ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৫ জুলাই ২০২৫, ৩০ আষাঢ় ১৪৩২

জীর্ণ ঘরে ভারসাম্যহীন আব্দুর রহমানের মানবেতর জীবন

মোঃ তানভীর হাসান, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, মঠবাড়িয়া পিরোজপুর 

প্রকাশিত: ১৮:৩০, ১৪ জুলাই ২০২৫

জীর্ণ ঘরে ভারসাম্যহীন আব্দুর রহমানের মানবেতর জীবন

ছবি: দৈনিক জনকণ্ঠ।

টিনের চাল ফুটো হয়ে বৃষ্টি পড়ে ঘরে, ছেঁড়া চাদরে জড়ানো একাকী এক মানুষ বিছানায় শুয়ে থাকে। মেঝেতে ছড়িয়ে থাকে ময়লা আর স্মৃতির ধুলো। কেউ কেউ খাবার দিয়ে যায়, কেউ করুণার চোখে তাকায়। কিন্তু কেউ কি সত্যিই দেখে তাকে এই মানুষটিকে, যিনি এক সময় স্বপ্ন দেখতেন, সংসার চালাতেন?

এই মানুষটির নাম আব্দুর রহমান। বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে। পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার ধানিসাফা ইউনিয়নের আমুরবুনিয়া গ্রামে বাস করেন। তবে ‘বাস’ বললেই ভুল হবে তার বাসস্থান যেন মৃত্যুর প্রহর গোনে এক জরাজীর্ণ কুঁড়ে ঘর, যা যেকোনো সময় ধসে পড়তে পারে।

প্রায় একযুগ আগে জীবন চালাতে একযুগ স্বরূপকাঠিতে ডাব বিক্রি করতে যান আব্দুর রহমান। ফেরার পথে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। ডাকাতরা তার সব কষ্টের উপার্জন কেড়ে নেয়। সেই রাতেই যেন সবকিছু বদলে যায়। টাকার ক্ষতির চেয়ে বড় ক্ষতি হয় মনের ভিতরে আব্দুর রহমান ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলেন মানসিক ভারসাম্য।
সংসার ছিল, স্ত্রী ও সন্তানও ছিল। কিন্তু আজ তারা নেই তার পাশে। পরিবার তাকে ছেড়ে চলে গেছে সমাজের মতনই। এখন কেবল ঘর, খালি পেট, ভাঙা মনের আর্তনাদ, আর একান্ত একাকিত্ব।

তার সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে দেখা গেল একটি ছোট ঘর, যার চারপাশ ভাঙা কাঠ আর বাঁশে ঠেকানো। ছাদে ফুটো টিন, বৃষ্টি হলেই ভিতরটা ভিজে যায়। একটি ময়লা বিছানা, তার পাশেই রান্নার পাত্র, ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আবর্জনা। এই পরিবেশেই বসবাস করছেন আব্দুর রহমান। খাবার? কারও করুণা থাকলে দু-মুঠো জোটে। না থাকলে অভুক্ত থাকাই নিয়তি। নোংরা মাটির বিছানায় তার রাত কেটে যায় ঘুমহীন, পেট খালি আর মন বিষাদে ভার।

প্রতিবেশী তরুণ তারিফ আহমেদ বলেন, “উনি আসলে বেঁচে আছেন কি না, সেটাই মাঝে মাঝে মনে হয় না। নিজে থেকে কিছু বলতে পারেন না। আমরা মাঝে মাঝে খাবার দেই। সরকার যদি একটু সাহায্য করত, তাহলে অন্তত তার একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই হতো।” তারিফের চোখে জল, গলায় কষ্ট তবুও তিনি চেষ্টা করছেন সাহস দিতে। এই সমাজে কিছু হৃদয়বান মানুষ এখনো আছেন, যারা আব্দুর রহমানকে ভুলে যাননি।

মঠবাড়িয়া উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. শফিকুল আলম বলেন, ‘আমরা জানি তার অবস্থা খুবই করুণ। শুনেছি তার জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। আমরা খোঁজ নিয়ে যতটা সম্ভব সাহায্য করবো।”

কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায় জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকলেই কি একজন মানুষ সব অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে? মানবিকতার কি কোনো প্রমাণপত্র লাগে?
আব্দুর রহমান: এক জীবন্ত প্রশ্নচিহ্ন।

আব্দুর রহমান শুধু একজন ব্যক্তি নন—তিনি আমাদের সমাজের আয়নায় স্পষ্ট হয়ে ওঠা সেই অবহেলিত চেহারা, যে প্রশ্ন করে 'মানসিক রোগী হলে কি আমি মানুষ নই? আমার কি থাকার অধিকার নেই?

তার এই নিঃশব্দ চিৎকার আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায় না কেন? সমাজ, রাষ্ট্র, প্রশাসন প্রশ্ন সবার কাছে।

মিরাজ খান

×