ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১২ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২

প্রসঙ্গ ইসলাম

আজান ॥ নিত্য সালাত ও কল্যাণের আহ্বান

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রকাশিত: ২০:২২, ১০ জুলাই ২০২৫

আজান ॥ নিত্য সালাত ও কল্যাণের আহ্বান

নামাজের সময় এলে একজন লোক উচ্চৈঃস্বরে আল্লাহ্র ইবাদতের সময় হয়েছে বলে মুসল্লিদের আল্লাহ্ দরবারে হাজির হওয়ার জন্য আহ্বান জানায়। এই আহ্বানকে ‘আজান’ বলে। যে আজান দেয় তাকে বলা হয় মোয়াজ্জিন। বিনা বেতনে কিংবা কোনো বিনিময় আশা ব্যতিরেকে আজান দেওয়ার ফজিলত অনেক বেশি। কুরআনুল কারিমে বলা হয়েছে : ওয়ামান আহসানু কাওলাম মিম্মান দাআ ইলাল্লাহ...তার কথার চেয়ে কার কথা উত্তম, যে ব্যক্তি মানুষদের আল্লাহ্র পথে আহ্বান করে ও সৎকাজ আন্জাম দেয় আর বলে নিঃসন্দেহে আমি মুসলমানদের একজন। মহানবী (সা.) জামাআতে নামাজ পড়তে তাগিদ দিযেছেন। জামাআতে নামাজের জন্য কীভাবে ডাকতে হয় কেউ জানত না। মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) সাহাবীদের নিয়ে একদিন পরামর্শে বসলেন, আলোচনা চলল। কেউ বলল নামাজের সময় হলে ঘণ্টা বাজানো হোক। কেউ বললেন শিঙ্গায় ফুঁ দিয়ে ডাকা হোক। অন্য একজন বললেন আগুন জ্বালানো হোক। আরও অনেকে অনেক কথা বললেন। নবী করিম (সা.) কোনোটাই পছন্দ করলেন না। 
নিঝুম রাত, সাহাবী আবদুল্লাহ্ বিন জায়েদ (রা.) গভীর ঘুমে মগ্ন। স্বপ্ন দেখেন একজন ফেরেস্তা তাকে আজানের বাক্যগুলো শুনাচ্ছেন। ভোরে তিনি ঐ বাক্যগুলো মহানবী (সা.)-কে শুনালেন। আশ্চর্যের কথা হযরত উমর (রা.)ও একই স্বপ্ন দেখেন। বাক্যগুলো মহানবী (সা.)-এর খুব পছন্দ হলো। তিনি বুঝলেন এটি আল্লাহ্ তায়ালারই নির্দেশ। তিনি হযরত বিলাল (রা.) কে আজান দিতে বললেন। হযরত বিলাল (রা.) এর কণ্ঠে ধ্বনিত হলো প্রথম আজান। হযরত বিলাল (রা.) হলেন ইসলমের প্রথম মোয়াজ্জিন। পরবর্তীকালে উচ্চ স্বরে আজান দেওয়ার ক্ষেত্রে হযরত উমরের সাহসী ভূমিকা ছিল ইসলামে উল্লেখযোগ্য। আজকে যেমন সুমধুর আজানের আওয়াজ কোনো কোনো দুর্ভাগাকে বিরক্তির উদ্রেক করে সে যুগেও বড় করে আজান দেওয়া ছিল মুসলমানদের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। হযরত উমরই মোয়াজ্জিনদের অভয়দান করেছিলেন। তার ব্যক্তিত্ব ও প্রভাবের কারণে তৎকালীন কাফির মুশরিকগণ ইসলামের এ আহ্বান ধ্বনি রুখতে পারেনি। 
এক হাদিসে আছে, যে ব্যক্তি আজান দেবে ও ইকামত বলবে এবং আল্লাহকে ভয় করবে তার ছগিরা গুনাহসমূহ মাফ করে তাকে বেহেস্তে প্রবেশ করানো হবে। অন্য এক হাদিসে আছে, যে ব্যক্তি সাত বছর কাল বিনা বেতনে আজান দেবে, সে বিনা হিসেবে বেহেস্তে যাবে। অপর একটি হাদিস হতে জানা যায়, হাশরের ময়দানে মোয়াজ্জিনের মর্যাদা ও মর্তবা এত বেশি হবে যে, সে যত লোকের ভিড়ের মধ্যে হোক না কেন, সকলের মাথার উপরে তার মাথা লক্ষ্য করা যাবে। 
ইসলামী ফিকহ শাস্ত্রের বিধান হলো, নবী করিম (সা.) হতে শ্রুত এবং বর্ণিত অবিকল আরবী শব্দগুলো ছাড়া অন্য কোনো প্রকার বা অন্য কোনো ভাষায় আজান দিলে তা ছহীহ হবে না- যদিও তাতে আজানের উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়। পুরুষেরাই আজান  দেবে। মহিলাদের আজান দেওয়া নাজায়েজ। কেননা মহিলাদের উচ্চশব্দ করা এবং পর পুরুষকে শব্দ শুনান নিষেধ। সুতরাং মহিলা আজান দিলে পুরুষকে পুনরায় আজান দিতে হবে। পুনরায় আজান না দিলে যেন বিনা আজানে নামাজ পড়া হলো। পাগল বা অবুঝ বালক আজান দিলে সে আজান শুদ্ধ হয় না, পুনরায় আজান দিতে হয়। আজান দেওয়ার সুন্নাত তরিকা এই যে, মোয়াজ্জিনের গোসলের দরকার হলে গোসল করা এবং ওজুু না থাকলে ওজু করে নেওয়া উচিত। তারপর মসজিদের বাইরে কিছু উঁচু জায়গায় কেবলার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে দুই হাতের শাহাদাত আঙ্গুল দুই কানের ছিদ্রের মধ্যে রেখে যথাসম্ভব উচ্চ শব্দে খোশ এলহানের সঙ্গে নির্দিষ্ট বাক্যমালা উচ্চারণ করবে। গানের মতো গেয়ে বা উঁচু নিচু আওয়াজে আজান দেওয়া ঠিক নয়। যথাসম্ভব আওয়াজ উচ্চ করে টেনে লম্বা করে আজান দেওয়া উচিত। 
জুমার ছানি আজান অপেক্ষাকৃত কম আওয়াজে হওয়া বাঞ্ছনীয়। কারণ ঐ আজান দ্বারা শুধু উপস্থিত লোকদের সতর্ক করা হয়। যাতে খুৎবা শোনার জন্য মুসল্লিগণ দায়িত্বশীল মন নিয়ে অগ্রসর হয়। পুরুষ হোক মহিলা হোক পবিত্র অবস্থায় যে কেউ আজানের আওয়াজ শুনবে তার জন্য আজানের জওয়াব দেওয়া মুস্তাহাব, কেউ কেউ ওয়াজিবও বলেছেন। কোনো কোনো আলিম বলেছেন যে, আজানের জবাব দুই প্রকার, (১) মৌখিক জবাব দেওয়া এবং (২) ডাকে সাড়া দিয়ে মসজিদে জামাতে হাজির হওয়া ওয়াজিব। এখানে মৌখিক জবাবের কথাই বলা  হচ্ছে। যদি কেউ আযানের জবাব ভুলবশত: কিংবা স্বেচ্ছায় সঙ্গে সঙ্গে না দিয়ে থাকে, তবে স্মরণ হলে কিংবা ইচ্ছা করলে আজান শেষ হয়ে যাওয়ার পর (অনেক সময় অতিক্রান্ত না হলে) জবাব দেয়া যায়।-(বেহেস্তি জিওর)। জুমার প্রথম আজান হওয়া মাত্রই সমস্ত কাজকর্ম পরিত্যাগ করে মসজিদের দিকে ধাবিত হওয়া ওয়াজিব। ঐ সময় বেচা-কেনা খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদিতে লিপ্ত হওয়া হারাম। (বিস্তারিত দেখুন সূরা জুমার তাফসির)। 
আমরা যেন কখনো আজান-আহ্বান উপেক্ষা না করি। আল্লাহ্র ইবাদত বন্দেগির ডাকে সাড়া দিয়ে আমাদের উচিত নির্মল নিষ্পাপ জীবন গড়ার পানে ধাবিত হওয়া।

লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও 
জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব
[email protected]

প্যানেল/মো.

×