ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ জুলাই ২০২৫, ৩ শ্রাবণ ১৪৩২

সাজাপ্রাপ্তদের তালিকা আরও দীর্ঘ হচ্ছে

আতঙ্কে এনবিআর কর্মীরা

জিয়াউল হক মিজান

প্রকাশিত: ২৩:৫২, ১৮ জুলাই ২০২৫

আতঙ্কে এনবিআর কর্মীরা

.

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড- এনবিআর-এ চলমান শুদ্ধি অভিযানে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে তীব্র আতঙ্ক বিরাজ করছে। ছাঁটাই, বরখাস্ত, অব্যাহতি, বদলি, দুদকের তদন্ত, রাষ্ট্রদ্রোহিতা, মামলা, গ্রেপ্তারসহ নানামুখী আতঙ্কে তাদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। চাকরি আছে কি-না? দুদক এলো কি-না? মামলা হলো কি-না? এমন নানা প্রশ্ন তাদের মুখে মুখে। কারও মুখে হাসি নেই। চাপা আতঙ্কে কাটছে প্রতিটি মুহূর্ত।

এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এনবিআরের ২৫ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বরখাস্ত করা হয়েছে। বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে চারজনকে। ১৬ জনের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান চলছে। আর অন্দোলেনের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বদলি করা হয়েছে শতাধিক ব্যক্তিকে। গত পহেলা জুলাই চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের একজন কমিশনারকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ ছাড়া মঙ্গলবার বরখাস্ত করা হয়ছে ১৪ জনকে। বুধবার বরখাস্ত হন নয়জন। তিনজন বরখাস্ত হয়েছেন বৃহস্পতিবার।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, প্রাথমিক হিসেবে আন্দোলনের কারণে জুন মাসে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হয়েছে আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ১০ হাজার কোটি টাকা কম। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সরকার। সাধারণ ক্ষমা চেয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নানান জায়গায় ধরনা দিলেও কাজ হচ্ছে না।

গণক্ষমা প্রার্থনা করলেও আন্দোলনে যুক্ত কর্মকর্তাদের ছাড় দিচ্ছেন না এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান। এনবিআরের বোর্ডে যুক্ত প্রায় সব কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেওয়ার হুমকিও  দিয়েছেন তিনি। এ নিয়ে যাতে কেউ উচ্চবাচ্য না করেন, সে বিষয়েও সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। প্রতিদিনই দীর্ঘ হচ্ছে বরখাস্ত, বদলি, দুদকের তদন্তের তালিকা। নতুন করে আরও অর্ধশত কর্মকর্তা-কর্মচারীর তালিকা করেছে সরকার। এ নিয়ে অস্বস্তি দেখা দিয়েছে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোয়।
আন্দোলনে রাজস্ব ঘাটতি \ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে ৪৩ হাজার ৯২ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করেছে এনবিআর। সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এ আদায় ২৫ হাজার ৯৪৭ কোটি টাকা কম। জুন মাসে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৬৯ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। অপূর্ণ থেকে যায় লক্ষ্যমাত্রার ৩৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ। আগের অর্থবছরের জুনের তুলনায় রাজস্ব আদায় কমেছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। আন্দোলনের কারণে রাজস্ব আদায়ে এ ঘাটতি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত।

তারা জানান, অর্থবছরের শেষ মাস জুনে রাজস্ব আদায়ের চাপ বাড়ে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুনে ৫৩ হাজার ৪৬ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়। এ হিসাবে আগের অর্থবছরের তুলনায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে ৯ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে। এ মাসে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ১৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ। বিগত অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, আদায় হয়েছে ৩ লাখ ৭০ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকার রাজস্ব। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার ৯২ হাজার ৬২৫ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়নি বা ১৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ আদায় করা যায়নি। এ দায় শেষ পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের ওপর বর্তায় বলে মনে করছেন তারা।
আরও তিনজন বরখাস্ত \ এদিকে বদলির চিঠি প্রকাশ্যে ছিঁড়ে ফেলায় বৃহস্পতিবার আরও তিনজন কর পরিদর্শককে সাময়িক বরখাস্ত করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান পৃথক তিনটি আদেশ সই করেন। গত কয়েক দিনে সব মিলিয়ে ২৭ জন কর কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বরখাস্ত করা হলো।

বৃহষ্পতিবার বরখাস্ত হয়েছেন আয়কর, গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিটের আবদুল্লাহ আল মামুন; কর অঞ্চল-৬-এর কর পরিদর্শক রুহুল আমিন এবং কর অঞ্চল-২-এর কর পরিদর্শক লোকমান আহমেদ। গত ২ জুলাই এনবিআরের কর বিভাগের সদস্য মো. আলমগীর হোসেন, মূসক নীতির সদস্য ড. মো আবদুর রউফ, শুল্ক নীতির সদস্য হোসেন আহমদ ও বরিশালের কর কমিশনার মো. শাব্বির আহমদকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়।
১ জুলাই রাতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার মো. জাকির হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করে সরকার। বরখাস্তের পর তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হিসেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) সংযুক্ত করা হয়। এর আগে সাময়িক বরখাস্ত হন মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত কমিশনার হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার; ঢাকার কর অঞ্চল-৮ এর অতিরিক্ত কর কমিশনার মির্জা আশিক রানা; ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক সিফাত ই মরিয়ম; জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) দ্বিতীয় সচিব শাহাদাত জামিল; ঢাকা কর অঞ্চল-২-এর যুগ্ম কর কমিশনার মাসুমা খাতুন; কর অঞ্চল-১৫-এর যুগ্ম কর কমিশনার মুরাদ আহমেদ; কুষ্টিয়া কর অঞ্চলের মোরশেদ উদ্দীন খান; নোয়াখালী কর অঞ্চলের যুগ্ম কর কমিশনার মোনালিসা শাহরীন সুস্মিতা; কক্সবাজার কর অঞ্চলের যুগ্ম কর কমিশনার আশরাফুল আলম প্রধান; খুলনা কর অঞ্চলের উপ-কর কমিশনার শিহাবুল ইসলাম; রংপুর কর অঞ্চলের উপ-কর কমিশনার নুশরাত জাহান; কুমিল্লা কর অঞ্চলের উপ-কর কমিশনার ইমাম তৌহিদ হাসান; খুলনা কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের রাজস্ব কর্মকর্তা শফিউল বশর এবং ঢাকা উত্তর কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের রাজস্ব কর্মকর্তা সবুজ মিয়া। 
সাজাপ্রাপ্তদের সবাই ওই আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন। কেউ কেউ নেতৃত্বও দিয়েছেন। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে এই আন্দোলন হয়। বরখাস্ত হওয়া মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত কমিশনার হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার এনবিআর ঐক্য পরিষদের সভাপতি এবং ঢাকার কর অঞ্চল-৮-এর অতিরিক্ত কর কমিশনার মির্জা আশিক রানা সহসভাপতি পদে আছেন। আন্দোলন প্রত্যাহারের পরের এই পর্যন্ত তিনজন সদস্য ও একজন কমিশনারকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। কাজ বন্ধ রাখার দায়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের তৎকালীন কমিশনারকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এছাড়া এনবিআরের ২ জন সদস্যসহ ১৬ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে দুদক। তাদের অধিকাংশই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন বলে জানা গেছে।
ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে কমিটি গঠন \ এদিকে গত মে ও জুন মাসের কর্মসূচির কারণে হওয়া রাজস্ব ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করতে কমিটি করেছে সরকার। ১৬ জুলাই অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের (আইআরডি) উপ-সচিব রেদোয়ান আহমেদের সই করা অফিস আদেশে একথা জানানো হয়। আদেশে বলা হয়, আইআরডির যুগ্ম সচিব সৈয়দ রবিউল ইসলামকে কমিটির আহŸায়ক করা হয়েছে। অর্থ, বাণিজ্য, শিল্প মন্ত্রণালয় ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের একজন করে উপসচিব কমিটির সদস্য হবেন। এছাড়া কমিটির সদস্য হবেন এনবিআরের একজন, বিজিএমইএর একজন ও এফবিসিসিআইয়ের এক কর্মকর্তা। আইআরডির উপসচিব (প্রসাশন ১) এর একজন হবেন কমিটির সদস্য সচিব।

কমিটির কার্যপরিধি সম্পর্কে বলা হয়, কমিটি গত ২৮-২৯ জুন দুইদিন চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের অফিস বন্ধ থাকায় রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ, দীর্ঘ ২ মাসব্যাপী কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগ এবং কর বিভাগের কর্মচারীদের কর্মসূচি পালনের কারণে সব কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, কাস্টম হাউস, কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট এবং আওতাধীন অধিদপ্তর/ পরিদপ্তর/ অনান্য দপ্তর সমূহের (কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট (আপিল) কমিশনারেটসহ) এবং কর অঞ্চলসমূহে রাজস্ব ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করবে।
২ মাসব্যাপী কর্মসূচি পালনের কারণে শুল্কায়ন কার্যক্রম এবং সব স্থলবন্দর ও নৌ-বন্দরে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে ক্ষয় ক্ষতিসহ দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করে আগামী ৩০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে।
কঠোর ব্যবস্থা চলমান থাকবে \ সংস্কারের অংশ হিসেবে গত মে মাসে এনবিআর দুই ভাগ করে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ও রাজস্ব নীতি নামে দুটি স্বতন্ত্র বিভাগ করে অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। রাতের আঁধারে জারি করা সেই অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে কলম বিরতিসহ নানা কর্মসূচিতে নামেন এনবিআরের কর্মকর্তারা।

প্রতিষ্ঠানটির সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমন্বয়ে গঠিত ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’ এর ব্যানের এসব আন্দোলন হয়। এক পর্যায়ে সরকার পিছু হটে। ২২ মে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অধ্যাদেশে ‘প্রয়োজনীয় সংশোধনী’ আনা হবে। আর সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত বিদ্যমান কাঠামোতেই চলবে এনবিআরের সব কাজ। এর মধ্যে সংস্থাটির কর্মীরা নানা অভিযোগ তুলে এনবিআর চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিতে নতুন করে আন্দোলনে নামেন এবং সংস্থার কার্যালয়ে তাকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করেন।
দাবি আদায়ে ২৮ জুন ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি শুরু করেন এনবিআরকর্মীরা। তাদের আন্দোলনে স্থবির হয়ে পড়ে আমদানি-রপ্তানিসহ এনবিআরের কার্যক্রম। পরের দিনও কর্মসূচি অব্যাহত থাকলে সংস্থাটির সেবাকে ‘অত্যাবশ্যকীয়’ ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার।

সংকট নিরসনে সেদিন এনবিআর কর্মীদের অবিলম্বে কর্মস্থলে ফেরার এবং ‘আইনবিরোধী ও জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থি কার্যক্রম’ থেকে বিরত থাকার আহŸান জানানো হয়। পরে সংকট সমাধানে পাঁচ উপদেষ্টাকে নিয়ে কমিটি গঠন করার কথা জানায় সরকার। ব্যবসায়ী নেতাদের মধ্যস্থতায় আন্দোলনকারীদের প্লাটফর্ম এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ শাটডাউন কর্মসূচি তুলে নেয়। এর মধ্যে আন্দোলনের সামনের সারির নেতাদের ‘দুর্নীতির তথ্যানুসন্ধানে’ নামে দুদক। তিন দফায় ১৬ জনের তথ্যানুসন্ধান শুরুর তথ্য দেয় সংস্থাটি। আন্দোলন থামার পর এখন একের পর এক কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে এনবিআর। এ প্রক্রিয়া চলমান থাকবে। 
 

প্যানেল মজি

×