
ছবি: (বামে) সবুজ মিয়া, (মাঝে) মাহবুব আলম, (ডানে) শারদুল আশীষ সৌরভ
২০২৪ সালের ৪ আগস্ট, শেরপুর শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী বিক্ষোভ। সেই গণ-আন্দোলন হঠাৎই রূপ নেয় সংঘর্ষে। একদিকে মিছিল, অন্যদিকে প্রশাসন ও সরকারি দলের পাল্টা উপস্থিতি। উত্তাল পরিস্থিতির একপর্যায়ে গুলিতে ও গাড়িচাপায় প্রাণ হারায় তিন তরুণ: সবুজ মিয়া, মাহবুব আলম ও শারদুল আশীষ সৌরভ।
প্রায় এক বছর পর, তিনটি পৃথক হত্যা মামলায় পুলিশ আদালতে চার্জশিট জমা দিয়েছে। যেখানে ৫০৫ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ তালিকায় রয়েছেন রাজনৈতিক ব্যক্তি, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, সরকারি কর্মচারী, এমনকি একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটও। কিন্তু বাদ দেওয়া হয়েছে আলোচিত একজন সাবেক পুলিশ সুপার ও ডিআইজিকে (পরে পদোন্নতিপ্রাপ্ত একই ব্যক্তি)।
চার্জশিটে নাম আছে যাদের
চার্জশিটে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা হলেন-
সাবেক হুইপ ও সংসদ সদস্য আতিউর রহমান আতিক, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবীর রুমান, সাবেক পৌর মেয়র গোলাম মোহাম্মদ কিবরিয়া লিটন, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (ঘটনার সময়কার) ও সরকারি গাড়িচালক, শেরপুর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এডিএম শহিদুল ইসলাম, সাবেক নারী এমপি ফাতেমাতুজ্জহুরা শ্যামলী, জেলা জাসদ সভাপতি মনিরুল ইসলাম লিটনসহ অনেকেই।
এছাড়াও আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা রয়েছেন চার্জশিটে।
কে বাদ পড়লেন, কেন?
চার্জশিট থেকে বাদ পড়েছেন মোট ৩৩ জন। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন-
তৎকালীন শেরপুরের পুলিশ সুপার ও পরে ডিআইজি পদে পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তা (একই ব্যক্তি), যুবলীগ নেতা ও ইউপি চেয়ারম্যান সাব্বির আহমেদ খোকন, শহর আওয়ামী লীগের নেতা জুলফিকার আলী, সাংবাদিক মেরাজ উদ্দিন। তদন্তে ‘অপরাধে সরাসরি সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি’—এই যুক্তিতে তাদের অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়েছে।
ঘটনার ভয়াবহতা: হত্যা, না দুর্ঘটনা?
সবুজ মিয়া গুলিতে নিহত হন, যখন আওয়ামী লীগের পাল্টা মিছিলের সময় সংঘর্ষ বাঁধে। অপর দুই ছাত্র মাহবুব ও সৌরভ নিহত হন প্রশাসনের গাড়ির নিচে চাপা পড়ে। অভিযোগ উঠেছে, ম্যাজিস্ট্রেট বহনকারী সরকারি গাড়িটি ইচ্ছাকৃতভাবে বেপরোয়া গতিতে শিক্ষার্থীদের ওপর চালিয়ে দেওয়া হয়। যদিও প্রশাসন শুরুতে এটিকে দুর্ঘটনা বলে দাবি করেছিল।
বিচার প্রক্রিয়ার ধীরগতি: শঙ্কা বাড়ছে
চার্জশিট জমা পড়লেও এখনও পর্যন্ত অধিকাংশ আসামি গ্রেফতার হয়নি। আদালত চার্জশিট গ্রহণ না করায় গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি হয়নি। এতে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে উদ্বিগ্ন নিহতদের পরিবার ও সচেতন মহল।
এক অভিজ্ঞ আইনজীবী বলেন, ‘এত বড় ঘটনায় চার্জশিট হলো, কিন্তু আসামিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে—এটা স্বাভাবিক নয়।’
পরিবারগুলোর প্রতিক্রিয়া: বিচার কি শুধু আশ্বাসে আটকে থাকবে?
সবুজ মিয়ার মা রওশন আরা বলেন, ‘আমার ছেলে কোনো রাজনীতি করতো না, কেবল মিছিলে ছিল। তবু তাকে গুলি করা হলো!’
সৌরভের ভাই বিপ্লব রায় বলেন, ‘শুধু চার্জশিট নয়, আমরা চাই গ্রেফতার, বিচার এবং দৃষ্টান্তমূলক সাজা।’ তারা প্রত্যাশা করছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিজে উদ্যোগ নিয়ে বিচারের পথে ধাপ এগিয়ে নেবেন।
রাজনৈতিক বার্তা: শাসকদলের তৃণমূল ভিত্তিতে ধাক্কা?
স্থানীয় বিশ্লেষকরা বলছেন, এই চার্জশিট শুধু আইনগত অগ্রগতি নয়, এটি ক্ষমতাসীন দলের তৃণমূল কাঠামোর ওপরও একটি সতর্ক সংকেত।
একজন প্রবীণ শিক্ষক বলেন, ‘দমন-পীড়ন ঢাকতে গেলে, এক সময় নেতৃত্বও জবাবদিহির মুখোমুখি হয়। এ ঘটনা তার ইঙ্গিতই দেয়।’
তিন তরুণের রক্তে লেখা একটি জবাব চায় শেরপুর
চার্জশিট দেওয়া হয়েছে, এটিই শেষ নয়। গ্রেফতার, বিচার এবং দৃষ্টান্তমূলক সাজা নিশ্চিত না হলে এই মামলা হয়ে উঠবে আরও একটি ‘অপ্রাপ্ত ন্যায়বিচারের নথি’। এজন্য পরিবার, নাগরিক সমাজ ও শিক্ষার্থীরা অপেক্ষায় আরও একবার, শেষবার নয়।
রাকিব