ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১২ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২

মতামত

মতামত বিভাগের সব খবর

গণঅভ্যুত্থান ও ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি

গণঅভ্যুত্থান ও ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি

আওয়ামী লীগ তার ঐতিহ্যকে ধারণ করেই মনের মাধুরি মিশিয়ে অপশাসন কায়েম করেছে এদেশে। তার পুরো অপশাসনের বিএনপি সংগ্রাম করেছে- যা এদেশের মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণ অবগত হয়েছে। ফ্যাসিস্ট হাসিনার জুলুম আর নিপীড়নে বিএনপি কি পরিমাণ ক্ষতির শিকার হয়েছে- তা ইতিহাস সাক্ষী। জাতীয়তাবাদী আদর্শে আমরা সংগ্রাম করেছি; ভারতের পরিকল্পনায় চালিত আওয়ামী লীগের সকল প্রকারের দোসরদের বিরুদ্ধে। অবশ্য এই সংগ্রামে আরও অনেকে শরিক হয়েছিল বিএনপির সঙ্গে- যাদের মানসিক ও রাজনৈতিক মতাদর্শ জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। দীর্ঘ এই সংগ্রামে আমাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ফ্যাসিস্ট সরকার ১৪২৮২৫টি মামলা- যার আসামির সংখ্যা ৫০৩২৬৫৫ জনের বেশি। গুম আর নির্যাতন আমাদের নিত্যসঙ্গী। ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিদায়ে বিএনপির ধারাবাহিক এই সংগ্রাম আর ত্যাগই ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিল। অবশেষে তারেক রহমানের নানারকম দিকনির্দেশনায় ছাত্র-জনতা চূড়ান্ত সফলতা বয়ে এনেছে। সত্যিকারার্থে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় এই অভ্যুত্থানে রাজপথে নেমে এসেছিল দেশের আপাময় জনগণ।  ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন ও আম-জনতার গণঅভ্যুত্থান রচিত হয়েছে আমাদের অনেক ভাই-বোনদের রক্ত আর অকুতোভয় সাহসিকতায়। তাই কৃতজ্ঞচিত্রে স্মরণ করছি স্বাধীন দেশের কঠিন ক্লান্তি মুহূর্তে রক্তাক্ত অভ্যুদয়ের পিচ্ছিল পিচঢালা বন্ধুর পথে যে অগণিত আপামর ভাই-বোনেরা জাগতিক জীবন হারিয়েছেন, শহীদ হয়েছেন তাদের সকলকে। এ সময়ে রাষ্ট্রের মূল ধারার যে কয়েকজন গণবুদ্ধিজীবী ফ্যাসিস্ট হাসিনার রক্তচক্ষুকে তোয়াক্কা না করে গত ১৬ বছর এবং অবশেষে আম-জনতার পক্ষে কলম ধরেছেন তাদেরকেসহ দেশের ক্লান্তিলগ্নের আন্দোলনকারী শহীদদের পরিবার-পরিজনকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। একই সঙ্গে ভালোবাসা আর বিপ্লবী অভিবাধন জানাই চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের সেই সকল অকুতোভয় সংগ্রামী মার্চ-পিপল বিশেষ করে জাতীয়তাবাদী আদর্শের প্রতিটি কর্মীকে- যারা জীবনকে বাজি রেখে জালিম ফ্যাসিস্ট হাসিনাসহ তার দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ধূসরদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ফ্যাসিবাদের আগ্রাসী থাবা থেকে ভঙ্গুর এই দেশটিকে উদ্ধার করে নব এক বাংলাদেশরূপে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে পেরেছেন।  আমরা যে আজ স্বপ্নের দেশ গড়ার পরিকল্পনার কথা উচ্চস্বরে বলতে পারছি- তা বীরের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গত ১৬ বছর সংগ্রাম করেছে- জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী এই জাতি। স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানের আদর্শ আর বেগম জিয়ার পরামর্শে জাতির এই বলিষ্ঠ সৈনিকদের নেতৃত্ব দিয়েছেন তারেক রহমান।  জুলাই-আগস্ট, ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান মানেই নব বাংলাদেশ- যেখানে নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে; এই জাতি। ইলিয়াস আলী ও চৌধুরী আলমের সঙ্গে ১৫৮১ জন নিহত এবং ২২ হাজার আহতের মাধ্যমে এই জাতি নব বাংলাদেশ ঠিকই পেয়েছে? একই সঙ্গে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পেটুয়া পুলিশ বাহিনীর ১৪৪ ধারাকে ভেঙে যেসব জাতীয়তাবাদী নেতাকর্মী গ্রেপ্তারের তোয়াক্কা না করে রাজপথে নেমে এসেছেন; তাদের শ্রমও মুক্তির পথকে করেছে মসৃণ। চলমান আন্দোলনে ১৪৪ ধারা ভেঙে ২০২৪-এর ১৯ জুলাই ঢাকার প্রেস ক্লাবে সরকারবিরোধী বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিল বিএনপির নেতৃবৃন্দ। ৩ আগস্ট শাহবাগ চত্বর স্লোগানে মুখরিত করেছিল এমএ গাফফাররা (যুবদল ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক)। ঢাকার রাজপথের নানা স্পটে নেতৃত্ব দিয়েছিল বিএনপি নেতা সেলিমুজ্জামান সেলিম (নির্বাহী কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক)। তারেক রহমানের নির্দেশনায় বিএনপির জাতীয় নেতৃবৃন্দ হাজার হাজার নেতাকর্মী নিয়ে কাকরাইল থেকে মালিবাগ লোকে লোকারণ্য করেছিল- এগুলো সরকারের বিদায়কে সহজ করেছে। ফ্যাসিস্ট সরকার ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পরেরদিন ২০ জুলাই ঢাকা উত্তর বিএনপির আহবায়ক আমিনুল হকসহ অনেককে গ্রেপ্তার করে এবং ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে চরমভাবে নির্যাতনকালীন অসুস্থ হলেও হাসাপাতালে নেয়নি। কিন্তু ফ্যাসিস্ট হাসিনা মুক্ত এই বাংলাদেশের ভিত যে তৈরি হয়েছিল বেগম জিয়ার অবৈধ কারান্তরীণ জীবন আর তারেক রহমানের দেশের বাইরে থাকাটাই। এই দেশের লাল সূর্য আবারও উদিত হয়েছে আলো নিয়ে বেগম জিয়ার বন্দি জীবনের প্রতিটি সীমাহীন কষ্টার্জিত সময়ের মূল্যে। এই যে, বাংলাদেশ! তা-তো ব্রিটিশ আর পাকিস্তানকে পরাজিত করেই তার স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। শেখ মুজিব ১৯৭০ সালের ভোটের মাধ্যমে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতেই চূড়ান্ত আগ্রহী ছিলেন। পাকিস্তান সরকারের নানারকম নির্যাতন ও হঠকারিতায় সেইদিন মেজর জিয়াই স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। বাকিটা ইতিহাস সাক্ষী। বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। অথচ ভারতের পরিকল্পনায় শেখ মুজিব ক্ষমতায় বসেই সব প্রকারের বাক-স্বাধীনতা হরণ করলেন। তিনি বাকশাল গঠন করে এক নায়কতন্ত্রের দিকে ধাবিত হলেন। ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ ইতিহাস এখানেও সাক্ষী।  ২০০৮ সালে শেখ হাসিনা নাটকীয়ভাবে ক্ষমতায়। একটানা সাড়ে ১৫ বছর বাংলাদেশের ওপর সে চালিয়েছিল শাসনের নামে শোষণের জিঞ্জির। পৃথিবীর ইতিহাসে নিজ জাতির ওপর এমন নির্যাতনের খড়গ আর কেউ চালিয়েছেন কিনা জানা নেই। অথচ শেখ হাসিনার শাসনামলে এই জাতির ১৮ কোটি আম-জনতার ওপর কি পরিমাণ নিপীড়ন আর নির্যাতনের স্টিম রোলার চলেছিল- তা পূর্ণরূপে প্রকাশিত হলে, বিশ্ব আঁতকে উঠবে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ৩০০ জন আইনপ্রণেতার মধ্যে ১৫৩ জন নির্বাচিত হন বিনা ভোটে। তামাশার নির্বাচনে জয়ী হয়ে এই সরকার দেশকে কোথায় নিয়েছে, তা দেখতে ও অনুধাবন করতে কোনো গবেষণার প্রয়োজন নেই। যে দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা চুরি হয়, যুবকের (এনজিও) মতো প্রতিষ্ঠান সাধারণ মানুষকে নিয়ে তামাশা করে, শেয়ারবাজার ধ্বংসকারীদের নেতা সালমান এফ রহমানের মতো লোক বাবা কিংবা দরবেশ উপাধি পায় এবং ২৩টি প্রতিষ্ঠানের কাছে ৫০ হাজার ৫শ’ কোটি টাকা দায়দেনা থাকে, যুবলীগের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সম্রাট বাহিনীর ক্যাসিনোকাণ্ড দেশের যুব সমাজকে হতাশায় নিমজ্জিত করে, ডেসটিনির মতো প্রতিষ্ঠানে সাবেক সামরিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জড়িত থেকে লাখো যুবককে পরিবারের কাছে কলঙ্কিত করে, হলমার্ক কেলেঙ্কারি ও অহরহ প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়, কোটা প্রক্রিয়ার কাছে মেধাবীরা বঞ্চিত হয়, ফুঁ দিয়ে বহুতল ভবন ভেঙে ফেলা যায়, মন্ত্রীর প্রতিষ্ঠিত ফারমার্স ব্যাংকে আমানতকারীদের আমানত ফেরত পাওয়া যায় না, সে দেশ আবার কেমন করে উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণ করে। আওয়ামী লীগ একতরফা চাঁদাবাজি, ফটকাবাজি, তদবির, মাস্তানি কেবল নয়; বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বানিয়েছে ছাত্রলীগের অত্যাচার ও অনাচারের লীলাক্ষেত্র। নতুন প্রজন্মের কাছে আওয়ামী ছিল বিচ্ছিন্ন, সংস্কৃতি অঙ্গনে তাদের তেলেসমাতি, পারিবারিক দাপটসহ শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ দেশটাকে তাঁবেদারি রাষ্ট্রে পরিণত করে। একই সঙ্গে এ দেশে আওয়ামী শাসনের গত ১৬ বছর ধরে সাংবিধানিক কোনো অধিকারই রক্ষা করা হয়নি। দেশের অধিকাংশ মানুষ সর্বদিকে চরমভাবে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছেন। দেশের অর্থনীতির চাকা অচল হয়েছে। দৃশ্যমান উন্নয়ন করতে গিয়ে বৈদেশিক দেনায় দেউলিয়ার দোরগোড়ায় রাষ্ট্র। শিক্ষাঙ্গনের লেজুড়বৃত্তি আগামী প্রজন্মকে অন্ধকারে নিয়ে গিয়েছিল। একদিকে নারী ও শিশু ধর্ষণ বেড়েছে, অপরদিকে যৌনাচারের আখড়াগুলোকে অবাধে বিচরণের সুযোগ করে দিয়েছিল কতিপয় আওয়ামী লীগের দোসররা। আমলাতন্ত্রে চরমপ্রকারের পচন ধরেছিল। দেশটাকে পুলিশিরাষ্ট্রে সম্পূর্ণরূপে পরিণত করেছিল। দুর্নীতি একেবারে সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নির্বাচিত যে জনপ্রতিনিধির প্রয়োজন- তা সবাই ভুলতে বসেছে। ২০১৮ এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনব্যবস্থা বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে করেছে কলঙ্কিত। ভোটের রাজ্যে আকাল পড়েছে। দিনের ভোট রাতে হয়েছে! এগুলোর হিসাব চাইলেই অকাতরে গুম হয়েছে মানুষ। ৩ হাজারের অধিক মানুষের খোঁজ পাওয়া যায়নি- যাদের অধিকাংশ বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত। আয়নাঘরের মতো রহস্যময় দানবের আবির্ভাব হয়েছে। ক্যাসিনোকাণ্ডের অভিযুক্তরা রাজনৈতিক পুনর্বাসন উদ্বেগজনক পরিস্থিতির বার্তা দিয়েছে। তারা পার্শ¦বর্তী ভারতের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের কাছে স্বেচ্ছায় নতি স্বীকার করে। নিজেদের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার প্রয়াসে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিকে এ দেশের উল্লেখযোগ্য আইনে পরিণত করেছে। পররাষ্ট্র নীতির নতি স্বীকারে জাতি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। আওয়ামী শাসন ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের গহ্বরে প্রবেশ করেছে- যা রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য হুমকিস্বরূপ। বাংলাদেশের ইতিহাসে ইহুদিবাদী ইসরাইল একটি অবৈধ ও অবাঞ্ছিত রাষ্ট্র। অথচ দেশের মানুষের গোপনীয়তাকে হরণ করার জন্য ইসরাইলের কাছ থেকে আড়ি পাতায় যন্ত্রপাতি কিনতে গিয়ে সরকার আরেকবার দেশকে লজ্জিত করেছে। দেশের পাসপোর্ট থেকে এক্সসেপ্ট ইসরাইল শব্দটি বাদ দিয়েছে। ডিবির ডিআইজি হারুন, অতিরিক্ত ডিআইজি বিপ্লব কুমারদের আচরণ সকল প্রকারের আমলাতন্ত্রকে কলঙ্কিত করেছে। যারা ফ্যাসিস্ট, তারা চূড়ান্ত পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে যাওয়ার আগ পর্যন্ত নিজের সিদ্ধান্তকে সেরা মনে করে। এমন ঘাড়ত্যারা স্বৈরশাসকদের বিদায়টা বড়ই করুণ ও নির্মম হয়। ইতিহাস এমনটাই সাক্ষী দেয়।  একটি রাজনৈতিক দলের সেক্রেটারি হওয়ার পরও ওবায়দুল কাদেরের মুখের ভাষা রাজনৈতিক শিষ্টাচারকে দুষিত করেছে। রাষ্ট্রীয় চেয়ারে বসে শেখ হাসিনা সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে কটূক্তি করতে দ্বিধাবোধ করেনি। সরকারপ্রধানের এমন কথা থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, এ দেশের রাষ্ট্র কাঠামোর নিয়মতান্ত্রিকতা কতটা ভঙ্গুর হয়েছে। পচন ধরেছে রাষ্ট্রের স্বাধীন স্তম্ভে। বাংলাদেশে মেধাবী শিক্ষার্থীরা তাদের ন্যায্যতার দাবিতে প্রথম রাজপথে নেমে আসে ২০১৮ সালে। এদের অনেককেই পড়াতে গিয়ে পরিবার দরিদ্রতার জাতাকলে পিষ্ট হয়েছে। কিন্তু চাকরি তাদের কাছে সোনার হরিণ। দ্বিতীয় দফা আন্দোলন শুরু হয়েছিল ২০২৪ সালের পহেলা জুলাই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা বাতিলের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে ছাত্রসমাবেশ ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। তাদের আন্দোলন ছিল শুধুই কোটার বিরুদ্ধে। তারেক রহমান রাজনীতির সুদূরপ্রসারী চিন্তা থেকেই কোটা আন্দোলনকে একদফার আন্দোলনে পরিণত করেন। তারই পরিকল্পিত ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিদায় সংক্রান্ত একদফার পরিপত্রকে বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠন আম-জনতার মাঝে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়।  ৩ আগস্ট, শনিবার এক দফা, এক দাবি নিয়ে মাঠে নামে এদেশের আমজনতা-আওয়ামী লীগের পেতাত্মারা বাদে দেশের সকল জনগণ তারেক রহমানের নির্দেশে একাকার হয়ে পড়ে। তারা প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করে। তাদের দাবির সঙ্গে পেছন থেকে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠন। বিশেষভাবে পুরো দেশে বিএনপির নেতৃত্বে একাকার হয়ে যায় ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের লাখ লাখ যুবক-যুবতী ভাই ও বোনেরা। তারেক রহমানের নির্দেশে সাধারণ আমজনতাসহ ছাত্রদের সঙ্গে বিএনপির কর্মীবাহিনীর মিশে যাওয়াটাই পুরো আন্দোলনকে ফ্যাসিস্ট সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যায়। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ একত্রিত হয়। সবাই তারেক রহমানের চূড়ান্ত নির্দেশনার অপেক্ষায় থাকে। অবশেষে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ ৫ আগস্ট, সোমবার মার্চ টু ঢাকা : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন- মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচির তারিখ পরিবর্তনে বিএনপি ঘরানার বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শ ত্বরিত কাজে আসে। ৬ আগস্টের পরিবর্তে ৫ আগস্ট সোমবার এ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা আসে- তারিখ পরিবর্তনের এই নির্দেশনা তারেক রহমান সিনিয়র নেতাদের আগেই জানিয়ে রাখেন। এতে সারাদেশ থেকে আন্দোলনকারীদের ঢাকায় আসার আহ্বান জানানো হয়। এরইমধ্যে নানা জাতীয় পত্রিকায় (এত লাশ কেন) ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের লেখা আসতে থাকে। তারেক রহমানের নির্দেশনায় ঢাকায় অবস্থিত নেতাদের কর্মকৌশলে লাখ লাখ জনতার সমাগম করে বিএনপি। বিএনপির এই যে দীর্ঘসংগ্রাম; তার ওপরই দাঁড়িয়ে ছাত্র-জনতা বিজয় ছিনিয়ে আনে। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে বাংলাদেশ ছাড়েন। তাঁর বোন শেখ রেহানার সঙ্গে বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারে দেশত্যাগ করেন।  তারেক রহমান আমজনতার ত্যাগকে মূল্যায়নে রেখেই আগামীর বাংলাদেশ গড়তে চান। তিনি বৈষম্যহীন, চাঁদাবাজমুক্ত এক নব বাংলাদেশ গড়ার কাজে হাত দিতে চান। লেখক : ভূরাজনীতি গবেষক

নারীশক্তির বিকাশে সহিংসতা অন্তরায়

নারীশক্তির বিকাশে সহিংসতা অন্তরায়

সুদূর অতীত-অতীত-নিকট অতীত বিশেষ করে বর্তমান সময়ে নারী ও শিশুদের প্রতি যেসব ভয়ংকর অনাচারের বহিঃপ্রকাশ পরিলক্ষিত হচ্ছে দেশের জনগণ তাতে যারপরনাই উদ্বিগ্ন-আতঙ্কগ্রস্ত। সারাদেশে নারী-শিশুরা যৌন হয়রানি-সহিংস আক্রমণ-শারীরিক শাস্তি-মানসিক নির্যাতন ও অবহেলাসহ নানা ধরনের সহিংসতার শিকার হচ্ছে। শিশুরাই অনেকাংশে প্রতিনিয়ত এমন কদর্য পরিস্থিতির সম্মুখীন। সাম্প্রতিককালে গণমাধ্যমে নারী ও নিষ্পাপ শিশুদের প্রতি পৈশাচিকতার ঘটনা বৃদ্ধির প্রবণতা প্রকাশ পাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে একের পর এক নৃশংস ঘটনা। অতিসম্প্রতি দেশে এক সপ্তাহের ব্যবধানে কুমিল্লা ও ভোলায় দুটি ধর্ষণের ঘটনা এবং এর সহিংসতার মাত্রা পুরো দেশবাসীকে হতবাক করেছে। উল্লেখ্য, ঘটনায় দেশজুড়ে প্রচণ্ড ক্ষোভ-বিক্ষোভ অব্যাহত আছে। বিজ্ঞজনদের মতে, আইন প্রয়োগের যথার্থ কার্যকারিতা-শিথিলতা-আদালত থেকে অতিসহজে মুক্ত হয়ে আসাসহ নানা কারণে এর ব্যাপকতা সমাজকে ধ্বংসের তলানিতে পৌঁছে দিচ্ছে। এসব জঘন্য কর্মকাণ্ড দেশের স্বাভাবিক জীবন ধারায় অন্তরায়-প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির লক্ষ্যে অশুভ অপশক্তি পরিচালিত দেশ বিধ্বংসী চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের অংশ কিনা তার দ্রুত তদন্ত অনিবার্য হয়ে পড়েছে। সৎ-যোগ্য-দক্ষ-চৌকস সদস্যদের সমন্বয়ে বিচার বিভাগীয় কমিটির মাধ্যমে প্রকৃত চিত্র দৃশ্যমান করার প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে অনুভূত। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, যে নারী শিক্ষার্থী বা শক্তির দুঃসাহসিক অবদানে জুলাই বিপ্লব শক্তিমান হয়েছে সেই নারী শক্তির অবজ্ঞা বা সহিংসতার মাধ্যমে তা স্থিতিমিত করার যে কোনো ধরনের অপকৌশল অবশ্যই পরিত্যাজ্য।  বর্তমানে ধর্ষণ একটি অন্যতম অপরাধে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনই কোনো না কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করেও একে অবদমন করা যাচ্ছে না। ৯ মার্চ ২০২৫ গণমাধ্যমে প্রকাশিত বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে সারাদেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩৯ জন নারী। এদের মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২১টি এবং দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৮ জন। ফেব্রুয়ারি মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল ৫৭টি। এর মধ্যে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ১৭টি এবং ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটেছে দুটি। এদের মধ্যে পাঁচ জন ছিল প্রতিবন্ধী কিশোরী ও নারী। উল্লেখ্য, মাসে ধর্ষিতদের মধ্যে ১৬ জন শিশু ও ১৭ জন কিশোরীর সংখ্যা প্রকাশ পেয়েছে। তাছাড়া এই মাসে ধর্ষণের চেষ্টা ১৯টি, যৌন হয়রানি ২৬টি, শারীরিক নির্যাতনের ৩৬টি ঘটনা ঘটেছে। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, বিগত ১১ মাসে সংঘটিত সহিংসতা ও ধর্ষণের ৭৮০টি ঘটনার মধ্যে ৫৫৮টি ঘটনা ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত। ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ প্রকাশ পাওয়া জাতিসংঘের প্রজনন স্বাস্থ্যবিষয়ক গ্রুপ- ইউএনএফপি এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ নারী জীবনের কোনো না কোনো সময় শারীরিক-যৌন নির্যাতনসহ নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হন।  দেশের ১৫টি পত্রিকার খবর সংকলনে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের হালনাগাদ প্রতিবেদন মতে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ২ হাজার ৫২৫ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে ৫১৬টি ছিল ধর্ষণের ঘটনা। শিশু ধর্ষণের ঘটনা ছিল ৩৬৭টি। ওই সময়ে ৫২৮ নারী ও কন্যাশিশু হত্যাসহ ১৮১ জন যৌন নিপীড়ন ও ৪৩ জন উত্ত্যক্তের শিকার হয়েছিলেন। রহস্যজনক মৃত্যু, শারীরিক নির্যাতন, সাইবার ক্রাইম, যৌতুকের কারণে নির্যাতনের ঘটনারও আধিক্য ছিল। চলতি বছরের  জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৪৮১ জন নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের খবর প্রতিবেদনে উপস্থাপিত। তন্মধ্যে শিশু ৩৪৫টি। উক্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪ সালের তুলনায় এ বছরের প্রথম ছয় মাসে ধর্ষণের ঘটনা কম হয়েছে মাত্র ৩৫টি এবং নারীর প্রতি সহিংসতার মধ্যে ধর্ষণের ঘটনাই সবচেয়ে বেশি। এর পরে রয়েছে হত্যা। তাছাড়া গত ছয় মাসে ১ হাজার ৫৫৫ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের সংবাদ প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে। ধর্ষণের ঘটনার মধ্যে দলবদ্ধ ঘর্ষণের শিকার হয়েছেন ১০৬ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৭ জনকে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, কিছু ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় বিচক্ষণ বা নষ্ট বুদ্ধিসম্পন্ন নারীদের প্রতারণা বা নানামুখী প্ররোচনায় আপরাধের সংখ্যা বেড়েছে বলেও জনশ্রুতি রয়েছে।   সমাজবিজ্ঞানীদের অভিমত, যে কোনো অপরাধ সংগঠনের জন্য শিশুরা খুব সহজেই নাগালে আসে এবং তারা কিছু বুঝে উঠতে পারে না বলে হীন ইচ্ছা চরিতার্থে শিশুদের টার্গেট করা হয়। অনেক সময় পরিবারের বড় সদস্যদের শায়েস্তা করতেও অপরাধীরা শিশুদের ‘বলির পাঁঠা’ বানায়। মানুষের দুর্বল জায়গায় আঘাত করার জন্যই এটা করা হয়ে থাকে। এটি এক ধরনের বিকারগ্রস্ত মানসিকতা ছাড়া কিছুই নয়। আবার ব্যক্তি শত্রুতার জেরে শিশুহত্যা বা অপহরণের মতো ঘটনাও ঘটছে। বিভিন্নক্ষেত্রে অর্থলোভে নষ্ট চরিত্রের মাদকাসক্ত পরিবারের সদস্যদের নিপীড়ন-নির্যাতনও নারীদের অসহায় করে তুলছে। পরিবারের নজরদারি, সামাজিক শৃঙ্খলা ও অপরাধীদর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের মাধ্যমে এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। উন্নত দেশে বিকারগ্রস্ত ব্যক্তিকে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে কাউন্সেলিং-চিকিৎসাব্যবস্থার সুযোগ রয়েছে। আমাদের দেশে এখনও সেই ধরনের বহুমুখী কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। তবে সামাজিক সচেতনতা এবং নৈতিক-ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার মাধ্যমে পরিস্থিতি উত্তরণ সম্ভব।      দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নারীদের অবদান অনস্বীকার্য। এতদসত্ত্বেও কর্মক্ষেত্র-পরিবার ও জনপরিসরে নারীদের প্রায়ই বৈষম্য-নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হয়। প্রতিবছর ভিন্ন ভিন্ন প্রতিপাদ্য নিয়ে নারী দিবস পালিত হলেও নারীর প্রতি বিরাজিত সহিংসতার বহিঃপ্রকাশে কোনো কমতি নেই। এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে কেন্দ্র করে সেভ দ্য রোড কর্তৃক প্রকাশিত তথ্যমতে, ২০২৪ সালের মার্চ থেকে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এক বছরে রেল, নৌ ও সড়কপথের পাশাপাশি রেল-নৌ-বাস স্টেশন এবং ফুটপাতে নারীদের শ্লীলতাহানি-নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৭৫৮টি এবং ধর্ষিত হয়েছেন ৪১ জন নারী। তন্মধ্যে রেলপথে ৫৬২টি নির্যাতন ও ১১টি ধর্ষণ; সড়কপথে ৪১৩টি নির্যাতন ও ২০টি ধর্ষণ; নৌপথে ৩২৫টি নির্যাতন ও ৫টি ধর্ষণ এবং রেল-নৌ-বাস স্টেশন ও ফুটপাতে ৪৫৮টি নির্যাতন ও ৫টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। তাছাড়া প্রযুক্তির সহায়তায়ও বাড়ছে নারী নির্যাতন। বিদ্বেষমূলক মন্তব্য, প্রতারণা, যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের আরেকটি বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। ২০২৪ সালের শুরুর থেকে শেষের দিকে অনলাইনে নির্যাতনের অভিযোগ বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ।      দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, দেশে সহিংসতার শিকার নারীদের প্রায় ৬৪ শতাংশ তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া সহিংসতার কথা কাউকে কখনো বলেননি। পরিবারের সুনাম রক্ষা, সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নারীদের এ নীরবতা বলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল বাংলাদেশের সমন্বয়ে পরিচালিত নারীর প্রতি সহিংসতা জরিপ-২০২৪ এ উত্থাপিত। চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত উল্লেখ্য জরিপের তথ্য অনুযায়ী, নারী আয় করলেও সেই টাকায় কর্তৃত্ব থাকে পুরুষের। গ্রামের সঙ্গে এক ধরনের পাল্লা দিয়ে শহরেও বেড়ে চলেছে নারী নির্যাতনের হার। জাতীয়ভাবে জীবনে একবার হলেও ফিজিক্যাল, সেক্সুয়াল, ইমোশনাল, কন্ট্রোলিং বিহ্যাভিয়ার, ইকোনমিক ভায়োলেন্সসহ নানা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন দেশের ৭৫ দশমিক ৯ শতাংশ নারী। এই হার শহরে ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশ এবং গ্রামে ৭৬ শতাংশ।  অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রশাসনে ছদ্মবেশে অনৈতিক পন্থায় নষ্ট চরিত্রের ব্যক্তিদের নিয়োগ-পদায়নের কারণে এসব ঘটনার অপরাধীরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। ফৌজদারি আইনের দুর্বলতায় অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি হয় না। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অপরাধীদের যথার্থ শাস্তির আওতায় আনা জরুরি হয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে জনপ্রতিরোধ সৃষ্টি আবশ্যক। বহুলাংশে আইন প্রয়োগে দেশপ্রেম-নীতিনৈতিকতার অভাবে ধর্ষণ মহমারি রূপ পরিগ্রহ করেছে। তাই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় জনতার অংশগ্রহণ ও সামাজিকভাবে ধর্ষকদের ছবি বা পোস্টার এলাকায় এলাকায় ছড়িয়ে দিয়ে এদের চরিত্র স্খলনের বিষয়টি জনসম্মুখে আনা যেতে পারে। তাদের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক না রেখে সামাজিকভাবে সর্বত্র তাদের চলাফেরায় সীমাহীন লজ্জা বা অপমান করে দেশে লজ্জার সংস্কৃতি সৃষ্টি করতে হবে। কারণ লজ্জার সংস্কৃতির অভাবেই একটি পরিবার নির্লজ্জ হয়ে তার ধর্ষক ছেলে, ভাই ও আত্মীয়দের বাঁচাতে আসে। জাপানে একজন মানুষ সাধারণ লজ্জায় আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে। অথচ এদেশে ধর্ষণ করে মিষ্টি খাওয়ানোর অপসংস্কৃতি চালু ছিল। যেসব পুরুষ এ ধরনের অপরাধ একের পর এক করে যাচ্ছে তাদের সঙ্গে অপরাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার গোপনীয় যোগসূত্র অনেক ক্ষেত্রে প্রচলিত। ফলস্বরূপ পুলিশ ও মেডিক্যাল রিপোর্ট এবং সর্বোপরি বিচার বিভাগ কর্তৃক ন্যায়বিচার পাওয়া সুদূর পরাহত বিষয়ে পরিণত। বিচারহীনতা-সহিংসতার সঙ্গে সন্ত্রাসীদের পেশিশক্তির সম্পৃক্ততা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। যেসব ক্ষেত্রে নিজের পরিবারের সদস্যরা সম্পৃক্ত, তাদের রক্ষার ক্ষেত্রেও নারীর ভূমিকা অগ্রহণযোগ্য।  নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে দেশে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০’, ‘পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন -২০১০’, ‘মানবপাচার (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন -২০১০’, ‘পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১২’, ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭’সহ নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসা প্রতিরোধে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা (২০১৩-২০২৫) প্রণীত হয়েছে। এতদ সত্ত্বেও এসব জঘন্য অপরাধের পেছনে কোনো ধরনের অপশক্তি অতিমাত্রায় সক্রিয় এবং সমাজে অস্থিরতা তৈরি করে কারা ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থে লিপ্ত রয়েছে তাদের মুখোশ উন্মোচন অপরিহার্য। দায়িত্বশীলতা-পেশাদারিত্বের উৎকর্ষতায় এলাকাভিত্তিক জরিপের মাধ্যমে দ্রুত এসব দানবরূপী হিংস্র পশুদের চিহ্নিত করে পর্যাপ্ত যাচাই-বাছাইয়ের ভিত্তিতে কঠোর আইনের আওতায় আনা উচিত। অতিসম্প্রতি দেশে সংঘটিত ঘটনাসমূকে কেন্দ্র করে এর প্রতিবাদে পুরো জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। ধর্ষকদের বিরুদ্ধে কালক্ষেপণ না করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তদন্ত-বিচার ও বিচারের রায় কার্যকর করার দাবি অত্যন্ত জোরালোভাবে উচ্চকিত। সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করার সম্মিলিত উচ্চারণে যৌক্তিক-ইতিবাচক ভূমিকা পালনে সংশ্লিষ্ট সকলের দায়িত্বশীলতা প্রমাণের সুযোগ অবলম্বন একান্তই অনিবার্য।    লেখক : শিক্ষাবিদ

কিন্ডারগার্টেনগুলোতে শিট বাণিজ্য

কিন্ডারগার্টেনগুলোতে শিট বাণিজ্য

বর্তমান সময়ে ঢাকা শহরের অলিতে গলিতে গড়ে উঠেছে অসংখ্য কিন্ডারগার্টেন স্কুল। যার সঠিক সরকারি হিসাব না পাওয়া গেলেও আনুমানিক কয়েক হাজার স্কুল রয়েছে বলে ধারণা করা যায়। যেখানে অনেক প্রতিষ্ঠানে পাঠদানের জন্য যথাযথ দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষক না থাকলেও দিনের পর দিন দেদার চলছে স্কুল। যেখানে মেলে না মানসম্মত শিক্ষা অথচ চলে শিটবাণিজ্য। সাধারণত পাঠদানের অন্যতম উপকরণ হওয়া উচিত এনসিটিবি কর্তৃক প্রেরিত সরকারি পাঠ্যবই। কিন্তু সেখানে এর পরিবর্তে দেখা যায় সহজলভ্য শিট মাধ্যম। এর ফলে শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে পাঠ্যবইয়ের জ্ঞান থেকে এবং ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে ব্রয়লার মুরগি তথাকথিত পঙ্গু প্রজন্ম হিসেবে। অন্যদিকে প্রতি সেমিস্টারে একাধিক বিষয়ের শিট এবং নোট বিক্রি করে প্রতিষ্ঠান আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে।

সোনালি আঁশের সুদিন ফিরুক

সোনালি আঁশের সুদিন ফিরুক

বাংলাদেশের ইতিহাস, অর্থনীতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িত একটি শব্দ- পাট। একে বলা হয় ‘সবুজ সোনা’, কারণ একসময় পাটই ছিল দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে রপ্তানি আয়ের প্রায় ৭০ শতাংশই আসত পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে। অথচ আজ, যাদের হাতে এই সোনালি আঁশের জন্ম, সেই পাট চাষিরা বারবার অবহেলার শিকার হচ্ছেন, পাচ্ছেন না তাদের ন্যায্য দাম। এই চিত্র শুধু হতাশাজনক নয়-জাতীয় উন্নয়ন কৌশলের এক গুরুভার দুর্বলতা ও অদূরদর্শিতার বহিঃপ্রকাশ। এক সময়ের গর্ব, আজ সংকটে, ১৯৭০-এর দশকে বাংলাদেশ বছরে প্রায় ১০ লাখ টন পাট রপ্তানি করত। বর্তমানে এই পরিমাণ নেমে এসেছে সাড়ে ৭ লাখ টনের নিচে (তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ পাট অধিদপ্তর, ২০২৩)। বিশ্বব্যাপী পরিবেশবান্ধব পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির পরও বাংলাদেশের পাটশিল্প ঠিকমতো পুনরুজ্জীবিত হয়নি। একটি বড় কারণ-পাট উৎপাদনে কৃষকের আগ্রহ ক্রমেই কমে যাচ্ছে, কারণ তারা উৎপাদন খরচের তুলনায় ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২৪ সালে এক বিঘা জমিতে পাট উৎপাদনের খরচ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৪ হাজার টাকা, কিন্তু হাটে সেই পাট বিক্রি করে পাওয়া গেছে সর্বোচ্চ ১২-১৩ হাজার টাকা। এতে কৃষকের প্রতি বিঘায় লোকসান হয়েছে ১ হাজার টাকার বেশি। এই লোকসান সরাসরি কৃষকের খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা ও জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলে। অথচ কৃষকের ঘাম ও শ্রমের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে দেশের বহুমুখী শিল্প ও রপ্তানি সম্ভাবনা। পাট মৌসুম আসন্ন, এখনই সময় বর্তমানে বাংলাদেশে পাট কাটার মৌসুম জুলাই-আগস্টে শুরু হয়। অর্থাৎ আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নতুন পাট বাজারে আসবে। এই সময়ে মধ্যস্বত্বভোগী ও অসাধু ব্যবসায়ীরা চাষিদের দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে দরপতনের কারসাজি করে থাকেন। সরকারি সংস্থাগুলো দৃশ্যত ‘ক্রয় কেন্দ্র’ খুললেও বাস্তবে তা হয় প্রদর্শনমূলক ও সীমিত পরিসরে, যা অধিকাংশ চাষির নাগালের বাইরে। মধ্যস্বত্বভোগী নয়, সরাসরি কৃষকের হাতে লাভ। বাংলাদেশ পাট অধিদপ্তরের তথ্যমতে, প্রতি মৌসুমে পাট উৎপাদনে ৩০ লক্ষাধিক কৃষক পরিবার যুক্ত থাকেন। কিন্তু কৃষকের হাতে লাভ পৌঁছায় না। একদিকে খরচ বেশি, অন্যদিকে মিল মালিকরা দাম নির্ধারণ করেন নিজেদের সুবিধামতো। অধিকাংশ চাষি পাট সংরক্ষণের জায়গা ও উপায় না থাকায় উৎপাদনের পরপরই বাধ্য হন নিম্নমূল্যে বিক্রি করতে। ফলে লাভ তো দূরে থাক, উৎপাদনের মূলধনও উঠে আসে না। সরকারের উচিত- হাট পর্যায়ে ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ করা, কৃষক পর্যায়ে সরাসরি ডিজিটাল, কেনাবেচার প্ল্যাটফর্ম চালু করা, সরকারি পাট গুদাম বা মিলকে বড় পরিসরে পাট সংগ্রহে বাধ্য করা, বিআরডিবি, কৃষি ব্যাংক, জনতা ব্যাংক এর মাধ্যমে কৃষিঋণ সহজীকরণ, পাট সংরক্ষণের জন্য স্থানীয়ভাবে সংরক্ষণ কেন্দ্র ও শেড নির্মাণ, পাটশিল্পের অবস্থা: কিছু চিত্র বর্তমানে দেশে সক্রিয় পাটকল রয়েছে প্রায় ৯০টি, যার মধ্যে সরকার পরিচালিত ১৮টি মিল ২০২০ সালের পর বন্ধ বা বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়ায় রয়েছে। (তথ্যসূত্র: পাট অধিদপ্তর, শিল্প মন্ত্রণালয়, ২০২৩) অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশ ভারত, যেখানে বাংলাদেশ থেকে পাট আমদানি করে- তারা একে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হিসেবে দেখছে। তাদের সরকার প্রতি বছর পাটচাষিদের জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (গঝচ) নির্ধারণ করে, যা কৃষক নিশ্চিন্তে বুঝে পান। অথচ বাংলাদেশে এমন কোনো কাঠামো নেই।  পাটশিল্প কেবল কৃষি নয়, এটি শিল্প, পরিবেশ ও রপ্তানি খাতের সংযোগকারী সেতু। আজ বিশ্ব যখন প্লাস্টিক বর্জনের আন্দোলনে, তখন বাংলাদেশ পাটকে সামনে রেখে পরিবেশবান্ধব পণ্যের বিশ্ব বাজার দখল করতে পারে। পাট চাষে ফেরাতে হবে সম্মান, দিতে হবে আর্থিক নিরাপত্তা। তাহলেই এই সোনালি আঁশ আবারও জাতির মুখ উজ্জ্বল করবে।  পাট চাষিকে বাঁচাতে পারলে পাট শিল্প বাঁচবে। আর পাট শিল্প বাঁচলে রক্ষা পাবে দেশের কৃষি অর্থনীতি, কর্মসংস্থান ও রপ্তানি। তাই সময়ক্ষেপণ নয়, এখনই সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও ব্যবস্থা নিতে হবে। পাট মৌসুমের আগেই ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে না পারলে আগামীতে এই ঐতিহ্যবাহী খাতকে টিকিয়ে রাখা আরও কঠিন হয়ে পড়বে। পাট চাষিকে তার শ্রমের দাম দিন-কারণ সোনালি আঁশ মানেই বাংলাদেশের আত্মমর্যাদা। মো. শামীম মিয়া জুমারবাড়ী, সাঘাটা, গাইবান্ধা

এ আই যুগে মানব মস্তিষ্ক

এ আই যুগে মানব মস্তিষ্ক

সময়ের পরিক্রমায় প্রযুক্তি তার সীমানা অতিক্রম করে আজ মহাকাশ জয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। প্রযুক্তির এই অভাবনীয় অগ্রগতির পেছনে রয়েছে মানব মস্তিষ্কের অসামান্য অবদান। মানুষের চিন্তা, গবেষণা ও উদ্ভাবনী শক্তির ফলেই আজ পৃথিবী এক ডিজিটাল বিশ্বে রূপান্তরিত হয়েছে। তবে প্রশ্ন উঠছে- এই প্রযুক্তিই কি শেষ মেশ মানব মস্তিষ্ককে নিষ্ক্রিয় করে দেবে? প্রশ্নটি হয়তো প্রথম শুনতে কিছুটা উদ্ভট বা অবাস্তব মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমরা এমন এক প্রযুক্তিনির্ভর যুগে প্রবেশ করেছি, যেখানে প্রযুক্তি পরিচালনার জন্য মানুষের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ আর অপরিহার্য নয়। বিশেষত, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI)-এর আবির্ভাব মানব চিন্তার বিকল্প হিসেবে ক্রমশ সামনে আসছে। বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্লেন চালনার ক্ষেত্রে দক্ষ পাইলটের বিকল্প হয়ে উঠছে। যুদ্ধক্ষেত্রে হাজার মাইল দূরে নির্ভুলভাবে লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণে AI-এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। চ্যাটবট, অটোমেশন সিস্টেম এবং ডেটা অ্যানালাইসিসে AI -এর ব্যাপক ব্যবহার আমাদের দৈনন্দিন জীবন, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছে। উল্লেখযোগ্যভাবে OpenAI-Gi ChatGPT, DeepSeek কিংবা গুগলের এবসরহর এখন মানুষের চিন্তা ও বিশ্লেষণের জায়গা দখল করে নিচ্ছে। আগে যেখানে কোনো বিষয়ের জন্য অনেক বই ঘেঁটে তথ্য খুঁজতে হতো, এখন চ্যাটজিপিটিতে একটি সঠিক নির্দেশনা দিলেই পাওয়া যাচ্ছে সুসংগঠিত ও পূর্ণাঙ্গ উত্তর। এটি সময় বাঁচালেও মানুষের চিন্তা করার প্রয়োজনীয়তাকে কমিয়ে দিচ্ছে। শিক্ষার্থীরা এখন আর গভীরভাবে চিন্তা না করে AI-এর ওপর নির্ভর করে এসাইনমেন্ট সম্পন্ন করছে। ফলে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক ব্যায়াম ও সৃজনশীলতার সুযোগ কমে যাচ্ছে। এই প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে সামনে মানবজাতির জন্য এক সংকট ঘনিয়ে আসতে পারে। শুধু দৈহিক শ্রম নয়, মানসিক পরিশ্রমও কমে যাবে। AI যখন মানুষের ভাবনার জায়গা দখল করে নেবে, তখন প্রশ্ন উঠবে- মানুষের প্রয়োজনটাই বা কী? তাই আমাদের উচিত, প্রযুক্তিকে সহযোগী হিসেবে গ্রহণ করা, তবে নির্ভরশীল হয়ে নয়। প্রযুক্তির সুবিধা গ্রহণের পাশাপাশি আমাদের নিজেদের চিন্তাশক্তি, বিশ্লেষণক্ষমতা এবং সৃজনশীলতাকে ব্যবহার করতে হবে। নাহলে একসময় হয়তো মানব অস্তিত্বই প্রযুক্তির ছায়ায় হারিয়ে যেতে বসবে। প্রযুক্তি নিঃসন্দেহে মানবজগতের এক বড় আশীর্বাদ। তবে সেটি যেন অভিশাপে পরিণত না হয়, সেদিকে আমাদের নজর দিতে হবে। প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রেখে মানুষের মৌলিক গুণাবলীকে বিকশিত করাই হবে ভবিষ্যৎ টিকিয়ে রাখার মূলমন্ত্র।

উত্তরাঞ্চল থেকে খুলনায় সরাসরি ট্রেন

উত্তরাঞ্চল থেকে খুলনায় সরাসরি ট্রেন

উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে খুলনায় যাতায়াতের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে যাত্রীদের একটি বড় অংশ ভোগান্তির সম্মুখীন হচ্ছেন। নীলফামারী জেলার চিলাহাটি থেকে দিনাজপুরের পার্বতীপুর হয়ে খুলনায় সরাসরি আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল করলেও পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও থেকে খুলনায় সরাসরি কোনো ট্রেন নেই। ফলে ওই জেলার যাত্রীদের খুলনায় যেতে হলে অন্য কোনো স্টেশনে গিয়ে ট্রেন পরিবর্তন করতে হয়, যা সময়সাপেক্ষ ও ঝামেলাপূর্ণ। অন্যদিকে রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, গাইবান্ধা জেলার বোনারপাড়া এবং বগুড়ার মতো উত্তরাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ রেলস্টেশনসমূহ থেকেও খুলনার উদ্দেশ্যে সরাসরি কোনো আন্তঃনগর ট্রেন না থাকায় যাত্রীদের প্রথমে একটি ট্রেনে চড়ে সান্তাহারে আসতে হয়। কিন্তু সমস্যা হলো, এসব স্টেশন ও জেলা থেকে আগত ট্রেনগুলো সান্তাহারে এসে খুলনার রুটে যায় না। ফলে যাত্রীদের সান্তাহারে নেমে সম্পূর্ণ ভিন্ন লাইনের অন্য একটি ট্রেনে উঠতে হয়। এই ট্রেন পরিবর্তনের সময়সূচি মেলানো কঠিন এবং ট্রেনগুলোর মধ্যে ব্যাপক সময় ব্যবধান থাকায় যাত্রীদের পক্ষে পরবর্তী ট্রেন ধরা কঠিন হয়ে পড়ে। এতে টিকিট পাওয়া দুরূহ হয়ে দাঁড়ায় এবং যাত্রীদের এই পদ্ধতিতে যাত্রা করতে গেলে অনিবার্যভাবেই সময়ের অপচয় ঘটে। বিশেষ করে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী ও রোগীরা এ সমস্যায় বেশি ভুগছেন। এই ভোগান্তি লাঘবে রেল কর্তৃপক্ষকে সময়সূচি ও রুট পুনর্বিন্যাস করে চিলাহাটি থেকে খুলনা পর্যন্ত যাতায়াত আরও সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করতে হবে। একই সঙ্গে পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁওয়ের যাত্রীদের সুবিধার্থে প্রয়োজনীয় রেলসংযোগ নিশ্চিত করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে উত্তরাঞ্চলের বিস্তৃত অঞ্চল থেকে খুলনায় সরাসরি যাতায়াতের লক্ষ্যে একটি নতুন আন্তঃনগর ট্রেন চালু করা সময়োপযোগী ও প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে।

সংস্কার চাই

সংস্কার চাই

নান্দাইলের ব্যস্ততম পয়েন্ট হলো ভোরাঘাট। বিভিন্ন রুটের যানবাহন চলাচল এই সড়কে। ভোরাঘাট থেকে চারদিকে ৩টি সড়ক বিস্তৃত। ভোরাঘাট থেকে জামতলা হয়ে কিশোরগঞ্জ, ভোরাঘাট থেকে সিংরইল হয়ে নান্দাইল এবং ভোরাঘাট থেকে নান্দাইল হয়ে ময়মনসিংহ। প্রতিদিন প্রায় হাজারো শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী ও পথচারীদের যাতায়াত এই স্থানে। একটি ভাঙা ব্রিজ থাকলেও নেই দুইপাশে কোনো রেলিং, মাঝখানে হয়ে গিয়েছে ফুটা এবং দুটি অটোরিক্সা একসঙ্গে যাতায়াত করতে পারে না। হাজারো মানুষ এই ব্যস্ততম রাস্তা পার হচ্ছে কোনো প্রকার নিরাপত্তা ছাড়াই। তাই ব্যস্ততম সড়কটিতে প্রাণের নিরাপত্তা সময়ের দাবি। সিংরইলবাসীর বহুদিনের দাবি একটি প্রশস্ত ব্রিজ নির্মাণ। প্রশাসনের এ ব্যাপারে নেই কোনো নজরদারি বরং তারা নীরব ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। কয়েকবার এই সেতুর দাবিতে আন্দোলন চালিয়েছে জনবাসী, তবে বিপরীতে পাওয়া যায়নি কোনো ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া। বর্তমানে সড়কে চলাচলের নিরাপত্তা যেন একজন পথচারীর নিজ দায়িত্ব। নিজেদের প্রাণের নিরাপত্তা অনুভব করলেও তাদের নিরাপত্তার জন্য নেই কোনো জরুরি পদক্ষেপ। এ অবস্থায় এভাবেই চলতে থাকলে ক্রমে বেড়েই চলবে ভোরাঘাট সড়কে দুর্ঘটনা, থেকে যাবে পথচারীদের নিরাপত্তাহীনতা। তাই এ ব্যাপারে প্রশাসনের দ্রুত হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। সঙ্গে প্রয়োজন কিছু ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ও কার্যক্রম যাতে নিশ্চিত হবে সিংরইলবাসীর প্রাণের নিরাপত্তা এবং বজায় থাকবে সড়কে সুস্থ চলাচল।

ডেঙ্গুর থাবা ও সতর্কতা

ডেঙ্গুর থাবা ও সতর্কতা

এডিস নামক মশার কামড়ে সৃষ্ট হয় ডেঙ্গু জ্বর। মশার কামড়ের ৩-১৫ দিনের মধ্যে এ জ্বরের উপসর্গগুলো দেখা যায়। বিশ্বের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও উপক্রান্তীয় অঞ্চলে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সারাদেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ৬ হাজার মানুষ। গত জুনে এডিসবাহিত এ রোগের প্রকোপ ছিল সর্বোচ্চ। জুন মাসের আবহাওয়া ছিল ডেঙ্গুর অনুকূলে, এমনটাই বলছেন কীটতত্ত্ববিদরা। ডেঙ্গু জ্বরের ফলে সমস্ত শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হয়, ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট পর্যন্ত উচ্চ জ্বর, বমি বমি ভাব, শরীরের বিভিন্ন অংশে ফুসকুড়ি, চোখের মণির পেছনে ব্যথা, তীব্র মাথা ব্যথাসহ নানাবিধ শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়।  শিশু ও বয়স্কদের খুব সহজেই এই ডেঙ্গু ভাইরাস কাবু করে ফেলে। তাই ডেঙ্গুর ভয়াল থাবা থেকে বাঁচতে ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করুন এবং মশা নিধনে কয়েল বা স্প্রে ব্যবহার করুন। এছাড়া মশার বংশ বিস্তার রুখতে বালতি, ফুলের টব, নারকেলের খোসা ইত্যাদিতে পানি জমিয়ে না রেখে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখুন। এছাড়া ড্রেনগুলো রাখতে হবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে ভয় না পেয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করুন। মরিয়ম ফেরদৌস  ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

মাধ্যমিকের ফল

মাধ্যমিকের ফল

বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) দুই মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে চলতি বছরের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এবার পাসের হার ও জিপিএ-৫ উভয়ই কমেছে। দেশের ৯টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত এবারের ফল বিশ্লেষণে দেখা যায় পরীক্ষায় পাসের হারের দিক দিয়ে সবচেয়ে এগিয়ে আছে রাজশাহী বোর্ড। আর সবচেয়ে পিছিয়ে আছে বরিশাল শিক্ষা বোর্ড। চলতি বছরের দাখিল পরীক্ষায়ও গতবারের তুলনায় পাসের হার ও জিপিএ-৫ কমেছে। তবে এসএসসি ও দাখিল ভোকেশনাল শাখায় পাসের হার কমলেও জিপিএ-৫ বেড়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো এবার ফলের সর্বোচ্চ সূচক জিপিএ-৫ প্রাপ্তিতে মেয়েরা এগিয়ে রয়েছে। আর বিভাগগুলোর মধ্যে এগিয়ে রয়েছে বিজ্ঞান বিভাগ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সবাই পাস করেছে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৯৮৪টি। অন্যদিকে কোনো পরীক্ষার্থী পাস করতে পারেনি এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১৩৪টি, যা গত বছর ছিল মাত্র ৫১টি।  চলতি বছরের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় প্রায় ১৯ লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে ১৩ লাখ এবং ফেল করেছে ৬ লাখ। বিশেষ করে গণিতের ফলে রীতিমতো বিপর্যয় ঘটেছে। অনেক বোর্ডে গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ফল হয়েছে। বিষয়টি উদ্বেগজনক। ফলে এবার পরীক্ষার্থীরা প্রত্যাশা অনুযায়ী তাদের প্রতিভা ও মেধার স্বাক্ষর রাখতে পারেনি বলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। শিক্ষাবিদরা বলছেন, জুলাই-গণঅভ্যুত্থানে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণের প্রভাব এবারের ফলে পড়েছে। এছাড়া অভ্যুত্থান পরবর্তী প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ, শিক্ষার্থীদের মধ্যে মনস্তাস্তিক ট্রমা এবং আগের মতো রাজনৈতিক কারণে ‘ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে’ ফল না দেখানোর প্রভাবও পড়েছে। বরবার ফল প্রকাশের ক্ষেত্রে শিক্ষক এবং প্রতিষ্ঠানের নানাবিধ চাপ থাকত। কিন্ত এবার সেটা ছিল না। এবারের পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা ও মূল্যায়ন অনেকটা নিরপেক্ষ ছিল। ফলে পাসের হার এবং জিপিএ-৫ কম হলেও সেটি গুণগত শিক্ষার জন্য ইতিবাচক। বহু বছর পর এবারই বাস্তবসম্মত ফলাফল পেলাম আমরা। আশা করা যায় এমন ফল প্রকাশে আগামীতে শিক্ষার্থীরা আরও বেশি পড়ার টেবিলমুখী হবে। অবশ্য এমন বাস্তবতা শতভাগ আনন্দদায়ক নয়। তারপরও শিক্ষার মান বজায় রাখতে এমন তা মেনে নেওয়া বাঞ্ছনীয়। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি জানিয়েছেন, চলতি বছরের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় এবার ওভার মার্কিং ও আন্ডার মার্কিং না করে যথাযথভাবে খাতা মূল্যায়ন হওয়ায় পাসের হার ও জিপিএ-৫ কমলেও প্রকৃত পাসের হার পাওয়া সম্ভব হয়েছে।  শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় অভিভাবকরা অক্লান্ত পরিশ্রমের পাশাপাশি বিপুল বিনিয়োগও করে থাকেন। ফলে লাখ লাখ শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হওয়ায় তাদের পরিবারগুলোয় কিছুটা হলেও হতাশা দেখা দিয়েছে। তাই এবার কেন এমনটি হলো সে বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে অনুসন্ধান করা জরুরি। পরীক্ষার ফলের সঙ্গে শিক্ষার মানের বিষয়টি সম্পর্কযুক্ত। শিক্ষার মানের উন্নতি হলে পরীক্ষার ফলেরও উন্নতি হবে- এজন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক।

প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনা

প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনা

গত বুধবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচনের জন্য ডিসেম্বরের মধ্যে বিভিন্ন রকমের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। অন্যদিকে পাঁচটি সমন্বয় ও তদারকি কমিটি গঠন করেছে নির্বাচন কমিশন। এটা নিঃসন্দেহে নির্বাচনী প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ অগ্রগতি। নির্বাচন সুষ্ঠু করার উদ্দেশ্যে জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, পদায়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে আট লাখের মতো সদস্য মাঠে থাকবেন, তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া একটা সময়সাপেক্ষ ও বিরাট কাজ। উল্লেখ্য, জাতীয় সংসদ নির্বাচন ফেব্রুয়ারি বা এপ্রিল- যে সময়েই হোক না কেন, নির্বাচন কমিশনের সেই প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন।  নির্বাচনমুখী গণতন্ত্রকামী মানুষ অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা থেকে উত্তরণের স্বপ্ন দেখছেন। অবাধ ও মুক্ত পরিবেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের অভিযাত্রা প্রত্যাশিত গন্তব্য পাক, এমনটিই চাইছেন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। তাই ব্যবধান, সংশয়, সংকট, এ জাতীয় সব নেতিবাচকতাকে পেছনে ঠেলে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের বাস্তবতায় বিএনপির মতো বড় রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতার সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের খোলাখুলি বৈঠক কাক্সিক্ষত ছিল। লন্ডন বৈঠক সুসম্পন্ন এবং যৌথ বিবৃতির কারণে জাতি সুস্পষ্ট ইতিবাচক বার্তা পেয়েছে ইতোমধ্যেই।  নির্বাচন কমিশনের মূল অঙ্গীকার হলো একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন পরিচালনা করা। এই লক্ষ্যে কমিশন বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে। সবার জন্য সমান সুযোগ রেখে নির্বাচন সুষ্ঠু করার ক্ষেত্রে যেসব বাধা আসতে পারে তার অন্যতম হচ্ছে সরকারের কোনো সংস্থা যাতে হয়রানিমূলক মামলা না করে। সুষ্ঠু ভোটের ক্ষেত্রে আরেকটি বাধা অর্থ ও পেশিশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা। এ ধরনের ১৪টি বাধা চিহ্নিত করে কীভাবে তা মোকাবিলা করা হবে, নিজেরাই সেই কর্মপরিকল্পনা কয়েক বছর আগে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ভোটাররা আশা করেন, সব বাধা অপসারণ হবে। সেক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি সরকারের যেমন দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে, তেমনি দায় ও অঙ্গীকার রয়েছে দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের। মনে রাখতে হবে বহু বছর পর দেশের নাগরিকদের সামনে সুযোগ আসছে সম্পূর্ণ নিজের পছন্দে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের। তাই আশা করা যায়, এবারের ভোট সত্যিকারার্থেই হয়ে উঠবে আনন্দপূর্ণ এক উৎসব।   গত তিনটি বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনে যেসব প্রিসাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তা দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদের বাদ দিয়ে নির্বাচন করা হবে, দেশবাসী এমনটাই আশা করে। নির্বাচনের প্রস্তুতির প্রশাসনিক দিক নিয়েই ওই বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। তবে জাতীয় নির্বাচনের সব অংশীজনকেই এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা চাই। স্বয়ং সরকারপ্রধান যখন ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের সব প্রস্তুতি শেষ করতে বলেছেন, তখন নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে ফেব্রুয়ারি না এপ্রিল- এমন ধোঁয়াশা থাকা আর বাঞ্ছনীয় হতে পারে না।

নীল, নথি ও নগরের উন্মেষ

নীল, নথি ও নগরের উন্মেষ

নীলের গাঢ় রঙে রাঙানো অতীত, রাজকীয় ফাইলের নীরব নির্দেশ আর এক বিস্তীর্ণ ধূসর সমতলের বুকে ধীরে ধীরে জেগে ওঠা এক জীবন্ত নগরের নাম নীলফামারী। এ শহর যেন শুধু একটি ভূগোল নয়, একটি আবেগ, একটি ইতিহাস, একটি অতৃপ্ত অনুরণন, যার প্রতিটি ইট, প্রতিটি পথ, প্রতিটি জনপদ আজও ধারণ করে রেখেছে ঔপনিবেশিক পরিকল্পনার সুনিপুণ ছাপ, কৌতূহলময় উত্থান আর জনমানসের সৃষ্টিশীল অভিযাত্রার চিহ্ন। উত্তর বাংলার এক প্রান্তে, ঘন কুয়াশার চাদরে মোড়া এক নির্জন জনপদ। চারপাশে বিস্তীর্ণ ধানখেত, ছোট ছোট গাঁওঘর আর দুর্বল আলোকিত কিছু পথ- এ যেন নিস্তরঙ্গ সময়ের এক সাদাকালো পর্দা। কিন্তু ঠিক এই নীরবতার মাঝখানেই ১৮৮২ সালে ইতিহাস লেখে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। রংপুর জেলার প্রশাসনিক রূপরেখায় হঠাৎই এক নতুন নাম উঠে আসে- নীলফামারী’। ব্রিটিশ আমলার আমলাতন্ত্রীয় ফাইলের পাতায় স্থান পায় এই নিভৃত অঞ্চলটি। ব্যুরোক্রেটিক সিদ্ধান্তের অদৃশ্য কলম যেন হঠাৎই এঁকে দেয় এক শহরের অবয়ব। আর সেই আঁচড়ে গড়ে ওঠে একটি নতুন প্রশাসনিক মহাকেন্দ্র। বাগডোগরার প্রশাসনিক তৎপরতা সরে আসে এই নীলের ভূমিতে- যেখানে নীল চাষের অতীত, জমিদারদের কুঠিবাড়ি আর ব্রিটিশ নীলকরদের দম্ভজড়িত ইতিহাস মিলেমিশে এক জটিল ও রহস্যময় পটভূমি সৃষ্টি করেছিল। শহরটি যেন কেবল এক প্রশাসনিক প্রয়োজনের বাস্তবায়ন ছিল না, ছিল এক কৌশলগত আয়োজন, যার প্রতিটি সীমানা নির্ধারিত হয়েছিল ঔপনিবেশিক স্বার্থ ও পরিকল্পনার ধারায়। এ জায়গাটি যদি না নির্বাচিত হতো মহকুমা সদর হিসেবে, তবে হয়তো এর অস্তিত্বই হারিয়ে যেত শত-সহস্র বাঙালি গ্রাম্য জনপদের ভিড়ে। নীলফামারী নামটির উচ্চারণেই যেন ভেসে আসে কৃষকের ঘামে ভেজা নীল রঙের জমি, তিস্তা নদীর ঘোলা জল আর ফাইলের ভেতর ঘুমিয়ে থাকা এক অচেনা সম্ভাবনার দীর্ঘশ্বাস। এ নাম শুধু শব্দ নয়- এ এক প্রতীক; ঔপনিবেশিক কাঠামো, নীলের ইতিহাস এবং ভবিষ্যতের এক তীব্র প্রত্যাশার প্রতীক। এই শহর জন্ম নিয়েছিল কাগজে-কলমে, কিন্তু বেঁচে উঠেছিল মানুষের ঘামে, শ্রমে ও স্বপ্নে। একদিনের প্রশাসনিক ঘোষণা ধীরে ধীরে রূপ নেয় এক জীবন্ত শহরে, যার প্রতিটি অলিগলি আজও বহন করে সেই নীরব ইতিহাসের পদধ্বনি। এ শহর আমাদের শুধু ইতিহাস শেখায় না, শেখায় কীভাবে নথির নিঃশব্দ ভাষাও একদিন মানুষের জীবনের অনিবার্য অংশ হয়ে ওঠে। নামটির উৎস আজও বিতর্কিত। প্রাচীন কথন বলছে, নীলফামারি নামটি এসেছে ‘নীল’ তথা ইন্ডিগো চাষ এবং ‘ফান্দরি’ অর্থাৎ নিচু জলাভূমির মিশ্রণ থেকে। ব্রিটিশদের প্রতিষ্ঠিত নীলকুঠি ও তার পরিত্যক্ত ধ্বংসাবশেষ যেন সেই ইতিহাসের নীরব দলিল। এ কুঠি ছিল একদিকে ইন্ডিগো উৎপাদনের কেন্দ্র, অন্যদিকে কৃষকের কান্না আর প্রতিরোধের প্রতিচ্ছবি। আজকের শহরের রাস্তাঘাট আর দোকানপাটের নিচে চাপা পড়ে আছে সেই শোষণের দিনলিপি। ১৯১১ সালের রংপুর গেজেটিয়ারে উঠে আসে শহরের অবয়ব। জনসংখ্যা তখন প্রায় ২ হাজার ৪০০-এর মতো, যদিও অঘোষিত লোকসংখ্যা কিছুটা বেশি ছিল বলেই অনুমান। শহরটি রেলস্টেশন থেকে প্রায় দুই মাইল দূরে অবস্থিত, পূর্ববঙ্গ স্টেট রেলওয়ের সংযোগ এই শহরের সঙ্গে তার বাইরের জগতের সেতুবন্ধ তৈরি করে। দৈর্ঘ্যে ১৪ মাইল আর প্রস্থে আধা মাইলের নীলফামারী ছিল বিস্তৃত এক জনপদ, যার বেশির ভাগই ছিল খোলা মাঠ, বালুময় মাটি ও নিচু সমতল। প্রাকৃতিকভাবে শহরটি ছিল অনন্য। প্রচুর খোলা জায়গা, বালুর ওপর গড়ে ওঠা বসতি, আর গভীর কূপ বা কুয়ার মাধ্যমে জল সরবরাহ। তবে বর্ষার শেষে পানির স্তর বেড়ে গিয়ে কুয়া উপচে পড়ত, শহরে ছড়িয়ে পড়ত নোংরা জল। তখনকার স্বাস্থ্যব্যবস্থা ছিল সীমিত ও নাজুক-বর্ষা শেষে মহামারির মতো রোগ দেখা দিত আর শহরের জীবনযাত্রা স্থবির হয়ে পড়ত। তবু শহরটি ছিল উত্তরবঙ্গের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কেন্দ্র। এখানে ছিল সাবডিভিশনাল অফিস, দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত, থানা, উপকারাগার, দাতব্য চিকিৎসালয়, হোস্টেলসমেত উচ্চবিদ্যালয়, বালিকা প্রাথমিক বিদ্যালয়, শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, পাবলিক লাইব্রেরি এবং একটি নাট্যশালা। প্রশাসনিক কাঠামোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে গড়ে উঠেছিল সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল- যেখানে নাট্যশালা, পাঠাগার ও বিদ্যালয় এক নতুন নাগরিক চেতনার জন্ম দেয়। অর্থনৈতিকভাবে শহরটি ছিল প্রশাসনিক ও বিচারিক পেশাজীবীদের আধিক্যে পূর্ণ। মোক্তার, আইনজীবী, সরকারি কর্মচারীরাই শহরের চালিকাশক্তি। শহরের বাজারকে ঘিরে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী গড়ে উঠেছিলেন, যাঁরা দেশীয় কাপড়, পাট, লবণ বা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন। স্থানীয় জনগণ সংখ্যায় অধিক হলেও শহরের অর্থনীতির চালকের আসনে ছিলেন বাঙালি উচ্চবিত্ত ও মারোয়ারি অভিবাসীরা। তৎকালীন নীলফামারীতে দুটি যৌথ মূলধনী কোম্পানি ছিল- একটি ব্যাংকিং খাতে ও অন্যটি বাণিজ্যে। এ যেন ভবিষ্যতের এক সম্ভাবনার ইঙ্গিত, যে শহরটি এখনো বাণিজ্যিকভাবে পূর্ণ বিকশিত হয়নি, তবু তার মধ্যে ছিল শহর হয়ে ওঠার নীরব আকুতি। নীলফামারীর ইতিহাস কেবল একটি শহরের গড়ে ওঠার কাহিনি নয়, বরং এটি ঔপনিবেশিক পরিকল্পনার কাঠামোয় কীভাবে একটি অঞ্চল নতুন পরিচয় পায়, তার জীবন্ত দলিল। শহরটি কখনো সৈয়দপুর কিংবা ডোমারের মতো বাণিজ্যিক শক্তি হয়ে উঠতে পারেনি। তবু এর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, শিক্ষাগত কাঠামো, বিচারব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা ও প্রশাসনিক অবকাঠামো একে এক স্বাতন্ত্র্যময় চরিত্র দেয়। আজকের নীলফামারী শহরকে যদি আমরা দেখি, তবে তার মাঝে দেখতে পাই এক শতাব্দীজুড়ে বয়ে আসা পরিশ্রম, প্রতিরোধ, প্রশাসন ও সংস্কৃতির সম্মিলিত ছাপ। এখানকার মাটির নিচে রয়েছে নীল চাষের কষ্টগাথা, পুরানো আদালতের নথিপত্রে লুকিয়ে আছে ইতিহাসের পাতা আর জনমানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায় সেই দিনগুলোর স্মৃতি- যেখানে নগর জন্ম নেয় এক ফাইলের নির্দেশে আর বেড়ে ওঠে হাজারো হাতের শ্রমে। এ শহরের জন্ম কেবল প্রশাসনিক প্রয়োজনের অনিবার্য ফসল নয়, বরং এক নথিভিত্তিক কল্পনা ও ভূপ্রাকৃতিক বাস্তবতার যুগলবন্দিতে গড়ে ওঠা এক সজীব প্রতিচ্ছবি। নীলফামারীর প্রতিটি ইট যেন বহন করে শতাব্দীপ্রাচীন একটি নীরব সংকেত; প্রতিটি গলি যেন একটি অদৃশ্য ইতিহাসের পথরেখা যেখানে পায়ে পায়ে জমে আছে কৃষকের ঘামের দাগ, আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের প্রতিধ্বনি আর স্বপ্ন দেখার সাহসী মানুষের আত্মকথা। এখানে দালানকোঠার দেয়ালে, বিদ্যালয়ের শ্লেট-পড়া ছায়ায়, কোর্ট-কাছারির ধুলো জমা বারান্দায়- সবখানে ছড়িয়ে আছে সেই ঔপনিবেশিক ছোঁয়া, আবার জেগে আছে স্বাধীন স্বপ্নের দ্যুতি। নীল চাষের সেই গাঢ় ইতিহাস যেমন রক্তমাখা এক বর্ণগাথা, তেমনি মহকুমা সদরের নথিতে জন্ম নেওয়া প্রশাসনিক কাঠামোও একসময় হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ। এই হলো নীলফামারীর জন্মগাথা- এমন একটি গল্প, যেখানে নীল, নথি ও নগর এক ছন্দে, এক সুরে বাঁধা পড়েছে। এ গল্প কেবল শহরের নয়, এ গল্প মানুষের; এ গল্প রাষ্ট্রের, ভূগোলের, সময়ের ও স্বপ্নের। আমরা যারা এই শহরের সন্তান, আমরা শুধু এর বাসিন্দা নই- আমরা এই শহরের ইতিহাসের উত্তরাধিকারী। আমরা সেই গানের উত্তরসূরি, যে গানে একান্ত সুরে মিশে আছে কৃষকের দীর্ঘশ্বাস, জমিদারের ছায়া, ব্রিটিশ আমলার স্ট্যাম্প-করা ফাইল আর স্বাধীন মানুষের এক অনির্বচনীয় প্রত্যয়। নীলফামারী আমাদের কাছে শুধুই একটি নাম নয়- এ এক চলমান ইতিহাস, এক আত্মপরিচয়, এক আবেগ, যা সময়ের স্রোতে ভেসে চলে আবার মাটির গন্ধে ফিরে আসে বারবার, নতুন করে চিনিয়ে দেয়- আমরা কারা আর এই শহর আমাদের কতখানি আপন।

উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিকল্পিত জনসংখ্যা

উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিকল্পিত জনসংখ্যা

আজ ১১ জুলাই বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশেই পালিত হচ্ছে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য হলো ‘একটি ন্যায্য এবং আশাবাদী পৃথিবীতে তাদের পছন্দের পরিবার তৈরি করতে তরুণদের ক্ষমতায়ন’। মূলত এ প্রতিপাদ্যের মাধ্যমে ১৯৯৪ সালের জনসংখ্যা ও উন্নয়ন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে, যেখানে বলা হয়েছে প্রতিটি ব্যক্তির তাদের জীবন এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার রয়েছে। সমাজ ব্যবস্থায় আমরা কিন্তু আমাদের অধিকার সম্পর্কে আমরা যেমন সচেতন না অন্যদিকে বাধার সম্মুখীন হচ্ছি এটাও বাদ দেওয়া যাবে না। সবার অধিকারের সমতার বিষয়টি এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে আমরা এ বিষয়ে সঠিক কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করতে পারছি না। বর্তমান পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে এ দিবসটি অনেক তাৎপর্য বহন করে থাকলেও সমানভাবে সব দেশে প্রভাব বিস্তার করতে পারছে না। প্রতিদিনই বাড়ছে জনসংখ্যা কিন্তু সে হারে বাড়ছে না মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান তাই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে রাষ্ট্রকে। ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির গভর্নিং কাউন্সিলে জনসংখ্যা ইস্যুতে গুরুত্ব দেয়া জরুরি মনোযোগ আকর্ষণের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী ১১ জুলাই বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে প্রতি বছরই নতুন আঙ্গিকে। কিন্তু যতই দিবস পালন করছি না কেন তার ফল মোটেও আমাদের সঠিকভাবে সামনে নিয়ে যাচ্ছে না।  সঠিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য জনসংখ্যার সঠিক ব্যবহার কীভাবে করা যায় সেই লক্ষ্যে প্রতি বছরই বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে পালিত হয় এ জনসংখ্যা দিবস। এ দিবসের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করাই মূল লক্ষ্য। যেসব দেশে প্রতিনিয়ত জনসংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়ছে সেসব দেশের রাষ্ট্রযন্ত্রের চাপটা একটু বেশি। অন্যদিকে কিছু কিছু দেশে জনসংখ্যা কমছে তাই তাদেরও ভিন্ন নীতি অনুসরণ করতে হচ্ছে। বিশেষ করে কিছু কিছু দরিদ্র বা উন্নয়নশীল দেশে যেভাবে জনসংখ্যা বাড়ছে তা উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। জনসংখ্যা দিবসের আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই যে বিষয়টি সামনে চলে আসে তা হলো বর্তমান বিশ্বের জনসংখ্যার সার্বিক অবস্থা এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কি হারে বাড়ছে জনসংখ্যা? আমাদের জানা দরকার অধিক জনসংখ্যা আমাদের ওপর কি চাপ সৃষ্টি করছে? অধিক জনসংখ্যার ফলে স্বাস্থ্যগত প্রভাব কি ধরনের হচ্ছে তাও লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। পরিবেশ দূষণ, ওজোন স্তর হ্রাস, বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি বিকিরণ থেকে আর রক্ষা করে না যা ত্বকের ক্যান্সার এবং অকাল ত্বকের বার্ধক্যের মতো চর্মরোগ সৃষ্টি করে, ইমিউন সিস্টেমকে দুর্বল করে, বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক রোগের উদ্ভব ও বিস্তার সহজ, বিভিন্ন ধরনের দুরারোগ্য রোগের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি, বর্জ্য ক্যান্সার, স্নায়বিক ব্যাধি, জন্মগত বিকৃতিসহ স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে চলে আসে। শুধু যে স্বাস্থ্যঝুঁকি তা কিন্তু নয়। আমাদের মতো দেশে সবচেয়ে বেশি সমস্যা দেখা দিচ্ছে সম্পদের জোগান। যার ফলে পানি ঘাটতি, ভূমির ব্যবহার, জীবাশ্ম জ¦ালানি, বায়ু ও জনদূষণ, বর্জ্য উৎপাদন, নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার, টেকসই কৃষি উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হওয়ার মতো সমস্যা। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) তথ্য মতে বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ কোটি ৫৭ লাখ যার মধ্যে অর্ধেক নারী এবং কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা দুই-তৃতীয়াংশ। আর বিশে^র জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮.২ বিলিয়নে। গত ৭ জুলাই ‘বিশ^ জনসংখ্যা পরিস্থিতি ২০২৫’-সংক্রান্ত প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনে আরও জানানো হয় বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৭ শতাংশ মানুষ ৬৫ বছর বা তার বেশি, যা বয়ষ্ক জনসংখ্যা বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিচ্ছে। অন্যদিকে জনসংখ্যার ১৯ শতাংশ কিশোর-কিশোরী এবং ১০-২৪ বছর বয়সী তরুণের সংখ্যা ৫০ মিলিয়ন যা জনসংখ্যার ২৮ শতাংশ। তবে এবারের প্রতিপাদ্যের মাঝে তরুণদের প্রতি বেশি লক্ষ্য রাখা হয়েছে এটা একটি ভালো দিক।  বাংলাদেশের মোট প্রজনন হার ২ দশমিক ১, যা মধ্যম স্তরে রয়েছে। তবে কিছু অঞ্চলে কিশোর বয়সে নারীদের গর্ভধারণের হার বেশি, যার পেছনে রয়েছে বাল্যবিয়ে, জন্মনিরোধ ব্যবস্থার সীমিত ব্যবহার এবং যৌন শিক্ষার অভাব। হ্রাস বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে জাতিসংঘের প্রতিবেদনটা লক্ষণীয়। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৭ থেকে ২০৫০ সাল পর্যন্ত যেসব দেশের জনসংখ্যা হ্রাস পাবে তাদের মধ্যে বুলগেরিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, পোল্যান্ড, মলডোভা, রোমানিয়া, সার্বিয়া, ইউক্রেন, হাঙ্গেরি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিন দ্বীপগুলো অন্যতম। আর এর মধ্যে এশিয়ার দেশ জাপানের অবস্থান দশম। এসব দেশে জনসংখ্যা কমলেও শুধু অভিবাসন নীতি বা বিদেশীদের গ্রহণের মাধ্যমে জনসংখ্যার স্থিতিশীলতা ধরে রেখেছে। এখন প্রশ্ন হলো কেন কমছে জনসংখ্যা? শুধুই কি প্রাকৃতিক কারণ? গবেষণায় বলছে নগরায়ণ, শিল্পায়ন, শিক্ষা, কর্মসংস্থানে নারীর অগ্রযাত্রা, নারীর ক্যারিয়ার, শিশু লালন পালন ও শিক্ষার ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি, কাজের সন্ধানে দেশ ত্যাগ, ভোগবাদিতা, জীবনযাত্রা ক্রমে কঠিন থেকে কঠিনতর হওয়ায় উন্নত দেশের অনেক নারী সন্তান ধারণ এমনকি বিয়েতে পর্যন্ত আগ্রহ হারাচ্ছে। এসব কারণে বিভিন্ন দেশে জনসংখ্যা দ্রুত কমে আসছে। সময়ের প্রেক্ষাপটে আজ অনেক কিছুই পরিবর্তন হচ্ছে। একদিকে যেমন বাড়ছে জনসংখ্যা অন্যদিকে আবার হ্রাসও পাচ্ছে জনসংখ্যা উভয় সংকটে বিশ্ব। জনসংখ্যা অধিক বৃদ্ধি যেমন আমরা চাই না তেমনি চাই না জন্যসংখ্যা একেবারেই কমে যাওয়া। এ ক্ষেত্রে একেক দেশের চাওয়াটা একেক রকম। প্রতি বছরই ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা ও এর সমাধানের আলোকে প্রতিপাদ্য তৈরি করে জনসংখ্যা দিবস পালিত হয়ে থাকে তবে এ গুরুত্বপূর্ণ দিবসটির প্রয়োজনীয়তা সাধারণ মানুষের কাছে আরও বেশি করে সামনে আনা প্রয়োজন। বাংলাদেশে যেহেতু জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এখনো নিয়ন্ত্রণে আনা এখন সম্ভব হয়নি তাই এ বিষয়ে আরও গুরুত্ব দিয়ে জনসাধারণের নিকট পৌঁছতে হবে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলে দেশে বিভিন্ন সমস্যা তৈরি হতে থাকবে। দেশের উন্নয়নের জন্য যত পরিকল্পনাই করি না কেন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে সেসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে পড়বে। আর যেসব জন্যসংখ্যা রয়েছে তাদের কর্মমুখী করে জনসম্পদে রূপান্তর করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে পরিকল্পিত জনসংখ্যা দেশের উন্নয়নের পূর্বশর্ত এটা মাথায় রেখে আমাদের মতো জনবহুল দেশে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। আমাদের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ০ দশমিক ৭ শতাংশ এবং সাধারণ বাজেটের ২ শতাংশ বরাদ্দ যা অত্যন্ত অপ্রতুল। এ বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করে স্বাস্থ্য খাতকে আরও সুস্থ রাখতে হবে এবং জনসংখ্যাকে কর্মক্ষম করে তোলার জন্য আরও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি সিদ্ধান্ত নিতে হবে আরও বাস্তবমুখী।   লেখক : শিক্ষক ও গণমাধ্যমকমী

বর্জ্য পরিবহন নাকি দুর্গন্ধ বিতরণ

বর্জ্য পরিবহন নাকি দুর্গন্ধ বিতরণ

‘প্লাস্টিক দূষণ আর নয় বন্ধ করার এখনই সময়’ এই প্রতিপাদ্য নিয়েই পালিত হলো ২০২৫ সালের বিশ্ব পরিবেশ দিবস। চারদিকে অত্যন্ত জোরেশোরেই স্লোগান তুলছি পরিবেশ দূষণ রোধে। কিন্তু পরিবেশ দূষণের সকল আয়োজন আমরাই করে চলেছি। পরিবেশ দূষণের অন্যতম দূষণ হলো বায়ুদূষণ। বায়ুদূষণ আমাদের প্রভূত ক্ষতি করছে। বায়ুদূষণের যতগুলো দূষণ উপাদান আছে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পার্টিকুলেট মেটার ২.৫ (চগ২.৫)। এছাড়াও রয়েছে পার্টিকুলেট মেটার ১০ (চগ১০), ওজোন (০৩), সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইড প্রভৃতি ক্ষতিকারক গ্যাস। ওজোন লেয়ার আমাদেরকে অতিবেগুনি রশ্মি থেকে রক্ষা করলেও ওজোন গ্যাস বায়ুদূষণ করে মানুষের বিবিধ রোগ তৈরি করে। বায়ুদূষণের মাত্রা পরিমাপ করা হয় ইয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স বা একিউআই দিয়ে। ঢাকা শহরে ৬ জুলাই ২০২৫ একিউআই এর মান ৮৬। এতেই বুঝা যাচ্ছে ঢাকার বাতাস কতটা দূষিত, যার প্রধানতম দূষণকারী বস্তু পিএম ২.৫। ঢাকা শহরে এই পার্টিকুলেট মেটার ২.৫-এর মান ২৮ মাইক্রোগ্রাম প্রতি ঘন মিটার। যেখানে বিশ্ব-স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রদত্ত সূচক মান ৫ মাইক্রোগ্রাম প্রতি ঘন সিটার। পিএম২.৫ হলো এমন পার্টিকল যার ব্যাস ২.৫ মাইক্রোন। যেখানে আমাদের চুলের ব্যাস ৫০-৭০ মাইক্রোন। সে সেই হিসাব অনুযায়ী পিএম ২.৫ চুলের তুলনায় কত গুণ ক্ষুদ্র হতে পারে। এই ক্ষুদ্র পার্টিকল অতি সহজেই মানুষের নিঃশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে এমনকি রক্তের সঙ্গেও মিশে যেতে পারে। এই পার্টিকলের তুলনায় রোগ সৃষ্টিকারী প্যাথোজেন (ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও ফানগাসসহ অন্যান্য জীবাণু) আরও অনেক ক্ষুদ্র। বাতাস এর মধ্যে সাসপেনডেড প্যাথোজেনগুলোর ব্যাস ০.৫ মাইক্রোন হতে ১ মাইক্রোন। উদাহরণ হিসেবে বলা স্টেফাইলোকক্কাস ব্যাকটেরিয়া, ল্যাকটোব্যাসিলাস ব্যাক-টেরিয়া, একটিনো ব্যাকটেরিয়া, প্রোটিও ব্যাকটেরিয়া, এ্যাসকোমাইকোটা ফানগাস, সহ-অসংখ্য ভাইরাস, আরকিয়া এবং প্রোটিস্টা পিএম ২.৫ দ্বারা পরিবাহিত হয়। এখন পরিষ্কার করে বুঝতে পারছেন পিএম২.৫ একটি অত্যন্ত কার্যকর বাহক। বিভিন্ন ধরনের রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ফানগাস, অ্যাকটিনোমাইসেটস্, প্রটোকটিষ্ট প্রভৃতি অণুজীব কে বহন করে মানুষের শরীরের রক্তে মিশে দিচ্ছে এই পিএম২.৫। আমার মনে পড়ে আজ হতে ৩০ বছর আগের কথা। যখন আমি প্রথম ঢাকায় আসি। সবুজে ঘেরা বগুড়া জেলার নির্মল বায়ুতে বেড়ে উঠা এক যুবক যখন ঢাকা শহরে পৌঁছি, তখন বুঝতে পারি নাই ময়লা পরিবহনের ট্রাক এতো ভয়ংকর উৎকট দুর্গন্ধ ছড়ায়ে চলতে পারে। সেদিন আসাদগেট হতে ফার্মগেট পর্যন্ত যেতে যে অসহনীয় কষ্ট হয়েছিল তা এখনো আমাকে পীড়া দেয়। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে তা অবশ্য একেবারেই খেল বলে মনে হয়। আমার স্পষ্ট মনে আছে কদিন আমি দুপুরে খেতে পারিনি। অথচ আজ প্রতিদিন সেই পরিস্থিতির চেয়ে কত গুণ উৎকট গন্ধযুক্ত রাস্তায় চলাচল করছি হরহামেশাই। মনে হচ্ছে সকল সেন্স অরগানগুলো ভোতা হয়ে পড়েছে। কিন্তু তার পরও সকাল বেলা যখন অফিসে যাই তখন রাস্তায় চলন্ত অবস্থায় যে উৎকট অসহ্য দুগন্ধ ছড়িয়ে অত্যন্ত দাপটের সঙ্গে ময়লা পরিবহনকারী ট্রাকগুলো হুস খুস শব্দে চলতে থাকে তখন মনে হয়, বিশ্বের সরচেয়ে দুর্গন্ধময় স্থান নিউজিল্যান্ডের রোটোরোয়াতে এসে পড়েছি। আর সকালের মজা করে খাওয়া নাস্তাকে মনে হতে থাকে ডুরিয়ান ফল (যা বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর দুর্গন্ধযুক্ত ফল) তক্ষণি পেট হতে বেরিয়ে আসতে চায়। বিকাল বেলা যখন পড়ন্ত বেলায় নিরস মুখে বাসায়, ফিরি তখনও রাস্তায় মনে হয় ডুরিয়ান ফল (বিশ্বের সবচেয়ে দুর্গন্ধযুক্ত ফল) এবং থিওঅ্যাসিটোন (তীব্র ও অপ্রীতিকর গন্ধযুক্ত রাসায়নিক পদার্থ) মিশ্রিত করে কে যেন রাস্তায় ঢেলে দিয়েছে। এত সুন্দর কারুকাজটি আসলে কে করতে পারে। এত বড় শুভাকাক্সক্ষী কে? একটু পরখ করলেই দেখতে পাবেন শুভাকাক্সক্ষী আর কেউ না সেই ক্ষমতাধর ময়লা পরিবহনকারী ট্রাকটি। যে অতি সুচারুভাবে তার বাহিত পবিত্র ময়লার নির্যাস অত্যন্ত দক্ষতা ও সাহসিকতার সঙ্গে রাস্তায় ঢেলে দিয়ে দুর্গন্ধ বিতরণ করতে করতে তার গন্তব্যে ধেয়ে চলছে। নামকা ওস্তে ত্রিপল দিয়ে ঢেকে এই রোগ জীবাণু সৃষ্টিকারী জীবাণু যুক্ত ময়লা-আবর্জনা এমন করে পরিবহন করা কি চলতেই থাকবে। তাহলে এর ফলাফল কতটা ভয়াবহ তা কি কখনই আমাদের উপলব্ধিতে আসবে না। এ কী শুধু গন্ধ ছড়িয়েই নগরবাসীকে তীব্র কষ্ট প্রদান করছে? না বিষয়টি এখানেই শেষ না। উচ্চ পিএম২.৫ যুক্ত বাতাসে এই ময়লা আবর্জনা হতে উৎপন্ন মারাত্মক রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু অতি সহজেই আমাদের ফুসফুসসহ রক্ত সঞ্চালনে মিশে মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করে চলছে। যে জীবাণুগুলো ছিল শহরের নির্দিষ্ট জায়গায়- সেই জীবাণুগুলোকে অপরিকল্পিতভাবে সংগ্রহ ও পরিবহনের ফলে মানুষের শরীরে পৌঁছে যাচ্ছে। নগরীতে তৈরি করছে একটি অসহনীয় পরিবেশ। রোগ-সৃষ্টিকারী প্যাথোজেন ও বাহকের সংখ্যাও পরিবেশে বৃদ্ধি করছে। ফলে অনেক সংক্রামক রোগের ইমার্জিং ও রি-ইমার্জিং হচ্ছে অতি সহজেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই অতি নাজুক পরিস্থিতি হতে উত্তরণের উপায় কি? উপায় অবশ্যই আছে। তবে সবার আগে দেশপ্রেম ও মানবতা-প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় উপায়গুলো-নিম্নে প্রদত্ত হলো- প্রথমেই ঝুঁকিপূর্ণ ও ঝুঁকিহীন বর্জ্যকে আলাদা করতে হবে।  ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য যেমনÑ রাসায়নিক দ্রব্য, ব্যাটারি, মেডিক্যাল বর্জ্য ইত্যাদি। ঝুঁকিহীন বর্জ্য যেমন প্লাস্টিক, দৈনন্দিন ব্যবহত কাজে উৎপাদিত বর্জ্য, বায়োডিগ্রেডেবল বর্জ্য ইত্যাদি। আলাদা করার পর বর্জ্য পরিবহনের জন্য প্রস্তুত করতে হবে। নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্যরে প্রতি সজাগ দৃষ্টি রেখে প্রতিটি কন্টেনার সিল করে নিতে হবে। অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে কোনোভাবেই যেন কন্টেনার ফুটো হয়ে বর্জ্য বেরিয়ে আসতে না পারে। রাস্তার পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে কন্টেনারগুলোতে সাজাতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি কন্টেনারে লেবেল লাগাতে হবে। এসব কাজ করতে হবে নিজে যথাযথভাবে পিপিই ব্যবহার করে। এরপর সঠিক পরিবহন পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনার গাইড লাইন অনুসরণ করে, পরিবহনের রুট, পরিবহনের লোড ও ভেহিকল নির্দিষ্ট করে পরিবহন শুরু করা আবশ্যক। পরিবহনে কখনো যদি অনাকাক্সিক্ষত কোনো ঘটনা ঘটে তা অবশ্যই মানব জাতি, অন্যান্য জীবজন্তু ও পরিবেশের কথা চিন্তা করে পরিবহনে ব্যবহৃত গাড়িটি বন্ধ করে তা যথাযথ নিয়ম মেনে সমাধান করেই আবার পরিবহন শুরু করতে হবে। যেমন: যদি কোন বর্জ্য লিক হয়ে পরিবেশে পড়ে যায় বা রাস্তা দূষণ করে, তবে তা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে এবং কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে প্রয়োজনীয় পরিচ্ছন্নতা শেষেই কেবলমাত্র আবার পরিবহন শুরু করতে হবে। সর্বোপরি ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নীতিমালা অনুসরণ করে তা, পরিবহন ও ব্যবস্থাপন সম্পূর্ণ করতে হবে। একইভাবে ঝুঁকিহীন বর্জ্যও নীতিমালা অনুসরণ করেই ব্যবস্থাপনার আওতায় নিতে হবে। বায়োডিগ্রেডেবল বা রি-সাইকেল করা যায় এমন বর্জ্য পদার্থকে অবশ্যই বর্জ্য হতে সম্পদে পরিণত করার ব্যবস্থা করতে। আমাদের দেশের কৃষি জমিতে উপর্যুপরি রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরশক্তি দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। বর্জ্য ব্যবস্থায় রি-সাইকেল পদ্ধতিতে বায়ো ফার্টিলাইজার তৈরি করে দেশে ও বিদেশে রপ্তানি করা যায়। এমনিভাবে নিজের বাসযোগ্য স্থানকে নান্দনিক ও বসবাসযোগ্য করে গড়ে তোলার দায়িত্ব আমার আপনার সবার। তাই আসুন সবাই মিলে এই ধরিত্রীকে রোগমুক্ত সবুজ ঘেরা একটি শান্তির নীর হিসেবে গড়ে তুলি। লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, নিপসম

আজান ॥ নিত্য সালাত ও কল্যাণের আহ্বান

আজান ॥ নিত্য সালাত ও কল্যাণের আহ্বান

নামাজের সময় এলে একজন লোক উচ্চৈঃস্বরে আল্লাহ্র ইবাদতের সময় হয়েছে বলে মুসল্লিদের আল্লাহ্ দরবারে হাজির হওয়ার জন্য আহ্বান জানায়। এই আহ্বানকে ‘আজান’ বলে। যে আজান দেয় তাকে বলা হয় মোয়াজ্জিন। বিনা বেতনে কিংবা কোনো বিনিময় আশা ব্যতিরেকে আজান দেওয়ার ফজিলত অনেক বেশি। কুরআনুল কারিমে বলা হয়েছে : ওয়ামান আহসানু কাওলাম মিম্মান দাআ ইলাল্লাহ...তার কথার চেয়ে কার কথা উত্তম, যে ব্যক্তি মানুষদের আল্লাহ্র পথে আহ্বান করে ও সৎকাজ আন্জাম দেয় আর বলে নিঃসন্দেহে আমি মুসলমানদের একজন। মহানবী (সা.) জামাআতে নামাজ পড়তে তাগিদ দিযেছেন। জামাআতে নামাজের জন্য কীভাবে ডাকতে হয় কেউ জানত না। মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) সাহাবীদের নিয়ে একদিন পরামর্শে বসলেন, আলোচনা চলল। কেউ বলল নামাজের সময় হলে ঘণ্টা বাজানো হোক। কেউ বললেন শিঙ্গায় ফুঁ দিয়ে ডাকা হোক। অন্য একজন বললেন আগুন জ্বালানো হোক। আরও অনেকে অনেক কথা বললেন। নবী করিম (সা.) কোনোটাই পছন্দ করলেন না।  নিঝুম রাত, সাহাবী আবদুল্লাহ্ বিন জায়েদ (রা.) গভীর ঘুমে মগ্ন। স্বপ্ন দেখেন একজন ফেরেস্তা তাকে আজানের বাক্যগুলো শুনাচ্ছেন। ভোরে তিনি ঐ বাক্যগুলো মহানবী (সা.)-কে শুনালেন। আশ্চর্যের কথা হযরত উমর (রা.)ও একই স্বপ্ন দেখেন। বাক্যগুলো মহানবী (সা.)-এর খুব পছন্দ হলো। তিনি বুঝলেন এটি আল্লাহ্ তায়ালারই নির্দেশ। তিনি হযরত বিলাল (রা.) কে আজান দিতে বললেন। হযরত বিলাল (রা.) এর কণ্ঠে ধ্বনিত হলো প্রথম আজান। হযরত বিলাল (রা.) হলেন ইসলমের প্রথম মোয়াজ্জিন। পরবর্তীকালে উচ্চ স্বরে আজান দেওয়ার ক্ষেত্রে হযরত উমরের সাহসী ভূমিকা ছিল ইসলামে উল্লেখযোগ্য। আজকে যেমন সুমধুর আজানের আওয়াজ কোনো কোনো দুর্ভাগাকে বিরক্তির উদ্রেক করে সে যুগেও বড় করে আজান দেওয়া ছিল মুসলমানদের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। হযরত উমরই মোয়াজ্জিনদের অভয়দান করেছিলেন। তার ব্যক্তিত্ব ও প্রভাবের কারণে তৎকালীন কাফির মুশরিকগণ ইসলামের এ আহ্বান ধ্বনি রুখতে পারেনি।  এক হাদিসে আছে, যে ব্যক্তি আজান দেবে ও ইকামত বলবে এবং আল্লাহকে ভয় করবে তার ছগিরা গুনাহসমূহ মাফ করে তাকে বেহেস্তে প্রবেশ করানো হবে। অন্য এক হাদিসে আছে, যে ব্যক্তি সাত বছর কাল বিনা বেতনে আজান দেবে, সে বিনা হিসেবে বেহেস্তে যাবে। অপর একটি হাদিস হতে জানা যায়, হাশরের ময়দানে মোয়াজ্জিনের মর্যাদা ও মর্তবা এত বেশি হবে যে, সে যত লোকের ভিড়ের মধ্যে হোক না কেন, সকলের মাথার উপরে তার মাথা লক্ষ্য করা যাবে।  ইসলামী ফিকহ শাস্ত্রের বিধান হলো, নবী করিম (সা.) হতে শ্রুত এবং বর্ণিত অবিকল আরবী শব্দগুলো ছাড়া অন্য কোনো প্রকার বা অন্য কোনো ভাষায় আজান দিলে তা ছহীহ হবে না- যদিও তাতে আজানের উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়। পুরুষেরাই আজান  দেবে। মহিলাদের আজান দেওয়া নাজায়েজ। কেননা মহিলাদের উচ্চশব্দ করা এবং পর পুরুষকে শব্দ শুনান নিষেধ। সুতরাং মহিলা আজান দিলে পুরুষকে পুনরায় আজান দিতে হবে। পুনরায় আজান না দিলে যেন বিনা আজানে নামাজ পড়া হলো। পাগল বা অবুঝ বালক আজান দিলে সে আজান শুদ্ধ হয় না, পুনরায় আজান দিতে হয়। আজান দেওয়ার সুন্নাত তরিকা এই যে, মোয়াজ্জিনের গোসলের দরকার হলে গোসল করা এবং ওজুু না থাকলে ওজু করে নেওয়া উচিত। তারপর মসজিদের বাইরে কিছু উঁচু জায়গায় কেবলার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে দুই হাতের শাহাদাত আঙ্গুল দুই কানের ছিদ্রের মধ্যে রেখে যথাসম্ভব উচ্চ শব্দে খোশ এলহানের সঙ্গে নির্দিষ্ট বাক্যমালা উচ্চারণ করবে। গানের মতো গেয়ে বা উঁচু নিচু আওয়াজে আজান দেওয়া ঠিক নয়। যথাসম্ভব আওয়াজ উচ্চ করে টেনে লম্বা করে আজান দেওয়া উচিত।  জুমার ছানি আজান অপেক্ষাকৃত কম আওয়াজে হওয়া বাঞ্ছনীয়। কারণ ঐ আজান দ্বারা শুধু উপস্থিত লোকদের সতর্ক করা হয়। যাতে খুৎবা শোনার জন্য মুসল্লিগণ দায়িত্বশীল মন নিয়ে অগ্রসর হয়। পুরুষ হোক মহিলা হোক পবিত্র অবস্থায় যে কেউ আজানের আওয়াজ শুনবে তার জন্য আজানের জওয়াব দেওয়া মুস্তাহাব, কেউ কেউ ওয়াজিবও বলেছেন। কোনো কোনো আলিম বলেছেন যে, আজানের জবাব দুই প্রকার, (১) মৌখিক জবাব দেওয়া এবং (২) ডাকে সাড়া দিয়ে মসজিদে জামাতে হাজির হওয়া ওয়াজিব। এখানে মৌখিক জবাবের কথাই বলা  হচ্ছে। যদি কেউ আযানের জবাব ভুলবশত: কিংবা স্বেচ্ছায় সঙ্গে সঙ্গে না দিয়ে থাকে, তবে স্মরণ হলে কিংবা ইচ্ছা করলে আজান শেষ হয়ে যাওয়ার পর (অনেক সময় অতিক্রান্ত না হলে) জবাব দেয়া যায়।-(বেহেস্তি জিওর)। জুমার প্রথম আজান হওয়া মাত্রই সমস্ত কাজকর্ম পরিত্যাগ করে মসজিদের দিকে ধাবিত হওয়া ওয়াজিব। ঐ সময় বেচা-কেনা খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদিতে লিপ্ত হওয়া হারাম। (বিস্তারিত দেখুন সূরা জুমার তাফসির)।  আমরা যেন কখনো আজান-আহ্বান উপেক্ষা না করি। আল্লাহ্র ইবাদত বন্দেগির ডাকে সাড়া দিয়ে আমাদের উচিত নির্মল নিষ্পাপ জীবন গড়ার পানে ধাবিত হওয়া।

প্রসঙ্গ অর্থনীতি ॥ মন্দার ঝুঁকি মোকাবিলা

প্রসঙ্গ অর্থনীতি ॥ মন্দার ঝুঁকি মোকাবিলা

বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে সরকারি মহল থেকে মাঝেমধ্যে আশ্বাসের বাণী শোনা যায়, বাস্তব তথ্য-উপাত্ত ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর গবেষণা প্রতিবেদনে যে চিত্র ফুটে উঠেছে, তাতে দেশে ভোক্তা ব্যয়ে চরম সংকোচন ও অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। গত কয়েক বছরে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ, বিনিময় হারের অস্থিরতা, বেসরকারি বিনিয়োগে ভাটা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা মিলে একটি জটিল সংকটের জন্ম দিয়েছে, যার কেন্দ্রে রয়েছে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ক্রমাবনতি ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ধীরগতি। অর্থনৈতিক সূচক ও তাত্ত্বিক কাঠামোর বিশ্লেষণ বলছে, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক মন্দার একাধিক লক্ষণ প্রদর্শন করছে, যদিও কারিগরি দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশ এখনো একটি ‘বৃদ্ধিমূলক মন্দা’ পর্যায়ে রয়েছে, অর্থাৎ পূর্ণমাত্রার সংকোচনে না হলেও খুব কাছেই আছে। প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়ে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ (বিশ্বব্যাংক) বা ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশে (সরকারি হিসাব অনুযায়ী) নেমে এসেছে- যা সংকটপূর্ব ৬-৭ শতাংশ গড় প্রবৃদ্ধির তুলনায় অনেক কম এবং একটি উচ্চ জনসংখ্যার অর্থনীতির জন্য প্রায় স্থবিরতার পর্যায়ে। পরপর দুই অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হ্রাস (২০২৩-২৪ ও ২৪-২৫ যথাক্রমে ৪ দশমিক ২ ও ৩ দশমিক ৩ শতাংশ) পাওয়া ‘বৃদ্ধি মন্দা’র সংজ্ঞার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, যেখানে প্রবৃদ্ধি অর্থনৈতিক সক্ষমতার তুলনায় অনেক নিচে অবস্থান করে এবং এর ফলে মাথাপিছু আয় স্থবির বা নিম্নমুখী হয়ে পড়ে। এমন এক প্রেক্ষাপটে সর্বাগ্রে শ্রেণি-বর্ণ নির্বিশেষে জরুরি ভিত্তিতে সতর্ক ও সচেতন হয়ে সরকারকে কাজ করতে দিতে হবে এবং সংকট উত্তরণে সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে। যে দেশে দশকের পর দশক ধরে রাজনীতিবিদ-আমলারা অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে এডিপি বা উন্নয়ন বাজেটের ৪০-৫০ শতাংশই আত্মসাৎ করে ফেলছে, সে দেশে সবার সতর্ক প্রচেষ্টা ছাড়া মন্দার ঝুঁকি থেকে উত্তরণ অসম্ভব। অর্থনীতি বিজ্ঞানের ‘বৃদ্ধিমূলক মন্দা’ ধারণাটিকে মন্দার ঝুঁকি, মন্দার দ্বারপ্রান্ত, মন্দার আশঙ্কা কিংবা অর্থনৈতিক ধসের পূর্বাভাস- যা-ই বলি, সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে ২০২৪ সালের নভেম্বরে অর্থনীতির শিক্ষক দেশের পরিকল্পনা উপদেষ্টা একটি স্পষ্ট সতর্কবার্তা উল্লেখ করে বলেছিলেন, বেসরকারি বিনিয়োগের অভাব এবং সরকারি উন্নয়ন খাতের স্থবিরতা দেশকে মন্দার দিকে ঠেলে দিতে পারে। তার এই মন্তব্যের মাত্র দুই সপ্তাহ আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর মন্দার আশঙ্কা নেই বলে আশ্বস্ত করলেও, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মূল্যায়ন পরিকল্পনা উপদেষ্টার বক্তব্যের দিকেই ইঙ্গিত করছিল। ঐতিহাসিকভাবেই আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের নিজস্ব পূর্বাভাসের তুলনায় অনেক সতর্ক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। মুডি’স ইনভেস্টর্স সার্ভিস বাংলাদেশের ঋণমান অবনমিত করে ‘বি ২’-এ নামিয়ে আউটলুক ‘নেগেটিভ’ ঘোষণা করেছে। তাদের মতে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সম্ভাবনার ক্ষেত্রে ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এই মূল্যায়নগুলো আসলে ছিল অর্থনীতির ভঙ্গুর অবস্থারই প্রতিফলনচিত্র। এর পরের ছয় মাসের চিত্র বলছে, ভোক্তা ব্যয় সংকোচনের মূল চালক একন দীর্ঘস্থায়ী উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, যা অর্থনৈতিক সংকটের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে। ২০২৫ সালের মে মাসেও সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ০৫ শতাংশে অবস্থান করছে, যেখানে খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরও উদ্বেগজনক ৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের এই লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি সরাসরি ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, তিন বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে, সঞ্চয় ভেঙে খরচ করতে বাধ্য হচ্ছে অনেকে। এর ফলে অভ্যন্তরীণ ভোগ চাহিদা মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। ভোক্তারা এখন বাধ্য হয়েই ব্যয় সংকোচনের পথ বেছে নিচ্ছেন। প্রয়োজনীয় পণ্যেও তারা কম দামি ব্র্যান্ড, ছোট প্যাকেট বা নিম্নমানের বিকল্প বেছে নিচ্ছেন। ক্রেতারা বড় প্যাকেটের বদলে ছোট প্যাকেট, দাম আগের মতো কিন্তু পরিমাণ কম এবং একটি কিনলে একটি ফ্রি কেনার প্রবণতা বেশি দেখাচ্ছেন- যা অর্থনৈতিক কষ্টের স্পষ্ট ইঙ্গিত। ভোক্তা ব্যয় সংকোচনের এই প্রবণতা অর্থনীতির প্রায় সব খাতেই ধস নামিয়ে এনেছে। খুচরা বাণিজ্যে গত কয়েক বছরের তুলনায় ভয়াবহ মন্দা চলছে, যা রাজধানীর প্রধান বাজারগুলোয় ক্রেতাসাধারণের উল্লেখযোগ্য হারে কম উপস্থিতিতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। বিশেষ করে পোশাক, গৃহস্থালি সামগ্রী, ইলেকট্রনিকস এবং ফাস্ট মুভিং কনজিউমার গুডস (এফএমসিজি) খাতে বিক্রি মারাত্মকভাবে কমে গেছে। ঈদের মতো বড় উৎসবেও বাজারে কাক্সিক্ষত জোয়ার দেখা যায়নি। রোজার ঈদে পোশাক বিক্রি গত বছরের তুলনায় প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা কম ছিল। কোরবানির পশুর বাজারেও ধস ছিল, বছর তুলনায় পশু বিক্রি প্রায় ১৫ লাখ কম। ফলে খামারিদের ব্যাপক লোকসান। নির্মাণ খাতও এখন গভীর সংকটে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও চাহিদা কমে যাওয়ায় রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো উৎপাদন প্রায় অর্ধেকে হ্রাস করেছে। ফার্নিচার শিল্পে বিক্রি প্রায় ৫০ শতাংশ কম, অনেক কারখানা কর্মী ছাঁটাইয়ে বাধ্য হচ্ছে। হোটেল-রেস্তোরাঁ খাতেও চলছে চরম মন্দা। রাজনৈতিক অস্থিরতা, নিরাপত্তাজনিত শঙ্কা এবং মানুষের বিনোদন খাতে ব্যয় কমানোর প্রবণতায় অনেক রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে গেছে, বেঁচে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিক্রিও ৩০ শতাংশ কমেছে। রিকন্ডিশন্ড গাড়ির বাজারে চাহিদা প্রায় ৪০ শতাংশ কম।  ভোক্তা ব্যয় হ্রাসের পাশাপাশি অর্থনৈতিক স্থবিরতার আরেকটি মুখ্য কারণ হলো বেসরকারি বিনিয়োগে ধস। গত এক দশক ধরে বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির প্রায় ২০ শতাংশে আটকে আছে এবং ২০১৯ সাল থেকে তা ধারাবাহিকভাবে কমছে। শিল্পখাতে প্রবৃদ্ধি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মাত্র ৩ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে এসেছে। বিনিয়োগের এই স্থবিরতার পেছনে একাধিক গভীর কাঠামোগত কারণ কাজ করছে। উচ্চ প্রকৃত সুদের হার (নামমাত্র সুদ হারের চেয়ে মুদ্রাস্ফীতির হার বেশি হওয়ায় প্রকৃত ঋণের বোঝা বেড়েছে), অবকাঠামোগত ঘাটতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ ও আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা, জ্বালানির উচ্চমূল্য এবং সর্বোপরি দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাসে প্রচণ্ড আঘাত হেনেছে। বিনিয়োগের প্রধান অন্তরায় হিসেবে দুর্নীতি শীর্ষ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) জরিপ অনুযায়ী বিচার বিভাগ দেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত খাত। ভেবে দেখুন, অন্য খাতের কী অবস্থা। দেশের ৭০ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি খাত বা প্রতিষ্ঠানে সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়। ২০০৯ সাল থেকে এপ্রিল ২০২৪ পর্যন্ত সরকারি সেবার জন্য আনুমানিক ১.৪৬ লাখ কোটি টাকা ঘুষ প্রদান করা হয়েছে। এমন দেশে বিদেশিদের বিনিয়োগের কী ‘ঠেকা’ পড়েছে? এসব ছাড়াও রয়েছে পদে পদে নানা জটিলতা- দুর্বল নীতিনির্ধারণ, দুর্নীতিগ্রস্ত ও ধীরগতির বিচারব্যবস্থা এবং স্থিতিশীল ও পূর্বানুমানযোগ্য অর্থনৈতিক পরিবেশের প্রচণ্ড অভাব। বাংলাদেশ যে অর্থনৈতিক মন্দার প্রবল ঝুঁকিতে আছে, তা নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও ব্যাংকিং খাতের গভীর সংকটেও স্পষ্ট। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ২৪.১৩ শতাংশ, যা সামনে আরও বাড়বে। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কড়াকড়ি নীতির কারণে ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট তীব্র হয়েছে, যা নতুন ঋণ প্রবাহে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ওপর। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা প্রকট ঋণসংকটে ভুগছেন। রেমিটেন্স প্রবাহ কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও টাকার অবমূল্যায়ন (গত দুই বছরে ডলারের বিপরীতে প্রায় ৪০ শতাংশ) এবং আমদানি ব্যয় মেটানোই রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে মুখ্য ভূমিকা রাখেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারাও স্বীকার করেছেন যে, এই রিজার্ভ বৃদ্ধি হঠাৎ অস্থিরতা সামাল দিতে সহায়ক হলেও অর্থনীতির মৌলিক দুর্বলতা বিশেষ করে রপ্তানি আয় বাড়ানো এবং টেকসই এফডিআই আকর্ষণে এখনো বড় চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। বাজারভিত্তিক বিনিময় হার ব্যবস্থা স্থিতিশীলতা আনতে পারলেও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানোর জন্য আরও স্থিতিশীল ও স্বচ্ছ অর্থনৈতিক পরিবেশ প্রয়োজন, যার জন্যে সবার আগে প্রয়োজন ঘুণে ধরা রাজনীতিবিদ ও আমলা শ্রেণির বদ মানসিতকার পরিবর্তন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় নীতিনির্ধারক পর্যায়ে একটি স্পষ্ট দ্বন্দ্ব লক্ষণীয়। একদিকে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়িয়েছে, অন্যদিকে সরকার আগামী অর্থবছরে ব্যাংকিং খাত থেকে ১.০৪ লাখ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। এই দ্বন্দ্বে মনে হচ্ছে, নিয়ত সৎ হলেও নীতিনির্ধারদের মধ্যে কোনো এক অনিশ্চয়তাবোধ কাজ করছে, যা তাদের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান তৈরিতে বাধা তৈরি করছে। এই প্রবণতা দীর্ঘ হলে নিশ্চিতভাবেই ব্যাংকিং খাতের তারল্য সংকট আরও তীব্র হবে, সুদহার উচ্চ থাকবে এবং বেসরকারি খাতের জন্য ঋণপ্রাপ্তি আরও দুরূহ হয়ে উঠবে। অর্থাৎ মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির মধ্যে সমন্বয়ের অভাব প্রকট। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কেবল স্বল্পমেয়াদি ঋণনির্ভরতা নয়, গভীর কাঠামোগত সংস্কারও অপরিহার্য। এ জন্য দুর্নীতি দমন ও সুশাসন নিশ্চিতকরণ, আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি, বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নয়ন (বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য), অবকাঠামোগত উন্নয়ন, একটি স্থিতিশীল ও পূর্বানুমানযোগ্য অর্থনৈতিক নীতি কাঠামো বাস্তবায়ন এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। শিল্পনীতিতে রাষ্ট্রের ভূমিকা ও দায়বদ্ধতার স্বচ্ছ সীমারেখা নির্ধারণ করে একটি আধুনিক, বিনিয়োগবান্ধব এবং প্রতিযোগিতামূলক শিল্প পরিবেশ গড়ে তোলা জরুরি। বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে ভোক্তা ব্যয় সংকোচন, বিনিয়োগ স্থবিরতা, মুদ্রাস্ফীতির চাপ এবং আর্থিক খাতের দুরবস্থায় জর্জরিত। মনে রাখতে হবে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে কিছুটা উন্নতি হলেও তা মূলত বৈদেশিক ঋণ, যা সুদাসল অবমূল্যায়িত মুদ্রার জরিমানাসহ শোধ করতে হবে। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা খুচরা বাণিজ্য থেকে শুরু করে শিল্প উৎপাদন পর্যন্ত সবখানে ধস নামাচ্ছে। বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণে ব্যর্থতা, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, দুর্নীতি-চাঁদাবাজি ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এই সংকটকে আরও গভীর ও তীব্র করছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য দরকার রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি, সুদূরপ্রসারী ও সমন্বিত নীতিকৌশল এবং দুর্নীতি দমনে কঠোর পদক্ষেপ। শুধু স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করার মাধ্যমেই বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক গতিশীলতা ফিরিয়ে ভোক্তাদের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হতে পারে। অন্যথায় দেশকে দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক মন্দার ধকল সইতে হবে।