ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৫ জুলাই ২০২৫, ৩০ আষাঢ় ১৪৩২

জুলাইয়ের দিনগুলো: ১৫ জুলাই

মুহাম্মদ ওমর ফারুক

প্রকাশিত: ০০:০০, ১৫ জুলাই ২০২৫

জুলাইয়ের দিনগুলো: ১৫ জুলাই

ছবি: সংগৃহীত

গত কয়েকদিন ধরেই আওয়ামী সরকারের মন্ত্রী, পুলিশ ও ছাত্রলীগের আগ্রাসী ভাষা ও আচরণে এমন শঙ্কা তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু এত দ্রুত পরিস্থিতির এই অবনতি—তা কল্পনারও বাইরে ছিল।

১৪ জুলাই রাতেই ‘তুমি কে, আমি কে—রাজাকার রাজাকার’, ‘চাইতে গেলাম অধিকার—হয়ে গেলাম রাজাকার’, ‘কে বলেছে কে বলেছে—স্বৈরাচার’—এসব স্লোগান তুলে ধরে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এর রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টার আভাস পাওয়া যায়।

পরদিন ১৫ জুলাই, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ করে বলেন, “নিজেদের রাজাকার বলতে তাদের লজ্জা লাগে না?” 

তাঁর এই বক্তব্যের পর থেকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দলীয় স্বত্বাধিকারের সেই পুরনো রাজনীতি ফের সামনে আসে। শ্লোগানের নির্যাস ছেঁটে এনে আওয়ামী লীগ ও তার অনুসারীরা এর বিরুদ্ধেই নেমে পড়েন।

ছাত্রলীগের সহিংসতা আরও প্রবল হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যে। তিনি বলেন, “‘রাজাকার’ স্লোগানের জবাব ছাত্রলীগই দেবে।” মূলত এই বক্তব্যের মধ্য দিয়েই তিনি ছাত্রলীগকে মাঠে নামার অঘোষিত অনুমতি দেন।

এর কিছুক্ষণের মধ্যেই কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ঘোষণা দেন—“আমি রাজাকার” স্লোগান দেওয়া শিক্ষার্থীদের শেষ দেখে ছাড়বেন।

এরপরই ঘটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের এক ভয়াবহতম ঘটনা—নিজের সহপাঠীদের ওপর নৃশংস হামলা চালায় ছাত্রলীগ এবং তাদের সঙ্গে থাকা বহিরাগতরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বুয়েট ও ইডেন কলেজ ক্যাম্পাস পর্যন্ত। দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত চলা এই হামলায় আহত হন ২০০ জনের বেশি।

ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার সময় ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা রড, হকিস্টিক, স্টাম্প দিয়ে শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালায়। মধুর ক্যানটিন থেকে একদল ছাত্রলীগ সদস্য লাঠিসোটা নিয়ে বেরিয়ে আসে এবং ভিসি চত্বরে অবস্থানরত আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের তিন দিক থেকে আক্রমণ করে। শিক্ষার্থীরা বাধ্য হয়ে ফুলার রোড, শহীদ মিনার, কার্জন হল ও পলাশীর দিক দিয়ে পালিয়ে যান।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দোতলা বাসে আত্মরক্ষার্থে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ৫০-৬০ জন ছাত্রীকেও নামিয়ে এনে বেধড়ক মারধর করে ছাত্রলীগ। ছাত্রীদের অনেকে জুতা, ব্যাগ, ছাতা ফেলে পালিয়ে যান। চারজন ছাত্রী ও দুইজন ছাত্রের মাথা ফেটে যায়, অনেকে গুরুতর আহত হন।

ফুলার রোডেও আন্দোলনরত ছাত্রীদের উপর হামলা চালানো হয়। পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, রাস্তায় ছোপ ছোপ রক্ত, ছড়ানো জুতা, ইট ও লাঠি পড়ে থাকতে দেখা যায়। অনেকে রাস্তায় পড়ে কাতরাতে থাকেন। ছাত্রলীগের পাশাপাশি হামলায় যোগ দেয় অস্ত্রধারী বহিরাগতরাও।

এই হামলায় নেতৃত্ব দিতে দেখা যায় ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি রবিউল হাসান রানা, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবু ইউনুস, সাংগঠনিক সম্পাদক হারুন রশিদ ও বঙ্গবন্ধু হল ছাত্রলীগ সভাপতি মেহেদী হাসান শান্তকে। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত অস্ত্রধারীদের নিয়ে মলচত্বরের দিকে যান।

মুল মিছিলটি সেখানে গেলে মধুর ক্যানটিনে আগে থেকেই দেশীয় অস্ত্রসহ প্রস্তুত থাকা দক্ষিণ মহানগর ছাত্রলীগ সভাপতি রাজিবুল ইসলাম বাপ্পির নেতৃত্বে হেলমেট পরা নেতাকর্মীরা আক্রমণ করে। সূর্যসেন হল, প্রশাসনিক ভবন, ভিসি চত্বর থেকেও বহিরাগতরা এসে হামলা চালায়।

ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান ও রাজিবুল ইসলাম বাপ্পির নেতৃত্বে ক্যাম্পাসজুড়ে মহড়া দিতে থাকে ছাত্রলীগ ও তাদের সঙ্গে থাকা বহিরাগতরা। তানভীর হাসান সৈকতও তার দলবল নিয়ে একইভাবে মাঠে থাকেন। বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত তাঁরা রাজু ভাস্কর্যে অবস্থান নেন।

এছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা শিক্ষার্থীদেরও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা একাধিকবার মারধর করে।

চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা হয়। খুলনা, বরিশাল, সিলেটেও শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন।

এই হামলার প্রতিবাদে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম রাতে পরের দিন (১৬ জুলাই) বিকেল ৩টায় দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা দেন। তিনি জানান, ঢাবি এলাকায় ২০০ জনের বেশি আহত হয়েছেন, যাঁদের মধ্যে ১৭-১৮ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

নাহিদ ইসলাম বলেন—“সরকার পরিকল্পিতভাবে বহিরাগত এনে আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য আমরা তীব্রভাবে নিন্দা জানাই।”

ছাত্রলীগও একই সময়ে, অর্থাৎ দুপুর দেড়টায় ক্যাম্পাসজুড়ে পাল্টা বিক্ষোভের ঘোষণা দেয়।

এদিকে, হামলার ঘটনার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন বলেন, “আমাদের নেতাকর্মীদের উস্কে দেওয়া হয়েছে। আমরা দাঁতভাঙা জবাব দিয়েছি। পাঁচ মিনিটে তাদের ক্যাম্পাস থেকে বের করে দিয়েছি।”

দিনভর সংঘর্ষের মধ্যে বিকেল ৫টায় জরুরি বৈঠকে বসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সন্ধ্যায় এক বিজ্ঞপ্তিতে শান্তিপূর্ণ শিক্ষার পরিবেশ বজায় রাখতে পাঁচটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বলা হয়—নাশকতামূলক কাজে কেউ জড়িত হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শিক্ষার্থীদের হলে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়, প্রাধ্যক্ষ ও আবাসিক শিক্ষকরা সার্বক্ষণিক হলে উপস্থিত থাকবেন, এবং হলে কোনো বহিরাগত থাকতে পারবেন না।

তবে হামলাকারীরা চিহ্নিত থাকলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

১৫ জুলাই আন্দোলনে সরাসরি যোগ দেয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও, আন্দোলনে আসে নতুন মাত্রা। তারা রাজধানীর বাড্ডা, বসুন্ধরা, নতুনবাজার, পূর্বাচল ও ভাটারা এলাকায় সড়ক অবরোধ করে।

এইদিন ঢাকার বাইরে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও বিক্ষোভ দেখা যায়। সন্ধ্যায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বিএল কলেজের শিক্ষার্থীরা একত্রিত হয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল বের করেন এবং নগরীর জিরো পয়েন্ট মোড়ে মহাসড়ক অবরোধ করেন।

দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন।

এভাবেই শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের এবং ছাত্রলীগের নির্মম অবস্থান শান্তিপূর্ণ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে সহিংসতার দিকে ঠেলে দেয়।

ফারুক

×