ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৭ জুলাই ২০২৫, ২ শ্রাবণ ১৪৩২

অসুস্থ মা-বাবার সেবায় নিবেদিত আপন, এসএসসিতে জেলার সেরা

মিজানুর রহমান, নাগেশ্বরী, কুড়িগ্রাম

প্রকাশিত: ০০:১৩, ১৭ জুলাই ২০২৫

অসুস্থ মা-বাবার সেবায় নিবেদিত আপন, এসএসসিতে জেলার সেরা

ছবি: জনকণ্ঠ

রাত তখন সাড়ে দশটা। কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারীর একটি প্রত্যন্ত গ্রামের ছোট্ট টিনের ঘরে আলো জ্বলছে শুধু রান্নাঘরের কোণায়। সেখানে বসে গণিতের জটিল সূত্র মেলানোর চেষ্টা করছে এক কিশোর। হঠাৎ পাশের ঘর থেকে ভেসে আসে মায়ের গোঙানির শব্দ। খানিক পরেই বাবাকে ওষুধ খাওয়ানোর সময়। কিশোরটির নাম নুরুন্নবী ইসলাম আপন। বয়স মাত্র ১৬ বছর। অথচ এই বয়সেই সে একসঙ্গে ছাত্র, অভিভাবক ও সংসারের কর্তা।

এই সংগ্রামী কিশোর ২০২৫ সালের কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষায় কুড়িগ্রাম জেলার মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর (২৩৩০/২৬০০) পেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। তার স্কুল—নাগেশ্বরী সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। শিক্ষকদের ভাষায়, "আমরা অনেক মেধাবী ছাত্র দেখেছি, কিন্তু এমন বাস্তবতা পেরিয়ে এমন রেজাল্ট—এটা বিরল।"

আপনের মা নুরজাহান বেগম বিগত ১০ মাস ধরে শয্যাশায়ী। চলাফেরা তো দূরের কথা—সোজা হয়ে বসতেও পারেন না। বাবা বাচ্চু মিয়া কাঠমিলে কাজ করতে গিয়ে ৯ মাস আগে দুর্ঘটনায় পড়ে পা ভেঙেছেন। তিনিও চলাফেরায় অক্ষম।

এমন পরিস্থিতিতে ছোট ছেলেটাই এখন বাবা-মায়ের দেখভাল করে। সকালবেলা টিউশনি, দুপুরে ক্লাস, সন্ধ্যায় সংসারের কাজ—এই চক্রেই চলে তার প্রতিদিন। আপন বলেন, “আব্বু পড়ে যাওয়ার পর বুঝলাম—আমি আর শুধু ছাত্র না, আমাকে এই সংসারের দায়িত্ব নিতে হবে। দু’মুঠো খাবার জোগাড় করেই চলে পড়াশোনা।”

অষ্টম শ্রেণিতে থাকতেই টিউশনি শুরু করে আপন। এখন দিনে তিনটি টিউশন করে তার সঞ্চয়েই চলে ওষুধ, চাল, ডাল, চিকিৎসা ও লেখাপড়ার খরচ। বন্ধু রাকিবুল হাসান রোমান বলেন, “স্কুলে সবাই জানত ও মেধাবী, কিন্তু ও যে কী ভয়াবহ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যায়, তা কেউ বুঝত না। ও কখনো অভিযোগ করেনি, বরং ক্লাসের ফাঁকে নীরবে বই পড়ত।”

নাগেশ্বরী টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাডেমিক ইনচার্জ শামীম আজম বলেন, “আপনের মতো প্রতিভাবান ছাত্রকে নিয়ে আমরা গর্বিত। সরকারের উচিত তার উচ্চশিক্ষার দায়িত্ব নেওয়া।”

আপনের বাড়ি ভুরুঙ্গামারী উপজেলার আন্ধারীঝার ইউনিয়নে। তিন ভাইবোনের মধ্যে সে সবচেয়ে ছোট। বড় দুই বোনের কেউই অর্থাভাবে লেখাপড়া চালাতে পারেননি—একজন দশম শ্রেণি থেকে, অন্যজন এসএসসি পাশ করেই বিয়ে করেছেন।

তার মা বলেন, “আমার ছেলেটা না থাকলে আমরা বাঁচতাম না। নিজে না খেয়ে আমাদের খাওয়ায়। এত কষ্ট করেও এমন রেজাল্ট করেছে, আল্লাহর রহমত ছাড়া এটা হতো না।”

প্রতিবেশী ও আন্ধারীঝার ইউপি সদস্য এরশাদুল হক বলেন, “আপনের সাফল্য শুধু তার পরিবার না, গোটা গ্রামের গর্ব। সরকারের উচিত তার পাশে দাঁড়ানো।”

পাঠ্যবইয়ের বাইরেও আপনের আগ্রহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে। টানা দুই বছর উপজেলা পর্যায়ে বিজ্ঞান মেলায় সেরা হয়েছে, পুরস্কার তুলে দিয়েছেন ইউএনও নিজে। তবে কোচিংয়ের সুযোগ কখনোই পায়নি। কারণ, আয়ের যা অবস্থা, তাতে বাড়তি খরচ একদমই সম্ভব নয়।

আপন বলেন, “আমি চাই একজন দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার হতে, দেশের জন্য কিছু করতে। কিন্তু এখনো কোচিংয়ে ভর্তি হতে পারিনি। টিউশনের আয়েই কোনোমতে সংসার চলে।”

২০২৫ সালের এসএসসি (কারিগরি বোর্ড) পরীক্ষায় কুড়িগ্রাম জেলায় অংশ নেয় প্রায় ৪০০ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে নাগেশ্বরী উপজেলায় ১০১ জন এবং কুড়িগ্রাম সদরে ২৭৯ জন। সব পরীক্ষার্থীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে আপন—২৩৩০।

ফলাফলটি শুধু একটি কিশোরের অর্জন নয়, বরং এক অনুপ্রেরণার নাম হয়ে উঠেছে সে। নুরুন্নবী ইসলাম আপনের গল্প কেবল একটি ভালো ফলাফলের নয়—এটা অন্ধকার ঘরে আলো জ্বালানোর গল্প, একটা কিশোরের হার না মানা যাত্রার গল্প। তার মতো ছেলেরা হারায় না, বরং হারিয়ে যাওয়া মানুষের পথ দেখায়।

শহীদ

×