
ছবি: প্রতীকী
আগে মনে করা হতো হার্ট অ্যাটাক শুধু বয়স্ক মানুষদেরই রোগ। কিন্তু এখন এই ধারণা বদলে গেছে। আজকাল কম বয়সী তরুণ-তরুণীরাও হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হচ্ছেন। এমনকি ২০ বা ৩০ বছর বয়সেই কেউ কেউ গুরুতর হার্ট অ্যাটাকে ভুগছেন বা মৃত্যুবরণ করছেন। কেন এই পরিবর্তন? কেন কম বয়সে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ছে? এর পেছনে রয়েছে বেশ কিছু আধুনিক ও জীবনধারাজনিত কারণ। চলুন সেগুলো সহজ ভাষায় বুঝে নেওয়া যাক।
প্রথমত, বর্তমান প্রজন্মের খাদ্যাভ্যাস আগের তুলনায় অনেক বদলে গেছে। আগে মানুষ বাসায় রান্না করা সহজ খাবার খেতো, এখন তারা ফাস্টফুড, প্রক্রিয়াজাত খাবার, কোমল পানীয়, বেশি লবণ বা চর্বিযুক্ত খাবারের দিকে ঝুঁকছে। এইসব খাবার শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। কোলেস্টেরল ধমনীতে জমা হয়ে রক্তপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। এতে হৃদয়ের পেশীতে রক্ত সরবরাহ কমে যায় এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ে।
দ্বিতীয়ত, শরীরচর্চার অভাবও একটি বড় কারণ। এখন অনেকেই দিনের বেশিরভাগ সময় মোবাইল, কম্পিউটার বা টিভির সামনে কাটান। ঘরবন্দি জীবন, অফিসের চাপে দীর্ঘ সময় বসে থাকা, হাঁটা বা ব্যায়াম না করাই এখন সাধারণ অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এতে শরীরে চর্বি জমে, রক্তচাপ বাড়ে, ডায়াবেটিসের ঝুঁকি তৈরি হয়—সবকিছু মিলেই হার্টের উপর বাড়তি চাপ পড়ে।
তৃতীয়ত, ধূমপান এবং মাদকদ্রব্য গ্রহণের প্রবণতাও এখন অনেক বেশি। কম বয়সেই অনেক তরুণ ধূমপান শুরু করেন। ধূমপান রক্তনালিকে সংকুচিত করে এবং ধমনীতে ফ্যাটি উপাদান জমাতে সাহায্য করে। একইভাবে নেশাদ্রব্য হৃদস্পন্দন অনিয়মিত করে, যা হার্ট অ্যাটাকের কারণ হতে পারে।
চতুর্থত, মানসিক চাপ এখন তরুণদের মাঝেও প্রচণ্ড। পড়ালেখা, চাকরি, সম্পর্ক, ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা—এইসব কারণে তরুণদের মধ্যে মানসিক চাপ বেড়েই চলেছে। দীর্ঘমেয়াদী মানসিক চাপ হৃদপিণ্ডের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এতে স্ট্রেস হরমোন যেমন কর্টিসল এবং অ্যাড্রেনালিন নিঃসরণ বাড়ে, যা হৃদযন্ত্রের স্বাভাবিক কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটায়।
পঞ্চমত, অনিয়মিত ঘুমও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায়। আধুনিক জীবনে ঘুমের সময় অনেক কমে গেছে। মোবাইল বা ল্যাপটপে সময় কাটানোর কারণে রাতে ঘুমাতে দেরি হয় এবং সকালে উঠতে হয় তাড়াতাড়ি। নিয়মিত কম ঘুম হার্টের সুস্থতায় বিরূপ প্রভাব ফেলে। এতে রক্তচাপ বাড়ে, ইনসুলিনের কার্যকারিতা কমে যায় এবং শরীরে প্রদাহ সৃষ্টি হয়—সব মিলেই হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা বাড়ে।
আরেকটি বড় কারণ হলো—ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের মতো রোগ এখন অনেক কম বয়সেই ধরা পড়ছে। আগে এই রোগগুলো ছিল মধ্যবয়সী বা বয়স্কদের মধ্যে। এখন ২৫–৩০ বছরের মধ্যেই অনেক তরুণ-তরুণী ডায়াবেটিস বা হাই ব্লাড প্রেসারে ভুগছেন। এই রোগগুলো নিয়ন্ত্রণে না রাখলে তা হৃদরোগের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।
এছাড়া জিনগত কারণও রয়েছে। অনেক সময় পারিবারিক ইতিহাসে হৃদরোগ থাকলে কম বয়সেই হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। যেমন, কারো বাবা বা চাচা যদি অল্প বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তাহলে সেই ব্যক্তির ঝুঁকিও বেড়ে যায়।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো—তরুণদের মধ্যে এই ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে সচেতনতা খুবই কম। তারা ভাবেন, এসব রোগ তো বয়স্কদের হয়, এখনো অনেক সময় আছে। ফলে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা বা জীবনধারা পরিবর্তনের দিকে তারা মনোযোগ দেন না।
তবে আশার কথা হলো—এইসব ঝুঁকির অনেকটাই প্রতিরোধযোগ্য। খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন, নিয়মিত ব্যায়াম, ধূমপান পরিহার, পর্যাপ্ত ঘুম, মানসিক চাপ কমানো এবং সময়মতো ডাক্তার দেখানো—এই সাধারণ অভ্যাসগুলো হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকটাই কমাতে পারে। কম বয়সে হার্ট অ্যাটাকের ভয়াবহতা ঠেকাতে হলে এখন থেকেই সচেতন হওয়া জরুরি।
সুতরাং, বয়স কম হলেও নিশ্চিন্তে থাকার সময় নয়। আধুনিক জীবনযাপন আমাদের হৃদয়ের উপর চাপ বাড়াচ্ছে। তাই নিজের প্রতি যত্নশীল হতে হবে এবং স্বাস্থ্যকর জীবনধারা গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে—হার্ট সুস্থ থাকলে জীবনও থাকবে দীর্ঘ ও শান্তিপূর্ণ।
এম.কে.