ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৬ জুলাই ২০২৫, ১ শ্রাবণ ১৪৩২

উপন্যাস: ফিরে আসা ছায়া, পর্ব ২

মো আইয়ুব মন্ডল

প্রকাশিত: ০৮:০৭, ১৬ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ০৮:১৭, ১৬ জুলাই ২০২৫

উপন্যাস: ফিরে আসা ছায়া, পর্ব ২

উপন্যাস: ফিরে আসা ছায়া

ঢাকার সন্ধ্যা যেন রহস্যে মোড়ানো কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ে গেছে। রায়হান হাঁটছে ধীরে ধীরে, হাতে ধরা সেই পুরনো ডায়েরি “রহস্য ১৯৮৯”।
চা দোকান থেকে বাসায় ফিরলেও, তার মাথা যেন রয়ে গেছে সেই লাল চাদর পরা নারীর চোখের গভীরতায়।

সে জানে, ডায়েরি খুললেই জীবনের ছক বদলে যাবে।
কিন্তু না খুলে আর থাকা যাচ্ছে না।

বুকের মধ্যে একটা তীব্র কৌতূহল, আর ভয়...
একসঙ্গে ঠেলে তুলছে আবেগের ঢেউ।

রাত তখন সাড়ে এগারোটা। চারপাশ নিস্তব্ধ। ঘরের জানালা খুলে দিয়েছে সে। শহরের বাতাসে এক ধরনের ভারি ঘ্রাণ, যেন কোনো পুরনো কাগজের শরীরে লেগে থাকা সময়ের গন্ধ।

রায়হান ডায়েরির প্রথম পৃষ্ঠা খুলল।
কালচে পাতায় সাদা কালি দিয়ে লেখা

“এই শহর ভুলে গেছে, আমি কী দেখেছি।
কিন্তু আমি ভুলিনি।
১৯৮৯ সালের ১৪ই অক্টোবর রাত ১২টা ৪৫ মিনিট।”

তার নিচে লেখা একটা নাম
"তাসনিম হোসেন"

রায়হান চমকে উঠল। তাসনিম হোসেন... এ নাম সে কোথায় যেন শুনেছে। সাংবাদিক জীবনে বহু কেসে নাম ঘেঁটেছে, বহু ঘটনার খোঁজে গেছে। কিন্তু এই নাম তার স্মৃতির এক কোণায় দাগ কেটে রেখেছিল।

সে দ্রুত পাতা উল্টাতে লাগল।

১৯৮৯, পুরান ঢাকা
এক তরুণী, বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী, রাতে হোস্টেল থেকে বেরিয়ে আর ফেরেনি।
পুলিশের রিপোর্ট বলেছিল, সে আত্মহত্যা করেছে।
কিন্তু পরিবারের দাবি ছিল তাসনিম কোনো দিন আত্মহত্যা করতে পারত না।

ডায়েরির পাতায় পাতায় সে মেয়েটির লেখা,
সে বলছে,
“আমি কিছু দেখেছি, যেটা দেখা উচিত হয়নি।
সেই রাতে পুরনো গলির এক বাড়িতে আলো জ্বলছিল...
আমি সেখানে গিয়েছিলাম, আর আমি তখন বুঝি, কিছু মানুষ অন্ধকারে লুকিয়ে শয়তানের খেলা খেলছে।”

রায়হানের শিরদাঁড়া দিয়ে হিমস্রোত বয়ে গেল।
সে এক পৃষ্ঠা, দুই পৃষ্ঠা... একের পর এক পড়তে লাগল।
প্রতিটি পাতায় ভয়াবহ বিবরণ, অদ্ভুত চিত্র, এক ধরনের মানসিক ধ্বংস, এবং বারবার একই নাম উঠে আসছে—

“ডেভিল হাউজ”
“দেয়ালে লাল রঙে আঁকা চিহ্ন”
“কেউ আছে যে সব দেখছে, কিন্তু কিছুই বলে না”
“আর আমি, আমি বেঁচে আছি কারণ এখনো সময় আসেনি”

রায়হান এক পৃষ্ঠা পড়ার পর হঠাৎ থেমে গেল।
একটি পাতায় বড় করে লেখা 

"সায়রা"

তার নিচে তাসনিম লিখেছে 
“তাঁকে আমি ভালোবাসতাম।
কিন্তু সে ভালোবাসে যে ছেলেটিকে,
সে জানে না ছেলেটা একদিন এই শহরকে বাঁচাবে...
আর নিজেকে হারাবে।”

রায়হান কিছুক্ষণের জন্য স্থির হয়ে গেল।
এই লেখাগুলো কার? কাকে ইঙ্গিত করা হচ্ছে?

সে নিজেকে প্রশ্ন করল 
সায়রা কি সেই মেয়েটি?
আর সে? সে-ই কি সেই ছেলেটি যার জন্য এই সব ঘটছে?

ডায়েরির একেবারে শেষ পাতায় কিছু নেই, শুধু একটা শব্দ লেখা 

“শুরু”

রায়হান ডায়েরি বন্ধ করল।
তার মনে হচ্ছে, সব কিছু একটা ছকের মতো সাজানো হচ্ছে।
কেউ যেন তাকে একটা পথ দেখাচ্ছে।

তবে প্রশ্ন হচ্ছে কে?

রাতে ঘুম এল না।
সে শুধু একটা কাজ করল 

পুরনো কাগজপত্র ঘেঁটে ১৯৮৯ সালের সেই তাসনিম হোসেন কেস খুঁজতে বসল।
তার চোখ আটকে গেল এক পুরনো সংবাদের হেডলাইনে 

“তাসনিম হোসেন নিখোঁজ, পুলিশের দাবি আত্মহত্যা।
কিন্তু ময়নাতদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ নেই কোনো আত্মহত্যার প্রমাণ।”

নিচে আরেকটি লাইন:
“তাসনিম হোসেনের ঘরে পাওয়া গেছে একটি লাল চাদর ও অদ্ভুত চিহ্ন আঁকা নোটবুক।”

রায়হান আরেকবার চমকে উঠল।
সায়রার চাদরও লাল।
তার হাতে দেওয়া ডায়েরির মলাটেও ছিল অদ্ভুত চিহ্ন।

এই ঘটনার সাথে কি সায়রার সম্পর্ক ছিল?
সে কি তাসনিমের বন্ধু? না কি...

হঠাৎ করেই রায়হানের ঘরের দরজায় টোকা পড়ল।
রাত তখন ১টা ১৭।

সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল দরজার দিকে।
ঝুঁকে দেখে দরজার নিচ দিয়ে আরেকটি খাম ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
খামের ওপর লেখা:

"ডেভিল হাউজ, ১৪ নম্বর গলি, কাল রাত ২টা।
এটাই তোমার শুরু।"

রায়হান জানে, তার আর পিছু হটার উপায় নেই।

তাসমিম

×