
এস এম নাহিদ হাসান ( শিক্ষক, সাংবাদিক ও কবি)
১. গত বুধবারের একটি হত্যার দৃশ্যের ভিডিও ফুটেজ সম্প্রতি ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। গত বুধবারের এই ধরনের একটি ঘটনা মূলধারা বা উপধারার সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টিগোচর না হলেও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পরে তারা এ বিষয়ে আলোকপাত করেছে। দৃশ্যে দেখা যায় একজন ব্যক্তিকে রাস্তার মাঝে ফেলে অপর কয়েকজন ব্যক্তি মস্ত একটি পাথরের চাঁই দিয়ে উপর্যপুরি আঘাত করে তার হাত-পা ও পাঁজরের হাড় ভেঙে দিতে চেষ্টা করছে এবং এভাবে চেষ্টা করছে মৃত্যু নিশ্চিতের! সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমের বরাতে এও জানা যায় যে মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরেও পাথরের চাঁইয়ের ওই আঘাত বন্ধ হয়নি। পাশাপাশি এও শোনা যাচ্ছে, হত্যাকারীরা নাকি মৃত (বা অর্ধ মৃত) ওই ব্যক্তির মুখে প্র*সা*ব করতে উদ্যত হয়েছিল। তবে মানবতা (!) জেগে ওঠায় অন্তত ওই অপকর্ম থেকে তারা বিরত থেকে ছিল!
২. আসুন ইতিহাসের নৈরাজ্যময় দুটি সময় ও সমাজ সম্পর্কে জানি।
আইয়াম-এ-জাহিলিয়া: "জাহিলিয়া" শব্দটি আরবি, যার অর্থ হলো অজ্ঞতা বা অন্ধকার যুগ। "আইয়াম-এ-জাহিলিয়া" মানে সেই সময়কাল যখন ইসলাম ধর্মের আগমন হয়নি, অর্থাৎ ইসলাম-পূর্ব আরব সমাজ।
সে সময় আরবরা নানা গোত্রে বিভক্ত ছিল। ছোটখাটো বিষয়ে দীর্ঘ যুদ্ধ চলত। কন্যাশিশুদের জীবন্ত কবর দেওয়া হতো। মদ্যপান, জুয়া ও হ*ত্যা ছিল প্রচলিত। আইন ছিল না; প্রতিশোধ নেওয়াই ছিল ন্যায়বিচারের একমাত্র উপায়!
ইসলাম আসার পর নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ইসলাম প্রচার করে এই জাহিলি সমাজকে নৈতিক ও আইনত সমাজে রূপান্তর করেন।
এই যুগের বিভিন্ন অপকর্মের বর্ণনা আল কোরআন, হাদিস, সীরাহ, বিভিন্ন ইসলামী ইতিহাস গ্রন্থ যেমন, 'আল তাবারির ইতিহাস', 'আল মাগাজি' ও 'আর রাহীকুল মাখতুম' এবং আরব কবি ইমরুল কায়েস, যুহাইর ইবনে আবু সালমা ও আবু সাদ্দাদের কবিতায় উঠে এসেছে।
মগের মুল্লুক: "মগের মুল্লুক" বাংলার একটি প্রবাদপ্রতিম শব্দগুচ্ছ, যার অর্থ হলো যার যা খুশি তাই করা চলে, কোনো শাসন বা শৃঙ্খলা নেই।
১৭ শতকে বার্মার মগ (আরাকান) জলদস্যুদের আক্রমণে বাংলার উপকূলীয় অঞ্চল বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও দক্ষিণাঞ্চল ছিল বারবার আক্রান্ত।
তারা লুট করত, ধ*র্ষ*ণ করত, শিশু ও নারীকে অ*প*হ*র*ণ করত এবং সম্পূর্ণ অরাজকতা সৃষ্টি করত। এই সময়টিকে সাধারণ মানুষ "মগের মুল্লুক" নামে ডাকত, কারণ তখন শাসনের কোনো উপস্থিতি ছিল না।
এই যুগের অরাজকতার ভয়াবহ বর্ণনা আমরা পাই মির্জা নাথানের 'বাহারিস্থান ই গায়বি', আবুল ফজলের 'আকবর নামা' ও এর অন্তর্গত 'আইন ই আকবরী' সহ বিভিন্ন আধুনিক গবেষণা পত্রে।
৩. পবিত্র আল কোরআনে হত্যাকাণ্ডের সম্পর্কে কি বলেছে আসুন দেখি।
“যে কেউ কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করে -না কোনো প্রাণের বদলায়, না কোনো উপদ্রবের কারণে- সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করল। আর যে তাকে বাঁচায়, সে যেন সমস্ত মানবজাতিকে বাঁচায়।”
(সূরা আল-মায়েদা-৩২)
“যে প্রাণকে আল্লাহ হত্যা হারাম করেছেন, তা ন্যায়সঙ্গত কারণ ছাড়া হত্যা করো না।”
(সূরা আল-ইসরা-৩৩)
(এখানে 'ন্যায়সঙ্গত' বলতে ন্যায়বিচার ও রাষ্ট্রীয় বিচারে, প্রাণদণ্ড বোঝানো হয়েছে)
“যে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে একজন মুমিনকে হত্যা করে, তার শাস্তি জাহান্নাম, সেখানে সে চিরকাল থাকবে...”
(সূরা আন-নিসা-৯৩)
এ ছাড়াও অন্যান্য প্রধান ধর্ম গ্রন্থগুলোতে (যেমন হিন্দুদের 'ভগবত গীতা', খ্রিস্টানদের 'বাইবেল', বৌদ্ধদের 'ত্রিপিটক' এবং ইহুদিদের 'তোরাহ্') হত্যা থেকে কঠোরভাবে বিরত থাকার জন্য বলা হয়েছে।
৪. এখন, ঐতিহাসিক অরাজকতার সাথে আমরা বুধবারে পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকায় সোহাগ নামে ওই ব্যবসায়ীর হত্যাকাণ্ডকে মিলিয়ে দেখলে এটা মেনে নিতে কষ্ট হয় যে এই ঘটনাটি একটি সভ্য সমাজে প্রকাশ্য দিবালোকে শত প্রত্যক্ষদর্শীর সামনে সংঘটিত হয়েছে। বরং শিউরে ওঠার মত ঘটনাটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় আইয়াম এ জাহিলিয়া বা মগের মুল্লুকের সামাজিক অবক্ষয় আর নিরাপত্তাহীনতার শৃঙ্খলকে।
আর ধর্মের আলোকে বিষয়টি দেখলে তো ব্যাপারটি আরো ভয়াবহ। একজনকে হত্যা যদি পুরো মানবজাতি কে হত্যার শামিল হয় আর রক্ষা করা যদি পুরো মানবজাতিকে রক্ষা করা হয় তাহলে এ শঙ্কায় পরতেই হয়, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা ১৮ কোটি মানুষ কি 'হত্যাকারী' নাকি 'নিহত'!
৫. কোন বিশেষ ব্যক্তির অপকর্মের দায় কোন সমাজ বা রাষ্ট্রের উপরে সরলভাবে বর্তায় না। এটি অত্যন্ত সত্য। তবে ওই বিশেষ ব্যক্তি যেহেতু সমাজ ও রাষ্ট্রের সুবিধাভোগী এবং সেই সূত্রে সমাজ ও রাষ্ট্রেরই অংশ, সেহেতু সম্পূর্ণ দায় সমাজ ও রাষ্ট্রের এড়ানোর সুযোগও নেই বললেই মনে হয়। ন্যায়বিচার ও ন্যায়বিচার বোধ ব্যক্তি থেকে পরিবার, পরিবার থেকে সমাজ এবং সমাজ থেকে রাষ্ট্র পর্যায়ে গড়ে ওঠে। ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র- কোন পর্যায়ে এই ন্যায়বিচার বোধ যদি উপেক্ষিত হয় বা এর প্রয়োগ বাধাগ্রস্ত হয় অথবা এর শিক্ষা যদি প্রয়োগ না করা হয়, তখনই হত্যা বা অন্যান্য অমানবিক অপসংস্কৃতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে।
মিটফোর্ডের ওই ঘটনা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি একটি সমাজের প্রতিচ্ছবি; সেই সমাজ যেটি দিনের পর দিন, যুগের পর যুগ, তার বুকে বসবাসকারী মানুষগুলোকে মানবিক গুণাবলীর আলোকে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে! যার ফলশ্রুতিতে কেউ অপরাধ করছে, কেউ চোখ বন্ধ করে মেনে নিচ্ছে অথবা কেউ চোখ খুলে দেখে উল্লাস প্রকাশ করছে!
অর্ধ উ*ল*ঙ্গ ওই সোহাগের হত্যাকাণ্ড সমাজ আর দেশকে যে পূর্ণ উ*ল*ঙ্গ করে দিয়েছে সেই লজ্জায় মাথা নীচু হয়ে গিয়েছে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের আর আমাদের ১৮ কোটি জনতার।
তবে কিছুটা স্বস্তির ব্যাপার হলো এই দৃঢ় বিশ্বাস যে অপরাধীর কোন দল নেই। অপরাধীর দল একটাই, 'অপরাধী'! আর এর একটা বিরোধীদল আছে; সেই বিরোধী দল হল 'বাংলাদেশ'!
এস এম নাহিদ হাসান
শিক্ষক, সাংবাদিক ও কবি
ফরিদপুর, পাবনা
শেখ ফরিদ