
ছবি: প্রতীকী
বর্তমান যুগ প্রযুক্তিনির্ভর। মোবাইল ফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ কিংবা ডেস্কটপ কম্পিউটার—এসব এখন আর শুধু বড়দের ব্যবহারের জিনিস নয়। শিশুরাও আজকাল খুব ছোট বয়স থেকেই প্রযুক্তির সংস্পর্শে আসছে। কিছুটা শেখার উদ্দেশ্যে, কিছুটা খেলনার বিকল্প হিসেবে, আবার কখনো অভিভাবকের ব্যস্ত সময়কে সামাল দিতে শিশুর হাতে মোবাইল তুলে দিচ্ছেন অনেকেই। কিন্তু একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে, এই প্রযুক্তি ব্যবহারের অভ্যাস ধীরে ধীরে আসক্তিতে পরিণত হচ্ছে।
সন্তান যদি ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইল বা ট্যাবলেটে চোখ গুঁজে থাকে, পরিবার বা বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, বাইরের খেলাধুলা বা অন্যান্য সৃজনশীল কাজে মন না দেয়, তবে বুঝতে হবে সে প্রযুক্তির জালে আটকে যাচ্ছে। এটি শুধু মানসিক নয়, শারীরিকভাবেও ক্ষতিকর। অতিরিক্ত পরিমাণে স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকলে চোখের দৃষ্টিশক্তি কমে যেতে পারে, ঘাড় ও পিঠে ব্যথা হতে পারে, ঘুমের সমস্যা হতে পারে, এমনকি খাবারেও অরুচি দেখা দিতে পারে।
শুধু শারীরিক নয়, মানসিক সমস্যাও বাড়ছে প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহারে। অনেক শিশু ভিডিও গেমে এতটাই মগ্ন হয়ে পড়ে যে বাস্তব জীবনের সঙ্গে সম্পর্ক কমে যায়। তাদের ধৈর্য কমে যায়, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, এবং তারা সহজে রাগান্বিত হয়ে ওঠে। কিছু কিছু শিশু এমনকি ভার্চুয়াল জগতকে বাস্তব জীবনের চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় মনে করতে শুরু করে, যা তাদের সামাজিক বিকাশে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
অভিভাবকদের একটা বড় ভুল হলো—প্রযুক্তিকে "শান্ত রাখার হাতিয়ার" হিসেবে ব্যবহার করা। অনেক সময় দেখা যায়, শিশুকে চুপ করাতে বা খাওয়াতে মোবাইল দেওয়া হয়। এতে করে শিশু শেখে, তার চাহিদা পূরণের সহজ উপায় হলো প্রযুক্তির আশ্রয় নেওয়া। সময়ের সাথে সাথে এই অভ্যাস দৃঢ় হয় এবং একপর্যায়ে এটি আসক্তিতে পরিণত হয়। তখন শিশুর মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
প্রযুক্তি একেবারেই খারাপ নয়। বরং সঠিকভাবে ব্যবহার করলে এটি শিক্ষার শক্তিশালী মাধ্যম হতে পারে। ইউটিউবে রয়েছে অসংখ্য শিক্ষামূলক ভিডিও, বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে শিশুরা নতুন ভাষা, অংক কিংবা সৃজনশীল দক্ষতা শিখতে পারে। তবে সঠিক ব্যবহার বলতে বোঝায়—সময় সীমিত রাখা, উপযুক্ত কনটেন্ট নির্বাচন করা এবং অভিভাবকের তত্ত্বাবধানে ব্যবহার করা। শিশু কী দেখছে, কতক্ষণ ব্যবহার করছে—এ বিষয়গুলো নজরে রাখা জরুরি।
এখন প্রশ্ন হলো, আপনি একজন সচেতন অভিভাবক হিসেবে কী করতে পারেন? প্রথমত, নিজে প্রযুক্তির ব্যবহার সীমিত করুন। আপনি যদি সারাক্ষণ ফোনে চোখ গুঁজে থাকেন, তবে সন্তানও সেটাই শিখবে। দ্বিতীয়ত, শিশুর সঙ্গে বেশি সময় কাটান। ওর সঙ্গে গল্প করুন, বই পড়ুন, একসঙ্গে খেলাধুলা করুন। এতে শিশুর মনোযোগ প্রযুক্তি থেকে সরে আসবে এবং বাস্তব জীবনের আনন্দের সঙ্গে পরিচিত হবে।
তৃতীয়ত, প্রযুক্তি ব্যবহারের সময় নির্ধারণ করুন। দিনের নির্দিষ্ট সময় ছাড়া মোবাইল বা ট্যাব ব্যবহার করতে দেবেন না। এক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট রুটিন বানিয়ে সেটি অনুসরণ করাতে পারেন। যেমন, হোমওয়ার্ক শেষে ৩০ মিনিট কার্টুন দেখা যাবে, বা সপ্তাহে ২ দিন ভিডিও গেম খেলা যাবে। নিয়ম ভঙ্গ করলে প্রযুক্তি থেকে বিরত রাখা হবে—এমন নিয়মও রাখতে পারেন।
চতুর্থত, বিকল্প বিনোদনের ব্যবস্থা করুন। বই, রংতুলি, খেলনা, লুডু কিংবা বাইরের খেলাধুলার মতো বিভিন্ন সৃজনশীল কাজ শিশুকে দিন। এতে তার মনোযোগ প্রযুক্তি ছাড়াও অন্য কিছুতে আকৃষ্ট হবে। বিশেষ করে প্রকৃতির কাছাকাছি গেলে শিশু অনেক বেশি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।
প্রযুক্তি ব্যবহারে সচেতনতা জরুরি। এখনই যদি ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে আগামী দিনে সন্তান শুধু প্রযুক্তির দাস হয়ে উঠবে না, বরং সমাজের সঙ্গে সংযুক্ত থাকার সক্ষমতাও হারিয়ে ফেলবে। তাই, প্রযুক্তির সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে শেখান। সন্তানের সুস্থ ও স্বাভাবিক মানসিক বিকাশের জন্য সচেতন হন এখনই। কারণ, ভবিষ্যতের ভিত্তি গড়ে ওঠে আজকের সঠিক সিদ্ধান্তে।
এম.কে.