ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৮ জুলাই ২০২৫, ৩ শ্রাবণ ১৪৩২

কোটির বেশি চাকরি হারানোর আশঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক হুমকিতে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ২১:০২, ১৮ জুলাই ২০২৫

কোটির বেশি চাকরি হারানোর আশঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক হুমকিতে বাংলাদেশ

ছবিঃ সংগৃহীত

আগামী ১ আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করতে যাচ্ছে—এমন খবরে দেশের রপ্তানি নির্ভর অর্থনীতি তীব্র সংকটে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন শিল্পপ্রধানেরা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু তৈরি পোশাক (RMG) খাত নয়, বরং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চামড়া, প্লাস্টিক, কৃষি, পরিবহন ও আর্থিক খাতেও এর বিরূপ প্রভাব পড়বে।

"এটা শুধু বাণিজ্য সংকট নয়, জাতীয় সংকট," বলে মন্তব্য করেছেন স্প্যারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম।

তিনি বলেন, “শুধু মনে করলেই হবে না যে আমাদের মার্কিনমুখী পোশাক রপ্তানিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যেকোনো বড় ক্রেতা একটি দেশ থেকে বহু বাজারের জন্য পণ্য সংগ্রহ করে। এই শুল্কের প্রভাব হবে বহুস্তরীয়।”

একজন ইউরোপিয়ান ফ্যাশন ব্র্যান্ডের কান্ট্রি ম্যানেজার বলেন, “যদি এই শুল্ক সংকট বাংলাদেশের অনুকূলে সমাধান না হয়, তবে আমাদের এখানে ব্যবসা করা অর্থনৈতিকভাবে যুক্তিযুক্ত থাকবে না। আমাদের বিকল্প উৎপাদন দেশ ভাবতে হবে।”

প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক পোশাক খাতে সরাসরি এবং আরও প্রায় ১০ লাখ মানুষ পরোক্ষভাবে এই খাতের সঙ্গে জড়িত।
শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্ডার কমে গেলে দুই মাসের মধ্যে এক মিলিয়ন বা তার বেশি চাকরি চলে যেতে পারে।

স্প্যারো গ্রুপ, যেখানে ১৮ হাজার কর্মী কাজ করেন এবং মাসে প্রায় ৪০ কোটি টাকা বেতন দেন, তাদের ৩০ কোটি ডলারের রপ্তানির অর্ধেকই যুক্তরাষ্ট্রে যায়।
শোভন ইসলাম বলেন, “এই বাজার যদি ভেঙে পড়ে, আমরা দুই মাসও টিকতে পারবো না।”

চট্টগ্রামভিত্তিক শীর্ষস্থানীয় রপ্তানিকারক এশিয়ান গ্রুপ, যাদের ৯৩ শতাংশ পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে যায়, তারাও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

তাদের নির্বাহী পরিচালক খোন্দকার বেলায়েত হোসেন বলেন, “সরকার যদি দ্রুত কোনো সমাধান না করতে পারে, আমরা টিকে থাকতে পারবো না।”

তিনি জানান, প্রতি মাসে তারা ৬০ কোটি টাকা মজুরি দেন এবং তাদের মোট মাসিক ব্যয় ৭০ কোটি টাকার মতো।

“আমাদের সবচেয়ে বড় ক্রেতা ওয়ালমার্ট এখনো পুরোনো অর্ডার চালাচ্ছে, কিন্তু পরবর্তী মৌসুম নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে। তারা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছে,” তিনি জানান।

হোসেন আরও বলেন, “আমাদের বেশিরভাগ কারখানাই (প্রায় ৯৫%) এক মাসের বেশি শ্রমিকদের বেতন দিতে পারবে না যদি পরিস্থিতির উন্নতি না হয়।”

হা-মীম গ্রুপ, দেশের বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক, যেখানে মাসে ৯০ কোটি টাকা মজুরি দেওয়া হয়, তারাও ঝুঁকির মুখে।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু হা-মীম গ্রুপেই ৭০ হাজার চাকরি হারানোর শঙ্কা রয়েছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (NBR) এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২,৩৭৭টি বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করেছে, যাদের মধ্যে ৮০১টি কোম্পানি তাদের রপ্তানির ৫০ শতাংশের বেশি মার্কিন বাজারে নির্ভরশীল।

বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বছরে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়।

এই বিপুল পরিমাণ রপ্তানি ঝুঁকিতে পড়লে, স্পিনিং মিল, ডাইং ইউনিট, অ্যাকসেসরিজ কারখানা, পরিবহন ব্যবসা, ব্যাংক এবং বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

একজন ব্যাংক কর্মকর্তার ভাষায়, “রপ্তানি হ্রাস পেলে অনেক রপ্তানিকারক 'ব্যাক টু ব্যাক এলসি' এবং অন্যান্য ট্রেড ফাইন্যান্সিং সুবিধা ব্যবহার করতে পারবে না, ফলে ঋণ খেলাপির ঝুঁকি বাড়বে।”

শুল্ক প্রভাব পড়বে বীমা খাতেও—সমুদ্র বীমা ও রপ্তানি ক্রেডিট ইন্স্যুরেন্সের প্রিমিয়াম হ্রাস পেতে পারে।

ছোট ও মাঝারি শিল্পগুলো (SMEs) যারা বড় কারখানাগুলোকে কাঁচামাল বা অন্যান্য সাপোর্ট দেয়, তারা এই সংকটের সবচেয়ে দ্রুত এবং কঠিন ধাক্কা খাবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, যেখানে ভারত, ভিয়েতনাম বা ইন্দোনেশিয়া যুক্তরাষ্ট্রকে গ্যাস, তুলা বা অন্যান্য কৌশলগত পণ্য সরবরাহের মাধ্যমে বাণিজ্য কূটনীতি চালিয়েছে, বাংলাদেশ তেমন কোনো বিনিময়মূলক প্রস্তাব উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে।

“আমরা দেখেছি, ট্রাম্প সরকারের সময় চীন যখন ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি মার্কিন রপ্তানি হারিয়েছিল। বাংলাদেশও একই বিপদের মুখে,” বলেন শোভন ইসলাম।

তিনি পরামর্শ দেন, দক্ষ অর্থনীতিবিদ এবং অভিজ্ঞ ব্যবসায়ীদের যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়ে জরুরি আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজতে হবে।

বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী মঙ্গলবার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে বলেন, “এই সংকট যদি সঠিকভাবে মোকাবিলা না করা হয়, তাহলে আমাদের অর্থনীতি, কর্মসংস্থান ও রপ্তানিতে ভয়াবহ প্রভাব পড়বে।”

তিনি জাতীয় ঐকমত্যের আহ্বান জানিয়ে বলেন, “এটি একটি জাতীয় ইস্যু। রাজনৈতিক দল, ব্যবসায়ী ও শিল্প নেতাদের একত্র হয়ে আলোচনায় অংশ নিতে হবে।”

তথ্যসূত্রঃ https://thefinancialexpress.com.bd/

 

মারিয়া

আরো পড়ুন  

×