
ছবি: লেখকের সৌজন্যে
ঢাকার পুরোনো এক আবাসিক এলাকা নিরিবিলি, কিছুটা ধূসর, কিছুটা ঘোলাটে রঙের ভবন আর দীর্ঘ পুরোনো গলিগুলোয় যেন এক অন্যরকম নিস্তব্ধতা জমে থাকে। সকাল বেলা হলেও চারপাশে একটা ঘুমঘুম ভাব। এই সময়েই ডাকপিয়ন এসে রেখে গেল একটা খাম। সাদামাটা খাম, ঠিকানার জায়গায় কেবল লেখা "রায়হান আহমেদ"।
রায়হান তখনো ঘুম থেকে উঠেনি। রাত জেগে রিপোর্ট লিখেছে, দেশি এক মাফিয়া চক্র নিয়ে বড় রিপোর্ট বেরোচ্ছে তার কাগজে, নাম প্রকাশ করা যাবে না এমন সূত্রে পাওয়া সব তথ্য। তার ঘুম তাই সকাল পর্যন্ত গড়ায়। আজও অন্যদিনের মতোই ভাবছিল দিনটা কাটবে।
কিন্তু খামটা হাতে নিতেই তার বুকের মধ্যে হালকা একটা কাঁপুনি জেগে উঠল।
লাল কালির হাতে লেখা তার নাম। খামের ভাঁজে এক বিন্দু শুকানো রক্ত।
খামটা খোলার আগেই কেমন একটা শীতলতা তার সারা শরীরে ছড়িয়ে গেল। কে পাঠাতে পারে এমন চিঠি? এখনকার যুগে কেউ আর চিঠি লেখে না, বিশেষ করে এমন হাতে লেখা অদ্ভুত খাম!
চোখের পাতা ভার হয়ে এলো, কিন্তু কৌতূহল তাকে বসতে দিল না। সে ধীরে ধীরে খাম খুলল। ভিতরে একটিমাত্র কাগজ। কাগজে লেখা মাত্র এক লাইন:
"যে শহর তোমায় দিয়েছে সব, সেই শহরই কেড়ে নেবে সব কিছু। ১৯৮৯ সালের স্মৃতি খুঁড়লে তুমি আর ফিরে পাবে না নিজেকে।"
তার পরেই আরেকটি শব্দ, বড় বড় করে লেখা "সায়রা"
রায়হান দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ। চোখ স্থির, বুক ধুকধুক করছে। সায়রা? এই নাম তার জীবনের এক নিষিদ্ধ অধ্যায়। চার বছর আগে হারিয়ে যাওয়া এক নারীর নাম, যার সঙ্গে তার জীবনের সবচেয়ে আবেগী, সবচেয়ে বেদনাময় মুহূর্ত জড়িয়ে আছে।
কিন্তু তার সঙ্গে তো শেষবার দেখা হয়েছিল এক ভয়াবহ রাতে, তারপর থেকে আর কোনো খোঁজ নেই।
এই চিঠিটা তাহলে পাঠাল কে?
তার মাথার ভেতর একাধিক প্রশ্ন দানা বাঁধতে শুরু করল। আর তখনই তার ফোন বেজে উঠল।
অপরিচিত নাম্বার।
কল রিসিভ করতেই একটা নারীকণ্ঠ, নরম অথচ স্পষ্ট, বলল
"তুমি যদি সত্য জানতে চাও, আজ রাত ৮টায় পুরাতন শহরের গলিপথের সেই চা দোকানে এসো... যেখানে তুমি একদিন বলেছিলে, তুমি আমায় ভুলবে না।"
এর পরই ফোন কেটে গেল।
রায়হান জানে, এই কণ্ঠ তার অচেনা নয়। কিন্তু একে চেনার ভয়, আর না চেনার অভিশাপ দুটোই এখন তাকে তাড়া করছে।
সন্ধ্যা নামতেই শহরের চেনা রাস্তাগুলো যেন অচেনা হয়ে গেল। গলিপথের বাতিগুলো কেমন ম্লান আলো ছড়ায়। রায়হান কিছুটা দুশ্চিন্তা, কিছুটা রহস্য, আর কিছুটা ভয় নিয়ে এগিয়ে চলেছে সেই চা দোকানের দিকে।
চা দোকানটা এখন প্রায় বন্ধ। ভিতরে হালকা হলুদ আলো, আর জানালার পাশে বসে থাকা একজন নারী লাল চাদরে মুখ ঢাকা, এক হাতে চায়ের কাপ।
রায়হান ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। নারীর মুখটা স্পষ্ট দেখার আগেই সে বলল-
"তুমি তো বলেছিলে, তুমি আমায় ভুলবে না... ভুলেছিলে?"
তার গলা কেঁপে উঠল। এই কণ্ঠ...
সায়রা।
কিন্তু সে তো...
চার বছর আগেই নিখোঁজ।
সে কীভাবে এখানে?
সে কীভাবে বেঁচে আছে?
আর সে কেন বলছে এই শহর রায়হানের সব কেড়ে নেবে?
রায়হান চুপচাপ তাকিয়ে রইল তার চোখে। সায়রার চোখে যেন দীর্ঘশ্বাস লুকানো, কিন্তু সেই গভীরতায় আছে এক প্রচণ্ড শীতলতা।
সায়রা ধীরে ধীরে বলল,
"যা দেখতে এসেছো, তা এখনই দেখাবে না শহর। কিন্তু যদি শুরু করো, শেষ দেখার আগেই শেষ হয়ে যেতে পারো তুমি..."
রায়হান কিছু বলার আগেই সায়রা উঠে দাঁড়াল। তার হাতে এক পুরনো ডায়েরি।
তিনি বললেন,
"এটা তোমার... যদি সাহস থাকে, খুলে দেখো।"
ডায়েরির মলাটে লেখা: "রহস্য ১৯৮৯"
তারপর সে চলেও গেল, নিঃশব্দে।
রায়হান একা দাঁড়িয়ে রইল সেই পুরনো দোকানের ধারে, ডায়েরি হাতে।
তার সামনে এখন একটা প্রশ্ন-
এই ডায়েরির পেছনে কী এমন আছে, যা ১৯৮৯ সালকে আজও ভয়াবহ করে রেখেছে?
আর সায়রার ফিরে আসার মানে কী? সে কি সত্যিই ফিরে এসেছে, নাকি এও কোনো ছায়া?
চলবে...
সাব্বির