ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ জুলাই ২০২৫, ৩ শ্রাবণ ১৪৩২

উৎপাদন বন্ধের শঙ্কা

কয়লার মূল্য হ্রাসে আর্থিক সংকটে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি

জনকণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০১:৩৩, ১৯ জুলাই ২০২৫

কয়লার মূল্য হ্রাসে আর্থিক সংকটে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি

.

কয়লার দাম কমানোয় মারাত্মক অর্থ সংকটে পড়েছে দেশের একমাত্র কয়লাখনি বড়পুকুরিয়া কোল মাইন কোম্পানি। বড়পুকুরিয়া খনি কোম্পানির হিসাবে, বর্তমানে কয়লার উৎপাদন খরচ টনপ্রতি ১৪০ ডলার। এই কয়লা তারা ১৭৬ ডলারে বিক্রি করত। কিন্তু দাম কমিয়ে এখন খনির কয়লা বিক্রি হচ্ছে প্রতি টন ১০৪ ডলারে। এতে উৎপাদন মূল্য বিবেচনায় প্রতি টনে কোম্পানি লোকসান দিচ্ছে ৩৬ ডলার।   
চলতি অর্থবছরে উৎপাদন খরচ আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় বড়পুকুরিয়া কয়লার একমাত্র ক্রেতা পিডিবির কাছ থেকে টনপ্রতি উৎপাদন খরচের চেয়ে কম মূল্য পাওয়ায় কোম্পানিটি লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে উৎপাদন বন্ধের ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আর উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলে খনিমুখে স্থাপিত ৫২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। কয়লার মূল্য নিয়ে জ্বালানি ও বিদ্য্ৎু বিভাগের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে রশি টানাটানি চলছে। বিদ্যুৎ বিভাগ সচিব বড়পুকুরিয়া পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ার পর দুই বিভাগের রশি টানাটানিতে স্বার্থরক্ষার পাল্লা পিডিবির দিকে ভারি হচ্ছে। 
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের তৃতীয় ইউনিট চালুর পর সরকারি সিদ্ধান্তে এই খনির পুরো কয়লার ক্রেতাই এখন পিডিবি। 
জ্বালানি মন্ত্রণালয় ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে উৎপাদিত কয়লার দাম টনপ্রতি ১৩০ ডলার থেকে বাড়িয়ে ১৭৬ মার্কিন ডলার নির্ধারণ করে। এ সময় পিডিবি ১৩০ ডলার করেই দাম পরিশোধ করে আসছিল। কিন্তু টনপ্রতি ৪৬ ডলার মূল্যবৃদ্ধি এক বছর পূর্ব থেকে কার্যকর করায় পিডিবির কাছে বড় পুকুরিয়া কোম্পানির বকেয়া দাবি দাঁড়ায় দুইশ’ ৮৭ কোটি টাকা। বকেয়ার ওপর ৪০ দিনে গ্রেস সময় বাদে বিলম্ব মাশুল যোগ হয় ১৩ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এ ছাড়া ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের বিলম্ব মাশুল বাবদ ১০৯ কোটি টাকা পাওনা দাবিও ছিল বড়পুকুরিয়ার পক্ষ থেকে। 
বিষয়টি সুরাহা করার জন্য জানুয়ারি মাসে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক ডাকা হয়। এই বৈঠকে বড়পুকুরিয়া কোম্পানির পক্ষ থেকে পাওনা আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে যাওয়া হলেও বৈঠকে বিলম্ব মাশুলের ১২২ কোটি টাকা মওকুফ এবং মূল্য বৃদ্ধিজনিত বকেয়া ২৮৭ কোটি টাকা দুই বছরে সমান মাসিক কিস্তিতে পরিশোধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। 
অপরদিকে, কয়লার মূল্য হ্রাস করার লক্ষ্যে ইন্দোনেশিয়ার কয়লাসূচক অনুসরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর আলোকে কয়লার মূল্য অন্তত ৭২ ডলার হ্রাস করে মূল্য পরিশোধ করা হচ্ছে। তবে এরই মধ্যে জ্বালানি বিভাগ মূল্য নির্ধারণে ৯ সদস্যের কমিটি করে দিয়েছে। কমিটি দুয়েক দিনের মধ্যে রিপোর্ট পেশ করবে। এই রিপোর্ট চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত  দুই বিভাগের মৌখিক নির্দেশনার আলোকে আপাতত ১৩০ ডলার টন মূল্য পরিশোধের জন্য বড়পুকুরিয়া পিডিবির প্রতি অনুরোধ করেছে বলে জানা গেছে। 
বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড (বিসিএমসিএল) সূত্রগুলো বলছে, কয়লা বিক্রির আয় থেকে বড়পুকুরিয়া খনি কর্তৃপক্ষ কয়লা উত্তোলন, ঠিকাদারের বিল, খনি পরিচালনা ছাড়াও সরকারের রাজস্ব জোগান দেয়।
তারা বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম হ্রাসের কারণ দেখিয়ে বড়পুকুরিয়া খনির কয়লার দাম কমানোর তৎপরতা খনিকে লোকসানী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করবে। অন্যদিকে, পিডিবি সূত্র আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কম দামে কয়লা কেনার প্রতিই আগ্রহী, যাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ভর্তুকি হ্রাস করা যায়। সূত্র জানায়, ২০২২ সালে বড় পুকুরিয়ার কয়লার সমানমানের কয়লার আন্তর্জাতিক বাজারে এফওবি ( ফ্রেইড অনবোর্ড) মূল্য প্রতি টন ১৯৬ ডলার থেকে ৪৩০ ডলার পর্যন্ত উঠলেও দেশি কয়লা প্রতিটন ১৭৬ ডলার দামেই বিক্রি করা হয়েছে। তখন কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সঙ্গতির প্রশ্নটি আসেনি। কোম্পানি সূত্রের ধারণা, কয়লার দাম কমিয়ে দেওয়া হলে ভবিষ্যতে কয়লা উত্তোলনসহ খনি পরিচালনা ও খনির উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
বিশেষ করে, নতুন করে জমি অধিগ্রহণসহ পরিকল্পনাসমূহ বাস্তবায়ন হবে না এবং খনি শেষে মাইন ক্লোজারের আওতায় বেশ কিছু খরচের বিষয় থাকে, তা সম্পন্ন করাও দুঃসাধ্য হয়ে উঠবে। খনি সূত্রের দাবি, বিদ্যুৎ উৎপাদনে এবং উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি দীর্ঘ ২০ বছর ধরে অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করে আসছে।
জানা যায়, বিদেশি ঠিকাদারের মাধ্যমে কয়লা উত্তোলন করে বড় পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা সরবরাহ করা হয়। কয়লা উত্তোলনসহ বিভিন্ন পর্যায়ে অপারেশনাল খরচ বাদ দিয়ে বিক্রি করে প্রতি টন কয়লায় যে মুনাফা থাকে, তা দিয়েই খনি উন্নয়ন ও সামগ্রিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।
২০২৩ সালের ৫ জানুয়ারি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী ৩০০ একর জমি অধিগ্রহণের ব্যয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সরবরাহ করা কয়লার বিক্রয় মূল্যের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করে ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরে টনপ্রতি প্রকৃত উৎপাদন ব্যয় দাঁড়ায় ১৩৯.৭৮ ডলার। তবে ২০২৪-২০২৫, ২০২৫-২০২৬, ২০২৬-২০২৭, ২০২৭-২০২৮ অর্থ বছরে প্রাক্কলিত উৎপাদন ব্যয় যথাক্রমে ১৫৬,  ১৬৫, ১৬২ ও ১৬৯ ডলার দাঁড়াবে, যার গড় মূল্য হবে ১৬৩.৪৪ মার্কিন ডলার।
এর  ব্যয়ের মধ্যে জমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণ ব্যয় বাবদ টনপ্রতি ১৩.৪২ ডলার, অনুসন্ধান ব্যয় বাবদ উৎপাদন ব্যয়ের ৭.৫ শতাংশ তথা ১২.২৬ ডলার এবং ১৫ শতাংশ হারে মুনাফা বাবদ ২৪.৫২ ডলার যোগ করে প্রতি টন কয়লার বিক্রয়মূল্য দাঁড়াবে ২১৩.৬২ ডলার। এসব খরচের সঙ্গে আরও মাইনক্লোজার ব্যয় যুক্ত হতে পারে।
দেশি ও আমদানিকৃত কয়লার মান প্রশ্নে বিসিএমসিএল জানায়, আমদানিকৃত কয়লার ক্যালোরি ফিক ভ্যালু ৪৫০০-৫০০০ কিলো ক্যালোরি/কেজি, যার ময়েশ্চার ২৮-৩৫ শতাংশ। বড় পুকুরিয়া কয়লার ক্ষেত্রে তা ৬১৩৭ কিলোক্যালোরি/কেজি, যার ময়েশ্চার ৩.৩৯ শাতংশ। অর্থাৎ সবক্ষেত্রেই বড় পুকুরিয়ার কয়লার গুণগত মান বেশি। 
২০০৫ সাল থেকে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির সেন্ট্রাল পার্টের কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে। বর্তমানে চতুর্থ চুক্তির আওতায় ২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর থেকে শুরু করে ২০২৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ৪৫ লাখ মেট্রিক টন কয়লা উত্তোলন করা হবে। আর জানুয়ারি পর্যন্ত ২৪ দশমিক ৭৩ লাখ মেট্রিক টন কয়লা উত্তোলিত হয়েছে।
বিসিএমসিএলের কর্মকর্তারা জানান, ২০২৭ সালের পর বর্তমান চুক্তি শেষে অতিরিক্ত প্রায় ২৭ লাখ মেট্রিক টন কয়লা উত্তোলন করা সম্ভব হবে, যা ২০৩০ সাল পর্যন্ত উত্তোলন করা যাবে।
তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৩টি ইউনিট অর্থাৎ মোট ৫২৫ মেগাওয়াট চালু থাকলে বার্ষিক প্রায় ১৫ লাখ টন কয়লার প্রয়োজন হয়। কিন্তু বাস্তবিকভাবে সব সময় ২টি ইউনিট চালু থাকায় বছরে প্রয়োজন হয় প্রায় ৭-৮ লাখ টন। কোনো ইউনিট বন্ধ থাকলে অতিরিক্ত কয়লা কোল ইয়ার্ডে জমা হতে থাকে।
এ ছাড়া দেশে বছরে প্রায় ৬৫ লাখ মেট্রিক টন কয়লা ইটভাঁটিতে ব্যবহার হয়ে থাকে। অর্থাৎ বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাদেও কয়লার অত্যধিক চাহিদা রয়েছে দেশীয় বাজারে।
 

প্যানেল মজি

×