
জীবন থেকে নেয়া জীবন্ত গল্প অথবা গল্পে জীবন দান করে প্রাণ সঞ্চার করা, এমন দ্বিধার দোলাচলে দুলতে দুলতে পুনর্বার সূচিপত্রে চোখ বুলিয়ে ফিরে পাওয়া সম্বিত নিয়ে গল্পের ভেতর আবার ডুবে যাওয়া। এমন ঘোর লাগানো শৈল্পিক সৃষ্টির পসরা সাজিয়ে পাঠকের সামনে যখন কোনো গল্পগ্রন্থ ধরা দেয় তা অবশ্যই সুপাঠ্য গ্রন্থই বটে! বহুমাত্রিক লেখক পীযূষ কান্তি বড়ুয়ার দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’ এমনই এক চমকপ্রদ গল্পের বই।
পীযূষ কান্তি বড়ুয়া গল্প বলেন তাঁর স্বকীয় ভঙ্গিতে। যাপিত সময়ের বাস্তবতা ও চেতনার জাগরণ সৃষ্টি করে তাঁর গল্পের বিষয়বস্তু। সাবলীল এবং সহজ ভাষায় অতি পরিচিত ও সাধারণ চরিত্রের মধ্য দিয়ে অসাধারণ জীবনবোধের গল্প তুলে আনেন তিনি যার সাহিত্যমূল্য অপরিসীম।
পরম ভালোবাসা ও বিশ্বাসের ভিতে দাঁড়িয়ে থাকে আমাদের প্রিয় সম্পর্কগুলো। প্রেম-প্রণয়ের এই পথচলায় কখনো কখনো ফাটল ধরে উটকো সন্দেহ কিংবা অবিশ্বাসের বিষাক্ত থাবায়। আত্ম-অহংবোধের অদৃশ্য দেয়াল ক্রমশই দূরে ঠেলে দেয় আত্মার বাঁধনে জড়িয়ে থাকা ভালোবাসার মানুষকেও। কিন্তু যখন ভুলের অধ্যায়ের অবসান হয় তখন আর কারুরই ফেরার সময় থাকে না। অথচ দুজনেই শেষ পরিণতিতে নিজেদের সর্বস্ব দিয়ে ভালোবাসার প্রতিদান দিতে চেয়েছেন। এভাবেই এক দম্পতির ভালোবাসার গল্প হয়ে ওঠে ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। অসাধারণ এই গল্পটি পড়ার পর যে কোনো পাঠক কয়েক মিনিটের জন্য ‘থ’ হয়ে বসে থাকবে এটা নিশ্চিত!
এর পরেই পাঠকের যখন ‘বিয়েবার্ষিকীর উপহার’ গল্পটি পড়া শেষ হয় তখন আবার আরেক ভৌতিক ঘোর জন্ম দিয়ে যায়! এটি বইয়ের দ্বিতীয় গল্প। দীর্ঘদিন প্রেমের পর ৩ বছরের সংসার পার করে ডাক্তার অর্ঘ্য মুখোমুখি হয় এক অনভিপ্রেত ভৌতিক রহস্যের সামনে।
‘পাগলিনী’ নামে একটি গল্পে ছোট এক শহরে নতুন এক বৃদ্ধ পাগলের আবির্ভাব ঘটে। পাগলিনী শহরে ঘোরাফেরা করে, শিল্পকলা চেনে, নাট্যকর্মী চেনে এমনকি শিল্পকলার ক্যান্টিনে চা খেতেও সে খুব পছন্দ করে। শহরে ইলিশ উৎসব উপলক্ষে শিল্পকলায় নাটকের আয়োজন হয়। নাটকের এক পর্যায়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মেজর যখন এক নারীর ওপর পাশবিক নির্যাতন চালাতে যায় তখনই পাগলিনী মঞ্চে উঠে চমকপ্রদ এক ঘটনার জন্ম দেয়, হামলে পড়ে মেজরের ওপর। এ ঘটনা শুধু পাগলামি নয়, এ যেন চেতনার বারুদে আগুন দিয়ে জয় বাংলা সেøাগানে জাগিয়ে দেয় পুরো শিল্পকলায় উপস্থিত দর্শকদের।
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা মহান মুক্তিযুদ্ধ অনেক বীরত্বগাথা ও ত্যাগ তিতিক্ষার ফসল। এখানে সম্মুখ যুদ্ধে লড়াই করে যেমন অনেকে ভূমিকা রেখেছেন তেমনই কেউ কেউ নিজ অবস্থানে থেকেও জন্ম দিয়েছে অসীম বীরত্বগাথার ইতিহাস। হরিপদ মাঝির ছোট্ট ছেলে সুকান্ত বাবার কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে স্বপ্ন দেখতো সেও মিলিটারি মারবে। একদিন মিলিটারি তার গ্রামে এলে সে কৌশলে নৌকা ডুবিয়ে তাদের হত্যা করে। ‘মুক্তিবীর’ এই গল্পটি একইসাথে রোমাঞ্চকর এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে।
এই গ্রন্থে আরেকটি চমকপ্রদ গল্পের নাম ‘জয় বাংলার হাসি’। গল্পের প্রথমদিকে যুদ্ধকালীন সময়ে প্রেম-প্রনয়, যুদ্ধ- সংকট ইত্যাদি দিয়ে গল্পের প্লট শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত মায়ের হাতে নিজ সন্তান খুনের মধ্য দিয়ে জয় বাংলা’র হাসি ফুটে ওঠে।
প্রতিটি গল্পই বৈচিত্র্যময় নানা চরিত্র ও ঘটনার মাধ্যমে পাঠককে এক ইন্দ্রজালের জগতে নিয়ে যায়।
পীযূষ কান্তি বড়ুয়ার গল্পে প্রেম-ভালোবাসা, অলৌকিকতা, সামাজিক অবক্ষয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এই বিষয়গুলো সচরাচর চোখে পড়বে যেকোনো সচেতন পাঠকের। এই গল্পগুলো আমাদের চারপাশের চেনা জীবনের কথা বলে। আবার আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে নানা অসঙ্গতি দেখিয়ে দেয়, আমাদের মরিচা পড়া দেশাত্মবোধ ও চেতনাকে জাগ্রত করে তোলে। গল্প পাঠে আগ্রহী পাঠক বইটি পড়লে যেমন বিমোহিত হবেন, একইভাবে নতুন পাঠকও এই গল্পগুলো পাঠ করলে তিনি পাঠের আনন্দ খুঁজে পাবেন তা হলফ করেই বলা যায়!
৮৫ পৃষ্ঠার এই বইটিতে মোট ১০টি গল্প রয়েছে।
বইটি প্রকাশ করেছে পরিবার পাবলিকেশন্স।
প্যানেল/মো.