ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০২ অক্টোবর ২০২৩, ১৭ আশ্বিন ১৪৩০

সাহিত্য

সাহিত্য বিভাগের সব খবর

সুনয়নী দেবীর শিল্পভুবন ও দুটি দুষ্প্রাপ্য রচনা

সুনয়নী দেবীর শিল্পভুবন ও দুটি দুষ্প্রাপ্য রচনা

সচেতনভাবে বাঙালি নারীদের চিত্রকলা চর্চার ইতিহাস সুদীর্ঘ নয়। তৎকালে নারীরা সহজাত প্রবৃত্তি থেকে আপন মনে ছবি আঁকতেন। ছবি আঁকার কাঠামোবদ্ধ নিয়ম-কানুন তারা জানতেন না, যেহেতু তাঁদের জন্যে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চিত্রকলা শেখার দ্বার অবারিত ছিল না। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে বাড়ির লোক কিংবা শুভাকাক্সক্ষীরা ছবি আঁকায় তাদের উৎসাহ দিতেন ও সহযোগিতা করতেন।  ১৮৭৯ সালে প্রথমবারের মতো কলকাতার একটি প্রদর্শনীতে ২৫ জন নারী চিত্রশিল্পীর চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হয়। তারও পাঁচ দশক পর, ১৯৩৯ সালে ক্যালকাটা গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে প্রথম ছাত্রীরা ভর্তি হওয়ার সুযোগ লাভ করে। ওই বছর ১৭ জন নারী ভর্তি হয়েছিলেন। প্রথমদিকের বাঙালি নারী চিত্রশিল্পীদের মধ্যে অগ্রগণ্য গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী (১৮৫৮Ñ১৯২৪)। ‘ভারতী’, ‘মানসী’ ও ‘মর্মবাণী’ পত্রিকায় তাঁর ছবি গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হতো। এমনকি অস্ট্রেলিয়ার এক চিত্রপ্রদর্শনীতেও তাঁর চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছিলো।  বাঙালি নারীদের চিত্রকলা চর্চার ইতিহাসে সুনয়নী দেবীর নামটি উল্লেখযোগ্য। তাঁর জন্ম ১৮৭৫ সালের ১৮ জুন, জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে। বাবা গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মা সৌদামিনী দেবী। শিল্পাচার্য গগণেন্দ্রনাথ ও শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ তাঁর ভাই। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের  ভ্রাতুষ্পুত্রী। মাত্র বারো বছর বয়সে রাজা রামমোহন রায়ের নাতি রজনীমোহন রায়ের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। পথিকৃৎ শিল্পী সুনয়নী দেবী চিত্রকলা চর্চায় ব্রতী হন সহজাত প্রবৃত্তি থেকেই। শিখে-পড়ে তিনি ছবি আঁকতেন না। অবলীলায় তা স্বীকার করে বলেছেন, ‘কারো কাছে কোনো দিন আঁকা শিখিনি। শিখতে ইচ্ছেও করেনি। আমি যা এঁকেছি সবই নিজের চেষ্টায়।’ ছবি আঁকার পূর্বে শিল্পীরা পেন্সিল দিয়ে খসড়া এঁকে নেয়। সুনয়নী খসড়া করতেন না, সরাসরি রঙ-তুলিতে আঁকতেন। এ কারণে তাঁর ছবিগুলো কৃত্রিমতা স্পর্শ করতে পারেনি। শৈশব থেকে তিনি কিছু ছবি এঁকেছেন। সেগুলো ছিল খেলার ছলে আঁকা। তবে সচেতনভাবে যখন ছবি আঁকতে শুরু করেন তখন তাঁর বয়স ত্রিশ। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘ত্রিশ-বত্রিশ বছর বয়সে আমার ছবি আঁকার শুরু।’ তাঁর আঁকা ছবি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২১-২২ সালে। তাঁর তখনকার ছবিগুলোতে বিশেষত্ব খুঁজে পান বিখ্যাত শিল্প-ইতিহাসবিদ স্টেলা ক্রামরিশ (১৮৯৬-১৯৯৩)। তিনি সুনয়নী দেবীর চিত্রকর্মের প্রশংসা করে একটি প্রবন্ধ লিখেন। এ প্রবন্ধটি সুনয়নী দেবীকে শিল্পরসিকদের কাছে পরিচয় করে দেয়। ১৯২৫ সালেও স্টেলা ক্রামরিশ তাঁকে নিয়ে আরেকটি প্রবন্ধ লিখেন। স্টেলা ক্রামরিচ মনে করেন, সুনয়নী দেবী প্রথম আধুনিক ভারতীয় নারী চিত্রশিল্পী। তিনিই প্রথম ভারতীয় নারী, যিনি তাঁর চিত্রকর্মে প্রথম সাক্ষর করেছেন। সুনয়নী দেবী বলতেন, তিনি স্বপ্নে ছবির মিছিল দেখতেন। দেখতেন তাঁর চোখের সামনে অসংখ্য ছবি এসে ভিড় করে আছে। সেই ছবিগুলোই বাস্তবে তিনি ক্যানভাসে আঁকতেন। তিনি তাঁর নাতির কাছে বলেছেন, ‘আমার বেশিরভাগ ছবি আগে স্বপ্নে দেখেছি। পরে সেগুলোকে এঁকেছি।’ সুনয়নী দেবী নিয়ম করে ছবি আঁকতেন। সকাল আটটা থেকে দুপর পর্যন্ত এবং তিনটা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত ছিলো তাঁর ছবি আঁকার সময়। ‘সুনয়নী দেবীর কাজের ধরন কেমন? পূর্বেই বলেছি তিনি আপন মনে আঁকতেন। তাঁর চিত্রকর্মের বিশেষত্ব সম্পর্কে চিত্রা দেবের অভিমত উল্লেখ করা মতো। তাঁর মতে, সুনয়নী দেবীর তুলির টানে কোনো দুর্বলতা বা সংশয় নেই। চিত্রকর্মে তাঁর আঁকা চোখগুলো ভীষণ বাস্তব, সুন্দর ও স্বপ্ন রঙিন। সুনয়নীর চিত্রকর্ম সম্পূর্ণ বিদেশী প্রভাবমুক্ত। শিল্পের জগতে তিনি নিজের তৈরিকৃত পথে হাঁটতেন। এই স্বকীয়তার কারণে জীবদ্দশাতেই সুনয়নী দেবীর কাজ দেশে-বিদেশে মূল্যায়িত হয়েছে। বরেণ্য মানুষরা তাঁর কাজের প্রশংসা করেছেন।

ভ্রমণ ॥ কাতালোনিয়ার রৌদ্রের ভেতর

ভ্রমণ ॥ কাতালোনিয়ার রৌদ্রের ভেতর

(পূর্ব প্রকাশের  একবার গড়িয়ে পড়লে কয়েক শ’ মিটার নিচের খাদে। প্রায় ঘণ্টা তিনেক হাঁটার পর মানচিত্র আমাদের বলে কিংবা আমরা দেখতে পাই, পাহাড়ের চূড়া আমাদের পায়ের নিচে। বিশাল নিঃশ্বাস ফেলি! প্রায় ১৫ শ ফিট! একেবারে উপরে পাথরের ফাটলে ঘাস আর গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ ছাড়া আর কোনো সবুজের দেখা নেই। চূড়ার দিকে মাটি নেই বললেই চলে। কেবল বিশাল বিশাল পাথর। অবাক হয়ে তাদেরকে দেখি আর ভাবি, কত হাজার বছর ধরে এইখানে পাথরেরা এভাবে নিটল হয়ে রোদের সঙ্গে কথা বলে! একেবারে উপরে উঠে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমাদের ফিরে আসার পালা। দলের সিদ্ধান্ত হয়, যে পথে আমরা এসেছি সে পথে ফেরা হলে একঘেয়ে লাগতে পারে, তাই আমরা অন্য পথ ধরে এগোই।

রূপ ও রূপান্তর বাঙালির বসনভূষণ

রূপ ও রূপান্তর বাঙালির বসনভূষণ

সমাজবিকাশের একটি পর্যায়ে মানুষ তার অনাবৃত শরীরকে ঢেকে রাখবার প্রয়োজন অনুভব করেছে। প্রকৃতির সন্তান মানুষ প্রকৃতির কাছেই পেয়েছে তার প্রথম আচ্ছাদন। শুরুতে গাছের পাতা বাকল পশুর চামড়া, এরপর কালে কালে শিখেছে সুতা ও রেশমের ব্যবহার। নিজেকে অন্যের কাছে সুন্দরভাবে উপস্থাপনের জন্য ফুল লতাপাতা বীজ নানান রতœপাথর পোড়ামাটি ধাতুর অলঙ্কার শরীরে ধারণ করেছে। আদি অরণ্যচারী জীবন থেকে গ্রাম-নগর জনপদের মানুষ নানা আর্থ-সামাজিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে সভ্যতার পথে কাল অতিক্রম করছে। বস্তুত এই রূপান্তর প্রতিনিয়তই ঘটে চলেছে। প্রাচীন বঙ্গভূমি থেকে আমাদের আজকের এই বাংলাদেশ।

বই ॥ বাল্যবিয়ে প্রতিরোধী আখ্যান

বই ॥ বাল্যবিয়ে প্রতিরোধী আখ্যান

মোহিত কামালের ‘কার্তিকে বসন্ত’ উপন্যাসে এক গ্রামীণ কিশোরীর মনোজগতের সাহসী ও সদর্থক ভাবনা উঠে এসেছে। পাঠকের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণে এই উপন্যাস ভূমিকা রাখতে পারে।  গ্রামীণ পরিবেশে খেটে খাওয়া পরিবারে জন্ম ও বেড়ে ওঠা চন্দার। অক্ষরজ্ঞানহীন মজিদ মিয়া আর সফিনা বানুর মেয়ে চন্দা। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া চন্দা ছুটির দিনে পরিবারের সঙ্গে মাঠের জমিতে কাজ করে, ফসল ফলায়। চাষাবাদে অংশ নেয়। পড়াশোনায়ও সে ভালো। কথাবার্তায়ও সে স্মার্ট। তবে তার স্মার্টনেস ক্ষেত্রবিশেষে দেখা যায়। গ্রামের সহজ বাসিন্দা চন্দার মধ্যে লেখক এক তেজস্বী, প্রতিবাদী, বুদ্ধিমতী চন্দাকে সৃষ্টি করেছেন। বাল্যবিয়ের প্রতিরোধে সে সহপাঠীদের নিয়ে শিক্ষকের সহায়তায় ‘মনপুর উপজেলা বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ সংগঠন’ গড়ে তুলেছে। সহপাঠীয় বিয়ে হয়ে যাওয়ায় তার প্রস্তাবে শ্রেণিকক্ষে ১ মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এর মাধ্যমে লেখক চন্দাকে প্রতিবাদী চরিত্রের প্রতীক হিসেবে সৃষ্টি করেছেন।  স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে গ্রামের কিছু বখাটে ছেলে চন্দাদের বিরক্ত করত। চন্দা দৃঢ় কণ্ঠে তাদের সতর্ক করে দেয়। এমন কি মার দেবার হুমকিও দেয়। একই গ্রামের ছেলে রশীদ। সে এক সময় স্কুলে যেত। কিন্তু অভাবের কারণে তাকে স্কুল ছাড়তে হয়েছে। সেও মাঠে কাজ করে। অনেক সময় সে চন্দাদের জমিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। পেশিবহুল তামাটে শরীর রশীদের। চন্দাদের জমিতে কাজ করার সময় সে আড়চোখে তাকিয়ে রশীদকে দেখে। রশীদ চন্দার থেকে দুই ক্লাস উপরে পড়ত। বাবা-মারা যাবার কারণে তাকে পড়াশোনা বাদ দিয়ে মাঠের কাজ করে সংসারের হাল ধরতে হয়। কিন্ত চন্দার কাছে বিষয়টি ভালোলাগেনি। সে মনে মনে চায় রশীদ যেন আবার পড়াশোনা শুরু করে। পড়াশোনায় রশীদ ভালো ছিল। তবে সে মাঠের কাজেও খুব দক্ষ। রশীদের অবচেতন মনে চন্দার আসা-যাওয়া। চন্দাও নিজের অজান্তে ঘুরেফিরে সে পথেই চলছে। লেখকের ভাষায়, ‘খর¯্রােতা মনের মঙ্গা মোকাবিলায় সরু নাইলের মধ্যে চন্দা পুরে নিচ্ছে ভালোবাসার আগাম শস্যবীজ। মরা কার্তিক মাসকে আর মরা মনে হচ্ছে না। উজ্জ্বল শস্যবীজ বুক ভরে বুক ভরে কার্তিকে লেগেছে বসন্তের ছোঁয়া। উর্বর হয়ে উঠেছে মন-ভূমি। ভালোলাগার উর্বর ভূমি কেবল রশীদের জন্য।’  গ্রামের বখাটে ছেলেদের দ্বারা চন্দাদের উত্ত্যক্ত করার কারণে রশীদ একবার নরক আলী নামে এক বখাটে যুবকের চোখ উপড়ে ফেলে। যার ফলে তাকে জেলে যেতে হয়। রশীদকে জেল থেকে বের করার জন্য চন্দার উৎকণ্ঠার মাধ্যমে লেখক রশীদের প্রতি চন্দার গভীর ভালোবাসার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। চন্দার অগ্রহ আর জোরালো উদ্যোগের কারণে একসময় রশীদ জেল থেকে ছাড়া পায়। ধানকলে রশীদের মায়ের চাকরি হয় চন্দার চেষ্টায়। পাশের বাড়ির জরিনার বাল্যবিয়ে রোধ করে চন্দারা। চন্দাদের ¯ু‹লে বাল্যবিয়ে সংঘকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। সেখানে উপস্থিত থাকবে উপজেলা, জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ। প্রান্তিক পর্যায়ে বসবাস করেও চন্দা তার কাজের জন্য উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যে সাহায্য-সহযোগিতা পাবে এটা ভেবেই চন্দার বাবা মনে শান্তির পরশ অনুভব করে।  গ্রামের নানা দ্বন্দের অবসান হয় চন্দার কৌশলগত কার্যক্রমের কারণে। চন্দার বিপরীতপন্থিরাও তাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানায় তার বল্যবিয়ে প্রতিরোধক সংঘের কারণে। মনপুর গ্রামে শান্তি ফিরে আসে চন্দার হাত ধরে। এসব কিছুর মাঝেও চন্দার মনের গোপন কুঠরিতে আলোর প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখে রশীদ নামের ছেলেটি। গ্রামের প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষকে আলোকিত করার জন্য লেখক ‘কার্তিকে বসন্ত’ বইয়ে চন্দার মত উদ্যমী  কিশোরীর চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। চন্দার মতো কিশোরী যে সমাজে আছে সেখান থেকে বাল্যবিয়ে অন্তর্হিত হবে। বেকারের কর্মসংস্থান হবে, দুষ্কৃতকারীরা সুপথে আসবে, ঝরে পড়ার হার কমবে, বিদ্যালয়ে গমনোপযোগী শিশুর সংখা বাড়বে। চন্দা  কিশোরী হলেও তার ব্যক্তিত্বে  অভিভূত হন ইউএনওসহ এলাকার মানুষ। ব্যক্তিত্ব মানুষের একটা বড়গুণ। ব্যক্তিত্বের কারণে শত্রুও মিত্রে পরিণত হয়। যেমনটা লেখক চন্দাদের গ্রামের ছবিতে এঁকেছেন। এদেশের প্রতিটি গ্রামে যদি একজন করে চন্দার আবির্ভাব হয় তবে দেশের চেহারাই পরিবর্তন হয়ে যাবে। কার্তিক মাসের শূন্য মাঠ ফাল্গুনের ফুলে-ফলে উঠবে।

ভ্রমণ ॥ কাতালোনিয়ার রৌদ্রের ভেতর

ভ্রমণ ॥ কাতালোনিয়ার রৌদ্রের ভেতর

(পূর্ব প্রকাশের  পার্ক নামে। স্থানীয়দের কাছে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি, পাহাড়গুলোর নাম আল্টা গ্যারাটক্সা (Alta Garrotxa)। মূলত এই পাহাড়গুলো স্পেনের উত্তর দিকে ফরাসি দেশের সীমান্তে অবস্থিত পিরিনীয় পর্বত-শ্রেণির অংশ। এই পর্বত-শ্রেণির মধ্য দিয়েই ফ্রান্স ও স্পেনের বিভাজন রেখা চলে গেছে। এই পর্বতমালাটির অভ্যন্তরে পৃথিবীর ষষ্ঠ ক্ষুদ্রতম দেশ অ্যান্ডোরা অবস্থিত। অ্যান্ডোরা যাওয়ার গল্প অন্য এক লেখায় কখনো করা যাবে। জানতে পারি, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায়  ৪ শত ফুট উচ্চতায় আমাদের যেখানে ক্যাম্প তার কিছুটা কাছে পাহাড়ের মধ্যে ছোট্টো একটি আবাসিক হোটেল অবস্থিত। সেই হোটেল সংলগ্ন ছোটো ভলিবল মাঠ এবং সুইমিং পুল বা নীল জলের শান বাঁধানো পুকুরটি আমাদের ব্যবহারের জন্য অনুমতি নেওয়া আছে, চাইলেই আমরা সেখানে যেতে পারি। কৌতূহলে এক-দুই বার সেখানে যাইও। দলের অধিকাংশই পুল আর মাঠে বেশি সময় কাটায়। কিন্তু আমার মতো কয়েকজনের তাতে যেন মন নেই—এতো পথ পাড়ি দিয়ে কাতালোনিয়ার পাহাড়ে এসে যদি সেই ইট-কাঠের শহুরে ঘটনায় আবদ্ধ থাকি, তাহলে আসার কী অর্থ হলো? কয়েকজন মিলে সিদ্ধান্ত নিই এলাকা ঘুরে দেখবো।  প্রথম আগ্রহ মুগা নদীকে ঘিরে। কিন্তু আবশ্যিক নিয়ম হলো, দলের কেউ যদি আলাদা কোনো পরিকল্পনা করে তবে সবকিছুই প্রথমে আমাদের দলের প্রধান এবং পরে ক্যাম্পিং-এর আয়োজকদের জানাতে হবে। নিয়ম অনুযায়ী তাদের জানানো হয়। তারা বলেন, এই সাতদিনের কোনো একদিন ক্যাম্পের আয়োজকের পক্ষ থেকে একটি চৌকস বিশেষজ্ঞ দলের সহায়তায় আমরা মুগা নদী ট্রেকিং করার সুযোগ পাবো। নিজেরা একাকী যেন আমরা এই নদী ধরে কোথাও না যাই। কারণ, সরু পাহাড়ি-পাথুরে এই নদীর তলদেশের পাথর কিছু কিছু স্থানে খুব পিচ্ছিল, কিছু কিছু স্থানে গভীর খাদ। পিছলে পাথরের গায়ে ধাক্কা খেলে খুব খারাপ কিছু হতে পারে। যারা এই নদী ভালো চেনে তাদের সঙ্গে করে না গেলে আমরা যে কোনো সময়ই বিপদে পড়তে পারি। আমরা তবু নদীর কাছে যাই। সুস্বাদু জলে ভরা নদী, বড়ো বড়ো প্রাচীন পাথরের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে।  ওয়াটার ট্রেকিং-এর দিনেও মুগা নদীকে নিয়ে আমাদের উত্তেজনার অন্ত ছিল না। সবাইকেই হেলমেট আর নেওপ্রিনআনসুগ (জার্মান: হবড়ঢ়ৎবহধহুঁম) নামে এক ধরনের নিউপ্রিন, রবার বা সিন্থেটিকের স্যুট বাধ্যতামূলকভাবে পরতে হয়। সঙ্গে কাপড়ের জুতো। যেহেতু পাথুরে পিচ্ছিল সরু খরস্রোতা নদী, সে কারণেই এই প্রস্তুতি। তারপরও একবার পড়ে গিয়ে কনুই ছিলে যাওয়া রক্ষা করতে পারিনি। যাত্রা শুরু হয় ক্যাম্প থেকে উত্তরে মুগা নদীর প্রশস্ত অগভীর স্থান থেকে। জলের গভীরতা সেখানে হাঁটু থেকে কোমর অব্দি। আমরা হাঁটতে শুরু করি নদীর মাঝ বরাবর। অধিকাংশ স্থানে নদীর কোনো পাড় নেই- দুই পাশে পাথুরে পাহাড় খাড়া উপরে উঠে গেছে, প্রায়ই মনে হয় দুই পাহাড়ের চিড়ে আমরা। পাহাড়ের মধ্যকার ফাটল ধরে বয়ে চলা নদীতে কেবলই পাথর। কোথাও সহসা সুগভীর, কোথাও অগভীর। কোথাও পিছলে যেতে হয় বৃহৎ পাথরের উপরে। কোথাও লাফ দিয়ে তলিয়ে যেতে হয় দশ-বিশ হাত। স্রোতস্বিনীর ভেতরে বড়ো-ছোটো মাছের দেখা।

সুরের জগতে  চিরঞ্জীব সাধক

সুরের জগতে  চিরঞ্জীব সাধক

প্রকৃত শিল্পীরা মনুষ্যত্বের সুধা পান করে জীবনে অমরত্ব অর্জন করেন। সুরের দ্বারা ও গানের দ্বারা তাঁরা সৃষ্টি করেন ইহ এবং পর জনমের মধ্যে বিনা সুতোর মালায় গাঁথা সেতুবন্ধন। এই সেতু বেয়ে তাঁরা বিচরণ করেন মানুষের আত্মা থেকে আত্মায়, হৃদয় থেকে হৃদয়ে। একদিন হয়তো এ নশ্বর দেহ পরিত্যাগ করে তাঁরা আরেক আনন্দলোকে গমন করেন। এ লোকান্তর মহাকালের সিন্ধুর তরঙ্গে তরঙ্গায়িত। তাঁদের সুরের বিচরণ যেখানে আত্মা থেকে আত্মায় মৃত্যু তাদের শেষ কথা নয়। শিল্পীর আত্মা অমর, অক্ষয়, অনশ্বর। কোনো ভঙ্গুরতা শিল্পীর আত্মাকে কালগ্রস্ত করতে পারে না। হাজার বছরের আলো যুগ যুগ ধরে তাঁদের আত্মাকে গতিশীল ও জ্যোর্তিময় করে রাখে। তাঁদের সুর তাঁদের করে রাখে চিরঞ্জীব।

স্কার্দু উপত্যকা ॥ একটি স্মৃতিচারণ

স্কার্দু উপত্যকা ॥ একটি স্মৃতিচারণ

উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানের একটি বিশাল ভূখণ্ডের নাম : বাল্টিস্তান। ওটার একটা অঞ্চল আবার পাকিস্তানের দখলিকৃত কাশ্মীরের অংশও বটে! ১৯৬৭-’৬৮ সালে আমি পিআইএ’র এফ-২৭ প্লেনের কো-পাইলট। বর্তমানে বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন বিভাগে চিফ এক্সামিনার হিসেবে কর্মরত ক্যাপ্টেন রফিউল হক এবং আমার একই সঙ্গে পোস্টিং হলো পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে। ওই শহরের গ্যাটমল মটেল নামের হোটেলে বড় এবং সুন্দর একটি রুম ভাড়া করে আমরা দুজনে এক সঙ্গে থাকতাম। গিলগিট-স্কার্দু হয়ে লাদাখ পর্যন্ত বিস্তৃত হলো বাল্টিস্তান। লাদাখের কিছু অংশ ভারতীয় কাশ্মীর রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। বাকি বিরাট অংশ আছে চীনের দখলে। হিমালয়, কারাকোরাম, হিন্দুকুশের মতো সাতাশ/আটাশ হাজার ফুটের উচ্চতাসম্পন্ন পর্বত শ্রেণি পেরিয়ে স্কার্দু যেতে হতো। স্কার্দু যাওয়া ছিল গিলগিট যাওয়ার চেয়েও অনেক বেশি বিপজ্জনক। ফকার ফ্রেন্ডশিপ সতেরো/আঠারো হাজার ফুটের বেশি উচ্চতা দিয়ে ফ্লাই করতে পারত না। তাই ওই সুউচ্চ পাহাড় শ্রেণি পাশ কাটিয়ে স্কার্দু-গিলগিট যেতে হতো। কারাকোরাম পর্বতমালার শীর্ষে পাশাপাশি দুটি বর্তুল আকৃতির পাশাপাশি শৃঙ্গ ছিল। বর্তুল আকারের শৃঙ্গদ্বয় পার হলেও ডান দিকে গিয়েছে একটি গিরিপথ। বর্তুল আকারের শৃঙ্গদ্বয় দেখতে পেলেই আমরা নিচের দিকে নামতে শুরু করতাম এবং প্রথম ডান দিকের যে গিরিপথ গিয়েছে, ওই গিরিপথ ধরে দশ/বারো মিনিট ফ্লাই করলেই পৌঁছে যেতাম স্কার্দু উপত্যকায়। যে গিরিপথের কথা বললাম, তা ছিল খুবই অপ্রশস্ত। গিরিপথের ভেতর প্রবেশ করলে ১৮০ ডিগ্রি টার্ন করে বেরিয়ে আসা সম্ভব ছিল না। তাই রাওয়ালপিন্ডি বিমানবন্দরে আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতাম। এবং বিমানবন্দরের আবহাওয়া অধিদপ্তরের অফিস থেকে যখন জানতে পারতাম, স্কার্দু যাওয়ার গিরিপথে কোনো মেঘমালা থাকবে না, তখনই কেবল স্কার্দুর পথে যাত্রা করতাম। স্কার্দু যাওয়ার গিরিপথ এতটাই অপ্রশস্ত ছিল যে মনে হতো গিরিপথের পাশের পাহাড়ে ধাক্কা লেগে আমাদের অ্যারোপ্লেন বিধ্বস্ত হবে। এমন ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় স্কার্দু-গিলগিটের প্রতিটা ফ্লাইট করার জন্য আমাদের পাইলটদের ৪০ টাকা করে রিক্স অ্যালাউন্স দেওয়া হতো। প্রতিমাসে আমরা এক একজন পাইলট সাত-আটটা ফ্লাইট করতাম নর্দান এরিয়াতে। রিক্স অ্যালাউন্স হিসেবে তিন শ থেকে সাড়ে তিন শ টাকা ভাতা পেতাম। তখনকার তিন শ/সাড়ে তিন শ টাকা বর্তমানের মুদ্রামানে কয়েক হাজার টাকা হবে। স্কার্দু উপত্যকা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে বেশ উঁচুতে ছিল। তাই সারা বছরই ওখানে প্রচণ্ড শীত থাকে। আমরা স্কার্দু যেতাম, কেরোসিন এবং লবণ নিয়ে। কালেভদ্রে দু’একজন যাত্রীও থাকত আমাদের ফ্লাইটে।

গল্প ॥ মন ভালো নেই

গল্প ॥ মন ভালো নেই

আজ সোনাভানুর মন ভালো নেই। শরীরও ভালো নেই। শুধু ঘাম ঝরছে গা বেয়ে। তীব্র দাবদাহে বিপর্যস্ত জনজীবন। রৌদ্রের দিকে তাকানো যায় না। মাথা ঘুরছে ভনভন করে। শাড়িটা আলগা করে বসে পড়ে উঠানের কোণে আম গাছের ছায়ায়। পাখিরাও ভালো নেই। বৃক্ষরাও ভালো নেই। বৃষ্টির অভাবে পাতা লাল হয়ে ঝরে যাচ্ছে। রান্না ঘরের পাশে লাগানো জামরুল গাছে এই প্রথম জামরুল ধরেছে। বোটা শুকিয়ে জামরুল ঝরে পড়ে আছে গাছের গোড়ায়, মাটিতে। আকাশে মেঘের ছিটেফোঁটা নেই। এমন আর্দ্রতাহীন দিন উপেক্ষা করে বেলী ফুলগাছটা প্রাণ ভরে নয়ন জুড়ানো ফুল ফুটিয়েছে! বিপরীত আবহাওয়ায় ছোট ছোট গাছগুলো কী আপ্রাণ চেষ্টায় সপ্রাণ বেড়ে উঠে! ভাবলে অবাক মানতে হয়।

কবি ও কবিতা

কবি ও কবিতা

কোনো কবি যখন তাঁর ভাবনাগুলোকে ছন্দাকারে সাজিয়ে, শব্দের সুতোয় গেঁথে, কয়েকটি স্তবক প্রসব করেন তাকে আমরা কবিতা বলতে পারি।  পাখিরা খড়কুটো সংগ্রহ করে বাসা তৈরি করে। কবিরা সমাজের মানুষের মনোজগতের চেতনার অনুভূতি সংগ্রহ করে শব্দে গেঁথে গেঁথে কবিতার দেহ বির্নিমাণ করেন। যা কবিতা হয়ে আপামর মানুষের কথা বলে। কবির অন্তর জগতের সঙ্গে বহির্জগতের দর্শনীয় বস্তুর সঙ্গে কবির অন্তরলোকে মিথস্ক্রিয়ার ফলে যে অমৃতময় বস্তুর জন্মলাভ হয়; সেটিকে আমরা কবিতা বলতে পারি।  কবিতা জীবনের কথা বলে। সমাজের কথা বলে। কবিতা কখনো রাজনীতি ও স্বাধীনতার কথা বলে। কবিতার কয়েকটি চরণ হাজার হাজার বুলেটের চেয়েও শক্তিশালী।  কবির দর্শন বাস্তব দর্শন। কবি যা দেখে-তাই লেখে। সেখানে কবির অনুভূতি অত্যন্ত প্রখর। দিবাকরের উজ্জ্বল প্রভার মতো দীপ্তিময়। কবির দর্শন কখনো ভুল হয় না। কবিতা মানে দর্শন। কবি মানে দার্শনিক। কবি কবিতায় বাস্তব সত্যকে প্রকাশ করতে কখনো কুণ্ঠাবোধ করেন না। কবি তাঁর উপলব্ধির দ্বারা সত্যকে জানতে পারেন। কবির চেতনায় সত্য অনুভূতি আঘাত করে বলেই কবি ছন্দে ছন্দে, শব্দে শব্দে গেঁথে ফেলেন একখানা কবিতার অবয়য়ব। কবিতা শুধু কবির বাণী নয়। সেটি বিশ্বজনীনতার বাণী। সাম্যের বাণী জনগণমন নন্দিত বাণী, সমাজের ভূমিকার বাণী। যে বাণী কবির কলমে চেতনার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়ে শব্দের ঝলকানিতে বারুদের মতো বিস্ফোরিত হয়! কবিতা মানে বারুদ, কবিতা মানে কবির কলমে জ্বলে ওঠা চেতনার অগ্নিমশাল! কবিতা কবির একান্ত অনুভূতির ফসল হলেও সে অনুভূতি পৃথিবীর আপামর মানব হৃদয়ের অনুভূতির বহির্প্রকাশ। কেননা, কবিতা শুধু একজন মানব মনের  কথা নয়। সে কথায় বিশ্বজনীনতার অনুভূতি লিপিবদ্ধ থাকে। কবিতায় প্রেম থাকে, দ্রোহ থাকে। কবিতায় সমাজের সকল অবক্ষয় ও অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ থাকে। যে কবিতায় এ সবের কিছু নেই। সে কবিতা সত্যিকার  অর্থে মানব সমাজের কোনো উপকারে আসে না। যে কবিতা দেশের, সমাজের, মানুষের কথা বলে না যে কবিতা অন্যায়, অত্যাচার, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে না সে কবিতা নিছক আবর্জনা ছাড়া আর কিছু নয়। যে কবিতা সমাজের আনুষঙ্গিক বিষয়কে অতিক্রম করে নির্লিপ্ত ও অপ্রয়োজনীয়-অনুসন্ধিৎসা ভাব প্রকাশ করে যে কবিতা পঠনে পাঠক দুর্বোধ্যতার সীমাহীন অতলে হাবুডুবু খায় সে সকল কবিতা কবিত্বের দাবি রাখে না। সত্যের সিঁড়ি বেয়ে হেঁটে যে কবিতা সমাজের সকল অন্যায়, অপরাধ, অত্যাচার, নিপীড়ন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ও প্রতিবাদী শব্দের উচ্চারণ করে সে কবিতাই প্রকৃত অর্থে কবিতা হয়ে ওঠে! কবিতা শুধু কবির ভাবনার ফসল নয় কবিতা কবির একান্ত অনুভূতির ফসল। যে অনুভূতি সমাজের সকল মানুষের অনুভূতির সঙ্গে  একাত্ম হয়ে মিশে যায়। সমাজের সকল মানুষ কবি নয়। কিন্তু তাদের অনুভূতিগুলো কবির কবিতার সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। যে কারণে কবির কবিতা সকল মানুষের চেতনায়, মরমে অনুভূতি সঞ্চার করে। কবি সকলের কাছে সমাদৃত হন। কবিতার কোনো জাত-পাত নেই। কবিতা মানুষে মানুষে কোনো  বিভেদের দেওয়াল তৈরি করে না। কবিতার কাছে পৃথিবীর সকল মানুষ সমান। কবিতা কোনো মানুষকে ভিন্নতার চোখে দেখে না। বরং কবিতা পৃথিবীর আপামর মানুষকে ¯েœহ-মমতার একক বন্ধনে আবদ্ধ করতে চায়। কারণ কবি কোনো মানুষকে ভিন্নতার চোখে দেখেন না। কবি সকল মানুষকে সমতার চোখে দেখেন। এ জন্য তিনি কবিতায় সাম্যের কথা বলেন, মিলনের কথা বলেন। সুতরাং কবিতাই পারে, মানব সমাজের সকল বৈরিতা এবং ভিন্নতাকে সমূলে বিনাশ করতে! বাইরের দৃশ্যমান বস্তুর সঙ্গে কবির মনোজগতে যে ভাবের আদান-প্রদান চলে। সেটি একসময় শব্দবৃক্ষে পরিণত হয়। আর এ শব্দবৃক্ষই হলো কবিতা। কবিতার আগুন ভয়ঙ্কর আগুন! এ আগুন হঠাৎ জ্বলে উঠে একটি দেশ-জাতি-সমাজের অবক্ষয়কে পুড়িয়ে ছারখার করতে পারে! একটি কবিতা পারে পরাধীনতার শিকল ভাঙার গান গাইতে! একটি কবিতা পারে স্বাধীনতার ডাক দিতে। একটি কবিতা জাগাতে পারে একটি দেশকে, দেশের আপামর জনতাকে। একটি কবিতা রুখে দিতে পারে সকল অন্যায়-অত্যাচাররের খড়গ কৃপানকে। একটি কবিতা গর্জে উঠলে রাজার মসনদও টলমল করে। একটি কবিতার বজ্রনিনাদে দৌড়ে পালায় হাজারো অপরাধী ভেড়ার দল! কবিতা কারো বাধা মানে না। কবিতা কারো চোখ রাঙানির ভয় করে না। কবিতা কোনো আইন মানে না। কবিতা কোনো বন্দুক, রাইফেল কিংবা মেশিনগানের ভয়ে আড়ালে লুকিয়ে থাকে না। কবিতা প্রকাশ্য অভিমুখী। স্ববাক হয়ে-স্বপ্রণোদিত হয়ে ঘোষণা করে তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য। কবিতা সকল প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে, সকল নষ্টতার বিরুদ্ধে, সকল অপবিত্রতা ও কলুষতার বিরুদ্ধে স্লোগানমুখর হয়ে গর্জে ওঠে!  কবিতা। কবির কলমে প্রসূতি মায়ের মতো প্রসবিত সন্তান। কবিতার জন্মদাতা পিতা কবি। কবিতা কবির চেতনার জল-রক্ত-মাংসে গড়া প্রতিমা। যার অবয়য়বে কবির সত্তার নির্যাস পীযুষের মতো অমৃতময় হয়ে জগতজনের মাঝে প্রকটিত হয়। কবিতা আড়মোড়া দিয়ে ফুটেওঠা প্রস্ফুটিত পূষ্প। যে পুষ্পের সুগন্ধে চারিদিক সুবাসিত হয়। অন্ধকারাচ্ছন্ন দেশ, জাতি, সমাজ সোনালি আলোর ঝলকানি দেখতে পায়। কবিতা জীবন্ত বোধিবৃক্ষের মতো। আজীবন চৈতন্যসত্তায় বোধ সঞ্চার করে। বোধিবৃক্ষ কবি। আর কবিতা বোধিবৃক্ষের ফল। একজন কবি কবিতার বোধিবৃক্ষ। কবির চিত্তগহণে যে ফুল ফোটে। সে ফুল কবিতার ফুল। কবির চিত্তবীণায় যে সুর শব্দ হয়ে ঝংকার তোলে। কবি সেই সুর-শব্দে শব্দে, ছন্দে ছন্দে, গেঁথে নির্মাণ করেন একখানা শব্দপুষ্পহার। যে হার শোভা পায় কবিতার মহাভক্ত পাঠকের গলায়। কবিতা সময়ের প্রকোষ্ঠে-চৌকাঠের ফ্রেমে বন্দি হওয়া বস্তু নয়। কবিতা দেশ-কাল-সময়ের গ-ি পেরিয়ে মহাবিশ্বের অসীম সীমানায় মিশে যায়। সময়ের অর্গল ভেঙে সমসাময়িকতার কথা বলে। তেমনি একজন কবি। শুধু একটি নির্দিষ্ট দেশের সম্পদ নয়, একটি জাতির সম্পদ নয়। একজন কবি। সমগ্র বিশ্বের সম্পদ, বিশ্বজনীন সম্পদ। কেননা, কবির কবিতা কোনো নির্দিষ্ট স্থানে জমাটবাঁধা আবর্জনাস্তূপের মতো জমাটবদ্ধ হয়ে স্থির থাকে না। কবির কবিতা সময়ের অলক্ষ্যে বায়ুপ্রবাহের মতো ছুটে চলে একস্থান থেকে আরেক স্থানে। দেশ থেকে অন্যদেশে। এক জাতিগোষ্ঠী থেকে আরেক জাতিগোষ্ঠীর কাছে। কবিতা মেঘে ঢাকা তারার মতো চিরকাল সময়ের অন্তরালে আবৃত থাকে না। মেঘ অপসারিত হলে নক্ষত্ররাজি যেমন আলোকচ্ছটা বিচ্ছুরিত করে। তেমনি কবিতাকে কেউ অবলুপ্ত করতে পারে না। কবিতা স্ব-মহিমায় প্রকট হয়। কবিতার কোনো বয়স নেই। কবিতা সব সময় চিরযৌবনা। কবিতা আমৃত্যু যৌবন রসে সিক্ত হয়ে, জগৎজনের মাঝে আত্মগৌরব নিয়ে বেঁচে থাকে। কবিতার মাঝে কবির নামও অমর রয়। কবিতা কথা কয় মহাকালের ¯্রােতে ভেসে ভেসে। কাল অতীত হয়। কিন্তু কবিতা কখনো অতীত হয় না। অতীতকে অতিক্রম করে ভবিষ্যতের ছবি আঁকে দূর-সীমানায়। কবিতা বেঁচে থাকে কালের কালান্তরে সময়ের সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে। তার ব্যক্তধ্বনির লহরী তুলে। মানবের হৃদয়ে হৃদয়ে। গুপ্ত-ব্যথার মতো সঞ্চিত হয়ে!