
.
দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতে বিশ্বব্যাংকের ৯শ’ কোটি টাকার ঋণের অর্থে ‘সহনশীলতা, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন এবং কার্যকর লক্ষ্য নির্ধারণে সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ’ প্রকল্প গ্রহণ করে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। কিন্তু প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রমগুলোর মধ্যে সামাজিক সুরক্ষায় ৫৮৯ কোটি টাকা ব্যয় হলেও পরামর্শক ফি, ডাটা স্টোরেজ, কম্পিউটার ও আনুষঙ্গিক এবং স্থানীয় প্রশিক্ষণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩১৫ কোটি টাকা, যেখানে শুধু পরামর্শক ফি প্রায় ২শ’ কোটি টাকা।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, গত ২০ এপ্রিল অনুষ্ঠিত একনেক সভায় প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। সভা পরবর্তী প্রেস ব্রিফিংয়ে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সে সময় পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, দাতা সংস্থাগুলো অনেকক্ষেত্রে তাদের শর্ত চাপিয়ে দেয়। তাদের দেওয়া ঋণের বিপরীতে কিছু শর্ত জুড়ে দেয়, যা অনেক সময় দেশের উন্নয়নের জন্য সহায়ক নাও হতে পারে। এই বিষয়ে আমাদের আরও সতর্ক হওয়া উচিত এবং জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে দাতা সংস্থাগুলোর সহযোগিতা ছাড়া দেশের উন্নয়ন কঠিন বলেও তিনি মনে করেন। এক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে এমন একটি পথ খুঁজে বের করতে হবে, যেখানে উভয়পক্ষের স্বার্থ রক্ষা হয়।
তথ্য সূত্রে জানা যায়, দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার আওতা প্রসারিত ও সরবরাহ ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে এ প্রকল্প নেওয়া হয়। এর মাধ্যমে একটি সামাজিক রেজিস্ট্রি স্থাপন ও চালু, নগদ স্থানান্তর কর্মসূচি শক্তিশালী করা এবং তাদের জীবিকা সহায়তা সম্প্রসারণ করাই ছিল প্রকল্পের উদ্দেশ্য।
প্রকল্পের পটভ‚মিতে বলা হয়, দেশের মানবসম্পদ সূচকের স্কোর কম, অর্থনীতিতে বেশিরভাগ কর্মীরা অনানুষ্ঠানিক। তাই টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য আর্থিক খাতের সংস্কার অপরিহার্য। অপরদিকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এখানে ঘন ঘন বন্যা প্রতিবছর লাখ লাখ জনগোষ্ঠীর ওপর প্রভাব ফেলে। এক্ষেত্রে এসব জনগোষ্ঠীর সামাজিক সুরক্ষায় ২০২৫ অর্থবছরে সরকার জিডিপির ১ দশমিক ৮ শতাংশ বরাদ্দ করেছে, যার উল্লেখযোগ্য অংশগুলোর মধ্যে রয়েছে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা।
এতে বলা হয়, গত এক দশকে সামাজিক সহায়তা কার্যক্রম প্রসারিত হলেও অদক্ষ লক্ষ্যমাত্রার কারণে তা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর তেমন প্রভাব ফেলেনি। এমনকি অনেক দরিদ্র পরিবার কোনো ধরনের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় নেই। তাদের স্বার্থেই সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমাজ সেবা অধিদপ্তরের আওতায় জুলাই ২০২৫ থেকে জুন ২০৩০ মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।
এক্ষেত্রে প্রকল্পটির প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে যেসব ব্যয় উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে দেখা যায়- প্রকল্পের আওতায় সুবিধাভোগীদের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ৫৮৯ কোটি টাকা, যা মোট প্রকল্পের ৬৫ দশমিক ১৪ শতাংশ। অপরদিকে পরামর্শক ফি (প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি) ব্যয় হবে ১৯৪ কোটি ৩ লাখ টাকা, যা প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ২১ দশমিক ৪৭ শতাংশ। এছাড়া ডাটা স্টোরেজ ব্যয় (৫ বছরের জন্য) ১২ কোটি টাকা, কম্পিউটার ও আনুষঙ্গিক ৯ কোটি ৭ লাখ টাকা এবং স্থানীয় প্রশিক্ষণ (৩শ’ জন) বাবদ ৫০ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।
কোনো সম্ভাব্যতা পরীক্ষা (ফিজিবিলিটি টেস্ট) ছাড়াই কারিগরি সহায়তা প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। চলতি বছরের জুলাই থেকে শুরু হওয়া প্রকল্পটিতে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ব্যয় বরাদ্দ হয়েছে ১৮০ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। প্রকল্পটির মেয়াদকাল ২০৩০ পর্যন্ত।
প্রতি অর্থবছরেই সমহারে বরাদ্দ থাকবে। এক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশনের সুপারিশ ও মতামতে বলা হয়েছে, প্রকল্পটির মাধ্যমে একটি গতিশীল সামাজিক রেজিস্ট্রি প্রতিষ্ঠা ও চালুকরণ, দরিদ্রদের জন্য নগদ স্থানান্তর কর্মসূচি শক্তিশালীকরণসহ তাদের জীবিকা সহায়তা সম্প্রসারণ করা হবে। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের দরিদ্রদের জন্য জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার কভারেজ প্রসারিত হবে।
তবে ৯শ’ কোটি টাকার প্রকল্পের ২শ’ কোটি টাকাই পরামর্শক ফি কেন, জানতে চাইলে আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) ড. কাইয়ুম আরা বেগম বলেন, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রজেক্টগুলো এরকম যে, সব শর্ত ওয়ার্ল্ড ব্যাংক দিয়ে থাকে। আমাদের কিছু করার থাকে না। আমাদের বরং বিরক্ত লাগে যে, আমাদের সাহায্য দিয়ে সবটাই কনসালটেন্সি ফি দিয়ে নিয়ে যায়।
এক্ষেত্রে দর কষাকষির কোনো সুযোগ নেই জানিয়ে তিনি বলেন, নেগোসিয়েশন তো আমরা করি। কিন্তু সেই অর্থে আমাদের নেগোসিয়েশনের সুযোগ নাই। কারণ, এটা ওদের টাকা। আমরা যদি না নেই টাকাটা ওরা নিয়ে আরেক দেশে দেবে। আফ্রিকার অনেক দেশ বসে আছে। আমরা আজকে না বললে কালকেই ওরা চলে যাবে- এরকম একটা অবস্থা। এইটুকুই আমি বুঝি যে, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রজেক্টগুলোয় তারা একদমই ছাড় দেয় না, বিশেষত, কনসালটেন্সির বিষয়ে ওরা এক পাও সওে না।
এদিকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমাজসেবা অধিদপ্তরে এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনসংযোগের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা রেজাউর রহমান এই প্রতিবেদককে বলেন, এ ধরনের কোনো প্রকল্প আমাদের দপ্তরে নেই। তবে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একটি ডকুমেন্টস তাকে দেওয়া হলে বলেন, এখন পর্যন্ত এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) নিয়োগ হয়নি। তাই এ সম্পর্কিত কোনো তথ্য জানা নেই।
প্যানেল মজি