ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৯ মে ২০২৫, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

মতামত

আসুন শপথ গ্রহণ করি, আর কখনো খাবার অপচয় করব না 

আসুন শপথ গ্রহণ করি, আর কখনো খাবার অপচয় করব না 

বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। গণমাধ্যমের পাতা উল্টোলেই পরতে পরতে চুরি ডাকাতি ছিনতাই রাহাজানি ধর্ষণ ও মব জাস্টিস যেন নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতিটি গ্রাম পাড়া ও মহল্লায় ডজন খানিক ব্যক্তি রয়েছেন, যারা এসব অপকর্ম করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। অনেকে আবার সালিশ দরবারের নামে অবিচার করাকে রোজগারের উৎস বানিয়ে নিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ছেড়ে দে মা কাইন্দা বাঁচি নীতি অবলম্বন করতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেকে আবার সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে বোল পাল্টিয়ে স্বভাব সুলভ অপরাধ করে বেড়াচ্ছেন। কেউবা নতুন দলবাজি ও চাটুকারিতা করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। কতক আবার বিভিন্ন উপলক্ষকে সামনে রেখে মন মত ট্যাগ লাগিয়ে লুটতরাজে নেমেছেন। এসব অনাচারে বৈধতা দিতে গিয়ে কেউবা বলছেন, এদেশের মানুষ গরিব তাই এসব করছেন, দারিদ্র সীমার নিচে থাকায় এসব করতে বাধ্য হচ্ছেন। এসব অপরাধ বিকলাঙ্গ কানা বধির বা অন্য কোনো কারণে কাজ করতে অক্ষম ব্যক্তি করছেন না, কর্মক্ষম ব্যক্তি করছেন। তবে কেন এমন মন্দ কাজ? কেন এ মিছে অভিনয়?

মতামত বিভাগের সব খবর

তারুণ্যের রাজনীতির চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

তারুণ্যের রাজনীতির চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘রাজনীতিতে তরুণদের আরও সক্রিয় হতে হবে’। তাঁর বক্তব্যটিকে নিছক মতামত হিসেবে না দেখে, বরং একটি দিকনির্দেশনা হিসেবে গ্রহণ করাই শ্রেয়। এই বক্তব্য আমাদের জাতীয় রাজনৈতিক চেতনায় একটি জরুরি আলোচনার দ্বার খুলে দিয়েছে। আজকের তরুণ সমাজ শুধু ভবিষ্যৎ নয়, বর্তমানও। রাজনীতির প্রতিটি পরতে তরুণদের সক্রিয় অংশগ্রহণের গুরুত্ব দিন দিন আরও দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। এ কারণেই তরুণদের রাজনীতিতে সক্রিয় করা এখন কেবল প্রয়োজন নয়, একটি অনিবার্য বাস্তবতা। তরুণদের রাজনীতি অংশগ্রহণের গুরুত্ব বোঝাতে গেলে প্রথমেই বোঝা দরকার-তরুণ মানে কী? তরুণ মানে শুধু বয়সে তরুণ নয়, বরং চিন্তায়, উদ্যমে, নতুনত্বে এবং সংস্কারে তরুণ। একক দলগত কোনো বিষয় নায়। সকল দলে তরুণরা গুরুত্ব পাক। তরুণ মানেই সম্ভাবনার ঝর্ণাধারা। একজন তরুণের মধ্যে থাকে সাহস, সততা, আত্মবিশ্বাস, নতুন কিছু করার আকাক্সক্ষা, সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন। তারা দীর্ঘমেয়াদি লাভ বা ক্ষমতা ধরে রাখার চেয়ে তাৎক্ষণিক পরিবর্তনের জন্য কাজ করতে আগ্রহী থাকে। তারা ‘হয়ে গেছে’ বলতে রাজি নয়, তারা চায় ‘নতুন করে গড়ে তোলা’। এটাই তরুণদের শক্তি। বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষাপটে এ ধারাটি অত্যন্ত স্পষ্ট। ফিনল্যান্ডের সানা মারিন, নিউজিল্যান্ডের জাসিন্ডা আরডার্ন, ফ্রান্সের ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ, চিলির গ্যাব্রিয়েল বরিচ, ইউক্রেনের ভলোদিমির জেলেনস্কি- তারা সবাই তরুণ বয়সে ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছে গেছেন। শুধু নির্বাচনে জয়ী হওয়া নয়, তারা রাষ্ট্র পরিচালনায় নতুন ধারা সৃষ্টি করেছেন। উদ্ভাবনী চিন্তা, প্রযুক্তি-সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত, পরিবেশবান্ধব নীতি এবং মানবিক নেতৃত্বের আদর্শ তাঁরা তৈরি করেছেন। এতে প্রমাণিত হয় যে, তরুণদের হাতে ক্ষমতা দিলে রাষ্ট্র মেধাবী, মানবিক ও কার্যকর হতে পারে। বাংলাদেশেও আমরা এর ব্যতিক্রম নই। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ, গণআন্দোলন থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক শিক্ষার্থীদের আন্দোলন পর্যন্ত-তরুণরাই ছিলেন সামনে। ১৯৫২-র শহীদ সালাম, রফিক, বরকত ছিলেন তরুণ। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনানী ছিলেন তরুণরা। ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতাই ছিল নেতৃত্বে। শাহবাগ আন্দোলন, কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন-সবখানেই তরুণরাই দিয়েছে নেতৃত্ব। তারা শুধু ক্ষোভ প্রকাশ করেনি, যুক্তি ও গঠনমূলক প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। দুঃখজনকভাবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মূলধারার রাজনীতিতে তরুণদের অংশগ্রহণ কমে গেছে। রাজনীতি হয়ে উঠেছে অভিজ্ঞদের ‘ক্লোজড সার্কেল’। এই ক্লোজড সার্কেলে তরুণদের যেন প্রবেশাধিকার নেই। আবার তরুণরাও রাজনীতিকে দুর্নীতিগ্রস্ত এবং অসৎ বলেই ভাবতে শিখেছে। এর ফলে দেশের মেধাবী একটি অংশ রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। এ এক বিপজ্জনক প্রবণতা। কারণ যখন ভালো মানুষ রাজনীতি থেকে দূরে থাকে, তখনই খারাপ মানুষদের দখলে চলে যায় সমাজ ও রাষ্ট্র। তরুণদের রাজনীতিতে ফেরানোর জন্য দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও কাঠামোতে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। প্রথমত, রাজনৈতিক দলগুলোকে তরুণদের জন্য সুনির্দিষ্ট কোটাভিত্তিক নেতৃত্বের স্থান নির্ধারণ করতে হবে। প্রতিটি ওয়ার্ড, উপজেলা, জেলা ও কেন্দ্রীয় কমিটিতে কমপক্ষে ৩০-৪০ শতাংশ পদ তরুণদের জন্য সংরক্ষণ করতে হবে। তবে কেবল কাগজে-কলমে না থেকে, এটি বাস্তবায়নের জন্য কঠোর নজরদারি করা প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলের সুষ্ঠু এবং কার্যকর নেতৃত্বের জন্য তরুণদের প্রয়োজনীয় অংশগ্রহণ এবং প্রভাব নিশ্চিত করা অপরিহার্য। তরুণদের নেতৃত্বে আনা কেবল একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয়, এটি তাদের ক্ষমতায়ন এবং পরিবর্তনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগও। তরুণদের নেতৃত্বের বিষয়টি যদি দৃষ্টিভঙ্গি, নীতি এবং চিন্তাভাবনার পরিবর্তন আনতে পারে, তবে তা রাষ্ট্র পরিচালনায় নতুন দিশা এবং উদ্ভাবন নিয়ে আসবে। দলের অভ্যন্তরে তরুণদের সুনির্দিষ্ট স্থান নিশ্চিত করার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম আরও প্রাণবন্ত এবং প্রগতিশীল হতে পারে। দ্বিতীয়ত, তরুণদের রাজনৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা জরুরি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ‘নাগরিক শিক্ষা’ এবং ‘নৈতিক নেতৃত্ব’ বিষয়ক পাঠ্যক্রম বাধ্যতামূলক করা দরকার। এতে তরুণরা রাজনীতি ও রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী এবং সচেতন হয়ে উঠবে। এই শিক্ষা তরুণদের মধ্যে রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলবে, যা ভবিষ্যতে তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ‘লিডারশিপ প্রোগ্রাম’, ‘ইয়ুথ পার্লামেন্ট’, ‘ডেমোক্রেসি ক্যাম্প’ ইত্যাদি আয়োজন করলে তারা বাস্তব রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা অর্জন করবে। তরুণরা যদি রাজনৈতিক বিষয়ে গভীর জ্ঞান এবং দক্ষতা অর্জন করতে পারে, তবে তারা দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে সক্ষম হবে। এই ধরনের উদ্যোগগুলো যুব সমাজের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলী বিকাশে সাহায্য করবে এবং তাদের আত্মবিশ্বাস ও প্রস্তুতি বাড়াবে। তৃতীয়ত, তরুণদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং সক্ষমতা রাজনৈতিক দলে কাজে লাগাতে হলে একটি সহনশীল রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তোলা জরুরি। আজকের তরুণরা সংঘাতমুখী নয়। তারা সহমত ও সমঝোতায় বিশ্বাস করে। কিন্তু বাস্তব রাজনীতি এখনো অনেক ক্ষেত্রে সংঘাত, অপবাদ, প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধে ভরপুর। এই সংস্কৃতির পরিবর্তন না হলে তরুণরা রাজনীতিতে প্রবেশ করে হতাশ হয়ে পড়বে। রাজনীতির মাঠে নেতিবাচক কার্যকলাপ, অপরাজনীতি এবং অসুস্থ প্রতিযোগিতা দূর করার মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। তরুণরা চাইলে রাজনীতি আরও মানবিক, সহনশীল এবং শান্তিপূর্ণ হতে পারে। রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ যদি তরুণদের মতামত ও মতপার্থক্যকে সম্মান করে এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বৈচিত্র্য গ্রহণ করে, তবে রাজনীতি তরুণদের জন্য আরও আকর্ষণীয় এবং সুযোগ-সুবিধাযুক্ত হবে। চতুর্থত, মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ইতিবাচক ব্যবহার তরুণদের উৎসাহিত করতে পারে। তরুণদের সফল নেতৃত্বের গল্প প্রচার, রাজনৈতিক দায়িত্ব পালনকারী তরুণ জনপ্রতিনিধিদের কাজ তুলে ধরা তরুণদের অনুপ্রাণিত করবে। পাশাপাশি নেতিবাচক রাজনীতির প্রতি তাদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হবে। সোশ্যাল মিডিয়া ও অন্যান্য মিডিয়াগুলোর মাধ্যমে তরুণরা বাস্তব রাজনৈতিক ঘটনাবলী জানতে পারবে এবং প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতন হতে পারবে। এই ধরনের প্রচার তাদেরকে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের প্রতি উৎসাহিত করবে এবং তাদের নেতৃত্বের মনোভাব গড়ে তুলবে। তাই, রাজনৈতিক দলগুলো ও সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের শক্তি ব্যবহার করে তরুণদের মধ্যে ইতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করতে পারে, যা রাজনীতির মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন এবং ভবিষ্যতের নেতৃত্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। রাজনীতিতে তরুণদের বাধা আসে কেবল সিস্টেম থেকে নয়, পরিবার ও সমাজ থেকেও। বাবা-মা চায় সন্তান ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিসিএস ক্যাডার হোক, কিন্তু রাজনীতিবিদ হোক- এটা তারা চায় না। কারণ রাজনীতিকে তারা মনে করেন ‘ঝুঁকিপূর্ণ ও নোংরা’ একটি পেশা। এই মনোভাবও ভাঙতে হবে। রাজনীতি একটি সম্মানজনক পেশা হতে পারে- এই বার্তা সমাজে পৌঁছাতে হবে। তরুণদের সামনে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের নতুন মডেলও হাজির করতে হবে। একটি বিকেন্দ্রীকৃত রাজনৈতিক কাঠামো, যেখানে তৃণমূল পর্যায়ে নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ থাকবে, তা তরুণদের এগিয়ে আনবে। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় তরুণদের বেশি করে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ বা পৌরসভায় তরুণ প্রার্থীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হলে প্রার্থী মনোনয়নে স্বচ্ছতা ও অগ্রাধিকার দিতে হবে। তরুণদের অংশগ্রহণ রাজনীতিকে শুধু প্রাণবন্তই করবে না, বরং উদ্ভাবনী, প্রযুক্তিনির্ভর এবং দায়িত্বশীল করে তুলবে। তরুণরাই পারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করে স্বচ্ছতা আনতে এবং মানুষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে। তারা অন্ধ অনুসরণ নয়, নেতৃত্বে জবাবদিহিতা চায়। বিশ্বব্যাপী দেখা গেছে, তরুণ নেতৃত্ব কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়নই নয়, সামাজিক ন্যায়বিচার, জলবায়ু পরিবর্তন, শিক্ষানীতি, নারী অধিকারসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। আজকের পৃথিবী, যেখানে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ, সংকট এবং সমস্যাগুলোর মুখোমুখি, সেখানে তরুণরা তাদের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, উদ্ভাবনী চিন্তা এবং সাহসিকতার মাধ্যমে এসব সমস্যা সমাধানে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। তারা সমাজে নতুন সংস্কৃতি, পরিবর্তন এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন নিয়ে এসেছে, যা রাষ্ট্র পরিচালনায় উন্নয়ন এবং গণতন্ত্রের মূল্যবোধে অবদান রেখেছে। উদাহরণস্বরূপ, জলবায়ু পরিবর্তন, যা একটি বৈশ্বিক সংকট, সে বিষয়ে তরুণ নেতারা আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এর মাধ্যমে তারা প্রমাণ করেছে যে, তরুণরা শুধু দেশীয় নয়, বৈশ্বিক সমস্যারও সমাধান খুঁজে বের করার শক্তি রাখে। বাংলাদেশের মতো জনবহুল, তরুণ জনগোষ্ঠীসমৃদ্ধ দেশে এই ধরনের নেতৃত্ব অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয়। আমাদের দেশে প্রায় ৪ কোটি তরুণ ভোটার রয়েছেন, যারা আগামী দিনের নেতৃত্ব নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। এই তরুণরা যদি তাদের ক্ষমতা ও প্রভাব সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারেন, তবে তারা দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থায় উন্নতি আনতে সক্ষম হবে। তরুণরা দেশের সমৃদ্ধি, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার এবং পরিবেশ রক্ষায় নেতৃত্ব দিতে পারে। তাদের চিন্তা, উদ্ভাবন এবং দৃষ্টিভঙ্গি সমাজকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, পরিবেশবান্ধব এবং উদ্দীপক করে তুলতে পারে। এভাবেই আগামী দিনের বাংলাদেশে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠবে, যা তরুণ নেতৃত্বের হাতে আলোকিত হবে। তরুণদের রাজনীতিতে আসার পথ সুগম করতে হলে কেবল আহ্বান নয়, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব হবে যে, তারা তরুণদের নেতৃত্বের জন্য স্থান করে দেবে এবং তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করবে। সরকার এবং প্রশাসনকেও তরুণদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া, তাদের ক্ষমতায়ন করা এবং তাদের চিন্তা ও প্রস্তাবনা শোনার ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তরুণদের রাজনৈতিক শিক্ষা এবং নাগরিক দায়িত্বে আগ্রহী করে তুলতে প্রভাবশালী ভূমিকা রাখতে পারে। পরিবার এবং গণমাধ্যমও তরুণদের নেতৃত্বের গুণাবলী বিকাশে সহায়ক হতে পারে। পরিবার তরুণদের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং নৈতিক শিক্ষা প্রদান করতে পারে, যা তাদের আগামী দিনের নেতৃত্বে সাহায্য করবে। গণমাধ্যম তরুণদের সফল নেতৃত্বের গল্প প্রচার করে তাদের মধ্যে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করতে পারে, যাতে তারা রাজনীতির প্রতি আগ্রহী হয় এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে। এই পরিবর্তন সম্ভব হতে পারে শুধু যখন সমস্ত সেক্টরগুলো একত্রে কাজ করবে এবং তরুণদের জন্য সঠিক অবকাঠামো গড়ে তুলবে। সবার সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে তরুণদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের পথ খুলে যাবে এবং তারাই একটি নতুন, উন্নত, এবং উদ্যমী বাংলাদেশ গড়ার পক্ষে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। তরুণদের নেতৃত্বের মধ্যেই লুকিয়ে আছে একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন, যেখানে তারা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাফল্যের ধারক ও বাহক হিসেবে কাজ করবে। রাজনীতিতে তরুণরা যদি নেতৃত্ব দেয়, তাহলে সেই রাজনীতি হবে গণমুখী, মানবিক এবং অগ্রগতিমুখী। কারণ তরুণরা স্বপ্ন দেখে, সাহস করে, আর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য নিজের সবটুকু ঢেলে দেয়। তাদের এই শক্তিকে অবজ্ঞা নয়, স্বীকৃতি দিতে হবে। দেশ গড়ার রাজনীতিতে তাদের অগ্রণী ভূমিকাই হোক আগামী বাংলাদেশের প্রধান দিকনির্দেশনা।

পরিবেশবান্ধব টেকসই ব্যবসা

পরিবেশবান্ধব টেকসই ব্যবসা

বিশ্ব আজ নজিরবিহীন জলবায়ু সংকটের সম্মুখীন। যার প্রভাব দিন দিন ভয়াবহ হয়ে উঠছে। খরা, অকালবৃষ্টি, তীব্র তাপপ্রবাহ, ঘূর্ণিঝড়, সুনামি, জলাবদ্ধতা, এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো শুধু ঘন ঘনই নয়, বরং আগের চেয়ে অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠেছে। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৫০ সাল থেকে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা প্রায় ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে (বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা, ২০২০)। বিজ্ঞানীরা বারবার সতর্ক করে আসছেন যে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বৃদ্ধি পেলে পৃথিবীর জন্য তা বিপর্যয় ডেকে আনবে। এছাড়া ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে বৈশ্বিক ঈঙ২ কনসেনট্রেশন ৪২৬.০৩ পিপিএম রেকর্ড করা হয়েছে, যা ২০২৪ সালের জানুয়ারির তুলনায় ৩.৭৮ পিপিএম বৃদ্ধি। এই প্রবণতা চলতে থাকলে, বৈশ্বিক উষ্ণতা ২ক্কঈ বা তারও বেশি বৃদ্ধি পেতে পারে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক প্রভাব সৃষ্টি করবে। অধিকিন্তু, ২০৫০ সালের মধ্যে যদি কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করা না যায়, তবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হবে ভয়াবহ ও অপরিবর্তনীয় (ওচঈঈ)। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলই কমবেশি জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির শিকার হলেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো-বিশেষ করে বাংলাদেশ-সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স অনুযায়ী, ২০০০-২০১৯ সাল পর্যন্ত সময়ের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ৭ম সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশ (জার্মানওয়াচ, ২০২০)। এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ১৮৫টি চরম আবহাওয়ার ঘটনা ঘটেছে, যার ফলে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩.৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ শুধু অতীতের ঘটনা নয়; বর্তমানেও বাংলাদেশ চরম আবহাওয়া মোকাবিলা করছে। বাংলাদেশ প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে, যার বড় অংশ জুড়ে রয়েছে বন্যা, নদীভাঙন, খরা ও ঘূর্ণিঝড়। শুধু ২০২২ সালেই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৭০ লাখ মানুষ এবং কৃষি উৎপাদনে ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা (বিশ্বব্যাংক ও জিএফডিআরআর এর যৌথ প্রতিবেদন)। এই সংকট শুধু প্রাকৃতিক নয়- এটি আমাদের জীবিকা, খাদ্যনিরাপত্তা, জনস্বাস্থ্য, নারী-শিশু সুরক্ষা এবং সামগ্রিক অর্থনীতির ওপরও গভীর প্রভাব ফেলছে। উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষেরা বাধ্য হচ্ছেন বাসস্থান ছেড়ে জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হতে। শহরমুখী এই অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের ফলে বাড়ছে নগরীর চাপ, কর্মসংস্থান সংকট এবং সামাজিক অস্থিরতা। সুতরাং জলবায়ু সংকট আর ভবিষ্যতের কোনো আশঙ্কা নয়- এটি এখনই ঘটছে। বর্তমান বৈশ্বিক জলবায়ু সংকটের পেছনে সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি হলো মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে অদূরদর্শী এবং পরিবেশ-বিরুদ্ধ ব্যবসায়িক চর্চা। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির ইমিসন গ্যাস রিপোর্টে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের প্রায় ২১ শতাংশ দায়ী খনিজ জ্বালানিভিত্তিক শিল্প খাত। তাছাড়া উন্নয়নশীল দেশগুলোর অনেক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান টেকসই উৎপাদন প্রক্রিয়া অনুসরণ না করায় প্রাকৃতিক সম্পদের অবক্ষয় এবং পরিবেশ দূষণ মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে (বিশ্ব ব্যাংক, ২০২১)। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, পরিবেশসম্মত উৎপাদন ব্যবস্থার ঘাটতি এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি বাড়ছে। একইসঙ্গে বাংলাদেশের শিল্প ও অবকাঠামো খাতেও টেকসই নীতিমালার ঘাটতি জলবায়ু সংক্রান্ত দুর্বলতাকে আরও তীব্র করেছে (জিজিজিআই, ২০২২)। এই বাস্তবতায়, টেকসই ব্যবসায়িক চর্চা (ঝঁংঃধরহধনষব ইঁংরহবংং চৎধপঃরপবং) গড়ে তোলার বিকল্প নেই। টেকসই ব্যবসায়িক চর্চা বলতে এমন ব্যবসায়িক কৌশল ও কার্যক্রমকে বোঝায় যা পরিবেশ, সমাজ এবং অর্থনীতির প্রতি দীর্ঘমেয়াদি ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে। এটি এমন একটি পদ্ধতি যেখানে ব্যবসা শুধু আর্থিক লাভের দিকে নজর না দিয়ে, পরিবেশগত এবং সামাজিক দায়িত্ব পালন করে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও পৃথিবী ও তার সম্পদ সুরক্ষিত থাকে। বিশ্বব্যাপী টঘএঈ এবং ডঈঊউ-এর মতো প্রতিষ্ঠিত সংস্থাগুলো টেকসই ব্যবসায়িক চর্চাকে প্রাথমিকভাবে ‘সামাজিক, পরিবেশগত এবং অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে লাভজনক এবং সমৃদ্ধ ব্যবসার অনুশীলন’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে। বাংলাদেশে এখন টেকসই বা পরিবেশবান্ধব ব্যবসা বাড়ানোর জন্য অনেক উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ২০১১ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক সবুজ ব্যাংকিং নীতিমালা চালু করে। ২০২৪ সালের শেষ তিন মাসে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার বেশি টেকসই খাতে ঋণ দিয়েছে। এর মধ্যে ৭,৬২০ কোটি টাকা সরাসরি পরিবেশবান্ধব প্রকল্পে গেছে। সবুজ খাতে বিনিয়োগ আরও সহজ করতে বাংলাদেশ ব্যাংক ৫ শতাংশ সুদে বিশেষ ঋণ চালু করেছে। এর মাধ্যমে নবায়নযোগ্য জ্বালানি, জৈব কৃষি আর পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিতে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলো সহায়তা পাচ্ছে। আবার সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে প্লাস্টিকের ৫০ শতাংশ পুনর্ব্যবহার এবং ২০২৬ সালের মধ্যে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ৯০ শতাংশ পর্যায়ক্রমে নিষিদ্ধ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এই উদ্যোগ শিল্প খাতে পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে। অধিকন্তু বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৫.৭৭ লাখ টন টেক্সটাইল বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার বেশির ভাগই পুনর্ব্যবহার না করে ফেলা হয়। বর্তমানে কিছু স্থানীয় প্রতিষ্ঠান উন্নত প্রযুক্তি ও শ্রমিকদের জন্য ভালো কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করে টেক্সটাইল বর্জ্য পুনর্ব্যবহারে কাজ করছে। টেকসই বা পরিবেশবান্ধব ব্যবসা বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অর্থায়নও পাচ্ছে। ২০২৫ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংক ৮৫০ মিলিয়ন ডলারের দুটি অর্থায়ন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যার মধ্যে ৬৫০ মিলিয়ন ডলার বন্দর অবকাঠামো উন্নয়নে এবং ২০০ মিলিয়ন ডলার সামাজিক সুরক্ষা ও কর্মসংস্থান সেবায় ব্যবহৃত হবে। এছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বাংলাদেশের জন্য ১.১৪৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ অনুমোদন করেছে, যার মধ্যে ২২০ মিলিয়ন ডলার জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ব্যবহৃত হবে। এছাড়া বাংলাদেশে সবুজ ভবন নির্মাণে সরকার ও বেসরকারি খাতের উদ্যোগে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও ঝজঊউঅ যৌথভাবে ‘এৎববহ ইঁরষফরহম ঋবধঃঁৎবং’ নামে একটি রেটিং সিস্টেম চালু করেছে, যা পুনঃঅর্থায়ন স্কিমের আওতায় সবুজ ভবন নির্মাণে সহায়তা করে। একইসঙ্গে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০২০–২৫) এবং স্মার্ট বাংলাদেশ ভিশন ২০৪১-এর আওতায় সরকার টেকসই উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। সরকারও নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে, আন্তর্জাতিক অর্থায়নও আসছে, কিন্তু তারপরও সাসটেইনেবল বিজনেস বা টেকসই উন্নয়ন বাস্তবে কাক্সিক্ষত অগ্রগতি পাচ্ছে না। যদিও বিশ্বজুড়ে পরিবেশবান্ধব উৎপাদন, সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং দীর্ঘমেয়াদি মূল্য সৃষ্টির ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু বাংলাদেশের বেশির ভাগ ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান এখনো এই ধারণাকে কৌশলগতভাবে গ্রহণ করেনি। ২০২৩ সালে ইউনাইটেড নেশনস গ্লোবাল কমপ্যাক্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের ৮৫ শতাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই এখনো এসডিজি লক্ষ্যমাত্রাগুলোকে তাদের কোর বিজনেস মডেলে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেনি। এর মূল কারণ হলো কাঠামোর দুর্বলতা ও কার্যকর বাস্তবায়নের অভাবসহ অন্যান্য চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশে টেকসই ব্যবসায়িক অনুশীলন প্রতিষ্ঠার পথে বিভিন্ন কাঠামোগত ও বাস্তবায়নভিত্তিক চ্যালেঞ্জ দৃশ্যমান। প্রথমত, শক্তিশালী নীতিমালা ও নির্দেশিকা থাকা সত্ত্বেও মাঠপর্যায়ে কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। যার পেছনে স্থানীয় প্রশাসন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার সমন্বয়হীনতা একটি বড় বাধা। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের বেশিরভাগ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এখনো স্বল্পমেয়াদি মুনাফাকে অগ্রাধিকার দেয় এবং টেকসই ব্যবসা মডেলকে অতিরিক্ত ব্যয়সাপেক্ষ হিসেবে বিবেচনা করে। ফলে তারা দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশগত ও সামাজিক দায়বদ্ধতা এড়িয়ে চলে। তৃতীয়ত, উদ্যোক্তা, কর্মকর্তা ও সাধারণ জনগণের মধ্যে সাসটেইনেবল বিজনেস মডেলের প্রয়োজনীয়তা, কার্যকারিতা এবং সম্ভাব্য আর্থিক সুফল সম্পর্কে সচেতনতার অভাব রয়েছে। চতুর্থত, পরিবেশবান্ধব উৎপাদন প্রযুক্তি এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সক্ষমতার অভাব, বিশেষত ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের মধ্যে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সর্বশেষ, দুর্নীতি ও স্বচ্ছতার অভাব নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর কার্যকারিতাকে বাধাগ্রস্ত করছে। যার ফলে অনেক পরিবেশ-ধ্বংসী ব্যবসায়িক কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। তাই বাংলাদেশে টেকসই ব্যবসায়িক চর্চা প্রতিষ্ঠায় এখন সময়োপযোগী, কঠোর এবং সুসংহত পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। প্রথমত, শক্তিশালী নীতিমালা এবং নির্দেশিকাগুলোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে স্থানীয় প্রশাসন এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি করা জরুরি। এর মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে কার্যকর মনিটরিং এবং প্রয়োগ নিশ্চিত হবে। দ্বিতীয়ত, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে টেকসই ব্যবসা মডেলের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি করতে বিশেষভাবে শিক্ষণীয় কর্মশালা এবং প্রোগ্রাম আয়োজন করা উচিত। উদ্যোক্তাদের জন্য টেকসই উন্নয়ন সম্পর্কে প্রশিক্ষণ এবং আর্থিক সুবিধা প্রদান করে তাদের প্রণোদিত করা যেতে পারে। তৃতীয়ত, প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যে পার্টনারশিপ গড়ে তোলা উচিত, বিশেষত ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (ঝগঊং) জন্য পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারের সুবিধা নিশ্চিত করা। চতুর্থত, পরিবেশবান্ধব উদ্যোগগুলোতে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে কর অবকাশ এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক প্রণোদনা অধিক হারে চালু করা উচিত। সর্বশেষ, দুর্নীতি ও স্বচ্ছতার অভাব কাটিয়ে উঠতে কার্যকর নজরদারি এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর স্বচ্ছতা বাড়ানোর জন্য তৎপরতা চালানো প্রয়োজন, যেন সঠিকভাবে পরিবেশগত নিয়মকানুনগুলো অনুসরণ করা হয় এবং পরিবেশ-ধ্বংসী কার্যক্রম বন্ধ হয়। বর্তমান জলবায়ু সংকটের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের টেকসই ব্যবসায়িক চর্চা প্রতিষ্ঠা একটি জরুরি ও মৌলিক পদক্ষেপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, তবু কার্যকর বাস্তবায়নে অনেক বাধা রয়েছে। শক্তিশালী নীতিমালা, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সচেতনতা, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা এবং স্বচ্ছতা বৃদ্ধির মাধ্যমে টেকসই ব্যবসায়িক চর্চা গড়ে তোলা সম্ভব। তবে এর জন্য প্রয়োজন কঠোর বাস্তবায়ন, সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা এবং শক্তিশালী নজরদারি ব্যবস্থা। সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশকে আরও টেকসই, পরিবেশবান্ধব এবং অর্থনৈতিকভাবে স্থিতিশীল করে তোলা সম্ভব। তাই এই সংকট মোকাবিলায় সবার সমন্বিত প্রয়াস প্রয়োজন। যাতে আমরা একটি নিরাপদ এবং স্থিতিশীল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারি।

সচেতনতাই হোক আত্মরক্ষার শক্তি

সচেতনতাই হোক আত্মরক্ষার শক্তি

প্রায় সারা দেশে কমবেশি চলছে তাপপ্রবাহ। প্রচণ্ড গরমে হিটস্ট্রোক এখন শুধুই একটি শব্দ নয় বরং এক বাস্তব আতঙ্কের নাম। প্রতিবছর গ্রীষ্মকালে যখন তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায় তখন জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ে। বিশেষ করে শিশু বৃদ্ধ ও অসুস্থরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। একটু অবহেলা এক মুহূর্তের অসচেতনতা প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। তাই প্রয়োজন সময়োপযোগী প্রস্তুতি এবং সচেতনতা। হিটস্ট্রোক মূলত তখনই ঘটে যখন শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণকারী স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটি ব্যাহত হয়। অতিরিক্ত গরমে শরীর থেকে ঘাম নিঃসরণ বন্ধ হয়ে গেলে তাপমাত্রা বেড়ে যায় এবং শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো বিকল হতে শুরু করে। এতে মাথাব্যথা দুর্বলতা বমিভাব শরীর ঝিম ধরে যাওয়া এবং কখনো কখনো অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। তাই এই লক্ষণগুলো অবহেলা না করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। সকাল দশটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত সূর্যরশ্মি সবচেয়ে প্রখর থাকে। এই সময় বাইরে যাওয়া একান্ত প্রয়োজন হলে অবশ্যই মাথা ঢেকে বের হতে হবে। ছাতা ক্যাপ সানগ্লাস ব্যবহার এবং হালকা রঙের ঢিলেঢালা জামাকাপড় পরা খুবই জরুরি। বাইরে থেকে ফিরে ঠান্ডা পানি দিয়ে মুখ ধোয়া অথবা গোসল করে শরীরকে ঠান্ডা রাখা উচিত। প্রতিদিন কমপক্ষে দুই থেকে তিন লিটার পানি পান করতে হবে। শুধু পানি নয় ফলের রস ডাবের পানি ও ঘরের তৈরি শরবতও হতে পারে জীবনরক্ষাকারী উপাদান। গরমে বাইরের খাবার থেকে দূরে থাকতে হবে। বাসি বা ফাস্টফুডজাতীয় খাবার পেটের সমস্যা তৈরি করে এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমিয়ে দেয়। তাই বাসায় রান্না করা সহজপাচ্য ও পুষ্টিকর খাবারই বেছে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। দিনে একাধিকবার হাত মুখ ধোয়া, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, ঘরের জানালা খোলা রাখা যেন বাতাস চলাচল করতে পারে- এসব ছোট ছোট কাজই বড় বিপদ থেকে বাঁচাতে পারে। শিশু ও বৃদ্ধদের দিকে রাখতে হবে বাড়তি নজর। তাদের পানির চাহিদা পূরণ করা এবং নিয়মিত শরীরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা খুব জরুরি। একই সঙ্গে গৃহকর্মী রিকশাচালক শ্রমজীবী মানুষদের প্রতিও আমাদের দায়িত্ব রয়েছে। তাদের যদি পর্যাপ্ত পানি বিশ্রাম বা ছায়াযুক্ত পরিবেশ না থাকে তবে তারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। এই মানুষগুলোর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া সমাজের সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের সকলের কর্তব্য। আমরা অনেক সময় ঠান্ডা পানীয় বরফমিশ্রিত জুস কিংবা আইসক্রিমের প্রতি আগ্রহ দেখাই। ভাবি এগুলোই গরম থেকে মুক্তি দেবে। অথচ বাস্তবে এসব খাবার শরীরকে সাময়িক আরাম দিলেও অভ্যন্তরীণ ভারসাম্যে ব্যাঘাত ঘটায়। তাই বেছে নিতে হবে স্বাস্থ্যকর ও স্বাভাবিক উপায়। হিটস্ট্রোক প্রতিরোধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নিজেকে সচেতন রাখা এবং সেই সচেতনতার আলো চারপাশে ছড়িয়ে দেওয়া। পরিবার সমাজ এবং রাষ্ট্রের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ই এ ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলা করা সম্ভব। এই গ্রীষ্মে ভয় নয়, চাই উত্তপ্ত পরিস্থিতি মোকাবেলায় যথাযথ প্রস্তুতি। সচেতনতাই হোক আত্মরক্ষার শক্তি। একটু যত্ন ও বাড়তি সতর্কতা হয়তো পারে অনেকের জীবন রক্ষা করতে, তাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করতে। আসুন আমরা সকলে হিটস্ট্রোক প্রতিরোধে সচেতন হই নিরাপদ থাকি এবং অন্যকেও নিরাপদ রাখি।

ভূমিকম্পের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি ও প্রস্তুতি

ভূমিকম্পের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি ও প্রস্তুতি

গত ২৮ মার্চ, ২০২৫ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মিয়ানমারে একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে, যার ফলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ এবং প্রাণহানি ঘটে। রিখটার স্কেলে ৭.৭ মাত্রার এই ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল মিয়ানমারের মান্দালয় অঞ্চল। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ভারত, লাওস, কম্বোডিয়া এমনকি বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোতেও কম্পন অনুভূত হয়েছিল। চট্টগ্রামে নিজেই অনুভব করেছি। তখন চেয়ারে বসা অবস্থায় টের পেয়েছিলাম। মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে আঘাত হানা শক্তিশালী এই ভূমিকম্পে মিয়ানমারের মধ্যে মৃতের সংখ্যা ৩০০০ ছাড়িয়েছে, থাইল্যান্ডেও বহু হতাহত হয়েছে। এ ছাড়া আহত হয়েছেন আরও অন্তত কয়েক হাজার। আমাদের এই বাংলা অঞ্চলে ১৯১৮ সালে ৭.৬ মাত্রার ভূমিকম্পের আঘাত ঘটেছিল সিলেটের শ্রীমঙ্গলে। ভৌগোলিক অবস্থানের বিবেচনায় ভূমিকম্পের জন্য সংবেদনশীল এই অঞ্চলে দীর্ঘকাল ধরে  ভূমিকম্প না ঘটায় এবং পার্শবর্তী দেশ মিয়ানমারের এই সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের পর বাংলাদেশ বর্তমানে ভূমিকম্পের চরম ঝুঁকিতে রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞ মহলের ধারণা। এমতাবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে এসেছে- ভূমিকম্পের ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কি পরবর্তীতে ৭ এর অধিক মাত্রার ভূমিকম্পের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত? অতীত দুর্যোগ থেকে বাংলাদেশ কি কোনো শিক্ষা নেয়? পরিত্রাণেরই বা কী উপায়?

বিমান: অযোগ্যতা দায়িত্বহীনতা

বিমান: অযোগ্যতা দায়িত্বহীনতা

কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশ বিমানের একটি ড্যাশ ৮-৪০০ মডেলের উড়োজাহাজ নারী-শিশুসহ মোট ৭১ জন যাত্রী নিয়ে আকাশে উড্ডয়নের পরপরই একটি চাকা খুলে পড়ে যায়। অবশ্য তেমন বড় কোনো দুর্ঘটনা হয়নি। পাইলট ও কো-পাইলটের দক্ষতায় বিমানটি শেষ পর্যন্ত ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করতে সক্ষম হয়। ফলে বেঁচে যান যাত্রীরা। এই ঘটনায় বিমানের ফেসবুক পেজে চালকদের প্রশংসা করা হলেও অনেকেই মন্তব্য করেছেন, এটি যান্ত্রিক ত্রুটি নয়, বরং বিমান কর্তৃপক্ষের চূড়ান্ত অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার নিদর্শন। যা বাংলাদেশ বিমানের ক্ষেত্রে আগেও ঘটেছে বহুবার। ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের হ্যাঙ্গারে দণ্ডায়মান অবস্থায় একাধিক বিমানের পারস্পরিক সংঘর্ষ, বিমানের রানওয়েতে অজ্ঞাত বস্তুর পড়ে থাকা যা বিমানের খুলে যাওয়া অংশ বলে প্রতীয়মান হয়েছে, ভিআইপি যাত্রী নিয়ে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে বিমানের ত্রুটি, পাইলট নিয়োগে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ অযোগ্য বিমানচালক নিয়োগ, সর্বোপরি অব্যাহত লোকসান- এ সবই বারবার ঘটেছে বাংলাদেশ বিমানে। বিমানের সেই অদক্ষতা ও অপকর্মের নিদর্শন অদ্যাবধি চলমান। আরও যা দুঃখজনক তা হলো, কয়েকমাস আগে বাংলাদেশ বিমানের প্রকৌশলীদের চাকরির বয়সসীমা ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। ফলে যেখানে তাদের বিমানের রক্ষণাবেক্ষণে আরও দক্ষতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে করার কথা, উল্টো তাদের চরম ব্যর্থতার কারণে আকাশ থেকে খুলে পড়েছে বিমানের চাকা। বারবার এ ধরনের ঘটনা বিমানের ভাবমূর্তিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ৫ আগস্টের পর দেশের অনেক ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ এবং দৃশ্যমান অগ্রগতি পরিলক্ষিত হলেও বাংলাদেশ বিমানের ক্ষেত্রে ঘাটতি নিরসনের আদৌ কোনো লক্ষণ দেখা যায় না বললেই চলে। ইতোপূর্বে ‘আকাশে শান্তির নীড়’ বার্তাবহ বাংলাদেশ বিমানকে একটি অথর্ব প্রতিষ্ঠান বলে মন্তব্য করেছেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ। সম্প্রতি আগারগাঁওয়ে এনইসি সম্মেলন কক্ষে অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ বিষয়ক টাস্কফোর্স কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে তিনি একথা বলেন। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ বিমান পুনর্গঠন নিয়ে উত্থাপিত প্রস্তাবে বলা হয়েছে, প্রয়োজনে একটি নতুন এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করা যেতে পারে। নতুন এয়ারলাইন্সটির সম্ভাব্য নাম হতে পারে ‘বাংলাদেশ এয়ারওয়েজ’। এটি পরিচালনা করা হবে একটি স্বাধীন বিশ্বমানের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ গঠনের মাধ্যমে। এর জন্য প্রয়োজনে বিদেশ থেকে কোনো পেশাদার বিশেষজ্ঞ ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ করা যেতে পারে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সেবার মান অর্জন ও বাজার ধরে রাখতে ব্যর্থ হলে সংস্থাটি বাজার থেকে অপসারণের পরিকল্পনাও রয়েছে। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, বিমানকে সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে লাভজনক করে তোলার মতো দক্ষ ও গতিশীল নেতৃত্বসহ ব্যবস্থাপনা বর্তমানে বাংলাদেশ বিমানে প্রায় নেই। টিকিট বিক্রির টাকা লোপাট থেকে শুরু করে সেবার মান, বিমানবন্দরের নিরাপত্তা, পাইলটের অদক্ষতা ও দুর্নীতি প্রায় সবই ওপেন সিক্রেট। এ অবস্থায় খোল-নলচে পাল্টে ফেলতে হবে বিমানের। বর্তমানে বাংলাদেশ বিমানে উড়োজাহাজের সংখ্যা ২১টি। এর মধ্যে তিনটি লিজকৃত। তবে বিমানের লাভ-লোকসান নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের। এর অবসান হওয়া জরুরি। এর পাশাপাশি বিমান এবং বিমানবন্দরের সার্বিক সেবার মান ও নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক।

নারীর ডাকে মৈত্রীযাত্রা

নারীর ডাকে মৈত্রীযাত্রা

শুক্রবার তপ্ত দুপুরে ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউয়ে নারীসমাজের উদ্যোগে এক ব্যতিক্রমী সমাবেশ ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। নারীর অংশগ্রহণে এমন রঙিন, বৈচিত্র্যপূর্ণ ও বৃহৎ সমাবেশ বাংলাদেশে এর আগে খুব বেশি হয়নি। তবে এই আয়োজনে বহু পুরুষও যোগ দেন। ধর্ষণ, নিপীড়ন, অসমতা, অন্যায্যতা, পিতৃতন্ত্র, শ্রমের অবমূল্যায়ন, উগ্রবাদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত কণ্ঠে আওয়াজ তুলেছেন নারী-পুরুষ সবাই। ‘নারীর ডাকে মৈত্রীযাত্রা’ ব্যানারে স্লোগানে, গানে, পদযাত্রায় এ আওয়াজ ওঠে। ঘোষণাপত্রে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা ও বৈষম্য চালিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টাকে মেনে না নেওয়ার স্পষ্ট অবস্থানের কথা জানানো হয়। লড়াই অব্যাহত রাখার কথা জানিয়ে ঘোষণাপত্রে বলা হয়, ‘আমরা সরকার ও প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নারীবিষয়ক অবস্থানকে নজরদারিতে রাখব। যে ক্ষমতাকাঠামো জুলুমবাজি জিইয়ে রাখে, সেই কাঠামো ভাঙব। আমরা চুপ করব না, হুমকির মুখে নত হব না। অধিকার আদায়ের দাবিতে অটল থাকব। ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশের স্বপ্ন ও তা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে হাল ছাড়ব না।’ বলা দরকার, সম্প্রতি নারী অধিকার সংক্রান্ত সংস্কার-উদ্যোগের অংশ হিসেবে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। এ কমিশন শ্রমজীবী নারী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নারী ও অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ নারীর জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে ৪৩৩টি  সুপারিশ পেশ করে। রিপোর্ট প্রকাশের পর থেকেই বিষয়টি নিয়ে নানা ধরনের অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। দেশবাসীর সামনে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভ্রান্ত ব্যাখ্যাও উপস্থাপন করা হচ্ছে। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, কমিশনের সদস্যদের নানাভাবে অসম্মান করা হচ্ছে। শুক্রবারের সমাবেশের নেপথ্যে এসব বাস্তবতাও কাজ করেছে।   নারীসমাজ ঘোষণায় তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে বলেছে- ‘অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়েও নারীসহ অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অগ্রযাত্রায় নানান প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলেছে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। নারীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ক্ষেত্রেও তারা বাধা তৈরি করছে। ব্যক্তিগত আক্রমণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধা এবং অনলাইনে হয়রানি করে রাজনৈতিক পরিসরে নারীর অংশগ্রহণ নিরুৎসাহিত করার তৎপরতা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। বিভিন্ন স্থানে অতর্কিত হামলা, আন্দোলনে বাধা, পরিকল্পিত মব-আক্রমণ, মোরাল পুলিশিং, যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, প্রকাশ্যে মারধর এবং নানা ধরনের হুমকি প্রদান অব্যাহত রয়েছে।’ ‘নারীর ডাকে মৈত্রীযাত্রা’ আয়োজনের আগে এবং পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে বিরূপ মন্তব্য ও কটাক্ষ করা হচ্ছে। এসব থেকে সমাজে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নারীসমাজকে বঞ্চনা, বৈষম্য ও বিভেদের বেড়াজালে আটকে রেখে সমাজ কিছুতেই সামনের দিকে এগোতে পারবে না। সমাজের সুস্থতার জন্যই নারী-পুরুষের সমতা, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য জরুরি। ধর্মের দোহাই তুলে, নারীর অধিকার হরণ করে, নারীকে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করে দেশের সার্বিক উন্নতি সম্ভব নয়। এমন সমাজই প্রত্যাশিত যেখানে নারীর সম্মান ও নিরাপত্তা সমুন্নত থাকবে। আজকের দিনে নিজ অধিকার আদায়ের জন্য নারীর পথে নামা গোটা সমাজের জন্যই লজ্জার।

ইতিহাসে জাদুঘরের গুরুত্ব

ইতিহাসে জাদুঘরের গুরুত্ব

জাদুঘর আমাদের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের এক নমুনা সংগ্রহশালা। দেশের ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক, নৃ-তাত্ত্বিক, ভূতাত্ত্বিক শিল্পকলা, প্রাকৃতিক ও প্রাণিবিষয়ক নমুনা সংগ্রহ, সংরক্ষণ প্রদর্শন ও গবেষণার উদ্দেশ্যে জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮ মে আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস। ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব মিউজিয়াম (আইকম) ১৯৭৭ সালে মস্কোয় অনুষ্ঠিত ১২তম সাধারণ সভায় প্রতি বছর ১৮ মে বিশ্ব জাদুঘর দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯৭৮ সালের ১৮ মে প্রথমবারের মতো বিশ্ব জাদুঘর দিবস পালিত হয়। বিশ্বের অন্য দেশের মতো বাংলাদেশে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করা হয়। বিশ্বের প্রথম জাদুঘর স্থাপিত হয় কায়রো-মিশরে। দ্বিতীয় শতাব্দীতে মিসরে টলেমি শাসনামলে আলেকজান্দ্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। এশিয়া মহাদেশে জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭৮৪ সালের ১৫ জানুয়ারি এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। ব্রিটিশদের মাধ্যমে উপমহাদেশে জাদুঘরের ধারণা তৈরি হয়। ভারতীয় এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্যরা জাদুঘর প্রসারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এশিয়াটিক সোসাইটি পৃষ্ঠপোষক লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস কলকাতার পার্কস্ট্রিটে জাদুঘর নির্মাণের জন্য জমির ব্যবস্থা করে দেন এবং ১৮০৮ সালে ভবন নির্মাণের কাজ শেষ হয়। উপমহাদেশের প্রথম জাদুঘর ‘এশিয়াটিক সোসাইটিক মিউজিয়াম’ ১৮১৪ সালে প্রতিষ্ঠি হয়। ১৮৫৬ সালের ১ নভেম্বর ‘দি ঢাকা নিউজ’ পত্রিকায় প্রথম ঢাকায় একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে সংবাদ প্রকাশিত হয়। তবে ১৯ শতকে জাদুঘর প্রতিষ্ঠার বিষয়ে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ অপ্রত্যাশিতভাবে ঢাকায় জাদুঘর প্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি করে। তবে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রহিত হওয়ায় সরকারি উদ্যোগে জাদুঘর স্থাপনের প্রচেষ্টা থেমে যায়। কিন্তু ঢাকার বিশিষ্ট নাগরিকরা জাদুঘর প্রতিষ্ঠার জন্য সোচ্চার হন। ১৯১২ সালের ২৫ জুলাই বাংলার তৎকালীন গভর্নর লর্ড কারমাইকেল ঢাকায় আগমন উপলক্ষে নর্থব্রুক হলে তাকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এই অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট নাগরিকরা ঢাকায় একটি জাদুঘর স্থাপনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ২ হাজার রুপি মঞ্জুর করেন। ১৯১৩ সালের ৫ মার্চ জাদুঘর স্থাপনের সরকারি অনুমোদনের গেজেট প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালের ২০ মার্চ তৎকালীন সচিবালয়ে (বর্তমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল) একটি কক্ষে জাদুঘরের নিদর্শন সংরক্ষণের কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯১৩ সালের ৭ আগস্ট লর্ড কারমাইকেল ঢাকা জাদুঘরের উদ্বোধন করেন। ১৯১৪ সালের ৬ জুলাই নলিনীকান্ত ভট্টশালীকে জাদুঘরের কিউরেটর নিযুক্ত করা হয়। ১৯১৪ সালের ২৫ আগস্ট সর্বসাধারণের জন্য জাদুঘর খুলে দেওয়া হয়। জাদুঘরের নিদর্শন সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকলে স্থান সংকুলান না হওয়ায় ১৯১৫ সালের জুলাই মাসে ঢাকার নায়েব নাজিমদের বারোদুয়ারি ভবন নিমতলীতে জাদুঘরটি সরিয়ে নেওয়া হয়। ১৯৮৩ সালের ১৭ নভেম্বর শাহবাগ জাদুঘরের নিজস্ব আধুনিক ভবনে স্থানান্তরিত করা হয়। শাহাবাগে ৮.৬৩ একর জমির ওপর একটি চারতলা আধুনিক ভবনে বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘর অবস্থিত। এই জাদুঘরে ৪৪টি প্রদর্শনী কক্ষ, ৩টি অডিটোরিয়াম, ১টি গ্রন্থাগার ও ২টি অস্থায়ী প্রদর্শনী কক্ষ রয়েছে। জাদুঘরে সংগৃহীত নিদর্শন রয়েছে ৮৫ হাজারের বেশি। বাংলাদেশের প্রথম জাদুঘর বরেন্দ্র জাদুঘর ১৯১০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বরেন্দ্র জাদুঘরে প্রায় ৯ হাজার পূরাকীর্তি রয়েছে। রাজধানী ঢাকা শহর, বিভাগীয় শহর, জেলা শহর ও উপজেলায় জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে জাদুঘরের সংখ্যা শতাধিক। আমাদের দেশেও বিভিন্ন ক্যাটাগরির জাদুঘর রয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর (ঢাকা), মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর (ঢাকা), স্বাধীনতা জাদুঘর (ঢাকা), আহসান মঞ্জিল জাদুঘর (ঢাকা), বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা জাদুঘর (ঢাকা), সামরিক জাদুঘর (ঢাকা), প্রাণী জাদুঘর (ঢাকা) দিয়াশলাই জাদুঘর (ঢাকা), বরেন্দ্র জাদুঘর (রাজশাহী), জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর (চট্টগ্রাম), পানি জাদুঘর (কুয়াকাটা), পাথর জাদুঘর (পঞ্চগড়), নৌকা জাদুঘর (লৌহজং) ইত্যাদি। ভিন্ন ভিন্ন নিদর্শন সংরক্ষণে জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হলেও এসব জাদুঘরের লক্ষ্য অভিন্ন। অতিত ও বর্তমানের সেতুবন্ধ হচ্ছে জাদুঘর। জাদুঘর দেশের গৌরবময় ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে। নিদর্শনভিত্তিক গবেষণা ও শিক্ষা বিস্তারের জাদুঘর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটি দেশের হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতার সঙ্গে সেই দেশের পরিচয় তুলে ধরে জাদুঘর। দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য জানার জন্য জাদুঘর পরিদর্শন করতে হবে। বাংলাদেশ একটি সু-প্রাচীন সভ্যতার দেশ। আমাদের রয়েছে গৌরবদ্বীপ্ত ইতিহাস। পর্যটকরা জাদুঘর পরিদর্শনে আকৃষ্ট হচ্ছে। প্রতিদিন প্রায় ৫ হাজার দর্শনার্থী বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর পরিদর্শন করছেন। দেশের পর্যটনশিল্পকে সমৃদ্ধ করতে জাদুঘর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

বৃষ্টিতে স্বস্তি ও দুর্ভোগ

বৃষ্টিতে স্বস্তি ও দুর্ভোগ

বর্ষাকাল আসে এক বিশেষ রকম আবহ নিয়ে। গরমের ক্লান্তি দূর করে, পরিবেশ ঠান্ডা করে, প্রকৃতিকে সুন্দর করে তোলে। আমাদের দেশে গরম পড়লে মানুষ হাঁসফাঁস করে। রোদে ঘাম ঝরে, রাস্তা গরম হয়ে যায়, আর পানি খাওয়ার তৃষ্ণা বাড়ে। তখন সবাই অপেক্ষা করে একটু বৃষ্টির জন্য। কারণ বৃষ্টি হলে গরম কিছুটা কমে আসে, হাওয়া ঠান্ডা হয়, পরিবেশটা একটু আরামদায়ক লাগে। তাই বৃষ্টি এলে অনেকেই স্বস্তি পান, ভালো লাগে। বৃষ্টির সময় কিছু অনুভব একদম আলাদা। অনেকেই বৃষ্টির দিনে জানালার পাশে বসে চা খেতে ভালোবাসেন। শিশুরা কদম ফুল হাতে নেয়, কেউ ভিজে খেলে, কেউ ছাতা মাথায় দিয়ে ঘোরে। স্কুল ছুটি হয়ে গেলে একসাথে হেঁটে বাড়ি ফেরা—এগুলো বর্ষার সঙ্গেই জড়িয়ে আছে।

সম্ভাবনার আকাশে উড়ুক তারা

সম্ভাবনার আকাশে উড়ুক তারা

মানব জীবন এক বিশাল ক্যানভাস, যেখানে প্রতিটি ব্যক্তি একেকটি স্বতন্ত্র রঙের রেখা। কেউ ঝলমলে রোদ, কেউ গভীর অরণ্যের সবুজ, কেউবা নদীর বয়ে চলা স্রোত। কিন্তু কিছু মানুষ আছে, যাদের সমাজ দুর্বল বলে চিহ্নিত করেছে, যাদের চারপাশে গড়ে তোলা হয়েছে অবহেলার এক অদৃশ্য দেয়াল। তারা প্রতিবন্ধী নামের সেই সূর্য সন্তান, যাদের চোখে অনন্ত স্বপ্ন। অথচ সমাজের বৈষম্যের কুয়াশায় সেই স্বপ্নগুলো অস্পষ্ট হয়ে যায়। প্রতিবন্ধী মানে কি অপূর্ণতা? নাকি এটা শুধু এক সামাজিক নির্মাণ, যেখানে কিছু মানুষকে ‘অক্ষম’ বলে চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে? প্রকৃতপক্ষে, প্রতিবন্ধী মানে শক্তির এক নতুন সংজ্ঞা। তাদের হয়তো হাত নেই, কিন্তু মন আছে সৃষ্টির অনিঃশেষ সম্ভাবনায় ভরপুর। তাদের হয়তো চোখ নেই কিন্তু হৃদয়ের গভীরে অনুভূতির এক মহাসমুদ্র আছে। তাদের হয়তো শ্রবণশক্তি নেই কিন্তু তারা পৃথিবীর শব্দ অনুভব করে স্পন্দনে, আত্মার উষ্ণতায়।

মানবিক বিশ্ব গড়তে চাই বৈশ্বিক শৃঙ্খলা

মানবিক বিশ্ব গড়তে চাই বৈশ্বিক শৃঙ্খলা

বিশ্ব যেন ক্রমশ আমানবিক হয়ে উঠছে। কথাটি এভাবে বললে যথার্থ হয় যে, বিশ্বে বসবাসরত কথিত শ্রেষ্ঠ প্রাণী মানুষ দিনে দিনে প্রায় অমানুষে পরিণত হচ্ছে। কোথাও কোনো শৃঙ্খলা নেই। আইনের শাসন ব্যবস্থা অনেকটা ধ্বংসপ্রাপ্ত। গোটা বিশ্ব ভয়ংকর অস্থির সময় অতিক্রম করছে। বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রই ন্যায়বিচার ও নিয়মনীতি মেনে চলার সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে এসেছে। মানুষই মানুষের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন চালাচ্ছে। যে যেভাবে পারছে বল প্রয়োগ করে স্বার্থ হাসিল করছে। গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে আমরা হাপিতেশ করছি। কিন্তু গণতন্ত্র কি সেটা না বুঝেও গণতন্ত্রের বুলি আওড়াচ্ছি। আসল সমাধান কী তা চিহ্নিত করার কোনো চেষ্টাই করা হচ্ছে না বলে মনে হয়। বস্তুত মানুষের জীবনটাই যজ্ঞ। মহৎ কর্মযজ্ঞ দিয়ে সমস্ত জীবনটাই কল্যাণের জন্য দান করার মধ্য দিয়েই সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যায়। বিশ্বের রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে প্রায় সকল মানুষই যাজ্ঞিক ভাবনা থেকে দূরে সরে এসেছে। মানুষ রাজনীতিতে যে কাজ করে তা মূলত কর্মযজ্ঞই। বর্তমানে রাজনীতি যাজ্ঞিক চরিত্র হারিয়ে ফেলেছে। এখন রাজনীতিক ক্ষেত্রে দেখা যায় একমাত্র ক্ষমতা দখলই রাজনীতির কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে জন্য এত অশান্তি এত অরাজকতা। সাধারণ মানুষকে স্বাধিকার সম্বন্ধে সচেতন করে তোলার কাজ রাজনীতিতে নেই বললেই চলে। রাজনীতির মূল কাজ হলো কোটি কোটি দেশবাসীকে শিক্ষা দিয়ে সচেতন করে তোলা যে- সে এক মহান গণতান্ত্রিক দেশের সম্মানিত নাগরিক। একটা দেশের সরকার শুধু নাগরিকদের কল্যাণের জন্যই কাজ করবে। সরকারকে নাগরিকদের মতামতের ওপরই নির্ভর করতে হবে। জনগণের কাছ থেকেই সরকার শক্তি অর্জন করবে। গণতান্ত্রিক রাজনীতির উদ্দেশ্যই হবে জনগণের মর্যাদা বৃদ্ধি করা। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, রাজনীতিকগণ কেবল ক্ষমতা দখলের সন্ধানেই ব্যস্ত থাকে। ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতা ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে দলগত পর্যায়ে বিস্তৃত। মনে রাখা দরকার যে, জীবন থেকে যজ্ঞভাবনা সরিয়ে নিলে জীবন হয়ে পড়ে নিম্নমানের। এতে মানব জাতির জীবনযাত্রা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জীবনের যজ্ঞভাবনার সামান্য কিছুও যদি প্রভাবিত হয় তবে সব কিছুই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। শাসন ব্যবস্থা এক যজ্ঞ, শিক্ষা ব্যবস্থাও যজ্ঞ- এ ভাবনা থেকে সরে এলেই বিশ্ব বিশৃঙ্খলার পতিত হয়। যেটি বর্তমানে লক্ষণীয়। সাম্প্রতিক বিশ্ব প্রায় সব রাষ্ট্রের শাসকই চরম ক্ষমতার লোভে পড়ে গেছে। এই লোভ আগেও ছিল, তবে তার প্রকৃতিটা বদলে গেছে। জার্মান ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক তাত্ত্বিকে হ্যান্স মরগেনথুর মতে, ‘প্রায় সব রাষ্ট্রই একটা সময় লোভে পড়ে যায়। যেখানে তারা নিজেদের স্বার্থকে নৈতিকতার দোহাই দিয়ে ঢেকে রাখে।’ বর্তমান বিশ্ব তার কথার বাস্তব প্রতিফলন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সভ্যতার ক্রমবিকাশের এক পর্যায়ে আন্তর্জাতিক বিধিবিধানকে সব শাসকই গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করতো। মানবাধিকার রক্ষাসহ সব সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হতো। আইনের শাসনের প্রতি ছিল শ্রদ্ধাশীল। এই সংস্কৃতি থেকে যেন সব রাষ্ট্রই সরে এসেছে। বিশ্ব এখন আর আইনের শাসন মেনে চলতে পারছে না। কোনো কোনো রাষ্ট্রের কোনো কোনো রাজনীতিকগণ দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের জিগির তোলে জনগণের সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করে। এসবের আড়ালে পরস্পরে হিংসা ও বিদ্বেষ লালন করে আসছে। সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা, রেষারেষি সেই সঙ্গে জাতিগত বিদ্বেষকে উস্কে দিয়ে রাজনীতির মাঠকে গরম রাখার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে ধর্মের দোহাই দিয়ে। কোনো কোনো গোষ্ঠী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে রাষ্ট্রযন্ত্র দখল করে ভিন্নমতাদর্শের ওপর ক্রমাগত আঘাত করে চলেছে। ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতিতে বিশ্ব রাজনীতি এক ভয়ংকর বিশৃঙ্খলা ভেতর দিয়ে গতিময়তা লাভ করছে। কোনো কোনো অঞ্চলে যুদ্ধ চলছে। আবার কোথাও কোথাও যুদ্ধের দামামা বেজে উঠছে। পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকিও অনেকটা স্বাভাবিকতা লাভ করেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয় ২০২২ সালে। ইউক্রেনের চেয়ে অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি শক্তিশালী রাষ্ট্র রাশিয়া যখন ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালায় তখন মনে হয়েছিল খুব সহজে ইউক্রেন পরাস্ত হবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। পৃথিবীর শক্তিধর রাষ্ট্র অর্থাৎ বিশ্বের একক পরাশক্তির দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় ইউক্রেন এখনো যুদ্ধে টিকে আছে। যদিও ব্যাপক ক্ষতি ও ইউক্রেনের অনেক ভূমি রাশিয়ার দখলে চলে গেছে। যুদ্ধে ব্যাপকভাবে নিরীহ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। মাঝেমধ্যে যুদ্ধ বিরতি ঘটে, কিন্তু যুদ্ধ চলমান। মধ্যপ্রাচ্যও অশান্তির আগুনে জর্জরিত। গাজা যুদ্ধের ভয়াবহতা বিশ্ববাসীকে বিস্মিত করেছে। গাজা ও সিরিয়াতে ইসরাইলের আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে। লেবাননে হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীর সঙ্গেও বড় ধরনের সংঘর্ষের শঙ্কা বিরাজ করছে। এদিকে দক্ষিণ এশিয়াতেও যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। গত ২২ এপ্রিল ২০২৫ ভারতের ভূ-স্বর্গখ্যাত রাজ্য জম্মু কাশ্মীরের পেহেলগাও অঞ্চলে জঙ্গি হামলায় ২৬ জন পর্যটক প্রাণ হারায়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তান পরস্পরের সামরিক অভিযানের হুমকি প্রদর্শন করছে। ভারতের দাবি, এই হামলার জন্যে পাকিস্তান দায়ী। বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চলমান। উত্তর কোরিয়াও জাপানে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করার হুমকি দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে জাপানের নিরাপত্তা ও মানসিক স্থিতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। বিশ্বের পারস্পরিক দেশের মধ্যে অনেক ছোট ছোট বিষয়ে বিরোধ রয়েছে, যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যায়। কিন্তু সে দিকে কেউ নজর না দিয়ে শক্তি প্রদর্শনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো দীর্ঘ সময় যুদ্ধ সংস্কৃতি পরিহার করে চলেছে। এসব শক্তিশালী দেশ সরাসরি যুদ্ধে জড়াতো না। এরা মধ্যস্ততাকারী গোষ্ঠী বা জোট তৈরি করতো। কিংবা নেপথ্যে যুদ্ধ পরিচালনা করতো। বর্তমানে সে কৌশল বদলে গেছে। এখন বড় শক্তিধর দেশগুলো নিজেরাই সরাসরি সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ক এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে চীন যার বন্ধু, সে বন্ধুরাষ্ট্র আমেরিকার শত্রুতে পরিণত হচ্ছে। আবার আমেরিকার ঘনিষ্ঠ দেশ চীনের বৈরী রাষ্ট্র হিসেবে বিকশিত হচ্ছে। ক্রমাগত পরিবর্তন হচ্ছে রাজনীতির সমীকরণ। বর্তমান বিশ্বয়নের যুগে ভূরাজনীতিকে সকলেই গুরুত্ব দিচ্ছে। সমুদ্রকেন্দ্রিক অর্থনীতিকে জোরদার করতে সমুদ্র জবর দখলের প্রতিযোগিতা চলছে। প্রয়োজনে সামরিক শক্তিতে কাজে লাগাতে কৌশলী হচ্ছে। দক্ষিণ চীন সাগরকে ঘিরে যে সব ঘটনা ঘটছে তা খুবই উত্তেজনাপূর্ণ। আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা কাঠামো অনেকটাই ভেঙে পড়েছে। রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসন তার প্রমাণ। পৃথিবী এখন টালমাটাল অবস্থায় উপনীত। মানবতা বলতে কিছু নেই। মনুষ্যত্ব বিকাশের পথ রুদ্ধ। আমার মনে হয় জবরদস্তিমূলক মধ্যযুগীয় শক্তির মহড়ায় লিপ্ত হয়ে পড়েছি। বিশ্ব রাজনীতিও গতিপথ বদল করে ফেলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যেমন প্রকৃতি নষ্ট হচ্ছে, নদীর স্বচ্ছ পানি গন্ধযুক্ত নর্দমার পানিতে পরিণত হয়েছে, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে গেছে। তেমনি রাজনীতিও গন্ধযুক্ত হয়ে পড়েছে। বিশ্ব রাজনীতি এখন আর সূক্ষ্ম কূটনৈতিক কৌশলের ওপর নির্ভরশীল নয়। কূটনীতিকরাও নিজ দেশ ও জনগণের স্বার্থের পরিবর্তে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের কৌশল অবলম্বন করে দায়িত্ব পালন করছেন। যে কারণে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে বৈরিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে দেশে কূটনীতিকগণ জেনেভা কনভেনশনের শর্তগুলোরও ধার ধারছে না। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনকে উপেক্ষা করে শ্রেণীস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ চরিতার্থ করার প্রতিযোগিতা করছে। বিশ্বের মানুষ পরমাণু যুদ্ধের ঝুঁকিতে পড়েছে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির পর মানব জাতির মধ্যে একটা পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়েছিল। এই যুদ্ধ মানব মনকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়েছিল। মানব হৃদয়ে এক নতুন প্রজ্ঞা সঞ্চারিত হয়েছিল। বিশ^ মানবীয় ‘সচেতনতার, ক্রমবিকাশ সূচিত হয়েছিল। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সংস্থাগুলো বিশ্বমানবীয় সচেতনতার ভাবকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল। কিন্তু সেই মানবিক ভাব ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে গেল। জাতিপুঞ্জের সংস্থাগুলোও তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলল। জাতিসংঘের দোহাই দিয়েই বিশ্বে যত অপকর্ম হচ্ছে। ঐ বিশ্ব সংস্থাটিও কার্যত অর্থহীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বৈশ্বিক বিশৃঙ্খলা রাষ্ট্র সমাজ তথা শাসনব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এই বিশৃঙ্খলা এড়াতে দরকার কাজ, ভালো কাজ। সমাজে কিছু ব্যস্তবাগিশ আছে, যারা কেবল এখানে ওখানে কেবল কিছু অনুষ্ঠানে ব্যস্ত থাকে। তাদের কাজের মাত্রা খুবই সীমিত। তারা নাম চায়, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি এবং গুরুত্বপূর্ণ আধিকারিকদের সঙ্গে চায় ছবি তুলতে। কিন্তু লোক কল্যাণে তাদের কোনো ভূমিকা নেই। আধুনিক, প্রগতিশীল নর-নারী লোক কল্যাণমূলক কাজকেই ধর্মীয় কাজ হিসেবে বিশ্বাস করে। কিন্তু প্রগতিশীল আধুনিক নর-নারীর এই মহৎ কাজে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে কিছু ধর্মান্ধ তর্কবাগিশ। লোক কল্যাণের চেয়ে ঘুরে বেরিয়ে বক্তব্য প্রদানই এদের মূল কাজ। এ ধরনের লোক সমাজ জীবনে, প্রতিষ্ঠানে, রাজনীতিক দলে সর্বত্রই রয়েছে। কর্মজীবী মানুষ যৌথভাবে মানব কল্যাণমূলক কাজে অংশ গ্রহণ করলে বিশৃঙ্খলার সুযোগ থাকবে না। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় মানুষে মানুষে ভেদাভেদ সৃষ্টি হয়েছে। কিছু মানুষ অন্য কিছু মানুষকে ঘৃণা করে, হিংসা করে। রাষ্ট্রশক্তি এসবকে প্রশ্রয় দিয়ে সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরিতে মত্ত থাকে। ফলে রাষ্ট্র আইনের শাসনের ক্ষেত্রে দুর্বল হয়ে পড়ে। একটা সময় শাসন ব্যবস্থাই ভেঙে যায়। শাসকগোষ্ঠী এই ভেদনীতিকে পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধার শেষে জনগণকে বিপদে ফেলে চলে যায় অন্যত্র। রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি সর্বক্ষেত্রে মনুষ্যত্ব বিকাশে কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হবে। মানবিক বিশ্ব গড়ে তুলতে হলে গোটা বিশ্বের মানব জাতিকে একত্ব পরিহার করে বহুত্বে মনোনিবেশ করতে হবে। সেই সঙ্গে সেবা ও ত্যাগের মানসিকতায় জীবন পরিচালিত করতে হবে। রাজনীতিবিদ তথা রাষ্ট্রের শাসকদেরই আগে ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। তবেই মানবিক বিশ্ব গড়ে উঠবে।       লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক [email protected]

পণ্য বিপণনে ধর্মীয় সংস্কৃতি

পণ্য বিপণনে ধর্মীয় সংস্কৃতি

বর্তমান বিপণন ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয় শব্দের কিংবা ধর্মীয় নির্দেশনার ব্যবহার জনপ্রিয়তা পেলেও এর যথাযথ প্রয়োগ, সুবিধা-অসুবিধা, আইনগত বাধ্যবাধকতা, সাংস্কৃতিক চর্চার সঙ্গে বন্ধুত্ব কিংবা বিরোধ, প্রযুক্তির উৎকর্ষতা ও বিশ্বায়নের ক্ষেত্রে প্রায়োগিক জটিলতা, নীতি শাস্ত্রের কিংবা নীতি বিদ্যার সঙ্গে যুতসই কি-না? ভার্চুয়াল দুনিয়া ও ট্রেডিশনাল দুনিয়ায় এর ব্যবহারিক জটিলতা ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে যে আলোচনা সামনে আসে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার প্রতিপাদ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়- ‘হালাল’ ‘হারাম’ ‘নিষেধ’ ‘পাপ’ ইত্যাদি। প্রতিটি বস্তুর ভালো, সর্বজনীন গ্রহণীয় ও উপকারী বিষয়গুলো তুলে ধরার মাধ্যমে যেহেতু বাজারজাত করা হয় সেহেতু মুসলিমসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর মানুষের কাছে ‘হালাল’ ‘পাপ’ ‘হারাম’ ইত্যাদি শব্দগুলোর ব্যবহার গ্রহণীয়, বর্জনীয়, সম্মানীয় ও অতীব পবিত্র বলে বিবেচিত- এই ভাবনায় কোম্পানীগুলো তাদের পণ্য বাজারজাতকরণে উল্লিখিত শব্দগুলো ব্যবহার গ্রাহকদের সন্তুষ্টি কিংবা অসন্তুষ্টি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। সুতরাং বর্তমান সময়ে উল্লিখিত শব্দগুলো কেবল ধর্মীয় শব্দ নয়, মার্কেটিং অস্ত্রও বটে। বর্তমানে ‘হালাল’ বিষয়টাকে শুধু মৌখিক কিংবা কিতাবিক দুনিয়ায় সীমাবদ্ধ না রেখে কীভাবে বিশ্বায়ন করা যায় সেদিকে জোর দেওয়া হচ্ছে। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য তৈরি করা হয়েছে ‘ইসলামিক ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন কাউন্সিল’, যা যুক্তরাজ্যে অবস্থিত। আই এস ও (ISO)  যেমন একটি সার্টিফিকেট প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান যার মাধ্যমে পণ্যের ওপর আস্থা আনা যায়, ঠিক তেমনি আই এফ এ এন সি এ (IFANCA- Islamic Food and Nutrition Council of America) একটি সার্টিফিকেট প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান- যা ‘হালাল’ শব্দটির প্রাতিষ্ঠানি গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করে। বিশ্বব্যাপী ‘হালাল’ সার্টিফাইড প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ছিল মাত্র ২৩টি। বর্তমানে সেটা ২০০০ এর ওপরে (বাকের আহমেদ আলসাবহান, ২০১০)। সুতরাং বিপনণ প্রল্ডিয়ায় ‘হালাল’ শব্দটি এখন বিশ্বজনীন যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ম্যাক ডোনাল্ড রেস্টুরেন্ট- সিংগাপুর, যা ‘হালাল’ সার্টিফিকেট অর্জন করার পর ২০% বেশি মুনাফা করে (চেং- ২০০৮)। ১৯৯৬ সালে ‘হালাল’ শব্দটি ব্যবহার করে এ্যারামেটিক সাবান ব্যাপক কনজিউমার সন্তুষ্টি অর্জন করতে সক্ষম হয়। পরবর্তী পর্যায়ে হালাল সাবানের সত্যতা প্রমাণের জন্য লিভার ব্রাদার্স (বর্তমানে ইউনিলিভার) কর্তৃক এ্যারোমেটিক সোপ ইন্ডাস্ট্রিজের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। বাংলাদেশের আদালত একটি জোরালো সাক্ষ্য প্রমাণের মাধ্যমে এ্যারোমেটিক্সের পক্ষে মামলাটি খারিজ করে দেয় (জোবাল ২০০৩)। বিপণন পলিসি, কাস্টমার বিশ্লেষণ, দক্ষ জনবল, লজিস্টিক সাপোর্ট ইত্যাদি কারণে এ্যারোমেটিক সাবান টেকসই না হলেও হালাল শব্দটির ব্যবহারিক প্রয়োগ কতটা শক্তিশালি তা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়। এরই ধারাবাহিকতা এবং বাস্তবতায় মাল্টিন্যাশলাল কোম্পানি যেমন- নেসলে, ইউনিলিভার, কে এফ সি, ম্যাক ডোনাল্ড ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানগুলো মুসলিম বিশ্বে হালাল শব্দটির নান্দনিক উপস্থিতি নিশ্চিত করার মাধ্যমে কাস্টমার গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে ব্যাপক সফলতা অর্জনে সক্ষম হয়। পি কে মুভি যারা দেখেছেন তারা নিশ্চয় ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়টি অনুভব করেছেন। একই আগারবাতী মসজিদ ও মন্দির উভয়স্থানে ব্যবহার হয়, কিন্তু মোড়ক ভিন্ন, নাম ভিন্ন। যেমন- মদিনা, বেলাল দরবার ইত্যাদি নাম ব্যবহার হয় মসজিদে ব্যবহৃত আগরবাতীতে। আর আনন্দ, কল্পনা, নমস্তে ইত্যাদি নাম ব্যবহার করা হয় মন্দিরে ব্যবহৃত আগর বাতিতে। বাংলাদেশে হার্ডওয়ার ব্যবসায়ীর একটা বড় অংশ সনাতন ধর্মাবলম্বী। তাই তাদের দোকানে ‘ওম’ নামধারী দাঁড়িপাল্লা ও ‘গণেশ’ নামধারী কোদাল বিল্ডয় করতে বেশি দেখা যায়। এমনি অনেক উদাহরণ আছে যার মাধ্যমে বলা যায় ধর্ম কেবল বিশ্বাস নয়, এটি একটি অনুভূতি ও আস্তার নামও বটে। আর এ অনুভূতি আজকের নয়, হাজার বছরের পুরানো। হোমার বলেছেন- দেবতাদের বিচ্যুতির পথে টেনে নামানো এমন কোনো শক্ত ব্যাপার নয়, মানুষ যদি কিছু পাপ করে থাকে আর দেবতা হয়ে থাকে ল্ডোধান্বিত তাহলে একটু প্রার্থনা, কিছু সুরার উপঢৌকন, আর ভাজা চর্বির লোভনীয় গন্ধ- এটাই হবে যথেষ্ট দেবতার সেই ল্ডোধকে প্রশমিত করতে। (প্লেটোর রিপাবলিক, সরদার বজলুল করিম, পৃষ্ঠা-৮৪) বিপণন ব্যবস্থাপনায় ‘পাপ’ কিংবা ‘হারাম’ শব্দ দুটি সতর্কতামূলক শব্দ। এগুলো যাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সেগুলোর বিপণনে অত্যন্ত সতর্ক অবস্থান গ্রহণ করতে হয়। যেমন- সনাতন ধর্ম অনুযায়ী গরু হলো- ‘পবিত্র প্রাণী’। সুতরাং গরুর মাংস খাওয়া পাপ। আবার ইসলাম ধর্মানুযায়ী পর্ক খাওয়া হারাম বা পাপ। সুতরাং গরুর মাংস, পর্ক এর মাংস, মদ- এগুলোর বিপনণ পলিসি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুভূতির দিকে খেয়াল রাখা খুবই জরুরি। এলকোহল সংবলিত খাদ্যপণ্য ইসলামী নীতিমালায় কিংবা বিশ্বাসে অনুমোদিত নয়। কিন্তু অধিকাংশ কফ সিরাপ এলকোহল ধারণ করে। সুতরাং ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো এগুলো হারবাল সিরাপ নামে বিপণন করে। আবার ‘ইসলামিক’, ‘শরীয়াহ মোতাবেক’, ‘পবিত্র’ ইত্যাদি শব্দগুলো বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টর ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। পরবর্তী পর্যায়ে এগুলোকে অনুসরণ করছে ইনসুরেন্স কোম্পানি, ঋণদানকারী ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে ও বিপণন ব্যবস্থাপনা যাদের টার্গেটেড কাস্টমার হলো মুসলিম সম্প্রদায়। কিন্তু এর যে ব্যতিল্ডম নেই তা নয়। যেমন- বর্তমানে দুবাইয়ে ইসলামিক হোটেলের ৬০% কাস্টমার হলো নন-মুসলিম। বলা হচ্ছে ধর্ম সংস্কৃতির অংশ। কোনো কোনো দেশের ধর্ম ও সংস্কৃতি প্রায়ই এক। যেমন- মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো বিশেষ করে সৌদি আরব, ইয়েমেন, কাতার ইত্যাদি, আবার বাংলাদেশে অধিকাংশ মানুষ মুসলমান। এদেশের সাংস্কৃতির সঙ্গে ধর্ম অনেক  ক্ষেত্রেই সাংঘর্ষিক, আবার অনেক ক্ষেত্রে সঙ্গতিপূর্ণ। যেমন- পহেলা বৈশাখ সংস্কৃতির অংশ হলেও সকল ধর্মের লোকজন  বেশ উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে এটা পালন করে এবং এর ব্যাপকতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুতরাং বিপণন ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয়নীতি যত কার্যকর, তার চেয়ে বেশি কার্যকর সাংস্কৃতিক উৎসব। তাই যে কোনো দেশে পণ্য ব্যবস্থাপণার ক্ষেত্রে ধর্মীয় মূল্যবোধের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ মাথায় রাখা খুবই জরুরি। ধর্মীয় সংবেদনশীলতার কথা চিন্তা করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বিজ্ঞাপন ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও সার্বিক বিবেচনায় গ্রহণীয় বিষয়াদির ওপর জোর দিয়ে থাকে। যেমন- কোকাকোলা মধ্যপ্রাচ্যে যে বিজ্ঞাপন চালায় সেখানে মডেলদের সেদেশীয় পোশাকেই দেখা যায় এবং একটি বিজ্ঞাপনের স্লোগান হলো- চেইঞ্জ হ্যাজ এ টেস্ট (Change has a taste)। আবার ইন্ডিয়ার কাস্টমার বিহেবিয়ারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিজ্ঞাপনে দেখানো হয়- একটার সঙ্গে একটা ফ্রি। এর একটি বিজ্ঞাপনের স্লোগান হলো- ‘Taste The Feeling’। ডিজিটাল মিডিয়ার বিস্তার ও প্রভাব ধর্মীয়ভাবে অনুভূতিশীল জনগোষ্ঠীকে যত প্রভাবিত করেছে তার চেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে ধর্মীয়ভাবে শ্রেণিবদ্ধ জনগোষ্ঠীকে। যেমন- বাংলাদেশে সকল ধর্মের লোকজনের সহঅবস্থান থাকলেও হিন্দু সম্প্রদায়, মুসলিম সম্প্রদায়, বৌদ্ধ সম্প্রদায় তাদের নিজ নিজ ধর্ম প্রচারের মাধ্যমে ও নিজেদের মধ্যে পণ্য বিনিময়ে বা বিপণনে অধিক বেশি তৎপর। যেমন- ঈদের সময় মুসলিম সম্প্রদায় বিশেষ ধরনের শুভেচ্ছা কার্ড (ডিজিটাল) বিনিময় করে। ঠিক তেমনি হিন্দু সম্প্রদায় ও বৌদ্ধ সম্প্রদায় উৎসব ও পার্বণে নিজস্ব ধর্মীয় ঐতিহ্যের প্রতীক ব্যবহার করে। এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ধর্ম ও বাণিজ্য সহঅবস্থান করছে। যেমন- থাইল্যান্ডে ব্যবসাবাণিজ্যে উন্নতি করার ক্ষেত্রে বৌদ্ধের মূর্তিকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সিঙ্গাপুরে হিন্দু ধর্মীয় লোকজনের ধর্মীয় অনুভূতির কথা চিন্তা করে একটি বড় ফুলের বাজার গড়ে উঠেছে। চায়নায় কুইংমিং ফ্যাস্টিভাল বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এখানে বলা হচ্ছে ‘যারা পাপ নিয়ে মারা যাবে তারা মৃত্যুর পর খেতে পারবে না, কিন্তু কুইংমিং উৎসবের দিন খেতে পারবে’। ধর্মীয় নীতি অপরিবর্তনীয়, বাজার ব্যবস্থাপনা পরিবর্তনশীল। সুতরাং স্থির ধারণার সঙ্গে পরিবর্তনশীল ধারণার সংযোজন ধর্মীয় মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক যাতে না হয়, সেজন্য ধর্মীয় বিভাজনও লক্ষ্য করা যায়। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ বাংলাদেশে বিভিন্ন ইসলামিক গোষ্ঠী। যেমন- তাবলিগ, জাকের পার্টি, খেলাফত আন্দোলন, মাজারকেন্দ্রিক ইসলাম ইত্যাদি। পবিত্র কুরআনে ‘হালাল’ খাদ্য গ্রহণের ব্যাপারে- ০৬টি (বাকারা, মায়িদাহ, আন-আম, আরাফ, নাহল ও হজ) সূরাতে বলা হয়েছে- যার মর্মার্থ একই, কিন্তু এর মূল ভাবার্থ বিশ্লেষণে বিভিন্ন গোষ্ঠী বিভিন্নভাবে বাণিজ্যিকীকরণ করে। সুতরাং রিলিজিয়ন মার্কেটিং মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর কাছে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ধর্মীয় ব্যবসায়ীদের নিকটও গুরুত্বপূর্ণ। আজকের বাজার ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয় শব্দ কিংবা বাক্যের উপস্থিতি গুগল, ফেসবুক বা টুইটারের মতো জনপ্রিয়তা না পেলেও এগুলো কিন্তু ধর্মীয় সুপার মার্কেটের কাজ করে। পৃথিবীতে অনেক মানুষ পাওয়া যাবে যারা ধর্মের প্রতি তেমন বিশ্বাস করে না, কিন্তু একটি মানুষও পাওয়া যাবে না যে টাকায় বিশ্বাস করে না। সুতরাং পরিবর্তনশীল বিপণন ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয় অনুভূতির প্রয়োগ গ্লোবাল মার্কেটিং এ যুতসই অবস্থান তৈরি করতে পারবে না; তবে বড় একটি মার্কেট শেয়ার নিতে পারবে। এহেন প্রেক্ষাপটে একটি পণ্য বিপণনের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, সে রিজিওনালি অবস্থান করবে না গ্লোবালি। ধর্মীয় বিপণন ব্যবস্থার রিজিওনালি অবস্থান আর্থিকভাবে যুতসই হলেও গ্লোবালি হবে দুর্বল, যা পরিশেষে অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। কোকাকোলাকে ঠেকাতে মার্কেটে আসে ‘মক্কা কোলা’, জমজম কোলা, কিবলা কোলা কিন্তু কোকা কোলার বিশ্বায়ন অবস্থান থাকলেও অন্যদের নেই। সুতরাং ধর্মীয় বিপণন ব্যবস্থাপনায় পণ্যের আঞ্চলিক অবস্থানকে বিশ্বায়ন করতে আগে প্রয়োজন ধর্মীয় শব্দ কিংবা ধর্মীয় নীতির বিশ্বায়ন। লেখক : বিপণন গবেষক

সমাজের অসহায় শিশুদের সুরক্ষা ও উন্নয়ন

সমাজের অসহায় শিশুদের সুরক্ষা ও উন্নয়ন

কোমলমতি শিশুদের চোখে সমাজ মানে একটি স্বপ্নময় জগৎ, যেখানে তারা ভালোবাসা, নিরাপত্তা ও আনন্দের আশায় বুক বাঁধে। কিন্তু বাস্তবতা অনেক সময় ভিন্ন। বিশেষ করে অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য সমাজ একটি কঠিন বাস্তবতার নাম, যেখানে তাদের শৈশব কষ্ট, বঞ্চনা ও নির্যাতনের ছায়ায় ঢাকা পড়ে। এই প্রবন্ধে আমরা অসহায় শিশুদের দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজের বাস্তবতা, তাদের সমস্যা, কারণ ও সমাধান নিয়ে আলোচনা করব। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে অসংখ্য শিশু তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপদ আশ্রয় ও পুষ্টিকর খাদ্য থেকে বঞ্চিত হয়ে জীবনের শুরুতেই সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে। বিশ্বে প্রায় ১৬ কোটি ৮০ লাখ শিশু শ্রমে নিয়োজিত, যার মধ্যে প্রায় অর্ধেক ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিযুক্ত। বাংলাদেশে ৫-১৪ বছর বয়সি শিশুশ্রমিকের সংখ্যা মোট শিশু জনসংখ্যার ১৯ শতাংশ, ছেলে শিশুদের হার ২১.৯ শতাংশ এবং মেয়ে শিশুদের হার ১৬.১ শতাংশ। অসহায় শিশুদের জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হলো শিশুশ্রম। দারিদ্র্য, শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব, এবং সামাজিক নিরাপত্তার ঘাটতি শিশুদের শ্রমে ঠেলে দেয়। তারা গৃহকর্ম, কারখানা, নির্মাণ, কৃষি, পরিবহন, হোটেল, দোকানসহ বিভিন্ন খাতে কঠোর পরিশ্রম করে। অনেক সময় তারা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়। শিশুশ্রম শিশুদের শৈশব কেড়ে নেয়, তাদের শিক্ষা ও উন্নয়নের পথ রুদ্ধ করে। অসহায় শিশুরা অনেক সময় বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ পায় না। দারিদ্র্য ও পরিবারের চাহিদা মেটাতে তারা কাজ করতে বাধ্য হয়। ফলে তারা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ে, যা তাদের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। শিক্ষার অভাবে তারা দক্ষতা অর্জন করতে পারে না। ফলে ভবিষ্যতে ভালো কাজ পাওয়ার সম্ভাবনাও কমে যায়। অসহায় শিশুরা পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। তারা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করে এবং কাজ করে, যা তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অনেক সময় তারা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়, কিন্তু সঠিক চিকিৎসা পায় না। অসহায় শিশুদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল। তারা নির্যাতন, শোষণ ও সহিংসতার শিকার হয়, কিন্তু তাদের সাহায্য করার মতো ব্যবস্থা অনেক সময় অনুপস্থিত থাকে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নজরদারি ও সুরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী না হওয়ায় তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। অসহায় শিশুদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক সময় সহানুভূতিশীল নয়। তাদের সমস্যাগুলোকে গুরুত্ব না দিয়ে অনেক সময় অবহেলা করা হয়। তাদের শ্রমকে স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নেওয়া হয়, যা তাদের শোষণকে বৈধতা দেয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন না হলে অসহায় শিশুদের অবস্থার উন্নয়ন সম্ভব নয়।

গুচ্ছ পরীক্ষায় অন্তর্ভুক্ত হোক সব বিশ্ববিদ্যালয়

গুচ্ছ পরীক্ষায় অন্তর্ভুক্ত হোক সব বিশ্ববিদ্যালয়

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার বেসিক উদ্দেশ্য হচ্ছে কোনোরকম হয়রানি বা ভোগান্তি তৈরি না করে লাখ লাখ শিক্ষার্থী থেকে সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের ভর্তির জন্য নির্বাচন করা। গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা খুবই ভালো উদ্যোগ। গত পাঁচ শিক্ষাবর্ষে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় কিছু ভুলত্রুটি থাকলেও এটা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের জন্য স্বস্তির বিষয় ছিল। ২০২০ সালের ১৯ ডিসেম্বরে প্রথমবারের মতো দেশের ২০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা গুচ্ছ পদ্ধতিতে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের জন্য ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা কার্যক্রমের নেতৃত্ব দিচ্ছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো না আসায় গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা শতভাগ সফল হয়নি। তাই সরকারকে বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একটি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার আওতায় আনার জন্য জোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের কষ্ট কমে যাবে। কারণ, শিক্ষার্থীদের এখনো প্রায় পাঁচ-ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরম তুলতে হয় ও পরীক্ষা দিতে হয়। তাই আগের মতো ভোগান্তি থেকে যায়। যদিও গুচ্ছ পদ্ধতির এ পরীক্ষায় একটি আবেদনে গুচ্ছের আওতাভুক্ত সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ থাকছে। কয়েক বছর ধরেই গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে আলোচনা চলছিল। অবশেষে যখন সত্যিই এ পদ্ধতি আংশিক বাস্তবায়িত হলো, তা পরীক্ষার্থীদের জন্য কিছুটা হলে স্বস্তি নিয়ে আসছে। গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা একসঙ্গে হওয়ায় আসন নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা কম। আগে একজন শিক্ষার্থী কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাতালিকায় সুযোগ পেয়ে যখন পছন্দের একটি বেছে নিতেন, তখন একই সঙ্গে অন্য জায়গায় কয়েকটা আসন ফাঁকা থেকে যেত। কিছু ক্ষেত্রে পছন্দের বিষয় পেতে দেরি হতো এবং প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ ছিল। ফলে, অনেকেই হতাশায় ভুগতেন। বিশেষজ্ঞদের দিয়ে এ পদ্ধতিতে যে সমস্যা আছে, সেগুলো বন্ধ করতে হবে। এ সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারলে সবার নিকট খুবই গ্রহণযোগ্য হবে। তবে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় কিছু জটিলতা তৈরি হয়েছে। যেমনÑ কেউ পরীক্ষার কেন্দ্র পছন্দ দিয়েছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু তাকে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয়েছে দূরবর্তী অন্য কোনো কেন্দ্রে। আবার কেউ পরীক্ষার কেন্দ্র পছন্দ দিয়েছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বাস্তবে পরীক্ষার কেন্দ্র পড়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এভাবে অনেক শিক্ষার্থী কষ্ট এবং ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। ফলে, ২০২৬ সালে ভর্তি পরীক্ষায় বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে গুরুত্বের সহিত বিবেচনা করে সমাধান বের করা উচিত । তারপরও গুচ্ছ পদ্ধতি ভোগান্তি কমানোর জন্য একটি যুগোপযোগী পদক্ষেপ। তবে কিছু বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে আরও যত্নবান হতে হবে। আবেদন নির্দেশিকাতে বলা হয়েছিল, পছন্দক্রম অনুসারে কমপক্ষে পাঁচটি কেন্দ্র নির্বাচন করতে, যেখানে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিতে চান। তবে তারা সঠিকভাবে কেন্দ্রের তালিকা পূরণ করার পরও অনেক শিক্ষার্থী পছন্দের কেন্দ্র পাননি। সেক্ষেত্রে যেভাবে হোক ওই কেন্দ্রে ব্যবস্থা করা জরুরি। প্রয়োজন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে কোনো স্কুল বা কলেজে কেন্দ্র করা যেতে পারে। অতীতে একেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য একেক জেলায় বা বিভাগে শিক্ষার্থীদের ছুটতে হতো। স্বাভাবিকভাবেই ভ্রমণক্লান্তি বা অসুস্থতার জন্য প্রস্তুতি থাকার পরও অনেকের পরীক্ষা আশানুরূপ হতো না। তাই গুচ্ছ পদ্ধতি সবার জন্যই স্বস্তির বিষয়। সময় ও অর্থসাশ্রয়ের সঙ্গে পছন্দের কেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে পারলে আত্মবিশ্বাসও বাড়বে শিক্ষার্থীদের। তবে অনেকে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতেন, এগুলোতে সুযোগ না হলে তাদের ঘুরতে হতো সারাদেশে। গুচ্ছ পদ্ধতি আশপাশের কোনো কেন্দ্রে বসে ২০ বা ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ করে দিয়েছে অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের। কিন্তু এ বছর ১৯ বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ৫টি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ থেকে বের হয়ে যায়। সরকারের উচিত, যেভাবেই হোক সব বিশ্ববিদ্যালয়কে এক সিস্টেমের আওতায় নিয়ে আসা।   এছাড়া ভর্তি ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা ছবি পরিবর্তনসহ অন্য কোনো সমস্যায় পড়লে তাদের গুচ্ছভুক্ত কাছাকাছি যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগ করে তা সমাধান করা হয়েছে। শিক্ষকরাও গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কিছুটা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। কারণ, প্রতিকক্ষে প্রধান পরিদর্শক রাখা হয়নি। তবে এ বছর অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সমস্যা সমাধান করা হয়েছে। যদি এখনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রধান পরিদর্শক না রেখে থাকেন, আগামী শিক্ষাবর্ষে যেন এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়।   ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা গুচ্ছ পদ্ধতিতে হলে শিক্ষার্থীরা শতভাগ খুশি হতো। কারণ, এতে এক আবেদনে তাদের ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন হতো। অনেক শিক্ষার্থী মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এ প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত না হওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। তারা মনে করেন, সব বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় এলে সবচেয়ে ভালো হতো। নতুবা ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অজুহাতে অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় ভবিষ্যতে নাও থাকতে পারে, যা ইতোমধ্যে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় অনুসরণ করেছে। তবে নতুন এ ব্যবস্থাকে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন বেশির ভাগ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। আশা করছি, এ পদ্ধতিতে পুরানো সমস্যাগুলো দূর হবে। এছাড়া গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার নেতিবাচক দিক হলো, যদি কোনো এক শিক্ষার্থী দুর্ঘটনাবসত পরীক্ষা দিতে না পারেন বা পরীক্ষায় বেশি খারাপ করে ফেলেন, তাহলে তার গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার অন্তর্ভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ আর থাকবে না। আগে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে খারাপ করলেও আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে ভালো পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তি হওয়ার সুযোগ মিলত। এগুলো পাবলিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে মেনে নিতে হবে। প্রতিবছর যে হারে জিপিএ পাস করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেই অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংখ্যা বাড়ছে না। তার ওপর আবার রয়েছে পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয় ও বিষয় নির্বাচন। সব মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর বিশাল চাপ সৃষ্টি হয়। উচ্চশিক্ষার জন্য তাই তীব্র প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হয় তাদের। তবে এ তীব্র প্রতিযোগিতা ফেস করতে গিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের নানা বিড়ম্বনার মুখোমুখিও হতে হয়। সবচেয়ে জনপ্রিয় যে সমাধানটি গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আলোচনায় এসেছে, তা হলোÑ সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করা, যা ইতোমধ্যে কার্যকর হয়েছে। কিন্তু শতভাগ সফল হয়নি। অধিকাংশ শিক্ষার্থী রাজধানীতে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রগুলোতে পরীক্ষা দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ হাজার ৯১৫ জনের পরীক্ষা নেওয়ার ধারণক্ষমতা আছে। কিন্তু প্রথম বছর সেখানে ৩৭ হাজার ৭৪৯ জন শিক্ষার্থী প্রথম পছন্দের কেন্দ্র হিসেবে আবেদন করেছেন। আবার শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ হাজার জনের পরীক্ষা নেওয়ার ধারণ ক্ষমতা থাকলেও সেখানে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য আবেদন জমা পড়েছে ২০ হাজার ৮৯৪ জনের। ফলে, নির্ধারিত আসনের বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থীর পছন্দ থাকায় যারা স্কোরে এগিয়ে ছিলেন, তারাই ওই কেন্দ্রে পরীক্ষার আসন পেয়েছেন। তাই শিক্ষার্থীদের উচিত হবে তার নিজ বিভাগ সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্র পছন্দ করা। তাতে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা আয়োজক কমিটির সুবিধা হবে। দেশে অনুমোদিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ৫৪টি। এসবের মধ্যে সাধারণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, যেগুলোয় ভর্তি পরীক্ষা আলাদা আলাদা তারিখে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি প্রকৃতপক্ষে ওই রকম হ্রাস পাচ্ছে না। অর্থাৎ গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা সফল হবে তখনই যখন একটি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় অন্তর্ভুক্ত হবে সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তাই এমন সিস্টেম বের করতে হবে যাতে সাধারণ, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে স্নাতক ভর্তির কার্যক্রম সম্পন্ন করা যায়।   লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকারের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে মালয়েশিয়ার প্রতিনিধিদের গত বৃহস্পতিবার (১৫ মে) পুত্রজায়ায় শ্রমবাজার নিয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়ার বিষয়ে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটি। তবে ২১ মে ঢাকায় যৌথ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের শ্রমিকদের জন্য ফের উন্মুক্ত হচ্ছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। বৈঠকে মালয়েশিয়াকে বাংলাদেশ থেকে নিরাপত্তাকর্মী, নার্স, কেয়ারগিভারসহ দক্ষ কর্মী নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে মালয়েশিয়ায় কর্মরত বাংলাদেশি কর্মীদের বিভিন্ন সুবিধা দেওয়ার বিষয় নিয়েও আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশি শ্রমিকরা সিঙ্গেল এন্ট্রি ভিসা পান। তাদের যেন অন্য দেশের শ্রমিকের মতো মাল্টিপল ভিসা দেওয়া হয়, সে অনুরোধ দেশটির কাছে করা হয়েছে। অবশ্য বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়ার আগে কয়েকটি শর্ত দিয়েছে মালয়েশিয়া।   আগামী ৬ বছরের মধ্যে মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে ১২ লাখ শ্রমিক নেবে বলে আশা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক নেবে বিনা খরচে। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান উপদেষ্টা জানিয়েছেন, মালয়েশিয়া আগামী কয়েক মাসে এক থেকে দেড় লাখ বিদেশী শ্রমিক নিতে পারে। দেশটি নেপাল, মালদ্বীপসহ আরও পাঁচটি দেশ থেকে শ্রমিক নেবে। লোক নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে এবং অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি লোক নেওয়া হবে। উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের শুরুতে বাংলাদেশসহ সবার জন্য মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ করে দেয় দেশটির কর্তৃপক্ষ। তখন দেশটিতে শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট তৈরির অভিযোগ ছিল। বৈদেশিক কর্মসংস্থানে মালয়েশিয়া দেশের অন্যতম শ্রমবাজার। অথচ দীর্ঘ সময় ধরে মালয়েশিয়া শ্রমবাজারে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এটি একবার খোলে, আবার বন্ধ হয়, আবার খোলে। যার অন্যতম কারণ সিন্ডিকেট ও অব্যবস্থাপনা। কোরিয়া ও জাপানে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে কখনো অনিয়ম পরিলক্ষিত না হলেও মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে প্রায়ই এমনটি ঘটছে। গত বছর সংক্ষিপ্ত সফরে ঢাকায় এসেছিলেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। সে সময় তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বাংলাদেশ থেকে যেতে না পারা কর্মীদের দেশটিতে যাওয়ার সুযোগ করে দেবেন। সেই প্রতিশ্রুতিই যেন এখন বাস্তবায়ন হতে  যাচ্ছে, যা আশাব্যঞ্জক। শ্রমিক হিসাবে যারা ভাগ্যান্বেষণে প্রবাসে পাড়ি জমান, তাদের অধিকাংশই দেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অংশ। তারা হাড়ভাঙা পরিশ্রমের মাধ্যমে রেমিটেন্স পাঠিয়ে দেশকে এগিয়ে দিচ্ছে। কাজেই সরকারের অবিলম্বে এদিকে নজর দেওয়া দরকার বলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের অভিমত।  একইসঙ্গে মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু শ্রমিকরা যেন কোনোভাবেই প্রতারণার শিকার না হন, তা-ও নিশ্চিত করা জরুরি। সরকার এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেবে- এটাই প্রত্যাশা।

চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনা

চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনা

বিশ্বের শীর্ষ তুলা আমদানিকারক দেশ হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দর তুলা ও অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী সংরক্ষণাগার গড়ে তোলার মাধ্যমে বছরে ১০/১২ বিলিয়ন ডলার আয় করতে পারে। এটা বড় সম্ভাবনা। বন্দর থেকে বাংলাদেশসহ পার্শ্ববর্তী দেশসমূহ মুক্তবাণিজ্য অঞ্চলের সুবিধা গ্রহণ করতে পারে। চট্টগ্রাম বন্দরের ১৩৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গত মাসে দারুণ সম্ভাবনার কিছু চিত্র উঠে এসেছিল। বিশ্ব ব্যাংক নিউইয়ার্ক বে-টার্মিনালের ব্রেক ওয়াটার ও ড্রেজিংয়ের জন্য ৪৬০ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি সই করেছিল সে সময়ে। চলতি বছরের শেষ প্রান্তে লালদিয়ার চর এলাকায় টার্মিনাল নির্মাণের কাজ শুরু করার কথা। আশার কথা হলো, চট্টগ্রাম বন্দরকে ঘিরে বিদেশী বিনিয়োগের প্ল্যাটফর্ম তৈরি হচ্ছে। এই বছরেই গড়ে উঠবে মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল। দেশের অর্থনীতির গেম চ্যাঞ্জার খ্যাত মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রে দুটি টার্মিনাল নির্মাণের কাজ শুরু হবে। বে-টার্মিনালে ডিপি ওয়ার্ল্ড ও সিঙ্গাপুর পোর্ট অথরিটি কর্তৃক দুটি টার্মিনালের কাজ শুরু হচ্ছে। গত সপ্তাহে চট্টগ্রাম বন্দর পরিদর্শনকালে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসও আশার বাণী শুনিয়েছেন। চট্টগ্রাম বন্দরকে বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড। হৃৎপিণ্ড দুর্বল হলে ডাক্তার, বৈদ্য, সবকিছু আনো; মেরামত হবে, কিন্তু চলবে না। ছোট্ট একটি হৃৎপিণ্ড, তার মধ্যে হলো রোগাক্রান্ত, এই হৃৎপিণ্ডে যতই ঠেলাঠেলি করো, রক্ত সঞ্চালন হবে না। এটিই যদি একমত হই- বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড হলো চট্টগ্রাম বন্দর, তাহলে যে সাইজের হৃৎপিণ্ড আছে, ওই সাইজে চলে না। এই হৃৎপিণ্ড বিশ্ব সাইজের হতে হবে।’ এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড। এই বন্দরের বিভিন্ন টার্মিনালে বিদেশি কোম্পানিকে সম্পৃক্ত করার যে প্রক্রিয়া চলছে, সে বিষয়ে সরকারের মনোভাব স্পষ্ট করা হয়েছে। আশপাশের দেশগুলোর অর্থনীতির জন্য এই বন্দর গুরুত্বপূর্ণ। এটি ব্যবহারের সুযোগ পেলে নেপাল, ভুটান এমনকি সেভেন সিস্টার্সও (ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্য) লাভবান হবে। উপকৃত হবে বাংলাদেশও। এটাই প্রকৃত সত্য। দেশের উন্নয়ন অবকাঠামোর স্বার্থেই বন্দর উন্নয়ন জরুরি। চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনা অবশ্যই বিশ্বমানের হতে হবে, এ বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। সরকার এ বিষয়টির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। এ বন্দর পুরোদস্তুর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর বিনিয়োগ এবং বাণিজ্য সংযোগের মাধ্যম হয়ে উঠলে দেশ বিপুলভাবে লাভবান হবে, এমনটাই প্রত্যাশা।