ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৭ জুলাই ২০২৫, ১ শ্রাবণ ১৪৩২

বৌমা থেকে কবির স্বয়ং ‘মা’ হয়ে গিয়েছিলেন উমা কাজী

শরিফুল রোমান

প্রকাশিত: ০০:০০, ১৭ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ০০:০১, ১৭ জুলাই ২০২৫

বৌমা থেকে কবির স্বয়ং ‘মা’ হয়ে গিয়েছিলেন উমা কাজী

বৌমা থেকে কবির স্বয়ং ‘মা' হয়ে গিয়েছিলেন উমা কাজী। কবির জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মায়ের মতোই সেবা করে গেছেন নির্বাক অসুস্থ কবিকে। 

বর্ধমানের এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম। পড়াশোনা করেছিলেন নার্সিং এর ওপর, এরপর কোলকাতার লেডি ডাফরিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নার্স হিসাবে কর্মরত ছিলেন। কাজী নজরুল ইসলাম ততোদিনে জীবনীশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। নির্বাক কবির স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধিও লোপ পেয়েছে ইতোমধ্যে। বাঁধনহারা চিরবিদ্রোহী যেই কবি চষে বেড়িয়েছেন সবদিকে, সেই কবির জীবনের গন্ডি আঁটকে গেলো বাড়ির চারদেয়ালের মধ্যে।

কবিপত্নী প্রমীলাও ততোদিনে অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী। তাহলে কবির সেবাযত্ন করবে কে? এজন্য বাড়িতে একজন সার্বক্ষণিক নার্সের দরকার পড়লো।
লেডি ডাফরিন হাসপাতালের হেডনার্সের পরামর্শে উমা সেই দায়িত্বটা নিতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। নজরুল ততোদিনে উভয় বাংলায় তুমুল জনপ্রিয় নাম, তার সেবিকা হওয়ার মাঝেও একটা বড় গৌরব আছে। বাড়িতে দেখতে গিয়ে কবির একদম মাথার কাছে বসলেন তরুণী উমা। 
কবিপত্নী প্রমীলা দেবী বললেন,“মা, তুমি কি পারবে কবির সেবা করতে? ওই যে দ্যাখো, উনি খবরের কাগজ ছিঁড়ছেন। উনি এখন শিশুর মতো।" এ প্রশ্নের উত্তরে উমা বললেন, “আমি তো কোলকাতার হাসপাতালে শিশু বিভাগেই ডিউটি করি। কবি যদি শিশুর মতো হন, তবে নিশ্চয়ই পারবো।”

তারপর থেকে কবির সব দায়দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিলেন উমা। তাকে গোসল করানো, খাওয়ানো, দেখভাল করা সবকিছু পরম যত্নে করতেন তিনি। কবি তখন এতোটাই শিশুর মতো হয়ে গিয়েছিলেন যে তাকে গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে খাইয়ে দিতে হতো। সেবা ও স্নেহের দ্বারা অল্পদিনেই কবির কাছে প্রিয় মানুষ হয়ে উঠলেন উমা।
এরইমধ্যে উমার এমন মিষ্টি ব্যবহার দেখে এবং তার দায়িত্বশীল মনোভাব দেখে তার প্রেমে পড়ে গেলো কবিপুত্র সব্যসাচী কাজী। উমার কাছে নিজের ভালোবাসার আহ্বান জানানোর পর উমাও 'না' করতে পারেন নি। দু'জনের ভেতর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠলো। বিয়েও করে ফেললেন তারা। বিয়ের পর উমা মুখার্জি হয়ে উঠলেন উমা কাজী। পুত্রবধুকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন প্রমীলা।

এতদিন তার দায়িত্বে ছিলো শুধু এক কবি, এখন থেকে পুরো পরিবারের দায়িত্বই তার ওপর চলে গেলো। নিজের নতুন সংসার, কবির যত্ন, অসুস্থ প্রমীলার দেখাশোনা থেকে শুরু করে পুরো সংসারের সবকিছুই নিজের হাতে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সামলাতে শুরু করলেন উমা।
১৯৬২ সালে মাত্র ৫২ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন প্রমীলা কাজী। পুরো সংসারে নেমে এলো শোকের ছায়া। এই সংসারের সবকিছু একা হাতে সামলে নেওয়া শুরু করলেন উমা কাজী।

সব্যসাচী-উমার ঘরে একে একে এলো তিন সন্তান। মিষ্টি কাজী, খিলখিল কাজী আর বাবুল কাজী। নাতি-নাতনির খেলার সাথী নজরুল। নজরুলও তো মনেপ্রাণে তখন শিশুর মতোই। নিজের সন্তানদের যেভাবে যত্ন করতেন উমা, তেমনি নজরুলকেও রাখতেন পরিপূর্ণ যত্নআত্তির ভেতর। কারণ উমা ছাড়া অন্যকেউ কবিকে সেভাবে বুঝতে পারতো না। পুত্রবধু হয়েও উমা যেন বাস্তবে হয়ে উঠলেন কবির মা। একদম মায়ের মত করেই তাকে আগলে রাখতেন। 
১৯৭২ সালে কবিকে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে নিয়ে আসা হলো। সব্যসাচী ব্যবসায়িক কাজে তখন বাংলাদেশে না আসতে পারলেও কবির সাথে নিজের ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসলেন পুত্রবধু উমা। এরপর তাদের ঠিকানা হলো ধানমন্ডি।

বৌমা চন্দন সাবান দিয়ে গোসল করিয়ে না দিলে গোসল করেন না নজরুল, দাড়ি কেটে দেয় বৌমা-ই, গল্প করে করে খাইয়ে দিতে হবে বৌমাকেই, অন্যকেউ হলে চলবে না। বৌমার কাছে শিশুর মতো আবদার-বায়না করতেন কবি।

১৯৭৬ সালে সবাইকে কাঁদিয়ে চিরবিদায় নিলেন দুই বাংলার জনপ্রিয় কবি নজরুল। উমা যেন তার শ্বশুরকে নয়, হারালেন তার সন্তানকে, নার্সের সেবা করতে এসে যেই সন্তানের দায়িত্ব তিনি বুঝে নিয়েছিলেন, আমৃত্য নিষ্ঠার সাথে সেই দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। 
উমা কাজী বাকী জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশেই। ২০২০ সালে ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ৮০ বছর বয়সী বৃদ্ধা উমা কাজী। 

রাজু

×