
ছবি: সংগৃহীত
আজ হুমায়ুন আহমেদের মৃত্যুবার্ষিকী। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাসে এমন একটি দিন, যেদিন হারিয়ে গিয়েছিলেন এক অসামান্য আলোকবর্তিকা। ২০১২ সালের ১৯ জুলাই নিউ ইয়র্কের একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন কোটি পাঠকের প্রিয় কথাশিল্পী। দেখতে দেখতে কেটে গেছে তেরোটি বছর, কিন্তু হুমায়ুন আহমেদ নামটি আজও ততটাই উজ্জ্বল, ততটাই জীবন্ত।
কোনো এক অদ্ভুত কারণেই এই মানুষটা আমাদের এত আপন। তাঁর বই, নাটক বা সিনেমা পড়লে বা দেখলে মনে হয় এই মানুষটা বুঝি আমাকে নিয়েই লিখেছেন। আমার মতো করেই ভাবেন, আমার মতো করেই কাঁদেন, হাসেন। তাঁর লেখা কখনও গভীর দর্শন নিয়ে হাজির হয় না, কিন্তু তার সহজ-সরল বাক্যগুলোই আমাদের হৃদয়ে গিয়ে থেমে যায়। সেই থেমে যাওয়া শব্দগুলো আমাদের জীবনের সঙ্গী হয়ে ওঠে।
হুমায়ুন আহমেদ আসলে শুধু একজন লেখক ছিলেন না। তিনি ছিলেন সময়ের এক অনন্য ভাষ্যকার। যে সময়টাকে তিনি ছুঁয়ে গেছেন, সে সময়টা আজও তাঁর স্পর্শে মোহিত হয়ে আছে। ‘হিমু’, ‘মিসির আলি’, ‘শুভ্র’— তাঁর চরিত্রগুলো যেন কল্পনায় নয়, বাস্তবেই হেঁটে বেড়ায় আমাদের চারপাশে। হিমুর মতো হলুদ পাঞ্জাবি পরে হাঁটা এক তরুণকে আমরা খুঁজে ফিরি ব্যস্ত শহরের ভিড়ে। মিসির আলির মতো যুক্তিবাদী কোনো মানুষকে আমরা চাই, যখন বাস্তবতা মনের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়।
বাংলা সাহিত্যে যখন আধুনিকতা ঢুকলেও পাঠকের হৃদয়ে টিকতে পারছিল না, তখন হুমায়ুন আহমেদ এসেছিলেন এক নতুন ধারায়। তাঁর প্রথম উপন্যাস “নন্দিত নরকে”-ই দেখিয়ে দিয়েছিল যে, তিনি অন্যরকম কিছু নিয়ে এসেছেন। এরপর একে একে “শঙ্খনীল কারাগার”, “জোছনা ও জননীর গল্প”, “দেবী”, “অচিনপুর”, “কবি”— সহ অসংখ্য উপন্যাস দিয়ে তিনি সাহিত্যপ্রেমীদের মন জয় করে নিয়েছেন।
তাঁর কলম কখনও কাঁদিয়েছে, কখনও হাসিয়েছে। হঠাৎ এক প্যারাগ্রাফ পড়ে চোখে জল চলে আসে, পরের লাইনেই হেসে ওঠা যায়— এটাই ছিল হুমায়ুন আহমেদের যাদু। তিনি গল্পের ভেতরে এমনভাবে জীবনের খুঁটিনাটি ঢুকিয়ে দিতেন, যা পাঠককে ঠিক ছুঁয়ে যেত।
হুমায়ুন আহমেদের টেলিভিশন নাটকও ছিল অনন্য। আশি-নব্বইয়ের দশকে তাঁর নাটক মানেই ছিল সারা দেশের মানুষ টিভির সামনে বসে পড়বে। “এইসব দিনরাত্রি”, “কোথাও কেউ নেই”, “অয়োময়”, “বহুব্রীহি”— এসব নাটক যেন এক একটি জীবন্ত দলিল হয়ে উঠেছিল। বাক্যে, চরিত্রে, গল্পে, হাস্যরসে— সবখানেই ছিল জীবনের সোঁদা গন্ধ।
বিশেষ করে বাকের ভাইয়ের মৃত্যুর পর যে গণআন্দোলন তৈরি হয়েছিল, সেটিই প্রমাণ করে, হুমায়ুন আহমেদের চরিত্রগুলো সাধারণ মানুষের জীবনে কী পরিমাণ প্রভাব ফেলেছিল। তিনি কেবল বিনোদন দেননি, তিনি মানুষকে ভাবতে শিখিয়েছেন— তবে কোনো কঠিন ভাষায় নয়, একদম সহজ, সাবলীল কথায়।
চলচ্চিত্রেও হুমায়ুন আহমেদ রেখে গেছেন অবিস্মরণীয় ছাপ। “আগুনের পরশমণি”, “শ্যামল ছায়া”, “ঘেঁটুপুত্র কমলা”, “দুই দুয়ারী”— এসব ছবি শুধু দেখার জন্য বানানো হয়নি, এগুলো আমাদের ভেতরটাকে নেড়ে দেওয়ার জন্য নির্মিত। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো আমাদের ইতিহাসচর্চাকে সহজ করে তোলে, হৃদয়বান করে তোলে।
ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন এক নিঃসঙ্গ সাধক। হাজারো মানুষের ভালোবাসার মাঝে থেকেও হুমায়ুন আহমেদ ছিলেন খানিকটা একা। তিনি নীরবে লিখেছেন, চিন্তা করেছেন, গড়েছেন একের পর এক কালজয়ী চরিত্র। তাঁর লেখার টেবিলের পাশে ছিল আকাশ দেখার জানালা, ছিল একটি মাছের অ্যাকুরিয়াম— এই ছোট ছোট জিনিসগুলো নিয়েই তিনি গড়েছিলেন এক মায়াবী জগৎ, যেখান থেকে জন্ম নিয়েছে শত শত গল্প।
তাঁর পাঠকরা আজও তাঁর মৃত্যুদিনে বুকের ভেতর শূন্যতা অনুভব করে। কারণ এই দেশে বহু সাহিত্যিক এসেছেন, বহু মানুষ লিখেছেন, বলছেন। তবে হুমায়ুন আহমেদ ছিলেন সেই বিরল লেখক, যিনি আমাদের মনের গোপন আবেগগুলোকে শব্দে বাঁধতে পেরেছিলেন। আমরা তাঁর গল্পে নিজেদের খুঁজে পাই, আমাদের হাসি-কান্না খুঁজে পাই।
এখনো শহরের ছোট দোকানে পাওয়া যায় তাঁর বই। স্টেশনের পাশের ছোট দোকানে, কোনো কলেজের করিডোরে কিংবা পাঠাগারে হুমায়ুন আহমেদের বইগুলো আজও একজন একা পাঠককে গল্পের ভিতরে নিয়ে যায়। তাঁর লেখা পড়ে এখনও কেউ প্রেমে পড়ে যায়, কেউ বিষণ্নতায় একটু স্বস্তি খোঁজে, কেউ হয়তো কেবলই স্মৃতি হাতড়ে বেড়ায়।
হুমায়ুন আহমেদ নেই, কিন্তু তাঁর গল্প আছে। তাঁর হাতে গড়া চরিত্রগুলো আজও জীবনের সঙ্গে মিশে আছে।
হুমায়ুন আহমেদ নেই, কিন্তু তাঁর ভাষা, তাঁর ভালোবাসা, তাঁর স্বপ্ন আমাদের ভেতরেই বাস করছে।
আজ এই মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা শুধু মুখেই বলি না, আমরা মনে-প্রাণে তোমাকে অনুভব করি। তুমি শান্তিতে ঘুমাও, গল্পের যাদুকর। তুমি ঘুমাও তোমার সৃষ্টি আর আমাদের ভালোবাসার চাদরে মুড়ে। তোমার গল্প শেষ হয়নি। তোমার গল্প চলছেই...
এম.কে.