
ছবি: প্রতীকী
জ্বর আমাদের শরীরের একটি প্রতিক্রিয়া। এটি তখনই হয় যখন শরীর কোনো সংক্রমণ বা অস্বাভাবিক অবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করে। তবে যদি কারও ঘন ঘন জ্বর হয়, তাহলে সেটি শুধু ভাইরাসজনিত নয়, বরং অন্য কোনো গুরুতর শারীরিক সমস্যার লক্ষণও হতে পারে।
প্রথমে বুঝে নিতে হবে যে, ভাইরাসজনিত জ্বর সাধারণত সিজনাল হয়ে থাকে। বিশেষ করে বর্ষাকাল বা হেমন্তে ভাইরাসের প্রকোপ বেড়ে যায়। তখন ঠান্ডা লাগা, সর্দি, কাশি, গলা ব্যথা, ও হালকা জ্বর হয়। এসব ক্ষেত্রে জ্বর ২-৩ দিনের মধ্যে কমে যায়। কিন্তু যদি প্রতি মাসে বা মাসে একাধিকবার জ্বর হয়, তাহলে সেটি স্বাভাবিক নয়। তখন সেটি কোনো ভিন্ন স্বাস্থ্যগত সমস্যার ইঙ্গিত দিতে পারে।
যেমন ধরুন, অনেক সময় ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ থেকে জ্বর হয়। টনসিল, গলা, কানে ইনফেকশন, দাঁতের সমস্যার কারণে বা প্রস্রাবের সংক্রমণেও শরীরে জ্বর আসে। তবে এসব ক্ষেত্রে সাধারণত জ্বরের সঙ্গে অন্যান্য উপসর্গও থাকে—যেমন গলা ব্যথা, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া, মুখে ব্যথা ইত্যাদি। এই উপসর্গগুলো যদি বারবার ফিরে আসে, তাহলে সেটা গুরুত্ব দিয়ে দেখা দরকার।
ঘন ঘন জ্বর হওয়া রক্তের রোগ বা সংক্রমণের কারণেও হতে পারে। যেমন টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু বা টিবি—এসব রোগে শরীর মাঝে মাঝেই জ্বরে আক্রান্ত হয়। টাইফয়েডে অনেক সময় জ্বর কমে আবার বাড়ে, শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। ডেঙ্গুতে জ্বরের সঙ্গে শরীর ব্যথা, চোখের পেছনে চাপ ও চামড়ার র্যাশ হয়। ম্যালেরিয়ায় আবার নির্দিষ্ট সময় পর পর জ্বর আসে। এই রোগগুলোতে শুধু জ্বর দেখা দিলেই চলবে না, দ্রুত রক্ত পরীক্ষা করে রোগ নির্ণয় করতে হয়।
এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি রোগ যেমন ক্যানসার, অটোইমিউন ডিজিজ (যেমন লুপাস বা রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস), এমনকি কিডনি বা লিভারের সমস্যায়ও ঘন ঘন জ্বর হতে পারে। এই ধরনের জ্বর সাধারণত কয়েক সপ্তাহ বা মাসজুড়ে স্থায়ী হয় এবং সঙ্গে ক্লান্তি, ওজন কমে যাওয়া, বমি ভাব, শরীরে ব্যথা ইত্যাদি লক্ষণ থাকে।
শিশুদের ক্ষেত্রে ঘন ঘন জ্বর হলে আরও বেশি সতর্ক হওয়া জরুরি। অনেক শিশু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ঘন ঘন জ্বরে ভোগে। তবে যদি সঙ্গে খাওয়ার অনীহা, ওজন না বাড়া, ঘুমে ব্যাঘাত বা বারবার সর্দি-কাশি থাকে, তাহলে সেটা কোনো রোগপ্রবণতার ইঙ্গিত হতে পারে। শিশুদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম হলে তাদের দেহে দ্রুত সংক্রমণ হয়, সেখান থেকেই ঘন ঘন জ্বর হতে পারে।
অনেক সময় শরীরে কোনো গোপন ইনফেকশন থাকে, যা বাইরে থেকে বোঝা যায় না, কিন্তু বারবার জ্বর দিয়ে তা প্রকাশ পায়। যেমন দাঁতের ভেতরে পুঁজ জমে থাকলে বা ইউরিনারিতে ইনফেকশন থাকলে তা দীর্ঘ সময় ধরে শরীরে ঘন ঘন জ্বরের কারণ হতে পারে। আবার কিছু ক্ষেত্রে হরমোনজনিত অসামঞ্জস্যতা থেকেও জ্বরের অনুভূতি হয়, যদিও আসলে তাপমাত্রা বাড়ে না।
আরেকটি বিষয় হলো পরিবেশ ও জীবনযাত্রা। ধুলাবালি, অপরিষ্কার পানি, দূষিত খাবার ও অপর্যাপ্ত ঘুমের কারণে দেহের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায়। তখন সামান্য ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াতেও জ্বর হয় এবং সেটি পুনরায় ফিরে আসে। তাই স্বাস্থ্যসম্মত জীবনধারা বজায় রাখা, পর্যাপ্ত বিশ্রাম, পুষ্টিকর খাবার খাওয়া এবং নিয়মিত হাত ধোয়া এসব অভ্যাস গড়ে তোলা খুব জরুরি।
সবশেষে বলা যায়, ঘন ঘন জ্বর মানেই শুধু ভাইরাস নয়। এটি কোনো আভ্যন্তরীণ রোগ, দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণ, ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ বা শরীরের প্রতিরোধক্ষমতার দুর্বলতার লক্ষণও হতে পারে। তাই বারবার জ্বর হলে ঘরোয়া চিকিৎসায় না গিয়ে একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। প্রয়োজন হলে রক্ত, প্রস্রাব, এক্স-রে, বা আল্ট্রাসনোগ্রাফি জাতীয় কিছু পরীক্ষাও করতে হতে পারে। কারণ সঠিক রোগ নির্ণয় ছাড়া শুধু জ্বরের ওষুধ খেয়ে যাওয়া কখনোই স্থায়ী সমাধান নয়। শরীরের এই সতর্ক সংকেতকে অবহেলা করা উচিত নয়।
এম.কে.