
ছবি: প্রতীকী
অনেক সময় আমাদের শরীরে জ্বর থাকে না, সর্দি-কাশির লক্ষণও দেখা যায় না, কিন্তু তবুও শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। হাঁটাচলা করলে বা হালকা পরিশ্রমেও নিঃশ্বাস ছোট হয়ে আসে, মনে হয় বুকের ভেতর ভারী কিছু জমে আছে। এই উপসর্গকে আমরা অনেকে সাধারণ ক্লান্তি বা শ্বাসকষ্ট বলে হালকাভাবে নিই। কিন্তু এই উপসর্গগুলো হতে পারে মারাত্মক শ্বাসতন্ত্রজনিত একটি রোগের পূর্বাভাস – যার নাম COPD বা ‘ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ’।
COPD হলো ফুসফুসের একটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ, যার কারণে ধীরে ধীরে শ্বাসনালী সংকুচিত হয়ে পড়ে এবং অক্সিজেন গ্রহণ ও কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনে বাধা সৃষ্টি হয়। এই রোগ সাধারণত ধীরে ধীরে বাড়ে এবং অনেক সময় মানুষ বুঝতেই পারে না যে তার ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শুরুতে শুধু হালকা শ্বাসকষ্ট, পরে তা তীব্র আকার ধারণ করে। রোগী মনে করে এটা সাময়িক কিছু, কিন্তু বাস্তবে তা ধীরে ধীরে ফুসফুসকে স্থায়ীভাবে দুর্বল করে ফেলে।
এই রোগের প্রধান কারণ ধূমপান। সক্রিয় ধূমপান তো বটেই, পরোক্ষ ধূমপান বা প্যাসিভ স্মোকিং-ও এই রোগ সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া ধুলাবালি, গাড়ির ধোঁয়া, রান্নাঘরের ধোঁয়া বা দীর্ঘ সময় ধরে দূষিত বায়ুতে কাজ করলে COPD হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। গ্রামের মহিলাদের মধ্যেও এই রোগের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, কারণ তারা দীর্ঘ সময় ধরে কাঠ বা কয়লা দিয়ে রান্না করেন।
COPD এর আরেকটি বড় সমস্যা হলো, এটা পুরোপুরি আরোগ্যযোগ্য নয়। একবার হলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, কিন্তু সম্পূর্ণভাবে ভালো করা যায় না। তাই শুরুতেই সচেতনতা খুব জরুরি। যখন শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, বুক ধড়ফড় করে, হালকা কাশিও লেগে থাকে, রাতে ঘুমের সময় নিঃশ্বাসে হাঁপানির মতো আওয়াজ হয় – এসব লক্ষণ দেখা দিলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
অনেক সময় মানুষ মনে করে শ্বাসকষ্ট মানেই অ্যাজমা বা হাঁপানি। তবে অ্যাজমা আর COPD এক জিনিস নয়। হাঁপানির ক্ষেত্রে ঔষধে দ্রুত উপশম হয় এবং ঋতুভিত্তিক ওঠানামা করে। কিন্তু COPD ধীরে ধীরে বাড়ে এবং সবসময়ই একটা স্থায়ী শ্বাসকষ্ট লেগে থাকে।
চিকিৎসার জন্য চিকিৎসক সাধারণত স্পাইরোমেট্রি নামের একটি ফুসফুস পরীক্ষার পরামর্শ দেন। এটি ফুসফুসের ক্ষমতা যাচাই করতে সাহায্য করে। এছাড়া এক্স-রে, সিটি স্ক্যান বা রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা মাপার মাধ্যমেও রোগ নির্ণয় করা যায়। একবার নিশ্চিত হলে নিয়মিত ওষুধ, ইনহেলার এবং জীবনযাত্রায় পরিবর্তনের মাধ্যমে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
যারা ধূমপান করেন, তাদের এই রোগের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। তাই ধূমপান ত্যাগ করাটাই প্রথম করণীয়। পাশাপাশি ধুলাবালি ও ধোঁয়া থেকে দূরে থাকা, ঘরের জানালা খুলে রাখার মাধ্যমে বায়ু চলাচলের সুযোগ করে দেওয়া, রান্নার সময় ভালোভাবে বায়ু চলাচল নিশ্চিত করা, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং নিয়মিত হালকা ব্যায়াম করাও গুরুত্বপূর্ণ। ফুসফুসকে সবল রাখার জন্য প্রয়োজন সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও মানসিক প্রশান্তি।
COPD একটি নীরব ঘাতক। অনেক সময় জ্বর নেই, ঠান্ডাও নেই, কিন্তু তবুও শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে – এটা উপেক্ষা করা যাবে না। এটি হতে পারে COPD-এর প্রাথমিক সংকেত। তাই দেরি না করে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। সচেতন থাকলে এবং শুরুতেই ব্যবস্থা নিলে জীবন অনেক সহজ ও স্বাভাবিক রাখা সম্ভব।
ফুসফুস সুস্থ থাকলে জীবন সহজ হয়। নিঃশ্বাস আমাদের জীবনের প্রাণ। তাই শ্বাস নিতে কষ্ট হলে সেটা হালকা ভাবে নেবেন না। নিরবধি নিঃশ্বাসের স্বস্তির জন্যই আমাদের আজ থেকে সচেতন হতে হবে – যেন আমরা ও আমাদের প্রিয়জনরা দীর্ঘদিন সুস্থ থাকতে পারি।
এম.কে.