ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৯ জুন ২০২৫, ৫ আষাঢ় ১৪৩২

সাহিত্য

সাহিত্য বিভাগের সব খবর

বোহেমিয়ার স্ক্যান্ডাল

বোহেমিয়ার স্ক্যান্ডাল

(পূর্ব প্রকাশের পর) ‘বেশ বলুন তাহলে, আমি শুনছি।’ আবার চোখ বন্ধ করলো হোমস। ‘এই হলো ঘটনা : পাঁচ বছর আগে, দীর্ঘ সময়ের জন্য ওয়ারশ গিয়েছিলাম আমি। সেখানে ইরিন এডলারের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। আপনি নিশ্চয়ই জানেন তার সম্পর্কে?’ ‘ডাক্তার, প্লিজ আমার ইনডেক্স  ‘বেশ বলুন তাহলে, আমি শুনছি।’ আবার চোখ বন্ধ করলো হোমস। ‘এই হলো ঘটনা : পাঁচ বছর আগে, দীর্ঘ সময়ের জন্য ওয়ারশ গিয়েছিলাম আমি। সেখানে ইরিন এডলারের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। আপনি নিশ্চয়ই জানেন তার সম্পর্কে?’ ‘ডাক্তার, প্লিজ আমার ইনডেক্স কার্ডে একটু দেখো তো নামটা।’ চোখ না খুলেই মৃদুকণ্ঠে বললো হোমস। বহু বছর ধরে সে ইনডেক্স কার্ড তৈরি করছে- বিভিন্ন বস্তু, বিষয় ও মানুষের নামের প্রথম অক্ষর ধরে ধরে। বিস্তারিত বিবরণসহ তা বর্ণমালা অনুযায়ী সাজানো আছে, আমি জানি। ইরিন এডলারের নাম লেখা কার্ডটা বের করলাম। ‘দেখি তো।’ হোমস বললো। ‘হ্যাঁ, এই যে। জন্ম নিউ জার্সিতে, ১৮৫৮ সালে। ওয়ারশ অপেরার প্রধান গায়িকা...হুম! এখন লন্ডনে বসবাস করছে। বুঝতে পেরেছি, ইয়োর ম্যাজেস্টি। এই যুবতীর সঙ্গে আপনি জড়িয়ে গেছেন, চিঠি লিখেছেন যাতে কিছু ইন্টিমেট কথা আছে, এখন চিঠিগুলো আপনি ফেরত চান, এই তো?’ ‘হ্যাঁ ঠিক, একদম। কিন্তু কীভাবে যে-’ ‘বিয়ে-টিয়ে কী হয়েছিল?’ ‘না।’ ‘তার মানে কোনো আইনগত দলিল নেই?’ ‘না নেই।’ ‘তাহলে এত চিন্তার কী আছে বুঝতে পারছি না ইয়োর ম্যাজেস্টি। এই যুবতি যদি ব্ল্যাকমেইল করতে চায়, কীভাবে সে প্রমাণ করবে তার দাবির সত্যতা?’ ‘আমার চিঠিগুলো আছে তার কাছে।’ ‘ফুহ! আমরা বলবো জাল চিঠি।’ ‘কিন্তু...ব্যক্তিগত প্যাডে লেখা যে।’ ‘চুরি করা প্যাড বলবো।’ ‘আমার সিল-ছাপ্পর আছে প্যাডে।’ ‘নকল সিল।’ ‘আমার ছবিও আছে।’ ‘বাজার থেকে কেনা ছবি।’ ‘কিন্তু দুজনে আছি ছবিটাতে, একসঙ্গে-’ ‘ওহ মাই গড! ইয়োর ম্যাজেস্টি এটা একটা মারাত্মক ভুল হয়েছে।’ ‘কী করবো- পাগল হয়ে গিয়েছিলাম যে।’ ‘ঘটনা জটিল হয়ে গেল।’ ‘উচ্ছৃঙ্খল প্রিন্স ছিলাম তখন। বয়স কম ছিল। এখন আমার বয়স তিরিশ বছর।’ ‘চিঠিগুলো ফেরত পেতেই হবে।’ হোমস বললো। ‘চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি।’ হতাশ গলায় বললো বোহেমিয়ার রাজা।  ‘টাকা দিয়ে কিনে নিন ইয়োর ম্যাজেস্টি।’ ‘বিক্রি করছে না।’ ‘তাহলে চুরি করতে হবে।’ ‘পাঁচবার চেষ্টা করেছি। পেশাদার চোর দিয়ে দুবার তার বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি। একবার ভ্রমণের সময় তার লাগেজ সরালাম। আরেকবার তাকে থামিয়ে চেক করা হলো। সব বৃথা।’ ‘ছবিটা পাওয়া যায়নি?’ ‘না।’ হেসে উঠলো হোমস। ‘এ দেখি এক মজার রহস্য।’ বললো সে। ‘হ্যাঁ, কিন্তু আমার জীবন-মরণ সমস্যা।’ একটু ক্ষুণ্ন রাজার গলা। ‘অবশ্যই...অবশ্যই। ছবি দিয়ে কী করতে চায় ইরিন?’ ‘আমাকে ধ্বংস করতে চায়।’ ‘কীভাবে?’ ‘আমার বিয়ের সবকিছু ঠিকঠাক-’ ‘হ্যাঁ শুনেছি।’ ‘স্ক্যান্ডিনেভিয়ার রাজকন্যার সঙ্গে বিয়ে। তার পরিবার খুব রক্ষণশীল। এখন যদি এমন একটা স্ক্যান্ডাল প্রকাশ পায়, তাহলে বিয়েটা বরবাদ হয়ে যাবে।’ ‘ইরিন ঠিক কী করতে চায়?’ প্রশ্ন করলো হোমস। ‘কনের কাছে ছবি পাঠানোর হুমকি দিয়েছে সে।’ জবাব দিল রাজা। ‘ইরিন কাজটা ঠিকই করবে। আপনি তো তাকে চেনেন না- পাথর দিয়ে তৈরি তার মন। অপরূপ সুন্দরী নারী ইরিন, কিন্তু তার হৃদয় ইস্পাতের চেয়েও কঠিন। এ বিয়ে ভাঙবার জন্য সবকিছু করবে সে।’ ‘ছবি এর মধ্যেই পাঠিয়ে দেয়নি তো?’ ‘না দেয়নি।’ ‘কেন দেয়নি?’ ‘বলেছে এনগেজমেন্ট যেদিন হবে, সেদিন পাঠাবে। আগামী সোমবার এনগেজমেন্ট।’ ‘বেশ, তাহলে তিনদিন সময় আছে হাতে।’ হাই তুলতে তুলতে বললো হোমস। ‘এটা ভালো খবর। দু’একটা জরুরি কাজ সারতে হবে আমাকে। ইয়োর ম্যাজেস্টি এখন লন্ডনেই থাকবেন তো?’ ‘হ্যাঁ, ল্যাংহাম হোটেলে আছি আমি। কাউন্ট ভন ক্রাম নামে।’ ‘চিরকুট লিখে আপনাকে অগ্রগতির খবর জানাবো।’ ‘প্লিজ তাই করুন। খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে আছি আমি।’ ‘তাহলে, টাকা-পয়সার ব্যাপারটা?’ ‘ব্ল্যাঙ্ক চেক দিচ্ছি আপনাকে।’ ‘ব্ল্যাঙ্ক চেক?’ ‘মিস্টার হোমস, ছবিটার বিনিময়ে আমার রাজ্যের একটা প্রভিন্স দিয়ে দিতে রাজি আছি আমি ।’ ‘বেশ। কিন্তু এই মুহূর্তের খরচ?’ আলখাল্লার ভেতর থেকে ছোট একটা চামড়ার থলি বের করলো রাজা। টেবিলের উপর রাখলো। ‘এখানে তিনশ’ পাউন্ডের মোহর আছে, আর আছে সাতশ’ পাউন্ডের নোট।’ বললো সে। হোমস তার নোট বইয়ের পৃষ্ঠা ছিঁড়ে রসিদ লিখে রাজার হাতে দিল।  ‘মাদমোঁয়াজেলের ঠিকানা?’ জিজ্ঞেস করলো হোমস। ‘ব্রায়োনি লজ। সারপেন্টাইন এভিনিউ। সেন্ট জনস উড।’ ঠিকানা লিখে নিল হোমস। ‘শেষ প্রশ্ন।’ বললো সে। ‘ছবিটা কি কেবিনেট সাইজের?’  ‘হ্যাঁ।’ (চলবে...)

কবিতার শিরায় শিরায় স্বদেশ

কবিতার শিরায় শিরায় স্বদেশ

বাংলা সাহিত্যে হাসান হাফিজুর রহমান (১৯৩২-১৯৮৩) এক প্রবাদপ্রতিম নাম, যিনি কেবল একজন কবি নন, বরং একাধারে প্রাবন্ধিক, গল্পকার, সম্পাদক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবেও সুপ্রতিষ্ঠিত। তবে সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তিনি প্রধানত কবি এবং এই পরিচয়েই তিনি সর্বাধিক আলোচিত ও স্মরণীয়। বিশেষত পঞ্চাশের দশকে যখন বাংলা কবিতা ভাষা আন্দোলনের অভিঘাতে এক নতুন দিগন্তে প্রবেশ করে, তখন হাসান হাফিজুর রহমানের আগমন ঘটে এক স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর নিয়ে—যা ছিল দ্রোহে দীপ্ত ও স্বদেশভক্তিতে নিমগ্ন। হাসান হাফিজুর রহমান একজন  সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সমালোচক। ১৯৩২ সালের ১৪ জুন জামালপুর শহরে মাতুলালয়ে তাঁর জন্ম। পৈতৃক নিবাস জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার কুলকান্দি গ্রামে। তিনি  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫১ সালে বিএ এবং ১৯৫৫ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ভাষা আন্দোলন ও কবির হৃদয়বেদনা পঞ্চাশের দশকের কবিতায় ভাষা আন্দোলনের অভিঘাত ছিল ব্যাপক। ১৯৫২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারিতে নির্মিত প্রথম শহীদ মিনারটি পাকিস্তানি শাসকরা ভেঙে ফেললে, সে ঘটনার অভিঘাত কবির অন্তরকে রক্তাক্ত করে তোলে। এই হৃদয়বেদনা থেকেই তিনি সম্পাদনা করেন ঐতিহাসিক সংকলন ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’, যা কেবল সাহিত্যনির্মাণ নয়, বরং এক জাতীয় আত্মপ্রকাশের দলিল। এই সংকলন বাংলা ভাষার আন্দোলনকে সাহিত্যের ভাষায় রূপ দিয়েছে এবং কবিকে স্মরণীয় করে রেখেছে। দেশপ্রেমের অনন্য উচ্চারণ হাসান হাফিজুর রহমানের কবিতায় দেশপ্রেম একটি কন্দরের মতো ছায়াপাত করে। তিনি লিখেছেন:  “আমার হৃদপিণ্ডের মতো/আমার অজানা সামুতন্ত্রীর মতো/সর্বক্ষণ সত্য আমার দেশ/আমার দেহের আনন্দ-কান্নায় তোমাতেই আমি সমর্পিত।” এখানে কবি কেবল দেশকে ভালোবাসেননি, বরং দেশই তাঁর অস্তিত্বের প্রতীক হয়ে উঠেছে। ‘স্বদেশ’ তাঁর কাছে কেবল ভৌগোলিক পরিচয় নয়, বরং চেতনার স্পন্দন, হৃদয়ের আরাধ্য, আত্মার আত্মীয়। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ব্যক্তিগত শোক ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ তাঁর কবিতায় এসেছে এক করুণ অথচ দীপ্তিময় অভিঘাত হয়ে। যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাঁর দুই সহোদরকে হত্যা করে। এই ব্যক্তিগত শোক তাঁকে কাঁদায় না, বরং রূপ দেয় এক শিল্পসত্তায়, দ্রোহের ভাষ্যে: “একজন নয়, তোমার দুই দুটি সহোদরের রক্তে/ওরা মাটি ভিজিয়ে দিল/তবু তোমার শোক নেই কেন?/...আমি পারি না কাঁদতে/শুধু শিল্পীভূ হই শেষ আঘাতের অমোঘতায়।” এই উচ্চারণে একদিকে রয়েছে নিঃসীম শোক, অন্যদিকে রয়েছে বিপ্লবী কণ্ঠ যে কণ্ঠ কাঁদে না, বরং শিল্পে পরিণত হয়। সাহিত্যচর্চায় রাজনৈতিক বোধ তিনি ছিলেন সময়ের সচেতন সাক্ষী। পঞ্চাশ, ষাট, সত্তরের দশকের সকল রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, দমনপীড়ন, গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধ তাঁর কবিতার বিষয় হয়ে উঠেছে। তার কবিতায় ঘন ঘন উঠে এসেছে বরকত, রফিক, সালাম, জব্বারের নাম, এসেছে জাতীয় শোক ও জাগরণের মিশ্র প্রতিচ্ছবি: “এই এক সারি নাম বর্ষার ফলার মতো / এখন হৃদয়কে হানে।” এসব উচ্চারণে তিনি কেবল একজন কবি নন, বরং জাতির ইতিহাসের দায়ভার বহনকারী কণ্ঠ হিসেবে আবির্ভূত হন। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ও বৈশিষ্ট্য তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে: বিমুখ প্রান্তর (১৯৬৩) আর্ত শব্দাবলি (১৯৬৮) অন্তিম শরের মতো (১৯৬৮) যখন উদ্যত সঙ্গীন (১৯৭২) শোকার্ত তরবারী (১৯৮১) প্রতিবিম্ব (১৯৭৬) ভবিতব্যের বাণিজ্য তরী (১৯৮৩) বিশেষত ‘আর্ত শব্দাবলি’ এবং ‘অন্তিম শরের মতো’- এই দুটি কাব্যগ্রন্থে মুক্তি সংগ্রামে জাতির মানসপ্রবণতা প্রধান হয়ে উঠেছে। এসব কবিতায় কবি রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, গণচেতনা ও প্রতিরোধের ভাষা নির্মাণ করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, বাঙালি জাতি সব প্রতিকূলতা জয় করে এগিয়ে যেতে পারে। রোমান্টিকতা ও দ্রোহের সমন্বয় তাঁর কবিতায় শুধু রাজনৈতিক চেতনা নয়, রয়েছে রোমান্টিক অনুভবও। সমাজচেতনার পাশাপাশি প্রেম, প্রকৃতি ও মানবিক বোধও তাঁর কবিতায় জারিত হয়েছে। কিন্তু এই রোমান্টিকতা কখনো দুর্বল নয়; বরং দ্রোহের সঙ্গে এর এক অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটে। তিনি ছিলেন প্রেমিক ও দ্রোহীর এক অদ্ভুত সহাবস্থানে অবস্থানকারী কবি। বাংলাদেশ : শোক, সংগ্রাম ও স্বপ্নের প্রতীক স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সূর্যোদয়ে হাসান হাফিজুর রহমান নিজেকে প্রতিটি বীর শহীদ মা-বোন-যোদ্ধার সঙ্গে একাত্ম করে ফেলেন। তাঁর কবিতায় স্বাধীন দেশের স্বপ্ন যেমন ফুটে উঠেছে, তেমনি শোক ও বেদনার রক্তমাখা ইতিহাসও প্রতিধ্বনিত হয়েছে। সন্তানহারা মা যখন পতাকায় চোখ মুছে, তখন সেই দৃশ্য কবিকে স্পর্শ করে- কবিতা হয়ে ওঠে ইতিহাসের দলিল। হাসান হাফিজুর রহমান বাংলা কবিতাকে দিয়েছেন নতুন ভাষা, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি কেবল কবি নন, এক জনপদের যন্ত্রণার মুখপাত্র। তাঁর কবিতা শুধু শিল্পের নন্দনতত্ত্ব নয়, বরং সময়ের শ্রুতি ও সংগ্রামের ইতিহাস। তিনি আমাদের কণ্ঠস্বর, আমাদের স্বপ্ন, আমাদের দেশপ্রেম। স্বদেশকে ভালোবেসে কবিতা রচনার অনন্য নিদর্শন তিনি যিনি ছিলেন নিঃশর্তভাবে বাংলাদেশের কবি। 

ঘুণপোকা

ঘুণপোকা

থানকুনি পাতার সবুজাভ রসের গন্ধে বুঁদ হয়ে থাকতেন বুড়ো! উঠানের দক্ষিণ দিকে। কাঁঠালতলায় বসে ভাঙা শিল পাটায় ফাল্গুনের সকালবেলায় থানকুনি পাতা পিষে রস নিংড়ে নিতেন। আমকাঠের ভাঙা জলচৌকিতে ন্যুব্জ হয়ে বসে প্রতি সকালেই চলত তাঁর এই কর্মযজ্ঞ! পরনের নোংরা লুঙ্গি হাঁটুর ওপর তুলে ভূতলের দিকে ঝুকে লম্বাটে হাত দুটো পাটার উপর ব্যস্ত থাকত— ধীরগতিতে পিষতেন পাতাগুলো। পাতাগুলো পিষে কম্পিত হাতে রস নিংড়ে নিতেন একটা পেতলের গ্লাসে। বুড়ো যখন রস নিংড়ে নিতেনূ তখন সেই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে বেশ ভালোই লাগত। থেঁতলানো পাতাগুলো হাতের মুঠোয় পুরে নিয়ে বুড়ো যখন ঘুণে-ধরা জরাজীর্ণ শরীরের সম্পূর্ণ সামর্থ্য প্রয়োগ করে আঙুলগুলো মুঠো করে চাপ দিতেন ঠিক তখনই আঙুলে ফাঁক দিয়ে নীরক্ত কোঁচকানো চামড়া বেয়ে ঝরনাধারার মতো নেমে আসত সবুজ রসের ধারা গন্ধযুক্ত! পেতলের গ্লাসে টপটপ করে ঝরে পড়ত রস। একবিন্দুও রস ফেলা যাবে না। বুড়ো শেষবিন্দু অব্দি তালুতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চেপে যেতেন থেঁতলানো পাতার ছিবড়েটুকু! ঘরের বারান্দায় বসে বুড়োর প্রতি লক্ষ্য রাখতাম। তাঁর অদ্ভুত ধরনের কার্যকলাপে সকলেই আশ্চর্য চোখে তাকিয়ে থাকত। রোদ তেতে ওঠার আগেই রসটুকু পেটের ভেতর চালান করে দিতেন বুড়ো। পেতলের গ্লাসে সম্পূর্ণ রসটুকু নিংড়ে নেওয়ার পর তাতে সামান্য লবণ মিশিয়ে ঢকঢক শব্দ তুলে সাবাড় করে দিতেন দ্রুতবেগে। রোদ তখনও তেতে ওঠেনি কিংবা চড়াও হয়নি বুড়োটার রং নিভে যাওয়া চোখে তবুও তাঁর তাড়া। এক ধরনের অদ্ভুত অস্থিরতা তাঁকে আটপৌরে তাড়িয়ে বেড়ায় যেন। গন্ধযুক্ত রসের ধারা কণ্ঠনালী বেয়ে নামতেই মুখটি বিকৃত করে দাঁতে দাঁত চেপে খানিকক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে থাকেন তিনি! তেতো নাকি? নাকি অন্যকিছু? বাতিকগ্রস্ত মানুষেরা কি এমনই বুড়োর মতো? পেতলের গ্লাসটিতেই যেন লুকিয়ে আছে বুড়োর আয়ু পেতলের ওই বস্তুটি তাঁর এতই প্রাণের! আশ্চর্যের ব্যাপার এই গ্লাসটি সকালবেলাতেই দেখতে পাওয়া যায় তাঁর হাতে সারাদিনে আর দেখতে পাওয়া যায় না। কোথায় যে লুকিয়ে রাখেন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বুবুজান যখন বেঁচে ছিলেন প্রায়ই বলতেন ‘পেতলের ওই জিনিসটা আমার দাদাশ্বশুরের হাতের চিন্ন।’ শুধু এতটুকুই বলতে শুনতাম। বুবুজান যখন মারা গেলেন তারও অনেক পরে জানতে পারলাম পেতলের ওই গ্লাসটির ইতিবৃত্ত। গ্লাসটি বুড়ো অর্থাৎ আমার দাদাজানেরও দাদাজান ব্রিটিশ আমলে হাট থেকে ক্রয় করেছিলেন। ব্যবহার তো দূরের কথাূ বাড়ির কেউ স্পর্শও করতে পারত না ওই বস্তুটি। সারাক্ষণ লোহার সিন্দুকেই তালাবদ্ধ থাকত। হঠাৎ একদিন তাঁর আয়ু ফুরিয়ে গেল। তাঁর অনুপস্থিততে ক্রমে বাটোয়ারা হতে লাগল লোহার সিন্দুকে তালাবদ্ধ ধনরত্নের ভাণ্ডার। তাঁতের লুঙ্গি সিল্কের পাঞ্জাবি কাঠের একজোড়া খড়ম বাদামী রঙের খসখসে কাগজে মোড়া তোবড়ানো কয়েকটি নোট এবং পেতলের ওই বস্তুটি সবকিছুই বাটোয়ারা হলো। একেকজন ইচ্ছেমতো জিনিস নিয়ে নিল। বুড়ো বাটোয়ারার সময় ছিলেন না তাঁর বাবা ছিলেন। মফস্বল থেকে ফিরে দেখলেন জং-ধরা লোহার সিন্দুকে শুধু পেতলের একটা গ্লাস পড়ে আছে তিনি ওটাকেই হাতে তুলে নিলেন। তারপর থেকে ওটা তাঁর অধিকারে রয়ে গেল। একদিন তিনিও উধাও হলেন। বর্তমানে উত্তরাধিকার সূত্রে বুড়োই আগলে রেখেছেন জিনিসটাকে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলেই বুড়ো বারান্দায় মাদুর পেতে বসতেন। প্যাঁচার মতো নীরবতা যখন ক্রমে গিলে ফেলত বাড়িটাকেূ বুড়ো ঠিক তখনই অদ্ভুত শব্দ করে উঠতেন। বুবুজান যখন বেঁচে ছিলেনূ প্রায়ই বুড়োর এই অদ্ভুত অভ্যাসের জন্য গালমন্দ করতেন। অথচ বুড়ো একটুও তেজ দেখাতেন না টুঁ শব্দটিও করতেন না— ঝিম মেরে মাথা নিচু করে বসে থাকতেন। লোকটা ছিলেন অস্বস্তিকর ভয়ংকর বাতিকগ্রস্ত! সন্ধ্যার পর কারও সান্নিধ্যে থাকতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন না একা থ মেরে বসে থাকতেই যেন আনন্দ পেতেন। একটা সময় ছিলূ সন্ধ্যার পর বুড়ো মহানিম পাতার রস গিলতেন! বিশ্রী গন্ধযুক্ত তেতো সেই তরল অবলীলায় ঢকঢক শব্দে মুহূর্তেই গিলে ফেলার আশ্চর্য ক্ষমতা রপ্ত করে ফেলেছিলেন। বুবুজান ভীষণ বকাঝকা করতেন ‘অমন কি রোজ রোজ প্যাটে সইব? রোজ রোজ অমন বিষের মতো তেতো গিললে কি মানুষ বেশিদিন বাঁচব?’ বুড়ো বেঁচেছিলেন। কচ্ছপের মতো আয়ু নিয়েই মাতৃগর্ভ ছেড়ে পৃথিবীতে নেমে এসেছিলেন কিনা! মাঝেমধ্যে মনে হয় বুড়োটা হুট করেই হারিয়ে গেলেন। সত্যিই কি তাই? বুড়ো শুধু একা হারিয়ে যাননি। সবকিছু নিয়েই হারিয়ে গেছেন। স্বীকার করতে দোষ নেই। বুড়োর আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল— যাদুমন্ত্রবলে সবকিছুকে কেমন নাচাতে পারতেন! অঘ্রানমাসের এক বিকালবেলা নায়েব বাড়ির কাজের ঝিটা হন্তদন্ত হয়ে এল বুড়োর কাছে। ভরা সন্ধ্যা। বুড়ো সেই মুহূর্তে তেতো নিমের রসে পরিপূর্ণ পেতলের গ্লাসটি ডানহাতে ধরে ঝিম মেরে বসেছিলেন। ধ্যানস্থ ঋষির মতো স্থির। হঠাৎ ধ্যানভঙ্গ হলো। নায়েব বাড়ির ঝি রেবেকার ডাকে তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন বুড়ো ‘কে রে?’ রেবেকা আবছা অন্ধকারে বুড়োর পায়ের কাছে বসেই ডুকরে উঠল ‘আপনেই পারবেন! দাদাজানূ আপনেই পারবেন!’ বুড়ো খানিকক্ষণ থ মেরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তারপর হাতের গ্লাসটি রেবেকার দিকে এগিয়ে ধরে বলেছিলেনূ ‘নে মাগী! এইডা শ্যাষ কর আগে। সব হইব তোর।’ আশ্চর্য! মাসপাঁচেক পরই রেবেকার পেট কবরের মাটির মতো উঁচু হয়ে উঠল। জলচৌকিতে বসে বুড়ো প্রায়ই রোদ মাখতেন শরীরে। তখন বুড়োর ধারেকাছে কেউ ঘেঁষতে পারত নাূ কালেভদ্রে বুড়ো আমাকে ডেকে নিতেন। বলতেন ‘পিঠটা এট্টু দলাই মলাই কইরা দে তো। লাঠি লজেন আইনা দিমু!’ বুড়োর কাছ ঘেঁষতেই শরীর ঠিকরে বেরিয়ে আসত সোঁদা গন্ধ। কোঁচকানো চামড়া রোদে ভিজে উঠত। নরম রোদে চকচক করত। বাড়ির দক্ষিণদিকে কাঁঠালগাছটার পাশেই করমচাগাছ। গাছটির ঝাকড়া ডালপালায় রোদের ঝিলিক পিছলে পড়ত চৈত্রমাসের দুপুরগুলোয়।  বুড়োও চলে গেলেন এক চৈত্রের দুপুরে। সঙ্গে ওই করমচাগাছটিও নিয়ে গেলেন। তিনি অছিয়ত করেছিলেন ওই গাছটির নিচেই যেন তাঁকে কবর দেওয়া হয়। অছিয়ত পূর্ণ করা হয়েছিল। সেকারণেই অগত্যা করমচাগাছটিকে কেটে ফেলা হয়েছিল। এখন চৈত্রমাসের দুপুরগুলোতে রোদ দাপিয়ে বেড়ায় অথচ করমচার ডালে রোদের ঝিলিক পিছলে পড়ার সুদৃশ্য আর চোখে পড়ে না। গোয়ালঘরের পাশেই ছিল বিচালির স্তূপ। বৃষ্টিভেজা বিচালির সোঁদা গন্ধে একধরনের মাদকতা ছিল। বৃষ্টির দিনে টানা দুই-তিনদিন ধরে বৃষ্টি নামত। বৃষ্টি থামার পর যেদিন মখমলের মতো রোদ উঠতূ সেদিনই বিচালির সোঁদা গন্ধ ভেসে আসত নাকে। বুড়োর আয়ুর রেখা ধরে সবকিছু হারিয়ে গেছে যেন! সেই বিচালির সোঁদা গন্ধ এখন আর নাকে আসে না। বুড়ো নেই বাড়ির উঠানের গোয়ালঘরের পাশে যেখানে বিচালির পর্বতপ্রমাণ স্তূপ থাকত ওই সম্পূর্ণ জায়গাটি ফাঁকা বিরান। শূন্যতা খা খা করে আটপৌরে। বুড়োটা যেদিন মারা গেলেনূ তার সপ্তাহখানেক পরই বাবা গোয়ালঘরের সবগুলো গরু সস্তায় বেচে দিয়েছিলেনূ সঙ্গে পর্বতপ্রমাণ বিচালির স্তূপও। বাড়িটা ক্রমে স্তব্ধ হয়ে গেল। চারধারে অদৃশ্য নীরবতার দেওয়াল বেষ্টনী করে রাখত বাড়িটাকে। বাড়িও বুড়োটার মতো নীরবতাকে ভালোবাসে বোধহয়! বুড়োকে নিয়ে কানাঘুষাও কম ছিল না। মানুষের মুখে মুখে রটনা ছিল। বুড়োর নাকি দোষ ছিল। অবশ্য বুড়ো বেঁচে থাকতে কথাটি অত ঢাকঢোল পিটিয়ে কেউ বলেনিূ তখন শুধু কানাঘুষাই চলত। যেই তিনি মারা গেলেনূ অমনি মানুষের মুখের আগল যেন খুলে গেল মুহূর্তেই। নানা কথা রটতে লাগল বুড়োর নামে। চা দোকানে বসে বুড়োর নামে কুৎসা শুনতে লোকেরা উদগ্রীব হয়ে বসে থাকত। অত্যধিক নোংরা রং চটে যাওয়া চায়ের কাপ হাতে নিয়ে কলিমুদ্দিন নিচু স্বরে বলত ‘বুইড়ার দম কি আছিল? ওই বয়সে ক্যামনে পারল?’ চা দোকানের নড়বড়ে কাঠের বেঞ্চে বসে থাকা লোকেরা টঁত শব্দটিও করত না। একমুহূর্ত সকলেই নীরবে বসে থাকত। চারধারে কেবলই নীরবতা। তারপর আচমকা নীরবতা ভেঙে একজন বলে উঠতূ ‘রেবেকার স্বামীডা কি পুরুষ? হালায় মানল কি কইরা?’ মাঝেমধ্যে বুড়োকে নিয়ে বিপাকে পড়ি। সামান্য বিব্রতও হই। সত্যিটা কী? বুড়ো কি তাহলে রেবেকাকে সত্যিই? ঘোর ভাঙে। দাঁত দিয়ে জিভ কাটি। রেবেকার স্বামী অবশ্য লোকের কথায় কর্ণপাত করত না। দীর্ঘদিন করমচা খাই না। করমচা দেখলেই বুড়োর কথা মনে পড়ে। ছুটিতে বাড়ি যাই। প্রতিবারই ভাবি কবরের পাশে একটা করমচাগাছ লাগাব। ছুটি ফুরিয়ে যায়। গাছ আর লাগানো হয় না। আমার শৈশবটাকে রঙিন করে তুলেছিল বুড়ো। ইদানীং মাঝেমধ্যেই বুড়োর কীর্তিতে সত্যিই বিস্মৃত হই। পুরোনো একেকটি ঘটনা মনে পড়ে আর আশ্চর্য হই। বুড়োর মধ্যে কি এমন ছিল? নিমের তেতো রসেই কি রেবেকার পেটে সন্তান এল? নাকি বুড়োর অলৌকিক ক্ষমতা ছিল। যাদুটোনা জানতেন নাকি? তাছাড়া আরও অবাক হই বুড়োর রসের বাতিকের কথা ভেবে! একটা সুস্থ মানুষ কি করে ওগুলো খেতে পারতেন। নিমপাতার রস, থানকুনি পাতার রস। থানকুনি পাতার রস না হয় তেতো নয় দিব্যি খাওয়া চলে। কিন্তু নিমপাতার রস? গন্ধযুক্ত ঘন তেতো তরল রোজ সন্ধ্যায় কি করে গিলতেন ওই বুড়োটা? সেই দৃশ্য ভাবতেই বিবষিমা পায়। থানকুনি কিংবা নিমপাতার রসই হোক না কেন বুড়ো স্বস্তির সঙ্গেই খেতেন। যদিও রস মুখে নিয়ে গেলার সময় মুখের আকৃতি বিকৃত হয়ে যেত। চোখ দুটি বুঁজে থাকতেন। বুড়ো মারা যাবার কয়েকদিন পর এক বিকালে পেতলের ওই গ্লাসটিকে আবিষ্কার করে ফেলি! সকলেই গ্লাসটি তন্নতন্ন করে খুঁজেছে কেউ পায়নি। গ্লাসটি বুড়ো ঘরের পেছনের কাঠবাদাম গাছের তলায় হাঁটুসমান গর্তের ভেতর লুকিয়ে রাখতেন। গর্তটা কারো চোখে পড়ার জো নেই। এমনিতেই জঙ্গুলে জায়গা। তার উপর গর্তের মুখ শুকনো পাতা দিয়ে ঢাকা ছিল। বুড়োর বুদ্ধির তারিফ করতেই হয়ূ কায়দা জানতেন বেশ। লোহার সুটকেসের ভেতর গ্লাসটা যত্নে তুলে রেখেছি। আলাউদ্দিনের চেরাগের চেয়ে বস্তুটার মাহাত্ম্য কম কোথায়? মাঝেমধ্যে সুটকেস খুলে গ্লাসটা বাইরে নিয়ে আসি। নাকের সঙ্গে চেপে ধরে রাখি। থানকুনি কিংবা নিমপাতার রসের গন্ধ লেগে আছে কিনাূ নিরীক্ষা চালাই। গন্ধের কথা মনে পড়তেই বুকের ভেতর হুলস্থুল শুরু হয়ূ বুড়োকে নিয়ে কত স্মৃতি সেইসব স্মৃতির বাহারি গন্ধ দূরে কোথাও হাতছানি দিয়ে ডাকে। ছুটিতে বাড়ি এলে ঘরের পেছনে এসে দাঁড়াইূ মহানিমগাছটার নিচে। গাছটা তরতরিয়ে দ্রুতবেগে বেড়েই চলেছে যেন! গাছটার সঙ্গে কিছু একটা বলার চেষ্টা করি। ওর বয়স জানতে চাই। বুড়োর সঙ্গে ওর সম্পর্কের কথা জানতে চাই। অথচ গাছটি নির্বাক। বোবা হয়ে সহজাত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে। শুধু বাতাসে পাতাগুলো নড়েচড়ে উঠে। ততক্ষণে সোঁদা গন্ধ ভেসে আসে। দূরাগত সোঁদা গন্ধের সঙ্গে বাতাসে ভেসে আসে বুড়োর অস্পষ্ট কাশির শব্দ। মুহূর্তেই চোখের সামনে ভেসে উঠে করমচাগাছটিূ ঝলমলিয়ে ঢেউ খেলে যায় চৈত্রমাসের রোদ্দুর। কাঁঠালতলায় বুড়ো যেন বসে আছেন। ধনুকের মতো বাঁকা শিরদাঁড়া নিয়ে জলচৌকিতে বসে ঝুঁকে পাটায় থেঁতলে যাচ্ছেন থানকুনি পাতা। একমুহূর্তেই মগজটাকে মনে হতো একটুকরো কাঠ! কাঁঠাল কিংবা আমকাঠ। আর সেই কাঠে ক্রমশ একটা ঘুণপোকা যেন করাতের মতো শানিত দাঁত দিয়ে খুঁটে যাচ্ছে। কাঠের শরীরে ঘুণপোকা যেমনটা প্রভাববিস্তার করেূ অবিকল তেমনই। বুড়োর স্মৃতি ঘুণপোকার মতোই। আটপৌরে খুঁটে খুঁটে খেত। এখনও খায়।

কবর

কবর

আধুনিক বাংলা সাহিত্যভাণ্ডারে ‘কবর’ শিরোনামে দুটো সাহিত্য-কীর্তি অবিস্মরণীয়। একটি কবি জসীমউদ্দীন (১৯০৩-১৯৭৬) বিরচিত বাংলাদেশের লোকজীবন ও লোকভাষায় সমৃদ্ধ ‘কবর’ (প্র.প্র. ১৯২৫) কবিতা; অন্যটি ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী (১৯২৫-১৯৭১) রচিত কবর (প্র.প্র. ১৯৫৩) নাটক। ‘কবর’ কবিতার প্রথম পঙক্তি : ‘এইখানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে’। জসীমউদ্দীনের কবিখ্যাতি এনে দেওয়া কবিতার এই প্রথম পঙক্তিটি কবিজীবনের সঙ্গে কতোটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং অবিকল জীবনচিত্র তার অন্যতম অকাট্য প্রমাণ-‘জসীমউদ্দীনের অন্তিম ইচ্ছানুসারে ফরিদপুরের আম্বিকাপুর গ্রামে তাঁর দাদির কবরের পাশে তিনি সমাহিত’ (খান ও অন্যান্য, ২০১১ : ২৩৬)। আবার ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে (তাঁর জন্মভূমি ও মাতুলালয়) কবি যে ঘরে থাকতেন তার সামনে সিঁড়ি, সিঁড়ির দু’দিকে লেবু গাছ, মাঝখানে ডালিম গাছ। এই জায়গাটিই তাঁর কবিতার সৃষ্টির উৎসভূমি। কিশোরবেলায় জসীমউদ্দীন অনুপ্রাণিত হন দানু মোল্লা নামে এক অন্ধ দাদার কাছে কেচ্ছা শুনে। কবির ভাষায় : ‘আমার কবি জীবনের প্রথম উন্মেষ হইয়াছিল এই দাদার গল্প, গান ও কাহিনীর ভিতর দিয়ে’ (জসীমউদ্দীন, ১৯৭৬ : ৪৪)। সেই দাদার আত্মবিলাপ-স্বগতোক্তি দিয়েই রচিত ‘কবর’ কবিতাখানি। কবিতায় নিহিত এমন নিখাঁদ বা খাঁটি কাহিনী, ভাব ও ভাষা দেখে রবীন্দ্রনাথ ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন: ‘জসীমউদ্দীনের কবিতার ভাব, ভাষা ও রস সম্পূর্ণ নতুন ধরনের। প্রকৃত কবির হৃদয় এই লেখকের আছে। অতি সহজে যাদের লেখবার শক্তি নেই, এমনতর খাঁটি জিনিস তারা লিখতে পারে না (উদ্ধৃত, আনিসুজ্জামান, ২০১৫: ১৯০)। তাই ‘কবর’ কবিতার কাব্যভাষা বিশ্লেষণের মধ্যদিয়ে কবি জসীমউদ্দীনের কাব্যরস আস্বাদন এবং কবি-হৃদয়ের স্বরূপ উন্মোচিত হয়।  বিশ্বসাহিত্যে কাব্যভাষার দিকে দৃষ্টি ফেরালে দেখা যায়, ইউরোপীয় রেনেসাঁসের যথার্থ সূচনা দান্তে (১২৬৫-১৩২১) থেকে। দান্তে দি ইলাসট্রিয়াস ভার্নাকুলার নামক ল্যাটিন ভাষায় লিখিত বইয়ে লাতিন ভাষার বিরোধিতা করে সাহিত্যক্ষেত্রে সর্বপ্রথম মার্জিত প্রাদেশিক ভাষার জয় ঘোষণা করেন। রেনেসাঁসের বড় বৈশিষ্ট্য লাতিনের দাসত্ব থেকে লোকভাষাকে মুক্তিদান। সেই মুক্তিমন্ত্রের প্রথম পূজারী দান্তে। তাঁর মতে কবির মাতৃভাষাই কাব্যভাষা হওয়া দরকার; লাতিনের মতো কৃত্রিম ভাষার সে-গৌরব প্রাপ্য নয়। এজন্য ইতালির বিভিন্ন উপভাষা নিয়ে বিচার করে তিনি এ সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, ইতালিতে প্রচলিত যে-সমস্ত উপভাষা আছে তার মধ্যে যেটি প্রকাশক্ষমতায় শ্রেষ্ঠ, সেটি হবে সাহিত্যের ভাষা। এরই ধারাবাহিকতায় আবির্ভূত হন ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়র (১৮২১-১৮৬৭), ইংরেজ কবি টি এস এলিয়ট (১৮৮৮-১৯৬৫) প্রমুখ। তিরিশের দশকে আবির্ভূত প্রধান বাঙালি কবিগণ প্রধানত বোদলেয়র ও টি এস এলিয়টের কাব্যভাষা এবং রূপকল্প ব্যবহারের চমৎকারিত্বে আকৃষ্ট হয়ে একটি অ-রাবীন্দ্রিক কাব্যভুবন নির্মাণে ব্রতী হন এবং সম্মিলিত প্রয়াসে সৃষ্টি করেন তিরিশোত্তর বাঙলা কবিতার পটভূমি (আনোয়ার, ১৯৯৭: ৪৭)। জসীমউদ্দীন উচ্চশিক্ষিত, নগরজীবন সম্পর্কে অবহিত এবং সমকালীন কাব্যান্দোলনের সঙ্গে পরিচিত হয়েও নাগরিক জীবনের জটিলতাকে সন্তর্পণে এড়িয়ে গ্রামীণ মানুষের সহজ জীবনবৃত্ত ও তাদের আবেগ-অনুভূতিকে কাব্যরূপ দান করে বাংলা সাহিত্যে ‘পল্লীকবি’ হিসেবে অসামান্য প্রতিষ্ঠা অর্জনে সমর্থ হন (মুখোপাধ্যায়, ২০০২: ৬২)। তাঁর ‘কবর’ কবিতা থেকে শুরু করে অধিকাংশ কবিতার কাব্যভাষায় প্রতিফলিত-একেবারে সোজাসুজি মর্মস্পর্শ করবার আকুলতা। কোনো ‘ইজম’-এর ছাঁচে ঢালাই করা নয় বলে তাঁর কবিতা হয়তো জনতোষিণী নয়, কিন্তু মনোতোষিণী (সেনগুপ্ত, ১৯৮৮: ১০৪)। তিনি মূলত বাংলার শ্যামল গাঁয়ের জলমাটিহাওয়া ও তার মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনাকে আধুনিক সময়ের জাঁতাকলে উন্মেচিত করতে চেয়েছেন (মুস্তাফা, ২০২০)। তাঁর কাব্যভাষাও তাই গাঁয়ের জলমাটিহাওয়ার মতো সাধুভাষারীতির সঙ্গে প্রমিতভাষা আর লোকভাষার মিশেল এক সুরেলা মিষ্টি-মধুর বাংলা ভাষা। আক্ষেপের বিষয় পাশ্চাত্য আধুনিকতার তত্ত্বে-বয়ানে বিভ্রান্তিতে ডুবে বাংলাদেশের বেশিরভাগ কাব্যালোচক জসীমউদ্দীনের কাব্যভাষা বিশ্লেষণে বা তাঁর নন্দনতত্ত্ব নিরূপণে ব্যর্থতায় ডুবে গিয়ে পান্ডিত্য প্রমাণের ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়েছেন। যেমন: কারও মতে, জসীমউদ্দীনের কবিতার ভাষা প্রমিত বাংলাই, তার সঙ্গে মিশেল আছে আঞ্চলিক শব্দের-কিছু, কিন্তু প্রচুর নয় (আনিসুজ্জামান, ২০১৫ : ১৮৭)। কেউ আবার আরেকটু ঘুরিয়ে ‘কবর’ কবিতার আলোচনায়-একই কথা বলেছেন এভাবে: ‘আঞ্চলিক শব্দের সঙ্গে প্রচলিত ছন্দ ও প্রমিত ভাষার সমন্বয়ে এক নিজস্ব কাব্যভাষা নির্মাণে কবি জসীমউদ্্দীন সক্ষম হন’ (মুস্তাফা, ২০২০)। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের এইচএসসি শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে ‘কবর’ কবিতার আলোচনায় আছে: ‘আথালে- গোহালে (আথালে আঞ্চলিক শব্দ, পল্লী কবিদের রচনায় পাওয়া যায়)। ... মাথাল-খড় বাঁশের পাতা ইত্যাদি দিয়ে তৈরি ছাতা বিশেষ। গ্রামের কৃষকেরা হাতে তৈরি ছোট এ ছাতা মাথায় টুপির মতো করে পরে। রোদ বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচায়। এটি আঞ্চলিক শব্দ। মজীদ- মসজিদ (আঞ্চলিক শব্দ) (ঘোষ, ২০১৬: ১৫৫)। আরও বিস্ময়ের বিষয়: উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐ বইয়ে ‘গেনু’ শব্দকে আঞ্চলিক বলে শেখানোর প্রয়াস। অথচ কে না জানে ‘গেনু’ পদটি ‘গেলাম’ ক্রিয়াপদের কাব্যিক রূপ। বাংলাদেশ এনসিটিবি প্রকাশিত উচ্চমাধ্যমিক বাংলা সংকলন (২০০১) বইটতে: ‘আথালে’, ‘মাথাল’ বা ‘মজীদ’ শব্দ তিনটির কোনোটিকেই ‘আঞ্চলিক শব্দ’ বলা হয়নি। তবে এখানে আছে নতুন তথ্য: ভেস্ত-নসিব হয়- ভাগ্যে যেন বেহেশতের সুখ লাভ ঘটে। ‘বেহেশত’ শব্দের বিকৃত রূপ-ভেস্ত।... বা-জান- ‘বাপজান’ শব্দের সংক্ষিপ্ত আঞ্চলিক রূপ। পিতা (হক, ১৯৯৮: ৪১৭)। বাংলাদেশে কাব্যালোচনা-পাঠ্যবই সবটাতেই জসীমউদ্দীনের কাব্যভাষা নিয়ে এমন উদ্ভট বিভ্রান্তিকর বয়ান-বক্তব্যের কারণ অনুসন্ধানে আমরা হাজির হই ‘সদানন্দ’ খ্যাত পণ্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ সমীপে। তাঁর সম্পাদিত বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান-এর ভুক্তিতে ‘কবর’ কবিতায় ব্যবহৃত ৮৯৫ শব্দের কোনোটি আমাদের চোখে পড়েনি। অবশ্য , ঐ অভিধানে আছে-‘আথালে’ খুলনা-যশোর অঞ্চলে মাচা পাতিবার উপকরণ অর্থে বিশেষ্য পদ রূপে প্রচলিত (শহীদুল্লাহ, ১৯৬৫: ৭০)। সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান-এ আছে: ‘আথাল বি. গোশালা; গোয়াল ঘর’ (শরীফ, ১৯৯৬: ৪৬)। সুতরাং শব্দটি কোনো মতেই আঞ্চলিক নয়; বড়জোর লোকশব্দ ছিল। তবে বর্তমানে তা প্রমিত বাংলা শব্দ হিসেবেই প্রমিত ভাষার অভিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়ে আছে। ‘কবর’ কবিতায় ব্যবহৃত ‘মাথাল’ শব্দটিও আঞ্চলিক নয়। আঞ্চলিক অভিধানে ‘মাথাল’ ভুক্তিটি আছে ময়মনসিংহ অঞ্চলে প্রচলিত শব্দ রূপে। এর অর্থ মাথার দিকে। যেমন: গেরামের উত্তর মাথালে আমার বাড়ি (শহীদুল্লাহ, ১৯৬৫: ৮৪৯)। সুতরাং কৃষকের মাথার ছাতা অর্থে ব্যবহৃত ‘মাথাল’ আঞ্চলিক শব্দ নয়। এটিও লোকসংগীতে ব্যবহৃত লোকশব্দ। আর ‘মসজিদ’ অর্থে ‘মজীদ’ এবং ‘বেহেস্ত’ অর্থে ‘ভেস্ত’ শব্দের প্রয়োগ যে মাত্রাবৃত্ত ছন্দের প্রয়োজনে তা বলা বাহুল্য। অবশ্য এই পরিবর্তন কবির শৈলীর পরিচয়ও বটে। আরেকভাবে বলা যায়, কবিরা সমাজ-সংসার-সংগ্রামের কথা লিখবেন। এ সব কথা লিখতে গিয়ে শব্দ চাতুরির আশ্রয় নিলে, বিশেষ কোনো কথন-ভঙ্গির আশ্রয় নিলে দোষ নেই (সৈকত, ২০১১)। সুতরাং কবির ব্যবহৃত শব্দকে বিকৃত শব্দ বলা যায় না, অন্তত ঐ কবির কাব্যোলোচনায় তো নয়ই। এভাবে ‘কবর’ কবিতার প্রতিটি শব্দ বিশ্লেষণ করে দেখানো যায় এখানে কবি জসীমউদ্দীন কোনো আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করেননি। অবশ্য পল্লীর একটি আবহ তৈরির স্বার্থে সাধু-চলিত ভাষার সঙ্গে লোকভাষার শব্দভাণ্ডারে মিশ্রণ ঘটিয়ে নির্মাণ করতে হয়েছে তাঁর কাব্যভাষা।  জসীমউদ্দীনের কাব্য-সমালোচকদের মধ্যে ব্যতিক্রমী বক্তব্য পেশ করেন কবি হাসান হাফিজুর রহমান। তিনি যথার্থই মনে করেন, জসীমউদ্দীনের হাতে লৌকিকজীবন ও লোক-উপকরণ আধুনিক আঙ্গিকে ও রুচিতে সজ্জিত হয়ে পরিবেশিত হওয়া মাত্রই স্বীকার ও গৃহীত হতে এতটুকুও দেরি হল না (রহমান, ১৯৯৪: ৫১৪)। জসীমউদ্দীন লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান কাব্যে ব্যবহার করে লোকায়ত জীবনেরে স্পর্শ করেছেন (হায়দার, ২০১২: ৪৮)। কবিতায় লোকভাষা ব্যবহার করে নতুন কাব্যভাষা সৃষ্টির পাশাপাশি  বাঙালি লোকজীবনের গভীরে তাঁর পাঠককে প্রবেশ করাতে পারঙ্গমতার স্বাক্ষর রেখেছেন।   বাংলাদেশের সাধারণ জন-মানসের জীবন-উপকরণকে তাঁদের মুখের ভাষায় উপস্থাপন করতে গিয়ে জসীমউদ্দীন চলিত ভাষারীতির ক্রিয়াপদের সঙ্গে একই পঙ্ক্তিতে বসিয়েছেন সাধু ভাষারীতির ক্রিয়াপদ। বাংলাদেশের ভাষারূপ সম্পর্কে অধ্যাপক সলিম্মুল্লাহ খান যথার্থই বলেন, ‘আমরা যখন কথা বলি তখন তো চলিত রীতির ক্রিয়া ব্যবহার করি না। একটু লম্বা ক্রিয়া ব্যবহার করি। আমার ক্রিয়াটা আরেকটু লম্বামাত্র (আজম, ২০১৮)। জসীমউদ্দীনও তাঁর ‘কবর’ কবিতায়-সাধু, চলিত ও কাব্যিক এই তিন ধরনের-লম্বা-মাঝারি-বেঁটে ক্রিয়াপদগুলোকে একত্রে বসিয়ে কাব্যভাষায় একটা সুরেলা-সরলতা সৃষ্টি করেছেন। যেমন:  এখানে ওখানে ঘুরিয়া (সাধু) ফিরিতে (সাধু) ভেবে (চলিত) হইতাম (সাধু) সারা, সারা বাড়ি ভরি এত সোনা মোর ছড়াইয়া (সাধু) দিল কারা! সোনালি ঊষার সোনামুখ তার আমার নয়নে ভরি (কাব্যিক) লাঙল লইয়া (সাধু) খেতে ছুটিতাম (সাধু) গাঁয়ের ও-পথ ধরি (কাব্যিক)। এখানে লক্ষণীয় রবীন্দ্র-কাব্যে ব্যবহৃত ক্রিয়াপদের কাব্যিক রূপ ভরি, ধরি, গেনু ইত্যাদি ইত্যাদি বর্জনের তাগিদ ত্রিশের দশকের আধুনিক কবিগণ অনুভব করেন। তবে জসীমউদ্দীন এগুলো বর্জনের আগ্রহ দেখাননি (মাহমুদ, ২০০৯ : ১৭৪)। তাঁর কাব্যভাষায় তিনি ‘ভিজিয়ে রেখেছি’ বলেননি, ‘ভিজাইয়া রাখিয়াছি’ ও না; তিনি লেখেন, ‘ভিজায়ে রেখেছি’ এবং এভাবে কবি তৈরি করেন স্বকীয় স্বতন্ত্র ভাষাশৈলী। এই ভাষাশৈলীর গুণেই কবিতায় মৃত্যুর মুহুর্মুহু উপস্থাপনা সত্ত্বেও সংযম সহাবস্থান করে। আবার সরলতার পাশাপাশি আবেগী তীব্রতার কারণে অনায়াসে গালিবাচক শব্দও কাব্যভাষায় প্রবেশ করে ভাষাকে কলুষিত না করে, বরং করে তোলে শিল্প-সুষমায় মণ্ডিত। যেমন: ‘শ্বশুর তাহার কশাই চামার, চাহে কি ছাড়িয়া দিতে’। এখানে শ্বশুরের হিংস্রতাকে মাংস ব্যবসায়ী ও চামড়া ব্যবসায়ীর সঙ্গে তুলনা করতে গালিবাচক শব্দের ব্যবহার কবির আবেগের তীব্রতাকে গতি দিয়েছে; নাতনির করুণ পরিণতিকে আরও গাঢ় আবেগে ভরিয়ে দিয়েছে, নারীনির্যাতনের ক্ষোভকে করেছে বাস্তবানুগ। ‘কবর’ কবিতায় পুত্রহারা দাদুর কণ্ঠে যখন ধ্বনিত হয়:  তোমার কথার উত্তর দিতে কথা থেমে গেল মুখে, সারা দুনিয়ার যত ভাষা আছে কেঁদে ফিরে গেল দুখে! তখন পাঠকমাত্রেই ভাবতে বাধ্য এমন করুণ-বাস্তব বর্ণনার জন্যে জসীমউদ্দীনের কাব্যভাষার বিকল্প নেই। আর এ কারণেই শতবছর পরেও দুই রাষ্ট্রে বিভক্ত দুই বাংলায় জসীমউদ্দীন রচিত ‘কবর’ বহুল পঠিত ও নন্দিত কবিতা। জসীমউদ্দীন বিশ শতকের তিরিশের দশকের কাব্যান্দোলনে শরিক হলেও তিনি আধুনিকতার নামে রবীন্দ্র-বর্জনে যেমন বিশ্বাসী ছিলেন না, তেমনি পাশ্চাত্যমুখীও ছিলেন না। তাঁর কাব্যের বিষয়ে যেমন আবহমান বাংলার লোকজীবন ও সংস্কৃতি সমুজ্জ্বল, তেমনি বঙ্গজনপদের সাধারণের লোকভাষাও ঠাঁই পেয়েছে তাঁর কাব্যভাষায়। আমাদের নন্দনতাত্ত্বিকগণ বিশ্বসাহিত্যের আধুনিকতার বয়ানে বিভ্রান্ত অথবা তাঁরা লোকভাষা এবং আঞ্চলিক ভাষা- এই দুই উপভাষার ব্যবধান সম্পর্কে সম্যক অবগত নয় বলে পল্লীকবির ভাষাকে আঞ্চলিক ভাষা বলে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন। অথচ একটু সতর্কতার সঙ্গে অবলোকন করলে অনুধাবন করতে অসুবিধা হয় না যে, জসীমউদ্দীনের ‘কবর’ কবিতার কাব্যভাষায় বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মুখের ভাষাকেই অবলম্বন করেছেন। এখানে সাধু-চলিত ভাষারীতির ক্রিয়াপদ যেমন আছে তেমনি লোকভাষার অনেক শব্দ রয়েছে, রয়েছে কাব্যিক ক্রিয়াপদও। সবকিছু মিলে এই কাব্যভাষা আমাদের প্রাত্যহিক পল্লীজীবনের মৌখিক ভাষার এক পরিমার্জিত কাব্যিক রূপ বলা যায়। শতবছর পরে আজও তাই আনন্দে অবগাহন করি জসীমউদ্দীনের কাব্যভাষায়।

তোমাদের জন্য ছড়ার বই

তোমাদের জন্য ছড়ার বই

শিশুতোষ ছড়া, কবিতা, গল্প ও উপন্যাস সবখানেই তার উজ্জ্বল উপস্থিতি। তার লেখায় রয়েছে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য। বর্তমান সময়ে যারা শিশুসাহিত্য নিয়ে কাজ করছেন শিশুসাহিত্যিক হাসনাইন আহমদ তাদেরই একজন। শিশু-কিশোরদের জন্য ভাল লেখার অদম্য আগ্রহ তার মধ্যে প্রবল। দীর্ঘ বাইশ-তেইশ বছরের অধিক সময় ধরে নীরবে-নিভৃতে সাহিত্যচর্চা করে যাচ্ছেন; বিশেষ করে শিশুসাহিত্য। তার লেখা বিভিন্ন মাসিক পত্র-পত্রিকা থেকে শুরু করে সাপ্তাহিক ও জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। ‘মেঘ পাখি ও প্রজাপতির ছড়া’ তার প্রথম শিশুতোষ ছড়ার বই। বইটিতে মোট বিশটি ছড়া স্থান পেয়েছে। আলোচ্য ‘মেঘ পাখি ও প্রজাতির ছড়া’ বইয়ের কয়েকটি ছড়ার কিছু অংশ পাঠকদের জন্য উল্লেখ করা হল। ‘গ্রীষ্মতে’ ছড়ায় গ্রাম আর শহরের বাস্তব চিত্র অসাধারণ নৈপুণ্যে ফুটিয়ে তুলেছেন ছড়াকার। যেমন, ‘কড়-কড় গ্রীষ্মতে নেড়ে যায় কড়া/ টক্ টক্ রস্ রস্ মিষ্টিতে ভরা/ আম জাম থোকা থোকা, টক্ টক্ লিচু/ লাফ মেরে খাও পেড়ে, গাছ দেখে নিচু/ শহরের ছেলেদের এই সুখ নেই/ ওরা শুধু বাজারের কেনা ফলেতেই।’ বইয়ের প্রথম ছড়া হল ‘ছুটি’। ছুটির আমেজ শিশু-কিশোদের মনে  কিভাবে ধরা দেয়। তার একটি চিত্র তুলে ধরেছেন। যেমন, ‘আজকে আমার ছুটি/ সেই খুশিতে আনন্দে মন হেসেই কুটিকুটি/চোখ বুজে ফের ভাবিÑ/ বাবার কাছে করব আজই/মুক্তি পাওয়ার দাবি/ ইটের পাঁজর ছেড়ে/ ডাকছে শুনি বুনোপাতা/দু’হাত নেড়ে নেড়ে।’ ছড়া নির্মাণে অবাক করা মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন ছড়াকার এই ছড়াটিতে। যা যে কোন বোদ্ধা পাঠককে বিমোহিত করবে। এছাড়াও শিশু-কিশোদের আনন্দ দেওয়ার জন্য বেশকিছু ছড়া এ বইটিতে স্থান পেয়েছে। যেমন, ‘দাদির কাছে শুনছি বসে/ পুরান দিনের গল্প/ এই জামানায় সবই নাকি/ সেই তুলনায় অল্প। (পুরান দিনের গল্প)। ছোটদের কল্পনার রাজ্য অনেক বড়। নিজের মত করে কল্পনা করতে ভালোবাসে। কল্পনায় কতকিছু না ভাবে তারা। বইয়ের ‘হতাম যদি’ শিরোনামের ছড়াটিতে যেমনটি রয়েছেÑ ‘রঙধনুরা রঙ ধরে যে/ কোথায় তাদের দেশ/ ইচ্ছে করে তাদের খোঁজে/ চলতে নিরুদ্দেশ/ কোথায় তাদের ঘরবসতি/ কোথায় রঙের চিন/ খুঁজে পেতাম সবই আমি/ হতাম যদি জিন।’ যারা ছড়া লেখে বা লেখার ইচ্ছে আছে, তারাও এই বইটি পড়লে উপকৃত হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। লেখায় নতুনত্ব, বৈচিত্র্য ও আধুনিকতা এসব সব ছড়ার বইতে থাকে না। ফলে নতুন লেখক বিভ্রান্ত হয়। ‘মেঘ পাখি ও প্রজাপতির ছড়া’ একটি আধুনিক ছড়ার বই। লেখক মেধাবি, পরিশ্রমী এবং প্রতিশ্রুতিশীল। যেমন, ‘নারকেলের ওই পাতার ফাঁকে/ চাঁদের নীরব হাসি/ পিয়াল বনে আছড়ে পড়ে/ জোছনা রাশি রাশি।  ছড়াশিল্পী হাসনাইন আহমদ তাল-লয়-ছন্দ এবং অন্ত্যমিলের চমৎকার মেলবন্ধনে নির্মাণ করেছেন অসাধারণ সব ছড়া। ছোট-বড় সবাই বইটি পড়ে মুগ্ধ হবে। প্রখ্যাত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘ছোটদের সময়’ এই বইটি প্রকাশ করেছে। প্রচ্ছদ এঁকেছেন রজত। আর প্রতিটি ছড়ার সাথে সঙ্গতি রেখে অসাধারণ অলংকরণ করেছেন পার্বতী ঘোষ। বই এবং লেখক সম্পর্কে লিখেছেন বিখ্যাত ছড়াকার ও শিশুসাহিত্যিক আমিরুল ইসলাম। বইটির প্রথম প্রকাশ, অমর একুশে বইমেলা ২০২২। মূল্য ২০০ টাকা। বইটির ব্যাপক প্রচার-প্রসার ও পাঠকপ্রিয়তা কামনা করি। সেই সাথে ছড়াকার হাসনাইন আহমদের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা।

হারিয়ে যাওয়া হরিণ

হারিয়ে যাওয়া হরিণ

কলেজ রোডের শেষ মাথায় একটা আধা-ভাঙা বাড়ি, নাম ‘শিউলি নীড়’। এই বাড়ির নিচতলায় থাকে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র নাহিয়ান, সবাই ডাকে ‘নাহি’ নামে। হালকা পাতলা গড়ন, বুদ্ধিতে ঝাঁঝালো মরিচ। বয়স তেরো হলেও কথাবার্তায় যেন বিশ বছরের পুরনো মেজাজ! নাহির সঙ্গী দু’জন। ইমরান আর শ্রেয়া। ইমরান একটাই শার্ট পরে তিনদিন স্কুলে গেলেও দুনিয়ার খবর জানে খবরের কাগজের থেকেও বেশি। শ্রেয়ার কথা বললে আলাদা করে বলতে হয়। চুলে সবসময় দুটো পেনসিল গোঁজা থাকে। যেকোনও সময় কেউ যদি অঙ্ক না পারে, পেনসিলটা টেনে বের করে শ্রেয়া বলে, ‘আমি করে দিই।’ এই তিনজন মিলে একটা ক্লাব খুলেছে, ‘স্লিপার গ্যাং গোয়েন্দা ক্লাব’। নামটা এসেছে- কারণ সবাই ক্লাসে স্লিপার পরে আসে। বিকেলের দিকটা বেশ নিরীহ। নাহি বারান্দায় বসে চিপস খাচ্ছিল, হঠাৎ গেটের সামনে টিকটিক করে একটা শব্দ। নিচে নেমে দেখে- তিন তলার শম্পা আন্টি দাঁড়িয়ে, মুখ গম্ভীর। ‘নাহি, একটা ব্যাপার হয়েছে। তুমি গোয়েন্দা বলেই তো শোনালাম। আমাদের বাসার ট্যাক্সিডার্মি হরিণটা হারিয়ে গেছে!’ নাহি চোখ কুঁচকে বলে, ‘ট্যাক্সিডার্মি মানে?’ ‘মানে, মরার পর সংরক্ষণ করা হরিণ। তোমার আঙ্কেলের শখে কেনা ছিল। জিনিসটার দাম পঁচিশ হাজার টাকা!’ এই কথা শুনেই ইমরান বলে ওঠে, ‘মরা হরিণ হারায় কিভাবে? ও তো নড়তে পারে না!’ শম্পা আন্টি বলেন, ‘কাল  রাতে বারান্দায় ছিল। সকালে দেখি নাই।’ নাহি চিপসের টুকরো মুখে দিয়ে বলে, ‘মানে, চোর মরা হরিণ চুরি করেছে? বেশ মজার লাগছে।’ শ্রেয়া গম্ভীর, পেনসিল খুলে হাতে নেয়। ‘চুরি যেহেতু হয়েছে, রহস্যও আছে। কাজ শুরু করা যাক।’ বললো শ্রেয়া। প্রথমেই তারা ওঠে তিনতলায়। শম্পা আন্টির বারান্দা ঘেঁষে আছে পরের বিল্ডিংয়ের দেয়াল, যেটা সিমেন্টের পুরোনো প্যাচে ভর্তি। নাহি দেয়ালে আঙুল রাখে, ধুলা মোছে। ‘এখান দিয়ে কেউ আসা-যাওয়া করেছে। এটা পায়ে ঘষা দাগ।’ ইমরান মোবাইল দিয়ে ছবি তোলে। বলে, ‘এটা তো ঝুমঝুমি বিল্ডিং। ওই বাড়িতে তো একটাই ছেলে থাকে, তানভীর।’ শ্রেয়া বলে, ‘চলো, একবার কথা বলা যাক।’ তানভীর একাই থাকে, কারণ তার মা-বাবা বাইরে থাকেন বেশি। সে কম কথা বলে, তবে গেমিংয়ে ওস্তাদ। নাহি দরজায় নক করে, তানভীর দরজা খোলে, হাতজোড়া গেম কন্ট্রোলারে। ‘তুই কি কাল রাতে তিন তলায় গেছিলি?’ নাহি সরাসরি প্রশ্ন করে। তানভীর কাঁধ ঝাঁকে- ‘না, কেন?’ শ্রেয়া বলে, ‘তোর দেয়ালের ধারে পায়ের দাগ।’ তানভীর বিরক্ত হয়ে বলে, ‘আমি সারা রাত অনলাইনে ছিলাম। তবে আমি কাল রাতে একটা ছায়া দেখেছিলাম জানালা দিয়ে।’ ‘কী রকম?’ ইমরান আগ্রহে বলে। ‘ছায়াটা লম্বা ছিল, আর ওর পিঠে যেন কিছু ছিল। আমি ভাবছিলাম হ্যালুসিনেশন।’ রাতে নাহি, শ্রেয়া আর ইমরান ফের তদন্ত করতে বারান্দায় আসে। চাঁদের আলোয় নাহির চোখ পড়ে- একটা সাদা কিছু আটকে আছে পরের দেয়ালে। ‘ওইটা কি?’ শ্রেয়া পেনসিল দিয়ে দেখায়, ‘হরিণের লেজ!’ তারা নিচে নেমে দেয়াল টপকে পরের প্লটের ভেতর ঢুকে পড়ে। প্লটটা পরিত্যক্ত, কিন্তু হঠাৎ তারা দেখে, একটা হাফ ভাঙা শেডের নিচে হরিণটা দাঁড়িয়ে! নাহি হেসে ফেলে। বলে, ‘চোর যদি হরিণ রেখে পালায়, তবে এটা চুরি না, এটা পরিকল্পনা।’ পরদিন সকালে তারা ফের শম্পা আন্টির কাছে যায়। হরিণ ফেরত দিয়ে বলে, ‘এটা কোনো চোর নেয়নি।’ ‘তাহলে?’ শম্পা আন্টি চমকে ওঠেন। নাহি হাসে। ‘আপনার ছেলে, যে হোস্টেলে থাকে, কালকে সে এসেছিল, আপনি না থাকায় হরিণ দেখে ভয় পেয়ে বারান্দা থেকে নামিয়ে পাশের প্লটে রাখে।’ ‘তোমরা কীভাবে জানলে?’ আন্টি বিস্মিত। ইমরান বলে, ‘দেয়ালে পায়ের ছাপের পাশেই চিপসের প্যাকেট ছিল, আপনার ছেলেরই পছন্দের চিপস।’ শ্রেয়া বলে, ‘আর হরিণের গলায় আপনার ছেলের নাম লেখা স্টিকার ছিল, ভুলে রেখে গেছে।’ শম্পা আন্টি মাথা নাড়েন। ‘বাহ! তোমরা তো আসলেই ছোট গোয়েন্দা!’ ক্লাব রুমে ফিরে ইমরান বলে, ‘এইটা তো চুরির কেস না, ভয় পাওয়ার কেস!’ নাহি হেসে বলে, ‘কিন্তু রহস্য তো ছিল! আর আমাদের ক্লাবের নাম তো ‘স্লিপার গ্যাং’। আমরাই শহরের একমাত্র গোয়েন্দা যারা স্লিপার পায়ে রহস্য ধরতে পারি!’ তিনজন হাই ফাইভ করে। শ্রেয়া বলে, ‘পরের কেস কার জানি!’ আর বারান্দার কোণে পড়ে থাকে সেই পুরনো হরিণ, চুপচাপ, গম্ভীর, আর হালকা চিপসের গন্ধে ঘেরা।