ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৫ জুন ২০২৫, ১ আষাঢ় ১৪৩২

ভিন্নখবর

ভিন্নখবর বিভাগের সব খবর

‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়, তবু কেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়...’

‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়, তবু কেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়...’

‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়, তবু কেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায় কখনো নদীর মত, তোমার পথের পানে বয়ে বয়ে যায়...।’ বরেণ্য সংগীতশিল্পী প্রয়াত সুবীর নন্দীর কণ্ঠে জনপ্রিয় এই গানটি নারী পাথর শ্রমিকদের দুঃখ-কষ্ট জীবনের সঙ্গে যেন এক হয়ে মিলে আছে।   সেই সাত সকালে ঘুম থেকে উঠে সংসার সামাল দিয়ে  ছুটে যেতে হয় পাথর উত্তোলন ও পাথর ভাঙার কাজে। বিনোদন নেই জীবনে। গান-বাজনা শোনার সময়ও নেই। পেটের টানে স্বামীর সংসারে এসেও ঘরের বাইরে যেতে হচ্ছে এই গৃহবধূদের। যাদের স্বামী মারা গেছে বা বিচ্ছেদ ঘটেছে এমন নারীর সংখ্যা বেশি এই পাথর ভাঙা শ্রমে। পাথর ভাঙার ধুলো-ময়লা যেন মাথা থেকে পা পর্যন্ত ছেয়ে যায়। অনেকে অসুুস্থ হয়ে পড়েন। তবুও থেমে থাকে না জীবন নামের রেলগািড়টা। দেশের উত্তরের প্রান্তিক জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার বাংলাবান্ধা ও ভোজনপুর। হাজারো নারী পাথর শ্রমিক ¯্রফে বাঁচার তাগিদে বেছে নিয়েছেন এই কঠিন শ্রমের কাজ।। কিন্তু মজুরির বেলায় নিগৃহীত হচ্ছেন তারা। কর্মসংস্থানে পাথর ভাঙার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে থাকেন এই প্রান্তিক নারীরা। ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত তারা। তবুও কাজ হারানোর ভয়ে প্রতিবাদ করার সাহস পান না। বাংলাবান্ধা ও মহানন্দা নদী থেকে উত্তোলন করা পাথরের সাইটে প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক পাথর ভাঙার কাজ করেন। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এই কাজ করে একজন মজুরি পান ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। পুরুষরা পান ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। পাথর ভাঙা শ্রমিক আমেনা বেগম (৪০) বলেন, স্বামীর অভাবের সংসার। একাই কাজ করে কুলাতে পারেন না তিনি। বাজারে সব জিনিসের দাম বেশি। ছেলে- মেয়ে সংসার সামলানো কঠিন। বাধ্য হয়ে স্বামীর সংসারে জোগান দিতে আমিও  ৬ বছর ধরে পাথর ভাঙার কাজে নেমে পড়ি। এর আগে সবারই মজুরি কম ছিল। তখনো আমাদের নারী-পুরুষের মধ্যে মজুরি পার্থক্য ছিল। এখন মজুরি কিছুটা বেড়েছে, কিন্তু আমরা পুরুষদের সঙ্গে সমানতালে কাজ করেও মজুরি কম পাচ্ছি।  মরিয়ম বেগম (৪৫)। দুই ছেলে সন্তান রয়েছে তার। তাদের  মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়েছেন তিনি। স্বামী অন্যত্র বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছিল। কিন্তু একদিন সংসারের ঝগড়ায় স্বামী তার ওই স্ত্রীকে খুন করেছিল। স্বামীর সাজা হয়েছে ৩২ বছর। দশ বছর হয় সাজা খাটছে।  তাই বাধ্য হয়ে পাথর ভাঙা কাজে নামতে হয়েছে আমাকে। আগে প্রতিদিন সাড়ে ৩০০ টাকা পেতাম এখন ৫০০ টাকা পাই। এ দিয়ে সংসার খরচ চলে। এই নারী জানালেন, আমদের জীবনটা রেলগাড়ির মতো। সুখ কপালে নেই বলে আজও স্টেশন খুঁজে পাইনি। তাই সব সহ্য করে হাড়ভাঙা খাটুনির পাথর ভাঙা কাজে নেমেছি। মরিয়ম বেগমের কথা শুনে মনে হলো তিনি  মিতালী মুখার্জির গাওয়া ‘জীবন নামের রেলগাড়িটা পায় না খুঁজে ইস্টিশন, কোথা থেকে ছেড়ে এলো -যেতে হবে কতদূর- কোনখানে তার শেষ ঠিকানা কোনখানে তার অচিনপুর..’ এই গানটিকে ইঙ্গিত করে নিজের কষ্টের কথাগুলো বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। ওই এলাকার পাথর ভাঙা শ্রমিক রেহানা বেগম বলেন, আমি ৯ বছর ধরে পাথর ভাঙার কাজ করছি। ২ মেয়ে ও ১ ছেলে রয়েছে সংসারে। স্বামী মারা গেছেন প্রায় ৭ বছর হলো। এক মেয়েকে কোনোরকমে বিয়ে দিয়েছি। ছোট ছেলে-মেয়ে দুটি লেখাপড়া করছে। অভাবের সংসারের চাহিদা মেটাতে অল্প মজুরি দিয়ে জীবন নির্বাহ করতে হয়। তিনি আরও বলেন, আগে সবারই মজুরি কম ছিল। তখনো নারী-পুরুষের মধ্যে মজুরির পার্থক্য ছিল। এখন মজুরি কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু আমরা পুরুষদের সঙ্গে সমানতালে কাজ করেও মজুরি কম পাচ্ছি। তিনি জানান, পাথরের কাজ খুবই কষ্টের। প্রতিদিন এক লিটার করে দুধ খেতে হয়। বাজারে এক লিটার দুধের দাম ৬০ থেকে ৭০ টাকা। জীবন বাঁচাতে এ পথ ছাড়তেও পারছি না। স্বামী নেই।  সন্তানদের কথা চিন্তা করে জীবনের রঙ্গিন স্বপ্নগুলো যেন ম্লান । পাথর শ্রমিক  রেহেনার কথাগুলো শুনে মনে হবে নিশ্চিয়ই সুবীর নন্দীর ওই গানের আরও কথায়-‘শুনিতে চাই না গান, তবু সুর ফিরে আসে, স্বপ্নের বাঁশি বাজে, জীবনের বারো মাসে  কত রাত্রিতে আমার প্রদীপ শুধু জ্বলে জ্বলে যায়।’  দ্রব্যে মূল্য ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ায় সংসারের যোগান দিতে দিন দিন নারী শ্রমিকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সংসারের চাহিদা ও ভরণ-পোষণের জন্য ঘরের কাজ সেরে জীবিকার তাগিদে নারীরা নেমে পড়েন মাঠে-ঘাটে। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে ঘরে-বাইরে প্রায়শ নিগৃহীত হচ্ছেন তারা।  তাদের কষ্টের কথা বুকে চেপে ধরে রাখেন। তবে পাথর সংশ্লিষ্ট কাজে কম মজুরি দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করে জানিয়েছেন নারী শ্রমিকরা। এ অঞ্চলের নারী শ্রমিকরা পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাজ করছেন। এতে সংসারে ফিরেছে সচ্ছলতা। এক সময় নারীরা শুধুই ঘর- গৃহস্থালির কাজ করতেন। সরেজমিনে গিয়ে নারী শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে তাদের জীবনের অনেক কথাই উঠে আসে।  বিশেষ করে তেঁতুলিয়া উপজেলার বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর, পার্শ¦বর্তী দেশ ভারত থেকে বয়ে আসা ১৭ কি.মি. মহানন্দা নদীর বিভিন্ন পাথর সাইটে কাজ করেন কয়েক হাজার নারী শ্রমিক। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাজ করে মজুরি পান ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। পাথর ভাঙার কাজে নিয়োজিত ফিরোজা নামে নারী শ্রমিক জানালেন, আমরা পাথর ভাঙার মেশিনে কাজ করছি। সারাদিন সমান কাজ করেও আমাদের মজুরি পড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আর পুরুষদের মজুরি ৭০০ টাকা ৮০০ টাকা। বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর এলাকায় একেকজন পুরুষ পাথর শ্রমিক পাথর ভাঙা মেশিনে প্রতিদিন আট ঘণ্টা কাজ করে কেউ ৮০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা মজুরি পাচ্ছেন বলে জানালেন পাথর ব্যবসায়ী ওবায়দুল হক। তিনি বলেন, মহানন্দা নদীর পাথর কমে যাওয়ায় পাথর ভাঙার কাজ কোনোরকমে চলছে। উপায় নেই, কারণ পুরুষরা যে কাজটি খুব তাড়াতাড়ি করতে পারে সেই তুলনায় নারীরা ওই কাজ বেশি সময় নিয়ে করে। পুরুষ শ্রমিকরা বেশি পরিশ্রম করে থাকে। বর্তমানে পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায় নারী পাথর শ্রমিকদের কম মজুরি দেওয়া হয়ে থাকে। অপর পাথর ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম জানান, আগে তো নারী শ্রমিকরা পাথর ভাঙার কাজে আসত না। দিন দিন নারী শ্রমিকদের সংখ্যা বাড়ছে। । তবে প্রান্তিক পর্যায়ে পাথর ভাঙা মেশিনের সাইটগুলোতে নারী শ্রমিক সংখ্যা পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি। নারী শ্রমিকদের বেতন বৈষম্যের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুরুষ শ্রমিকরা ভারি কাজগুলো করে, তাই তাদের বেতন বেশি। কিন্তু নারী শ্রমিকরা শুধু দাঁড়িয়ে বা বসে কাজ করেন। সে হিসেবে মজুরি দেওয়ার সময় নারীদের বৈষম্যের শিকার হতে হয়। আমরা চাই এই ধরনের মানসিকতা থেকে সমাজ মুক্তি পাক। পঞ্চগড়ের দুপ্রকের সদস্য সহিদুল ইসলাম সহীদ বলেন, পাথর শিল্পে নারী-পুরুষের মধ্যে আমরা একটা প্রার্থক্য লক্ষ্য করি। পুরুষ শ্রমিকরা যে মজুরি পেয়ে থাকেন নারী শ্রমিকরা তার থেকে মজুরি কম পেয়ে থাকেন। আমি মনে করি এ ধরনের প্রার্থক্য থাকা উচিত না। কারণ একজন নারী শ্রমিক পুরুষ শ্রমিকের মতোই সমানভাবে কাজ করেন। তাহলে সমান মজুরি পাওয়ার হক তাদেরও। আমি বিশ্বাস করি আমাদের পাথর সংশ্লিষ্ট ক্রাশিং মালিকরা রয়েছেন, তারা এই বৈষম্য কমাবেন এবং মজুরি সমান রাখবেন। পাথর ভাঙার মতো কঠিন কাজে নারী শ্রমিকরা ভীষণরকম বঞ্চনার শিকার এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না। জীবন নামের রেলগাড়িটা কবে স্টেশন খুঁজে পায় সেই আশায় প্রহর গুনছে তারা।

ইকো পার্ক ও ট্যুরিস্ট কটেজ

ইকো পার্ক ও ট্যুরিস্ট কটেজ

কেউ তৈরি করছেন বসতঘরের দরজা, জানালা, কেউ ফ্রেম আবার কেউ তৈরি করছেন দেয়াল। এমন কি ছাদও তৈরি হচ্ছে কাঠের। সবশেষে দক্ষ শ্রমিকদের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় রং পালিশে শেষ হচ্ছে নান্দনিক ও পরিবেশবান্ধব কাঠের বসতবাড়ি বা ট্যুরিস্ট কটেজ। এ ট্যুরিস্ট কটেজের ভেতর-বাইরে এমন অনিন্দ্য সুন্দর কারুকাজ, যা প্রথম দৃষ্টিতেই আকর্ষণ করে।   এমন দৃশ্য দেখা যায় বাগেরহাট সদর উপজেলার প্রত্যন্ত কররী গ্রামের একটি ফার্নিচারের কারখানায়। বাগেরহাট-খুলনা মহাসড়কের সিএনবি বাজারসংলগ্ন এ গ্রামের ‘ন্যাচারাল ফাইবার’ নামের কারখানায় তৈরি ঘরগুলো রপ্তানি করা হচ্ছে ইউরোপের দেশ বেলজিয়ামের ‘পাইরি ডাইজা ইকো পার্কে’।  শুধু এই ‘ট্যুরিস্ট-কটেজ’ নয়, কাঠ দিয়ে তারা তৈরি করছেন ‘বেবি ব্যালেন্স সাইকেল’, ‘সান বেড’, ‘হোটেল বেড’, ‘কুকুর-বিড়ালের খেলনা’সহ পরিবেশবান্ধব আরও আকর্ষণীয় ফার্নিচার। যার চাহিদা তৈরি হয়েছে বিশ্ববাজারে। এসব পণ্য নতুন বাজার ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের নবদিগন্ত উন্মোচিত করছে।

পরিবার হোক সুপরিকল্পিত

পরিবার হোক সুপরিকল্পিত

ধনধান্য পুষ্প ভরা আবহমান বাংলা। ডি এল রয়ের সাঙ্গিতীক মূর্ছনাই শুধু নয় সত্যিই শ্যামলের সমারোহে নদীমাতৃক দেশটির উর্বর পলিমাটিও বিধাতার উত্তম উপহার। আর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তো বলেই দিলেন- বীজ মাত্রই নাকি এখানে সোনা ফলে। সমুদ্র পরিবেষ্টিত শাশ্বত বাংলার নয়নাভিরাম শৌর্যের পাশাপাশি কত বিপদ-বিপত্তি যে মাথা চাড়া দেয় তাও সবুজের প্লাবনে ঝরা পাতার মর্মরধ্বনি। অনিন্য সুন্দর বাংলার সবচেয়ে বড় দুর্ভোগ জনসংখ্যার ভারে কত অসময়কে সামলাতে হয়। সাধারণ মানুষের অসচেতনতা, নির্বিকার জীবনাচরণ সঙ্গে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাপনার প্রতি চরম উদাসীনতা যেন লেগেই থাকে। ছোট্ট এই দেশটি ১৮ কোটি মানুষের কলকাকলিতে মুখরিত হলেও আয়তন অনুযায়ী অধিক জনসংখ্যার অঞ্চল হিসেবেও বিশেষভাবে চিহ্নিত।  জনসংখ্যা যদি নিয়মিত পালাক্রমে জীবন আর সমাজকে ভারবাহী করে তোলে তা হলে তো সমস্যা পদে পদে। বারবার সতর্ক বাণী উচ্চারণ করা হচ্ছে আয়তনের তুলনায় অধিক জনসংখ্যা দেশ ও জাতির অমঙ্গল বয়ে আনে। বাংলাদেশে এখনো সিংহভাগ মানুষ বাস করে গ্রামে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে। যেখানে শিক্ষার আলো সেভাবে সংশ্লিষ্টদের জীবনকে আধুনিকতার বলয়ে প্রতিফলিত না করাও। সমাজ সংস্কারের প্রচলিত বিধি। তাই বিবাহিত জীবনে যা সাবধান বাণী কোনোভাবেই দুটির বেশি অধিক সন্তান নয়। তা আজও কেন মান্যতা পেল না তেমন প্রশ্ন থেকেই যায়। মূল কারণ হিসেবে আলোচনায় চলেই আসে বাল্যবিয়ের মতো চিরায়ত অপসংস্কার। যা আজও ঠৈকানো গেল না। বাল্যবিয়ে মানেই অকাল মাতৃত্ব। শুধু কি তা-ই? অধিক সন্তানের জননী হওয়াও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো। এক প্রকার পথে পথে কাঁটা ছড়ানোর মতো। অপরিণত বিয়ে মানেই শিক্ষার যথার্থ আলো থেকে প্রায়ই বঞ্চিত। নিজের ভালো-মন্দ বোঝার আগেই তাকে কনের সাজে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। বিভিন্ন গবেষণামূলক প্রতিবেদনে উঠে আসে আরও দুঃসহ কণ্টাকিত পিচ্ছিল পথ। শুধু কি অকাল মাতৃত্ব? বলা হচ্ছে এক কন্যা শিশুর গর্ভে আর এক নবপ্রজন্মের ভ্রƒণ বড় হচ্ছে যে নাকি পৃথিবীর আলো দেখার জন্য অপেক্ষমাণ। তাই পরিবার পরিকল্পনার বিষয়টা উড়িয়ে না দিয়েও বলা যায় সবার আগে বাল্যবিয়ের লাগাম টেনে ধরা।  যে কোনো মূল্যে কন্যা শিশুর বিয়ে বন্ধ করা। ঊনবিংশ শতাব্দফর আধুনিক প্রাণপুরুষ বিদ্যাসাগর বলেছিলেন বালিকাদের বিয়ের পিঁড়ি নয় বিদ্যালয়ে পাঠাতে হবে। নিজের ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা অর্জনও জরুরি। আমাদের দেশে নাকি ৩ কোটি ৪৫ লাখ মেয়ের বিয়ে হয় ১৮ বছরের আগে, অর্থাৎ শরীর-মনের জন্য জরুরি সীমা রেখাটি লঙ্ঘন করা। আবার এক কোটি তিরিশ লাখের বিয়ে যে ১৫ বছরের নিচে। তাই সুস্পষ্টতই প্রতীয়মান দক্ষিণ এশিয়ার বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে আমরা এগিয়ে আছি। যে বালিকা বধূটি তার নিরাপত্তার বিষয়ে অজ্ঞাত সে কিভাবে ভাবী প্রজন্মের কথা ভাববার অবকাশ রাখবে? আর পরিবার পরিকল্পনা বিষয়টি তেমন সহজসাধ্য নয়। চিরায়ত সংস্কারের বেড়াজালে আবদ্ধ কোনো শিশু কন্যার নিজের মতো তৈরি হওয়ার আগেই আরেক শিশুর জন্ম দিয়ে বসে। সঙ্গত কারণে অতিরিক্ত জনসংখ্যা প্রতিরোধ করার প্রধান এবং প্রাথমিক কাজটিই হলো বাল্যবিয়েকে যে কোনো মূল্যে ঠেকানো। তার জন্য প্রয়োজন শিক্ষার আলোয় নিজেকে আলোকিত করা। আর নিজের ভালো-মন্দ বিবেচনার শক্তি ও সাহস ভেতরের বোধে জাগিয়ে তোলা।  স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই মিলিত সংসারে পরিবারের শক্ত ভিত তৈরি হয়। সেখানে শিশু কন্যার সঙ্গে নতুন গ্রন্থিতে যদি প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ তার ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দেন তা হলে বিপত্তি পদে পদে। সিংহভাগ গ্রামের অসচেতন এবং অশিক্ষিত স্বামী কোনোভাবেই বালিকা স্ত্রীকে সেভাবে মর্যাদা দেন না- কোনো কথায় কর্ণপাতও করেন না। আর পরিবার পরিকল্পনা? সেটা কোনো কাজের মধ্যে না আসাও পরিস্থিতির বিপন্নতা। অকাল কিংবা ঘন ঘন মাতৃত্বের কারণে নবজাতক শিশু মৃত্যু গণমাধ্যমের পাতাকে ভারি করে তোলে। তবে আমরা বাংলাদেশেও বিভিন্ন গ্রামে কমিউনিটি ক্লিনিক কিংবা সন্তান প্রসবের জন্য আধুনিক ব্যবস্থা দেখতে পাই। বলা হচ্ছে যান্ত্রিক কলা-কৌশলকে যত তাড়াতাড়ি মানুষ আয়ত্বে আনে সেখানে চিন্তা, চেতনা, মূল্যবোধ, চিরায়ত সংস্কার পাল্লা দিতে পারেই না। ক্রমশ পিছু হটে বলে বিভিন্ন অসঙ্গতি দৃশ্যমান হয়। যেমন পরিবার পরিকল্পনার হরেক পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তাকে সহজ বোধে, নির্ভীক চেতনায় গ্রহণ করার মানসিকতা এখনো যথেষ্ট পরিমাণে অপ্রতুল। তেমন অবস্থায় নব দম্পতিদের যদি সচেতন সাবধানতায় নিজেদের মনস্তাত্ত্বিক বিষয় তৈরি করা না যায় তা হলে পদ্ধতি কোনো কাজেই আসবে না। স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলেই সিদ্ধান্ত নেবেন একজন সন্তানের পর নিদেনপক্ষে ৩-৪ বছরের ব্যবধানে অন্য সন্তান নিয়ে ভাবা। সেখানেই শেষ নয়। দুটি সন্তানের পর আর কোনো সন্তানের চিন্তা করাও যেন ভাবার অবকাশ না থাকে। তাই কন্যাটিকে লেখাপড়ায় জ্ঞানের আলোকে উজ্জ্বল এক পরিবেশ দেওয়া বাঞ্ছনীয়। যাতে নিজেই সতর্ক অবস্থায় সুরক্ষিত বলয় তৈরি করতে পারে। ঘন ঘন সন্তান প্রসব ও মা আর শিশুর জন্য সুফল বয়ে আনে না। পরীক্ষিত এবং বাস্তবোচিত চিত্র। বাংলাদেশ এখন উন্নয়ন মহাযজ্ঞে সামনের দিকে ছুটে চলেছে। সঙ্গে মান্ধাতা আমলের বিধি, সংস্কার, চিন্তাও ঝেড়ে ফেলতে হবে।  পুত্র-কন্যা যেই পৃথিবীর আলো দেখুক সমতার ভিত্তিতে ভাই-বোনকে সমান সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তৈরি করা মা-বাবা দুজনেরই অপরিহার্য দায়বদ্ধতা। অবুঝ আর অবোধ বালিকাকে প্রথমেই পাঠাতে হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। জ্ঞানের শিখা বিচ্ছুরিত হয়ে সন্তান নিজের ভালো-মন্দ, আনন্দ, দুঃখ- সবই যেন তার চেতনায় ধারণ করতে পারে। নারী জাগরণের আর এক পথিকৃৎ বেগম রোকেয়াও সচেতন দায়বদ্ধতায় আবেদন জানিয়েছেন বালিকাদের জ্ঞানের জগৎকে উন্মুক্ত করে দিতে। যা শুধু নিজেকে নয় পুরো সামাজিক বলয়কে সমস্ত দুর্দশা আর অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে পারে। তিনি রংপুরের পায়রাবন্দ এলাকায় সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাই স্কুল নামে বালিকা বিদ্যালয় খোলার ইতিহাসও তৈরি করেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও নিজ উদ্যোগে বহু বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করে বাল্যবিয়ে, অপরিণত মাতৃত্ব ঠেকানোর উদাহরণ স্থাপন করেছিলেন। এখন আমরা একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের মধ্যগগনে।  ইতোমধ্যে বাল্যবিয়ে একদম কমছে না তা নয়। কিন্তু যতখানি প্রয়োজন সে তুলনায় অপ্রতুল। আর জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিও এখন গ্রামে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরবরাহ করা হচ্ছে সময়ের আবেদনে। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ শুধু মনস্তত্ত্ব কিংবা চেতনা গ্রহণের ব্যাপার নয়। শরীর-স্বাস্থ্য তার উপযোগী কি না সেটাও বিবেচ্য বিষয়। প্রয়োজনে চিকিৎসকের সেবা গ্রহণও আবশ্যক। তাই পরিবার পরিকল্পনার মতো আধুনিক চেতনা সমৃদ্ধ ব্যবস্থাপনা ক্রমশ এগিয়েও যাচ্ছে। সামনে তা আরও বাড়বে যদি অবোধ বালিকাদের বিয়ের পিঁড়িতে বসানো না হয়। যদি নিজেকে তৈরি করার সুযোগ আসে।