‘এটা একটা সীমান্তিক জেলা। একটা মানুষ অসুস্থ হলে ভালো একটা চিকিৎসা পাবে তার কোনো ব্যবস্থা নেই। আজকে বহু জেলার মধ্যে একটি জেলায় কৃষি ইউনিভার্সিটি, একটি জেলায় মেডিক্যাল কলেজ, একটি জেলায় ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি, একটি জেলায় সবকিছু আছে আরেক জেলায় কিছুই নেই। এটা কোন ধরনের ইনসাফ! আওয়ামী লীগ ১৮ কোটি মানুষের ওপর জুলুম করেছে। মানুষ খুন করে তারা ক্ষমতায় টিকে থাকতে চেয়েছিল। ফ্যাসিস্টরা যেন পুনরায় ফিরে না আসে এবং আমরা যেন তাদের আশ্রয়-প্রশয় না দেই। আমরা বাংলাদেশে যত অন্যায়ভাবে যত মানুষকে খুন করা হয়েছে তার প্রত্যেকটির বিচার চাই। এক বছর আগেও মুক্তিপাগল বাংলাদেশী জনগণ চিন্তা করতেও পারে নাই; সব নেতাদের জেলে ভরা হয়েছিল। নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে। সেই লাশের ওপর পৈশাচিক নৃত্য করেছিল। আল্লাহকে ভয় করেনি। তাদের কারণে ১/১১ সৃষ্টি হয়েছিল। আওয়ামী লীগ খুনি হতে পারে কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ খুনি নয় দেশপ্রেমিক।শুক্রবার কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ মাঠে জেলা জামায়াতের কর্মিসভায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আমিরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর তান্ডব চালিয়ে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় স্পষ্ট দিবালোকে পল্টন ক্রসিং-এ আল্লাহ তালার বান্দা ৬ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। নিথর দেহের ওপর দাঁড়িয়ে তারা পৈশাচিক নৃত্য করেছিল। ২০১০ সালের ২৯ জুন আমাদের প্রাণপ্রিয় তিন নেতা তৎকালীন আমির জামায়াত সাবেক মন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী, নায়েবে আমির যিনি সারা বিশে^র মানুষকে কোরানের মানবিক দাওয়াত দিয়ে বেড়াতেন যাকে কোরানের পাখি বলা হতো আল্লামা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী, তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এই তিনজনকে খোঁড়া অজুহাতে, মিথ্যা অভিযোগে নির্লজ্জভাবে গ্রেপ্তার করে। তার পরের মাসে আর দুজন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামরুজ্জামান এবং আব্দুল কাদের মোল্লাকে গ্রেপ্তার করে। তাদেরকে সাজা দেওয়ার জন্য শাহবাগে আন্দোলন ঘোষণা করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্মের মানুষকে কারা জুলুম অত্যাচার করেছে, কারা তাদের জমিগুলো দখল করেছে, ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করেছে, সম্পদ লুণ্ঠন করেছে, তাদের ইজ্জতে হাত দিয়েছে, এই দুষ্কৃতকারীদের তালিকা তৈরি করে জনগণের সামনে প্রকাশ করে দেওয়া হোক। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দুর্বৃত্তরা এসব অপকর্মে জড়িত ছিল।’
দলের নেতাকর্মীদের সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সাড়ে ১৫ বছরের দুঃখ-ব্যথা-বেদনা-কষ্ট আমরা বুকে বহন করে বেড়াচ্ছি। কিন্তু ৫ আগস্ট জাতি যখন মুক্তি পেল। তখন বাংলাদেশের জনগণ, বিশেষ করে আমাদের সহকর্মীদের আমরা বললাম, শান্ত থাকুন ধৈর্য ধরুন, শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে নিজ নিজ জায়গা থেকে সর্বোচ্চ অবদান রাখুন।’
এর আগে আওয়ামী লীগ বলেছিল, কোনোদিন যদি ক্ষমতা থেকে তাদেরকে বিদায় নিতে হয় তাহলে ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়ার দু’দিনের মাথায় ৫ লাখ নেতাকর্মীকে আমরা নাকি খুন করব। আমি জিজ্ঞেস করি তাদের নেতৃত্বের মিথ্যা আতংক ছড়ানো নাকি বাস্তবায়িত হয়েছে। ৫ লাখ মানুষ মারা গেছে! ৫ আগস্ট! ৭ আগস্ট! সারা আগস্ট মাসজুড়ে! এখন পর্যন্ত! তাই তারা খুনি হতে পারে কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ দেশকে মানুষকে ভালোবাসে। ’
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ২৬ লাখ কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে চুরি করে নিয়ে গেছে। যদি এটাই তাদের দেশ হতো তাহলে দেশের টাকা কেউ কি বিদেশে চুরি করে! পাচার করে। পাঠায়! না। এটা ছিল তাদের জমিদারি। এখান থেকে খাজনা আদায় করবে আর দেশের টাকা বিদেশে পাচার করবে।’
নির্যাতিত নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘১৫ বছর যারা, যাদের কর্মীরা জীবন দিয়েছেন, পঙ্গুত্ববরণ করেছেন, ঘরছাড়া বাড়িছাড়া হয়েছেন বিভিন্নভাবে কষ্টভোগ করেছেন অসংখ্য মামলায় দফায় দফায় জেলে গিয়েছেন রিমান্ডে নির্যাতিত হয়েছেন, তাদের কাছে হাত জোড় করে বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ করব এমন কোনো হঠকারী কাজ যেন আমরা না করি যার কারণে আমাদের জাতীয় কোনো সমস্যা হয়। আমরা যেন কেউ চুরি চামারি না করি। চাঁদাবাজি না করি, দখল বাণিজ্য না করি, ঘুষের ভাগ না বসাই, মামলা-বাণিজ্য না করি। এবং ফেসিজম ফিরে আসে এবং ফেসিস্টকে আমরা যেন কোনো ধরনের আশ্রয়-প্রশ্রয় না দেই।’
পিলখানায় বিডিআর হত্যাকান্ড সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘চর বড়াইবাড়িতে যে যুদ্ধটা আপনারা রাতের অন্ধকারে করে যে শিক্ষাটা দিয়েছিলেন, সেই শিক্ষার প্রতিশোধ নেওয়া হয়েছিল বিডিআরের পিলখানায়। সে তো আপনাদের গর্বিত ইতিহাস। এখনো চকচক করছে।’
৫ আগস্ট শহীদ আবু সাঈদের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরে ফেসিজমকে বিদায় করতে গিয়ে একটা মানুষ বাংলাদেশের ইতিহাসে নয় বিশ্বের ইতিহাসে তার স্থানটি তার নামটি লেখা হয়ে গেছে। এই সন্তানটিও বৃহত্তর রংপুরের। তার নাম কি? আবু সাঈদ। সে আমাদের এখন বিপ্লবের আইকন। প্রতীক। আমাদের নেতা। আমাদের সিপাহসালার। আমাদের বীর সেনাপতি। তার রাস্তা ধরে যারাই জীবন দিয়েছেন মহান রাব্বুল আলামিন তাদেরকে শহীদ হিসেবে কবুল করুন। যারা পঙ্গু হয়েছেন, তাদেরকে আমরা যাতে গর্বের সঙ্গে সম্মান করতে পারি, শ্রদ্ধার সঙ্গে বুকে ধারণ করতে পারি। শহীদ এবং পঙ্গু সকলের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।’
দলের কর্মী সমর্থকদের প্রতি ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা সমাজে অনাচার দেখলে প্রতিবাদ করবই। এটা আপনার বিরুদ্ধে হলেও আমি প্রতিবাদ করব। অনাচার যিনিই করবেন তার ব্যাপারে আমরা মুখ বন্ধ করে তাকব না। এই জন্যই আমরা রাজনীতি করি। আমরা ন্যায়ের পক্ষ নিব। অন্যায়ের প্রতিবাদ করব। যদি অন্যায়কে নীরবে হজম করি। তাহলে আমিও অন্যায়কারীর মদতদাতা হলাম। আমরা এই অপকর্মের দায় নিতে চাই না। এমনকি আমাদের দলের কেউ যদি কোনো জায়গায় এ সমস্ত অন্যায় অপরাধ করে আমরা বলব এদেরকে ধরে দিন। ছাড় দেবেন না। আমাদেরকেও খবর দেবেন প্রশাসনকেও খবর দেবেন। এদের ব্যাপারে আমাদের জিরো টলারেন্স।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই জানুয়ারি মাসের ২৪ তারিখ পর্যন্ত দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় আমাদের লোকেরা চাঁদাবাজি করে নাই। দখল বাণিজ্য করে নাই। মামলা-বাণিজ্য করে নাই। শত শত নিরীহ মানুষকে মামলায় ঢুকিয়ে তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে নাই। ঘুষের ভাগাভাগি করে নাই। আমরা জানি এটা হারাম। আল্লাহ তায়ালা এই হারামকে বর্জন করার আজীবন তৌফিক দান করুন।’
কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ^বিদ্যালয় ও জেলার পিছিয়ে পরা মানুষের দুর্দশা নিয়ে তিনি বলেন, ‘এখানে একটা কৃষি বিশ^বিদ্যালয় হয়েছে। ঘোষণা হয়েছে। তার কংকাল আছে গোস্তও নাই চামড়াও নাই। হাড্ডিসার। নিজস্ব কোনো ক্যাম্পাস নাই। ধুঁকে ধুঁকে আস্তে আস্তে চলছে। অথচ এগ্রোবেজড এই প্রতিষ্ঠানটি এই অঞ্চলের চেহারা বদলে দিতে পারে। এটা শিক্ষা গবেষণা কেন্দ্রে পরিগণিত হতে পারে। এটা একটা সীমান্তিক জেলা একটা মানুষ অসুস্থ হলে ভালো একটা চিকিৎসা পাবে তার কোনো ব্যবস্থা নাই। আজকে বহু জেলায় একটি জেলায় কৃষি ইউনিভার্সিটি, একটি জেলায় মেডিক্যাল কলেজ, একটি জেলায় ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি, একটি জেলায় সবকিছু আছে আরেক জেলায় কিছুই নাই। এটা কোন ধরনের ইনসাফ!’
ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ২১ বছর পর কুড়িগ্রামে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। শুক্রবার সকাল ৯টায় কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ মাঠে অনুষ্ঠিত কর্মী সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামের আমির ডা. শফিকুর রহমান। জেলা শাখার আমির ও কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরা সদস্য মাওলানা আব্দুল মতিন ফারুকীর সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন, কেন্দ্রীয় কার্য পরিষদের সদস্য অধ্যক্ষ মমতাজ উদ্দিন, অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বেলাল, জামায়াত ইসলামী বাংলাদেশের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল হালিম, কেন্দ্রীয় কর্ম পরিষদ সদস্য ব্যারিস্টার সালেহীন, অধ্যাপক আজিজুর রহমান স্বপন প্রমুখ। এছাড়া কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যবৃন্দ ছাড়াও জেলা ও উপজেলা কমিটির নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন।
সম্মেলন উপলক্ষে শুক্রবার সকাল থেকে জেলার ৯টি উপজেলা থেকে মিছিলসহকারে হাজার হাজার কর্মী-সমর্থকরা ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে সমাবেশস্থলে সমবেত হন। অনুষ্ঠানে প্রায় অর্ধলক্ষাধিক কর্মী সমর্থক প্রধান অতিথির বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শোনেন। শান্তিপূর্ণভাবে ৩ ঘণ্টাব্যাপী অনুষ্ঠানে সবার মধ্যে ছিল উৎসাহ আর উদ্দীপনা।