ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ৫ মাঘ ১৪৩১

সাহিত্য

অ্যালেক্সান্দর সোলঝেনিৎসিনের দুটি কবিতা

অ্যালেক্সান্দর সোলঝেনিৎসিনের দুটি কবিতা

রুশ কবি ও ঔপন্যাসিক অ্যালেক্সান্ডার সোলঝেনিৎসিনের জন্ম ১১ ডিসেম্বর ১৯১৮ সালে। সোলঝেনিৎসিনের জন্মের ছয় মাস আগে রুশযুদ্ধে তাঁর বাবা মারা যান। মায়ের কাছে তিনি মানুষ হন। সোলঝেনিৎসিন পড়াশোনা করতে চেয়েছিলেন সাহিত্য নিয়ে। কিন্তু তার শহরের বিশ্ববিদ্যালয়ে সে সুযোগ ছিল না, তাই পড়াশোনা করলেন অঙ্কশাস্ত্রে। কোনো সাংঘাতিক বিষয়ও যে খুব সহজ করেই লেখা যায়, তার প্রমাণ রুশকবি ও ঔপন্যাসিক অ্যালেক্সান্ডার সোলঝেনিৎসিনের গদ্য কবিতাগুলো। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অবক্ষয় তার লেখার মূল প্রতিপাদ্য। তাঁর উপন্যাস ওয়ান ডে ইন দ্য লাইফ অব ইভান ডেনিসোভিচ (১৯৬২)  তাঁকে বিখ্যাত করে তোলে। সোলঝেনিৎসিন ১৯৭০  সালে নোবেল পুরস্কার পান। তিনি কমিউনিজমের শাসননীতি পছন্দ করতেন না। ফলে, তাঁর দেশে তাঁর লেখা বহুদিন নিষিদ্ধ ছিল।  ১৯৭৪ সালে তাঁর নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয় ও নির্বাসিত করা হয়। নির্বাসিত হয়ে তিনি আমেরিকাতে চলে যান। ১৯৯০ সালে তাঁর নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিলে তিনি জন্মভূমিতে ফিরে  আসেন। ২০০৮-এর ৩ আগস্ট অ্যালেক্সান্ডার সোলঝেনিৎসিনের মৃত্যু হয়। মাইকেল গ্লেনি অ্যালেক্সান্ডার সোলঝেনিৎসিনের কিছু কবিতা রুশ ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন।

সাহিত্য বিভাগের সব খবর

মকর সংক্রান্তি বা পৌষ সংক্রান্তি

মকর সংক্রান্তি বা পৌষ সংক্রান্তি

বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণের একটি হচ্ছে পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি। ১২টি রাশি অনুযায়ী ১২টি সংক্রান্তি রয়েছে। বাংলা পৌষ মাসের শেষদিন পালন করা হয় মকর সংক্রান্তি। একদিকে নতুন ধান ওঠার আনন্দ। অন্যদিকে মকর রাশিতে সূর্যের আগমনকে কেন্দ্র করে দিনটি মকর সংক্রান্তি নামে পরিচিত। বছরের বারোটি সংক্রান্তির মধ্যে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ মকর সংক্রান্তি। এ সময় সূর্য দক্ষিণায়ন থেকে উত্তরায়ণে যায়। খাওয়া দাওয়া, ঘুড়ি উৎসবের পাশাপাশি পূণ্যস্নানের জন্যও মকর সংক্রান্তি গুরুত্বপূর্ণ। মকর সংক্রান্তি যে মূলত বসন্তকে আহ্বান জানানো হয়। এটা ফসল কাটার উৎসব হিসেবেও বিবেচিত হয়। ভোরের স্নান, সূর্য প্রণাম, পিঠা-পুলি ও চিড়া-মুড়ির নাড়ু, তিলের নাড়ু খাওয়া, ঘুড়ি উৎসব নিয়ে ব্যস্ত থাকে বাঙালিরা। পৌষের শেষ আর মাঘ মাসের শুরুতে যে সংক্রান্তি আসে, তাই পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি। পৌষ মাস মল মাস বা অশুভ মাস হিসেবে চিহ্নিত হলেও শাস্ত্রমতে মকর সংক্রান্তি থেকেই শুরু হয় শুভক্ষণ। এই সময় সূর্য ধনু রাশি ত্যাগ করে মকর রাশিতে গমন করে। শুরু হয় সূর্যের উত্তরায়ণ তাই একে মকর সংক্রান্তি বলে। কেউ আবার এটাকে উত্তরায়ণ সংক্রান্তিও বলে। ছয় মাস থাকে উত্তরায়ণ আর ছয় মাস থাকে দক্ষিণায়ন। পৌষের শেষ মুহূর্তের এই উৎসব সনাতন সংস্কৃতির এক প্রাসঙ্গিক বিষয়। পৌরাণিক মতে, দেবতাদের দিন শুরু হয় উত্তরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে। দক্ষিণায়নের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় দেবতাদের রাত্রি। দীর্ঘ রাত্রি থেকে দেবতাদের দিনে প্রবেশ করার ক্ষণটিকে উৎসব আকারে পালন করে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। তবে এ উৎসব পালন নিয়ে রয়েছে নানা মত। সনাতন ধর্মীয় বিশ্বাস মতে, মকর সংক্রান্তি যে উত্তরায়ণের সূচনা এবং এ উৎসব পালন করার মাধ্যমে অশুভ শক্তি নাশ হয়। পূরাণ অনুসারে মকর ক্রান্তির এইদিনে অসুরদের সঙ্গে দেবতাদের যুদ্ধের অবসান ঘটে। ঐদিন বিষ্ণু অসুরদের বধ করে তাদের ছিন্নমুণ্ড (মাথা) মন্দিরা পর্বতে পুঁতে দেন এবং শুভ শক্তির সূচনা করেন। মহাভারত ও কালিকাপুরাণ অনুসারে এই মকর সংক্রান্তিতে দেবতাদের আরাধনা করা হয়। আর্থিক সমৃদ্ধির জন্য এ সময় লক্ষ্মী দেবীর আরাধনাও করা হয়। মল মাসের অর্থাৎ পৌষ মাসের শেষে এই উৎসব পালনের মাধ্যমে অশুভ শক্তির ত্যাগ আর শুভ শক্তির সূচনা করা হয়। আবার কোনো কোনো মতে এইদিনে সূর্যদেব তার পুত্র মকর রাশির অধিপতি শনির ওপর রাগ প্রশমিত করে তার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। এই জন্য সূর্যদেবের কাছ থেকে আশীর্বাদ পেতে সকালে সূর্যকে প্রাণের মধ্য দিয়ে মকর সংক্রান্তির উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। চিড়া-মুড়ি পিঠা-পুলি খাওয়ার পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলে ছোট ছেলেমেয়েরা পৌষ সংক্রান্তির আগের রাতে খড় দিয়ে ছোট ঘর বানায়, যাকে বলে তিল্লার ঘর। ঐদিন ছেলেমেয়েরা বাড়ির পাশে ঘর বানিয়ে সেমাই সুজি মাংস রান্না করে চড়ুই ভাতির মতো খাওয়া দাওয়া করে এবং রাত্রি যাপন করে। খুব ভোরে উঠেই স্নান করে তিল্লা ঘর পুড়িয়ে আগুন পোহায়। এ দৃশ্য অনেকটা কমে গেলেও গ্রামাঞ্চলে এখনো এ দৃশ্য চোখে পড়ে।  পৌষ সংক্রান্তির দিন ঘুড়ি উড়ানো বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী একটি উৎসব। মুঘল আমল থেকে এই উৎসব পালন হয়ে আসছে। পুরনো ঢাকার একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান এটি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই দেশে, উৎসব পার্বণের এই দেশে আমরা সবাই মিলেমিশে চলব এই কামনা আজ পৌষ সংক্রান্তির দিনে। বাঙালির ইতিহাস ঐতিহ্য এভাবেই এগিয়ে চলুক সুন্দর আগামীর পানে।

ত্রিমাত্রিক ভালোবাসার উপন্যাস

ত্রিমাত্রিক ভালোবাসার উপন্যাস

ত্রিমাত্রিক ভালোবাসার উপন্যাস ‘অচিন ফুলের সুবাস।’ মাতৃহারা টুশি ও পারমিতা, তৌফিক ও মিনার- এই চারটি চরিত্রের সম্পর্কের কড়ি ও কোমলে তৈরি এই উপন্যাস।কাহিনীর বাঁকে বাঁকে দেখা মেলে আরও অনেক নারী ও পুরুষের।কেন্দ্রীয় চরিত্র টুশির চলতে পথে যাদের সাথে নিবিষ্ট পাঠকের পরিচয় হয়, তারা প্রধান চরিত্র না হলেও স্বভাবে বৈশিষ্টপূর্ণ এবং কিছু সময়ের জন্যে হলেও অপরিহার্য হয়ে উঠেন কাহিনী নির্মিতির মুন্সিয়ানার গুণে। উপন্যাসের শুরুতেই দেখা যায় টুশি যাচ্ছে ঠাকুরগাঁওয়ে। পাশের আসনে বসে যাচ্ছেন আরেকজন প্রৌঢ় অধ্যাপক। এই অধ্যাপকের একটাই দৃশ্য। কিন্তু কাহিনীর শুরুতে রাশভারি এই চরিত্রটির উঁকি মারা যেন বা খুব দরকার ছিলো, যদিও তার আর দেখা মেলেনি একবারও। মনিরা পারভিন বাইরে থেকে মমতাময়ী । আসলে স্বার্থপর। মনিরা টুশির সৎমা। তাকে হাড়ে হাড়ে চেনে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া টুশি।হঠাৎ তৌফিক এসে যায় একলা একা টুশির জীবনে। টুশি স্নেহময় পিতা আশরাফ আহমদ ; থাকেন ঠাকুরগাঁওয়ে টুশির সৎমা মনিরার সাথে।তৌফিক টুশির প্রতি খুব কেয়ারিং। মাঝেমধ্যে রোমান্টিক হয়ে গেলেও সীমা ছাড়িয়ে যায় না।  সাবলেট বাসায় সংসার পাতে টুশি আর তৌফিক। ওদের প্রেমময় সংসারে কাঁটার মতো এসে পড়ে শিশু পারমিতা। পারমিতা তৌফিক ও তার মা-বোনের চোখে কাঁটা হলেও টুশির পরম আরাধ্য। নিষ্পাপ এই মেয়েটির সাথে এক নিবিড় গভীর অনাবিল মমতার বন্ধনে বাঁধা পড়ে টুশি। হঠাৎ পারমিতার মা মারা যাওয়ার পর মাতৃস্নেহে শিশুটিকে বুকে টেনে নেয় টুশি।পারমিতাকে টুশি নিয়ে আসে নিজের কাছে।পারমিতার বাবা মিনার হাফ ছেড়ে বাঁচলেও তৌফিক বিষয়টি স্বাভাকিভাবে নিতে পারেনি।পারমিতাকে নিয়ে বিরক্ত তৌফিকের মা ও বোনও । টুশির প্রতি কৃতজ্ঞ পারমিতার বিপত্নিক পিতা মিনার । প্রতিদিন অফিস শেষে মিনার এ বাড়িতে এসে মেয়েকে দেখে যায়। কিন্তু তার ও মেয়ের জন্যে টুশি-তৌফিকের সংসারে যাতে কোনো ভুল বোঝাবুঝি না হয় সে ব্যপারেও খুব সাবধান মিনার, যদিও টুশি মিনারকে দেখে বোনের চোখে। মিনারও তা-ই। তারপরেও সাবধানতা। মিনার কখনই তৌফিকের অবর্তমানে মেয়েকে দেখতে আসে না। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হলো না। টুশি ও তৌফিকের সংসারে ঝড় উঠলো।তৌফিকের মনে উপ্ত হলো সন্দেহের বীজ। বিষ বৃক্ষের বড় হতে লাগলো সেই সন্দেহ। পারমিতাতে দিয়ে আসতে হলো বাবার কাছে। অসহায় পিতা মেয়েকে নিয়ে চাকরি-বাকরি ছেড়ে পাড়ি জমালেন গ্রামে। টুশি চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাবে। বাঁধ সাধলো তৌফিক।সংসারে আগুন লাগলো। টুশি একটা কলেজে চাকরি পেলো। কিন্তু টুশির আর তৌফিকের সংসারে ফিরে যাওয়া হলো না। আবার টুশির জার্নি বাই ট্রেন। গন্তব্য ফেনীর মির্জাগঞ্জ – যেখানে পারমিতাকে নিয়ে গেছে মিনার। টুশি পারমিতাকে ঢাকায় নিজের কাছে নিয়ে আসতে চাইলো। তখনই ঘটলো কাহিনীর নাটকীয় মোড় পরিবর্তন।কেন কিভাবে ঘটে গেলো সেই পরিবর্তন ; সেটা সত্যিই কৌতূহল উদ্দীপক।টুশি ও মিনারের হৃদয়াবেগের কী নাম দেওয়া যায়! এটাকে প্লেটোনিক লাভের দৃষ্টান্ত বলা যায় কি?মিনারের প্রতি টুশির কিংবা টুশির প্রতি মিনারের হৃদয়াবেগ কি সংগোপনে অবচেতনে দানা বেঁধে উঠেছিলো অনেক আগেই।সন্হে নেই, এই বই পাঠকচিত্ত দোলায়িত করবে, প্রশ্নবিদ্ধ করবে। ইমন চৌধুরীর সাবলীল রচনাভঙ্গি পাঠককে টেনে নিয়ে যায় অবলীলায়। ঝড়ো প্রেমের এই উপন্যাসটি হতে পারে পাঠকের আনন্দপাঠের উপলক্ষ্য । রাজীব হাসানের আঁকা প্রাণবন্ত প্রচ্ছদ ও ঝকেঝকে ছাপা বইটিকে করেছে আরও বেশি আকর্ষণীয়। অচিন ফুলের সুবাস বইটি প্রকাশ করেছেন রতনচন্দ্র পাল গ্রন্থ কুটির, বাংলাবাজার, ঢাকা মূল্য: ৪৩০ টাকা মাত্র।

দালিলিক উপস্থাপন

দালিলিক উপস্থাপন

সত্য বলা ইতিহাসের দায়। অতীতের ঘটনাপ্রবাহ ইতিহাসের বস্তু। সামাজিক আন্দোলন,  যুদ্ধ, স্বাধিকারসহ নানা বিষয় ইতিহাসের চাকা সচল রাখে। ১৯২১ সালে সংঘটিত চা-শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনও ইতিহাসের অংশ। এটি নিয়ে লেখা মুহাম্মদ ফরিদ হাসানের গ্রন্থ ‘শতবর্ষে চা শ্রমিক আন্দোলন : ডেডলাইন ২০ মে ১৯২১’। পূর্বে বইটি বাংলাদেশে প্রকাশিত হয়েছিল। সম্প্রতি বইটির ভারতীয় সংস্করণ প্রকাশ করে অভিযান পাবলিশার্স। মুল্লুকে চলো আন্দোলনের দলিলপত্র, সংবাদভাষ্য, সাক্ষাৎকারসহ বস্তুনিষ্ঠ তথ্যনির্ভরতায় নানা দিক উন্মোচন ইত্যাদির কারণে এ বইটি বিশেষ। পূর্বে এ বিষয় নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কোনো গবেষণা হয়নি। ভারতীয় উপমহাদেশে চা-শ্রমিকদের সংগ্রামের ইতিহাস প্রায় দুইশ’ বছরের। ১৯২১ সালের মে মাসে নিপীড়িত চা শ্রমিকরা  স্বদেশে যাত্রা  শুরু করেন। এ আন্দোলনের নাম ‘মুল্লুকে চলো’। শ্রমিক আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ এবং মাতৃভূমিতে গিয়ে মানুষের মত করে বাঁচার ইচ্ছা। কিন্তু তারা অত্যাচারী চা-বাগান মালিকদের সীমাহীন বাধা এবং নৃশংসতার মধ্যে পড়েন। রাতের আঁধারে চাঁদপুর স্টেশনে গূর্খাদের নির্মমতায় বহু শ্রমিক মারাত্মক আহত হন। এই নৃশংস ঘটনায় ভারতব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। স্টিমা ও রেল শ্রমিকরা ধর্মঘট ডাকেন। ফলে বাংলার জল ও  স্থলপথ সম্পূর্ণ অচল হয়ে যায়। এ ঘটনায় চিত্তরঞ্জন দাশসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ নিন্দা জানান।  ‘মুল্লুকে চলো’ আন্দোলনের ঘটনা প্রবাহ, শ্রমিকদের ত্যাগ, ব্রিটিশদের শোসন, সাহিত্য মূল্য, বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে বইটিতে আলোচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশ সংস্করণের প্রচ্ছদ করেছেন আফসিন রেজা। মুদ্রিত মূল্য ৫০০ টাকা। ভারত সংস্করণের প্রচ্ছদ করেছেন ইউনুস নাজিম। মূল্য ৩৫০ রুপি।

প্রেমে অন্য প্রান্তে

প্রেমে অন্য প্রান্তে

বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের নানাবিধ অ্যানাউন্সমেন্ট কানে ভেসে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল লাউঞ্জে চেকিং করে বোর্ডিং পাস সেরে খুব টিপটপ ফুড লাউঞ্জে বসে কফিতে চুমুক দিতেই সামনের টেবিলে চোখ গেল রোহনের। খুব সুন্দরী এক নারী মনোযোগ সহকারে মোবাইলে কিছু একটা করছে। নারীটিকে কেমন চেনা চেনা লাগছে পিউ না তো? না না এ হতেই পারে না। এ কত স্মার্ট সুন্দরী কত আকর্ষণীয় আর পিউ একটা আনকালচার্ড গেওভূত ছিল। কিভাবে সুতি শাড়ি পরে লম্বা চুলে খোঁপা করে রাখতো, অবশ্য গায়ের রংটা খুব ফর্সা ছিল। আর মহিলার তো ঘাড় থেকে সামান্য নিচে কালার করা সিল্কি চুল, টপ জিন্স পরা, না না এ পিউ হতে যাবে কোন দুঃখে? মনের ভুল চোখের বিভ্রম বলে কফিতে চুমুক দিতে দিতে আবারও চোখ যায় ওদিকে। সুন্দরী মহিলাটি খাবার আনতে সামনে আগায়। রোমেনও উঠে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল কি স্নিগ্ধসুবাস আসছে তার শরীর থেকে। খুবই দামি পারফিউম বোঝাই যাচ্ছে। মহিলাটি  একটু একটু করে প্লেটে সব আইটেম তুলে নিচ্ছে। যদিও ব্রেকফাস্ট তবুও অনেক  আইটেম, পোলাও, ভুনা খিচুড়ি, চিকেন, মাটন, বিফ, মহিলা ওসবের ধারে কাছেও গেল না। খুবই অল্প কিছু সসেজ, কিছু জয়তুন, এক পিস পাউরুটি, মাখন, আর এক গ্লাস পাইনঅ্যাপেল  জুস নিল। রোহনের খাওয়া আগেই শেষ হয়েছে। সে কফি দিয়ে শেষ করতে চেয়েছিল কিন্তু একটা প্লেট নিয়ে আবারও কিছু নেওয়ার ছলে মহিলাটির পাশে পাশে হাঁটছে। হঠাৎ করেই মহিলাটি রোহনের দিকে তাকিয়ে বলল, আরে রোহন তুমি? চমকে উঠে রোহন বলে  হ্যাঁ আমি । তুমি পিউ না? কেন আমাকে পিউ বলে মনে হচ্ছে না? আসলে অনেকদিন পর দেখা তো তাই বুঝতে পারছিলাম না,চিনতে একটু কষ্ট হচ্ছিল। পিউ বলে, চলো টেবিলে বসি। একই টেবিলে দুজনে মুখোমুখি বসল। রোহন প্রথম জিজ্ঞেস করল কোথায় যাচ্ছ?  অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে, ওখানে আমার শ্বশুরশাশুড়ি  ননদ দেবর ভাসুর থাকে। আমার শ্বশুর অসুস্থ। পাঁচ দিন আগে আমার ছেলে মেয়ে ওদের বাবার সঙ্গে চলে গিয়েছে। আমি এদিকটা গুছিয়ে তবে আজ যাচ্ছি। রোহন মনে মনে ভাবে ঘরের কাজ গুছিয়ে যেতে পাঁচ দিন পরে যেতে হলো? ও সেই নিষ্ককর্মাই রয়ে গেল। জিজ্ঞাসা করল কি গোছালে তুমি? পিউ বলে আমাদের ফ্যাক্টরির এমপ্লয়ীদের সেলারি দিলাম, একটা সিপমেন্ট ছিল ওটা কমপ্লিট করলাম। সামনের মাসের জন্য শিপমেন্টের কাজ ওদের বুঝিয়ে দিয়ে গেলাম। তাছাড়াও জারিফের  আরও ব্যবসা আছে সেগুলোরও কিছু কিছু দেখতে হয়েছে। ও হঠাৎ করে সংবাদ পেয়ে চলে গেছে তাই ওর অনুপস্থিতে আমাকে সব করতে হলো। রোহন মাথা ঘুরে পড়বে না আছাড় খেয়ে মরবে ভেবে পাচ্ছে না। যাকে সে অকর্মা ভেবে অপমান করেছে, কত খারাপ কথা বলেছে যাকে তার কোন দিক দিয়েই ভালো লাগেনি আজ তার এরূপ অবস্থান দেখে সে সত্যিই মর্মাহত। হাত দিয়ে নিজের গায় চিমটি কাটে সব সত্যি শুনছি নাকি স্বপ্ন দেখছি? না সবই দিনের আলোর মতো সত্যি। পিউ জিজ্ঞেস করে তুমি কোথায় যাচ্ছ? আমিও অস্ট্রেলিয়ায় যাচ্ছি আমার অফিসের কাজে অফিস থেকেই পাঠাচ্ছে।  ও ও তুমি কি আগের অফিসেই আছো? হ্যাঁ শুধু একটু প্রমোশন হয়েছে। শুনেছিলাম জেরিনের সঙ্গে তোমার বিয়েটা  টিকেনি? ঠিকই শুনেছ দুই বছর টিকে ছিল একটি মেয়ে হওয়ার পর  ওর অফিসের কলিগের সঙ্গে চলে যায়। মেয়েটাকে দেখাশোনার জন্য লালন পালনের জন্য আরেকটি বিয়ে করেছিলাম। কিন্তু ও আমার মেয়েটিকে এত অপছন্দ করতো যে রূপকথার সৎ মায়েদেরও হার মানায়।  এ নিয়ে প্রবলেম হওয়ায় ও চলে যায়। পিউ মুচকি হেসে কফিতে চুমুক দিয়ে বলে এখন কি চার নম্বরটা আছে? রোমেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে চার নম্বর আর হয়নি মেয়েটাকে এক হোস্টেলে রেখেছি। তুমি যাওয়ার পর থেকে আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার জীবনের সব শেষ হয়ে গিয়েছিল।  না না রোহন, তুমি এখনো মিথ্যে কথা ছাড়তে পারলে না। আমি যাওয়ার পর তো তুমি জেরিনকে নিয়ে স্বপ্নের দেশে উড়ে বেরিয়েছ। জেরিনের সঙ্গে যখন তোমার সম্পর্ক চলছিল তখনকার দিনগুলোর কথা মনে হলে এখনো আমার বুক ভেঙে কান্না আসে। তুমি কখনো আমার কষ্ট বুঝতে চাওনি বরং জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কষ্টটা তুমি আমাকে দিয়েছিলে। স্ত্রী হিসেবে তো তুমি আমাকে  পেয়ে খুব সেটিসফাইড ছিলে। তোমার জীবনের প্রথম নারী ছিলাম আমি। তুমিও প্রথম পুরুষ ছিলে আমার, অথচ যখন জেরিনের দিকে তোমার মন প্রাণ চোখ সব গেল, তোমার কাছে আমি হয়ে উঠলাম তোমার জীবনের বড় শত্রু বড় বিরক্তকর মানুষ। অফিস থেকে সাজুগুজু পরিপাটি সেন্ট মাখা জেরিন দেখে বাসায় এসে সুতি শাড়ি পরা গায়ে সংসারের হলুদ মরিচের ঘ্রাণ  যুক্ত আট পৌরে নারী খুব বেমানান লাগতো তোমার। আমাকে তো কোনোদিন ভালোই বাসোনি শুধু প্রয়োজন মিটিয়েছো। করেছ নিষ্ঠুর তাচ্ছিল্য, প্রয়োজন মিটে গেছে ছুড়ে ফেলে জেরিন তুলে নিলে। তুমি ছিলে নির্মম আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর একজন মানুষ। তোমার অল্প বেতনের সংসারে কত কষ্টে দিন কেটেছে, তবু কোনো চাহিদা ছিল না আমার। তোমার সংসারে না ছিল প্রাচুর্য না ছিল স্বাচ্ছন্দ্য তবুও ছাড়তে চাইনি। মন প্রাণ দিয়ে ভালোবেসে আঁকড়ে ধরে থাকতে চেয়েছিলাম। অথচ তুমি আমায় ছেড়ে দিলে। জেরিনের নেশায় অকারণে নিন্দা কুচ্ছা রটিয়ে ক্ষতবিক্ষত করেছ আমায়। চূড়ান্ত অবহেলায় দুর্দান্ত অপমানে অন্তহীন যন্ত্রণায় কেটেছে নিদারুণ প্রহর। যখন প্রমোশন হলো কত স্বপ্ন  দেখেছিলাম সংসার গোছাবো মনের মতো করে। আমার নিজের একটা সংসার হবে সন্তান হবে, স্বামীকে নিয়ে সন্তান-সংসার নিয়ে আঁকড়ে থাকবো। অথচ সাফল্য পেয়ে কাছের মানুষটা হয়ে গিয়েছিল দূরের মানুষ আর তোমার দূরের মানুষই হয়ে উঠেছিল কাছের মানুষ। সময় মতো মানুষ বুঝতে পারে কে কাছের কে দূরের। ততদিনে কাছের মানুষটাও সত্যিসত্যি  দূরের মানুষ হয়ে যায়। সুসময় দুধের মাছির অভাব হয় না। রোহন বলে জীবনের সবকিছু কি আমার ভুল ছিল তোমার কি কোনো ভুল ছিল না? না আমার তো কোনো ভুল ছিল না বলে নিজেকে বিন্যস্ত করে পিউ। রোহন বলে আমি না হয় না বুঝে সরে গিয়েছিলাম তুমি কেন জোর করে আমায় ধরে রাখোনি? এখন তোমার এরকমই মনে হবে আমি আমার প্রাণের উত্তাপ ভালোবাসা আকুতি দিয়েও তোমায় ফিরাতে পারিনি বুঝাতে পারিনি আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি। জেরিনের তো একটা জব ছিল তুমি না থাকলেও চলতে পারতো কিন্তু আমার কথা কি তুমি একটিবারের জন্যও ভাবতে পারোনি আমার কি হবে কোথায় যাব? আমার তো কোন জব ছিল না। তুমি জেরিনকে নিয়ে যখন সুন্দর সুখময় সময় কাটিয়েছো তখন আমি বাবার বাড়িতে একাকীত্ব নিঃসঙ্গ রাত জেগে দারুণ কষ্টে নির্ঘুম রাত করেছি পার। তুমি জানো না আমি আসার সময় তোমার একটা ইউজ করার শার্ট নিয়ে এসেছিলাম। যখনই মন পুড়তো প্রাণ কাঁদতো তখন বুকে জড়িয়ে তোমার ঘ্রাণ নিতাম। কাক্সিক্ষত প্রাণের মানুষটাকে কেড়ে নিয়ে গেল অন্য জনে। আমি পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে যাই। দুর্মর অস্বস্তি শুষ্ক মরুভূমির মতো নিজেকে নির্জীব করে রেখেছি। ঘরের বউয়ের প্রতি আকর্ষণ হারিয়েছিলে, আর পরনারীর মনোযোগ আকর্ষণ করতে গিয়ে অনেক কিছুই করেছো। তার বিনিময়ে কি পেলে তুমি?  তুমি আজ সত্যি করে বলতো আমায় অমানবিক কষ্ট দিয়ে তুমি কি খুব ভালো আছো? সুখী হতে পেরেছো? আমার খুব জানার ইচ্ছে ছিল তাই হয়তো আজ তোমার সঙ্গে আমার এভাবে দেখা হয়ে গেল। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রোহান বলে সত্যি বলার মতো মুখ আমার নেই। তবে দাম্পত্য জীবনে আমি বড়ই অসুখী ভালো নেই পিউ, আমি ভালো নেই। মানুষ যখন মোহে পড়ে মরীচিকার পিছনে ছুটতে ছুটতে ঘরের অমূল্য রতনকে ছাই মনে করে ঝেড়ে ফেলে দেয়, যখন হুঁশ ফিরে ততদিনে মরীচিকার আলো নিভে যায়, জীবনের সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায়। মানুষের জীবনটাই বোধহয় এমন যা চাই তা পাই না, যা পাই তা চাই না। পিউ তোমাকে দেখার পর ভিতরটা খা খা শূন্যতার ঢেউ  কেন উঠছে? আমি প্রচন্ড মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে আছি। আজ আমি বড়ই অসুখী, চরমভাবে অসুখী যদি পারো ক্ষমা করে দিও আমায়। পিউ বলে তোমার ওপর আমার কোনো রাগ দুঃখ কষ্ট কিছুই নেই কারণ কি জানো? তুমি মূল্যহীন ভেবে যা ফেলে দিলে জারিফ সেটা মূল্য দিয়ে আজ আমায় কোথায় এনেছে দেখতেই পাচ্ছো। তোমার থেকে সরে গিয়ে জারিফকে পেয়ে আমি বুঝতে পেরেছি জীবন কত সুন্দর, মানুষ কত মহান তোমার কাছে থাকলে এটা আমি কোনোদিনও জানতে পারতাম না। অনেকদিনের না বলা কথাগুলো বলতে পেরে পিউ আজ শান্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। পিউ হাতের ঘড়ি দেখে বলে, ফ্লাইটের সময় হয়ে গিয়েছে উঠতে হবে এখন। 

জাতীয় জাগরণের যাত্রিক কবি

জাতীয় জাগরণের যাত্রিক কবি

অবিভক্ত বাংলার কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালি মুসলিম রেনেসাঁর অন্যতম পথিকৃৎ কবি মোজাম্মেল হক। মেঘনা-তেঁতুলিয়া বিধৌত পলিমাটির দেশ ভোলার এক বিশেষ প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই লালিত এবং বিকশিত হয়েছিলেন তিনি। মোজাম্মেল হক একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সংগঠক, সমাজসেবক, রাজনীতিক ও  পার্লামেন্টারিয়ান ছিলেন। দ্বীপজেলা ভোলায় বেড়ে উঠলেও পুরো উপমহাদেশ জুড়েই তাঁর খ্যাতি ছিল। যখন আমাদের দেশে শিক্ষা এবং সভ্যতার আলো থেকে বঞ্চিত ছিল সাধারণ মানুষ তখন তিনি তাদের জাগিয়ে তোলার জন্য গেয়ে উঠলেনÑ ‘নির্জীব বাঙালি তোরা কে দেখিবি আয়’। শুধু কবিতাই নয়, শিক্ষা বিস্তারের জন্যও তিনি সচেষ্ট হয়ে উঠলেন। বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললেন। জীবনের বেশিরভাগ সময় ব্যয় করেছিলেন মানুষের কল্যাণে। বাংলা সাহিত্যে একজন কবির বিরল দৃষ্টান্ত এই যে, তিনি শিল্প-সাহিত্যের সমঝদার হওয়ার পাশাপাশি প্রায় ১৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি তাঁর সময়েও আধুনিক ছিলেন। সমকালে প্রগতির প্রেক্ষাপটেও অনেক কবি-সাহিত্যিকদের রক্ষণশীল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অথচ কবি মোজাম্মেল হক ছিলেন সময়ের শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী প্রেরণা। মুসলিম কবি-সাহিত্যিকদের প্রথম সংগঠন ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য’ ও পত্রিকার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর সম্পাদিত বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় কবি নজরুলের প্রথম কবিতা ‘মুক্তি’ এবং গল্প ‘হেনা’ প্রকাশ পায়। মোজাম্মেল হকের আমন্ত্রণে কবি নজরুল করাচির সৈনিক জীবন ছেড়ে পুরোদমে সাহিত্যে মনোনিবেশ করেছিলেন। মোজাম্মেল হক সেই সময় কলকাতায় ‘দি ওরিয়েন্টাল প্রেস অ্যান্ড পাবলিশাস’ প্রতিষ্ঠা করে মুসলিম কবি-সাহিত্যিকদের বহু গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। ১৯০০ সালের দিকে কবি’র নামের সঙ্গে মিলে যাওয়া তৎকালীন নদীয়ার শান্তিপুরের প্রধান মুসলিম কবি মুন্সী মোজাম্মেল হক বাংলা ১৩০৭ সালের বৈশাখ মাস হতে লহরি নামে একটি কবিতার কাগজ বের করতেন। বার্ষিক মূল্য ছিল এক টাকা। সেখানে জাতীয় মঙ্গলের কবি’র ‘অভাগা-বিলাপ’, ‘নববর্ষ’, ‘পথহারা পান্থ’ ও সান্ত্বনা শীর্ষক ৫টি কবিতা ছাপা হয়। সম্পাদক ‘অভাগা-বিলাপ’ কবিতা পড়ে মন্তব্য করেন, ‘অভাগার এই বিলাপ’ নিরতিশয় মর্মস্পর্শী। ইহা পাঠ করিলে হৃদয় শোকে ও ক্ষোভে অবসন্ন হইয়া পড়ে। এই কবিতা পড়ে মালদহ-কানসাটের জমিদার মৌলবী মোহাম্মদ এয়াকুব আলি চৌধুরী জাতীয় মঙ্গলের কবিকে কিছু আর্থিক সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। কবি মোজাম্মেল হক ১৮৮৩ সালের ৫  সেপ্টেম্বর ভোলা সদর উপজেলার বাপ্তা গ্রামে পরাণ তালুকদার বাড়ির মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মৌলভী আব্দুল করিম। মাতা বিবি আরফিনজান বেগম। তিনি ১৯০১ সালে কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশন থেকে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পাস করার পর প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯১৫ সালে গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি অর্জন করেন। ভোলা জেলার তৃতীয় গ্র্যাজুয়েট তিনি। আদালতে জজ বা বিচারককে ‘মাই লর্ড’ বললে শিরক হবে ভেবে এলএলবি পাস করে অ্যাডভোকেট হয়েও আইন পেশা ত্যাগ করেন। তিনি কলেজে পড়া অবস্থায়ই মুসলমান সমাজের হৃত গৌরব ও আত্মবিশ^াস ফিরিয়ে আনার জন্য জাতীয় মঙ্গল কাব্য রচনায় হাত দেন। তাঁর প্রথম কবিতাগুলো ছাপা হয় মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী সম্পাদিত সাপ্তাহিক সোলতান, মুন্সী রেয়াজ উদ্দিনের ইসলাম প্রচার ও মওলানা আকরম খাঁ সম্পাদিত সাপ্তাহিক মোহাম্মদী’তে। কমরেড মুজাফফ্র আহমদ কবি মোজাম্মেল হক সম্পর্কে তাঁর স্মৃতি কথায় বলেন, কবি মোজাম্মেল হকের সময় ছিল বড় কম। তিনি একই সঙ্গে আইন ও এমএ ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলেন। প্রথমে বেকার হোস্টেলের অ্যাসিসটেন্ট সুপারিনটেনডেন্ট ও পরে কারমাইকেল হোস্টেলের সুপারিনটেনডেন্ট হয়েছিলেন। তার ওপরে তিনি ব্যারাকপুর গভর্নমেন্ট স্কুলে শিক্ষকতার চাকরিও নিয়েছিলেন। বিশিষ্ট কূটনীতিক ও সাহিত্যিক সৈয়দ আবদুস সুলতান তাঁর এক নিবন্ধে লিখেন, কোলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের এক হাজার সদস্যের মধ্যে মাত্র নয়জন ছিল মুসলমান। তখন কবি মোজাম্মেল হক চিন্তা করে স্থির করেন অনুরূপ একটি সাহিত্য সংগঠনের মাধ্যমে সকল মুসলমান কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিকদের একত্রিত করে সমাজের অগ্রগতি সাধনে ব্রতী হবেন। মুসলমান কবিদের মধ্যে সাহিত্য চর্চা হবে কী, তাদের পড়ালেখা ও জানার আগ্রহই ছিল কম। মুসলিম পরিবারের ছেলেদের বয়স ১০-১২ বছর হয়ে গেলেও বাবা-মা স্কুলে ভর্তি করতে চাইতেন না। ছেলেরা মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াত। মেয়েদের পড়ালেখার বিষয়টি তো ভাবাই যেত না। সমাজের এই অসহনীয় অবস্থা দেখে কবি জাতীয় মঙ্গল কাব্যের ‘নির্জীব বাঙালি’ কবিতায় লিখেছেনÑ দশ বর্ষ যায় চলে, তবুও ‘দুধের ছেলে’ কি জানি ‘আলোক’ দেখে পাছে ভয় পায়, নির্জীব বাঙালি তোরা কে দেখিবি আয়, বারবর্ষ বয়স হলে, গিয়া গ্রাম্য পাঠশালে, ‘বানান’ শিখিতে দু’টি বর্ষ চলে যায় নির্জীব বাঙালি তোরা কে দেখিবি আয়। মোজাম্মেল হক বলেন, সেই সুদূর একশত কি সত্তয়া’শ বৎসর পূর্বেই ভোলা মহকুমার বর্তমানের ন্যায় কোনো ‘সিনেয়র কিম্বা জুনিয়র’ মাদ্রাসা ছিল না। শুধু ধর্মশিক্ষার জন্য কোরআন খতমের পাশাপাশি পান্দেনামা, গোলেস্তাঁ ও বোস্তাঁ পড়ান হতো। গোলেস্তাঁ ও বোস্তাঁ পাঠান্তে কেহ কেহ পারসি ইউসুফ-জোলায়খাঁ, সেকন্দরনামা, শাহনামা প্রভৃতি কেতাব পড়িতেন। মোজাম্মেল হক সে সময় বিখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে চলাফেরা করতেন। মুসলমানদের শিক্ষা বিস্তারে তাদের সঙ্গে বিভিন্ন সময় আলোচনা করতেন। তাঁর সঙ্গে চট্টগ্রামের বিশিষ্ট শিল্পপতি ও তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এ কে খানের শ^শুর আবদুল বারী চৌধুরী, হাবিবুল্লা বাহার, নুরুল হক চৌধুরীসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকতেন। মোজাম্মেল হক বলেন, বর্তমানে যেরূপ বৎসর বৎসর নূতন পাঠ্যপুস্তক নির্ধারিত হয়, পূর্বে সেরূপ ছিল না। জানিয়াছি বাল্যশিক্ষা তিন পুরুষ পর্যন্ত পাঠ্য ছিল। তারপর তৎকালীন বহুল প্রচলিত মদনমোহন তর্কালঙ্কার প্রণীত শিশুশিক্ষা। তারপর ছিল পণ্ডিত ঈশ^রচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রণীত প্রসিদ্ধ পাঠ্যপুস্তক বোধোদয়। এই সময় শ্রী মনোমোহন বসু প্রণীত কোমল-কবিতা নামে একখানা অতি সহজ-সরল, অনিন্দ্যসুন্দর এবং সুললিত কবিতা পুস্তক আমাদের পাঠ্য ছিল। এ পুস্তকের ‘রেলগাড়ি’, ‘আম’, ‘পেয়ারা’ ‘টিয়া পাখি’ প্রভৃতি সুললিত কবিতাগুলি পড়িয়া আমার ভিতরের সুপ্ত কবিত্ব শক্তি জাগরিত হইয়া উঠিল। তাহার কিছু নমুনাÑ

প্রকৃতির কুঞ্জবনে

প্রকৃতির কুঞ্জবনে

শাহ মতিন টিপুর কবিতা যতই পড়ি ততই যেন, ওই মদনমোহন তর্কালংকারের ‘ডুব দাও খুব খাও’-এর মতো পুলকবোধ করি। তবে সে কথা পরে, আগে দেখা যাক কবি শাহ মতিন টিপু জল জোছনার গান কেন নামকরণ করলেন? এর আগে তাঁর একক সংহিতার আর একটি বই প্রকাশ হয়েছিল যার নামটি ছিল ‘ছায়া ও ঘুণপোকা’। বর্তমান বইটি অনেক আগে পেয়েছি, কিন্তু অনেকদিন আপিসে যাবার পথে আর ফেরবার পথে নিজেকে প্রশ্ন করেছি, জল জোছনার গান নামটি কেন দিলেন! হঠাৎ একদিন রাতে মনে পড়ল, তিনি জাহাজে তাঁর বাড়ি ভোলায় মাঝে মধ্যে যেতেন, জাহাজে বসা অবস্থায় সেলে কথা হতো, কোথায়? জাহাজে। কি করছেন, পাশা ভাই জাহাজের ছাদে বসে মোবাইলে গেম খেলছি। কী বলব পাশাভাই, ওপরে চাঁদ আর নিচে পানি। পানির ওপর জাহাজ চলছে। পানিগুলো সোনালি রঙে ডুবে গেছে। সেরাম লাগছে পাশাভাই! আজ মনে হচ্ছে, সে রকম একটি মনোজাগতিক চেতনায় হয়ত বইটির জল জোছনার গান নামকরণ করেছেন কবি। শুরু করেছিলাম ডুব দাও, খুব খাও দিয়ে। আমি তাঁর কবিতার দীর্ঘ পাঠক। সেই যে বাংলাবাজার পত্রিকা থেকে তাঁর কবিতা পড়ে আসছি, আজো একইরকম কাব্যময়তার স্বাদ পাচ্ছি। তাঁর কবিতার অন্যতম গুণ ‘কাব্যময়তা’ ফেসবুকেই হোক বা জাতীয় দৈনিকগুলোতেই প্রকাশিত হোক, সব কবিতায় সব সময় উপস্থিত থাকে। তাঁর কবিতা সাবলীলভাবে পড়ে যাওয়া যায়। তবে শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ যেভাবে তাঁদের কবিতাতে ক্রমেই এবং বয়সকালে আরও গম্ভীর হয়ে এসেছেন, শাহ মতিন টিপু ঠিক তেমনভাবে এখনকার কবিতাগুলোকে বেশ জাগতিকের পাশাপাশি এক আধ্যাত্ম আবহের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন, এ কারণেই বলেছিলাম ‘ডুব দাও, খুব খাও’ প্রণিধানযোগ্য বচনটি। এটি একটি কবির সামাজিক দায়বোধও। ‘এইতো চলছে ছকে বাঁধা জীবন। সবার মতোই/ আমিও আটকে আছি আবর্তে। প্রত্যুষে গৃহত্যাগ আর/ সন্ধ্যায় নীড়ে ফেরা পাখি খেলা করে আঁখিতে আমার। আমি আর পাখি, পাখি আর আমি, খুবই মাখামাখি। ... হোক ফাঁদ, হোক অপবাদ, লয়-ক্ষয় যা হয় হোক/ সব মেনেই- এ চিড়িয়াখানাই আমার প্রিয় অমৃতলোক।’ (অমৃতলোকের জীবন-পৃ-৯)। এটি সাধারণ অথচ একটি বিশাল বিশ^পাঠশালা মানবজগতের, তা কোনো মানবই অস্বীকার করতে পারে না। ‘শহরে থাকবে আর ঠান্ডা মেশিন উপভোগ করবে না/ মোটেও হয় কি তা, তবে তো ভালো সে গ্রামেরই শীতল ছায়া।/ চারদিকে এতো ফুল চোখ ধাঁধানো, এতো মদিরার ছড়াছড়ি-/ যদি না ছুঁয়েই দ্যাখো এই রূপরসে মাতানো মাতাল বিভাবরী/’ (শহর কাব্য-পৃ-১১)। শাহ মতিন টিপুর কবিতার আর এক উপলব্ধি, ‘বললেন জওহরলাল নেহেরু, ‘মহেঞ্জোদারোর ওই টিলার ওপর দাঁড়িয়ে/ অনুভব করেছিলাম- আমি পাঁচ হাজার বছরেরও বেশি/ পুরনো এক সভ্যতার উত্তরাধিকারী।’ (ঐতিহ্যের গান-পৃ-২৮)। এ কবিতাতেই কবির সহজ ও শাশ^ত বিশ^াস উঠে আসে, পাক-ভারত-বাংলা মুল্লুক উপমানচিত্রের একক সভ্যতার ঐতিহাসিক মূল্যবোধ। তবে শব্দ সঞ্চয়ন ও দৃশ্যকল্প নির্বাচনে কবি বেশ প্রকৃতিপ্রেমী. পুরোপুরি বাঙালিআনায় সিক্ত। ‘এক চিলতে মেঘ হয়ে উড়ছিল দুটি চিল’ (পৃ-৪৬), ‘পাহাড়চূড়া ছুঁয়ে ছুঁয়ে মেঘদূতকে দেখেছি/ মেতে উঠতে জীবনসংগীতে- (পৃ-৫০), ‘ভোরের সোনার থালা এখন ঊর্ধ্বগগণে’ (পৃ-৫১), ‘সেই পঁচানো পাট তার আশতোলা হরমুল/ সেই ছাতিমতলা ঝরে পড়া গাব কিংবা সেই/ কাঠবাদাম কুড়ানোর দিন কেনো এতো অমলিন’ (পৃ-৫৫)- এমন ধরনের প্রকৃতিসঞ্জাত শব্দমালা ও প্রকৃতি-সন্বিষ্ট দৃশ্যকল্প বেশ প্রাণবন্ত। শাহ মতিন টিপু আশি দশকের শেষপ্রান্তের কবি। তাঁর কবিতা সহজেই আমাদের দৃষ্টি কাড়ে। কাব্যে তিনি মৃন্ময়ী। তিনি বিশ^াস করেন, ‘বারবার মনে হয় আমিই অত্রিজাত/ এ আমারই অভিরূপ, নয় অভিন্ন-অজ্ঞাত।’ (পৃ-৬৪), প্রাচীন ঋগবেদের সপ্তঋষির অন্যতম ঋষি তিনি। সামনের দিনগুলোতে তিনি আরও নক্ষত্রমালা কুড়িয়ে এনে বারকেশজুড়ে আমাদের উপহার দেবেন, এ কাম্য আমাদের। পরিপাটি মুদ্রণ। তবে প্রচ্ছদটিতে দেশের প্রখ্যাত কোনো শিল্পীর শিল্পকর্ম অনুসরণ উঁকি দেয়। জল জোছনার গান/ শাহ মতিন টিপু। প্রকাশক/ চন্দ্রছাপ, আদাবর, ঢাকা। প্রকাশকাল/ একুশে বইমেলা, ২০২৪। প্রচ্ছদ/ মজনু বিশদ। মূল্য/ ২৮০ টাকা।  

যুদ্ধের কবিতায় কবি-যোদ্ধা

যুদ্ধের কবিতায় কবি-যোদ্ধা

উনিশশো সত্তর সালের চৌদ্দই আগস্ট ছিল পূর্ববঙ্গসহ পাকিস্তানের শেষ স্বাধীনতা দিবস। এই দিনটি উপলক্ষে মুলতানের উর্দু কবি রিয়াজ আনোয়ারের লেখা ‘আজাদির দিনে’ নামে একটি কবিতা তর্জমার ছলে সেদিন জসীমউদ্দীন প্রকাশ করেছিলেন নিজের মনেরই গহীনের বেদনা। তিনি তরজমায় বলেছিলেন- ‘আজ আজাদির তেইশ বছরে কিবা উন্নতি দেশে নয়া সড়কের শত তন্তুতে আকাশের কোণ মেশে। শোষণের আর শাসনের যেন পাতিয়া এই পথ-জাল অন্তরীক্ষে আছে পাহারায় মহাশয় মহীপাল। আজি আজাদির এ পুতঃ দিবসে বার বার মনে হয় এই সুন্দর শ্যাম মনোহরা এ দেশ আমার নয়।’ একাত্তরের সূচনা থেকেই কবিরা নিয়ে বসে আছেন শব্দের প্রতিরোধ-অস্ত্র। একাত্তরের ষোল মার্চ কবি জসীমউদ্দীন ‘ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে’ নামের কাব্যসংকলনভুক্ত ‘বঙ্গবন্ধু’ কবিতায় লিখেছেন, ‘তোমার হুকুমে তুচ্ছ করিয়া শাসন ত্রাসন ভয়, আমরা বাঙালী মৃত্যুর পথে চলেছি আনিতে জয়।’

ইংরেজি মাস ও দিনগুলো

ইংরেজি মাস ও দিনগুলো

যদি আমাদের জিজ্ঞেস করা হয়, ইংরেজি বারো মাসের নাম কি কি? তা হলে সঙ্গে সঙ্গে আমরা বলতে শুরু করব জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ...। তেমনি দিনগুলোর কথা বলা হলে বলব, সানডে, মানডে ইত্যাদি। এ তো জানা কথা। সবাই তা জানে। কিন্তু নামগুলো কোত্থেকে এলো সে কথা হয়তো আমরা অনেকেই জানি না। সে এক মজার ইতিহাস। প্রথমে ইংরেজি দিনগুলোর কথাই ধরা যাক। কিন্তু তার আগে ‘টিউটনদের’ সম্বন্ধে আমাদের কিছু জানা দরকার। কেননা, সপ্তাহের সাতটি দিনের ভেতর চারটি দিনের নামকরণ টিউটনরাই করেছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায়, রোমান সাম্রাজ্যের উত্তর প্রান্তে বহু যুগ ধরে শক্তিমান একদল লোক বাস করত। তারা লেখাপড়া কিছুই জানত না। তবে যুদ্ধ করতে তারা ভালোবাসত। অর্থাৎ অর্ধ সভ্য ছিল এই সব লোকেরা। টিউটনদের গায়ের রং ছিল সাদা। ইংরেজ, ফরাসি, জার্মান ও আমেরিকানদের অনেকেই পূর্ব পুরুষ ছিল এই টিউটনরা। গ্রিক বা রোমানদের মতো টিউটনরাও দেব-দেবীতে বিশ্বাসী ছিল। তবে তাদের দেব-দেবীরা ছিল ভিন্ন ধরনের। গ্রিক, রোমানদের দেব-দেবীর সঙ্গে তাদের কোনো মিল ছিল না। টিউটনের শ্রেষ্ঠ দেবতার নাম ‘উডেন’। উডেন হলো যুদ্ধের এবং আকাশের দেবতা। টিউটনরা মনে করত উডেন আকাশের ‘ভাল হাল্লা’ নামের এক আজব প্রাসাদে বাস করত। এই দেবতার নামানুসারেই উডেনস-ডে বা বুধবার নামকরণ হয়েছে। টিউটনদের পরবর্তী শ্রেষ্ঠ দেবতা ছিল ‘থর’। থর ছিল মেঘ-গর্জন ও বিদ্যুতের দেবতা। হাতে একটা হাতুড়ি নিয়ে থর দূর-দূরান্তে অবস্থিত ঠান্ডা দেশের দানব-দৈত্যদের সঙ্গে যুদ্ধ করত। তার নামানুসারেই হয়েছে ‘থারস-ডে’ বা বৃহস্পতিবার। টিউটনদের দু’জন দেবতার একজনের নাম ছিল ‘টিউ’ আর একজনের নাম ছিল ‘ফেরা’। তাদের নামনুসারে টুইস ডে বা মঙ্গলবার এবং ফ্রাই-ডে বা শুক্রবার হয়েছে। বাকি তিনদিন সান-ডে বা রবিবার, মান-ডে বা সোমবার হয়েছে সূর্য ও চন্দ্রের নামানুসারে। গ্রিকদের কৃষি ও সভ্যতার দেবতা ‘স্যাটান’-এর নামানুসারে স্যাটার-ডে বা শনিবারের নামকরণ হয়েছে। এবার ইংরেজি মাসগুলোর নাম কি করে হলে সে কথাই বলছিÑ প্রথমে আসছে জানুয়ারি মাসের কথা। রোমানদের বহু দেব-দেবী ছিল। তোরণ ও দরজার জন্য ছিল দুই মুখ বিশিষ্ট এক দেবতা নাম তার ‘জানুস’। আমরা জানি কোনো জায়গায় প্রবেশ করতে হলে প্রথমে তোরণ বা দরজা অতিক্রম করতে হয়। সে জন্য জানুসকে আরম্ভের দেবতাও বলা হতো। মাসগুলোর ভেতর জানুয়ারি প্রথম থাকায় দেবতা জানুসের নামানুসারে নামকরণ করা হয়। মাসের পনেরো তারিখে রোমানরা পবিত্র ও শুদ্ধির জন্য ভোজের আয়োজন করত। ল্যাটিন ভাষায় এটাকে বলা হয় ‘ফেব্রুয়া’ সেই থেকে পরবর্তী মাসকে তারা ফেব্রুয়ারি নামে অভিহিত করত। মার্চ মাসের নাম এসেছে রোমানদের দেবতা ‘মারস্’-এর নাম হতে। মারস্ ছিলেন যুদ্ধ ও কৃষির দেবতা। অ্যাফ্রোডাইট ছিলেন প্রেমের দেবী। গ্রিকরা সংক্ষেপে তাঁকে ‘অ্যাফ্রো’ নামে ডাকত। এপ্রিল মাসের নাম হয়েছে অ্যাফ্রো দেবীর নামানুসারে। রোমানদের দেবী ‘মে’ ও ‘জুনো’র নামানুসারে ইংরেজি মে ও জুন মাসের নাম হয়েছে। জুনো ছিল স্বর্গের দেবী। তা ছাড়া মেয়েদের অভিভাবিকা ও বিয়ের দেবীও ছিলেন জুনো। রোমের বীর সেনাপতি সিজারের নামেই ইংরেজি জুলাই মাসের নামকরণ করা হয়েছে। সিজারের পুরো নাম ছিল জুলিয়াস সিজার। তার নামের প্রথম শব্দ জুলিয়াস থেকে জুলাই কথাটি গ্রহণ করা হয়েছে, অগাস্টাস সিজার ছিলেন সিজারের পোষ্য পুত্র। তার আসল নাম ছিল অক্টভিয়াস্। বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি হয়ে তিনি এই উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। রোমকদের কাছে সুশাসনের জন্য তিনি দেবতা রূপে পুঁজিত হতেন। তার নামেই অগাস্ট মাসের নামকরণ করা হয়েছে। ‘সেপ্টেম’ ‘অক্টো’ ‘নভেম্’ ও ‘ডিসেম্’ প্রভৃতি ল্যাটিন শব্দগুলো থেকে বছরের বাকি চারটি মাস যথাক্রমে সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসের নামকরণ করা হয়েছে। ল্যাটিন ভাষায় সেপ্টেম্ শব্দের অর্থ সাত, অক্টো অর্থ আট, নভেম্ ও ডিসেম অর্থ যথাক্রমে নয় ও দশ। সুতরাং রোমানদের কাছে এই মাসগুলো ছিল যথাক্রমে সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম মাস। কিন্তু ইংরেজরা এই নিয়ম পাল্টে দিয়েছে অর্থাৎ সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাস আজ আর সপ্তম, অষ্টম, নবম, দশম মাস নয় বরং নবম, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ মাস। এভাবেই ইংরেজি মাসের নামকরণ হয়েছে।

পিউ ॥ নিজেই কবিতা যেন

পিউ ॥ নিজেই কবিতা যেন

আমাদের দেশে শিল্প-সংস্কৃতি শাখায় যাদের বহুমুখী বিচরণ কিংবা বলা ভালো যারা বহুমাত্রিক শিল্পী, তাদের পরিচয় ও মূল্যায়নের বেলায় রসগ্রাহীদের কিছুটা সমস্যায় পড়তে হয়। কোন পরিচয় রেখে কোনটাকে বড় করে দেখবেন! এক্ষেত্রে যেটি হয়, ওই শিল্পীর প্রতিভার প্রতি সুবিচার করা হয়ে ওঠে না। কোনো একটা শিল্পশাখার সাধক হিসেবেই তাকে পরিচয় করানোর রেওয়াজ দেখা যায়। পিউ, সুলতানা শাহরিয়া পিউয়ের বেলায়ও এমন বিভ্রাট ঘটেছে। তিনি নিভৃতে কবিতাতেই সমর্পিত ছিলেন, ছিলেন বিশ^ কবিতার নিষ্ঠ পাঠক এবং অনুবাদক; অথচ এই মৌল পরিচয়টিই যেন কিছুটা আড়ালেই পড়ে গেছে মঞ্চে ও টেলিভিশনে তাঁর বিবিধ পারফর্ম্যান্সের কারণে। পিউয়ের আকস্মিক প্রস্থানের পর প্রাথমিক শোক না কাটিয়েই আমরা, তাঁর বন্ধুরা মন্তব্য/অভিমত প্রকাশ করে চলেছি। সেসবের ভেতর সাহিত্যিক গৌরাঙ্গ মোহান্তের সংক্ষিপ্ত অথচ তাৎপর্যপূর্ণ অভিমত আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। তিনি বলছেন : ‘অসময়ে অসীম পারাবারে হারিয়ে গেলেন কবি সুলতানা শাহরিয়া পিউ। পাপিয়ার কাছে হয়তো তিনি প্রাকৃতিক সুরের দীক্ষা নিয়েছিলেন। কণ্ঠে অবলীলাক্রমে তুলে নিতেন রবিঠাকুরের গান, কবিতা আবৃত্তি করতেন আর গুণী মানুষজনকে আলোকধ্বনির উৎসের কাছে একত্রিত হতে আহ্বান জানাতেন। বেশ কিছুদিন থেকে তিনি ডায়ালিসিসে ছিলেন। কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের জন্য চেন্নাই যেতে চেয়েছিলেন। বাঁচতে চেয়েছিলেন আরও ক’টা দিন। অনেক কাজ রয়েছে অসমাপ্ত। দেশের জন্য যাঁরা যুদ্ধ করেছেন তাঁদের সাক্ষাৎকার নিতে চেয়েছিলেন। দুয়েকজনের নিয়েছেনও। সে সাক্ষাৎকার শব্দহীনতার ভেতর থেকে যেতে পারে। অনুবাদে মগ্ন থেকেছেন। তাঁর অনূদিত কর্মকে সুসজ্জিত করা সহজসাধ্য নয়। মৃত্যুর আকস্মিকতা অসহনীয়। সহসা একজন মুক্তবুদ্ধির মানুষ স্থির পটে বন্দি হবেন, মেনে নেওয়া যায় না। একটি অর্কিড বনের পথ ধরে যেতে যেতে তিনি এখন মুদ্রিত কবিতায় কিরণ ছড়িয়ে দিচ্ছেন! শেষের বাক্যটি আমি দ্বিতীয়বার পড়ি : ‘একটি অর্কিড বনের পথ ধরে যেতে যেতে তিনি এখন মুদ্রিত কবিতায় কিরণ ছড়িয়ে দিচ্ছেন।’ কবির বিদায়ের পর পাঠকের সামনে থাকে কবির কবিতারাজিই, আর কিছু নয়। সেখানেই কবিকে শনাক্ত করা যায়, ব্যক্তিমানুষের অনুভূতি ও প্রতিক্রিয়ার সারাৎসার স্পর্শ করা যায়। বহুমাত্রিক শিল্পী-লেখক ও প্রসারিত-হৃদয়া মায়াবতী ব্যক্তি পিউকে, বলা ভালো পিউয়ের শুদ্ধ সত্তাকে অবলোকন ও বিবেচনা করার জন্যে তাঁর কবিতার কাছেই আমাদের ফিরতে হবে। এবং অনুবাদকর্মের কাছেও। কেননা দান্তে বা আব্বাস কিয়োরাস্তামি, অথবা অন্য কেউ, অনুবাদের জন্য কবিকে নির্বাচন করার ভেতরেও একজন কবি বা অনুবাদকের কবিতাভাবনার সংকেত মেলে। এটা সত্য যে, অনুবাদের জন্য চিরায়ত কবির প্রতিই পিউয়ের পক্ষপাত ছিল। আর তাঁর মাতৃভাষার ক্ল্যাসিক কবির (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) গান তিনি গাইতেন বলে রবির কবিতা ও গীতিকবিতা তাঁকে প্রভাবিত করেছিল। অন্যের কবিতার কথা বলছি না, নিজের কবিতা যখন পিউ আবৃত্তি করতেন, তখন কবিতা, সংলাপ ও গানের সংমিশ্রণে এমন এক ঘোরলাগা আবহ তৈরি করতেন যে, স্বদেশের ও স্বসমাজ-স্বকালের ভাঁজ সাবলীলভাবে উন্মোচিত হয়ে পড়ত। পিউ গানের শিল্পী হওয়ার সুবাদেই মঞ্চে বা ঘরোয়া আয়োজনে নিজের যেসব কবিতা পরিবেশন করতেন, তা শ্রোতাদের তাঁর প্রতি অনুরাগী করে তুলত। একবার শুনলে কেউ তা ভুলত না। আবৃত্তিশিল্পী হিসেবে টেলিভিশনে তাঁর গুরুত্ব ছিল। যদিও টিভিতে তিনি আবৃত্তি করতেন সব বিশিষ্ট কবিদেরই কবিতা। পুড়িও না তোমার ঘর শিরোনামে পিউয়ের একটি ছোট কবিতা তুলে দিচ্ছি নবীন পাঠকদের জন্যে।

অদ্বৈত মল্লবর্মণের জীবন ও কর্ম

অদ্বৈত মল্লবর্মণের জীবন ও কর্ম

অদ্বৈত মল্লবর্মণ বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ এর অমর স্রষ্টা। তিতাস একটি নদীর নাম ছাড়াও অদ্বৈত মল্লবর্মণের উপন্যাস ‘রাঙামাটি’, ‘শাদা হাওয়া’, এবং ‘দলবেঁধে’ নামে একটি গল্প গ্রন্থ প্রকাশ পায়। তবে শুধু তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসটির মাধ্যমেই অদ্বৈত মল্লবর্মণ বাংলা সাহিত্যে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। এই তিতাস একটি নদীর নাম সারা বিশ্বের নদীমাতৃক ধীবর সম্প্রদায়ের জীবনোপাখ্যানের মহাকাব্য। উপন্যাসটির নাট্যরূপ দিয়ে কলকাতায় মঞ্চস্থ করেছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ারই আরেক খ্যাতিমান নাট্য ও চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব উৎপল দত্ত। যা পরবর্তীতে ঋত্বিক ঘটক চলচ্চিত্রে রূপ দিয়েছেন। এ ছাড়াও উপন্যাসটি নিয়ে আরও নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। অনূদিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়। এই ক্ষণজন্মা সাহিত্যিক  ছিলেন জলমজুর, জলদাস। অদ্বৈতর নিজের ভাষায় ‘জাউলার পোলা’। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ১ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের গোকর্ণ ঘাটে তিতাস নদীর তীরের একটি দরিদ্র মালো পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম অধরচন্দ্র বর্মণ। অদ্বৈতরা ছিলেন তিন ভাই একবোন। ভাই বোনদের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। বাবা অধরচন্দ্র বর্মণের সঙ্গে শৈশবে তিনি তিতাস নদীতে মাছ ধরতে যেতেন। সম্প্রদায়গতভাবেই তিনি ছিলেন অপরায়ণের নির্মম শিকার। মালোপাড়াটি উন্মাষিক ‘ভদ্র’জনদের নিকট ছিল ‘গাবর’পাড়া হিসেবে পরিচিত। ভারতবর্ষীয় ধর্ম-বর্ণ ও সমাজবাস্তবতার অপরভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে, মল্লবর্মণদের মালো বা গাবর বলে আখ্যা দিয়ে তাদের শ্রমের প্রতি ব্যঙ্গ ও তাচ্ছিল্য করে ‘ভদ্র’জনেরা এ ধরনের নামকরণ করেছেন। এ কারণে তার শৈশব-কৈশোর ছিল সঙ্কুচিত ও বিড়ম্বিত। যা তার ‘তিতাস একটি নদীর নাম’সহ অন্যান্য লেখায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আরম্ভ হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের প্রথম মাইনর স্কুল (বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়) থেকে। মাইনর স্কুলে ভর্তি হওয়ার পূর্বেই তার পিতা-মাতা উভয়ই পরলোকগমন করেন। এ সময় মালোরা চাঁদা তুলে লেখাপড়ার খরচ সংগ্রহ করেন। মাইনর স্কুলে তিনি বরাবরই প্রথম হতেন এবং বৃত্তিও পেয়েছিলেন। এরপর ভর্তি হন অন্নদা উচ্চ বিদ্যালয় (বর্তমান অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়)-এ। এ বিদ্যালয় হতে তিনি ১৯৩৩ সালে প্রথম বিভাগ পেয়ে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা পাস করেন। এরপর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে আই এ ক্লাসে ভর্তি হন। কিন্তু আর্থিক অনটনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় তিনি বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেননি। আই এ কøাসের পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখেই তিনি ক্যাপ্টেন নরেন দত্তের অনুরোধে ১৯৩৪ সালে কলকাতায় চলে যান। বাংলা সাহিত্যের অমর কথাশিল্পী অদ্বৈত মল্লবর্মণ পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। নেহাত ছোট বয়স হতেই তার সাহিত্যিক কৃতিত্বগুলো সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। তিনি স্কুল জীবনেই নানা পত্র-পত্রিকায় গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা লিখে অনেক পুরস্কার ও মেডেল পেয়েছিলেন। অদ্বৈত ছাত্রজীবনে কবিতাই বেশি লিখতেন। বিদ্যালয়ে তিনি হাতে লেখা দেয়ালপত্র ‘সবুজ’-এ  ‘তিতাস’ শিরোনামে কবিতা লেখেন। এটাই তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’র বীজ কবিতা। ওই সময়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তিনি প্রধানত শিশুতোষ অনেক কবিতা লিখেছেন। সাহিত্যপাঠ ও অনুধাবনে তিনি ওই বয়সেই শিক্ষকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেন। গ্রন্থ প্রকাশে অভিলাষী সতীর্থ বা অনুজ তার মতামত লাভের জন্যে তার কাছে পাণ্ডলিপি পাঠাতেন। সেসব ক্ষেত্রে কৃত মন্তব্যে তার সৃজন ও মননের পরিচয় পাওয়া যেত। প্রথম তারুণ্যেই তিনি মৃত্তিকালগ্ন ও লোকজ সাহিত্য অনুসন্ধান ও তার রসগ্রহণে ব্রতী হন। ভাবী সাহিত্যের উপাদান হিসেবে তখনই তিনি সেগুলোকে আত্মস্থ করতে শুরু করেন। কলকাতায় গমন করে প্রথমে ‘মাসিক ত্রিপুরা’ পত্রিকার কাজে যোগদান করেন। ১৯৩৭ সালে ক্যাপ্টেন নরেন দত্তের মালিকানায় নবপর্যায়ে ‘নবশক্তি’ সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হলে তাতে তিনি সহকারী সম্পাদকের পদে যোগদান করেন। ১৯৪১ সাল পর্যন্ত এ পত্রিকায় তিনি সম্পাদকরূপে দায়িত্ব পালন করার সাত বছর পর তার স্মৃতি-বিজড়িত সাপ্তাহিক এ পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় ‘আজাদ’, ‘কৃষক’, ‘মোহম্মদী’ প্রভৃতি পত্রিকাতে পার্টটাইম কাজ করে অর্থ উপর্জন ও ব্যাপকভাবে বই কেনা, পাঠ করা এবং লেখালেখি তথা গবেষণা কাজ চালিয়ে যান। নবশক্তির পাতায় নামে বেনামে তার অনেক বিচিত্র লেখা ছাপা হয়। নবশক্তি বন্ধ হলে তিনি ‘মোহম্মদী’তে নিয়োগ লাভ করেন। ১৯৩৯ সালে তিনি সতীর্থ বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে কলকাতার ৭ নবীনকুণ্ড লেনে ‘চয়নিকা’ পাবলিশিং হাউস গঠন করেন। বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন-কালিদাস মুখোপাধ্যায়, রাখালদাস চক্রবর্তী, সতীকুমার নাগ, সনৎকুমার নাগ প্রমুখ। ১৯৪০ সালে তিনি সনৎকুমার নাগের প্রকাশনায় কালিদাস মুখোপাধ্যায়, রাখালদাস চক্রবর্তী ও সতীকুমার নাগের সঙ্গে যৌথভাবে ‘দলবেঁধে’ গল্প সংকলন সম্পাদনা করেন। ১৯৪২ সালে তিনি তার উপন্যাস ‘শাদা হাওয়া’ রচনা শেষ করেন। যা সোনারতরী পত্রিকায় ছাপা হয় ১৯৪৮ ইংরেজি বা ১৩৫৫ বঙ্গাব্দে। সেই সালে তিনি আবুল কালাম শামসুদ্দীনের মনোনয়নে তারই সহ-সম্পাদকরূপে যোগদান করেন ‘মাসিক মোহাম্মদী’ পত্রিকায়। ক্রমে মোহাম্মদী সম্পাদনার ক্ষেত্রে মূল কর্তাব্যক্তিতে পরিণত হন। নামে-বেনামে মোহাম্মদীতে তার বেশকিছু রচনা প্রকাশিত হয়। ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত তিনি মোহাম্মদীতে দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি যুগান্তর, নবযুগ, আজাদ, কৃষক প্রভৃতিতে কাজ করেন। লেখেন প্রধানত অর্থের অভাব পূরণের জন্য। ১৯৪৩ সালে ‘ভারতের চিঠি-পাল বাক্কে’ গ্রন্থকারে প্রকাশ করেন নিজেদের ‘চয়কিনকা পাবলিশিং হাউস’ থেকে। একই বছর তিনি ‘রাঙামাটি’ উপন্যাস রচনা করেন। যা প্রকাশিত হয় মাসিক ‘চতুষ্কোণ’ পত্রিকায় ১৯৬৪ সালে, ১৩৭১ বঙ্গাব্দে। ১৩৭১ বঙ্গাব্দের বৈশাখ থেকে চৈত্র ১২ সংখ্যায় ১টি বাদ দিয়ে ১১ কিস্তিতে ছাপা হয়। ১৯৪৫ সালে তিনি সাগরময় ঘোষের সহযোগিতায় সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় যোগদান করেন। এ সময়ে তিনি ভালো বেতন পেতেন এবং তা নিয়মিত পেতেন। অকৃতদার নিঃসঙ্গ অদ্বৈত কৃচ্ছ্রসাধন ও উদয়াস্ত পরিশ্রম করে যতটুকু আয়-উপর্জন করতেন তার অধিকাংশই ব্যয় করতেন দুস্থ পরিজনদের মধ্যে। পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে কলকাতায় যাওয়া আত্মীয়পরিজনদের সাহায্য করতে অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন মেটাতে সাগরময় ঘোষ প্রমুখ বন্ধু-বান্ধবদের সহযোগিতায় বিশ^ভারতী গ্রন্থ বিভাগেও খণ্ডকালীন চাকরিপ্রাপ্তি এবং ১৯৫০ সাল পর্যন্ত (মৃত্যুর পূর্ববর্তী সক্ষম সময়কালে) এতে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৬ সালে মোহাম্মদীতে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এর প্রাথমিক খসড়া (৭ কিস্তিতে) প্রকাশিত হয়। ১৯৪৮ সালে শারদীয়া ‘সোনারতরী’ পত্রিকায় তার ‘শাদা হাওয়া’ উপন্যাস প্রকাশিত হয়। যা ড. অচিন্ত্য বিশ^াসের সম্পাদনায় কলকাতা থেকে ১৯৯৬ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। বিদ্যালয় জীবনেই অদ্বৈত যতটুকু পড়ার কথা তা অপেক্ষা অনেক বেশি পড়েছিলেন। নিদারুণ কৃচ্ছ্রতার মধ্যেও তিনি সারা জীবন গ্রন্থ সংগ্রহ করে গেছেন। তার নিজের স্বীকারোক্তি, ‘যা উপার্জন করেছি প্রায় সবই তো ব্যয় করেছি বই কিনতে। সাহিত্য ছাড়াও তার গ্রন্থভাণ্ডার ছিল নৃতত্ত্ব, দর্শন ও চারুকলার এক সুচিন্তিত ও মনোজ্ঞ সংগ্রহ। মানুষ ও স্বজনদের প্রতি ছিল তার অসম্ভব ভালোবাসা। কলকাতায় নিজের সীমিত রোজগার থেকে গোকর্ণঘাটের মালোপাড়ার শিশু-কিশোরদের ঘরোয়া বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য তিনি উপেন্দ্রবাবুর স্বল্পশিক্ষিত বিধবা প্রফুল্লকে নিয়তিম অর্থ প্রেরণ করতেন। তিতাসপাড়ের যেসব মালো ও অন্যান্য পরিবার উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গে গিয়েছে কিংবা রেলের শ্রমিক পরিবার তার ওখানে আশ্রয় নিয়েছিল তাদের যথাসাধ্য দায় গ্রহণ করেছিলেন অদ্বৈত মল্লবর্মণ। সঙ্গত কারণেই তার বন্ধুরা মন্তব্য করেছেন, ‘আমরা চিরকাল অদ্বৈতকে তাহার মুষ্টি অন্ন বহুজনের সঙ্গে ভাগ করিয়া খাইতে দেখিয়াছি।’ বই ও মানুষের প্রতি ভালোবাসার কারণে দীর্ঘদিন অনাহার ও অর্ধাহারে কেটেছে অদ্বৈত মল্লবর্মণের। মাইনের অর্ধেকের বেশি চলে যেত বই কিনতে, বাকি অর্ধেক দিতে হতো তার উপর নির্ভরশীল স্বজন ও আশ্রিতদের। এভাবে শরীরের প্রতি অযত্ন ও অবহেলা করে এবং অপুষ্টির শিকার হয়ে ১৯৪৮ সালে তিনি যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হন। বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের পীড়াপীড়ি ও সহযোগিতায় কাঁচপাড়া যক্ষ্মা হাসপাতালে ভর্তি হন। রোগমুক্ত হয়ে তিনি ষষ্ঠীতলার বাসায় ফিরে আসেন। ১৯৪৯ সালের ১৯ মার্চ বাংলা ১৩৫৫ সালের ৫ চৈত্র সংখ্যা সাপ্তাহিক ‘দেশ’-এ আর্ভিং স্টোন-এর উপন্যাস Lust for life এর অনুবাদ ‘জীবন তৃষা’ প্রকাশ  শুরু করেন। ৬২ কিস্তিতে  ‘দেশ’-এ প্রকাশ শেষ হয় ১৯৫০ সালের ২০ মে বাংলা ১৩৫৭ সালের ৬ জ্যৈষ্ঠতে। ১৯৫০ সালে পুনরায় যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হলে হাসপাতালে নিতে হলো। কিন্তু সেখানে তিনি কাউকে কিছু না বলে সেখান থেকে তিনি পালিয়ে এলেন। আর তাকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার সময় ও সুযোগ হলো না। এই ক্ষণজন্মা সাহিত্যিক ১৯৫১ সালের ১৬ এপ্রিল কলকাতার নারকেল ডাঙ্গার ষষ্ঠীতলার বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন।

সবুজ জমিনে লালপেড়ে শাড়ি

সবুজ জমিনে লালপেড়ে শাড়ি

জৈষ্ঠের তপ্ত দুপুর; ঝলমলে সূর্যে দীপ্তিময় চারিধার অনেক বছরের কুম্ভকর্ণময় ঘুমের অবসান পঞ্চাশ বছর পর মাকে দেখে; জিজ্ঞেস করলাম আতঙ্কে ভীত হয়ে । পঞ্চাশ বছরেই কেমন করে হলো; মুখখানা মেঘের মতো চুল সাদাকালো উত্তর দিল মা মলিনবদানা হয়ে; জানবে কীভাবে ছিলে তো ঘুমিয়ে নিজের তৃপ্তি নিয়ে এমন কথা যদি বলবি তোরা সেদিন আমায় কেন পরিয়েছিলি? সবুজ জমিনে লালপেড়ে শাড়ি। বলেছিলি তোরা দিবি না বাধা ; বলবে সবাই যে যার মনের কথা সবার উপরে রাখবি গণতন্ত্রের মান; ও কেন পেলো না ওর প্রাপ্য সম্মান এমনি যদি করবি তোরা সেদিন আমায় কেন পরিয়েছিলি? সবুজ জমিনে লালপেড়ে শাড়ি। কৃষকের ক্ষেতে আজ আগুনের সৃষ্টি মজুরি পেতে রাস্তায় শ্রমিকদের ঝরছে ঘামের বৃষ্টি কৃষণ শ্রমিকদের যাপিত জীবন যদি এমনই কষ্টের হবে সেদিন আমায় তবে কেন পরিয়েছিলি? সবুজ জমিনে লালপেড়ে শাড়ি। চারিদিকে গুম খুন ধর্ষণের হোলিখেলা শেয়ার, ব্যাংক সবখানেই আজ লুটের মেলা এমনই যদি লুটবি তোরা সেদিন আমায় কেন পরিয়েছিলি? সবুজ জমিনে লালপেড়ে শাড়ি। সর্বত্রই দেখছি নিষ্ঠুর ভয়াবহ নীতিহীনতা কোথাও নেই ভালোবাসা- নেই মায়ামমতা এমনই যদি নিষ্ঠুর হবি তোরা সেদিন আমায় কেন পরিয়েছিলি? সবুজ জমিনে লালপেড়ে শাড়ি। "খুলে ফেল মা। এ শাড়ি তুমি" কবেই তো খুলতাম শাড়িখানা যখনই খুলতে চাই তখনই মনে পড়ে ; তোদের আত্মত্যাগের কথা তরুণী থেকে যৌবনে পড়েছিলাম যেদিন মনের কোণে উঁকি দিয়েছিল স্বপ্ন সেদিন অঙ্গ ঢাকতে পরবো আমি ; সবুজ জমিনে লালপেড়ে শাড়ি। এ স্বপ্নে ক্ষিপ্ত হানাদার বাহিনী; বিদ্ধ করেছিল সুচ কোটিখানি একটি একটি করে সুচগুলো তুলে আমায় বাঁচিয়েছিলি সেদিন যে তোরা দিয়েছিলি প্রাণ অকাতরে; সম্ভ্রম বিলিয়েছিলি লাখে লাখে নয়মাস পর সুচমুক্ত হয়েছিলাম আমি; তোদের এ আত্মত্যাগ কেমনে ভুলি সাতকোটি মিলেমিশে পরিয়েছিলি; সবুজ জমিনে লালপেড়ে শাড়ি উপর থেকে বিধাতা মৃদু হেসে ; আশীর্বাদ করেছিলেন ভালোবেসে চিরযৌবনা বর পেয়েছিলাম সেদিন; বাঁচব ততদিন দুনিয়া রবে যতদিন। "তাহলে কেন তোমার চুল সাদাকালো বিধাতার আশীর্বাদ কি বিফলে গেলো?" কিছুক্ষণ আগে কাজলরেখা দিদি ; বলেছে একে একে তাঁর দুঃখ গাঁথাটি এখন সে মহাসুখে রাজরানির আসনে; থাকবে চিরকাল এমনই বেশে তাই আশা আবার জাগছে বুকে; রাখবি তোরা আমার মান হেসে হেসে এ আশায় পরে আছি এখনো আমি; সবুজ জমিনে লালপেড়ে শাড়ি।

কবিতা

কবিতা

প্রথম কদম ফুল শেখ আতাউর রহমান      গ্রাবিয়েল গার্সিয়া মার্কেস নোবেল লেকচারে দিয়েছিলেন অমূল্য যে ভাষণ কিছু কিছু আজো মনে আছে তার: ‘যা কিছু ঘটে জীবনে সবটুকুই করে না ‘ম্যাটার’ যে ঘটনাটা মনে থাকে এবং কি ভাবে তা মনে থাকে সেটুকুই জীবন-বাকিটুকু অসার কথন! জায়গা হয় তার আস্তাকুঁড়ের নোংরা আস্তরণ!’ এটাই বুঝি জীবনের প্রকৃত ধরন-স্মৃতিবিস্মৃতির খেলা চলে আমরণ আজীবন! যেমন চায়ে এক কাপ চিনি দেয়া অথবা উবু হয়ে জুতোর ফিতে বাঁধা ঘুমুতে যাওয়া রোজরাতে, ব্রেকফাস্ট সারা সুপ্রভাতে, সময়ে অসময়ে নখকাটা-কতো আর কোই আছে দাড়ি কাটা গোছল করা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খোঁজা চিরুনীটা সবশেষে খবরের কাগজে চোখটা বুলোই, ঘড়ির কাঁটা তখোন শব্দ করে বেজে চলেছে এক দুই অতঃপর সন্তানেরে লেবুনচুসে ভুলোই!-১২টায় শুই কথা কিন্তু হয়নিকো শেষ ওগো সখাসই, শীতে কমদামি কম্বলে নিজেকে মুড়োই সবইতো একঘেয়ে- কোনোটিই নয় স্বতন্তর-সারাজীবনভর মহড়া দিয়ে চলি এমনই পৌনঃপুনিক অভ্যেসে এবং ঝেড়ে ফেলে দিই মাথা থেকে সব-দিনে দিনে স্থূল হয় বিয়োগের খাতা অবশেষে! তবু কথা থেকে যায় ভুলি কি জীবনের সবটাই? কৈশোরে পাশের বাড়ির পাড়াবেড়ানি মেয়ে শিখা আমার হাতের তালোয় গুঁজে দিয়েছিলো ক’একটি ফুলের বিচি, বলেছিলো লাগিয়ে দিবি উঠোনে, ফুটবে ফুল দোপাটি আমি হেলাফেলা করে সে-বিচিগুলো পুতে দিই উঠোনে-তারপর যথারীতি ভুলে যাই এ ঘটনা থাকে না মনে অতঃপর একদিন সকালে ঘুম ভেঙে বিস্ময়ে দেখি অযত্নে পুতে দেয়া সেই বিচিতে থোকা থোকা ফুটেছে ফুল দোপাটি! ইচ্ছে করে তখুনি এ ফুলে সাজাই পাগলি মেয়ে শিখার অগোছালো ঋদ্ধ খোঁপাটি! এ বড় অতি তুচ্ছ ঘটনা-দোপাটিও অতিসাধারণ ফুল-কিন্তু আমার জীবনে তা ‘প্রথম কদম ফুল!’ সে আনন্দস্মৃতি আজও ছিনিয়ে নিতে পারেনিতো যম! জীবন এ-ভাবেই বয়ে চলে নদীর মতোন-থামেনাকো একদম!!