
ছবি: সংগৃহীত
হেপাটাইটিস ও ফ্যাটি লিভার ডিজিজ (চর্বিযুক্ত যকৃত) হলো দীর্ঘমেয়াদি যকৃত ক্ষতির প্রধান কারণ। এদের লক্ষণগুলো প্রায়ই খুবই সূক্ষ্ম এবং সহজেই উপেক্ষিত হয়। তাই সচেতনতা বাড়ানো এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো অত্যন্ত জরুরি, যাতে সময়মতো রোগ ধরা পড়ে এবং জটিল পরিস্থিতি যেমন সিরোসিস বা লিভার ক্যান্সার এড়ানো যায়। ক্লান্তি, হালকা ব্যথা, ত্বকের পরিবর্তন ইত্যাদি অস্বস্তিকর লক্ষণগুলো বুঝতে পারলে দ্রুত চিকিৎসা সম্ভব হয়।
বিশ্বব্যাপী দীর্ঘস্থায়ী যকৃত রোগের মধ্যে হেপাটাইটিস ও ফ্যাটি লিভার ডিজিজ সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। দুটি রোগই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে, তাই লক্ষণগুলো সচরাচর নজরে আসে না, ফলে চিকিৎসা ও নির্ণয় বিলম্বিত হয়। জটিলতা এড়াতে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্ত করা প্রয়োজন।
ফ্যাটি লিভার ডিজিজের সংজ্ঞা ও কারণ
যখন যকৃতের কোষে ৫ শতাংশের বেশি চর্বি জমা হয়, তখন ফ্যাটি লিভার ডিজিজ বা হেপাটিক স্টিওটোসিস দেখা দেয়। এর প্রধান ধরনগুলো হলো:
- অ্যালকোহল সম্পর্কিত ফ্যাটি লিভার ডিজিজ (AFLD)
- নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ (NAFLD) যা মেটাবলিক ডিসফাংশনের সঙ্গে যুক্ত (MASLD)
বিশ্বে স্থূলতা, টাইপ ২ ডায়াবেটিস ও মেটাবলিক সিন্ড্রোমের বৃদ্ধির কারণে MASLD বাড়ছে। এটি মেটাবলিক ডিসফাংশন-সংক্রান্ত স্টেইটোহেপাটাইটিসে (MASH) রূপান্তরিত হতে পারে, যা সিরোসিস, ফাইব্রোসিস ও লিভার ক্যান্সারের কারণ হয়। রোগের প্রক্রিয়ায় ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স, অক্সিডেটিভ স্ট্রেস, মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিসফাংশন ও প্রদাহজনক সাইটোকাইন যেমন TNF-α ও IL-6 গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পাশাপাশি গাট মাইক্রোবায়োটার ডিসবায়োসিস যকৃতের প্রদাহ ও এন্ডোটক্সিমিয়া বাড়ায়।
হেপাটাইটিস: যকৃতের প্রদাহজনিত ক্ষতি
হেপাটাইটিস হলো যকৃতের প্রদাহ, যা বিভিন্ন কারণে হতে পারে:
- ভাইরাসজনিত (হেপাটাইটিস A, B, C, D, E)
- অটোইমিউন হেপাটাইটিস
- ওষুধজনিত (যেমন অ্যান্টিবায়োটিক, হরবাল ঔষধ, প্যারাসিটামল)
- অ্যালকোহলজনিত
- মেটাবলিক কারণ (হেমোক্রোমাটোসিস, উইলসন ডিজিজ, আলফা-১ অ্যান্টিট্রিপসিন ঘাটতি)
তীব্র হেপাটাইটিসের ক্ষেত্রে লক্ষণ থাকে, কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী হেপাটাইটিস প্রায়ই নিঃশব্দ থেকে থাকে এবং রুটিন রক্তপরীক্ষাতেই ধরা পড়ে।
সাধারণ অথচ উপক্ষিত হেপাটাইটিস ও ফ্যাটি লিভারের লক্ষণ
বিভিন্ন প্রাথমিক লক্ষণ অস্পষ্ট ও অন্যান্য গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল বা সিস্টেমিক রোগের সঙ্গে সহজেই ভুল করা হয়। অনেক সময় রোগীরা বা ডাক্তাররাও উপেক্ষা করেন নিচের লক্ষণগুলো:
- দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি: স্ট্রেস বা অ্যানিমিয়া ভাবলেও, যকৃতের রোগে স্নায়ুতন্ত্র ও প্রদাহজনিত কারণে ক্লান্তি হয়।
- ডান দিকের উপরের অংশে হালকা ব্যথা: যকৃতের বড় হওয়া বা ক্যাপসুলের টান ধরে থাকলে হয়; প্রায়ই গলব্লাডার রোগ, গ্যাস্ট্রাইটিস বা পেশীর ব্যথা মনে করা হয়।
- অজানা খুসখুসে চুলকানি (প্রিউরিটাস): জন্ডিসের আগে দেখা যায়, ভুল করে ত্বকের সমস্যা ভাবা হয়; বিশেষ করে কোলেস্ট্যাটিক হেপাটাইটিসে।
- মাথা মেঘলা ও ঘুমের সমস্যা: প্রাথমিক হেপাটিক এনসেফ্যালোপ্যাথি বা সাইটোকাইনজনিত মস্তিষ্কের প্রভাব; স্মৃতি সমস্যা ও মনোযোগের ঘাটতি দেখা যায়।
- পেশী দুর্বলতা ও ওজন কমা: সর্কোপেনিয়া বা মাংসপেশীর ক্ষয় বিশেষ করে স্থূল রোগীদের মধ্যে গঠনগত ফাইব্রোসিস বা সিরোসিসের ইঙ্গিত।
- ত্বক ও নখের পরিবর্তন: ক্রনিক হেপাটাইটিসে পামার এরিথেমা, স্পাইডার অ্যানজিওমা, লিউকোনিখিয়া (সাদা নখ) দেখা যায়; MASLD-তে হাইপারপিগমেন্টেশন ও আকানথোসিস নিগ্রিক্যান্স।
- যৌন অক্ষমতা ও অনিয়মিত মাসিক: লিভার ডিজিজের কারণে হরমোনের ব্যাঘাত; রোগীদের মধ্যে কমই উল্লেখিত।
- হালকা জ্বর: ভাইরাল ইনফেকশন বা ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন মনে হয়, কিন্তু অটোইমিউন বা ড্রাগ-ইন্ডিউসড হেপাটাইটিসেও সাধারণ।
নির্ণয় ও মূল্যায়ন
রুটিন লিভার ফাংশন টেস্টে (ALT, AST, GGT) বৃদ্ধি দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু এগুলো ফ্যাটি লিভার বা হেপাটাইটিস শনাক্তে যথেষ্ট নয়। লিভারের চর্বি ও ফাইব্রোসিস মাপতে MRI-PDFF, ইলাস্টোগ্রাফি (FibroScan), আলট্রাসাউন্ড সহায়তা করে। অটোইমিউন হেপাটাইটিস বা MASH-এর জন্য লিভার বায়োপসি সেরা পদ্ধতি।
হেপাটাইটিসে ইমিউনোগ্লোবুলিন, অটোইমিউন মার্কার (ANA, SMA, LKM) ও ভাইরাল সিরোলজি প্রয়োজনীয়। মেটাবলিক মূল্যায়নে সেরাম ফেরিটিন, লিপিড প্রোফাইল ও HbA1c জরুরি।
হেপাটাইটিস ও ফ্যাটি লিভার সাধারণত অস্পষ্ট, অতি-সহজে উপেক্ষিত লক্ষণ দেখায়, বিশেষ করে যাদের মেটাবলিক রোগ রয়েছে। রোগী ও চিকিৎসকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, নিয়মিত স্ক্রিনিং ও সন্দেহের মান বজায় রাখার মাধ্যমে অপ্রত্যাবর্তনীয় যকৃত ক্ষতি প্রতিরোধ করা সম্ভব।
সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া।
রাকিব