
ছবি: প্রতীকী
চুল পড়া একটি সাধারণ সমস্যা, যা অনেক মানুষই জীবনে একবার না একবারের জন্যই সম্মুখীন হন। বিশেষ করে বর্তমান জীবনের ব্যস্ততা, অনিয়মিত জীবনযাপন এবং পরিবেশগত প্রভাবের কারণে চুল পড়ার সমস্যা বাড়ছে। অনেকেই মনে করেন, চুল পড়া রোধ করতে শুধু মাথায় তেল লাগানোই যথেষ্ট। কিন্তু এটা মোটেও যথেষ্ট নয়। আসলে চুল পড়ার পেছনে একাধিক কারণ কাজ করে এবং সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ। আজ আমরা এই বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো এবং জানবো কেন রক্তের হিমোগ্লোবিন বাড়ানো দরকার চুল পড়া রোধের জন্য।
প্রথমত, হিমোগ্লোবিন হলো আমাদের রক্তের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিন যা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে অক্সিজেন পৌঁছে দেয়। শরীরের কোষগুলো সঠিকভাবে কাজ করার জন্য পর্যাপ্ত অক্সিজেন প্রয়োজন। মাথার ত্বকের কোষও এর বাইরে নয়। যখন রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কম থাকে, তখন মাথার ত্বক এবং চুলের গোড়ায় পর্যাপ্ত অক্সিজেন পৌঁছায় না। এর ফলে চুলের মূলে পুষ্টির অভাব হয় এবং চুল দুর্বল হয়ে পড়ে, যা চুল পড়ার অন্যতম প্রধান কারণ।
হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যাওয়াকে আমরা চিকিৎসাবিজ্ঞানে 'অ্যানিমিয়া' বা রক্তাল্পতা বলি। অ্যানিমিয়া হলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কাজ ঠিকঠাক হয় না এবং এর প্রভাব প্রথমেই দেখা দেয় চুলের অবস্থায়। অনেক সময় দেখা যায়, যাদের রক্তাল্পতা আছে তাদের চুল অনেক দ্রুত পড়ে এবং নতুন চুলও জন্মায় না। তাই চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে হলে রক্তের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক রাখা খুবই জরুরি।
অনেকেই মনে করেন চুল পড়া রোধে শুধু বাহ্যিক যত্ন যথেষ্ট, যেমন তেল মেলা, শ্যাম্পু করা, হেয়ার মাস্ক ব্যবহার করা। অবশ্যই এগুলো গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তেল মাথার ত্বককে ময়েশ্চারাইজ করে, রক্তসঞ্চালন বাড়ায় এবং চুল মজবুত করে। তবে যদি রক্তে পুষ্টির অভাব থাকে, তখন বাহ্যিক যত্ন যতই করুন, চুল পড়া থামানো কঠিন। কারণ চুল জন্মানোর জন্য মাথার ত্বকের ভিতরে থাকা কুঁড়ি (ফোলিকল) পর্যাপ্ত পুষ্টি পায় না।
তাহলে কীভাবে রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়ানো যায়? হিমোগ্লোবিন বাড়াতে প্রথমেই খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। আয়রন বা লৌহ সমৃদ্ধ খাবার বেশি করে খাওয়া দরকার। যেমন পালং শাক, মাংস, মাছ, ডাল, বাদাম, শুকনো ফল এবং গমজাতীয় খাবার। এই খাবারগুলো রক্তে লৌহের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে। লৌহ হিমোগ্লোবিন তৈরির জন্য অপরিহার্য উপাদান। তাই নিয়মিত এই ধরনের খাবার খেলে রক্তাল্পতা কমে এবং চুলের স্বাস্থ্য ভালো থাকে।
তাছাড়া ভিটামিন সি যুক্ত খাবারও হিমোগ্লোবিন শোষণে সাহায্য করে। যেমন লেবু, কমলা, আম, কাঁঠাল, এবং বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি। ভিটামিন সি লৌহ শোষণ বাড়ায়, ফলে রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বাড়ে। সুতরাং এই ধরনের খাবার খাওয়াও অত্যন্ত জরুরি।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পানি খাওয়া। শরীর ভালোভাবে হাইড্রেটেড থাকলে রক্ত সঠিকভাবে প্রবাহিত হয় এবং রক্তে পুষ্টি উপাদান সহজে শরীরের বিভিন্ন অংশে পৌঁছায়। তাই প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি পান করাও চুল পড়া কমাতে সহায়ক।
চুল পড়ার সমস্যা থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াও জরুরি। কারণ অনেক সময় রক্তাল্পতা বা হিমোগ্লোবিন কম থাকার পেছনে গর্ভাবস্থা, রক্তক্ষরণ, পুষ্টির অভাব বা অন্য কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা থাকতে পারে। তাই সঠিক পরীক্ষা করিয়ে তার ভিত্তিতে চিকিৎসা শুরু করা উচিত।
চুল পড়া রোধে একটি সুস্থ জীবনযাপন এবং সুষম খাদ্য গ্রহণ অত্যন্ত প্রয়োজন। শুধু বাহ্যিক যত্ন নয়, অভ্যন্তরীণ পুষ্টির দিকে যত্ন না নিলে চুল পড়া বন্ধ করা কঠিন। মাথার ত্বকে তেল লাগানো ভালো, তবে তার সঙ্গে সঠিক খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা আরও জরুরি।
চুল পড়া রোধ করতে চাইলে প্রথমে রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক রাখতে হবে। কারণ সুস্থ রক্তই সুস্থ চুলের মূল চাবিকাঠি। ভালো খাবার, সঠিক পরিচর্যা এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শে চলা হলে চুল পড়ার সমস্যা অনেকাংশে কমে যাবে এবং চুল হবে মজবুত ও স্বাস্থ্যবান। তাই শুধু তেল দিয়ে নয়, শরীরের অভ্যন্তরেও যত্ন নিন, রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়ান এবং নিজের চুলের সুস্থতার প্রতি মনোযোগ দিন।
এম.কে.