ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সাহিত্য

সাহিত্য বিভাগের সব খবর

সংগীত অভিধান

সংগীত অভিধান

অতুলপ্রসাদ সেন (১৮৭১-১৯৩৪ খ্রি.) পঞ্চগীতি কবির একজন স্বনামখ্যাত কবি হিসেবে বাংলা গানের ইতিহাসে অধিষ্ঠিত আছেন। খুব বেশি গান তিনি লেখেননি, কিন্তু যে সব গান প্রকাশিত হয়েছে তা বৈশিষ্ট্য গুণে ভরপুর। সব শ্রেণির শ্রোতাদের মন আকৃষ্ট করেছে তাঁর গান। রবীন্দ্র ¯েœহধন্য অতুল পেশাজীবী হিসেবে ছিলেন ব্যারিস্টার, খুব ব্যস্ত জীবন ছিল তাঁর। তবুও বিভিন্ন পর্যায়ের গীত রচনা করে বাংলা গানকে সমৃদ্ধ করেছেন এবং পঞ্চকবিদের একজন হিসেবে নিজেকে আসীন করেছেন। তাঁকে নিয়ে অনেক কাজ হওয়ার কথা, কিন্তু হয়েছে কম। মাত্র দুটি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়। অতুলপ্রসাদ সমগ্র: সুনীলময় ঘোষ, প্রথম প্রকাশ : কলিকাতা পুস্তক মেলা ১৩৯২/১৯৮৬, সাহিত্যম, কলিকাতা এবং  অতুলপ্রসাদ সেন: বিশ^জিৎ ঘোষ, প্রথম প্রকাশ, বৈশাখ ১৪০১/মে ১৯৯৪, বাংলা একাডেমি, ঢাকা। এ দুটি গ্রন্থকে আশ্রয় করেই সংগীত গবেষক শাহীনুর রেজা ‘অতুলপ্রসাদ সেন সংগীত অভিধান’ গ্রন্থ রচনা করেছেন। আমাদের জানামতে দুই বাংলায় অতুলপ্রসাদকে নিয়ে এমন গ্রন্থ এই প্রথম। লেখক কেবল ১১৪০টি শব্দার্থ-টিকা দিয়েই বইয়ের পাতা পূর্ণ করেননি। পূর্ণ এবং অসমাপ্ত ২২৪টি গানের বর্ণানুক্রমিক তালিকা, ২৩টি গানের উৎস গল্প, বেশ কয়েকটি আলোকচিত্র, একটি হাতের লেখা ও বংশলতিকা এ গ্রন্থের অসামান্য দিক।  লেখকের ‘লেখকের-কথা’ পাঠ করলে যে কোনো পাঠক অতুলপ্রসাদের গানের তাৎপর্যতা অনুধাবন করতে পারবেন। যেমন লেখক লিখেছেন ‘অতুলপ্রসাদ সেনের গানগুলো দেবতা, প্রকৃতি, স্বদেশ, মানব ও বিবিধ পর্যায়ভুক্ত। অপ্রকাশিত বেশ কিছু গানও আছে। কোনো কোনো গানের শিরোনামে রাগ-তালের নামোল্লেখ আছে। ‘দেবতা’ পর্যায়ের গানে কৃষ্ণ, রাধা, লক্ষ্মী, শিব, মহেশ^র, সীতা, কৌশিকী, গিরিরাজ, গোরা, গোকুল, মথুরা, পা-ব, চ-ী, জাহ্নবী, ত্রিনেত্র, নারায়ণ, নিমাই, নিতাই, নটরাজ, মহেশ, রঘুনাথ, রাঘব, শ্রীকান্ত, সীতা, শূলপানী, সাবিত্রী ইত্যাদি হিন্দু-পৌরাণিক শব্দের ছড়াছড়ি। তবে অন্যান্য ধর্মের ছোঁয়া একেবারেই নাই।  গানের কথায় সাংগীতিক শব্দের ব্যবহার লক্ষণীয় ডমরু, ঢোল, বীণা, বাঁশি, মোহনবীণা, মুরলী, শঙ্খ, শিঙ্গা, ভৈরব, ভূপালী, নটনারায়ণ, পঞ্চম, মল্লার, রামকেলী, ললিত, শ্রীরাগ, মালসী, মেঘ, বসন্ত, কল্যাণী, মালবী, গৌড়, সারঙ্গ, সিন্ধু প্রভৃতি।’ ‘অতুলপ্রসাদ সেন সংগীত অভিধান’ গ্রন্থের জন্য প্রবন্ধ সাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক-প্রাবন্ধিক অধ্যাপক ড. মোরশেদ শফিউল হাসান একটি মূল্যবান ভূমিকা লিখে দিয়েছেন। যা পাঠ করলে গ্রন্থ ও লেখক দুই সম্পর্কেই খুব উন্নত ধারণা হয়। যেমন  ‘শাহীনুর রেজা আমাদের সংগীত জগতের সেই বিরল মানুষের একজন, গান গাওয়া ও শেখানোর অতিরিক্ত যিনি নিরলসভাবে সংগীত নিয়ে লেখালেখি, সংকলন-সম্পাদনা ও গবেষণাধর্মী কাজ করে আসছেন। কোনো রকম প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই সম্পূর্ণ নিজস্ব আগ্রহে ও উদ্যোগে করা এসব কাজ তাঁর পরিশ্রমশীলতা ও নিষ্ঠার পাশাপাশি দায়িত্বশীলতারও পরিচয় দেয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি তাঁর ‘নজরুলের সংগীত জীবন’ বইটি পড়ে ভীষণ মুগ্ধ হয়েছিলাম।

সমেস মণ্ডলের সমস্যা

সমেস মণ্ডলের সমস্যা

বোচন সাহার দোকানে লুঙ্গি কিনতে গিয়েছিল সমেস মণ্ডল। বেশ বিনয়ের সঙ্গেই বলেছিল ১নং একটা হাতি মার্কা লালপিন লুঙ্গি দেখাতে।  একটু উল্টে-পাল্টে দেখার পর সামনের মাসে দামটা পরিশোধ করবে বলায় একনম্বর দূরে থাক, দুই বা তিন, কোনো নম্বরের লুঙ্গিই দেওয়া হয়নি তাকে। উল্টো বাকির কথায় মহাখাপ্পা হয়ে উঠেছিলেন বোচন সাহা।  লুঙ্গিটা সরিয়ে নিতে নিতে মুখ বাঁকা করে বলেছিলেন ‘টাকা নাই, আবার ১নং হাতি মার্কা মারাইছিস্? যা, ভাগ।’ এতদিনের পরিচয়! অথচ আড়াই টাকা দামের লুঙ্গিটা হাত থেকে কেড়ে নিলো কেমন রাগ দেখিয়ে! তারপর সোজাসুজি বলে দিলেন, কোনো লুঙ্গিই বেচবেন না তার কাছে! গজরাতে গজরাতে লালপিন লুঙ্গিটা আবার তুলেও রাখলেন দোকানের তাকের ওপর!  এটা কি কম অপমান! অপমানের এই কথাটা খুব মনে আছে। মনে রেখেছে সমেস ম-ল ভালো করেই।  দেবেন প্রামাণিকেরও একই কেস।  শনিবারের হাটে এক পোয়া কেরোসিন আর এক ছটাক সরষের তেলের জন্য গিয়েছিল তার মনোহারি দোকানে। গলায় সুতলিবাঁধা ছোট-বড় বোতল দুটো হাতে নিয়েই প্রামাণিকের বেটা শুধালেন তাকে, ‘পয়সা আন্ছিস তো?’  তখন লুঙ্গির কোচর হাতিয়ে পয়সা না খুঁজে না পেয়ে কেবল বলেছিল, ‘আস্তার মধ্যে বুঝি পড়ি গেইছে বাবু! সামনের হাটোৎ দেমো আলা।’ এ কথা শুনেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন মুদিদোকানি দেবেন প্রামাণিক। তিনিও মুখ বাঁকিয়ে বলেছিলেন, ‘ইদিক ম্যালা মারি খাইছিস্। আর হওয়ার নয়। এ্যাখন ভাগ্ এ্যাটে থাকি।’ বলা চলে একরকম কুকুর তাড়ানোর মতো করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল তাকে দোকান থেকে।  এটাও মনে ভীষণ দাগ কেটে আছে সমেস ম-লের। খড়িয়াবাঁধা হাটের উত্তর-পূর্ব কোনের তামাকপাতা, বিড়ি-দড়ি, তাবিজ-কবজ মায় কবিরাজি ওষুধ থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরনের বেনেতি সদাইর দোকান মনি সেনের। এখানেও তার ওঠাবসা মেলা দিনের। দোকানের সামনে দাঁড়ালে হুকার তামাক আর বিড়ির সুগন্ধেই একরকম নেশা হয়ে যায় তার। সুযোগ পেলেই সে এখানে আসে।  দোকানের সামনে ঝাড়ু দেওয়া, ইঁদারা থেকে বালতি ভরে পানি এনে দেওয়া, কতদিন এমন কত ধরনের কাজই না করে দিয়েছে সে মনি সেনের।  সেই মনি সেনও কিনা সেদিন ভরা হাটের মধ্যে তাকে বলে বসলেন, ‘এ্যাকনা সরি খাড়া হ’তো বাহে। কিছুই কিনিস্ না। পত্তি-পত্তি খালি ভিড় করিস। দেখিস না কত গাহাক্?’ এতেও বিরাট সম্মানের হানি হয়েছে তার। এটাও খুব করে মনে রেখেছে তাই সমেস ম-ল। আসলে মনে আছে কথাটা ঠিক নয়। অপমানের এতসব কথা এখন নতুন করে উঁকি দিতে শুরু করেছে তার মনে।  ক’দিন থেকেই মান-সম্মান বোধটা একটু একটু করে বাড়তে শুরু করেছে তার। কিছুক্ষণ পরপরই তা চাগাড় দিয়ে উঠছে তার মনে।  ইন্ডিয়ার দালাল শেখ সাহেবের কথায় নৌকায় ভোট দিয়ে বাবুরা মনে করেছিল দেশটা বুঝি ওদের বাপের! হিন্দুদের সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগের মুসলমান শালারাও যে কি বুঝে হেরিকেন আর দাঁড়িপাল্লা মার্কা ছেড়ে একচেটিয়া সবাই ভোট দিল নৌকায়?  ভোট দিল সবাই, আর ভাব বাড়লো মালাউনগুলার! এই নৌকার পাওয়ারেই বহুৎ খারাপ ব্যবহার করেছে তার সঙ্গে এতদিন এরা।  আর বেকায়দায় পড়ে সহ্যও করতে হয়েছে তাকে এসব অপমান। দুটো পয়সার জন্য এতোদিন মালাউনের বাচ্চাদের বাবু-বাবু বলে সম্মানও দেখিয়েছে সে মেলা।  তবে আর নয়। এবার ক্ষমতার পালা বদল হতে শুরু হয়েছে।  চেয়ারম্যান কালামজিদ সাহেব শান্তি কমিটির বিরাট এক দায়িত্ব দিয়ে ফেলেছেন তাকে।  এই সমেস ম-ল আর সেই সমেস ম-ল নাই। এখন সে ইসলাম আর দেশের শান্তি রক্ষার বিরাট সৈনিক।  এবার সবাইকে দেখিয়ে দিতে হবে- নতুন দিনের নতুন মানুষ সমেস ম-ল এখন সরকারি ক্ষমতার অংশীদার। কালামজিদ চেয়ারম্যান তাকে সঙ্গে নিয়ে মাদ্রাসা আর চিনিরকলে বসানো পাকফৌজের ক্যাম্পে যাওয়ার পর  থেকেই বেশ সম্মানী মানুষ বনে গেছে সমেস ম-ল। সাচ্চা পাকিস্তানি হিসেবে তাগড়া মেজর সাহেবের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে তার। ঘাড়ে হাত দিয়ে মেজর সাহেব তাকে ডেকেছেন ‘সমেস সাহাব’ বলে!  সেদিনের পর থেকেই আর মাটিতে পা পড়ছে না যেন সমেশ ম-লের।  ক্ষমতার সূচনাটাও তার সেদিন থেকেই।  শান্তি কমিটির সদস্যের ডান্টিকার্ডটা হাতে পাওয়ার পর তো আর কথাই নাই। শরীরে যেন দুনো বল ভর করেছে সেদিন থেকে। গায়ের পোশাক, চলাফেরা আর ব্যবহারে ব্যাপক পরিবর্তন এখন তার।  ডান্টিকার্ডটা যেদিন হাতে এলো, সেদিন প্রায় সারারাত না ঘুমিয়ে পরদিনের কর্মপরিকল্পনা স্থির করে ফেললো সমেস ম-ল। প্রথম কাজ হিন্দু বাবুদের আর মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া পরিবারগুলোর বাড়িঘর লুটপাট করা। তারপর বাড়ি আর দোকানগুলো দখলে নেওয়া। লুঙ্গি, তেল বাকি না দিয়ে আর দোকানের সামনে থেকে খেদিয়ে দিয়ে করা অপমানের প্রতিশোধ নিতে এটা তার ন্যায্য অধিকার! অতএব পরদিন সকালেই অ্যাকশন শুরু সমেস ম-লের। দোকান-বাড়ি ফেলে যমুনা পাড়ি দিয়ে মানকারচর হয়ে ইন্ডিয়ায় চলে গেছে খড়িয়াবাঁধা বাজারের হিন্দুরা আগেই। অবশ্য তাদের বাড়ি-ঘরের মালামালও লুট হয়ে গিয়েছিল তখনই। বড়-বড় হিন্দুবাড়ি আর দোকানগুলো এখন চেয়ারম্যান আর মেম্বার সাহেবদের দখলে। তুলনামূলক ছোট আকারের কয়েকটি ধন-সম্পদ লুট হওয়া খালি বাড়ি আর দোকানঘর ছাড়া এখন আর তেমন কিছুই অবশিষ্ট নাই সেখানে।  কিন্তু প্রতিশোধ যে নিতেই হবে! চেয়ারম্যান কালামজিদ সাহেবকে বুঝিয়ে বলে অ্যাকশনে নেমে পড়লেন তাই তিনি।  তাকে অপমান করা তিন মালাউনের শূন্য বাড়ি তিনটা একে-একে দখলে এলো সমেস ম-লের। এগুলোর দখলদারিত্ব বজায় রাখতে প্রতিদিন সকাল হলেই শুরু হলো তার নতুন ডিউটি ।  সকাল বেলা এসে বাড়ি তিনটির সামনে পালাক্রমে কিছু সময় করে বসে থাকাও শুরু হলো এরপর থেকে। ধীরে ধীরে সবাই জানতে লাগলো গনিমতের মাল হিসেবে পাওয়া বাড়িগুলো এখন সমেস ম-লের। তিন বাড়ির সবগুলো ঘরের চাবির একটি গোছা আঙুলের ডগায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবাইকে দেখানোও একটা নিয়মিত কাজ তার।   সমেস ম-লের হাতে এখন অসীম ক্ষমতা!  আড়াই টাকার লালপিন লুঙ্গির দিন শেষ! দিন শুরু এখন দামি প্লেকার্ড লুঙ্গি আর পাজামা-পাঞ্জাবির!   লালপিন লুঙ্গি আর ছেঁড়া-ময়লা জামার বদলে দামি প্লেকার্ড লুঙ্গি বা পাজামার সঙ্গে পাঞ্জাবি আর টুপি পরে কেতাদুরস্ত চলাচল এখন তার। গায়ে আতর, চোখে সুরমা আর মাথায় হাঁস মার্কা গন্ধরাজ তেল মাখা সমেস ম-লকে সমীহ করে আপনি-আপনি করে ডাকাও শুরু করে দিয়েছে অনেকে। নিয়ম করে এখন প্রতিদিন সকালে আর্মি ক্যাম্প ঘুরে এসেই তিনি বসেন একেকটি বাড়ির সামনে। তারপর হাতের আঙুলের ডগায় চাবির গোছাটা ঘোরাতে ঘোরাতে পথচলতি মানুষজনকে ডেকে ডেকে বলেন, ‘কওতো বাহে কি সমস্যা! একটামাত্র ব্যাটা মোর, কিন্তু আল্লায় বাড়ি দিছে মোক তিনটা! এতোগুলা বাড়ি এ্যালা মুই কি করিম্?’ এলাকার লোকজন, বাজারের দোকানি বা হাটুরেদের সবার কান ঝালাপালা প্রত্যেক দিন একই কথা শুনে শুনে। সামনে পড়লে অনিচ্ছা নিয়েই হয়েই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতে বাধ্য হয় তারা।   তবে সুখের কাল বেশিদিন স্থায়ী হলো না সমেস ম-লের।  মাত্র মাসতিনেক আগে দখল নেওয়া বাড়ি তিনটার মালিকানা পাকাপোক্ত হওয়ার আগেই এলো নতুন বিপদ। পুরোপুরি শীত শুরুর আগেই মাদ্রাসা আর চিনিরকল ক্যাম্পের মিলিটারিরা হঠাৎ উধাও একদিন।  রাজাকারদের পাহারায় রেখে কোথায় যেন চলে গেলো তারা অক্টোবরের শেষ সপ্তাহের এক রাতের আঁধারে। রাজাকাররা অবশ্য তখনো বেশ দাপটের সঙ্গেই চষে বেড়াচ্ছে এলাকার হাট-বাজার আর মহিমাগঞ্জ রেলস্টেশন।  দিকে দিকে খবরও জানান দিচ্ছে তারা, দুয়েক দিনের মধ্যেই নাকি কাটাখালী সেতুর ক্যাম্প থেকে আবার চলে আসবে নতুন আরেকদল আর্মি।  কালামজিদ চেয়ারম্যান বলেছেন, পাকিস্তানের আর্মি হলো পৃথিবী সেরা আর্মি। তাদের কাছে লেংটিপরা মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো হিসাব আছে? তাছাড়া পেয়ারের পাকিস্তানের সঙ্গে আর্মি ছাড়াও ফেরেশতারা আছেন। সুতরাং ভয়ের কিছু নাই। সমেস ম-লের নিজেরও দৃঢ় বিশ্বাস এ কথায়। বেশ বড়-গলায় সবখানে এই কথা এতোদিন নিজেও বলে বেরিয়েছেন তিনি।  কিন্তু ক’দিন থেকে কিছুটা ভয়ের সঞ্চার হয়েছে তার মনে। বোঝা যায় একই শঙ্কায় চেয়ারম্যান-মেম্বারদের চোখে-মুখেও ভয়ের ছাপ।  বিভিন্ন দিক থেকে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা অপারেশনের খবর আসছে এখন মাঝে-মধ্যেই।   প্রতিদিনের মতো সেদিন সকালে মাদ্রাসার ক্যাম্প থেকে খবরাখবর নিয়ে বাজারে ফিরে এলেন সমেস ম-ল। বোচন সাহার বাড়ির সামনে পেতে রাখা পুরনো কাঠের চেয়ারটাতে প্লেকার্ড লুঙ্গি আর গায়ের পাঞ্জাবি গুছিয়ে বসেও পড়লেন।  এরপর অভ্যাস মতো আঙুলের ডগায় চাবির গোছাটা ঘোরানো শুরু করেছেন কেবলই। এখন কাউকে সামনে পেলেই বলা শুরু করবেন, একটি মাত্র ছেলের জন্য তিন-তিনটি বাড়ি নিয়ে তার সমস্যাটার কথাটা।  ঠিক সেই সময়ই এক নতুন সমস্যা এসে তার পুরনো সমস্যাটাকে ঢেকে ফেললো একরকম কালো মেঘের মতো।  যুদ্ধের কারণে বাজার প্রায় ফাঁকাই থাকে সবসময়। লোকজন তেমন থাকে না বললেই চলে।  হঠাৎ উত্তর দিকের বড় রাস্তা থেকে একজন মানুষ এদিকে আসছে দেখে কিছুটা আশার সঞ্চার হলো সমেস ম-লের মনে।  লোক বুঝি পাওয়া গেল একজন! কাছে এলে একেই বলতে হবে একটা মাত্র ছেলের জন্য তিন-তিনটি বাড়ি নিয়ে সৃষ্ট সমস্যার নিয়মিত সংলাপটি।   লোকটা এলো ঠিকই, তবে একা নয়। যেন আড়াই মণ ওজনের একবস্তা সমস্যা ঘাড়ে নিয়ে এসে পড়লো তার সামনে।  আজকের এ সমস্যা তার এতদিনের লালিত সমস্যার চেয়ে যে মেলা বড় তাও বোঝা গেল একটু পরেই।    দেখা গেল হেঁটে নয়, লোকটা আসছে দৌড়ে। আরও দেখা গেল, বারবার পেছন ফিরে তাকানো ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া লোকটির পরনের লুঙ্গিটা খুলে গেছে। ইজ্জত রক্ষায় খুলে যাওয়া লুঙ্গিটাকে কোনোমতে এক হাতে ধরে রেখেছে সে। দৌড় থামিয়ে না পারছে সেটা পড়ে নিতে, না পারছে একবারে ছেড়ে দিতে। আরেকটু কাছে আসতেই চেনা গেল লোকটাকে।  এক হাতে লুঙ্গি, আরেক হাতে ফিতার বদলে দড়ি দিয়ে বাঁধা ভাঙ্গা রাইফেলটাকে লটকে নিয়ে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে ছুটে আসা লোকটা তার খুবই চেনা।   লোকটা তারই পাড়াসম্পর্কের ভাইপো মালেক। নতুন রিক্রুট মালেক রাজাকার।  সমেস ম-লের সুপারিশেই রাজাকারের চাকরিটা হয়েছে তার ক’দিন আগেই।  এমন অভূতপূর্ব দৃশ্য তৈরি করে মালেক রাজাকারের দুই মাইল জমি-জলা-জঙ্গল ডিঙিয়ে পড়িমরি দৌড়ে খড়িয়াবাঁধা বাজারে ঢোকারও কারণ ঘটে গেছে একটু আগেই। সেদিন সকালের সূর্যোদয়ের পরপরই দেওয়ানতলা রেলসেতুর রাজাকার ক্যাম্পটা হঠাৎ ঘিরে ফেলে একদল গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা। শত্রুকে গুলি করতে রাইফেল উঠানোর বদলে শূন্য দুই হাত মাথার ওপর উঠিয়ে সারেন্ডার করে তারা। বাঁচার আকুতি নিয়ে কেঁদেকেটে একাকার অবস্থা তখন তাদের।  গেরিলা কমান্ডার দুলু একই এলাকার মানুষ। রাজাকাররা সবাই তার পরিচিত। তাই ‘ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ’ করার দরকার নাই বলে ছেড়ে দিয়েছেন তাদের।  গালে দু’য়েকটা চড়-থাপ্পড় আর পশ্চাদ্দেশে একটা করে লাথি কষিয়ে কুকুর তাড়ানোর মতো করে তাড়িয়ে দিয়েছেন তাদের তখনই। তারপর বোমা মেরে সেতুটির একাংশ ভেঙ্গে রংপুর-বগুড়ার রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে চলেও গেছে গেরিলারা তখনই।  দেওয়ানতলা রেলসেতু থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিভিন্ন দিকে প্রাণ নিয়ে পালানো রাজাকারদের একজন এই মালেক।  খড়িয়াবাঁধা বাজারে ঢুকে পড়ে দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য আর পড়িমড়ি করে ছোটা বিধ্বস্ত মালেকের দিশাহারা চোখ তখনও ভয়ে ইতিউতি চাইছিল কেবল। প্রাণের ভয়ে পালানোর এই ক্রান্তিকালে ভোম্বল হয়ে যাওয়া মাথাটা তুলতেই হঠাৎ তার নজর আটকে গেল মালেকের।  এভাবে দৌড়ের কারণ জিজ্ঞাসার জন্য তখন হাত তুলে তার সামনে দাঁড়ানো তারই পরম শুভাকাঙ্খী, অভিভাবক আর চাকরির সুপারিশকারী পাড়াতো জ্যাঠা সমেস ম-ল। পরনের খুলে যাওয়া লুঙ্গি আর ভাঙা রাইফেলের দড়ি হাতে পেচিয়ে ধরে বাজার পেরিয়ে দক্ষিণ দিকে দৌড়ানো মালেক  গতিটা কেবল কমালো একটু ছুটে চলার।  তারপর চাকরির প্রতিদান হিসেবেই হয়তো চিরকৃতজ্ঞ মালেক সমেশ ম-লকে লক্ষ্য করে শুধু একটা কথাই বলতে পারলো ‘দৌড়াও বাহে জ্যাঠো, মুক্তি আইলো!’। ‘দৌড়’ আর ‘মুক্তি’ শব্দ দু’টো কানে ঢুকতেই আঙুলের ডগায় ঘোরানো চাবির গোছাটা কোথায় ছিটকে গেল! তারপর একমুহূর্তও নষ্ট না করে নিজের দামি প্লেকার্ড লুঙ্গিটা কোমরে কষে বাঁধতে-বাঁধতেই মালেকের সঙ্গে ছুটতে শুরু করলেন চতুর সমেস ম-লও। জীবনপুরের মাঠ পেরিয়ে দক্ষিণ দিকের সাতবিলার দিকে সোজা দৌড়াতে লাগলেন তিনি। তারপর একটু পরেই মালেককে ডিঙিয়ে তিনি চলে গেলেন সবার দৃষ্টিসীমার বাইরে।  জনশূন্য খড়িয়াবাঁধা বাজারে তখন পড়ে রইলো কেবল দখল করা তিন হিন্দুবাড়ি, চাবির গোছাটা আর সমেস ম-লের ‘একটামাত্র ছেলের জন্য তিন-তিনটে বাড়ি’ নিয়ে নিত্যদিনের সেই সমস্যার গল্পটা।

জয় বাংলা স্লোগানে ধাবমান

জয় বাংলা স্লোগানে ধাবমান

পরনে হাফপ্যান্ট। সারাদিন দল বেঁধে হৈ চৈ করে বেড়াই। আমরা বাগান, বাঁশ বাগানের মধ্য দিয়ে ছুটছি আর ছুটছি। খালের খাড়ির গর্ত থেকে বেতের শীষ দিয়ে মাছ রাঙার বাচ্চা টেনে হাতে নিই। ওদের নরম শরীরে আদর করি আমরা। জল খাওয়াই। টানা হেঁচড়ার মধ্য দিয়ে ওদের জীবন যে বিপন্ন সেদিকে নজর পড়ে না। অন্য এক অনুভূতিতে নিষ্পাপ কৈশোরে আমরা বিভোর সবাই।  সময়টা একাত্তরের মার্চ। বলাচলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তখন ‘স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার’ কার্যকর। ধানম-ির বত্রিশ নম্বর বাড়ি থেকে তিনি আদেশ দিতেন। আর সারাদেশের মানুষ সেটাই অনুসরণ করতো। এরই মধ্যে মুজিব-ইয়াহহিয়া আপোস আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পরই ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করেন। আর ওই রাতেই নিরস্ত্র বাঙালির ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ওরা গুলি করে, অগ্নিসংযোগ করে। ঘাতকরা বলে, হিন্দুরা কাফের। হত্যার নীল নকশা ওদের হাতে। এই পর্যায়ে জানমালের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্য টাকা সোনার দরবার চলতে থাকে। দূর গ্রাম তালমার এই কথাগুলো কারও অজানা থাকে না। আমাদের গ্রামও কি এমন খপ্পরে পড়বে? কে জানে, ভয় সবার মনে। আমরা রথখোলায় ফুটবল খেলি। এক সময় এতে ছন্দ পতন ঘটে। এমনটি অন্যদিন ঘটে না। মাঠের মধ্য দিয়ে এক তরুণ যাচ্ছিলেন। তার গায়ে এসে পড়ে বল। বিষয়টি ছিল অপ্রত্যাশিত। তরুণ দাঁড়িয়ে পড়েন। প্রথম ভাগে মৃদু অভিযোগ আনেন তিনি।  সম্মানী লোকের আত্মীয় বলে কথা। দ্বিতীয়ত: সময় এখন বিপক্ষে। দেশ গাঁয়ের অবস্থা ভালো নয়। বিষয়টির মীমাংসা হলো। তরুণ হাসিমুখে বিদায় নিলেন। কিন্তু তখন চিন্তার ভাঁজ ফেললো কারও কারও কপালে। আমাদের সবাইকে বড়োরা সাবধান করে দিলেন। আমরা ঘরে ফিরলাম। পথে বলাবলি হলো, খুব তাড়াতাড়ি পাক সেনারা থানা পর্যায়ে চলে আসছে। কয়েক দিনের মধ্যে সত্যি সত্যি পাক সেনাদের বহর এলো ভাঙ্গায়। আসার সময় জলপাই রঙের গাড়ি থেকে ওরা গুলি ছুড়ল যত্রতত্র। শত সহস্র মানুষ পালাল দিগি¦দিগ। এরই একটি স্রোত এলো আমাদের এলাকায়। চাঁদহাট গ্রাম ভরে টইটুম্বুর হলো আমাদেরই আত্মীয়স্বজনে। মাদুরের মতো বিছানো একটানা বাড়ি। নদীর পারে একই সমতলে ঘরগুলো দাঁড়িয়ে দুইদিকে। মাঝে অবশ্য আড়াআড়ি ঘর আছে কোথাও। মাঝের জায়গায় ওঠা বসা মানুষের। বসার স্থান, শোয়ার জায়গায় টান পড়ে। ভরসার কথা অতটুকুই, মনটাতো আর ছোট নয়। এদিকে বাজার ঘাট করতে সবাই উৎসাহ পায় না। কোথা থেকে কে কোনো ঝামেলায় পড়ে! জাও ভাতের আয়োজন হয়। প্রায় সবার বাড়িরই একই দশা। তবে তেমন চাওয়া-পাওয়া নেই কারো। এর মধ্যে এই নিয়েই সন্তুষ্ট সবাই। বাড়ির পাশে কলঘর। ওই ঘরেই তখনকার দিনের বিকো মেশিনের রাইস মিল। এখানে গম ধান ভাঙাতে আসতো কাছে দূরের মানুষ। ওপরে বাঁধা ঘটিতে ধুপ ধুপ শব্দ হতো। ও ছিল কারও কারও কাছে এক আতঙ্কের নাম। কখন কোন দিক থেকে সেনারা চলে আসে তাতো এই শব্দে বুঝা যাবে না, এমনি ধারণা। এসব বিচ্ছিন্ন ভাবনার ফসল। রাইস মিল চলে, মানুষও বসে বসে ভয়ের ধারাপাত পড়ে।  কাকাদের ছিল ফিলিপ্স রেডিও। বড়ো আকারের এই রেডিও নাকি বিশাল তল্লাটে আর একটি ছিল। সকালে অনেক মানুষ বসে সংবাদ শুনতো। আকাশ বাণীর নীলিমা সান্যাল, অনিল চট্টোপাধ্যায়, ইভা নাগ সবার আকর্ষণ কাড়তেন। বিপদকালে ভারত আসবে পাশে, এমন আশা করেন কেউ কেউ। কিন্তু তেমনটি আসে না সংবাদে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক নারায়ণ ভৌমিক বলেন, সময় গেলে বুঝা যাবে। আশা নিরাশার দড়ি টানাটানি হয়। ফল এক জায়গায় থেমে থাকে। ইতোমধ্যে নগরকান্দা থানা সদরে পাকিস্তান সেনা এসে গেছে। কোদালিয়া গ্রাম জ্বালিয়ে ছারখার করেছে তারা। সেখানে ভগ্ন স্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে আর্তনাদ করে এক কুকুর। অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দেয় মা বাবার লাশের ওপর। একি রক্তগঙ্গা? এক বাড়িতে ঢুকে ১৮ জনকে হত্যা করে তারা। কিছুদিন আগেই ফরিদপুরের শ্রীঅঙ্গন আশ্রমে ঘটেছিল নারকীয় ঘটনার একটি। পাক হানাদাররা গুলি করে মারে ৮ জন সংসারত্যাগী সন্ন্যাসীকে। প্রথম দিকে ওদের আক্রোশ সনাতন ধর্মীদের ওপরই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু অল্প দিনেই এর উত্তাপ ছড়িয়ে গেল সবখানে। রেহাই পেলো না মুসলমান সম্প্রদায়। হতভম্ব হয়ে পড়ে সাধারণ মানুষ।  জানমাল কোনো কিছুর নিরাপত্তা নেই। খাবার চাল তার সঙ্গে অতি প্রয়োজনীয় কিছু শস্য পণ্য, কাঁসা পিতলের কিছু পাত্র রাখা হয় নৌকায়। অনেকটা ধরা ছোঁয়ার বাইরে মনে করে সেসব পাঠিয়ে দেওয়া হয় কাটা খালের মাথার একটি বাড়িতে। ওই বাড়ির মালিক দলিলউদ্দিন মিয়া। ওই বাড়ির সঙ্গে আমাদের পরিবারের ভালো সম্পর্ক, যা এখনো বহমান। খোঁজ পেয়ে এক সকালে খোকন মিয়াসহ ছয় রাজাকার আসে সেখানে।  রাজাকাররা এসেছিল সোনা দানার আশায়। কিংবা তারা এও মনে করতে পারে, হিন্দুকে খতম করার মোক্ষম সুযোগটিও জুটবে একই সঙ্গে। কিন্তু শিকার মেলে না। তারা পায় কেবল দলিলউদ্দিন মিয়া এবং সহোদর মোতালেব মিয়াকে। ঘটনা যা ঘটবার তাই ঘটে। তারা নাস্তানাবুদ হন রাজাকারদের রাইফেলের বাঁটে। সত্যটা এমন, তারা খুব কৌশলে ঐদিন আমাদের বাড়ির সদস্যদের রক্ষা করেন। এরপর কী আর করার থাকে রাজাকারদের! খানিক হম্বিতম্বি করে ওরা স্থান ত্যাগ করে। খবরটি কম বেশি জানাজানি হয়। গ্রামবাসী সবাই ভাবে ওরা আবার আসবে।  আতঙ্ক আর উদ্বেগ ছাড়ে না। এক ধরনের প্রতিক্রিয়াও কাজ করে মানুষের মধ্যে। তারা অভয় বাণী শোনায় প্রিয় গ্রামকে। মা..গো ভাবনা কেন/আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে/তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি/তোমার ভয় নেই মা আমরা প্রতিবাদ করতে জানি। ভেতরে গৌরী প্রসন্ন মজুমদার কথা কয়।  গজারিয়া আর চাঁদহাট, এক বৃন্তে দুটি ফুল। কাল হামলা করেছে প্রথমটিতে। আর আজ রাজাকাররা আসে চাঁদহাটের বণিকপাড়ায়। রাজাকার জাফর মিয়া আসে বিশাল সাজে। লুটপাট করে নেবে তামাম সম্পদ। ছিন্ন ভিন্ন করে খাবে ‘মানুষ আর প্রাণের মাংস’। কিন্তু কোনো ছাড় নয়, সাধারণ মানুষ বেরিয়ে পড়ে। তাড়া দেয় তাৎক্ষণিক। শত্রুরা সদরমুখী হয়ে দৌড়ায়... আর দৌড়ায়। বাস্তবতা এটাই, ওরা সংগঠিত। নীল নকশা তৈরি ওদের। ফার্স্ট ফ্রন্ট, সেকেন্ড ফ্রন্ট, থার্ড ফ্রন্ট। প্রথম দুই দফায় পিছু হটেছে, এবার তৃতীয় দফা। পাক সেনারা এলো। বিপুল প্রস্তুতি তাদের। তারা নামবে গ্রামে। তাদের মেশিন গান খৈ ফোটাবে। কিন্তু জলপাই রঙের গাড়ি এখানে অচল। রাস্তা বেয়ে বেয়ে দৌড়াচ্ছে। হানাদাররা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়বে সারা তল্লাট। নষ্ট করবে সামনের গ্রাম। মেতে উঠবে হত্যায়।  পাক সেনারা ঘোনাপাড়ার গাঙলি এসে থেমে যায়। তখন ছোট্ট এ খালটি পার হওয়ার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ওদিকে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিত হয় শত কণ্ঠে। লাঠি সোটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে জবদুল মিয়া, বর্ষায় কুমার-এর দক্ষ মাঝি। পেছনে হাঁক দেয় পুব পাড়ার মজিদ মিয়া। সাধারণের কল্পনায় আসে ‘কানফরদির সুলতানা রাজিয়া’। যার নামে গল্প নির্মিত হয়, যিনি গৃহিণী হয়েও নামেন একাত্তরের রণাঙ্গনে।  রাজাকার জাফর মিয়া ধরা খায়। তার দল কোথায় সটকে পড়ে, সে খবর আর কে রাখে! সবার মূল লক্ষ্য জাফর। ঐদিন সড়কি, ফুলকুচির খোঁচায় বিদীর্ণ হয় তার দেহ। তাকে মেরে পাটপাট করে ফেলে ওই ক্ষিপ্ত মানুষ। এক পর্যায়ে কলাগাছ এনে দেয় মুন্সী আবুবকর। বয়োজ্যেষ্ঠরা রোষানল থেকে আড়াল করতে পারে না প্রতীকী জাফরকেও। হানাদাররা দিগি¦দিগ হয়ে পড়ে। কেউ নামে পাট খেতে কেউবা ধানের জমিতে। কিন্তু বোরো ধানের গোড়ায় তো এক হাঁটু কাদা। মেশিনগান বসায়। তাক করে বৃষ্টি ঝরাতে যায়। তবে তার আগেই সে সুযোগ পায় না এই পাক সেনা। মোসলেম মাতুব্বরের লাঠির আঘাতে চৌচির হয়ে যায় পাক সেনার মস্তক। মোসলেম আনন্দে নেচে ওঠেন। লম্বা টানে মুখে উচ্চারণ করেন, জয় বাংলা। চতুর্দিকের সবার কণ্ঠ এক হয়ে ফেটে পড়ে। আকাশ বাতাস এক হয়ে যায়। এ ও বুঝি জাতির পিতার বজ্রকণ্ঠ, জয় বাংলা।... মুহুর্মুহু সেøাগানে কেঁপে ওঠে প্রান্তর। কেউ একজন একটু আটসাট হয়ে বলে, টিক্কা খানকে কোতল করলাম। ওদের কাছে খান সেনাদের যে কেউই বুঝি টিক্কা খান! সেদিন একজন নয় ৩৪ জনের প্রাণ সাবাড় করে দেশী অস্ত্রের এই মানুষগুলো। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র খবরটি প্রচার করে। এলাকাবাসী উজ্জীবিত হয়। এখন কী হবে? হানাদাররা কী বসে থাকবে? ওরা যারা থানায় আস্তানা নিয়েছে, চতুর্গুণ শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে নিরীহ মানুষের ওপর। তবে আপাতত কিছুটা শক্তি যে খুইয়েছে তাতো ঠিক! এরই মধ্যে বিস্ময়কর এক ঘটনা ঘটে যায়। সাবেক ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্টের সদস্য আজিজ মোল্লা তরুণদের নিয়ে থানার অস্ত্রপাতি সব কেড়ে নিয়ে আসেন। রবীন্দ্রনাথ বেজে ওঠেন। তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে,/এ আগুন ছড়িয়ে গেল সব খানে॥ সবার মুখে চাপা হাসি, সংযত আনন্দ। তার কারণ এইযে, বয়োজ্যেষ্ঠরা বলেন, ভিমরুলের চাকে ঢিল মারা হয়েছে। ওরা এখন স্থল নয় শুধু, আকাশ পথেও হামলা চালাতে পারে।  আমাদের কঞ্চি দিয়ে বানানো ফলফুটুনি নিয়ে বেরুনোর কথা। কিন্তু ওই বয়সেও হাঁটু আর চলে না। দৃষ্টিনন্দন আমজুম ফল গাছেই রয়ে যায়। পেকে সবুজ থেকে লাল আর লাল থেকে কালো রং নেয়। আমরা শুধু মহড়া করি কিন্তু এই ফল ফোটাতে পারি না। দূর গ্রাম থেকে যারা নিরাপদ মনে করেছিল এই গ্রামটা তারাও যে যেদিক পারে সরে পড়ে। আবার সত্যি সত্যি তাই হয়। ওরা হানা দেয়, একাত্তরের বর্গী ওরা। মানুষ ওদের কাছে সংখ্যা আর তাদেরই অর্জন হেলার বস্তুমাত্র। আকাশ থেকে ওরা খাদ্য নামায়। বাঙালি নিধনে প্লাটুন প্লাটুন সৈন্য আসে। হানাদাররা জ্বালায়, পোড়ায়, তছনছ করে ফেলে নিরীহ মানুষের জীবন। ওরা দখল নেয়।  গ্রামপ্রেমীরা, দেশপ্রেমীরা কেবল আর্তনাদ করে। জগৎবাসী বাংলাদেশকে যাও দেখিয়া...। এ আকুতি মাটি মানুষের জন্য।  পাক হানাদাররা কত সময় আর থাকবে! কেবল আসে আর যায়। আওয়ামী লীগের সোলায়মান আলী তখন টগবগে যুবক। তিনি এলাকার তরুণদের সংগঠিত করেন। আর আজিজ মোল্লা প্রশিক্ষণ দেন। একেকজন তরুণ হয়ে ওঠেন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা।  আমার পরনে সেই হাফপ্যান্ট। এবার গায়ে জড়িয়েছি জামা। যা প্রায়শই থাকে না। দলে আমরা তিন চারজন। চাঁদহাট বাজারের অদূরে তরুণদের প্রশিক্ষণ চলছে। আমি দূর থেকে দেখি আমার সোলায়মান আলী স্যারকে। তিনি নির্দেশনা দিচ্ছেন অন্যদেরকে। তাঁরা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে তখন। আমি শুধু দেখি... আরও একটু এগিয়ে দেখার চেষ্টা করি। সামনে যাই না। দ্বিতীয় মন বলে, যদি দেখা হয়...তাহলে কেমন হবে! অতঃপর দেখা হওয়া না হওয়ার দোলাচলে আমি তাড়াতাড়িই পেছনের দিক চলে আসি।  বৈশাখ জ্যেষ্ঠ মাসের কথা। দেশ কবে মুক্ত হচ্ছে তা তখনো স্পষ্ট নয়। তবে আমরা মুক্ত, আমাদের ‘জয় বাংলা’ এলাকা শত্রুমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে আরও আগে। প্রশিক্ষণ হয় তীর্থভূমিতে, চাঁদহাট সে নাম। মনি মুক্তার মতো খুঁড়ে বের করা হয় এর প্রাণকেন্দ্র। নাম রাখা হয় ‘জয় বাংলা’। চাঁদহাট, গজারিয়া, কুমারদিয়া, দহিসারা, দুলালী, বাগাট, রাখালগাছি, দামদরদি, আসফরদি, শ্রীবরদি- গ্রাম কিংবা একগুচ্ছ ফুলের নাম। এরই সাধারণ নাম ‘জয় বাংলা’। অর্থ : আমাদের নাম-পরিচয় ‘জয় বাংলা’। আমাদের আপন ঠিকানা ‘জয় বাংলা’। আমরা ‘জয় বাংলা’ সেøাগানে ধাবমান।

আঞ্চলিক সাহিত্য সংগঠন ও সাহিত্যচর্চা

আঞ্চলিক সাহিত্য সংগঠন ও সাহিত্যচর্চা

বলা হয়, লেখা শুরু হয় গ্রামে আর লেখক পরিচিত হন শহরে। নজরুল, বঙ্কিম প্রমুখ তাই। মফস্বলে সাহিত্যের উৎসাহদাতা, পৃষ্ঠপোষক নেই, আছে উদাসীনতার বাঁকা চোখ। মূল্যায়ন ছাড়াই তাই পল্লীর কবি লেখকরা মসীযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন আপন গতিতে, আপন উৎসাহে। সামাজিক ও পারিবারিক পাঠাগার গড়ে উঠলে সাহিত্য প্রতিভা বেরিয়ে আসে।  বিধাতা নিজেই নাকি একজন কবি। তাই কাব্য প্রতিভা সবার মাঝেই কম বেশি বিদ্যমান। বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতের কীর্তিমান কবি জসীমউদ্দীন মফস্বলের কবি, গ্রামীণ চিন্তাধারার কবি। আরেকটি ‘কবর’ কবিতা আজও আমরা দ্বিতীয়টি পেয়েছি কি? লোকসাহিত্য কি এখন রচিত হয়? নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট/ ভেঙে ফেল কররে লোপাট’ এবং ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে/ এলো খুশীর ঈদ’। রবীন্দ্রের ‘ওরে নবীন ওরে আমার কাঁচা/ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ/আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা’। কাব্যকথাগুলো কি গ্রামীণ না শহুরে?  নজরুলের একটি কাব্যবক্তব্য আমার খুবই প্রিয়! ‘উষার দুয়ারে হানি আঘাত/ আমরা আনিব রাঙা প্রভাত/ আমরা টুটাব তিমির রাত/ বাধার বিন্ধ্যাচল।’ রবীন্দ্রের একটি বাণী ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে/ তবে একলা চলো রে।’ এসব বাণী বুকে ধারণ করে পথ চলছি। আমার মতো একজন সাধারণ সাহিত্য শ্রমিকের জীবনে না হোক, বিগত ২৫ বছরের সাহিত্য আন্দোলন লক্ষ্মীপুর জেলা সাহিত্য সংসদের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষর অলংকৃত করবেই। লক্ষ্মীপুর জেলা সাহিত্য সংসদ নিয়মিত মাসিক সাহিত্য সভার পাশাপাশি, বাংলা আওয়াজ সাহিত্য পত্রিকার মাধ্যমে কবি লেখক সৃষ্টির এবং চর্চার উর্বর ভূমি। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সাহিত্য সম্মেলনগুলোতে দেশের প্রথিতযশা বরেণ্য কবি লেখক সংস্কৃতি সেবীদের আমন্ত্রণ করে এনে সাহিত্যের আইকন ও রোল মডেলদের উপস্থাপন করছি। সারা বছরই আমরা জেলার সাহিত্য প্রেমিরা এ অনুষ্ঠানের প্রতীক্ষায় প্রহর গুনি।  সমাজ হিতৈষী মহৎ ব্যক্তিদের অনুপ্রেরণা ও পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া কোনো মহৎ কর্ম বা সৃষ্টি জন্মায় না। লক্ষ্মীপুর জেলা সাহিত্য সংসদ ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হবার পর স্থানীয়ভাবে সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নয়নে সরব কর্মসূচি বাস্তবায়নে সক্ষমতা লাভ করে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল নজরুল শতবার্ষিকী পালন। সাহিত্য সংসদের মুখপত্র মাসিক বাংলা আওয়াজ এবং তৎকালীন স্থানীয় পত্রপত্রিকা সাক্ষী, পুরো জেলাব্যাপী সাহিত্য সংসদ কতটুকু সাড়া জাগিয়েছিল। ১/১১ এর সেনাশাসন আমলেও নিস্তব্ধ শহরে প্রকাশ্যে মাইক বাজিয়ে সাহিত্য সংসদ অনুষ্ঠান করেছে। মনে পড়ে, নারী নেত্রী মাজেদা শাহাবুদ্দিন, সাংবাদিক লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গোলাম রহমান, সংগ্রামী শিক্ষক নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক রফিকুল হায়দার চৌধুরী, কবি-বাগ্মী ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মাখন লাল ভৌমিক, সাংবাদিক এম এ মালেক, সাংবাদিক আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, অধ্যাপক মাইন উদ্দিন পাঠান প্রমুখ সাহিত্য সংসদের পাশে ছিলেন। পাশে ছিলেন অধ্যাপক চৌধুরী খুরশিদ আলম ও অধ্যাপক খলিলুর রহমান চৌধুরী। সাহিত্য সংসদ যখন মধ্য-গগণে উঁকি মারছিল। তখন গোলাম রহমানের সহায়তায় সান্নিধ্য পেলাম দেশের সাংস্কৃতিক অভিভাবক শ্রদ্ধেয় রামেন্দু মজুমদার মহাশয়ের এবং মুক্তিযোদ্ধা ও সুসাহিত্যিক সালেহা আনোয়ারের। সাহিত্য সংসদ এই পর্যায়ে পৌঁছানোর পেছনে যার অবদানের কাছে আমরা চিরঋণী হতে পারি, তিনি হচ্ছেন রামেন্দু মজুমদার। 

কবিতা ॥ অবগাহনরীতি

কবিতা ॥ অবগাহনরীতি

গদ্যের কঠিন চক্রে অচ্ছেদ্য বাঁধা যে জীবন, তার সঙ্গে কবিতার সদ্ভাব রক্ষা এক দুরূহ কাজ। আমাদের প্রাত্যহিক গেরস্তালি গদ্যের সঙ্গে এর কর্তৃত্ব ও দখলদারি প্রায় নিরঙ্কুশ এবং তা প্রায়শই জোয়ালের ভারচাপা এক জবরদস্তি। এই নিদারুণ সম্পর্কের দায় আমাদের প্রত্যেককেই আমৃত্যু বহন করতে হয়। সংসারের সমস্ত দায় মিটিয়ে, গার্হস্থ্য ও জাগতিক কর্তব্যের সব ঝামেলা চুকিয়ে তবেই কবিতার সঙ্গে মিলনের আয়োজন চলতে পারে। কবিতার সঙ্গে আমাদের যোগমিলন ইন্দ্রিয়জ নয় বলেই এর টানটা আলাদা। জিভ ও ত্বকের স্থূল সীমার আওতায় জীবনের সমাপ্তিরেখায় পৌঁছার তাড়নাকে আমরা কেবল ইতর জৈবিকতার সদৃশরূপে গণ্য করি। অন্নে উদরপূর্তি হয়, ঘরের চার দেয়াল,  ছাদে বিশ্রাম ও শয়নের ব্যবস্থা। দেহরক্ষা ও দৈহিক আরামের নিশ্চয়তার বিধান হলেই জেগে ওঠে আরেক ক্ষুধা। জীবনের অভিজ্ঞতাগুলোকে ভিন্নভাবে রূপদানের ইচ্ছা  কলমে, তুলির আঁচড়ে, সুরের স্বরগ্রামে।