
ছবি:সংগৃহীত
দুইটি ইউরোপের শ্রেষ্ঠ ৪.৫ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান—ইউরোফাইটার টাইফুন এবং দাসো রাফেল—প্রায়ই একে অপরের সঙ্গে তুলনা করা হয়। তাদের দ্বৈত ইঞ্জিন এবং ডেল্টা-উইং-কানার্ড ডিজাইন দেখতে অনেকটা একই রকম হলেও, পারফরমেন্সের দিক থেকে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। বর্তমান সময়ে এই দুটি বিমানই পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত যুদ্ধবিমানগুলোর মধ্যে একটি। তবে একটু গভীরভাবে খেয়াল করলে দেখা যায়, প্রতিটি বিমান তার নির্মাতার কৌশলগত চিন্তাধারা তুলে ধরে।
ইউরোফাইটার টাইফুন মূলত গতি, দ্রুত প্রতিক্রিয়া এবং আকাশে আধিপত্য বিস্তার করার দিকে বেশি মনোযোগী। এটি একটি চার-দেশের প্রকল্প—যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি এবং স্পেন—এবং বিশেষভাবে এটি উচ্চ গতির ডগফাইট এবং আকাশের নিয়ন্ত্রণে অসাধারণ পারফরমেন্স প্রদান করে। অন্যদিকে, রাফেল কিছুটা গতি এবং উচ্চতার থেকে ছাড় দিয়েছে, তবে এটি আরও বেশি বৈচিত্র্যময়। রাফেল দ্রুত না হলেও তার পাল্লা আরও বড়, বহন ক্ষমতা বেশি, এবং এর একটি ক্যারিয়ার-রেডি সংস্করণ (রাফেল এম) রয়েছে, যা ইউরোপে একমাত্র যুদ্ধবিমান যা বিমানবাহী জাহাজ থেকে উড্ডয়ন করতে সক্ষম। তাই ইউরোফাইটার টাইফুনকে বলা যেতে পারে তীক্ষ্ণ তলোয়ার, তবে রাফেলকে বলা যেতে পারে আরও বেশি কার্যকর সুইস আর্মি চাকু।
পেপারের উপর তুলনা
যখন সঠিক সংখ্যা এবং স্পেসিফিকেশনগুলো দেখা যায়, তখন এই দুই বিমানই প্রায় সমান পারফরমেন্স দিতে পারে, তবে তাদের মধ্যে কিছু পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ইউরোফাইটার টাইফুনের দ্বৈত EJ200 ইঞ্জিন প্রতি ৯০ কিলোনিউটন থ্রাস্ট প্রদান করে, যা রাফেলের Snecma M88-4e ইঞ্জিনের থেকে শক্তিশালী (প্রতি ৭৫ কিলোনিউটন)। এই অতিরিক্ত শক্তি টাইফুনকে দ্রুত অবস্থায় ফিরে আসতে সাহায্য করে, যা ডগফাইটের ক্ষেত্রে বড় সুবিধা। একাধিক RAF পাইলট এমনকি বলেছেন যে তারা রাফেলকে ট্রেনিং মিশনে পরাজিত করতে পেরেছেন, এর কারণ ছিল টাইফুনের ইঞ্জিন পারফরমেন্স।
রেঞ্জের দিক থেকে রাফেল এগিয়ে, এর রেঞ্জ ২,৩০০ মাইল, যেখানে ইউরোফাইটার টাইফুনের রেঞ্জ মাত্র ১,৮০০ মাইল। তবে, টপ স্পিডের ক্ষেত্রে দুটি বিমানই মাচ ১.৮ তে সমান। উচ্চতার দিক থেকে, টাইফুন একটু এগিয়ে, এটি ৫৫,০০০ ফুট পর্যন্ত উড়তে পারে, যেখানে রাফেলের সীমা ৫০,০০০ ফুট। তবে রাফেল পাল্লা এবং বহন ক্ষমতায় এগিয়ে, এটি ২১,০০০ পাউন্ড পর্যন্ত বহন করতে সক্ষম, যা টাইফুনের ১৬,৫০০ পাউন্ডের চেয়ে বেশি।
অস্ত্র ও অস্ত্রসজ্জা
অস্ত্রশস্ত্রের ক্ষেত্রে, দুটি বিমানই অত্যাধুনিক ও শক্তিশালী। টাইফুন বহন করে AMRAAM, Storm Shadow, Brimstone, ASRAAM মিসাইল এবং একটি ২৭ মিমি Mauser গান। রাফেল একইভাবে মিসাইল বহন করে, যেমন MICA, Scalp, Exocet, Hammer এবং একটি ৩০ মিমি NEXTER গান। পাশাপাশি, উভয় বিমানই Meteor মিসাইল বহন করে, যা ১২৫ মাইল রেঞ্জ সহ "নো এসকেপ জোন"-এর জন্য পরিচিত।
বিক্রির দিক থেকে পার্থক্য
ইউরোফাইটার টাইফুন এবং দাসো রাফেল, এই দুটি বিমান একসময় একই প্রকল্পের অংশ ছিল। তবে, ১৯৮৫ সালে ফ্রান্স আলাদা হয়ে গিয়েছিল এবং এরপর দুইটি ভিন্ন ধরনের যুদ্ধবিমান তৈরি হয়েছিল, যার ফলে পারফরমেন্সের কিছু পার্থক্য তৈরি হয়েছে। ২০২৪ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৬৮০টি ইউরোফাইটার টাইফুনের অর্ডার হয়েছে। স্পেন এবং ইতালি পুরনো মডেলগুলোকে নতুন টাইফুন দিয়ে প্রতিস্থাপন করছে। অন্যদিকে, রাফেল বিক্রি হয়েছে ৪৯৫টি, এবং সম্প্রতি ভারতের মতো দেশগুলি এটির ওপর আস্থা রেখেছে।
কিন্তু পারফরমেন্সের দিক থেকে, এই দুটি বিমানের মধ্যে এত বড় কোনো পার্থক্য নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা একে অপরের সাথে মুখোমুখি হবে না, কারণ তাদের ক্রেতারা প্রায়শই একই রাজনৈতিক পক্ষের। তাই, এই যুদ্ধবিমানের মধ্যে কোনটি সফল, তা নির্ধারণ করার জন্য অর্ডার সংখ্যা এবং খরচের দিকে নজর দিতে হবে, যা বেশিরভাগ দেশ আজকাল বেশি গুরুত্ব দেয়।
এখানে, রাফেল কিছুটা এগিয়ে, কারণ এটি সস্তা, রক্ষণাবেক্ষণ সহজ, এবং প্রতি এক্সপোর্ট ইউনিটের দাম প্রায় $২৪৫ মিলিয়ন। অন্যদিকে, ইউরোফাইটার টাইফুনের দাম প্রায় $৩২১ মিলিয়ন—যা অনেকের কাছেই অবাক করার মতো, বিশেষত কুয়েতের মতো দেশে যেখানে নতুন যুদ্ধবিমান যেমন F-35 আরো সাশ্রয়ী মনে হয়।
পারফরমেন্সের দিক থেকে এই দুটি বিমান তুলনামূলকভাবে কাছাকাছি, তবে ব্যবহারের ধরন, রক্ষণাবেক্ষণ এবং খরচের দিক থেকে রাফেল কিছুটা এগিয়ে। এই দুই বিমানই বিশ্বের আকাশে নিজেদের ছাপ রেখে চলেছে, এবং ভবিষ্যতে নানা যুদ্ধ পরিস্থিতিতে তাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
মারিয়া