ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৭ জুলাই ২০২৫, ২ শ্রাবণ ১৪৩২

গোপালগঞ্জে এনসিপি’র সভাস্থল-গাড়ীবহরে হামলা: আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে তিনজনের মৃত্যু

নিজস্ব সংবাদদাতা, গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ১৯:৩৭, ১৬ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ১৯:৩৮, ১৬ জুলাই ২০২৫

গোপালগঞ্জে এনসিপি’র সভাস্থল-গাড়ীবহরে হামলা: আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে তিনজনের মৃত্যু

ছবি: জনকণ্ঠ

এনসিপি’র আহবায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, আমরা আজকে গোপালগঞ্জে এসেছি দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা কর্মসূচী নিয়ে। কোন যুদ্ধের আহবান নিয়ে নয়, শান্তি এবং দেশ গড়ার আহবান নিয়ে আজ গোপালগঞ্জ এসেছি। আমরা গোপালগঞ্জের নাম বদলাইতে আসিনি। আমরা এসেছি ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে গোপালগঞ্জের মানুষের যাতে অধিকার রক্ষা করা হয়। বুধবার বিকেলে গোপালগঞ্জ শহরের পৌরপার্কের উন্মুক্ত মঞ্চে এনসিপি’র সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি আর বলেন, মুজিববাদীরা আজকে বাধা দিয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা বলেছিলাম, বাধা দিলে বাধবে লড়াই। সেই লড়াইয়ে জিততে হবে এবং সেই লড়াইয়ে আমরা জিতেছিলাম। আজকে আবারও বাধা দেয়া হয়েছে; দ্বিগুণ গতিতে এর জবাব আমরা দেব, ইনসাল্লাহ। 
যারা এই নতুন বাংলাদেশের পক্ষে রয়েছেন আপনাদেরকে দায়িত্ব নিতে হবে এই গোপালগঞ্জে যেন মুজিববাদীদের আশ্রয়কেন্দ্র হয়ে উঠতে না পারে। যদি পুলিশ প্রশাসন ব্যর্থ হয়, তাহলে নিজেদের এবং নিজেদের জেলার মর্যািদা রক্ষা করার দায়িত্ব, বাংলাদেশেকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের নিজেদেরকেই নিতে হবে; যেরকমটা আমরা গণ-অভ্যুত্থানে নিয়েছিলাম। আর গোপালগঞ্জ নামে এই বাংলাদেশে এবং সামনের বাংলাদেশে কোন বৈষম্য হবে না। গোপালগঞ্জ নামেও চাকরিতে কোন বৈষম্য আমরা সহ্য করব; কিন্তু গোপালগঞ্জে কোন সন্ত্রাসীদের আস্তানাও আমরা সহ্য করব না। মুজিববাদীরা মুক্তিযুদ্ধকে কলুষিত করেছে, গোপালগঞ্জকেও কলুষিত করেছে। সেই গোপালগঞ্জকে আমরা আবার পুনরুদ্ধার করব, আবার সমুন্নত করব। 
আজকে মুজিববাদীরা বাধা দিয়েছে। তাদেরকে জবাব দেয়া হবে। আজকে এখানে দাড়িয়ে যদি আমরা ঘোষণা দেই, সারা বাংলাদেশ এই গোপালগঞ্জে এসে জড়ো হবে। কিন্তু আমরা সময় দিয়ে যাচ্ছি। আজকে যে বাধা দেয়া হল, কারা বাধা দিয়েছে, কোন সাহসে বাধা দিয়েছে, কোন সাহসে মুজিববাদীরা এখনও গোপালগঞ্জে আশ্রিত রয়েছে, কারা আশ্রয় দিয়েছে, দ্রুত সময়ে মধ্যে যদি এদের বিচার করা না হয়, আমরা আবারও আসবো গোপালগঞ্জে। আমরা নিজ হাতে দায়িত্ব নিয়ে গোপালগঞ্জকে মুজিববাদীদের থেকে মুক্ত করব। 
মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছেন, প্রিয় গোপালগঞ্জবাসী, হাসিনা আপনাদের ছেড়ে পালিয়েছেন। গোপালগঞ্জকে যদি উনি ধারণ করতেন তাহলে ভারতে না গিয়ে তিনি গোপালগঞ্জেই আসতেন। উনি এতো স্বার্থপর, উনি আর ওনার ফ্যামিলির মানুষ ছাড়া গোপালগঞ্জবাসীর কথা একবারও ভাবেন নাই। গোপালগঞ্জ বাংলাদেশ হয়ে উঠতে পারে নাই। আওয়ামী লীগ পরিকল্পিতভাবে গোপালগঞ্জকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সংকটে ফেলেছে। গোপালগঞ্জবাসীকে আশ্বস্ত করে তিনি বলেন, গোপালগঞ্জ বাংলাদেশের, ফেনীও বাংলাদেশে, বগুড়াও বাংলাদেশের, বাংলাদেশ ৬৪টি জেলার সবার জন্য লড়াই করব, সবার জন্য সমানভাবে লড়াই করব। 
তিনি আরও বলেন, আমরা আপনাদেরকে জালিমের হাত থেকে মুক্ত করেছি। ইনসাফের বাংলাদেশ গড়ার জন্য আপনাদেরকে সাথে নিয়ে আমরা একসাথে ইনসাফের বাংলাদেশ গড়ব। এরপর তিনি ‘মুজিববাদের আস্তানা ভেঙ্গে দাও গুড়িয়ে দাও’, ‘ইনকিলাব ইনকিলাব জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ’ স্লোগান দেন। 
এনসিপি’র সদস্য-সচিব আখতার হোসেন বলেছেন, আমরা আপনাদের মতো হিংস্র নই। কিন্তু প্রতিশোধ নিতে আমাদেরকে বাধ্য করবেন না। যদি ভারতে প্রেসক্রিপশনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও জনগণের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে চান, এদেশের জনগণ আপনাদেরকে আস্ত রাখবে না। 
তিনি আরও বলেন, ওই আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। মুজিববাদ  বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি। আর মুজিববাদী সংবিধান আমাদের নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে প্রধানতম অন্তরায়। অতএব আওয়ামী লীগ ও মুজিববাদের সাথে সাথে মুজিববাদী সংবিধানেরও কবর রচনা করা হবে। ফ্যাসিবাদ চলে যাবার পরেও ফ্যাসিবাদের দালালদের আস্ফালন এখনও কমে নাই। 
সিনিয়র মুখ্য সমন্বয়ক নাসিরুদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, শেখ হাসিনার দ্বারা গোপালগঞ্জবাসীও বঞ্চিত হয়েছে, বৈষম্যের শিকার হয়েছে। তাকে আমরা ভারতে পাঠিয়ে দিয়েছি। গোপালগঞ্জবাসীর আর কোন ভয় নাই। আমরা একটি নতুন বাংলাদেশ গঠনের জন্য একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছি। বাংলাদেশে শেখ পরিবার থেকে যে পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি হয়েছে, সে রাজনীতি থেকে বাংলাদেশেকে ভালোবেসে নতুন একটি বাংলাদেশ গঠনের অভিপ্রায়ে বাংলাদেশমুখী রাজনীতি করতে চাচ্ছি। আপনারা আমাদের সাথে থাকবেন। যারা নির্যাজতিত ও নিপীড়িত হয়েছেন, আমরা আপনাদের সাথে থাকার চেষ্টা করব। 
জেলা এনসিপি’র আয়োজনে অনুষ্ঠিত সভা পরিচালনা করেন দলের মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম। এছাড়াও এনসিপি নেতা অনিক রায়, খোকন চন্দ্র বর্মন, ইঞ্জিনীয়ার মেজর সালাউদ্দীন, খেলাফত মজলিস নেতা মাওলানা হেদায়েতুল্লাহ জেলা এনসিপি’র প্রধান সমন্বয়কারী আরিফুল দাড়িয়া, প্রমূখ বক্তব্য রাখেন। এসময় মঞ্চে দলের অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দও উপস্থিত ছিলেন। 
এর আগে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে এনসিপি’র কেন্দ্রীয় কর্মসূচি জুলাই পদযাত্রাকে কেন্দ্র করে গোপালগঞ্জ-টেকেরহাট সড়কে সদর উপজেলার উলপুর এলাকায় পুলিশের গাড়িতে আগুন দেয় ছাত্রলীগের সমর্থকরা। পরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়।
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে গোপালগঞ্জ-কোটালীপাড়া সড়কে কাজুলিয়া এলাকায় গাছ কেটে রাস্তায় ফেলে যান-চলাচল বন্ধ করে দেয় এলাকার উত্তেজিত জনতা। খবর পেয়ে সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার এম রকিবুল হাসান সেখানে গেলে উত্তেজিত লোকজন তার গাড়ীও ভাংচুর করে। এসময় তিনি ও তার সঙ্গে থাকা ম্যাজিস্ট্রেট রাসেল মুন্সী, পরিসংখ্যান অফিসার উজ্জ্বল বিশ্বাস ও গাড়ীর ড্রাইভার হামিম আহত হন। 
বেলা দেড়টার দিকে একদল উত্তেজিত জনতা অতর্কিতে সভাস্থলে হামলা চালায় এবং চেয়ার-টেবিলসহ সভামঞ্চে ভাংচুর করে। এসময় সভামঞ্চের পাশেই একটি ককটেল বিস্ফোরিত হয়। পরে পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এগিয়ে গেলে হামলাকারীরা দ্রুত সভাস্থল ত্যাগ করে। এর কিছুক্ষণ পর এনসিপি নেতৃবৃন্দ সভাস্থলেপৌঁছান। 
বিকেল ৩টার দিকে সভা শেষ করে এনসিপি নেতৃবৃন্দ সভাস্থল থেকে রওনা হলে শহরের বঙ্গবন্ধু সড়কে উত্তেজিত জনতা ইট-পাটকেল ও লাঠিসোটা নিয়ে তাদের গাড়ীবহরে আবারও হামলা চালায়। এসময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ র্যা বসহ সেনাসদস্যরা টিয়ারগ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড ও ফাঁকা গুলিবর্ষণ শুরু করে। মুহূর্তেই গরম হয়ে ওঠে শহরের প্রাণকেন্দ্র। চারিদিকে শুরু হয় দৌড়াদৌড়ি।  উত্তেজিত জনতা একপর্যায়য়ে সভামঞ্চে আগুন ধরিয়ে দেয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে পুরোদমে শুরু হয় সংঘর্ষ। সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে শহরের বিভিন্ন সড়কে।  বিকেল সাড়ে ৫টা পর্য্ন্ত দফায় দফায় চলে সে সংঘর্ষ। এরই মধ্যে গোপালগঞ্জ সেনাবাহিনীর সাজোয়া যানে করে এনসিপি নেতৃবৃন্দ গোপালগঞ্জ ত্যাগ করেন। 
সর্বশেষ জানা গেছে, সংঘর্ষে রমজান, দীপ্ত ও সোহেল রানা নামে তিনজন মারা গেছে। এছাড়াও আহত হয়েছেন আরও অন্ত:ত ২০ জন। চিকিৎসার জন্য কেউ কেউ খুলনায় রওনা হয়ে গেছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। 
এ ঘটনায় রাত ৮টা থেকে বৃহষ্পতিবার সকাল ৬টা পর্যগন্ত গোপালগঞ্জে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে।

শিহাব

×