
জুলাইয়ে আমরা দেখেছি, কীভাবে ছেলে-মেয়েদের রক্তে রাজপথ লাল হয়েছে। জুলাই জাগরণের প্রাণভোমরা ছিল আমাদের মেয়েরা। তারা কেবল আন্দোলনে গলা মেলায়নি, তারা স্লোগান দিয়েছে, নেতৃত্ব দিয়েছে। নারীকে আলাদা করে সম্মাননা দেওয়ার কিছু নেই। তার যা আছে, তাই তাকে দেওয়া হোক। নারীরা যে কাজ করেছে, যে সম্মান অর্জন করেছে, মনে হয় না আর কোনো সম্মাননার প্রয়োজন আছে।
আজ সোমবার (১৪ জুলাই) সকাল ১১টায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) সিনেট ভবনে ‘জুলাই নারী দিবস’ উপলক্ষে আয়োজিত সভায় বক্তারা এসব বলেন।
এসময় অধ্যাপক রায়হানা শামস ইসলাম বলেন, “জুলাইয়ে আমরা যা দেখেছি, তা জীবনে একবারই দেখা সম্ভব। আমরা দেখেছি কীভাবে আমাদের ছেলে-মেয়েদের রক্তে রাজপথ লাল হয়েছে। এই যে জুলাই জাগরণ, এর প্রাণভোমরা ছিল আমাদের মেয়েরা। তারা কেবল আন্দোলনে গলা মেলায়নি, তারা স্লোগান দিয়েছে, নেতৃত্ব দিয়েছে। তাদের ভূমিকায় আমরা দেখেছি নিরাপত্তার জন্য ভাইকে কীভাবে আশ্রয় দিয়েছে। বোন যেভাবে ভাইকে রক্ষা করে, ঠিক তেমনি তারা নিরাপত্তা দিয়েছে এবং রক্ষা করেছে। এই আন্দোলনে মেয়েদের ভূমিকা তাই অনস্বীকার্য। আমি তোমাদের অভিনন্দন জানাই, কারণ তোমরাই নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করেছ।”
জুলাইয়ে নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমি জুলাইয়ের সেই দিনগুলো দেখেছি, তোমাদের (ছাত্রীদের) অবদান আমি ভুলব না। ১৪ জুলাই রাতে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর একটি অদ্ভুত মন্তব্যকে কেন্দ্র করে তোমরা যেভাবে তালা ভেঙে বেরিয়ে এসেছিলে, তা এই আন্দোলনকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিল। আমার কাছে এই আন্দোলনের টার্নিং পয়েন্ট ছিল ১৫ জুলাই, যেদিন আমি দেখলাম আমাদের মেয়েরা মার খেয়েছে। সেই দৃশ্য আমাকে মানসিকভাবে এই আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে ফেলে।”
তিনি আরও বলেন, “নারীদের সম্মানে জুলাই নারী দিবস পালন করা হচ্ছে। কিন্তু আমি বলব, এর মাধ্যমে নারীদের সম্মানিত করা হয়নি, বরং তাদের অবদানের স্বীকৃতি দেওয়া হলো। কারণ নারীরা তাদের কাজের জন্য আগে থেকেই সম্মানিত। এই জুলাই জাগরণ ছিল একটি নাগরিক প্রতিরোধ, যেখানে আমাদের মেয়েরা ছেলেদের পাশে থেকে নিজেদের নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। আমরা হয়তো ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমরা নাগরিক, কিন্তু জুলাই মাস আমাদের সেই আত্মপরিচয় মনে করিয়ে দিয়েছে।”
আরেক আলোচক অধ্যাপক ফৌজিয়া এদিব ফ্লোরা বলেন, “নারীকে আলাদা করে সম্মাননা দেওয়ার কিছু নেই। তার যা আছে, তাই তাকে দেওয়া হোক। নারীরা যে কাজ করেছে, যে সম্মান অর্জন করেছে, আমার মনে হয় না আর কোনো সম্মাননার প্রয়োজন আছে।”
অধ্যাপক ইফতিখারুল আলম মাসউদ বলেন, “জুলাইয়ে নারীরা শুধুমাত্র অবদান রাখেনি, তারা প্রেরণা হয়ে অবতীর্ণ হয়েছিল। জুলাইয়ে যেভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছে, সুতরাং নারী এবং পুরুষকে প্রতিপক্ষ হিসেবে তুলে ধরার কোনো কারণ নেই। প্রতিটা ক্ষেত্রে পরস্পরের সহযোগী হিসেবে পাশে থাকতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব বলেন, “জুলাই-আগস্টে আমরা কোনো অসাধারণ মানুষকে দেখিনি, দেখেছি সাধারণ মানুষের অসাধারণ ভূমিকা—কীভাবে তারা অবদান রেখেছে। তাই সাধারণের অসাধারণ ভূমিকাকে স্মরণীয় করে রাখতে হবে। একটা কথা বলতে চাই, জুলাই চেতনায় কোনো ‘আমি’ নেই, আছে ‘আমরা’। ‘আমি আমি’ বিষয়টি জুলাই চেতনাকে নষ্ট করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।”
নারীদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “নারীদের নিয়ে আমি আলাদা কিছু বলতে চাই না। তাদের অবদান একটু কম না, আবার একটু বেশিও না—সমানে সমান। মায়া এবং আগুন—দুটি বিষয়, এটি মেয়েরা ভালোভাবে মিলন ঘটাতে পারে, যেটি ছেলেরা পারে না। নারীরা যে আগুন ও মায়া নিয়ে তারা জুলাই-আগস্ট সামলেছে, তা অসাধারণ।”
আলোচনা সভায় অন্যদের মধ্যে আরও বক্তব্য রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্যদ্বয় অধ্যাপক মোহাম্মদ মাঈন উদ্দীন খান ও অধ্যাপক মো. ফরিদ উদ্দিন খান, লোক প্রশাসন বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মোসা. মর্জিনা বেগম এবং আইন বিভাগের শিক্ষার্থী সানজিদা ঢালি। আলোচনা সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের শিক্ষক-কর্মকর্তাসহ দুই শতাধিক শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন। এর আগে দিবসটি উপলক্ষে সকাল ১০টার দিকে একটি শোভাযাত্রা বের করা হয়। শোভাযাত্রাটি ক্যাম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো প্রদক্ষিণ করে।
আলোচনা সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মাঈন উদ্দীনের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব, বিশেষ অতিথি উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মো. ফরিদ উদ্দিন খান, কোষাধ্যক্ষ মো. মতিয়ার রহমান, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ইফতিখারুল আলম মাসউদ উপস্থিত ছিলেন। ছাত্র উপদেষ্টা অধ্যাপক আমিরুল ইসলাম সভাটি সঞ্চালনা করেন।
সানজানা