ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৩ জুলাই ২০২৫, ১৯ আষাঢ় ১৪৩২

সমাজ কি বলবে? – এই শৃঙ্খলে আবদ্ধ থেকে নিজেকে হারাবেন না

মেহেদী কাউসার

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ৩ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ০৫:৫৯, ৩ জুলাই ২০২৫

সমাজ কি বলবে? – এই শৃঙ্খলে আবদ্ধ থেকে নিজেকে হারাবেন না

ছ‌বি: প্রতীকী

সমাজের চাপে কিংবা অন্যদের প্রত্যাশার ভারে অনেকেই নিজেকে হারিয়ে ফেলার মতো পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। “সমাজ কি বলবে?”— এই প্রশ্নটি অনেকের জীবনে এক ধরনের দমনমূলক বাক্সে পরিণত হয়, যেখানে নিজস্ব ইচ্ছা, চিন্তা ও স্বপ্ন গুলো আটকে পড়ে।

সমাজের এই অব্যাহত তীক্ষ্ণ নজরদারি এবং বিচার-বিশ্লেষণের কারণে ব্যক্তি তার প্রকৃত স্বরূপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং নিজের আবেগ, মনোবাঞ্ছা বা দক্ষতা বিকাশের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। কিন্তু এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি, কারণ সমাজের শৃঙ্খলে আটকা পড়লে জীবনের প্রকৃততা ও আনন্দ নষ্ট হয়।

সমাজ একটি কাঠামো, যেখানে নিয়ম-কানুন ও মূল্যবোধ কাজ করে। এসব নিয়ম সমাজের অঙ্গসজ্জা হিসেবে একটি সামগ্রিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সাহায্য করে। তবে সমাজের নিয়মাবলী কখনো কখনো ব্যক্তির স্বাধীনতা ও সৃজনশীলতার বিকাশের বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে যখন সেই নিয়মগুলো ব্যক্তির মনের স্বাধীনতা ও নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার হরণ করে। এর ফলে অনেক সময় ব্যক্তি নিজের মনের প্রতি অবিশ্বাসী হয়ে পড়ে, নিজের ইচ্ছাকে দমন করে নিজের ভিতরেই দ্বন্দ্ব তৈরি হয়।

“সমাজ কি বলবে?” এই চিন্তাধারায় ঘিরে থাকা মানে নিজের স্বাধীন চিন্তা, সৃষ্টিশীলতা এবং স্বতন্ত্রতা বিলুপ্ত করে দেয়া। এর ভেতর লুকিয়ে থাকে আত্মবিশ্বাসের অভাব, নিজের প্রতি অবিশ্বাস এবং ভয়ের এক মনস্তাত্ত্বিক বন্ধন। ফলাফল হিসেবে, ব্যক্তি হয়তো তার জীবন পরিচালনায় অসন্তুষ্ট থাকে, হয়তো তার স্বপ্ন, পছন্দ-অপছন্দ কিংবা ব্যক্তিগত লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়। দীর্ঘমেয়াদে এইসব চাপ তার মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

সমাজের মান-দণ্ডে বাধ্য হয়ে চলা অনেক সময় ব্যক্তির ব্যক্তিত্বকে বিকৃত করে। একজন মানুষ যখন নিজের আবেগ, চিন্তা ও পছন্দ লুকিয়ে রাখে শুধুমাত্র সমাজের মনোভাব ঠিক রাখতে, তখন তার অন্তর্দ্বন্দ্ব বাড়ে এবং সে নিজের মধ্যে অস্থিরতা অনুভব করে। এই অস্থিরতা জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যেমন সম্পর্কের অবনতি, কর্মক্ষেত্রে মনোযোগ কমে যাওয়া এবং সামগ্রিক সুখ-শান্তির অভাব।

তাই প্রয়োজন সমাজের এই নকশাকৃত কাঠামোর বাইরে গিয়ে নিজের আসল পরিচয় খুঁজে বের করার। নিজেকে জানার জন্য সময় দিতে হবে, নিজের মতামত ও অনুভূতিকে গুরুত্ব দিতে হবে। যখন আমরা নিজেদের অনুভূতি ও মনোভাবকে সঠিক জায়গায় রাখতে শিখব, তখনই আমাদের জীবন হবে পরিপূর্ণ ও স্বতন্ত্র। নিজের পরিচয়ের প্রতি একাগ্রতা বাড়িয়ে, আমরা সামাজিক চাপের বিরুদ্ধে স্থির থাকতে পারব এবং নিজেদের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হব।

অর্থাৎ, সমাজের কথা ভাবা জরুরি, তবে সমাজের নিয়ম ও চিন্তাধারার অন্ধ অনুসরণ নয়। আমাদের উচিত সেইসব নিয়মের মধ্যে থেকে নিজের স্থান নির্ধারণ করা, যেখানে আমরা সম্মান এবং স্বাধীনতার মধ্যে সঠিক সমন্বয় রাখতে পারি। এই সঠিক সমন্বয় না হলে ব্যক্তি হয় একটি ছায়ার মতো, যাকে কেউ সত্যিই চিনতে বা বুঝতে পারে না, এমনকি সে নিজেও নিজের সঠিক অবস্থান বুঝতে পারে না।

আমাদের চারপাশের সমাজের কথা শুনে যদি আমরা নিজেদের কথা বলি না, নিজের প্রয়োজনকে গুরুত্ব না দিই, তাহলে আমরা শুধু সমাজের দৃষ্টিতে ভাল হওয়ার জন্য বেঁচে থাকব, কিন্তু নিজের সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য এবং স্বপ্নকে হারিয়ে ফেলব। এটাই হলো সবচেয়ে বড় ক্ষতি। কারণ জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে নিজের ইচ্ছা ও মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটিয়ে সুখী ও সার্থক জীবন যাপন করা।

সুতরাং, সমাজের “কি বলবে” প্রশ্নের বাইরে দাঁড়িয়ে নিজেকে সঠিকভাবে চিনে নেওয়ার প্রচেষ্টা করতে হবে। নিজেকে ভালোবাসতে হবে, নিজের মতামত প্রকাশে সাহসী হতে হবে। সমাজের নেতিবাচক বিচার-বিবেচনা থেকে ভয় পেয়ে নিজের স্বপ্ন ও স্বাধীনতা না হারিয়ে, নিজেকে উন্নত করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এতে করে আমরা একজন সম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারব, যিনি সমাজের অংশ হলেও নিজস্ব পরিচয় ও অধিকার থেকে বঞ্চিত নন।

সমাজের কথা শোনা উচিত, কিন্তু সেই কথা আমাদের স্বাধীনতা হরণ করতে পারবে না। নিজেকে হারিয়ে না দিয়ে, সেই সমাজের অংশ হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করার সাহস রাখতে হবে। কারণ জীবনের প্রকৃত সার্থকতা আসে নিজের পরিচয়কে ধরে রেখে সঠিক পথে চলার মধ্য দিয়ে। “সমাজ কি বলবে” এই প্রশ্নকে আমরা চিন্তার বিষয় হিসেবে রাখব, কিন্তু তার শৃঙ্খলায় গা বাঁধব না।

এম.কে.

×