ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ জুলাই ২০২৫, ৩ শ্রাবণ ১৪৩২

ভিন্নখবর

ভিন্নখবর বিভাগের সব খবর

মাটির ঘরে জ্ঞানের ভাণ্ডার

মাটির ঘরে জ্ঞানের ভাণ্ডার

গল্পটি অনেক পুরানো। আজ থেকে ৮০ বছর আগের গল্পটি একটি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার। কেনো শহরের গল্প নয়। সবদিক দিয়ে অনুন্নত একটি নিভৃত গ্রামের গল্প। গ্রামটির নাম পানিহার। এ গ্রামের অবস্থান রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায়।  রাজশাহী শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে গোদাগাড়ী উপজেলা সদরের ডাইংপাড়া মোড়। এখান থেকে আরও ১২ কিলোমিটার দূরের গ্রাম আইহাই। বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রায় প্রত্যন্ত এ এলাকা সাঁওতাল জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত। আইহাই গ্রামের ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা সরু সড়ক পেরিয়ে পৌঁছানো যায় পানিহার গ্রামে। এখন উপজেলা সদর ছাড়াও বিভিন্ন পথ বেয়ে ওই গ্রামে যাওয়া যায়। গত তিন দশকের ব্যবধানে ওই গ্রামের পাশে গড়ে উঠেছে বাজার, দোকান-পাট। এ গ্রামেই ৮০ বছর আগে ১৯৫৪ সালে মাটির ঘরে প্রতিষ্ঠা করা হয় একটি লাইব্রেরি। যখন জেলা শহর রাজশাহী তো দূরের কথা, উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগও ছিল দুর্গম। রাস্তাঘাট ছিল না। বিদ্যুতের আলো সেতো কল্পনারও অতীত ছিল। অথচ সেই গ্রামে প্রতিষ্ঠা বরা হয় বই সমৃদ্ধ এক লাইব্রেরি। যার নাম ‘পানিহার পাবলিক লাইব্রেরি’। ব্রিটিশ আমলে ১৯৪৫ সালেই অনুন্নত প্রান্তিক গ্রামে নিজের ভিটে বাড়িতে লাইব্রেরিটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এনায়েত উল্লাহ মাস্টার নামের একজন শিক্ষানুরাগী। তবে সে সময় তাঁর অন্যতম সহযোগী ছিলেন কিংবদন্তি আদিবাসী নেতা সাগরাম মাঝি। সাগরাম মাঝি ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের হয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে এমএলএ নির্বাচিত হয়েছিলেন। পানিহার লাইব্রেরীর পত্তন হয়েছিল মাটির ঘরে। অনেক পরে যদিও পাশেই পাকা ঘর তৈরি হয়। কিন্তু ৮০ বছরের পুরানো সেই মাটির ঘরটি এখনো ব্যবহার হচ্ছে। সোমবার সকালে সরেজমিন ওই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, মাটির প্রতিষ্ঠাকালীন ঘরের পাশেই পাকা একতলা ভবন। তিন কক্ষের বারান্দা ওয়ালা এ ভবনে লেখা ‘পানিহার পাবলিক লাইব্রেরি’। প্রতিষ্ঠাকাল দেওয়া আছে ১৯৪৫ আর মঞ্জুরির সাল দেওয়া আছে ১৯৫৪। সামনে দিয়ে সরু পাকা রাস্তা চলে গেছে গ্রামের মাটির বাড়িঘর ভেদ করে। সবুজ ছায়াঢাকা মায়াবি ও স্নিগ্ধ একটি গ্রাম। লাইব্রেরিটি পরিদর্শনে গিয়ে তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। তবে লাইব্রেরির দেওয়ালে লেখা ‘প্রয়োজনে যোগাযোগের জন্য একটি মোবাইল নম্বর’। সেটি লাইব্রেরিয়ান মোয়াজ্জেম হোসেনের। ওই নম্বরে কল দিয়ে পরিচয় দিতেই তিনি জানালেন, তার জমিতে ধান রোপণ চলছে। তিনি মাঠে রয়েছেন। আসতে মিনিট বিশেক লাগবে। কথা অনুযায়ী ২০ মিনিটের মধ্যে মোয়াজ্জেম হোসেন আসতে না পারলেও লাইব্রেরির চাবি নিয়ে যথাসময়ে হাজির আব্দুল্লাহ নামের এক ব্যক্তি। তিনি এসেই জানালেন, তিনি লাইব্রেরিয়ান মোয়াজ্জেম এর চাচাত ভাই। লাইব্রেরিয়ান মোয়াজ্জেম হোসেনের অনুপস্থিতিতে তিনিই লাইব্রেরি চালু রাখেন। তিনি লাইব্রেরি খুলে দিলেন। শুরুতেই তিনি বললেন, এখন আর তেমন পাঠক আসে না। পাঠকের এখন বড় অভাব। তবুও প্রতিদিন খোলা হয় লাইব্রেরি। মোবাইল আর ইন্টানেটের যুগে বই পড়ার পাঠকের অভাব এখন তবে অনেকে আসেন। পছন্দের বই নিয়ে বাড়িতে গিয়ে পড়েন। সে সব বই জমা দিয়ে আবার নিয়ে যান। এখন এভাবেই কার্যক্রম চলছে এ লাইব্রেরির।  লাইব্রেরি ভেতরে প্রবেশ করতেই নাকে বিঁধলো পুরানো বইয়ের ঘ্রাণ। টেবিল আলমারির থাকে থাকে সাজানো পুরানো বইয়ের ভাণ্ডার। দেওয়ালে লাগানো দেশ বিদেশের মনীষীদের ছবি। আছে রাজনৈতিক নেতাদের ছবিও। এককোনে লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠাতা এনায়েত উল্লাহর ছবি। আছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিখ্যাত লেখক, সাহিত্যিকদের বাঁধাই করা ছবি। আবদুল্লাহ জানালেন, এই লাইব্রেরির সংগ্রহে রয়েছে প্রায় ১০ হাজার বই। এমন এমন সব দুর্লভ বই ও পত্রিকার সংকলন রয়েছে যা দেশের জাতীয় লাইব্রেরিতে পর্যন্ত নেই বলে দাবি তার। লাইব্রেরির দুটি নতুন বুক সেলফ চোখে পড়লেও বাকি সব আসবাবপত্র যেমন বুক সেলফ সব কাঠের ও প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ের। পুরানো বুক শেলফগুলো ও সেই সাক্ষ্য দিচ্ছিল।  এনায়েত উল্লাহ মাস্টার লাইব্রেরিটি প্রতিষ্ঠা করলেও শেলফগুলো সে সময় মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান, সাঁওতাল, মুন্ডা আদিবাসসহ সব বর্ণ ধর্মের মানুষ নিজ পয়সায় কিনে দিয়েছিলেন। এই লাইব্রেরিটি অসাম্প্রদায়িতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।   এই লাইব্রেরিতে যারা কাজ করেন, তাঁরা শুরু থেকেই কোনো বেতন পান না। সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে মনের আনন্দে লাইব্রেরি সামলে রেখেছেন তারা। বিশেষ করে লাইব্ররিয়ান মোয়াজ্জেম হোসেন আন্তরিকতার সঙ্গে আগলে রেখেছেন ঐতিহ্যের এ লাইব্রেরিটি। প্রাচীন এ লাইব্রেরিতে গেলে যে কারও মন-প্রাণ দুটোই ভরে যাবে, যদি সে বইপ্রেমী হন। ৮০ বছর আগে প্রান্তিক এই গ্রামে এমন একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি জ্ঞানপিপাসার সাক্ষ্য বহন করে আসছে আজও। যেন মাটির ঘরে পুরো জ্ঞানের ভাণ্ডার। জ্ঞান বিকশিত করার ঘরও বলা যায় এ লাইব্রেরিকে। অনুসন্ধানে জানা যায়, ঐতিহ্যের পানিহার পাবলিক লাইব্রেরি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল গত শতকের চল্লিশের দশকের মধ্যভাগে। ঠিক ব্রিটিশ শাসনামলের শেষবেলায়। সে সময় অশিক্ষার অন্ধকারে ডুবে থাকা প্রত্যন্ত গ্রাম পানিহারসহ আশপাশের অনেক এলাকার মানুষের কাছে আলোকবর্তিকা হয়ে এসেছিল এই লাইব্রেরিটি। তখন বই পাঠে ছিল আগ্রহ। জ্ঞানপিপাসু মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে ছুড়ে আসতেন মাটির ঘরের এই জ্ঞান ভাণ্ডারে। বই পড়তে এসে গ্রামেও থেকে যেতেন। কারণ যোগাযোগ ব্যবস্থা বলেত ছিল না কিছুই। ছিল শুধু মাইলের পর মাইল হেঁটে চলা পথ।  এ সময় জ্ঞানের আলো ছড়ানো আলোকবর্তিকা হয়ে থাকা এ এ লাইব্রেরিটি তথ্যপ্রযুক্তি আর মোবাইল ফোন, ইন্টারনেটের যুগে এসে খেই হারাতে বসেছে। বইয়ের প্রতি অনাদর-অবহেলার কারণে আলো ছড়ানো লাইব্রেরিটি দীপ্তি এখন নিভতে বসেছে। পাঠক সংকট, সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হতে বসেছে এখানকার সংগ্রহে থাকা হাজারো গ্রন্থ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এনায়েত উল্লাহ মাস্টার ছিলেন এক সমাজহিতৈষী। তিনিই বাড়ির পাশে ২ শতক জমির ওপর ৮০ বছর আগে গড়ে তোলেন এই লাইব্রেরীটি। বর্তমানে আধুনিকতার কোনো ছোঁয়া ছাড়াই দাঁড়িয়ে আছে এটি। তবু কখনো কখনো দুর্লভ বইয়ের টানে অনেক কবি-সাহিত্যিক ও গবেষকরা ছুটে আসেন এখানে।

কীটনাশক ব্যবহারে স্বাভাবিক প্রজনন ও বংশবিস্তার হুমকিতে

কীটনাশক ব্যবহারে স্বাভাবিক প্রজনন ও বংশবিস্তার হুমকিতে

‘মাছে ভাতে বাঙালি’ বহুল প্রচলিত এ কথাটি এখন আর বাস্তবে নেই। এটি এখন কিতাবে জায়গা করে নিয়েছে। হাওড়-বাঁওড়, পুকুর, খাল-বিল, হাটবাজার কোথায়ও এখন আর মিঠাপানির সুস্বাদু মাছ আগের মতো পাওয়া যাচ্ছে না। গত কয়েক দশকে দেশি প্রজাতির অনেক মাছই হারিয়ে যেতে বসেছে। মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, হারিয়ে যাওয়া দেশি প্রজাতির মাছের সংখ্যা আড়াইশ’র বেশি। দেশি মাছের বদলে এখন বাজারে জায়গা দখল করে নিয়েছে বদ্ধপানিতে চাষ করা পাঙ্গাস, তেলাপিয়া, ক্রস ও কার্পজাতীয় মাছ। তারপরও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে যে চাহিদা বেড়েছে সে পরিমাণ মাছের জোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বাজারে মাছের দাম চলে যাচ্ছে ক্রেতা-সাধারণের নাগালের বাইরে। এলাকাবাসী গোলাম কুদ্দুস, রহমতউল্লাহ, আব্দুল কাইয়ুম জানান, এখন আর সুতিয়া নদী, ব্রহ্মপত্র নদ ও শীলা নদীতে সুস্বাদু দেশীয় মাছ আর তেমন পাওয়া যায় না। তারা বলেন, যা পাওয়া যায় দাম আকাশচুম্বি। বিলুপ্তির ঝুঁকিতে থাকা দেশি মাছের অঞ্চলভেদে বিভিন্ন নাম রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- চাপিলা, বৈচা, চাটুয়া, চাঁদা, নামা চাঁদা, গোল চাঁদা, আইড়, গুলশা, পাবদা, দেশি পুঁটি, সরপুঁটি, তিত পুঁটি, মেনি, ভেদা, শিং, কই, টাকি, শোল, গজার, ফলি, চিতল, মলা, ঢেলা, কানপোনা, দারকিনা, খয়রা, বাচা, বাটা, রিটা, পিয়ালি, জয়া, খৈলসা, ছোট টেংরা, বড় টেংরা, চান্দা, কাজলি, চ্যাং, কালিবাউশ, বাঘাইড়, ভাঙ্গন, ছোট চিংড়ি, বাতাসি, বড় বাইম, তারা বাইম, শাল বাইম, চিকরা বাইম, কাকিয়া, কুইচ্চা, তারা, রখাকসা, খরকুটি, বাঁশপাতারি, পটকা, বেলেসহ নাম না জানা অনেক প্রজাতির দেশি মাছ। প্রায় দুই দশকে কৃত্রিম প্রজনন ও চাষের মাধ্যমে মাছের সরবরাহ ও চাহিদা অনেকাংশে বাড়ানো হয়েছে। বাংলাদেশে এখন প্রতিবছর সাড়ে ৪২ লাখ টনেরও বেশি মাছ উৎপন্ন হচ্ছে। এর মধ্যে নদী, বিল ও হাওড়সহ উন্মুক্ত  জলাশয় থেকে ২৫ শতাংশ; পুকুর, ডোবার মতো বদ্ধ জলাশয় থেকে ৫৭ শতাংশ এবং বাকি অংশ সমুদ্র থেকে উৎপাদিত হচ্ছে। মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট উভয় কারণেই অনেক মাছ বিলুপ্ত হয়েছে। বিলুপ্তির পথে রয়েছে বহু মাছ। প্রাকৃতিক কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- জলাভ‚মির সঙ্গে বিশেষ করে নদী, হাওড়-বাঁওড় ও বিলের গভীরতা কমে যাওয়া, প্লাবন ভ‚মির সঙ্গে সংযোগ খাল ভরাট, জলাশয়ে বছরের অধিকাংশ সময় পানি না থাকা এবং প্রজনন মৌসুমে পানির প্রবাহ কমে যাওয়া। মনুষ্যসৃষ্ট কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- জমিতে রাসায়নিক সার ও অপরিকল্পিত মৎস্য আহরণ, প্রজনন মৌসুমে প্রজনন সক্ষম মাছ ও পোনা ধরা, কলকারখানার বর্জ্য নিকটস্থ জলাশয়ে ফেলা, কারেন্ট জালের ব্যবহার, মাছের আবাসস্থল ধ্বংস করা এবং ক্ষতিকর মৎস্য আহরণ সরঞ্জামের ব্যবহার। মৎস্যবিদ জহিরুল ইসলাম আকন্দ বলেন, বর্ষার শুরুতে বেড়জাল ও কারেন্টজাল, চায়না দুয়ারি জাল দিয়ে মা মাছ নিধনের ফলেও বিলুপ্ত হচ্ছে দেশীয় মাছ। একটি অসাধু চক্র মাছের ডিম ও পোনা মাছ ধরেও দেশীয় মাছের সংকট সৃষ্টি করছে। বিদেশি বিভিন্ন প্রজাতির হাইব্রিড মাছ চাষের ফলে দেশীয় উন্মুক্ত জলাশয়ের বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হচ্ছে। দেশীয় প্রজাতির মাছ বিশেষ করে মাগুর, চাপিলা, শিং, পাবদা, টাকি, রুই, কাতল, মৃগেল, চিতল, রিটা, গুঁজি আইড়, কৈ, বোয়াল, খৈলসার মতো সুস্বাদু মাছগুলো এখন আর তেমনটা চোখে পড়ে না। দেশি সরপুঁটি, গজার, বামাশ, টাটকিনি, তিতপুঁটি, বাঘাইড়, গুলশা, কাজলি, মাগুর, চেলা বাতাসি, কালনা (ফলি), চেলা, টেংরা, কানি পাবদা, পুঁটি, মলা, কালিবাউশ, শোল, মহাশোল, রিটা, তারাবাইম, বাতাই, কাকিয়া, বাইম, গুলশা, বেদরিসহ ৪০ থেকে ৬৪টি জাতের মাছ হারিয়ে যেতে বসেছে। এর মধ্যে ২৯ প্রজাতির বিলুপ্ত প্রায় মাছ ফিরিয়ে এনেছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই)। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সাবেক মৎস্য বিজ্ঞানী ড. কহিনুর ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, খাদ্যভাস্যের তালিকায় মাছ একটি নিত্য খাবার- যা আমিষের চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখে। কথায় আছে মাছের পোনা, দেশের সোনা। আর দেশি মাছ পুষ্টির আধার। নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড়-বাঁওড় শুকিয়ে মুক্ত জলাশয়ের মাছ বিলুপ্ত হতে চলেছে এবং ফসলি জমিতে অতি মাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগের কারণে মাছের জীবনচক্র হুমকির মুখে। কৃত্রিম উপায়ে ঘের-পুকুরে মাছের চাষ বৃদ্ধি পেলেও এর প্রকৃত স্বাদ বিনষ্ট হচ্ছে। গ্রাম-গঞ্জের খাল-বিলে কিছু দেশীয় মাছ মিললেও চাহিদার তুলনায় তা অপ্রতুল। বাজারে দেশি মাছের চাহিদা থাকলেও পুঁটি, মায়া, ট্যাংরা, খৈলসা, শিং, রয়না, কাকিলা, বাইম, পাকাল, গচি, গরগতে, দেশি মাগুর, পাবদাসহ এ জাতীয় মিঠা পানির মাছ নেই বল্লেই চলে। বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মোট ২৬০ প্রজাতির মিঠা পানির মাছের মধ্যে ১২টি প্রজাতি চরম বিপন্ন এবং ১৪টি প্রজাতি সংকটাপন্ন। যদিও চিংড়িসহ মিঠাপানির ২৯৬টি প্রজাতির মাছ এবং ৫১১টি সামুদ্রিক প্রজাতির মাছ রয়েছে। এসব বিষয় বিশ্লেষণ করলে মাছের যে প্রাকৃতিক জলাশয় ও মুক্ত জলাশয় রয়েছে তা আমাদের অযাচিত ও অনৈতিক কীটনাশক ব্যবহারের কারণে মাছের স্বাভাবিক প্রজনন ও বংশবিস্তারকে হুমকির সম্মুখীন করেছে। মাছের জাটকা সংরক্ষণে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং মৎস্য অধিদপ্তর বেশ প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছে কিন্তু সে বিষয়টি এখনো সাড়া জাগানো সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করা সম্ভব হয়নি। দেশীয় মাছ অবশ্যই সংরক্ষণ করে মুক্ত জলাশয়ে তার অবাধ বিচরণের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশি মাছ সংরক্ষণ ও চাষের মাধ্যমে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও আমিষের ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব। সেজন্য প্রয়োজন মৎস্যবান্ধব পরিবেশনীতি ও অবকাঠামোর সফল বাস্তবায়ন। এ বিষয়ে মৎস্য কর্মকর্তারা জানান, দেশীয় মাছগুলোকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষের আওতায় আনতে হবে। বদ্ধ জলাশয়ে দেশি প্রজাতির মাছ যাতে বেশি পাওয়া যায় সেজন্য বেশ কিছু কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে। ধান খেতে ছোট প্রজাতির মাছ চাষের ব্যবস্থা করা এবং এ ধরনের মাছ সারাবছর পাওয়ার জন্য ধান খেতে মিনি পুকুর তৈরি, মাছের প্রজনন মৌসুমে মাছ না ধরা, ফাঁস জাল ব্যবহার না করা, রাক্ষুসে মাছ কমানোর জন্য বিষ প্রয়োগ না করা, রুই জাতীয় মাছের সঙ্গে ছোট প্রজাতির মাছের মিশ্র চাষ, জলাশয় এবং পুকুরে দেশি মাছ চাষাবাদের জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। যদিও বর্তমানে মাছের স্বাভাবিক প্রজননক্ষেত্র, চলাচল অনেকখানি হুমকির মুখে। অনেকে না জেনে, না বুঝে জাটকা নিধন করেন। তাছাড়া জমিতে অতি মাত্রায় বালাইনাশক প্রয়োগ, অপরিকল্পিত বাঁধ দেওয়া, পোনা ও ডিমওয়ালা মাছ নিধন এবং মাছের প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা থেকে বিরত না থাকার কারণে এখন আর পরিচিত অনেক দেশি মাছের সন্ধান মেলে না। অভিজ্ঞ মহলের মতে দেশি মাছ সংরক্ষণের জন্য কারেন্ট জালের ব্যবহার বন্ধ করা, মাছের অভয়াশ্রম গড়ে তোলা, পুরাতন জলাশয়গুলো সংস্কার করা, ছোট দেশি জাতের মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ও অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয় সংরক্ষণ করে মাছের বংশবৃদ্ধির জন্য উপযোগী করে দেশীয় মাছের সংরক্ষণ করা অতিব প্রয়োজন। জলাশয়, খাল, পুকুর ভরাটের কারণে মাছের আবাসস্থল থাকছে না- যার কারণে হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় প্রজাতির সুস্বাদু মাছ। মৎস্যবিদরা জানান, বাংলাদেশের জলাশয়ে ২৬০ প্রজাতির দেশীয় মাছ, ১২ প্রজাতির বিদেশি মাছ এবং ২৪ প্রজাতির চিংড়ি রয়েছে। জাতীয় অর্থনীতিতে মৎস্যখাত গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখছে। স্থ’ূল জাতীয় উৎপাদনে এ খাতের অবদান শতকরা প্রায় ৪ ভাগ এবং কৃষির উৎপাদনে শতকরা ২১ ভাগ। জাতীয় রপ্তানি আয়ে মৎস্যখাতের শরিকানা শতকরা প্রায় ৪ ভাগ। আমাদের নিত্যদিনের খাদ্য তালিকায় প্রাণিজ আমিষের শতকরা ৫৮ ভাগ সরবরাহ আসে মাছ থেকে। এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকান্ডে প্রায় ১৩ লাখ শ্রমিক সার্বক্ষণিকভাবে এবং ১ কোটি ২৫ লাখ শ্রমিক খন্ডকালীনভাবে নিয়োজিত আছে। আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে, কর্মসংস্থানে, দারিদ্র্যমোচনে এবং প্রাণিজ আমিষের ঘাটতি দূরীকরণে মৎস্য খাতের উন্নয়ন অপরিহার্য। গফরগাঁও উপজেলার সিনিয়র মৎস্য অফিসার মুহাম্মদ মালিক তানভীর হোসেন জানান, ১৫টি ইউনিয়নের খাল-বিলে ও নদীতে দেশীয় মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। দেশীয় মাছ বিভিন্ন বাজারে খুবই কম পাওয়া যায়। উপজেলা বিভিন্ন খামার ও পুকুর, বিল মৎস্য চাষীদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে যে, দেশি শিং, মাগুর, পাবদা, টেংরা ও গুলশা চাষ করার জন্য। দেশীয় মাছ কমে যাওয়ার কারণ হলো বিভিন্ন রকমের অবৈধ জাল, চিকন জাল দিয়ে পোনা মাছ নিধন অন্যতম কারণ। রাওনা ইউনিয়নের গোলাম কুদ্দুস বলেন, গত ১০ থেকে ১৫ বছর ধরে ব্রহ্মপুত্র নদীতে বর্ষাকালে পানি না হওয়ার ফলে দেশীয় মাছের আকাল দেখা যাচ্ছে।