রোজা না রাখাই ভালো। আবার যারা লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত তাদের যদি রোগের লক্ষণ কম থাকে তবে রোজা রাখতে পারেন। খারাপ লাগলে রোজা ভেঙে ফেলবেন। কোনো কোনো সময় সিরোসিস রোগীদের পেটে বা পায়ে পানি জমতে পারে, শরীরে গ্লুকোজের পরিমাণ কমে যেতে পারে। তাদের বেলায় রোজা রাখা ঝুঁকিপূর্ণ। প্রয়োজনে আলেম-ওলামাদের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। গর্ভাবস্থায় রোজা : গর্ভবতী মায়ের যদি শারীরিক কোনো জটিলতা না থাকে, তাহলে রোজা থাকতে কোনো বাধা নেই। বিশেষ করে প্রথম কয়েক মাস সহজেই রোজা রাখা যায়। রোজা রাখবেন কি রাখবেন না, তার জন্য ডাক্তারের সঙ্গে অবশ্যই পরামর্শ করা উচিত। রোজা রাখলে যদি মা বা সন্তানের কারও ক্ষতি হয় বা এ ব্যাপারে যদি ডাক্তারের কোনো নিষেধাজ্ঞা থাকে, তবে রোজা না রাখাই ভালো। বুকের দুধ খাওয়ানো : বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ালে রোজার কোনো ক্ষতি হবে না। রোজা রাখলে বুকের দুধ কমে যায় না। অবশ্যই সেহরি ও ইফতারের সময় প্রচুর তরল খাবার খেতে হবে। ইফতারের পর শোয়া পর্যন্ত প্রচুর পানি ও তরল খাবার খেতে হবে। উপসংহারে বলা যায়, রোজা যেহেতু আল্লাহ তাআলার জন্য এবং আল্লাহ এর পুরস্কার দেবেন, তাই কেউ যদি মনে করেন আমি আল্লাহর জন্যই রোজা রাখব, যা হওয়ার হবে, তার কোনো সমস্যাই হবে না। দৈহিক রোজার সঙ্গে সঙ্গে অন্তরের রোজাটাই আসল। তাই কোনো অজুহাত বা আলস্য করে রোজা পালন থেকে বিরত থাকা উচিত নয়। লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক

মাগুরার শিশুর জন্য শোকগাথা

মাগুরার শিশুর জন্য শোকগাথা

শৈশব মানে নিষ্পাপ হাসি। শৈশব মানে দৌড়ে বেড়ানো। শৈশব মানে রঙিন স্বপ্ন দেখা। কিন্তু ভয়াবহ এক বাস্তবতা শৈশবের ওপরও নেমে এসেছে। মাগুরায় আট বছর বয়সী এক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তার অপরাধ কী? সে শিশু? সে মেয়ে? নাকি এই সমাজে জন্ম নেওয়া এক অভিশাপ? মাগুরার আকাশ এখন অন্ধকারে ভরা। কন্টকের মতো বিঁধে আছে চারপাশের নিঃশব্দতা। আট বছরের একটি শিশুর দেহে নির্মমতার ছায়া পড়েছে। তার কণ্ঠে জমে থাকা চিৎকার এখনো ধ্বনিত হচ্ছে নির্জন গলির মেঝেতে। অন্ধ গহ্বরে ঘটে যাওয়া বীভৎসতা সমাজের বুকে এক গভীর ক্ষতের জন্ম দিয়েছে। মায়ের মুখ থেকে বেরিয়ে আসা অভিযোগের বাক্যগুলো ছুরির ফলার মতো খোদাই হয়ে গেছে ন্যায়বিচারের দরজায়। ধর্ষণের পর নির্যাতন, অবশেষে মুমুর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি থেকে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে মৃত্যু। ভুক্তভোগী এক অবুঝ শিশু। অপরাধী নিতান্ত প্রিয়জন। বলতে গেলে একই পরিবারের সদস্য। এই সমীকরণে মানবতার সকল সমার্থক শব্দ হারিয়ে যায়। শিশুটির বোনের স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি, ভাসুর আত্মার সম্পর্কের জালে জড়িয়ে থাকা চারটি নাম এখন নিষ্ঠুরতার প্রতিশব্দ। মেঝেতে পড়ে থাকা শিশুটির দিকে তাকিয়ে বোনের চোখে ঘুমের ঘোর। সে ভেবেছে, হয়তো স্বপ্নের ভেতর কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছে শিশুটি। কিন্তু বাস্তবতা ছিল তার চেয়েও ভয়ংকর। বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের আঙিনায় লুকিয়ে থাকা এই নির্মমতা নতুন নয়। জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি ও মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসাক) এর তথ্যমতে ২০২৩ সালে দেশে শিশু ধর্ষণের সংখ্যা ১,৪০০। ২০২৪ সালে এই সংখ্যা ১৭০০ এ উন্নীত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই আবার ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে। অংক কষলে দেখা যায় প্রতি ১২ ঘণ্টায় একজন কন্যাশিশু যৌন সহিংসতার মুখোমুখি হয়। বাংলাদেশে শিশু নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র প্রতিনিয়ত আমাদের হতবাক করে। শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্বের বহু দেশেই শিশু ধর্ষণ বেড়েছে। ইউনিসেফের তথ্যমতে বিশ্বে প্রতি পাঁচজনে একজন মেয়ে শিশুর শৈশবে যৌন সহিংসতার শিকার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের জরিপ অনুযায়ী ৬৮ শতাংশ শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে আত্মীয়ের বাসায়। মামলার এজাহারে উল্লিখিত ‘অনৈতিক প্রস্তাব’-এর ইতিহাস সামাজিক ব্যাধির দিকে ইঙ্গিত করে। মাগুরার শিশুটির বোনের বিয়ের পর থেকেই শ্বশুরের কুদৃষ্টি। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের জানা সত্ত্বেও নীরবতা। এই নীরবতাই তো সমাজের আসল অপরাধ। ভার্জিনিয়া উল্ফ মনে করেন, ‘শত্রুর চেয়ে নিরপেক্ষতার মুখোশ পরা আত্মীয়রা অধিক ভয়ংকর।’ আন্তর্জাতিক পরিসরে শিশু ধর্ষণের পরিসংখ্যান হৃদয়বিদারক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বের ১২ কোটি মেয়েশিশু যৌন সহিংসতার শিকার। বাংলাদেশের প্রচলিত আইন কঠোর। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ অনুযায়ী ১৬ বছরের কম বয়সী শিশুকে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। তারপরও কেন কমছে না অপরাধ? কেন আট বছরের শিশুকে নির্মমতার শিকার হতে হয়? সমস্যার মূল কোথায়? সামাজিক অবক্ষয়, নৈতিকতা হারিয়ে ফেলা মানুষ নাকি বিচারহীনতার সংস্কৃতি? অপরাধীরা জানে তারা ধরা পড়বে না। ধরা পড়লেও শক্তিশালী কেউ এসে রক্ষা করবে। ২০২১ সালে প্রকাশিত ব্র্যাকের গবেষণা দেখায় বাংলাদেশে ধর্ষণের ৯০ শতাংশ ঘটনার বিচার হয় না। অপরাধীরা ক্ষমতার ছায়ায় রয়ে যায়। শিশুরা রক্ষা পাবে কীভাবে? পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র তিনটি স্তরে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। পরিবারে নৈতিক শিক্ষার বুনিয়াদ গড়তে হবে। শিশুকে শেখাতে হবে, কী ভুল, কী সঠিক। স্কুলে যৌনশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যাবে না। উন্নত বিশ্বে ‘গুড টাচ, ব্যাড টাচ’ শেখানো হয় ছোটবেলা থেকেই। বাংলাদেশেও এমন শিক্ষা জরুরি। রাষ্ট্রকে কঠোর হতে হবে। কেবল আইন থাকলেই হবে না তার কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। ধর্ষণের বিচার দ্রুত শেষ করতে হবে। ২০২২ সালে দিল্লিতে একটি শিশু ধর্ষণের ঘটনায় মাত্র ৩৪ দিনে বিচার শেষ হয়েছিল। বাংলাদেশেও এমন ব্যবস্থা দরকার। সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ যথেষ্ট নয়। সমাধানও আসবে না। সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। ধর্ষকের পরিচয় গোপন না রেখে তাকে সমাজচ্যুত করতে হবে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য বলছে, ধর্ষণের শিকার ৭২ শতাংশ শিশু পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারে ভোগে। তাদের ৩৪ শতাংশ আত্মহত্যার চিন্তা করে। প্রতিটি ধর্ষিত শিশুর আর্তনাদ আমাদের বিবেককে নাড়া দেয়। কিন্তু আমরা কি বদলাচ্ছি? নাকি সামনের দিনে আরও কোনো আট বছরের শিশুর রক্তাক্ত নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখব? আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখনই। নয়তো শিশুর শৈশব হবে অনিরাপদ, মায়ের বুক ভাসবে চোখের পানিতে আর আমরা শুধু লজ্জিত হওয়ার অভিনয় করবো। আইনের বলয়ে এই মামলা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(৪)/৩০ ধারায় দাঁড় করানো হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের ন্যায়বিচার ব্যবস্থায় শিশু মামলার গতি নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, শিশু ধর্ষণ মামলার ৮৭ শতাংশ এখনো বিচারাধীন। গড় নিষ্পত্তি সময় ৫-৭ বছর। এই সময়সীমা একটি শিশুর সমগ্র শৈশবকে গ্রাস করে নেয়। মাগুরার শিশুটির মায়ের এজাহারে উঠে এসেছে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ। শাশুড়ি-ভাশুরের জানা ছিল বলেই তো ধামাচাপা দিতে চেয়েছেন। লুকোচুরির এই খেলা আমাদের সাংস্কৃতিক ডিএনএ তে মিশে আছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ২০২২ সালের তথ্যমতে ৫৪ শতাংশ ধর্ষণ মামলায় প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষ্য দিতে অনীহা প্রকাশ করে। আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে ড. লিসা ফন্টেস বলছেন ‘পারিবারিক কলঙ্কের ভয়ে নিহিত সহিংসতা প্রজন্মান্তরে ছড়ায়।’ শুধু রাষ্ট্র নয়, সমাজও এই অপরাধের দায় এড়াতে পারে না। ইতিহাস সাক্ষী সমাজ যখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে তখনই ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়েছে। মাগুরার শিশুটির জন্য কি ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে? নাকি আরও একবার নীরবতার আড়ালে অপরাধীদের মুক্তির পথ সুগম হবে? শিশুটির অস্ফুট কান্না বাতাসে মিশে সারাদেশে আগুন জ্বেলে দিয়েছে। প্রতিটি হৃদয়ে ক্ষোভের লেলিহান শিখা। ফাঁসির দাবিতে উত্তাল সারাদেশ। পথে পথে রাজপথে মানুষ আর মানুষ। তৌহিদী জনতার কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে মধ্যযুগীয় প্রতিশোধ। পাথরের বৃষ্টিতে ধুয়ে ফেলতে চায় অপবিত্রতা। কিন্তু পাথর কি শুধু অপরাধীর বুকেই পড়ে? নাকি উল্কাপিণ্ড হয়ে ভেঙে পড়ে নিষ্পাপ প্রাণেও? ধর্ষকের শাস্তি চাই। কিন্তু শাস্তির খড়গ যেন থাকে ন্যায়বিচারের মসৃণ হাতেই। আইনের কঠোরতায় যেন অন্ধকারে ঢেকে না যায় মানবতার মোমবাতি। লেখক : শিক্ষক

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন

সড়ক মানে যেন মৃত্যুর মিছিল। এই মৃত্যুর মিছিল নিয়ে জাতি খুবই উদ্বিগ্ন। সড়ক দুর্ঘটনা এখন প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি বছর ঈদ,পূজাসহ অন্যান্য সামাজিক উৎসব আসলে সড়কে প্রাণহানির সংখ্যা অনেকগুণ বেড়ে যায়। সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের জীবনে যেন এক আতঙ্ক। নিরাপদ সড়ক আমরা সবাই চাচ্ছি। কিন্তু পরিবহনের সাথে যারা জড়িত তারা চাচ্ছে কিনা সন্দেহ আছে। যদি চাইত তাহলে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনা এত বৃদ্ধি পেত না। ঘর থেকে বের হলে আর ফিরব কিনা সন্দেহ থাকে। প্রতি বছর জাতীয় নিরাপদ সড়ক নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা করে থাকি আমরা। কিন্তু এ আলোচনার পেছনে যেসব কারণ ছিল,অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি না। কারণ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর হাজার হাজার লোক নিহত হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনার খবর প্রতিদিন আমাদের বেদনাহত করে। সড়ক দুর্ঘটনা একটি পরিবারকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এর কি কোনো সমাধান হবে না আমাদের দেশে? ঢাকায় সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে এই বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে সব রুট বিলুপ্ত করে ৯ রুটে ৯ রঙের উন্নত বাস পরিষেবা চালুর নির্দেশনা দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। যা ইতিবাচক পদক্ষেপ। তবে এই নির্দেশনার অপব্যবহার করে নতুন ও উন্নত বাসের বদলে ফিটনেসবিহীন পুরনো লক্কড়ঝক্কড় বাস রাতারাতি গোলাপি রং করে পরিবহন ব্যবসা করে যাচ্ছে। যা মনিটরিং দরকার। তদারকি না করলে রাজধানীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। সড়ক নিরাপত্তা ও দুর্ঘটনা রোধে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প, শত শত সুপারিশ, টাস্কফোর্স–কিছুই তেমন কাজে আসছে না। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৫০১ সড়ক দুর্ঘটনায়  ৪৮২ জন নিহত হয় এবং আহত হয় ৭১৮ জন। তবে ২০২৩ সালে প্রথমবারের মতো দুর্ঘটনা এবং হতাহতের পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে বিআরটিএ এ বছর। ওই বছর ৫ হাজার ৪৯৫ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫ হাজার ২৪ জন। যদিও বেসরকারি সংগঠনগুলোর চেয়ে সরকারি পরিসংখ্যানে হতাহতের সংখ্যা কম। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) এর তথ্য অনুযায়ী,বাংলাদেশে বছরে ৩১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় দুর্ঘটনায়। যদিও এই সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এসব চিত্র দেখলে সড়কে চলাচল ভয়াবহ মনে হয় এবং আমাদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এখন ঘর থেকে বের হলে মনে হয় আর সুস্থ জীবনে ফেরত আসব না হয়তো। ২০২৫ সালের প্রথম দুই মাসে ১ হাজার ১২ সড়ক দুর্ঘটনায়  ৯৬৩ জন নিহত হয়। কয়েক বছরের হিসাব পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রতিদিন প্রায় হাজারের মতো লোক নিহত হয়। কিন্তু এই সংখ্যা বিভিন্ন উৎসবে অনেক বেড়ে যায়। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি শুধু একটি পরিবারে গভীর শোক ও ক্ষত সৃষ্টি করে না, বরং আর্থিকভাবেও পঙ্গু করে দেয় ঐ পরিবারকে। যার ক্ষতি কোনদিন পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় না। কারণ, এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার মতো নয়। কোনো কোনো দুর্ঘটনায় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যু পরিবারকে পথে বসিয়ে দেয়। ফলে ঐ পরিবারের যে কি করুণ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তা বলে শেষ করা যাবে না। আর যারা পঙ্গু হয়ে যায় তাদের পরিবারকে আজীবন তার ভার বহন করে চলতে হয়। গণমাধ্যমে জানতে পারি,সড়ক দুর্ঘটনার কারণে বছরে গড়ে বাংলাদেশে জিডিপির ক্ষতি হয় ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। তবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কোনো গবেষক নেই, গবেষণা নেই, কোনো বাজেট বরাদ্দও নেই। ফলে প্রতি বছর সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বেড়েই চলছে। তাই এই বিষয়ে সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া একান্ত জরুরি।   সড়কে ফিটনেসবিহীন অনেক গাড়ি চলমান, যা সড়ক দুর্ঘটনার জন্য অনেকাংশে দায়ী। সড়ক দুর্ঘটনার অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে আরও রয়েছেÑট্রাফিক বিধি লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত পণ্য বোঝাই, চালকদের ওভারটেকিং, বিরতিবিহীন লম্বা সময়কাল গাড়ি চালানো, ছোট গাড়ির চালক বিশেষ করে মোটরসাইকেল চালকদের মধ্যে সতর্কতার অভাব, দূরপাল্লার সড়ক ও জনবহুল এলাকায় ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন এবং দেশের বিভিন্ন জায়গায় সড়কের বেহাল অবস্থা ইত্যাদি। সড়ক পরিবহন আইনের ৪৩ ধারা অনুযায়ী, যানবাহনে অতিরিক্ত ওজন বহন দণ্ডনীয় অপরাধ। ৮৬ ধারা অনুযায়ী, এ অপরাধের শাস্তি হলো অনধিক এক বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে দায়ী ব্যক্তি। এছাড়া অতিরিক্ত হিসেবে চালকের নিবন্ধন থেকে ২ পয়েন্ট কাটা যাবে। কিন্তু তারপরও চালকরা অতিরিক্ত ওজন বহন করে যানবাহনে। দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত ওভারলোডিং। ২০২১ সালে যা বন্ধে সারাদেশে ২৮টি এক্সেল লোড কন্ট্রোল স্টেশন বা ওজন পরিমাপক কেন্দ্র নির্মাণের প্রকল্প চলছে ১ হাজার ৬৩০ কোটি টাকায়। কিন্তু এটা কার্যকর হয়েছে কিনা সন্দেহ। দ্রুত এই প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করা প্রয়োজন। কারণ, অতীতে নির্মিত ১৭ এক্সেল লোড কন্ট্রোল সেন্টারের ১২টি বিকল। ফলে অতিরিক্ত পণ্য পরিবহন ধরা পড়ে না। যার কারণে দুর্ঘটনা আরও বেড়ে যাচ্ছে। এই ক্ষেত্রে মালিকদের আরও বেশি সচেতন হওয়া বা কম মুনাফা লাভের আশা করা দরকার। অর্থাৎ যাতে তাদের পরোক্ষ নির্দেশে ট্রাক বা গাড়িতে বেশি ওজন বহন করতে না পারে।   এছাড়াও চালকের লাইসেন্স পাওয়ার সিস্টেমে দুর্বলতা এবং তাদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের অভাবে সড়ক দুর্ঘটনা হয়ে থাকে। আইনের বাস্তব প্রয়োগ সড়কে তেমন কার্যকরী হিসেবে দেখা যাচ্ছে না। চালকরা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে আটক হওয়ার পর জামিনে মুক্ত হয়ে যায়। এছাড়াও দুর্ঘটনার দায়ী ব্যক্তিদের তেমন শাস্তি হয় না। কারণ, আইনে তেমন শক্তিশালী শাস্তির বিধানও নেই এবং নতুন সড়ক পরিবহন আইনও শিথিল করা হয়েছে। যার সুযোগ নিচ্ছে পরিবহন মালিক, শ্রমিক এবং চালকরা। ফলে চালকেরা বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাতে ভয় পাচ্ছে না। এর বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ এবং ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। লাইসেন্সবিহীন চালকের সংখ্যাও কম নয়। এটিও একটি কারণ সড়ক দুর্ঘটনার। দুর্ঘটনা কমানোর জন্য পরিবহনের সঙ্গে জড়িত তাদের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখছি না। বিশেষ করে, নিরাপদ সড়ক নিশিচত করার জন্য দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা নেই। পুলিশ মাঝেমধ্যে গাড়ি থামিয়ে শুধু মাদক আছে কি না তা চেক করে থাকে। কিন্তু সড়কে বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা আনার চেষ্টা করা হচ্ছে না। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি দুটিই বেড়ে চলছে। সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধে দেশের সকল বাস টার্মিনালসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সড়ক নিরাপত্তা সংক্রান্ত ভিডিও চিত্র প্রদর্শন করা উচিত। এর পাশাপাশি পরিবহন মালিক, চালক, যাত্রী ও পথচারীদের সচেতন করার লক্ষ্যে লিফলেট, পোস্টার ও স্টিকার বিতরণ করতে হবে। সড়কে নিরাপত্তার স্বার্থে নতুন এবং যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন করতে হবে। যাতে গাড়ি চালকরা বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাতে ভয় পায়। পরিবহনের সাথে জড়িত সকলের জন্য উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে মানুষের জীবনের মূল্য, পেশাগত দায়িত্ব সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারে। এছাড়াও দালাল বা তদবিরের মাধ্যমে ড্রাইভিং এর ভুয়া লাইসেন্স দেওয়া অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। দুর্ঘটনা ঘটলে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দ্রুত তদন্তের প্রতিবেদন প্রকাশ করে দোষীদের শাস্তি বাস্তবায়ন করতে হবে। কিন্তু যেকোন দুর্ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার নিশ্চিত করতে হবে। বিচারহীনতার অপসংস্কৃতির কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই শোচনীয় অবস্থা থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করার জন্য সরকার আইনের সংশোধনপূর্বক তা কঠোরভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে সড়কে নিরাপদ ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে। এছাড়াও পুলিশকে আইনের প্রয়োগ বিষয়ে আরও বেশি তৎপর হতে হবে। নাগরিক হিসেবে আমাদেরও কিছু দায়িত্ব রয়েছে। কারণ, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য শুধু চালকরাই যে দায়ী তা নয়। রাস্তার পাশের হাটবাজার, দোকান ও স্কুল প্রতিষ্ঠা, অনেক সময় যাত্রী, পথচারী, শিশুদের দৌড়ে রাস্তা পার হওয়াও দায়ী। আইন কার্যকর করার ক্ষেত্রে সরকার আরও কঠোর হবে বলে আমার বিশ্বাস করি।

কিডনির রোগ প্রতিরোধ

কিডনির রোগ প্রতিরোধ

১৩ মার্চ বিশ্ব কিডনি দিবস পালিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে নানা বিষয় সামনে চলে এসেছে। দেশে কিডনি প্রতিস্থাপনে সাফল্য এসেছে এক দশক আগেই। এরপর কিডনি চিকিৎসায় বড় ধরনের ভালো খবর নেই। অথচ কিডনি জটিলতায় ভুগছেন কোটি মানুষ। চিন্তার বিষয় হলো, এ রোগের চিকিৎসার জন্য দেশে মাত্র ৪০০ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। তাদের মধ্যে আবার ৭০ শতাংশ রাজধানীর বিভিন্ন চিকিৎসালয়ে প্র্যাকটিস করে থাকেন। রাজধানীতে যে কিডনি হাসপাতাল রয়েছে, তার শয্যাসংখ্যা সীমিত। কিডনি চিকিৎসায় ডায়ালাইসিস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও এই সেবা দেশে খুবই সীমিত। কিডনি রোগের চিকিৎসাসেবা বাড়ানো না হলে এটির অন্যতম ঘাতক ব্যাধি হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে। প্রতি বছর কিডনির নানা রোগে প্রায় ১৭ হাজার মানুষ মারা যায়। বাংলাদেশে কিডনি রোগে আক্রান্ত, মৃত্যু ও কিডনির রোগের ধরন বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব হেলথ ম্যাট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশনের (আইএইচএমই) ওয়েবসাইটে। আইএইচএমই দেড় দশকের বেশি সময় ধরে বিশ্বের ২০০টির বেশি দেশের রোগ পরিস্থিতির তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করার পাশাপাশি নিয়মিতভাবে গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করে থাকে। আইএইচএমইর পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ মানুষের কোনো না কোনো কিডনির রোগ দেখা দেয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয় কিডনিতে পাথরের সমস্যা। কিডনি বিকল হলে তার চিকিৎসা দুই ধরনের। নিয়মিত ডায়ালাইসিস করা এবং কিডনি প্রতিস্থাপন। প্রতিবার ডায়ালাইসিসে সরকারি হাসপাতালে খরচ হয় দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। সপ্তাহে অন্তত দুবার ডায়ালাইসিস করতে হয়। মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষেও দীর্ঘদিন ডায়ালাইসিস চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। অন্যদিকে কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য কিডনি পাওয়া যেমন কঠিন, তেমনি এককালীন খরচও অনেক বেশি। একদিকে চিকিৎসায় সুযোগের অপ্রতুলতা, অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুর্নীতি। ২০২০ সালে প্রায় ২৫৫ কোটি ২২ লাখ টাকার ‘১৫টি মেডিক্যাল কলেজ ও ৪৪টি জেলায় ডায়ালাইসিস ইউনিট স্থাপন’ নামে প্রকল্পটি হাতে নিয়েছিল সরকার। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু কমিশনের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে জটিলতার কারণে আটকে যায় প্রকল্পটি। এর জন্য দায়ী রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারা। এসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে স্বাস্থ্যসেবাকে জনমুখী করা সম্ভব হবে না। কিডনি রোগ প্রতিরোধে শারীরিক ক্লান্তি, নিয়মিত ওজন কমতে থাকা, হাত-পা বা চোখ ফোলাভাব, প্রস্রাবে পরিবর্তন, অ্যালার্জি বেড়ে যাওয়া ও ঘুমের ব্যাঘাত ইত্যাদি কারণ অগ্রাহ্য করা যাবে না। এসব লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যেহেতু শুরুর দিকে কিডনি রোগের কোনো উপসর্গ থাকে না, অন্তত ৪০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের নিয়মিত কিডনি পরীক্ষা করানো উচিত। এরপর রিপোর্ট অনুযায়ী চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। কিডনির রোগের ক্ষেত্রে প্রতিষেধক অপেক্ষা প্রতিরোধ উত্তম। এজন্য সবার সচেতন ও স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়া জরুরি। চিকিৎসাকে বাণিজ্যমুখী না করে আরও সেবামুখী করার মনোভাব নিয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে গেলে বাংলাদেশের পক্ষে প্রভূত উন্নতি করা সম্ভব। দেশবাসীরও সেটাই প্রত্যাশা।

শ্রমিকদের অসন্তোষ

শ্রমিকদের অসন্তোষ

ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের প্রধান দুটি উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার প্রাক্কালে প্রতি বছর বাংলাদেশের কলকারখানা ও গার্মেন্টসের শ্রমজীবী মানুষ বেতন বোনাস ও বকেয়া প্রাপ্তির দাবিতে সড়ক অবরোধ, বিক্ষোভ ও কর্মবিরতি পালন করে থাকেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘাত-সাংঘর্ষের দৃশ্যও দেখা যায় গণমাধ্যমে। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের শ্রীপুরে বকেয়া বেতন, ঈদ বোনাসের ঘোষণা এবং পাওনা ছুটির টাকার দাবিতে শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন প্রায় প্রতিদিন। একই দাবিতে ঢাকার আশুলিয়ার বাড়ইপাড়ায় নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন তারা। এ ছাড়া শ্রমিক নির্যাতনের প্রতিবাদ ও বন্ধ কারখানা খুলে দেওয়ার দাবিতেও আন্দোলন করছেন শ্রমিকরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে বিক্ষোভকারীদের সড়ক থেকে সরিয়ে দেন। বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রায় ৮৪ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। সরল বাক্যে এটা বলা যায়, গার্মেন্টস খাতের হাত ধরেই প্রধানত ঘুরছে দেশের অর্থনীতির চাকা। আসন্ন ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে শ্রমিকদের বোনাসসহ বকেয়া বেতন এবং যাবতীয় পাওনা ২০ রমজানের মধ্যে পরিশোধ করার নির্দেশ দিয়েছে ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদ (টিসিসি)। টিসিসি-এর ৮৫তম সভায় শ্রমিকদের স্বার্থে মোট সাতটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন শ্রমিক, মালিক, শ্রম ও কর্মসংস্থানসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের প্রতিনিধিরা। ত্রিপক্ষীয় এ সভায় সিদ্ধান্ত হয়, মালিকপক্ষ তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী কমপক্ষে চলতি মার্চের ১৫ দিনের বেতন দেবেন। শ্রমিক নেতাদের অনড় দাবি, ২০ রমজানের মধ্যে শ্রমিকদের সব পাওনাও অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে।   সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা গেছে, ঈদের আগ মুহূর্তে বেতন-বোনাস পরিশোধের আশ্বাস দেওয়ার পরও অনেক কারখানা মালিকই শতভাগ পাওনা পরিশোধ করেন না। ঈদের দীর্ঘ ছুটি হওয়ায় শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া নিয়েও কোনো সমাধান সহজে হয় না। শেষ পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করতে হয় সরকারকে। শ্রমিকদের দাবি, ঈদের আগ মুহূর্তে নয়, অন্তত ১০ দিন আগে বেতন-বোনাসসহ  তাদের সকল পাওনা পরিশোধ করলে কাজের ফাঁকে সুবিধা মতো তারা পরিবারের জন্য সামর্থ্য অনুযায়ী কেনাকাটা করতে পারেন। শ্রমজীবী মানুষের এ দাবি যথেষ্ট ন্যায্য ও যুক্তিসঙ্গত, আমরা এ দাবির সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। ভুলে গেলে চলবে না, শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তাদের পারিশ্রমিক দেওয়া পবিত্র রমজানের শিক্ষা।

সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা জরুরি

সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা জরুরি

ঈদযাত্রায় সড়কে বেপরোয়া হয়ে ওঠে যানবাহনগুলো। বাসের পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে সড়কে ছুটে চলে মোটরসাইকেল। ঈদে প্রতিবারই সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। গত ঈদেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ- বিআরটিএর তথ্যমতে গত পবিত্র ঈদুল ফিতরের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ের রোডক্র্যাশে ১৭ দিনে সারা দেশে ২৮৬টি সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটে। এতে ৩২০ জনের মৃত্যু এবং ৪৬২ জন আহত হয়। গত ঈদুল আজহার আগে ও পরে ঈদযাত্রায়  ১২ দিনে ২১৬টি দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ২১৫ জন নিহত ও ২৭৮ জন হয়। ২০২৩ সালের ঈদুল ফিতরে সড়ক দুর্ঘটনায় ১৫ দিনে ২৩৯ জনের মৃত্যু হয়। ২০২৩ সালে ঈদে যেখানে ঈদুল ফিতরে সড়ক দুর্ঘটনায় দিনে ১৬ জন করে মারা গেছেন, সেখানে ২০২৪ সালে দিনে ১৯ জন করে মারা গেছেন। ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে প্রায় ১৯ শতাংশ বেশি নিহত হয় বলে জানায় বিআরটিএ।

নতুন সমীকরণে আন্তর্জাতিক রাজনীতি

নতুন সমীকরণে আন্তর্জাতিক রাজনীতি

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে মার্কিন প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি এখন সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই পুতিনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছেন। এরই মধ্যে উভয় প্রেসিডেন্ট ফোনে কথা বলেছেন, দুই দেশের প্রতিনিধিরা বৈঠক করেছেন এবং ভবিষ্যতে আরও কয়েকটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকও রয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের এসব উদ্যোগের জবাব তৈরি করতে ইউরোপ ও ইউক্রেনের এখন নাভিশ^াস উঠেছে। এতে করে ইউরোপের নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে রাশিয়াকে তার প্রত্যাশিত অবস্থানে নিয়ে গেছে বৈশি^ক রাজনীতির চূড়ায়। কোনো প্রকার ছাড় না দিয়েই নিজেকে এমন অবস্থানে নিতে চেয়েছিল মস্কো। ক্রেমলিন রাশিয়ার জনগণ ও আন্তর্জাতিক মহলকে দেখাতে চায় যে, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়াকে একঘরে করার পশ্চিমাদের চেষ্টাব্যর্থ হয়েছে। রাশিয়ার সংবাদমাধ্যমগুলোও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার উষ্ণ সম্পর্কেও সম্ভাবনাকে স্বাগত জানিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের আশ^াস দিলেও তাঁর আরোপিত শুল্কনীতি থেকে রাশিয়াও রক্ষা পায়নি। ট্রাম্প প্রশাসন দায়িত্ব গ্রহণের পরই রাশিয়ার বিরুদ্ধেও একাধিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে জেলেনস্কির সঙ্গে ট্রাম্পের উত্তেজনাপূর্ণ বাক্য বিনিময়ের পর ইউক্রেনের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বন্ধুত্ব জোরদার করতে রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে ট্রাম্প। এ বিষয়ে একটি খসড়া তালিকা প্রস্তুতের জন্য হোয়াইট হাউস পররাষ্ট্র ও ও রাজস্ব দপ্তরকে নির্দেশ প্রদান করেছে। এর অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে মস্কোর সঙ্গে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরও মসৃণ করা। রয়টার্সের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, খসড়া তালিকায় উঠে আসা বিষয়গুলো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আগামীতে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা করবে। বর্তমানে নির্দিষ্ট কয়েকটি সংস্থা এবং ব্যক্তির ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার জন্য একটি প্রস্তাব তৈরি করা হচ্ছে। রয়টার্স জানিয়েছে, রাশিয়ার সঙ্গে ট্রাম্প এবং তার পরামর্শদাতারা কোনো চুক্তি করতে চাইছেন। এ কারণেই রাশিয়ার ওপর কিছু ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করতে চাইছেন। রাশিয়া পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশ। দেশটির জ¦ালানি ব্যবস্থার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা যদি শিথিল করা হয়, তবে এটি জ¦ালানি দাম বৃদ্ধি রোধ করতে সহায়তা করবে। ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর পরই রাশিয়ার সঙ্গে দূরত্ব কমানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য পুতিনের সঙ্গেও তিনি কথা বলেছেন। ট্রাম্প প্রশাসন আর রাশিয়ার ওপর সাইবার নজরদারি চালাবে না বলে জানিয়েছে। সিএনএনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাইবার কমান্ড রাশিয়ার বিরুদ্ধে এ সংক্রান্ত নজরদারি স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের চেয়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চিন্তার বিষয় হলো অবৈধ অভিবাসী। পুতিনকে নিয়ে বেশি না ভেবে অভিবাসন সংক্রান্ত সমস্যার দিকেই ট্রাম্প বেশি নজর দিতে চান। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও তার প্রশাসন ইতোমধ্যেই স্পষ্ট জানিয়েছে, তারা মস্কোর সঙ্গে দ্রুত একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি করতে চায়। এর ফলে ইউক্রেন বিভক্ত হয়ে পড়বে। দেশটি মার্কিন বা ন্যাটোর নিরাপত্তা নিশ্চয়তা থেকে বঞ্চিত হবে। আর মার্কিন কোম্পানিগুলো সেখানে ঢুকে কৌশলগত খনিজ সম্পদ লুটে নেবে। এটা পরিষ্কার যে, ট্রাম্প প্রশাসন আসলে জেলেনস্কির সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতের কোনো ইচ্ছে নেই। জেলেনস্কির জন্য এটি ভালো হবে যদি তিনি ইউরোপীয় সমর্থকদের ওপর তাদের প্রতিশ্রুতি দ্রুত বাস্তবায়ন করার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে পারেন। ইউক্রেনের খনিজ সম্ভাবনাকে দেখিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলোকে উৎসাহিত করতে পারেন। ট্রাম্প বলেছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত আমেরিকার সমর্থন তার সঙ্গে আছে, ততক্ষণ এ লোকটা শান্তি চাইবে না। এরপর তিনি ইউক্রেনের প্রতি মার্কিন সামরিক সহায়তা বন্ধ করে দেন। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে: কিয়েভ যেন নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং পুতিনের শর্ত মেনে যুদ্ধ বন্ধ করতে বাধ্য হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা স্থগিত করার সিদ্ধান্তকে মস্কো স্বাগত জানিয়েছে। ক্রেমলিনের মুখপাত্র মিমিত্রি পেসকভ বলেন, যদি যুক্তরাষ্ট্র এ সহায়তা বন্ধ বা স্থগিত করে, তাহলে এটি সম্ভবত শান্তির জন্য সর্বোত্তম অবদান হবে। একদিন পর্যন্ত ট্রান্সআটলান্টিক মৈত্রীই ছিল ইউরোপীয় নিরাপত্তার ভিত্তি। এই মৈত্রী কয়েক দশক ধরে ইউরোপের সমৃদ্ধি এনে দিয়েছে। দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সুরক্ষা ছাতার নিচে ছিল। যেকারণে প্রতিরক্ষা খাতে ইউরোপীয় দেশগুলোর বেশি ব্যয় করতে হয়নি।  এখন ট্রাম্প হয়তো ইউক্রেনের জন্য মার্কিন গোয়েন্দা তথ্যপ্রবাহ বন্ধ করে দিতে পারেন। অথবা ইলন মাস্কের স্টারলিংক স্যাটেলাইট যোগাযোগ ব্যবস্থায় ইউক্রেনের প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এক্ষেত্রে ইউরোপীয় দেশগুলোকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সরকারি স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক ব্যবহার করার অনুমতি দিয়ে ইউক্রেনকে সহযোগিতা দিতে পারে। ওভাল অফিসে ট্রাম্পের সঙ্গে জেলেনস্কির উত্তেজনাপূর্ণ বাক্য বিনিময়ের পর ইউরোপীয় নেতাদের জেলেনস্কির পােিশ দাঁড়ালেও ন্যাটোর মহাসচিব ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরায় স্থাপনের একটি উপায় খুঁজে বের করার পরামর্শ দিয়েছেন। যুক্তরাজ্য একটি বিবৃতিতে বলেছে, সকল পক্ষের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ যে, যত দ্রুত সম্ভব ইউক্রেনের জন্য একটি স্থায়ী ও নিরাপদ শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁও ট্রাম্পের সঙ্গে জেলেনস্কির আলোচনার আগ্রহকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র-ইউক্রেনের প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্যদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বড় সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে ইউক্রেন ছাড়াও ইউরোপীয় দেশগুলোর নিরাপত্তায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি অনেক সংশয় দেখা দেবে। এ উদ্বেগের কারণ ট্রাম্পের রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করার চেষ্টা। যুক্তরাষ্ট্র কিয়েভের জন্য সকল প্রকার সামরিক সহযোগিতা স্থগিত ঘোষণার পর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বলেছেন, তিনি দীর্ঘস্থায়ী শান্তির জন্য ট্রাম্পের শক্তিশালী নেতৃত্বে কাজ করতে প্রস্তুত। হোয়াইট হাউসে সংঘটিত বাগবিতণ্ডার ঘটনাটিকে তিনি দুঃখজনক বলেও উল্লেখ করেন। জেলেনস্কি বলেন, এখন পরিস্থিতি ঠিক করার সময় এসেছে। দ্রুত যুদ্ধ শেষ করার জন্য প্রস্তুত উল্লেখ করে জেলেনস্কি লিখেছেন, আমরা দ্রুত যুদ্ধ শেষ করতে প্রস্তুত। এবং প্রথম ধাপে যুদ্ধবন্দিদের মুক্তি ও আকাশে যুদ্ধবিরতি- ক্ষেপণাস্ত্র, দূরপাল্লার ড্রোন, জ¦ালানি ও অন্যান্য বেসামরিক অবকাঠামোতে হামলা নিষিদ্ধ করা এবং সমুদ্রে যুদ্ধবিরতি অবিলম্বে কার্যকর করা যেতে পারে, যদি রাশিয়া একই পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তিনি আরও বলেন, এরপর আমরা দ্রুত পরবর্তী ধাপগুলো শেষ করতে চাই এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলে একটি শক্তিশালী চূড়ান্ত চুক্তিতে পৌঁছাতে কাজ করতে চাই। তিনি বলেন, এটি দুঃখজনক যে, বিষয়টি এভাবে ঘটে গেছে। এখন আমরা চাই ভবিষ্যতে সহযোগিতা ও যোগাযোগ আরও গঠনমূলক হোক। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে খনিজ সম্পদ চুক্তি ব্যর্থ হওয়া প্রসঙ্গে জেলেনস্কি বলেন, ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ওই চুক্তি ব্যর্থ হওয়ার পর ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে খনিজ সম্পদ চুক্তি স্বাক্ষর করতে প্রস্তুত রয়েছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধে ইউক্রেনকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদানের জন্য জেলেনস্কি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি ট্রাম্পের প্রশংসা করে বলেন, আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বজায় রাখতে যুক্তরাষ্ট্র যা করেছে, আমরা সেটিকে সত্যিই মূল্যবান মনে করি। আমাদের সেই মুহূর্ত মনে আছে, যখন ট্রাম্প ইউক্রেনকে জ্যাভলিন মিসাইল দিয়েছিলেন, যা যুদ্ধের পরিস্থিতি বদলে দিয়েছিল। তিনি এর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেরন। এক সাক্ষাৎকার তিন বলেছেন, আমি আমেরিকান জনগণের প্রতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ, তাদের সকল ধরনের সহােগিতার জন্য। এদিকে ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের সম্পর্ক উন্নয়নে অনেক দেশের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়েছে। বিশেষ করে ইউরোপ এবং মার্কিন ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতে। ট্রাম্পের সমালোচক এবং ডেমোক্র্যাটিক সিনেটর ক্রিস মার্ফি মন্তব্য করেন, হোয়াইট হাউস এখন ক্রেমলিনের অঙ্গ সংগঠনে পরিণত হয়েছে। মনে হচ্ছে, আমেরিকা এখন একনায়কদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করছে। তবে রিপাবলিকান পার্টির নেতারা বলছেন, জেলেনস্কির উচিত এখন পদত্যাগ করা, যাতে মস্কোর সঙ্গে শান্তি চুক্তি করা যায়। ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়ালজ সিএনএনকে জানান, আমাদের এমন একজন ইউক্রেনীয় নেতা প্রয়োজন যিনি আমাদের সঙ্গে চুক্তি করতে পারবেন এবং পরবর্তী সময়ে রাশিয়ার সঙ্গেও চুক্তি করেÑ এ যুদ্ধ বন্ধ করতে পারবেন। এদিকে হোয়াইট হাউসে অপদস্থ হলেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখতে চাইছেন ইউক্রেন। এদিকে ইউক্রেন যুদ্ধ, পশ্চিমে রাশিয়াকে পৃথক করে দেওয়াÑ এসকল বিষয়ের মধ্যে পুতিনের দিকি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। দুই দেশের মধ্যে একটি পারস্পরিক সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে মাঝেমধ্যে এমনও অভিযোগ তোলা হয়েছিল যে, ইউক্রেন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য চীন রাশিয়াকে সহযোগিতা করছে। তবে সে অভিযোগ চীন বরাবরই অস্বীকার করে এসেছে। এখন পুতিনের প্রায় কথাই ট্রাম্প মেনে নিচ্ছেন। রাশিয়ার জন্য মঙ্গলজনক কোনো চুক্তিও সামনে হতে পারে; যেখানে হয়ত চীনের ভূমিকা নাও থাকতে পারে। যদিও কয়েক সপ্তাহ আগেও দৃশ্যপট অনেকটাই ভিন্ন ছিল। ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় চীনেরও ভূমিকা থাকার কথা ছিল। তবে বর্তমান পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বৈশি^ক শক্তি বা রাশিয়ার মিত্র হিসেবে আলোচনার টেবিলে চীন নেই। বিষয়টি চীনের কর্মকর্তাদের কিন্তু অবাক করেছে। গত মাসে সৌদি আরবের রিয়াদে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ও রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের নেতৃত্বে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় দফার বৈঠকের জন্য প্রস্তুতি চলমান। এ আলোচনাকে কেন্দ্র করে এ দুই পরাশক্তি বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা দেখছে। ক্রেমলিনের প্রধান অর্থনৈতিক দূত কিরিল দিমিত্রিয়েভ জানিয়েছেন, এই আলোচনার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ করে জ¦ালানি ক্ষেত্রে সহযোগিতার সুযোগ তৈরি হবে। ফিন্যান্সিয়াল টামইমস জানিয়েছে, রাশিয়ার নর্ড স্ট্রিম ২ গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প পুনরায় চালু করতে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের সম্পৃক্ত করার প্রচেষ্টা চলছে। জার্মানি এই প্রকল্প স্থগিত করেছিল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর। দিমিত্রিয়েব বলেন, ট্রাম্প প্রশাসনের উচিত রাশিয়ার সঙ্গে মানবতার একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা। যেখানে বিনিয়োগ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নয়ন এবং মহাকাশ গবেষণার মতো দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পের ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হবে। তিনি ইলন মাস্কের এক্স প্ল্যাটফর্মে একটি কম্পিউটার গ্রাফিক্স শেয়ার করেছেন, যেখানে একটি কল্পিত যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া-সৌদি মহাকাশ মিশন দেখানো হয়েছে; যা স্পেসএক্স রকেট ব্যবহার করে মঙ্গল গ্রহে অভিযান চালাচ্ছে। অর্থনৈতিক লাভের দিক থেকে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করার বিষয়টি আকর্ষণীয় মনে হলেও, এটি কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন মার্কিন প্রশাসনের নীতিগুলো রাশিয়ার সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে একটি নতুন গতিশীলতা এনেছে। নতুন মার্কিন প্রশাসন অতি দ্রুততার সঙ্গে তাদের বৈদেশিক নীতির কাঠামো পরিবর্তন করেছে; যা অনেকটাই রাশিয়ার দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। ট্রাম্প ফেব্রুয়ারিতে পুতিনকে অনুরোধ করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে মধ্যস্থতা করার জন্য। আলোচনার মূল বিষয় হচ্ছে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি এবং মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতি ইরানের সমর্থন। রাশিয়া এ প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসনের এমন পদক্ষেপ গ্রহণকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের আভাস হিসেবে দেখছেন। কারণ ট্রাম্প প্রথম মেয়াদে ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন এবং ২০১৮ সালে একতরফাভাবে ইরানের পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। তবে এবার তিনি সামরিক উত্তেজনা প্রশসন করে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রচেষ্টা করছেন। রাশিয়া বিশ^াস করে যে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান আলোচনার মাধ্যমে তাদের সমস্যার সমাধান করবে এবং মস্কো এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে আলোচনার মধ্যস্থতা এখন খুবই জরুরি। দুই দেশের মধ্যকার বর্তমান সম্পর্ক যুদ্ধ ও পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তারের ঝুঁকির দিকে এগুচ্ছে। রাশিয়া অতীতেও যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্কেও বিভিন্ন ইস্যুতে মধ্যস্থতা করেছে। রাশিয়াকে মধ্যস্থতা করতে আহ্বান জানানোর কারণ হলো মস্কো ও তেহরানের ঘনিষ্ঠ সামরিক ও কৌশলগত সম্পর্ক। গত জানুয়ারি মাসে দুই দেশ ২০ বছর মেয়াদি কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যা প্রতিরক্ষা, প্রযুক্তি, জ¦ালানি ও বাণিজ্যের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দুটি ভিন্ন প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র ভোট দিয়েছে রাশিয়ার পক্ষে। এমনকি নিরাপত্তা পরিষদেও যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রস্তাবে রাশিয়ার সমালোচনা করা হয়নি। এর মাধ্যমে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন নিজেদের অবস্থান আরও স্পষ্ট করেছে। রাশিয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোড়া লাগানোর ইঙ্গিত প্রদান করে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেছেন, ইউক্রেন সংকট নিরসনের পর যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া তাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারে। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র বড় ধরনের যৌথ অর্থনৈতিক প্রকল্প নিয়ে আলোচনা করছে। রাশিয়া তাদের শিল্পগুলোর বিকাশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি কোম্পানি এবং সরকারি সংস্থাগুলোর সাথে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। ট্রাম্প ও পুতিন নতুন মৈত্রীর পথে এগিয়ে গেলে বিশ^ রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে। দ্বিমেরু ব্যবস্থা ভেঙে গিয়ে বহুমেরু ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকতে পারে বিশ^ব্যবস্থা। এর ফলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভারসাম্য পুনর্গঠিত হতে পারে এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক সমস্যার সমাধানে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি পরিলক্ষিত হবে। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্কের এ নতুন ধারা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে; যা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও জোটের পুনর্গঠনে সহযোগিতা করবে। লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

রোহিঙ্গা সংকটে নতুন মাত্রা এবং নিরাপত্তা ঝুঁকি

রোহিঙ্গা সংকটে নতুন মাত্রা এবং নিরাপত্তা ঝুঁকি

দেশবাসী ও বিশ্বের সমগ্র সচেতন নাগরিক পরিপূর্ণ অবহিত আছেন, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সরকার পরিচালিত বর্বরতম অভিযানে নৃশংস গণহত্যা ও নির্যাতনের শিকার প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে। প্রাণ রক্ষায় পালিয়ে আসা বিপুলসংখ্যক এসব অসহায় মানুষকে মনুষ্যত্ব-মানবিকতায় প্রোজ্জ্বল বাংলাদেশ সাদরে বরণ করে। সীমান্তবর্তী উখিয়া-টেকনাফ অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ জীবন যাপনে মৌলিক চাহিদা পূরণসহ সামগ্রিক সার্থক ব্যবস্থাপনায় বিশ্বপরিমণ্ডলে বাংলাদেশ নতুন অধ্যায় নির্মাণ করে। বাংলাদেশের প্রায় ১০ হাজার একর ভূমি ব্যবহারকারী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নতুন আগমনে সাড়ে ছয় হাজার একর ভূমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। ইতোমধ্যে এক লাখ রোহিঙ্গাকে স্থানান্তরের জন্য আবাসনসহ পর্যাপ্ত সুবিধা সম্বলিত ভাসানচরে প্রায় ৩০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে। বিগত ১৪ মাসেও মিয়ানমারে বিদ্রোহী বাহিনীর হাতে বাংলাদেশের সীমান্তসংলগ্ন একাধিক শহরের পতন হওয়ায় আরও প্রায় ৭০ হাজার শরণার্থী অনুপ্রবেশ করেছে। সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা আরাকান আর্মির নির্যাতনের মুখে রোহিঙ্গা আসা অব্যাহত থাকবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে আগত রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে যেসব উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে; সংকট নিরসনে তা এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি করেছে। প্রশ্নবিদ্ধ অন্তরায় বিবেচনায় এ নিয়ে সচেতন মহলে নানামুখী কৌতূহল বাসা বেঁধেছে। এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য; রোহিঙ্গা সংকট একটি দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিয়েছে। এত বিশালসংখ্যক বিদেশী শরণার্থীর কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে অবস্থান শুধু ওই অঞ্চলে নয়; পুরো দেশেই অস্বাভাবিক ও অনাকাক্সিক্ষত দুরাশার দৃশ্যপট নির্মাণ করে। নিরাপত্তাজনিত-পরিবেশগত-নানামুখী অপরাধ সংঘটনে এ জনগোষ্ঠীর কদর্য কর্মযজ্ঞ বাংলাদেশের সামগ্রিক অগ্রযাত্রায় নিগূঢ় প্রতিবন্ধকতা পরিগ্রহ করেছে। মূলত এ সমস্যা সমাধানের মূলে রয়েছে মিয়ানমার সরকারের আগ্রহ ও ঐকান্তিক স্বদিচ্ছা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে যথার্থ চাপ প্রয়োগ ও প্রভাব বিস্তারে যৌক্তিক সমাধান নির্ধারণের বিপরীতে পরাক্রমশীল দেশসমূহের উদাসীন দৃষ্টিভঙ্গি এবং মিয়ানমারের সঙ্গে ক্রমাগত ব্যাপক বাণিজ্যিক সম্পর্কের সমৃদ্ধি সমস্যাকে প্রলম্বিত করছে। একদিকে লুম্পেন বিশ্বায়ন মোড়কে কথিত ভোগবাদী বিশ্বের বিলাসবহুল দিনানিপাত, অন্যদিকে তাদেরই কদর্য ভূ-রাজনীতি, অর্থনীতি-বাজার দখল, আধিপত্যবাদে সৃষ্ট দরিদ্র দেশসমূহে অনুন্নয়নের উন্নয়ন চৌহদ্দির বিকাশ বিস্তৃত হচ্ছে। ক্ষুধা-দারিদ্র্য-পুষ্টিহীনতা-অস্বাস্থ্যকর অবস্থার করুণ দৃশ্যাদৃশ্য বিশ্বের বিবেকবান মানুষের হৃদয়ে গভীর রক্তক্ষরণ অব্যাহত রয়েছে। বিপরীতে পশুতুল্য এসব অর্থ-ক্ষমতা-প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠায় নিরন্তর লিপ্ত জাতিরাষ্ট্র তাদের শোষণ-শাসনের যাঁতাকলের অপকৌশল সক্রিয় করেছে। রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে একই ধারাবাহিকতায় তাদের মুখরোচক বাচনিক আশ্বাস বাস্তবায়নে এখনো ফলপ্রসূ অর্জন গোচরীভূত নয়। সাত বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া কার্যকরণে রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে আরোপিত পাঁচটি শর্তকে মোটেও আমলে নেওয়া হচ্ছে না। উপরন্তু ২০২৪ সালের শুরু থেকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত ও রাখাইনে আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ চলমান থাকায় রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ২০২৩ সালে ডিসেম্বর মাসে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য যে পাইলট প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল তাও থেমে যায়। মিয়ানমারে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসার কোনো লক্ষণ অনুভূত নয়। তাই রোহিঙ্গা সমস্যা দীর্ঘায়িত হওয়ার পাশাপাশি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিশ্বের বর্তমান অন্যতম শক্তিশালী দেশ চীনের পক্ষ থেকে আশানুরূপ কোনো উদ্যোগ লক্ষণীয় নয়।   অতিসম্প্রতি জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) জরুরি তহবিলের অভাবে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের খাদ্য রেশন কমিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে। সংস্থাটির সংবাদ বিজ্ঞপ্তি মারফত জানা যায়, রোহিঙ্গাদের জন্য পূর্ণ রেশন চালিয়ে যেতে এপ্রিলে ১৫ মিলিয়ন ডলার এবং বছরের শেষ পর্যন্ত মোট ৮১ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। এ মাসের মধ্যে ১৫ মিলিয়ন ডলারের অর্থ সহায়তা জোগাড় করতে না পারলে ১ এপ্রিল থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য খাবারের বরাদ্দ অর্ধেক কমানো হতে পারে। বর্তমানে একজন রোহিঙ্গা মাসে ১২ দশমিক ৫০ ডলার মূল্যের খাদ্য সহায়তা পেয়ে থাকে, যা কমিয়ে ৬ ডলারে আনা হবে। ফলে প্রতি বেলার খাবারের জন্য বরাদ্দ বাংলাদেশী মুদ্রায় ১৬ টাকা থেকে কমে হবে ৮ টাকা। এতে আগে থেকেই বিরাজিত খাদ্য সংকট এবং অপুষ্টি আরও তীব্র আকার ধারণ করতে পারে। প্রাসঙ্গিকতায় ডব্লিউএফপির বাংলাদেশ মুখপাত্র কুন লি গণমাধ্যমে বলেন, ‘মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রে অনুদান সংকটের কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রোহিঙ্গাদের জন্য অনুদান কমে আসছে। এর আগে ২০২৩ সালে তহবিল ঘাটতিতে রোহিঙ্গাদের মাথাপিছু মাসিক খাদ্য সহায়তা ১২ মার্কিন ডলার থেকে কমিয়ে প্রথমে ১০ মার্কিন ডলার এবং পরে ৮ মার্কিন ডলারে করা হয়। পরবর্তীতে তা আবার বাড়ানো হয়।’ উক্ত সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের মাঝে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। রোহিঙ্গা নেতাসহ অধিকাংশ রোহিঙ্গাদের দাবি, অর্থ সহায়তা কমিয়ে আনলে ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের জনজীবন বিপর্যস্ত হতে পারে। কারণ এত অল্প টাকায় তারা না খেয়ে মরবে। বাড়তে পারে খুন-ধর্ষণ-মাদক ও মানব পাচার-ছিনতাই-ডাকাতিসহ নানা অপরাধ। উল্লেখ্য, খাদ্য সহায়তায় বরাদ্দ কমার ফলে রোহিঙ্গাদের ওপর প্রচণ্ড প্রভাব পড়তে পারে বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার প্রধান ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি। সামজিক মাধ্যম এক্স-এ দেওয়া পোস্টে তিনি বলেন, ‘যদি শিবিরগুলোয় দাতাদের সহায়তা নাটকীয়ভাবে হ্রাস পায়, যা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছেÑ তাহলে বাংলাদেশ সরকার, সাহায্য সংস্থা ও শরণার্থীদের ওপর প্রভাব ফেলবে এবং এর ফলে হাজার হাজার মানুষ ক্ষুধা, রোগ এবং নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে পড়বে।’ বিজ্ঞজনদের দাবি, খাদ্য সংকট দেখা দিলে রোহিঙ্গারা জীবিকার প্রয়োজনে বাংলাদেশের মূল স্রোতধারায় মিশে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। এরই মধ্যে অসংখ্য রোহিঙ্গা দেশের জনগোষ্ঠীর ভেতরে মিশে গেছে। শুধু তাই নয়, নানা উপায়ে তাদের অনেকে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্রও সংগ্রহ করেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির মধ্য দিয়ে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে রোহিঙ্গা শিবিরের বাইরেও। সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়ে দীর্ঘমেয়াদে দেশের স্থিতিশীলতায় ব্যাঘাত ঘটার বিষয়টিও অমূলক নয়। আরও রয়েছে বিভিন্ন উগ্রবাদী গোষ্ঠী তৈরির আশঙ্কা। আর সেই সুযোগে দেশী-বিদেশী গোষ্ঠী যারা বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল রাখতে চায়, তাদের কাছ থেকে তারা অস্ত্র সহায়তা পাবে। যেসব অস্ত্র তারা ব্যবহার করতে পারে বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে। তাছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসএআইডির কার্যক্রম স্থগিত করার কারণে রোহিঙ্গা শিবিরে একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে হাসপাতাল ও ক্লিনিক। ভবিষ্যতে আরও বন্ধের প্রক্রিয়াধীন। এতে দৈনিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রায় ৭০ হাজারের মতো রোহিঙ্গা। ক্যাম্পে স্বাস্থ্য খাতে কর্মরত কর্মকর্তাদের অভিমত, ইউএসএআইডির তহবিল স্থগিত হওয়ায় এসব প্রতিষ্ঠান থেকে অনেক কর্মী ছাঁটাই করা হয়েছে। তারা সবাই ২০-২৫ শতাংশ সেবা হ্রাস করেছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত এনজিওদের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক প্রতিষ্ঠান ইন্টার সেক্টর কোর্ডিনেশন গ্রুপ (আইএসসিজি) কর্তৃক সংবাদ মাধ্যমে প্রেরিত বিবৃতিতে জানা যায়, বৈদেশিক সাহায্য স্থগিত হওয়ার কারণে প্রয়োজনীয় ও জীবন রক্ষাকারী সেবাসহ বেশকিছু সেবা বন্ধ হয়ে গেছে, যা রোহিঙ্গা ও হোস্ট কমিউনিটিতে প্রভাব ফেলছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, কিছু সহায়তা স্থগিতাদেশ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে। কিন্তু রোহিঙ্গা শিবিরে এর প্রভাব স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে কী হতে পারে তার পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেতে সময় লাগবে। উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর কাছে জরুরিভিত্তিতে আর্থিক সহায়তার আবেদন করেছে ডব্লিউএফপি। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানের জন্য জাতিসংঘের অব্যাহত প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন এবং বাংলাদেশকে এ সমস্যার জন্য তহবিল নিশ্চিত করার আশ্বাস দিয়েছেন। রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত। চলতি মাসের ১১ তারিখ সম্মানিত পররাষ্ট্র উপদেষ্টা আসিয়ানের বিশেষ দূত ওথমান হাশিম এর সঙ্গে সাক্ষাৎকালে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আসিয়ান, জাতিসংঘ এবং দাতা দেশগুলোকে নিয়ে বিস্তৃত পরিসরে রোডম্যাপ তৈরির জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীতার ওপর জোর দিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আসন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনকে সফল করার বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণের জন্য জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা প্রধানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এ সম্মেলন থেকে তিনি কিছু বাস্তবসম্মত অগ্রগতি হওয়ার আশা প্রকাশ করেছেন। প্রধান উপদেষ্টা রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে একটি সুনির্দিষ্ট পথ থাকা দরকার বলে মন্তব্য করেন। রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে ১৩ মার্চ থেকে জাতিসংঘ মহাসচিবের চারদিনের বাংলাদেশ সফর কী বার্তা দেবে দেশের জনগণ সেদিকে তাকিয়ে আছে। লাখো রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ইফতার গ্রহণের পরিকল্পনা উদ্বাস্তু সমস্যা সমাধানে কতটুকু অর্থবহ হবে তা দেখার বিষয়। এটি স্পষ্ট যে, তাঁর এই সফর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ফল শূন্য বা প্রয়োগিক অর্জন ব্যতিরেকে এ সফরের মূল্য ভবিষ্যৎই নির্ধারণ করবে। দেশবাসী অধীর আগ্রহে ইতিবাচক ও যৌক্তিক যোগফলে দেশের প্রভূত সম্ভাব্য সমস্যা দূরীকরণে অচিরেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন প্রত্যাশা করছে।    লেখক : শিক্ষাবিদ

বসন্তে আগুনঝরা বনবাদাড়

বসন্তে আগুনঝরা বনবাদাড়

এখন চলছে ঋতুরাজ বসন্ত। এ ঋতুতে প্রতিটি গাছ ও পশু-পাখি প্রকৃতিতে নবরূপে সেজে উঠেছে। গাছে গাছে পুরাতন পাতা ঝরে পড়ে নতুন পাতা আসে। পাখিদের মাঝে ঋতুরাজ বসন্ত রঙিন স্বপ্ন বুনন করে চলে অবিরাম। কোকিল, ময়না, ঘুঘু নিস্তব্ধ দুপুরে ডেকে চলে অনবরত। ঋতুরাজ পাখির কলরবে যেন রূপছন্দ খুঁজে পায় সবাই। এ সময় লাল রঙা ফুলে বন বাদাড় ছেড়ে থাকে। জংলি ফুলে প্রকৃতির বন-বনান্তর স্নিগ্ধ শোভায় পুঞ্জীভূত করে তোলে। কৃষকের ফসলের মাঠ এখন ফুল থেকে ফল বাড়ন্ত হচ্ছে। মাঠে পাকা ফসলের ঝনঝনানিতে কৃষকের মন মৃদু হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। গ্রামের মেঠো পথগুলোতে কৃষাণীদের ফসল মাড়ানোর দৃশ্যগুলো যেন অভাবিত। ঋতুরাজ বসন্তেই এত শোভা মেলে। পাখিরা বসন্তজুড়েই তপ্ত দুপুরে গ্রামীণ জনপথকে মাতিয়ে রাখে। তাছাড়া প্রকৃতি নানা রঙের বর্ণিল সমাহারে গাছে গাছে শোভাময় দ্যুতি ছড়িয়ে দিচ্ছে। শিমুল আর পলাশের লাল রঙে বসন্তের নীরব-নিস্তব্ধ প্রকৃতির অমলিন বদনে দৃপ্ততা ছড়িয়ে দিচ্ছে বনে বনে। বসন্তের শুরুতে শরীর জুড়ানো ঝিরিঝিরি হাওয়ায় গাছের পাতার পতন ঘটিয়ে তাকে কঙ্কালসার করে তোলে। তখন গাছে গাছে পাতার ঝরে পড়ার মর্মর  শব্দের করুন সর বেজে চলে চারদিক। তারপর  গাছে গাছে সবুজ পাতার নতুন কুঁড়ি এসে পত্র-পল্লবকে সবুজে সবুজে ঢেকে দিয়ে তাকে পরিপূর্ণ করে তোলে। ঋতুরাজ বসন্তে প্রকৃতি যেন ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে বন-বাদাড়গুলো। গাছে গাছে কোকিলের মিষ্টি গলার সুরই বলে দেয় এখন বসন্তকাল। যেদিকে চোখ যায় শিমুল-পলাশে আর মাদার ফুলে লাল রং যেন সবারই দৃষ্টি কেড়ে নেয়। এ সময় ফোটে অশোক, হিমঝুড়ি, মহুয়া, মাদার, মুচকুন্দ, রুদ্রপলাশ, শাল, স্বর্ণ শিমুল, ক্যামেলিয়া, রক্ত কাঞ্চন, কুরচি, কুসুম, গাব, গামারী, জংলি বাদাম, দেবদারু, নাগেশ্বরসহ আরও অনেক ফুল। ঋতুরাজ বসন্তে মৌমাছিদের যেন ব্যস্ততা বেড়ে যায় মধু আহরণে। তারা এত ফুলের সমাহার দেখে যেন বিমোহিত হয় পড়ে। চারদিকে তখন ফুলের মিষ্টি সৌরভ ছড়িয়ে নানা ফুলেরা তাদের জানান দিয়ে থাকে। বসন্তের প্রকৃতিতে দেব- কাঞ্চন তার ডাল-পালা চারদিকে ছড়িয়ে হালকা গোলাপী ফুলের পসরা সাজায়। আর কনকচাপা কাঁচা সোনা রঙের বাহারি আয়োজন করে প্রকৃতি সাজিয়ে বসে থাকে। রুদ্র পলাশ থোকায় থোকায় ফুলের ডালি নিয়ে বাসন্তী রঙের বর্ণিল রূপের পাঞ্জেরী মেলে প্রকৃতির মধ্যে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকে। কৃষ্ণচূড়াও এ সময় কম যায় না। বিশাল এলাকায় তার ফুলের ডালা মেলে ধরে শিল্পীর কণ্ঠে বেদনার সুর তুলে দেয়। বসন্তে পলাশ ও শিমুল ফুলকে বলা যায় আগুন ঝড়া। গাঢ় লাল রঙের ফুলে ভরে থাকে গাছটি। লাল ফুলের রঙিন রং ছড়িয়ে তখন মনে হয় যেন বনে বনে আগুন লেগে গেছে। বসন্ত প্রকৃতির মাঝে সুনসান নীরবতা বিরাজ করে থাকে। তার সুশীতল বাতাস দেহমনে প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে দেয়। না শীত না গরমÑ এমনই ঋতু প্রকৃতির জন্য বিরল। পৃথিবীতে এমন ঋতু মেলা ভার। তাই তো বসন্তের মিষ্টি সুবাস আমাদের সকলকে সুমোহিত করে তোলে।  

ইফতারে তৈলাক্ত খাবার নয়

ইফতারে তৈলাক্ত খাবার নয়

রোজা মুসলমানদের একটি ফরজ বিধান। প্রতি বছর আরবি রমজান মাসে এই বিধানটি পালন করতে হয়। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার খাবার ও পানাহার থেকে বিরত থাকা রোজার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সারাদিন পানাহার থেকে ইফতারে শুরু হয় বিভিন্ন প্রকারের খাবার আয়োজন। বিশেষ করে অনেকেই ইফতারে তৈলাক্ত খাবার পিঁয়াজু, বেগুনি, আলুর চপ ইত্যাদি খেতে পছন্দ করে, যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘ সময় খাবার থেকে বিরত থাকার পর তৈলাক্ত খাবার, ভাজা-পোড়া ইত্যাদি খেলে হজম ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং গ্যাস্ট্রিক, আলসার ও বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ রোগ দেখা দেয়। তাই স্বাস্থ্য রক্ষার্থে ইফতারে ভাজা পোড়া ও অধিক  তৈলাক্ত খাবার পরিহার করে ফল-ফলাদি এবং স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ করা উচিত।

রিক্সাচালকদের প্রতি সদাচরণ

রিক্সাচালকদের প্রতি সদাচরণ

রমজান মাস মুসলিমদের জন্য অত্যন্ত পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়। এই মাসে আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ইবাদত, দান-খয়রাত এবং ভালো আচরণের মাধ্যমে নিজেদের উন্নত করার চেষ্টা করি। রমজানের পবিত্রতা শুধু ব্যক্তিগত ইবাদতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি সামাজিক দায়িত্ববোধ ও মানবিক মূল্যবোধেরও প্রতীক। এ মাসে আমাদের উচিত সবাইকে সহানুভূতি ও সম্মানের সঙ্গে দেখা, বিশেষ করে সমাজের যারা কঠোর পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করেন, যেমনÑ রিক্সাচালকদের প্রতি সদাচরণ করা। রিক্সাচালকরা আমাদের সমাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা দিনরাত পরিশ্রম করে আমাদের যাতায়াতের সুবিধা প্রদান করেন। বিশেষ করে রমজান মাসে, যখন গরম ও দীর্ঘ সময়ের রোজা রাখা হয়, তাদের কাজ আরও কঠিন হয়ে ওঠে। এই সময়ে তাদের প্রতি আমাদের আচরণে বিশেষ সতর্কতা ও সহানুভূতি প্রদর্শন করা উচিত। প্রথমত, রিক্সাচালকদের সঙ্গে কথা বলার সময় নম্র ও সম্মানজনক আচরণ করা জরুরি। তাদের কাজের কষ্টকে সম্মান এবং তাদের প্রতি ধৈর্য ধারণ করা আমাদের কর্তব্য। অনেক সময় রাস্তায় যানজট বা অন্যান্য সমস্যার কারণে রিক্সাচালকদের গতি ধীর হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে তাদের সঙ্গে রাগারাগি বা অসৌজন্যমূলক আচরণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। বরং তাদের কষ্টকে বুঝতে হবে এবং সহানুভূতিশীল আচরণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, রমজান মাসে রিক্সা ভাড়া নিয়ে বিশেষ সচেতনতা প্রয়োজন। এ মাসে আমাদের উচিত রিক্সাচালকদের সঙ্গে সঠিক ও ন্যায্য ভাড়া নিয়ে আলোচনা করা। অনেক সময় রিক্সাচালকরা তাদের পরিবারের প্রয়োজনে অতিরিক্ত পরিশ্রম করেন। তাই তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের অসদাচরণ বা ভাড়া নিয়ে বিতর্কে জড়ানো উচিত নয়। বরং প্রয়োজনে কিছু বেশি ভাড়া দেওয়ার মাধ্যমে তাদের সহায়তা করা যেতে পারে। তৃতীয়ত, রমজান মাসে দান-খয়রাতের মাধ্যমে রিক্সাচালকদের সাহায্য করা একটি মহৎ কাজ। অনেক রিক্সাচালক আর্থিক সংকটে থাকেন। এই সময়ে কিছু আর্থিক সাহায্য বা ইফতারের সময় খাবার দেওয়ার মাধ্যমে তাদের পাশে দাঁড়ানো যায়। এটি শুধু তাদের কষ্ট লাঘব করবে না, বরং আমাদের আত্মারও পরিশুদ্ধি ঘটাবে। রমজান মাসে রিক্সাচালকদের প্রতি সদাচরণ শুধু তাদের প্রতি দায়িত্বই নয়, বরং এটি আমাদের মানবিক মূল্যবোধেরও প্রতিফলন। এই মাসে আমরা যেন তাদের কষ্টকে সম্মান করি, তাদের সঙ্গে নম্র আচরণ করি এবং প্রয়োজনে তাদের সাহায্য করি। এতে করে আমরা একটি সুন্দর ও সহানুভূতিশীল সমাজ গঠনে অবদান রাখতে পারব। রমজানের প্রকৃত শিক্ষা হলো মানবতার সেবা করা এবং সবাইকে সম্মান দেওয়া। তাই আসুন, এই পবিত্র মাসে রিক্সাচালকদের প্রতি সদাচরণের মাধ্যমে আমরা আমাদের সমাজকে আরও সুন্দর করে গড়ে তুলি।

কি অপরাধ ছিল শিশুটির

কি অপরাধ ছিল শিশুটির

৮ বছরের এক শিশু। তার শরীরও কি বিপরীত লিঙ্গের মানুষকে আকর্ষণ করতে পারে! অথচ এ বয়সের একটা শিশুকে তিনজন মিলে পালাক্রমে ধর্ষণ করেছে। তাও আবার অন্য কেউ নয়, নিজের বোনের শ্বশুর, স্বামী ও দেবর। মাগুরায় ৮ বছরের শিশুটি বড় বোনের শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে এসে এমন পাশবিক নৃশংসতার শিকার হয়। অপরাধীরা ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাকে নির্মম নির্যাতনও করেছে। শিশুটি আশঙ্কাজনক অবস্থায় আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়েও বাঁচতে পারেনি। এ ঘটনায় দেশের সর্বস্তরের মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানা মাধ্যমে বিচার চেয়েছেন, নিন্দা জানিয়েছেন। ইতোমধ্যে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযানে গ্রেফতার করা হয়েছে শিশুটির বোনের স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি ও ভাসুরকে। কতটা সাইকোপ্যাথ হলে বাবাকে সঙ্গে নিয়ে নিজের বউয়ের ছোট বোনকে কেউ ধর্ষণ করে! মানে এতটা অধঃপতন হয়েছে কিছু মানুষের! মাগুরার শিশুটির ধর্ষণের ঘটনায় দায়ের করা মামলার বিচার দ্রুত শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আইন উপদেষ্টাও এই বিষয়ে জোর দিয়েছেন।   জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত সাড়ে ৩ বছরে ২২০৪ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৮ মাস পর্যন্ত ২২৪ জন কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কিছু ঘটনা নিকটাত্মীয়ের মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছে। হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) তথ্য অনুসারে, ২০২০-২০২৪ সাল পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে, বাংলাদেশে কমপক্ষে ৩ হাজার ৪৭১ জন মেয়ে শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। পরিসংখ্যান দেখে এটা অন্তত বোঝা যায়, আমাদের মধ্যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি বিরাজ করছে। এ ধরনের ঘটনা বেড়ে যাওয়া সেটিরই প্রতিফলন। গবেষণায় দেখা যায়, ঘরে ঘরে নিকটাত্মীয় কর্তৃক ধর্ষিত ও যৌন নিপীড়নের শিকার বেশি হয় শিশুরা। শিশু-কিশোরী ধর্ষণের ঘটনা বেশি ঘটে পরিবারে, নিকটাত্মীয় দ্বারা। এসব ঘটনার অনেক কিছুই প্রকাশ পায় না। একইভাবে শিক্ষিত মহল, মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তের মধ্যেও অনেক দুর্ঘটনা রয়েছে, যা প্রকাশ পায় না। সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়া, মূলত পারিবারিক ও সামাজিক প্রথা ও সংস্কার ধূলিসাৎ, সামাজিক ও নৈতিকতার চরম অবক্ষয়, তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার বিশেষ করে ল্যাপটপ-কম্পিউটার-মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা ও জবাবদিহিবিহীন ব্যবহারের সুযোগ, পর্নোগ্রাফির অবাধ বিস্তার ইত্যাদি কারণে। বিশ্ব সংস্কৃতির নেতিবাচক দিকের আগ্রাসন ধর্ষণের ঘটনা বাড়িয়ে দিয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্বল পারিবারিক বন্ধন, দুর্বল সামাজিক কাঠামো, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, দারিদ্র্য, বিচারহীনতা। আরও রয়েছে স্থানীয় ও জাতীয় সংস্কৃতি চর্চার অভাব, সুষ্ঠু ও সুস্থ ধারার বিনোদনের অনুপস্থিতি, কিশোর-কিশোরীদের ক্রীড়া-কর্মকাণ্ডের অভাব ইত্যাদি। এর চেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে, সমাজে যতসংখ্যক ধর্ষণের ঘটনা আমরা শুনি, ততটার বিচারের খবর আমরা পাই না। গণমাধ্যমে এ ধরনের খবর তেমন একটা দেখা যায় না। বরং অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষকরা শুধু পারই পায় না, পুরস্কৃতও হয়। ধর্ষণ তথা যৌন নির্যাতন হ্রাসের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে রাষ্ট্র। যদি ধর্ষককে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া যায়, তাহলে এ ঘটনা হ্রাসের পাশাপাশি বন্ধও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সমাজ এবং পরিবারও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তাই সামাজিক ও জাতীয় জীবনে নৈতিক মূল্যবোধ সুগঠিত ও সুসংগঠিত করতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার ও অশুভ বিস্তার ঠেকাতে হবে। বিশ্ব সংস্কৃতির নেতিবাচক উপাদানও নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এসবের দায়িত্ব প্রধানত রাষ্ট্রের। আর রাষ্ট্রকে সাহায্য করতে হবে আমাদের। পাশাপাশি আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য লালন করতে হবে। তাহলেই আমরা এই ভয়াবহতা এবং অমানবিকতা থেকে রক্ষা পেতে পারি।

অনাবাদি জমি চাষ

অনাবাদি জমি চাষ

দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে কিন্তু বাড়ছে না ভূমি। এ অবস্থায় বাংলাদেশের কৃষি মন্ত্রণালয়ভুক্ত প্রতিষ্ঠান এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণালব্ধ অর্জন সত্যিই আশা জাগানিয়া সংবাদ। বাংলাদেশের মোট চাষযোগ্য জমির ৭৮ শতাংশই ধান চাষের আওতায়। দেশের নাগরিকদের খাদ্যনিরাপত্তা সুরক্ষিত রাখতে সরকার ধান উৎপাদনের ওপর ব্যাপক জোর দিয়েছে সাম্প্রতিককালে। এ লক্ষ্যে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট নানা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ধানের উৎপাদন বাড়ানো অত্যাবশ্যক। দেশের প্রতিইঞ্চি অনাবাদি জমি কাজে লাগিয়ে নিজেদের খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর সরকারি নীতি মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নে ঠিক করা হচ্ছে। তৎপরতা শুরু হয়েছে ব্যক্তি মালিকানার বাইরে সরকারি প্রতিষ্ঠানের পতিত ভূমিতে ফসল ফলানোর। নিঃসন্দেহে এটি ভালো উদ্যোগ। দেশের কৃষি বিভাগ এমন সব জমি চিহ্নিত করেছে, যা কখনো কৃষি কাজে ব্যবহার হয়নি। এসব জমিতে চাষাবাদ করলে কৃষকের জন্য খুলে যাবে নতুন সম্ভাবনা। গবেষণায় দেখা গেছে, ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ১৩ লাখ হেক্টর অনাবাদি জমি আবাদের আওতায় আনা সম্ভব হতে পারে। বাংলাদেশ ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের তিনটি দ্রুততম অর্থনীতির দেশ হবে। বর্তমান খাদ্য চাহিদার নিরিখে কৃষিভূমির বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ ও ধান চাষের উপযোগিতা বিবেচনায় বিশেষজ্ঞ পরামর্শের ভিত্তিতে গোটা দেশকে পাঁচটি অঞ্চলে ভাগ করেছে কৃষি বিভাগ। পরিকল্পিত পন্থায়, অনাবাদি ও পতিত জমিতে চাষ করা গেলে ২০৩০ সালের মধ্যে ৮.৩ লাখ টন এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ১০.৬ লাখ টন অতিরিক্ত ধান উৎপাদন সম্ভব হবে। অনাবাদি, পতিত জমি ও বসতবাড়ির আঙিনায় পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী, শুধু বসতবাড়িতেই পতিত জমি রয়েছে দুই লাখ হেক্টর, যা মোট অনাবাদি জমির চার ভাগের এক ভাগ। দেশজুড়ে বসতবাড়ির আশপাশ, বিরোধপূর্ণ জমি, প্রাতিষ্ঠানিক জমি, উঁচু ভূমি, পাহাড়ি এলাকা, উপকূলীয় অঞ্চল, হাওড়-বাঁওড়, চরাঞ্চলসহ নিচু ও নিমজ্জিত জমি বছরের পর বছর অনাবাদি থাকছে। কৃষি অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশে তিন থেকে চার ধরনের অনাবাদি জমি রয়েছে। কিছু জমি পতিতই থাকছে, যেগুলো আবাদে আনা যাবে না। অনেক জমি রয়েছে শুধু এক ফসলি হিসেবে। আবার এমন অনাবাদি জমিও রয়েছে, যার মালিক খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নিতে হবে। বসতবাড়ির পাশেও পড়ে আছে অনেক জমি। কিছু জমি রয়েছে যেগুলো প্রাকৃতিকভাবেই আবাদযোগ্য করে তোলা সম্ভব। আবাদযোগ্য অনাবাদি জমি চাষের আওতায় আনতে কিছু কৌশলী ভূমিকা রাখতে হবে। সব জমিতেই ধান হবে না। কোথাও ধান, কোথাও আম-জাম, লেবু, গম, সবজি হবে। আবার কোথাও ধান চাষ, জলাভূমিতে হবে মৎস্য চাষ। দেশের প্রায় ১৮ কোটি মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষিবিজ্ঞানী, কলাকুশলী ও কৃষককূল নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। এর মধ্যে তারা সাফল্যও পেয়েছেন। আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীরা অনেক মেধাবী ও দায়িত্বশীল।  কিছু দিন পর পর আমরা গণমাধ্যমে দেখতে পাই তাদের ফসল উদ্ভাবনের নতুন সংবাদ। তাদের মতে, ধান উৎপাদন বাড়াতে শুধু আবাদযোগ্য অনাবাদি জমিই নয়, এমন জমিও আবাদের আওতায় আনতে হবে, যেগুলো আগে চাষের কথা কেউ চিন্তাও করেনি।