
ছবি:সংগৃহীত
কয়েক বছর আগেও দক্ষিণ কোরিয়া ছিল অস্ত্র আমদানিনির্ভর একটি দেশ। কিন্তু চুপিসারে দেশটি এখন বদলে ফেলেছে নিজের অবস্থান। এখন তারা শুধু অস্ত্র তৈরি করছে না—বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অস্ত্র রপ্তানিকারক হিসেবে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।
২০২৫ সালের এই সময়ে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষা শিল্প এমন এক উচ্চতায় পৌঁছেছে যেখানে তারা ইউরোপ, এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের মিত্র হিসেবে কোরিয়া শুধু নিজেকে নয়, অন্য দেশগুলোকেও আধুনিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দিতে শুরু করেছে।
বিশ্বব্যাপী দক্ষিণ কোরিয়ার রপ্তানি আঘাত
পোল্যান্ড: দক্ষিণ কোরিয়া বর্তমানে পোল্যান্ডের সঙ্গে ৬.৭ বিলিয়ন ডলারের দ্বিতীয় ধাপের চুক্তি করছে, যার অধীনে ১৮০টি K2 ট্যাংক সরবরাহ করা হবে। এর আগে ২০২২ সালে দুই দেশের মধ্যে প্রায় ১০০০টি K2 ট্যাংক, ৬৪৮টি K9 হাউইটজার ও ৪৮টি FA-50 জেট সরবরাহের চুক্তি হয়।
ফিলিপাইন: ২০২৫ সালের জুনে ফিলিপাইনে ১২টি FA-50 জেট সরবরাহের জন্য ৭১২.৮ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি করে কোরিয়া অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ (KAI)। এই চুক্তি ২০৩০ সালের মধ্যে বাস্তবায়িত হবে।
ভারত: হানওয়া অ্যারোস্পেস ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে ভারতের সঙ্গে ২৫৪ মিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি করে, যার মাধ্যমে K9 হাউইটজার সরবরাহ করা হবে। অংশীদার হিসেবে কাজ করবে ভারতের লারসেন অ্যান্ড টুব্রো।
সৌদি আরব: ২০২৪ সালে, সৌদি আরব ৩.২ বিলিয়ন ডলারে কোরিয়ার আধুনিক কেএম-স্যাম ব্লক II এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম কিনেছে। এতে ১০টি মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ইউনিট সরবরাহ অন্তর্ভুক্ত।
ইরাক: ২০২৫ সালের আইকিউডেক্স প্রদর্শনীতে দক্ষিণ কোরিয়া আরও বড় প্রতিরক্ষা চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে KUH-1 হেলিকপ্টার, FA-50 জেট এবং মোবাইল এয়ার ডিফেন্স ব্যবস্থা।
বিশ্বস্ততা, প্রযুক্তি ও মূল্য-সাশ্রয় — রপ্তানির মূলমন্ত্র
দক্ষিণ কোরিয়ার এই অগ্রগতি হঠাৎ নয়, বরং একটি পরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় কৌশলের ফল। দেশটি এখন বিশ্বের শীর্ষ ১০ অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশের মধ্যে। ২০২১ সালে যেখানে রপ্তানি ছিল ৭.৩ বিলিয়ন ডলার, ২০২২ সালে তা লাফিয়ে দাঁড়ায় ১৭.৩ বিলিয়নে। যদিও ২০২৩ ও ২০২৪ সালে কিছুটা কমে আসে (১৪ ও ৯.৫ বিলিয়ন), ২০২৫ সালে পুনরায় লক্ষ্যমাত্রা ২৩ বিলিয়ন ডলার।
সরকারি উদ্যোগে শিল্পের গতি
রাষ্ট্রপতি ইউন সুক ইওল ও লি জে-মুং-এর নেতৃত্বে সরকার এই শিল্পকে ‘কৌশলগত স্তম্ভ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ২ বিলিয়ন ডলারের বিশেষ তহবিল গঠন করা হয়েছে, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, এয়ারস্পেস ও উন্নত উপকরণ ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিরক্ষা শিল্পগুলোকেও সরকার সহায়তা করছে — ৩.৬ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত অনুদান ও সহজ ঋণের সুবিধা দিচ্ছে। শ্রম ঘাটতি মোকাবিলায় কারখানাগুলোকে বছরে ১৮০ দিন পর্যন্ত ৬৪ ঘণ্টা কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
কোরিয়ার কর্পোরেট পাওয়ারহাউসগুলো
Hanwha Aerospace, KAI, LIG Nex1, ও Hyundai Rotem—এই চার প্রতিষ্ঠানই বিশ্বের প্রতিরক্ষা বাজারে নিজেদের শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে গেছে। শুধু ২০২৫ সালেই এদের অর্ডার ব্যাকলগ ১০০ ট্রিলিয়ন ওয়ন (৭২ বিলিয়ন ডলার) ছাড়িয়ে যাবে।
দ্রুত উৎপাদন ও আন্তর্জাতিক চাহিদার প্রতি দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেওয়ার ক্ষমতা এই কোম্পানিগুলোকে প্রতিযোগিতামূলক করেছে।
বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া কোরিয়ান অস্ত্রসম্ভার
- T-50 অ্যাডভান্সড জেট ট্রেইনার – ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডে রপ্তানি।
- K9 হাউইটজার – ভারত, তুরস্ক, পোল্যান্ড, ফিনল্যান্ডসহ বহু দেশে ব্যবহৃত।
- Cheongung II ক্ষেপণাস্ত্র – ইউএই-তে ৩.৫ বিলিয়ন ডলারের চুক্তিতে সরবরাহ।
- সাঁজোয়া যান ও হেলিকপ্টার – ফিলিপাইন ও ইরাকে সরবরাহ করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এক ‘নীরব শক্তি’
যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে সরাসরি অস্ত্র না পাঠালেও ইউক্রেন যুদ্ধের পর ইউরোপের দেশগুলো দক্ষিণ কোরিয়ার দিকে ঝুঁকেছে। পশ্চিমা দেশগুলোর অস্ত্র উৎপাদন সক্ষমতা কমে যাওয়ায় কোরিয়া একটি ‘বিশ্বস্ত, দ্রুত ও সাশ্রয়ী’ বিকল্প হয়ে উঠেছে।
অনেক দেশ এখন কোরিয়ার অস্ত্র ব্যবস্থার উপর নির্ভর করছে—একবার কোনো সিস্টেম গ্রহণ করলেই সেই দেশের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এটাই কোরিয়ার কৌশলগত সাফল্যের মূল।
একটি নতুন যুগের সূচনা
দক্ষিণ কোরিয়ার উত্থান শুধু সামরিক নয়—এটি এক কৌশলগত, অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিনির্ভর রূপান্তরের প্রতিচ্ছবি। বিশ্ব যেখানে আরও নিরাপত্তাহীন হয়ে উঠছে, সেখানে দক্ষিণ কোরিয়া হয়ে উঠছে এক নির্ভরযোগ্য প্রতিরক্ষা অংশীদার।
এই পরিবর্তন নিঃশব্দ হলেও, প্রভাবশালী। বিশ্ব এখন তাকিয়ে আছে এই নতুন ‘নীরব শক্তি’র দিকে।
মারিয়া