ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৭ জুলাই ২০২৫, ২ শ্রাবণ ১৪৩২

ওই পদ্ম চোখের নীল যমুনা...‘তুমি বিন্যাবতী ছিলে’

আজও মুগ্ধতা ছড়ায় পৌরাণিক ঐতিহ্যের নীলসাগর

তাহমিন হক ববী

প্রকাশিত: ০০:০৩, ১৭ জুলাই ২০২৫

আজও মুগ্ধতা ছড়ায় পৌরাণিক ঐতিহ্যের নীলসাগর

নীলফামারীর বিন্যাবতীর নীলসাগর নান্দনিক সৌন্দর্যের আধার

এক সময় বিরাট রাজার রাজত্ব ছিল উত্তরাঞ্চলের নীলফামারী থেকে গাইবান্ধা হয়ে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত। বহু বছরের এই রাজত্বে নীলফামারীতে একটি দীঘি খনন করেছিলেন সেই রাজা। সেই দীঘির নাম দেওয়া হয় ‘বিন্যাবতী’। পুরাণ মতে, বিন্যাবতী ছিলেন বিরাজ রাজার কন্যা। কালের বিবর্তনে বিন্যাবতী দীঘির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় নীলসাগর।

বহুকালের সেই বিন্যাবতীর ঘাটে শীত বা গ্রীষ্মকালে আজও মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে প্রকৃতি। কখনো কখনো রঙ বদলায়। অনেকে আবার মনে করেনÑ বিরাট রাজার মেয়ে বিন্যাবতী যেন তার লাল ও বেগুনি রাঙা রূপ ফুটে তুলেছেন দীঘির জলে পদ্মফুলে। এই প্রকৃতিতেই যেন বেজে ওঠে বিন্যাবতীর পায়ের মল।
নীলফামারীর কৃতি সন্তান কবি ও সাংবাদিক মু আ কুদ্দুস সম্প্রতি তার লেখা একটি কবিতার বইয়ের নাম দিয়েছেন ‘তুমি বিন্যাবতী ছিলে’। কবিতার কয়েকটি লাইনে তিনি উল্লেখ করেছেন ‘তুমি এক কালে বিন্যাবতী ছিলে, কখনো নীল জলে আসো বেনারসি নয়তো উদয়ের রঙে, তোমার নাম বদলেছে গো নীলাম্বরী, তোমার নাম বিন্যাবতী নেই গো-নীলসাগরের জল ¯œান করতে যেথায়। তুমি এক কালে ছিলে জমিদার রাজার মেয়ে নন্দিনী... একবার শাপলা তুমি-একবার পদ্ম তুমি,-চোখ খুলে দাও জলে, সহ¯্রপ্রেমিক আজও খুঁজে তোমাকে নীলসাগরের নীলে...।’
কবিতার মতোই বিন্যাবতীর জল আর পদ্মর মিতালি দেখতে আসেন দর্শনার্থীরা। প্রকৃতির দ্বারে দাঁড়িয়ে, গাছগাছালিতে ঘেরা  সৌন্দর্যম-িত বিশাল দীঘি নীলসাগর। চারদিকে সবুজের সমারোহ। তাই অনেক দর্শনার্থী ‘বিখ্যাত শিল্পি শ্যামল মিত্রের কণ্ঠের গানের কিছু লাইন গেয়ে ওঠেন 
‘ওই পদ্ম চোখের নীল যমুনায় আমি ঝাঁপ দিয়েছি—-
দিনের বেলায় আকাশটাতে নিচেই তারা খুঁজেছি,
আলতা রাঙা কোকিল সেজে তাইতো গান ধরেছি....।’ 
আবার শীতকালে দূর দেশের পরিযায়ীরা দীঘিজুড়ে জলসা ঘরে পরিণত করে। পরিযায়ী পাখির আগমনে নান্দনিকতার পাশাপাশি বেড়ে যায় সৌন্দর্য।  খুনসুটিতে মেতে থাকে পাখিরা। কখনো ঝাঁকবেঁধে নান্দনিক কসরতে ডানা মেলে নীল আকাশে ওড়াউড়ি করে- আবার কখনো দীঘির পানিতে ভেসে বেড়ায়। সেই সৌন্দর্য ও নান্দনিকতার কিচিমিচির ডাক শুনে মনে হবে প্রয়াত কণ্ঠশিল্পী মান্না দের গাওয়া একটি গান, 
‘আমি যে জলসা ঘরে বেলোয়ারী ঝাড় ...
আমি যে আতর ওগো আতরদানে ভরা 
আমারই কাজ হলো যে গন্ধে খুশি করা...’
উত্তরাঞ্চলের নীলফামারী জেলা সদরের গোড়গ্রাম ইউনিয়নের ধোবাডাঙ্গা মৌজায় ৫৩.৯০ একর জমির ওপর নীলসাগরের এই বিন্যাবতী দীঘির অবস্থান। নীলফামারী জেলা শহর থেকে পাকা সড়ক ধরে পাড়ি দিতে হয় মাত্র ১৪ কিলোমিটার পথ। এর জলভাগ ৩২.৭০ একর এবং চারদিকের দীঘিপাড়ের জমির পরিমাণ ২১ একরের মতো। দীঘির গড় গভীরতা ৩০ ফুট। সারাবছর দীঘিতে ভরে  থাকে পানি।

১৯৮৩ সালে নীলফামারীর তৎকালীন জেলা প্রশাসক এম এ জব্বার এই দীঘিকে পর্যটন ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত করতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং নীলফামারীর নামানুসারে ‘বিন্যাবতী’  দীঘির পরিবর্তে এর নামকরণ করেন ‘নীলসাগর’। মহাস্থানগড় জাদুঘরের সহকারী তত্ত্বাবধায়ক এস এম হাসনাত বিন ইসলাম জানান, বিরাট রাজার এই বিন্যাদীঘি খননে আরও অনেক প্রাচীন নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যাবে। ১৮০৭-১৮০৮ সালে ব্রিটিশ প্রতœতত্ত্ববিদ ড. ফ্রান্সিস এ অঞ্চল ভ্রমণ করেছিলেন।

সূত্রমতে, রাজা বিরাট আজও স্বনামধন্য এবং রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের এই এলাকাটি বার্ষিক তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত। নীলফামারীর এই স্থানে ঐতিহাসিক মৎস্য দেশের রাজধানী ও সনাতন (হিন্দু) সম্প্রদায়ের অন্যতম তীর্থক্ষেত্র। হিন্দু পৌরাণিক উপাখ্যান মহাভারতের বর্ণনায়  রাজা বিরাটের নাম উল্লেখ রয়েছে। পৌরাণিক কাহিনী মতে, রাজা বিরাট নেপাল রাজ্যের বৈরাট নগরাধিপতি মহারাজ উত্তরের একমাত্র পুত্র ছিলেন। তিনি মৃগয়ার্থে বৈরাট নগর হতে আলোচ্য বিরাটে আগমন করেন। এই বিরাট বনের এক উচ্চ ভূমিতে রাজবাড়ী ও নগর স্থাপন করেন। মহাভারতে বিরাট রাজাকে বিরাট নামেই অভিহিত করা হয়।

তিনি তার রাজ্যে হাজার হাজার দীঘি-পুষ্করিণী খনন করে মৎস্য চাষ করে ‘মৎস্যরাজ বিরাট’ নামে খ্যাত হয়েছিলেন। উত্তর-দক্ষিণে লম্বা এ দীঘিকে ঘিরে রয়েছে বহু উপাখ্যান ও রূপকথা। কথিত আছে তৎকালীন বিরাট রাজা নামে বসবাস ছিল এখানে। তার বিপুলসংখ্যক গবাদিপশু ছিল। এ গবাদিপশুগুলোকে গোসল ও পানি খাওয়ানোর জন্য একটি দীঘি খনন করেন। রাজার  মেয়ে বিন্যাবতীর নামে দীঘির নামকরণ করা হয় ।

নীলসাগর নামে নীলফামারী-ঢাকা পথে ২০০৭ সালে চালু করা হয় আন্তঃনগর নীলসাগর এক্সপ্রেস। ট্রেনটি আজও তার জনপ্রিয়তা ধরে রেখে নিয়মিত চলাচল করছে।
বিন্যাবতীর রূপের এই নীলসাগর শীত মৌসুমে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে হাজার হাজার অতিথি পাখির আগমন ঘটে। এ সময় পাখির কলকাকলীতে মুখরিত হয়ে ওঠে নীলসাগর। এ সৌন্দর্য উপভোগ করতে বিভিন্ন এলাকা থেকে আগমন ঘটে অনেক দর্শনাথীর।

জনশ্রুতি রয়েছে, ১৯৯৩ সালে সংস্কারের সময় দীঘির তলদেশে পাওয়া গিয়েছিল স্বর্ণ, রৌপ্য এবং কষ্টিপাথরের মূল্যবান মূর্তি। তবে মজার ব্যাপার হলো, এই দীঘির গভীরতার প্রায় ৩০ ফুট নিচে মাটির তলদেশে মন্দিরের অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও সেখানে বাস করত বিশাল আকৃতির দুটি মাছ। ডুবুরিরা এই মন্দিরের ভেতরে যেতে পারেননি। কারণ, তাদের নাকি অলৌকিকভাবে ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছিল। কথিত আছে, এক সময়  বিন্যাবতীর দীঘির পানি শুকানোর জন্য অনেক মেশিন বসানো হয়েছিল।

কিন্ত পানির উচ্চতার কোনো পরিবর্তন হয়নি। লোকমুখে শোনা যায়, অতীতে গ্রামের লোকজন বিন্যাদীঘির পানিতে গাভীর প্রথম দুধ উৎসর্গ করতেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই দুধ চক্রাকারে ঘূর্ণায়মান অবস্থায় দীঘির মাঝখানে চলে যেত। তাদের বিশ্বাস ছিল, এতে গাভীর দুধ বেশি হবে এবং অনিষ্টকারীর দৃষ্টি থেকে গাভীটি রক্ষা পাবে। সত্য-মিথ্যা যাই হোক, দিন দিন মানুষের আনাগোনা বৃদ্ধি এবং জনপ্রিয়তা বাড়ায় উন্নয়নের ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে নীলসাগরে।
এ ব্যাপারে নীলফামারী জেলা প্রশাসক কার্যালয় সূত্র জানায়, বিভিন্ন সময়ে নীলসাগরের ভূমি উন্নয়ন, সীমানা প্রাচীর, আরসিসি বেঞ্চ, গার্ডশেড, রেস্ট হাউজ, টিনশেড ঘরসহ শেড, নলকূপ, অভ্যন্তরীণ সড়ক, পার্কিং এলাকা, আসবাবপত্র, ক্রোকারিজ, বৃক্ষ রোপণ ও পরিচর্যা, মৎস্য চাষ ও পরিচর্যাসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করা হয়েছে। রয়েছে শিশুদের রাইডস।
 দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক দর্শনার্থী নীলফামারী এসে বিন্যাবতীর রূপের নীলসাগরের প্রেমে পড়েছেন। লাল, নীল পদ্ম ফুটে উঠেছে- দীঘির পাড়ে রয়েছে বাতাসে দোল খাওয়া ফুলের সৌদর্য। আছে জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে রেস্ট হাউজ। ২০২০ সালে এই বিন্যাবতীর পাড়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক চারুকলা উৎসব। এ ছাড়া প্রতিবছর এখানে  চৈত্র সংক্রান্তিতে মেলা বসে। দীঘিতে অনেক মাছ চাষ হয়।

ইচ্ছে করলে টিকিট কেটে ছিপ দিয়ে মাঝ শিকার করতে পারবেন যে কেউ। পাশাপাশি এই দীঘির পানিতে ওই এলাকায় ধান উৎপাদনে সেচ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। বাংলার ছয় ঋতুতে এই দীঘির পানি কোনো সময় শুকিয়ে যায় না। বর্ষাকাল থেকে গ্রীষ্মকাল পানিতে ভরা থাকে দীঘি।
নীলফামারীর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নায়িরুজ্জামান জানান, নীলফামারীর নীলসাগরকে আরও নান্দনিকভাবে গড়ে তোলা হবে। এটি দেশের একটি ঐতিহ্যম-িত দীঘি।

প্যানেল হু

আরো পড়ুন  

×