
‘হকারমুক্ত শহর’- এই বাক্যটি যেন এক আধুনিক স্বপ্নের মতো। নগর পরিকল্পনার কাগজে-কলমে এটি সৌন্দর্য ও শৃঙ্খলার প্রতীক। প্রশাসনের চোখে ফুটপাত শুধু পথচারীর চলাচলের পথ, আর নাগরিকের চোখে তা শহরের শৃঙ্খলার ব্যাঘাত। কিন্তু বাস্তবের ঢাকা শহর আমাদের অন্য এক গল্প শোনায় যেখানে ফুটপাতের প্রতি বর্গফুট জুড়ে আছে জীবিকার যুদ্ধ, ক্ষুধার বিরুদ্ধে প্রতিদিনের এক নীরব অথচ দৃঢ় প্রতিরোধ।
ঢাকার প্রতিটি ব্যস্ত এলাকায় তাকালেই দেখা যায়, ফুটপাতজুড়ে বসা হকারদের মুখ। কারও সামনে শীতলপাটি, কারও গলায় ঝোলানো মোবাইল কাভারের মালা, কোথাও পুরানো বইয়ের স্তূপ, কোথাও আবার গরম চা আর সিঙ্গাড়ার কড়াই। এদের সবার ভেতরেই লুকিয়ে আছে একটি জীবন যেখানে নেই চাকরি, নেই মাসিক বেতন, নেই কোনো নিরাপত্তা। আছে শুধু বিকিকিনির মধ্য দিয়ে প্রতিদিনের লড়াই টিকিয়ে রাখার চেষ্টা।
প্রশাসনের চোখে এটি অনধিকার প্রবেশ, দখল। তাই হকার উচ্ছেদ একটি নিয়মিত অভিযান। কিন্তু প্রতিটি উচ্ছেদের দৃশ্যের পেছনে থাকে কান্না, অনিশ্চয়তা আর বেঁচে থাকার সংগ্রাম। দোকান গুটিয়ে চলে যাওয়া মানে কারও সন্তান স্কুলে না যাওয়া, কারও অসুস্থ মায়ের ওষুধ বন্ধ হয়ে যাওয়া, আবার কারও মাসের ঘর ভাড়ার টাকা জোগাড় না হওয়া। অথচ এসব মানুষের কেউই শহরের বোঝা নয়, তারা বরং শহরের বিকল্প অর্থনীতির এক বড় চাকা। প্রতিদিন লাখ থেকে কোটি টাকা ঘোরে এই ফুটপাত-বাজারে, যা অনেকের জন্য সাশ্রয়ী কেনাকাটার ভরসাও বটে।
রাজনীতি এখানে বড় চরিত্র। অনেক সময় হকারদের পেছনে থাকে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, আবার উচ্ছেদের সময় সেই একই রাজনীতি মুখ ঘুরিয়ে নেয়। চাঁদা, নীরব চুক্তি, পুনরায় বসে পড়া- সব মিলে এই জীবন যেন এক চক্রের নাম, যেখান থেকে বের হওয়ার পথ নেই, শুধু ঠেকে ঠেকে এগোনোর চেষ্টা আছে।
আমরা কি পারি না এই বাস্তবতাকে স্বীকার করে একটি মানবিক সমাধানের কথা ভাবতে? শহরের সৌন্দর্য অবশ্যই প্রয়োজন, পথচারীর নির্বিঘ্ন চলাচলও জরুরি। কিন্তু সেই সৌন্দর্য যদি কারও পেটের ভাত কেড়ে নেয়, তবে সে শৃঙ্খলার মধ্যে মানবিকতা কোথায়? পরিকল্পিত ‘হকার জোন’, বিক্রির সময়সীমা, অথবা নির্দিষ্ট এলাকায় বৈধভাবে বসার সুযোগ- এসব বাস্তবায়নই হতে পারে সহাবস্থানের উপায়। বিদেশের অনেক নগরে এসব পদ্ধতি কাজ করছে ভালোভাবেই।শহরকে শুধুই পাথরের শহর ভাবলে চলবে না। প্রতিটি ফুটপাত, প্রতিটি ছায়া, প্রতিটি বিকিকিনি- সবই আসলে মানুষের গল্প। এই শহরের নিচে আজ যে জীবনগুলো চাপা পড়ে আছে, আমাদের দায়িত্ব সেই জীবনের শব্দ শুনে নেওয়া। নইলে একদিন এই শহরই হয়ে উঠবে শুধু ইট-পাথরের কাঠামো- জীবনহীন, নীরব, অথচ নিখুঁত।
যশোর থেকে
প্যানেল