প্রথম দিকে পরস্পরবিরোধী শক্ত অবস্থানে থাকলেও জুলাই সনদের স্বার্থে এখন অনেকটাই নমনীয় রাজনৈতিক দলগুলো। রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে দলগুলো ছাড় দেওয়াকে সংলাপের বড় অগ্রগতি হিসেবেই দেখছে কমিশন। দেশের স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলো শক্ত অবস্থানে না থেকে যেভাবে নমনীয় হয়ে ছাড় দিচ্ছে, তাতে চলতি জুলাই মাসেই আলোচিত ‘জুলাই সনদ’ স্বাক্ষরের ব্যাপারে দৃঢ় আশাবাদী হয়ে উঠেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
বৃহস্পতিবারের বৈঠকেও রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শন সম্পর্কিত বিধান এবং বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ বিষয়ে দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ঢাকার পাশাপাশি বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্টের বেঞ্চ স্থাপনের বিষয়ে একমত হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। দ্বিতীয় পর্যায়ের টানা বৈঠকে এ পর্যন্ত সংবিধানের ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্ব, নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা-সম্পর্কিত বিধান এবং বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ বিষয়ে আলোচনা নিষ্পত্তি হয়েছে।
বৈঠক শেষে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেন, সংলাপে বড় ধরনের অগ্রগতি হয়েছে। এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে ধন্যবাদ দিতে চাই। কারণ সংস্কারের বিষয়ে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ছাড় দিয়েছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শন সম্পর্কিত বিধান এবং বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ড. আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় বৃহস্পতিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় ধাপের নবম দিনের বৈঠকে কমিশনের সদস্য সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক, ড. বদিউল আলম মজুমদার এবং ড. আইয়ুব মিয়া উপস্থিত ছিলেন।
সংলাপে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টিসহ ৩০টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। আগামী ৭ জুলাই আবার আলোচনা হবে বলে জানায় কমিশন।
বৈঠক শেষে ব্রিফিংকালে ড. আলী রীয়াজ বলেন, ‘বিগত দিনে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে ক্ষমতার ব্যাপক অপব্যবহার হয়েছে। তাই রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধানের ৪৯ নম্বর অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করেছে। এ বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, যা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার মধ্য দিয়ে বাস্তবায়িত হবে। আর সুপ্রিম কোর্টের স্থায়ী আসন রাজধানীতে থাকবে। পাশাপাশি প্রতিটি বিভাগে এক বা একাধিক স্থায়ী বেঞ্চ থাকবে। সে বিষয়েও ঐকমত্য হয়।’
ড. আলী রীয়াজ বলেন, সংবিধানের ৪৯ নম্বর অনুচ্ছেদ সংশোধন বিষয়ে যে ঐকমত্য হয়েছে তা হলো ‘কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ প্রদত্ত যে কোনো দণ্ডের ক্ষমা ও বিরাম মঞ্জুর এবং যে কোনো দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকবে। আইনের দ্বারা নির্ধারিত মানদণ্ড, নীতি ও পদ্ধতি অনুসরণক্রমে ওই ক্ষমতা প্রয়োগ করা হবে।’
তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘সংবিধানের ৪৯ নম্বর অনুচ্ছেদ সংশোধন বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের দেওয়া প্রস্তাবের আলোকে যে রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরি হয়েছে, তা ভবিষ্যতে সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে। এতদিন ধরে এ ক্ষমতার যে অপব্যবহার হয়েছে তা বন্ধ হবে।’
বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ সম্পর্কিত বিষয়ে যে অগ্রগতি হয়েছে তা উল্লেখ করে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘রাজধানীতে সুপ্রিম কোর্টের স্থায়ী আসন থাকবে তবে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিয়ে প্রধান বিচারপতি সময়ে সময়ে যে সার্কিট বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন তার পরিবর্তে রাজধানীতে সুপ্রিম কোর্টের স্থায়ী আসন থাকবে। প্রধান বিচারপতি কর্তৃক প্রতিটি বিভাগে এক বা একাধিক স্থায়ী বেঞ্চ থাকবে। অর্থাৎ হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ বিভাগীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। এ বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে সংবিধানের ১০০ নম্বর অনুচ্ছেদের পরিবর্তন হবে।’
বৈঠক শেষে রাজনৈতিক দলের নেতারা যা বলেন ॥ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক শেষে ব্রিফিংকালে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘জাতীয় সনদ দ্রুত বাস্তবায়ন হোক বিএনপি তা চায়। আর যেন এটি দীর্ঘায়িত না হয়। বিএনপি সরকারি বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করলেও একটি মহল বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা বিগত সময় দেখেছি রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার যথেষ্ট অপব্যবহার হয়েছে। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিসহ বড় বড় অপরাধ করা আসামিদের ক্ষমা প্রদর্শনের মাধ্যমে হত্যাযজ্ঞের একটা উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। ফলে দেশে এটার মাধ্যমে আলোচনায় আসছে এ ক্ষমতাটা রাষ্ট্রপতির হাতে এভাবে অবারিত থাকা উচিত কি না। সেই সেন্টিমেন্টের সঙ্গে একমত পোষণ করে, আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির এ ক্ষমতা প্রয়োগের একটা বিধান আনা যায় কিনা এবং আইনি একটা পরামর্শ সভা বা বোর্ড রাখা যায় কি না। এ ছাড়া এর সঙ্গে কোনো নীতিমালা প্রণয়ন করা যায় কি না, কি পদ্ধতি অনুসরণ করেই ক্ষমা প্রদর্শনীর বিষয়টি করা যায় এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। নীতিগতভাবে একমত পোষণ করেছি, রাষ্ট্রপতির এ ক্ষমতাটা আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে।
বৈঠকে বিভিন্ন বিষয়ে একমত পোষণ করার বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, আমরা এ সময়ে এসে সংবিধানে এমন কিছু পরিবর্তন করতে পারব না, যে পরিবর্তন পরবর্তীতে টিকবে না। সেটা আমাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে না। এখন যে পর্যায়ে আছি, এখানে জনগণ ও রাষ্ট্রের কাছে আমাদের দায় অনেক বেশি। আমরা এখানেই রাজনৈতিকভাবে মতামত দিচ্ছি না, জনগণের জন্য, দেশের কল্যাণের জন্য সার্বিকভাবে মতামত দিচ্ছি। এখানে কোনোভাবেই রাজনৈতিক বিবেচনা থাকার কথা নয়।
স্বাধীন বিচারব্যবস্থার সুফল জনগণকে ভোগ করতে হলে আগে উচ্চ ও নিম্ন আদালতকে ফ্যাসিস্টমুক্ত করতে হবে উল্লেখ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, ‘উচ্চ এবং নিম্ন আদালতে ফ্যাসিস্টদের বহাল রেখে যতই আমরা স্বাধীন বিচারব্যবস্থা করি না কেন, এর সুবিধাভোগী এরা (ফ্যাসিস্টরাই) হবে। আমাদের পরিষ্কার বক্তব্য, ফ্যাসিস্টমুক্ত হতে হবে উচ্চ এবং নিম্ন আদালত। তারপরে স্বাধীন বিচারব্যবস্থা সত্যিকার অর্থে কার্যকর হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের নেতাকর্মী, সাংবাদিকসহ সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে তারা অবৈধভাবে সাজা দিয়েছে। সেই ফ্যাসিস্টদের যেন আমরা রক্ষা না করি, আমরা চাই উচ্চ এবং নিম্ন আদালতে যাতে ফ্যাসিস্টের দোসররা না থাকে। এখন যাদের বিরুদ্ধে বদলি, বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এটা যথেষ্ট নয়। তাদের অপরাধের জন্য নির্দিষ্ট করে শুধু চাকরি গেলে হবে না, অপরাধের জন্য তাদের বিচারও করতে হবে।
ব্রিফিংকালে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, ‘বিগত দিনে চিহ্নিত অপরাধীদের ক্ষমা করে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। তাই এ বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়নের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছেছে। এতে বিচার ব্যবস্থাকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।’
তিনি বলেন, ‘কোনো অপরাধীর ক্ষমার বিষয়ে রাষ্ট্রপতি নিজে নিজে ক্ষমা করতে পারবেন না। অপরাধীর ক্ষমা চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করতে একটি কমিটি থাকবে। এ ক্ষেত্রে পরিবার বা ভুক্তভোগীর রক্তের সম্পর্ক থাকা ব্যক্তির মতামত লাগবে। তারা চাইলে সমঝোতা করতে পারবেন। আমরা আজ নতুন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যোগ করেছি। যদি কোনো ব্যক্তিগত অপরাধ, যেমন হত্যাকাণ্ড ঘটে এবং দোষী ব্যক্তিকে দণ্ড দেওয়া হয়, তাহলে ভুক্তভোগী পরিবারের সম্মতি ছাড়া রাষ্ট্রপতি বা কমিটি এককভাবে সেই সাজা মাফ করতে পারবেন না। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার সম্মতি দিলে তবেই ক্ষমা বিবেচনায় আসবে। এতে ইনসাফ নিশ্চিত হবে।’
বিভাগীয় শহরে হাইকোর্ট বেঞ্চ স্থানান্তরের বিষয়ে জামায়াতে ইসলামী একমত পোষণ করেছে উল্লেখ করে জামায়াতের নায়েবে আমির বলেন, ‘অনেক পরিবারের বিচার পেতে অনেক দূর থেকে ঢাকায় আসতে হয়। এ ক্ষেত্রে অনেকের জন্য থাকা-খাওয়া ও যাতায়াতের ব্যয়ভার বহন করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। তাই আমরা এ বিষয়টির পক্ষে বলেছি। শুরুতে হয়তো কিছুটা সীমাবদ্ধতা দেখা দিতে পারে। এত বিচারপতি কোথা থেকে আসবে। তারা ঢাকা থেকে যেতে রাজি হবেন কি না বা আইনজীবী পাওয়া যাবে কি না। হয়তো কিছুটা বেগ পোহাতে হবে। তবে সরকার চাইলে বাজেট বাড়াতে পারে ও প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিতে পারে। তাহলে অনেক বিচারপতিই ঢাকার বাইরে যেতে আপত্তি করবেন না।’
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, তারা রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের প্রক্রিয়া ও বিচারব্যবস্থার সংস্কারে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। অতীতে রাষ্ট্রপতির ক্ষমার অপব্যবহার হয়েছে। শীর্ষ সন্ত্রাসীদেরও ক্ষমা করা হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। এতে ন্যায়বিচার ক্ষুণœ হয়েছে, বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা কমেছে। রাষ্ট্রপতির ক্ষমা যেন আর নিরঙ্কুশ না থাকে, বরং একটি বোর্ডের সুপারিশের ভিত্তিতে তা প্রদর্শিত হয় এ প্রস্তাবে আমরা একমত হয়েছি।
তিনি বলেন, ২০ কোটি মানুষের দেশে হাইকোর্ট এবং আপিল বিভাগ মিলিয়ে কয়েক লাখ মামলা বিচারাধীন। মাত্র ১০০ জন বিচারপতি দিয়ে এই মামলাগুলো নিষ্পত্তি সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, আমরা যে গণঅভ্যুত্থানের পথ ধরে এই সংস্কার উদ্যোগে এসেছি, সেই জনগণের আকাক্সক্ষা আমাদের ধারণ করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো ও কমিশনের একমত হওয়া সিদ্ধান্তগুলো যেন বাস্তবায়ন হয়, সেটিই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।