বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় ভূমি মালিকানা একটি সংবেদনশীল, জটিল ও বহুমাত্রিক বিষয়। আমাদের দেশের মানুষের সঙ্গে ভূমির সম্পর্ক এক ধরনের আবেগ, নিরাপত্তা এবং উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ঐতিহ্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফলে ভূমি ক্রয়-বিক্রয় কিংবা মালিকানা প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াটি শুধু একটি সাধারণ লেনদেন নয়; এটি হয়ে দাঁড়ায় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোর একটি। তবে দুঃখজনকভাবে, এই ক্ষেত্রটিই সবচেয়ে বেশি প্রতারণা, জালিয়াতি ও দীর্ঘমেয়াদি মামলার আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ প্রতিদিনকার বাস্তবতা। জাল দলিল তৈরি, ভুয়া ওয়ারিশ সাজানো, মৃত ব্যক্তির নাম ব্যবহার করে দলিল রেজিস্ট্রি, একাধিকবার বিক্রি, দলিল ও খতিয়ানে অমিল, ভূসম্পত্তি দখল, এমনকি একই জমি একাধিক ব্যক্তিকে বিক্রির মতো প্রতারণার ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব সমস্যার শিকার হন সাধারণ মানুষ, যঁরা প্রয়োজনীয় আইনগত জ্ঞান কিংবা সতর্কতা অবলম্বন না করে কেবল বিশ্বাসের ভিত্তিতে জমি ক্রয় করে থাকেন। এ অবস্থায় ভূমি ক্রয়ের পূর্বে সঠিক তথ্য যাচাই, প্রামাণ্য দলিল পর্যালোচনা, আইনি পরামর্শ গ্রহণ এবং নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে অনুসন্ধান করা একান্ত প্রয়োজন। একজন সচেতন ক্রেতা হিসেবে দায়িত্বশীল আচরণই আপনাকে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা, অর্থনৈতিক ক্ষতি ও দীর্ঘমেয়াদি আইনি জটিলতা থেকে রক্ষা করতে পারে। এই প্রবন্ধে আমরা ভূমি মালিকানা সম্পর্কিত প্রতারণার সাধারণ কৌশলসমূহ, আইনি প্রতিকার এবং সচেতনতা অবলম্বনের করণীয় বিষয়ে বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা উপস্থাপন করব। আশা করি, বিষয়গুলোর প্রতি সুস্পষ্ট ধারণা ও সতর্কতা একজন সম্ভাব্য জমি ক্রেতাকে একটি নিরাপদ ও বৈধ মালিকানার পথে এগিয়ে যেতে সহায়তা করবে।
বাংলাদেশে ভূমি ক্রয় একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং জটিল প্রক্রিয়া। অনেক সময় সামান্য অসতর্কতা কিংবা প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাই না করার কারণে একজন ক্রেতা পড়তে পারেন বছরের পর বছর ধরে চলা মামলা, প্রতারণা কিংবা মালিকানা জটিলতার মধ্যে। ভূমি হচ্ছে একাধারে অর্থনৈতিক বিনিয়োগ এবং সামাজিক নিরাপত্তার প্রতীক। তাই জমি কেনার পূর্বে, সময়ে এবং পরে কিছু গুরুত্বপূর্ণ করণীয় অনুসরণ করলে প্রতারণার ফাঁদে পড়ার ঝুঁকি অনেকাংশেই কমে আসে। ভূমি ক্রয়ের প্রাথমিক ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো মালিকানা যাচাই। যিনি নিজেকে জমির মালিক দাবি করছেন, তিনি আসলেই বৈধ মালিক কি না-তা নিশ্চিত করাটা বাধ্যতামূলক। যদি বিক্রেতা জমির মালিক হন ক্রয়সূত্রে, তাহলে অবশ্যই তার দলিল, হাল ও পুরানো খতিয়ান, মৌজা ও প্লট নকশা এবং খারিজ রেকর্ড মিলিয়ে দেখা জরুরি। যদি তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে মালিক হন, তাহলে সংশ্লিষ্ট ওয়ারিশ সনদ, বাটোয়ারা দলিল এবং সম্পত্তিতে তার সুনির্দিষ্ট অংশের তথ্য যাচাই করতে হবে। জমিতে অন্য কেউ বর্গাদার হিসেবে বসবাস করছেন কি না, জমি বন্ধক দেওয়া আছে কি না, বা জমিটি পূর্বে অন্য কাউকে বিক্রি করা হয়েছে কি না-এসব তথ্য জানাও গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় জমির দাগ ও পরিমাণ দলিলের সঙ্গে মিল থাকে না; ফলে সরেজমিন পরিদর্শন করে জমির প্রকৃত অবস্থা, দখল কার হাতে আছে, প্রতিবেশীদের বক্তব্য কী-এসব বিষয় জেনে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। প্রয়োজনে সহকারী কমিশনার (ভূমি), তহসিল অফিস এবং সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে গিয়ে সংশ্লিষ্ট রেকর্ড যাচাই করে নেওয়া উচিত। দলিলে কোনো ধরনের উকিল নোটিস বা চলমান মামলা আছে কি না-তা কোর্ট বা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হতে হবে।
ভূমি কেনার সময় কিছু প্রক্রিয়াগত ও আইনগত পদক্ষেপ অনুসরণ করলে ভবিষ্যতে জটিলতা এড়ানো সম্ভব হয়। দলিলের স্ট্যাম্প অবশ্যই ক্রেতার নামে ক্রয় করতে হবে এবং দলিল রেজিস্ট্রির সময় উভয় পক্ষের ছবি, স্বাক্ষর ও টিপসই যথাযথভাবে নিশ্চিত করতে হবে। দলিল রেজিস্ট্রির রসিদ সংরক্ষণ করা এবং বিক্রেতার ২৫ বছরের মালিকানা ইতিহাস যাচাই করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতামূলক পদক্ষেপ। দলিলের সঙ্গে বিক্রেতার নামজারি কপি, আরএস পর্চা (সর্বশেষ রেকর্ড) এবং হাল খাজনার রশিদ সংযুক্ত রাখা ভবিষ্যতের বিরোধ ও দাবি-দাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। এ সময় একজন অভিজ্ঞ আইনজ্ঞ বা জমি সংক্রান্ত অভিজ্ঞ আইনজীবীর পরামর্শ গ্রহণ করলে পুরো লেনদেন প্রক্রিয়াটি আরও সুরক্ষিত হয়। দলিল রেজিস্ট্রির পরপরই জমির দখল গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দখলহীন জমি ভবিষ্যতে নানা সমস্যার উৎস হতে পারে। রেজিস্ট্রিকৃত দলিল হাতে পাওয়ার পর যথাশীঘ্রই সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিসে গিয়ে নিজের নামে নামজারি সম্পন্ন করতে হবে। নামজারি ছাড়াই শুধু দলিলের ভিত্তিতে সম্পূর্ণ মালিকানা প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। নামজারির পর থেকে খাজনা নিয়মিতভাবে পরিশোধ করা উচিত এবং খাজনার রসিদ, মূল দলিল ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র আলাদা ফাইলে সংরক্ষণ করা উচিত, যাতে ভবিষ্যতে প্রমাণ হিসেবে সহজেই উপস্থাপন করা যায়।
ভূমি ক্রয় কখনোই শুধু আর্থিক লেনদেনের বিষয় নয়-এটি ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, পারিবারিক ভবিষ্যৎ এবং দীর্ঘমেয়াদি সম্পত্তির মালিকানা সুরক্ষার সঙ্গে জড়িত। একটি ভুল সিদ্ধান্ত বা অবহেলার কারণে একজন মানুষকে বছরের পর বছর ধরে মামলা-মোকদ্দমার ঘানি টানতে হতে পারে। আমাদের দেশে ভূমি নিয়ে প্রতারণা, জাল দলিল, ওয়ারিশ বিভ্রান্তি, দখলবাজি এবং অবৈধ দখল অত্যন্ত সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বাস্তবতায় ভূমি ক্রয়ের প্রতিটি ধাপে জ্ঞান, সতর্কতা এবং আইনগত সহায়তা অত্যাবশ্যক। যাদের ভূমি সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা নেই, তারা প্রায়ই প্রয়োজনীয় নথিপত্র যাচাই না করে বা দলিলের ভাষা বুঝে ওঠার আগেই লেনদেন চূড়ান্ত করে ফেলেন। এতে করে প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা বহুগুণ বেড়ে যায়। তাই একজন অভিজ্ঞ আইনজীবী, ভূমি পরামর্শক বা জমি বিশেষজ্ঞের সহায়তা গ্রহণ করা হবে বুদ্ধিমানের পরিচায়ক। অনেক সময় ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বা পরিচিতজনের কথায় ভরসা করে দলিল যাচাই না করেই জমি কেনা হয়, যা ভবিষ্যতে মারাত্মক জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। ভূমি ক্রয়ের ক্ষেত্রে সর্বদা মনে রাখতে হবে, একটি সহজ কিন্তু কার্যকর নীতি- ‘সতর্কতা, যাচাই ও বিবেচনা’। এই তিনটি পদক্ষেপকে আমরা বলতে পারি ভূমি লেনদেনের ‘স্বর্ণসূত্র’ (এড়ষফবহ জঁষব)।
১. সতর্কতা রাখুন প্রতিটি কাগজপত্র, দখল ও রেকর্ড বিষয়ে।
২. যাচাই করুন জমির মালিকানা, রেকর্ড, মামলা ও খাজনার তথ্য নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে।
৩. বিবেচনা করুন ভবিষ্যতের প্রয়োজন, পারিবারিক চাহিদা এবং জমির অবস্থানগত গুরুত্ব।
একটি জমি যদি শতভাগ বৈধভাবে এবং আইনগত সুরক্ষা নিশ্চিত করে কেনা যায়, তবে সেটি কেবল একটি সম্পত্তি নয়, বরং এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের বিরুদ্ধে একটি সুরক্ষা বলয় তৈরি করে। আপনার সামান্য সতর্কতা আপনাকে ভবিষ্যতের অনাকাক্সিক্ষত বিরোধ, প্রতারণা ও হয়রানি থেকে মুক্ত রাখতে পারে। কাজেই, ভূমি ক্রয়ের প্রতিটি পদক্ষেপ হোক সচেতন, আইনি সহায়তাপুষ্ট এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাইনির্ভর। তাহলেই নিশ্চিত হবে একটি সুরক্ষিত, স্বচ্ছ ও শান্তিপূর্ণ ভূমি মালিকানা।
লেখক : আইনজীবী ও গবেষক