
পর্ব-৭
(পূর্ব প্রকাশের পর)
‘না না, মরেনি। বেঁচে আছে এখনো।’ আরেকটা গলা শোনা গেল। ‘তবে হাসপাতালে নিতে নিতে বোধহয় শেষ হয়ে যাবে।’
‘ভদ্রলোকের সাহস আছে।’ জনৈক নারীকণ্ঠের মন্তব্য। ‘উনি বাধা না দিলে ভদ্রমহিলার ঘড়ি আর পার্স নিয়ে গুণ্ডারা পালিয়ে যেত। ওরা একটা ভয়ংকর গ্যাং। এই যে...ভদ্রলোক নিঃশ্বাস নিচ্ছে দেখতে পাচ্ছি।’
‘কিন্তু এখানে রাস্তার মাঝখানে তো একে ফেলে রাখা যায় না। ম্যা’ম ওনাকে কী ঘরের ভেতরে নেওয়া যায়?’ কেউ একজন প্রশ্ন করলো ইরিনকে।
‘অবশ্যই। ড্রইংরুমে এনে রাখুন। সোফায় শুইয়ে দিন। এই যে এখানে।’
হোমসকে ধরাধরি করে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো। সোফার উপরে শুয়ে আছে হোমস- এখান থেকে সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমি। ঘরের আলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুয়ে শুয়ে কী ভাবছে হোমস জানি না, কিন্তু অপরূপ রূপসী যে নারীর বিরুদ্ধে আমরা এইসব ষড়যন্ত্র আর অভিনয় করছি- সে পরম মমতায় আহত হোমসের সেবাযত্নের চেষ্টা করছে দেখে আমি মনে মনে ভীষণ লজ্জিত হলাম।
জীবনে এত লজ্জা আর কখনো পাইনি। কিন্তু এই মুহূর্তে যদি পিঠটান দিই তাহলে বন্ধু হোমসের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে- তা আমি করতে পারি না। মনটাকে শক্ত করলাম, পকেট থেকে স্মোক বোম বের করে হাতে নিলাম। নিজেকে এই বলে সান্ত¦না দিলাম যে ইরিনকে আমরা আঘাত করছি না, আহত করছি না- অন্যকে যেন সে আহত করতে না পারে সেই চেষ্টা করছি।
হোমস উঠে বসেছে, অভিনয় করছে যেন তার ভীষণ শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। একজন পরিচারিকা তাড়াতাড়ি এসে জানালা খুলে দিল। হোমস হাত তুলেছে। তার ইঙ্গিত পাওয়া মাত্র আমি বোমটা ছুড়ে দিলাম ঘরের ভিতরে, চেঁচিয়ে উঠলাম ‘আগুন! আগুন!!’ জানালা দিয়ে ঘন ধোঁয়ার কুণ্ডলি বের হচ্ছে। ভেতরে লোকজনের ছুটোছুটি দেখতে পাচ্ছি, একটু পরে হোমসের গলা ভেসে এলো- ‘সব ঠিক আছে, সব ঠিক আছে। আগুন লাগেনি, ফলস অ্যালার্ম।’
রাস্তায় ভিড় জমে গেছে, ভিড়ের মধ্যে দিয়ে আমি নির্দিষ্ট জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। মিনিট দশেক পরে হোমস চলে এলো, ওকে দেখে আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। মিনিট কয়েক নীরবে দ্রুত হেঁটে আমরা অন্য একটা রাস্তায় এসে পড়লাম- এই রাস্তাটা গেছে এজওয়ার রোডের দিকে।
‘ঠিকঠাক কাজটা করেছো, ডাক্তার।’ এতক্ষণে কথা বললো হোমস। ‘একদম ঠিকঠাক। এর চেয়ে ভালো আর কিছু হয় না।’
‘ফটোটা পেয়েছো?’
‘পাইনি, কিন্তু জানি কোথায় আছে ওটা।’
‘কীভাবে জানলে?’
‘বলেছিলাম না ইরিনই আমাকে দেখাবে? ঠিক দেখিয়ে দিয়েছে।’
‘কী বলছো, বুঝছি না কিছুই।’
‘আচ্ছা খুলে বলছি।’ হাসলো হোমস। ‘খুব সহজ ব্যাপার। রাস্তার লোকগুলোকে আমিই কাজে লাগিয়েছি, সেটা নিশ্চয়ই বুঝেছো।’
‘হ্যাঁ, সেটা বুঝতে পেরেছি।’‘
‘আমি আসলে আহত হইনি। আমার হাতে রং লুকানো ছিল। মারামারির মাঝখানে গিয়ে পড়ে যাই আমি, লাল রংটা কপালে চেপে ধরতেই সবাই ভাবলো আমার মাথা ফেটে রক্তারক্তি কান্ড ঘটে গেছে। ছুটে পালালো ওরা। এ সবই অভিনয়।’
‘সেটাও বোঝা গেছে।’
‘তারপর তো দেখলেই আমাকে বয়ে নিয়ে গেল ভেতরে। ইরিন নিজেই অনুমতি দিল। না দিয়ে তার উপায় কী? তো এভাবে ঢুকে গেলাম ড্রইংরুমে, যেখানে ছবিটা আছে বলে আমি অনুমান করেছিলাম। হয় ড্রইংরুমে নাহলে তার বেডরুমে। আমি নিশ্চিত হতে চেয়েছিলাম কোন ঘরে আছে ছবিটা। তারপর শ্বাসকষ্টের অভিনয়। জানালা খুলে গেল। তুমি সুযোগ পেয়ে গেলে বোম মারার।’
‘তাতে কী লাভ হলো?’
‘আরে এখানেই তো আসল ট্রিক। ঘরে আগুন লাগলে ঘরের মালিক কি করবে? প্রথমেই ছুটে যাবে তার সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটাকে বাঁচাতে, তাই না? এই ট্রিক আমি আগেও ব্যবহার করেছি। দেখেছি মা ছুটে যায় তার সন্তানকে বাঁচাতে, কুমারি মেয়ে ছুটে গিয়ে তুলে নেয় তার গহনার বাক্স। আমি জানতাম ইরিন ছুটে যাবে ফটোটাকে উদ্ধার করতে। কারণ এই মুহূর্তে এর চেয়ে মূল্যবান জিনিস তার কাছে আর কিছুই না।
তোমার আগুন আগুন চিৎকার সবার মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে। তাছাড়া ধোঁয়ায় ভরে গেছে ঘর। ইরিনের প্রতিক্রিয়া ছিল চমৎকার। সে দৌড়ে গেল তার গুপ্তধনের কাছে। ছবিটা আছে দরজার পেছনে ঘণ্টা বাজানোর দড়িটার ঠিক উপরে একটা স্লাইডিং প্যানেলের পেছনে। ছবিটা সে বের করতে নিচ্ছিলো, তার আগেই আমি চিৎকার দিয়ে জানিয়ে দিয়েছি আগুন লাগেনি, ভয়ের কিছু নেই। ধোঁয়ার ভিতর দিয়ে দেখতে পেলাম ফটোটা সে আবার আগের জায়গায় রেখে দিল- মেঝেতে পড়ে থাকা বোমের দিকে একবার তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। তারপর তাকে আর দেখিনি। একবার ভাবলাম এখনি ফটোটা নিয়ে যাই। কিন্তু ততক্ষণে কোচম্যান ঘরে ঢুকেছে- আমাকে বেরিয়ে আসতে হলো। আরেকটু ধৈর্য ধরতে হবে আমাদের।’
‘তাহলে এখন কী প্ল্যান?’
‘কাজ তো মোটামুটি শেষ। আগামীকাল রাজা মশায়কে নিয়ে এই বাড়িতে আবার আসবো আমরা। তুমি সঙ্গে থাকলে খুব ভালো হয়। আমরা গৃহকর্ত্রীর সাক্ষাৎ প্রার্থী হবো। ড্রইংরুমে বসে অপেক্ষা করবো। কিছুক্ষণ পর গৃহকর্ত্রী যখন ড্রইংরুমে ঢুকবেন, তখন সেখানে আমরাও (চলবে...)
আমরা বেকার স্ট্রিটে পৌঁছে গেলাম। দরজায় দাঁড়িয়ে আছি, হোমস চাবির জন্য পকেট হাতড়াচ্ছে। এমন সময় কে যেন আমাদের পাশ দিয়ে চলে গেল। যেতে যেতে বললো, ‘গুড নাইট, মিস্টার শার্লক হোমস।’
আশপাশে অনেক মানুষ। ওভারকোট পরা ছিপছিপে এক যুবককে দেখলাম দ্রুত চলে যাচ্ছে- মনে হলো সে-ই কথাটা বলেছে।
‘গলাটা খুব চেনা চেনা লাগলো।’ আধো অন্ধকার গলির দিকে তাকিয়ে কথাটা বললো হোমস। ‘ভাবছি...কে এই যুবক!’
তিন.
রাতটা বেকার স্ট্রিটে থেকে গেলাম। সকালে টোস্ট আর কফি দিয়ে নাস্তা করছি, এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে বোহেমিয়ার রাজা ঢুকলো ঘরে।
‘ফটোটা পেয়ে গেছেন সত্যিই?’ উত্তেজিত গলা তার।
‘এখনো পাইনি।’
‘পাওয়ার আশা আছে?’
‘আছে।’
‘তাহলে চলুন। আমি আর ধৈর্য ধরতে পারছি না।’
‘একটা ক্যাব ডাকতে হবে।’
‘ডাকতে হবে না। আমার ব্রুহাম সঙ্গেই আছে।’
‘তাহলে তো কথাই নেই। চলুন।’
‘ইরিন এডলার এখন বিবাহিতা নারী।’ হোমস বললো।
‘বিবাহিতা? কবে বিয়ে করলো?’
‘গতকাল।’
‘কাকে করলো বিয়ে?’
‘নর্টন নামে একজন ইংলিশ আইনজীবীকে।’
‘তাকে নিশ্চয়ই ভালোবাসে না ইরিন।’
‘আশা করি বাসে।’
‘আশা করেন? কেন বলুন তো?’
‘ইয়োর ম্যাজেস্টি, সে যদি নর্টনকে ভালোবাসে তাহলে আপনার দুশ্চিন্তার আর কোনো কারণ থাকে না। কেননা নর্টনকে ভালোবাসলে সে আর আপনাকে ভালোবাসবে না, সহজ হিসাব। আপনাকে ভালো না বাসলে আপনার ব্যাপারে তার আর মাথাব্যথাও থাকবে না।’
‘সত্যি কথা। তারপরও...আমার ভাবতে ভালো লাগে- বোহেমিয়ার রানী হলে তাকে দারুণ মানাতো।’ কথাটা বলে কেমন যেন হঠাৎ নীরব হয়ে গেল বোহেমিয়ার রাজা।
ব্রায়োনি লজের দরজা খোলা। বয়স্ক একজন মহিলা গৃহকর্মী দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়ির উপরের ধাপে। তার চোখেমুখে বিদ্রুপের হাসি। ব্রুহাম থেকে নেমে দাঁড়াতেই মহিলা বললো, ‘মিস্টার শার্লক হোমস নিশ্চয়ই?’
হোমস চমকে উঠলো। একটু অবাক হয়ে বললো, ‘হ্যাঁ, আমিই মিস্টার হোমস।’
‘আমার মিসট্রেস বলছিলেন আপনি আসতে পারেন। তিনি তার স্বামী সহ ইউরোপের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন সোয়া পাঁচটার ট্রেনে, চ্যারিং ক্রস স্টেশন থেকে।’
‘কী!’ থমকে দাঁড়ালো হোমস। হতভম্ব হয়ে গেছে সে। ‘আপনি বলছেন তিনি ইংল্যান্ড ছেড়ে চলে গেছেন?’
‘চলে গেছেন এবং আর ফিরবেন না বলে গেছেন।’
‘তাহলে আমার কাগজপত্র?’ হতাশ গলায় জিজ্ঞেস করলো রাজা। ‘সব নিয়ে গেছে নিশ্চয়ই?’
‘দেখা যাক।’ গৃহকর্মীকে পাশ কাটিয়ে ড্রইংরুমে ঢুকলো হোমস। পিছে পিছে আমি আর রাজা। ঘরের ভেতরে আসবাবপত্র সব এলোমেলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। শেলফের পাল্লা খোলা, ড্রয়ার বের হয়ে আছে- দেখে মনে হয় যাওয়ার আগে তাড়াহুড়োয় এইসব নাড়াচাড়া করেছে কেউ। কলিংবেলের দড়ির পেছনের স্লাইডিংয়ের কাছে দৌড়ে গেল হোমস। ভেতরে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনলো একটা ছবি আর একখানা চিঠি। ছবিটা ইরিন এডলারের, ইভনিং ড্রেস পরে আছে সে। চিঠির খামে শার্লক হোমসের নাম লেখা। খাম খুলে চিঠিটা বের করলো হোমস। আমরা দুজন হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। চিঠিতে লেখা-
‘মাই ডিয়ার মিস্টার শার্লক হোমস,
দারুণ দেখিয়েছেন। প্রথমে খুব অবাক হয়েছিলাম আমি। আগুন আগুন চিৎকার শোনার আগে পর্যন্ত বুঝতেই পারিনি ঘটনা কী। তারপর যখন বুঝতে পারলাম গুপ্তধনের জায়গাটা আপনাকে দেখিয়ে দিয়েছি, তখনই আমার ভুল ভাঙলো। অনেকদিন আগেই বন্ধুরা আমাকে সতর্ক করেছে। তাদের ধারণা ছিল- রাজা যদি কাউকে এ কাজের জন্য নিযুক্ত করে, তাহলে সেই যোগ্য ব্যক্তিটি হবেন আপনি। আপনার ঠিকানাও তারা আমাকে দিয়ে রেখেছে।
যা হোক, এতকিছুর পরেও সেদিনের সেই আহত দয়ালু পাদ্রিকে আমি এতটুকুও সন্দেহ করিনি প্রথমে। কিন্তু জানেন তো, আমি নিজেও একজন অভিনেত্রী। পুরুষের ছদ্মবেশ দেখে অভ্যেস আছে আমার। নিজেও আমি অনেক সময় পুরুষের ছদ্মবেশে চলাফেরা করি। এতে অনেকটা স্বাধীনতা পাওয়া যায়। ঘর ধোঁয়ায় ভরে গেলে আমি আমার কোচম্যানকে আপনার পাহারায় রেখে উপরে চলে গিয়েছিলাম। দ্রুত ছদ্মবেশ পরে নিই। যুবক সেজে যখন নিচে এলাম দেখি আপনি বেরিয়ে যাচ্ছেন।
আপনাকে অনুসরণ করে আপনার বাড়ি পর্যন্ত গিয়েছিলাম আমি। নিশ্চিত হতে চেয়েছিলাম যে সত্যিই সেলিব্রিটি মিস্টার শার্লক হোমস আমার বিষয়ে ইন্টারেস্টেড কিনা। তারপর বোকার মতো কাজটা করে ফেললাম- আপনাকে শুভরাত্রি জানালাম পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়। সেখান থেকে চলে গেলাম আমার স্বামীর বাসায়।
দুজনে মিলে প্ল্যান করলাম ইংল্যান্ড ছেড়ে চলে যাওয়াই ভালো হবে- কেননা আমাদের পিছে লেগেছেন বিখ্যাত ডিটেকটিভ মিস্টার শার্লক হোমস। আপনি এসে দেখবেন নীড় ফাঁকা, পাখি উড়ে গেছে। হ্যাঁ ছবিটার বিষয়ে বলি...আপনার ক্লায়েন্টকে জানাবেন তার দুশ্চিন্তার কিছু নেই। তার থেকে শ্রেয় একজন মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি আমি- আমিও তাকে ভালোবাসি।
রাজাকে বলবেন তিনি যে নারীকে দুঃখ দিয়েছেন, সে আর কখনো তাকে বিরক্ত করবে না। ছবিটা আমি রেখে দিলাম সাবধানতা হিসেবে, অস্ত্র হিসেবে- যাতে আমাকেও কেউ আর বিরক্ত না করতে পারে। আমার একটা ছবিও আমি দিয়ে গেলাম রাজাকে। আমার শেষ উপহার।
আপনার একান্ত-
ইরিন নর্টন এডলার
‘বাপরে! কী সাংঘাতিক মেয়ে?’ রাজা বলে উঠলো। ‘আগেই বলেছিলাম এ হচ্ছে ডাকিনি মেয়ে। রানী হলে দুর্দান্ত মানাতো তাকে। কিন্তু কী আর করা- সামাজিক দিক দিয়ে আমার লেভেলের নয় সে।’
‘হ্যাঁ ইয়োর ম্যাজেস্টি, যতটুকু চিনলাম তাকে, তাতে বলতে পারি এই নারী আপনার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন লেভেলের।’ হোমস বললো। ‘আমি দুঃখিত আপনার কাজটা ঠিকঠাক মতো করে দিতে পারলাম না।’
‘ঠিক মতোই করে দিয়েছেন।’ খুশি খুশি গলায় বললো রাজা। ‘এর চেয়ে ভালো সমাধান আর হতে পারে না। এই নারী তার কথা রাখবে আমি জানি। ছবিটা ইরিনের কাছে থাকা আর আগুনে পুড়ে শেষ হয় যাওয়া একই কথা। আমি নিশ্চিন্ত।’
‘শুনে খুশি হলাম ইয়োর ম্যাজেস্টি।’
‘আমিও সন্তুষ্ট আপনার ওপর। বলুন কীভাবে আপনাকে প্রতিদান দিতে পারি। এই আংটিটা যদি-।’ হাতের মূল্যবান পান্নার তৈরি আংটিটা খুলে হোমসের দিকে এগিয়ে দিল রাজা।
‘এর চেয়েও মূল্যবান একটা জিনিস আছে ইয়োর মাজেস্টি আপনার কাছে। আপনি যদি সেটা আমাকে দিতেন।’ হোমস বললো।
‘কী জিনিস নামটা শুধু বলুন।’
‘ওই ছবিটা।’
‘ইরিনের ছবিটা চাচ্ছেন আপনি?’ রাজা অবাক চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলেন। তারপর বললেন। ‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই...নিন।’
‘ধন্যবাদ ইয়োর ম্যাজেস্টি। তাহলে আমাদের কাজ এখানেই শেষ। আপনাকে সুপ্রভাত জানাই।’ হোমস রাজাকে বাউ করলো। রাজার বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা উপেক্ষা করে সে ঘুরে দাঁড়ালো। আমরা ফিরে চললাম বেকার স্ট্রিটের দিকে।
বোহেমিয়া রাজ্য ঘিরে গড়ে ওঠা স্ক্যান্ডালের কেসটা এভাবেই শেষ হলো। যে কেসে শার্লক হোমস একজন নারীর কাছে পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছিল। আগে সে মেয়েদের সম্পর্কে উল্টোপাল্টা কথা বলতো। আজকাল আর বলে না। যদি কখনো ইরিন এডলারের কথা ওঠে, কিংবা তার ছবির প্রসঙ্গ ওঠে- হোমস শ্রদ্ধার সঙ্গে বলে ওঠে, ‘সেই মেয়েটা!’
কার্ডে একটু দেখো তো নামটা।’ চোখ না খুলেই মৃদুকণ্ঠে বললো হোমস। বহু বছর ধরে সে ইনডেক্স কার্ড তৈরি করছে- বিভিন্ন বস্তু, বিষয় ও মানুষের নামের প্রথম অক্ষর ধরে ধরে। বিস্তারিত বিবরণসহ তা বর্ণমালা অনুযায়ী সাজানো আছে, আমি জানি। ইরিন এডলারের নাম লেখা কার্ডটা বের করলাম।
‘দেখি তো।’ হোমস বললো। ‘হ্যাঁ, এই যে। জন্ম নিউ জার্সিতে, ১৮৫৮ সালে। ওয়ারশ অপেরার প্রধান গায়িকা...হুম! এখন লন্ডনে বসবাস করছে। বুঝতে পেরেছি, ইয়োর ম্যাজেস্টি। এই যুবতীর সঙ্গে আপনি জড়িয়ে গেছেন, চিঠি লিখেছেন যাতে কিছু ইন্টিমেট কথা আছে, এখন চিঠিগুলো আপনি ফেরত চান, এই তো?’
‘হ্যাঁ ঠিক, একদম। কিন্তু কীভাবে যে-’
‘বিয়ে-টিয়ে কী হয়েছিল?’
‘না।’
‘তার মানে কোনো আইনগত দলিল নেই?’
‘না নেই।’
‘তাহলে এত চিন্তার কী আছে বুঝতে পারছি না ইয়োর ম্যাজেস্টি। এই যুবতি যদি ব্ল্যাকমেইল করতে চায়, কীভাবে সে প্রমাণ করবে তার দাবির সত্যতা?’
‘আমার চিঠিগুলো আছে তার কাছে।’
‘ফুহ! আমরা বলবো জাল চিঠি।’
‘কিন্তু...ব্যক্তিগত প্যাডে লেখা যে।’
‘চুরি করা প্যাড বলবো।’
‘আমার সিল-ছাপ্পর আছে প্যাডে।’
‘নকল সিল।’
‘আমার ছবিও আছে।’
‘বাজার থেকে কেনা ছবি।’
‘কিন্তু দুজনে আছি ছবিটাতে, একসঙ্গে-’
‘ওহ মাই গড! ইয়োর ম্যাজেস্টি এটা একটা মারাত্মক ভুল হয়েছে।’
‘কী করবো- পাগল হয়ে গিয়েছিলাম যে।’
‘ঘটনা জটিল হয়ে গেল।’
‘উচ্ছৃঙ্খল প্রিন্স ছিলাম তখন। বয়স কম ছিল। এখন আমার বয়স তিরিশ বছর।’
‘চিঠিগুলো ফেরত পেতেই হবে।’ হোমস বললো।
‘চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি।’ হতাশ গলায় বললো বোহেমিয়ার রাজা।
‘টাকা দিয়ে কিনে নিন ইয়োর ম্যাজেস্টি।’
‘বিক্রি করছে না।’
‘তাহলে চুরি করতে হবে।’
‘পাঁচবার চেষ্টা করেছি। পেশাদার চোর দিয়ে দুবার তার বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি। একবার ভ্রমণের সময় তার লাগেজ সরালাম। আরেকবার তাকে থামিয়ে চেক করা হলো। সব বৃথা।’
‘ছবিটা পাওয়া যায়নি?’
‘না।’
হেসে উঠলো হোমস। ‘এ দেখি এক মজার রহস্য।’ বললো সে।
‘হ্যাঁ, কিন্তু আমার জীবন-মরণ সমস্যা।’ একটু ক্ষুণ্ন রাজার গলা।
‘অবশ্যই...অবশ্যই। ছবি দিয়ে কী করতে চায় ইরিন?’
‘আমাকে ধ্বংস করতে চায়।’
‘কীভাবে?’
‘আমার বিয়ের সবকিছু ঠিকঠাক-’
‘হ্যাঁ শুনেছি।’
‘স্ক্যান্ডিনেভিয়ার রাজকন্যার সঙ্গে বিয়ে। তার পরিবার খুব রক্ষণশীল। এখন যদি এমন একটা স্ক্যান্ডাল প্রকাশ পায়, তাহলে বিয়েটা বরবাদ হয়ে যাবে।’
‘ইরিন ঠিক কী করতে চায়?’ প্রশ্ন করলো হোমস।
‘কনের কাছে ছবি পাঠানোর হুমকি দিয়েছে সে।’ জবাব দিল রাজা। ‘ইরিন কাজটা ঠিকই করবে। আপনি তো তাকে চেনেন না- পাথর দিয়ে তৈরি তার মন। অপরূপ সুন্দরী নারী ইরিন, কিন্তু তার হৃদয় ইস্পাতের চেয়েও কঠিন। এ বিয়ে ভাঙবার জন্য সবকিছু করবে সে।’
‘ছবি এর মধ্যেই পাঠিয়ে দেয়নি তো?’
‘না দেয়নি।’
‘কেন দেয়নি?’
‘বলেছে এনগেজমেন্ট যেদিন হবে, সেদিন পাঠাবে। আগামী সোমবার এনগেজমেন্ট।’
‘বেশ, তাহলে তিনদিন সময় আছে হাতে।’ হাই তুলতে তুলতে বললো হোমস। ‘এটা ভালো খবর। দু’একটা জরুরি কাজ সারতে হবে আমাকে। ইয়োর ম্যাজেস্টি এখন লন্ডনেই থাকবেন তো?’
‘হ্যাঁ, ল্যাংহাম হোটেলে আছি আমি। কাউন্ট ভন ক্রাম নামে।’
‘চিরকুট লিখে আপনাকে অগ্রগতির খবর জানাবো।’
‘প্লিজ তাই করুন। খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে আছি আমি।’
‘তাহলে, টাকা-পয়সার ব্যাপারটা?’
‘ব্ল্যাঙ্ক চেক দিচ্ছি আপনাকে।’
‘ব্ল্যাঙ্ক চেক?’
‘মিস্টার হোমস, ছবিটার বিনিময়ে আমার রাজ্যের একটা প্রভিন্স দিয়ে দিতে রাজি আছি আমি ।’
‘বেশ। কিন্তু এই মুহূর্তের খরচ?’
আলখাল্লার ভেতর থেকে ছোট একটা চামড়ার থলি বের করলো রাজা। টেবিলের উপর রাখলো। ‘এখানে তিনশ’ পাউন্ডের মোহর আছে, আর আছে সাতশ’ পাউন্ডের নোট।’ বললো সে।
হোমস তার নোট বইয়ের পৃষ্ঠা ছিঁড়ে রসিদ লিখে রাজার হাতে দিল।
‘মাদমোঁয়াজেলের ঠিকানা?’ জিজ্ঞেস করলো হোমস।
‘ব্রায়োনি লজ। সারপেন্টাইন এভিনিউ। সেন্ট জনস উড।’
ঠিকানা লিখে নিল হোমস। ‘শেষ প্রশ্ন।’ বললো সে। ‘ছবিটা কি কেবিনেট সাইজের?’
‘হ্যাঁ।’
‘শুভ রাত্রি ইয়োর ম্যাজেস্টি। আশা করি খুব শীঘ্র আপনাকে সুখবর দিতে পারবো।’ ব্রুহামের চাকার শব্দ মিলিয়ে গেলে আমিও বিদায় নিলাম। ‘গুড নাইট ওয়াটসন।’ বললো সে। ‘প্লিজ আগামীকাল বিকেল তিনটার দিকে যদি একবার আসো, তাহলে এই ছোট্ট রহস্যটা নিয়ে তোমার সঙ্গে আলোচনা করবো।’
দুই.
পরদিন ঠিক তিনটায় বেকার স্ট্রিটে পৌঁছে গেলাম। হোমস তখনো ফেরেনি বাইরে থেকে। ল্যান্ডলেডির কাছে জানতে পারলাম সে সকাল আটটার একটু পরে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। ফায়ারপ্লেসের পাশে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে পড়লাম, যতক্ষণ লাগে লাগুক- হোমস না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবো। এর আগে দুটো কেস নিয়ে কাজ করেছি হোমসের সঙ্গে। এবারের কেসটা আমাকে খুব কৌতূহলী করে তুলেছে- যদিও এটা আগেকার কেসগুলোর মতো ভয়ংকর মনে হচ্ছে না।
রাজা-মহারাজার ব্যাপার-স্যাপার জড়িত এখানে- এটাই কেসটার মূল আকর্ষণ। তাছাড়া রহস্যের জট ছাড়ানোর জন্য যে তীক্ষè বুদ্ধি, কৌশল আর দক্ষতা ব্যবহার করে আমার বন্ধু- সেটা কাছে থেকে দেখাও একটা আনন্দের ব্যাপার। তার সফলতা দেখতে দেখতে আমি এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে হোমস ব্যর্থ হবে- এটা আমি ভাবতেও পারি না।
প্রায় চারটার দিকে দরজা খুলে গেল। ভেতরে ঢুকলো একটা মাতাল টাইপ লোক, তার পোশাক-আশাক আউলা-ঝাউলা, চিবুকের দুপাশে লম্বা জুলফি। হোমস ছদ্মবেশ নিতে ওস্তাদ- তা আমি ভালো করেই জানি। তারপরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য বারবার দেখলাম লোকটাকে। শেষে নিশ্চিত হলাম- হ্যাঁ এটা হোমসই। আমার দিকে একবার মাথা ঝুঁকিয়ে সে বেডরুমে চলে গেল। পাঁচ মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে এলো পরিচিত হোমস- আগুনের সামনে বসলো পা ছড়িয়ে, তারপর আপন মনে হাসতে শুরু করলো।
‘কী কাণ্ড, দেখো!’ বললো হোমস, হাসতে হাসতে শরীরটাকে সে চেয়ারে এলিয়ে দিল।
‘ঘটনা কী?’
‘দারুণ মজার ঘটনা। ভাবতেই পারবে না সারাটা সকাল কীভাবে কাটালাম আমি, আর শেষে কী ঘটলো।’
‘মিস ইরিন এডলারকে অনুসরণ করছিলে নিশ্চয়ই।’ একটু ভেবে নিয়ে বললাম। ‘অথবা তার বাড়িটার ওপর নজর রাখছিলে, তাই তো?’
‘ঠিক। তবে কিছুটা পার্থক্য আছে। বলছি শোনো। ঘোড়ার সহিসের ছদ্মবেশ নিয়ে আমি বেরিয়ে গেছি সকাল আটটার দিকে, একজন বেকার সহিস, যে কাজ খুঁজছে। ঘোড়া নিয়ে যাদের কাজ-কারবার, দেখবে তাদের মধ্যে দারুণ একরকম সম্প্রীতি আছে- ওদের একজন যদি হতে পারো, ওরা তোমাকে সহজেই আপন করে নেবে। প্রথমে ব্রায়োনি লজ খুঁজে বের করলাম। ছোট্ট সুন্দর দোতলা বাড়ি, পিছনে বাগান, সামনে রাস্তা পর্যন্ত বাড়িটার সীমানা। মেইন গেটে তালা লাগানো। ডানদিকে বড়সড় ড্র্রইংরুম, আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো, ফ্রেঞ্চ উইন্ডো। পিছনে তেমন কিছু নাই, শুধু একটা ঘোড়ার আস্তাবল। সেখানে গিয়ে দেখি সহিসরা ঘোড়া দলাইমলাই করছে। তাদের দলে ভিড়ে গেলাম। পারিশ্রমিক পেলাম দুই পেন্স, এক গ্লাস বিয়ার, কিছু তামাক আর মিস এডলার সম্পর্কে প্রচুর তথ্য।’
‘কী তথ্য পেলে?’ আমি জানতে চাই।
‘রূপসী ইরিন এডলার তার রূপের ছটায় আশেপাশের সবার মুন্ডু ঘুরিয়ে দিয়েছে। সে নিয়মিত কনসার্টে গান গায়, প্রতিদিন বিকেল পাঁচটায় বেরিয়ে যায়, ফেরে ঠিক সন্ধ্যা সাতটায় ডিনারের জন্য। এছাড়া বাড়ি থেকে আর বের হয় না বলতে গেলে। একজন পুরুষের যাতায়াত আছে বাড়িটায়। কোচোয়ানের সঙ্গে খাতির জমিয়ে সেই লোকটার নাম-ঠিকানা ও তার সম্পর্কে অনেক তথ্যও পেয়ে গেলাম। সে হ্যান্ডসাম, প্রতিদিন অন্তত একবার আসে এই বাড়িতে, কোনোদিন দুবার। তার নাম মিস্টার গডফ্রে নর্টন, থাকে ইনার টেম্পলে।
সবকিছু জানার পর বাড়িটার সামনে চলে এলাম আবার। ভাবতে থাকলাম কীভাবে এগোলে ভালো হয়। গডফ্রে নর্টন লোকটা একজন আইনজীবী। নিশ্চয়ই তার গুরুত্বপূর্ণ কোনো ভূমিকা আছে ছবি-রহস্য ঘটনায়। ইরিনের সঙ্গে লোকটার কী সম্পর্ক, এত ঘন ঘন এই বাড়িতে আসে কেন সে? ইরিন কী তার ক্লায়েন্ট, বন্ধু, নাকি প্রেমিকা? যদি ক্লায়েন্ট হয়, তাহলে ফটোটা হয়তো আইনজীবীর কাছে চালান হয়ে গেছে। প্রেমিকা হলে সেই সম্ভাবনা কম। কাজেই তাদের সম্পর্কের উপর এখন নির্ভর করছে তদন্তের গতিপ্রকৃতি। কোথায় ফোকাস করবো- এখানে ব্রায়োনি লজে নাকি গডফ্রের ইনার টেম্পল ঠিকানায়? এতসব ডিটেইল দিয়ে তোমাকে বোধহয় বোর করছি, ওয়াটসন। কিন্তু এসব না বললে তো সমস্যাটা ঠিক বোঝা যাবে না।’
‘আমি মোটেও বোর হচ্ছি না।’ মন্তব্য করলাম। ‘খুবই আগ্রহ নিয়ে তোমার কথা শুনছি।’
‘বেশ। তো এইসব নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে ছিলাম।’ হোমস বলতে থাকলো। ‘এমন সময় দেখি একটা ক্যাব এসে দাঁড়ালো বাড়িটার সামনে। ক্যাব থেকে লাফ দিয়ে নামলো এক ভদ্রলোক। খুব হ্যান্ডসাম, গোঁফ আছে- বুঝলাম একটু আগে এর কথাই বলেছে কোচোয়ান আমাকে। দেখে মনে হলো ভীষণ তাড়া আছে লোকটার, ক্যাবম্যানকে সে অপেক্ষা করতে বললো চেঁচিয়ে। বাড়ির মেইড দরজা খুলে দিল- তার পাশ দিয়ে দ্রুত ভেতরে ঢুকে গেলো লোকটা। বোঝা যায় এই বাড়িতে তার নিয়মিত যাতায়াত আছে।
আধ ঘণ্টার মতো বাড়ির ভেতরে কাটালো লোকটা। তাকে আমি ড্রইংরুমের জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম- হাত নেড়ে কথা বলছে, পায়চারি করছে উত্তেজিতভাবে। ইরিনকে দেখা গেল না। একটু পর বেরিয়ে এলো লোকটা, খুব অস্থির। ক্যাবে উঠতে উঠতে পকেট থেকে ঘড়ি বের করে সময় দেখলো। ‘তুফানের বেগে ঘোড়া ছুটাও!’ চেঁচিয়ে বললো সে ক্যাবম্যানকে। ‘প্রথমে রিজেন্ট স্ট্রিট, তারপর এজওয়ার রোডে সেন্ট মনিকা চার্চে যাবে। অর্ধেক গিনি বখশিস- যদি কুড়ি মিনিটে পৌঁছাতে পারো!’
চলে গেল ক্যাব। পিছে পিছে যাবো কিনা ভাবছি, তখন একটা ল্যান্ডাউ এসে দাঁড়ালো। কোচম্যানের কোটের বোতাম খোলা, টাই ঠিকমতো পরার সময় পায়নি। ঘোড়াটা পুরোপুরি থামবার আগেই ঝড়ের বেগে বেরিয়ে এলো ইরিন এডলার। এক মুহূর্তের জন্য তাকে দেখলাম- অপরূপ সুন্দরী, এমন মেয়েদের জন্যই পুরুষরা মরতে রাজি থাকে।
‘সেন্ট মনিকা চার্চে যাও, জন।’ বললো ইরিন। ‘বিশ মিনিটে যেতে পারলে অর্ধেক মোহর বখশিস।’
দৌড়ে গিয়ে ল্যান্ডাউয়ের পিছে উঠবো কিনা ভাবছি, এমন সময় একটা ক্যাব পেয়ে গেলাম। আমার পোশাক-আশাক দেখে নিষেধ করতে যাচ্ছিলো- তার আগেই চড়ে বসলাম ক্যাবে, বললাম, ‘অর্ধেক মোহর পাবে, যদি কুড়ি মিনিটের মধ্যে সেন্ট মনিকা চার্চে যেতে পারো।’ বারোটা বাজতে তখন পঁচিশ মিনিট বাকি।
দ্রুত ছুটলো ক্যাব। পৌঁছে দেখি আমার আগেই অন্য দুজন পৌঁছে গেছে। তাদের ক্যাব আর ল্যান্ডাউ দাঁড়িয়ে আছে, ঘোড়াগুলোর গা থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। ক্যাবম্যানকে ভাড়া দিয়ে চার্চে ঢুকে গেলাম। ঐ দুজন আর যাজক দাঁড়িয়ে আছে বেদির সামনে। আর কেউ নেই চার্চে। সাধারণ একজন ভবঘুরে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরতে ঘুরতে যেভাবে গির্জায় ঢুকে যায়, সেভাবে ভেতরে ঢুকে আমি একটু এগিয়ে গেলাম আইল ধরে। হঠাৎ তিনজনই ঘুরে দাঁড়ালো এবং আমাকে চমকে দিয়ে গডফ্রে নর্টন ছুটে এলো আমার দিকে। ‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।’ বললো সে হন্তদন্ত হয়ে। ‘আপনাকে পেয়েছি, আসুন আসুন এদিকে।’
‘এ কী...! কী বিষয়?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
‘আসুন প্লিজ, মাত্র তিন মিনিট। নইলে আইনত বৈধ হবে না।’
কিছু বুঝে উঠবার আগেই আমাকে টানতে টানতে বেদির কাছে নিয়ে গেল নর্টন। কী ঘটছে, কী ঘটনা না বুঝেই আমি পাদ্রির কথা অনুযায়ী বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়তে শুরু করে দিলাম- এইসব মন্ত্রের বিন্দু বিসর্গও আমি জানি না। বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে ইরিন এডলার আর গডফ্রে নর্টন। চোখের পলকে আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়ে গেল। একদিকে বর অন্যদিকে কনে আমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছে, সামনে পাদ্রি তাকিয়ে আছেন হাসি মুখে।
এমন অদ্ভুত ঘটনা আমার জীবনে আর কখনো ঘটেনি ওয়াটসন- তাই হাসছিলাম একটু আগে। বিয়েতে একজন সাক্ষীর দরকার ছিল, সাক্ষী ছাড়া পাদ্রি বিয়ে দিতে পারছিলেন না। আমি এসে সবাইকে উদ্ধার করেছি। কনে আমাকে একটা মোহর দিয়েছে। ভাবছি আমার ঘড়ির চেইনের সঙ্গে মোহরটাকে লাগিয়ে নেবো- এমন একটা ঘটনার স্মৃতি হয়ে থাকবে মোহরটা।
‘সবকিছু তো ওলট-পালট হয়ে গেল।’ আমি বললাম। ‘তারপর কী হলো?’
‘তারপর তো বর-কনে গির্জা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে আর আমি ভাবছি এবার কী করবো। দেখি ওরা দুজন যার যার বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছে। ‘বিকেল পাঁচটার সময় বের হবো প্রতিদিনের মতো।’ ইরিন বললো গডফ্রেকে। ব্যস এটুকুই যথেষ্ট আমার জন্য। আমি আমার ব্যবস্থা করতে চললাম।’
‘কী ব্যবস্থা?’ কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইলাম।
‘আপাতত কোল্ড বিফ আর এক গ্লাস বিয়ার।’ আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বেল বাজালো হোমস। ‘এত ব্যস্ত ছিলাম সারাদিন খাবার কথা মনেই ছিল না। সন্ধ্যাটাও খুব ব্যস্ততায় কাটবে। ডাক্তার, তোমার সহযোগিতা আমার দরকার যে।’
‘আমি খুশি মনে রাজি।’
‘আইন ভাঙতে আপত্তি নেই তো?’
‘একটুও না।’
‘অ্যারেস্ট হওয়ার ঝুঁকি আছে কিন্তু।’
‘ভালো কাজে ঝুঁকি থাকবেই।’
‘হ্যাঁ, কাজটা খুবই ভালো এবং পরোপকারী।’
‘তাহলে আমি সদা প্রস্তুত।’
‘জানতাম তুমি রাজি হবে।’
‘কাজটা কী?’
‘মিসেস টার্নার আগে খাবারটা দিয়ে যাক, তারপর বলছি।’ ল্যান্ডলেডি একটা ট্রে দিয়ে গেলেন। ক্ষুধার্ত হোমস খাবারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। খেতে খেতে বললো, ‘সময় বেশি নেই। খেয়েই দৌড়াতে হবে ঘটনাস্থলে। এখন পাঁচটা বাজে। দু’ঘণ্টার মধ্যে মিস ইরিন...ও হ্যাঁ এখন মিসেস ইরিন- বাড়ি ফিরে আসবে। তার আগেই আমাদের ব্রায়োনি লজে পৌঁছাতে হবে।’
‘পৌঁছে তারপর?’
‘পরেরটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। শুধু একটা বিষয় খেয়াল রাখবে- যাই ঘটুক না কেন, কোনো অবস্থাতেই তুমি ইন্টারফেয়ার করবে না।’
‘কিছুই করবো না?’
‘একদম কিচ্ছুটি না। অপ্রিয় কিছু ঘটনা ঘটতে পারে। ধারেকাছেও যাবে না। এভাবেই হয়তো বাড়ির ভেতরে ঢুকতে পারবো আমি- একটু পরেই দেখবে ড্রইংরুমের জানালা খুলে গেছে। খোলা জানালার পাশে গিয়ে পজিশন নেবে।’
‘ঠিক আছে।’
‘আমার দিকে লক্ষ্য রাখবে। জানালা দিয়ে আমাকে দেখতে পাবে তুমি।’
‘ও. কে।’
‘একটা জিনিস দিচ্ছি তোমাকে। একসময় আমি এভাবে হাত তুলবো- হাত তোলা মাত্রই জিনিসটা তুমি ছুঁড়ে মারবে ভেতরে। তারপর আগুন আগুন বলে চিৎকার-চ্যাঁচামেচি জুড়ে দেবে। ঠিক ঠিক বোঝাতে পেরেছি?’
‘একশ’ পার্সেন্ট।’
‘জিনিসটা ভয়ানক কিছু নয়।’ হোমস আমাকে আশ্বস্ত করলো। সিগারের মতো দেখতে লম্বা একটা জিনিস সে বের করলো পকেট থেকে। ‘এটা একটা সাধারণ স্মোক-বোম, দুই মাথায় দুটো ক্যাপ আছে- ছুঁড়ে দিলে তাতে আগুন ধরে যাবে। এটুকুই তোমার কাজ। তুমি আগুন আগুন চিৎকার দেওয়া মাত্র আরও কয়েকজন লোক তোমার সঙ্গে যোগ দেবে। এরপর তুমি রাস্তার মাথায় গিয়ে অপেক্ষা করবে। একটু পরেই আমি চলে আসবো তোমার কাছে। সব ঠিক ঠিক বুঝেছো?’
‘আমি ইন্টারফেয়ার করবো না কোনো কিছুতে। জানালার কাছে পজিশন নেবো। ইশারা পাওয়া মাত্র স্মোকবোম জানালা দিয়ে ছুঁড়ে আগুন আগুন চিৎকার দিতে থাকবো, তারপর রাস্তার মাথায় গিয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করবো।’
‘একদম ঠিক।’
‘নিশ্চিন্ত থাকো- যা বলেছো, তাই করবো অক্ষরে অক্ষরে।’
‘চমৎকার। এবার তাহলে আমি আমার নতুন ভূমিকার জন্য প্রস্তুত হই।’
ঘরের ভেতরে চলে গেল হোমস। একটু পরে বেরিয়ে এলো পাদ্রির ছদ্মবেশে। কে বলবে পাদ্রির কালো পোশাক পরা, চওড়া হ্যাট মাথায় এই লোকটা আমার বন্ধু হোমস। পাদ্রিদের মতোই তার হাবভাব, মুখের হাসি, সরল চাহনি। অভিনয় করলে ভালো অভিনেতা হতে পারতো হোমস।
সোয়া ছয়টার সময় আমরা বেকার স্ট্রিট থেকে রওনা দিলাম। ব্রায়োনি লজে যখন পৌঁছালাম সাতটা বাজতে দশ মিনিট বাকি। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, রাস্তার বাতিগুলো কেবলি জ্বলে উঠেছে। আমরা অপেক্ষা করছি বাড়ির বাসিন্দার ফিরে আসার। হোমসের বর্ণনা শুনে বাড়িটা যেমন কল্পনা করেছিলাম ঠিক তেমনই দেখতে পেলাম।
তবে আশপাশের পরিবেশ যতটা নিরিবিলি ভেবেছিলাম, ততটা নিরিবিলি নয়। রাস্তায় বেশ মানুষের ভিড়। একটু দূরে পুরনো ময়লা পোশাক পরা একদল লোক সিগারেট খাচ্ছে, হাসাহাসি করছে- ছুরি-কাঁচি ধার দেওয়ার লোকটা বসে আছে একপাশে, দুজন গার্ড মশকরা করছে এক নার্সের সঙ্গে, আর কয়েকজন সুবেশধারী যুবক সিগার মুখে ইতস্তত পায়চরি করছে রাস্তায়।
‘বুঝলে তো,’ হোমস বললো, ‘ওদের বিয়েটা অনেক কিছু সহজ করে দিয়েছে।’ এদিক-ওদিক হাঁটছি আমরা দুজন। হাঁটতে হাঁটতে হোমস বললো, ‘এখন ইরিনও চাইবে না ছবিটা গডফ্রের চোখে পড়ুক, যেমন আমাদের ক্লায়েন্ট চাচ্ছে না তার বাগদত্তার হাতে পড়ুক এই ছবি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ছবিটা কোথায়?’
‘সেটাই প্রশ্ন।’ আমি সায় দিলাম।
‘ছবিটা কেবিনেট সাইজের। পোশাকের মধ্যে লুকিয়ে রাখার উপায় নাই। তাছাড়া ইরিন জানে বোহেমিয়ার রাজা তক্কে তক্কে আছে, দুবার চেষ্টা করা হয়েছে ছবিটা ছিনিয়ে নেওয়ার। কাজেই আমরা ধরে নিতে পারি ছবিটা নিজের সঙ্গে নিয়ে ঘোরাঘুরি করবে না ইরিন।’
‘তাহলে কোথায় থাকতে পারে সেই যক্ষের ধন?’
‘তার আইনজীবী কিংবা ব্যাঙ্কারের কাছে রাখতে পারে। কিন্তু কী জানো, মেয়েদের মন বড় বিচিত্র- তারা গোপন বিষয় সহজে কাউকে জানাতে চায় না। আমার মনে হয় ছবিটা এই বাড়িতেই আছে। ভেবে দেখো, দু’একদিনের মধ্যেই ছবিটাকে কাজে লাগাবে ইরিন- সেক্ষেত্রে ছবিটা সে হাতের কাছে রাখবে এটাই যুক্তিসঙ্গত। হ্যাঁ ছবিটা এখানেই কোথাও আছে, এই বাড়িতে।’
‘কিন্তু এই বাড়িতেও দুবার সার্চ করেছে রাজার লোকেরা।’
‘ঠিকমতো খুঁজতে জানে না ওরা।’
‘তুমি জানো?’
‘আমিও জানি না।’
‘তবে?’
‘ইরিন আমাকে জানাবে।’
‘জানাবে না।’
‘জানাতে বাধ্য হবে। ঐ যে গাড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছে। রেডি হও। যা যা বলেছি একদম অক্ষরে অক্ষরে করা চাই কিন্তু।’
হোমসের কথা শেষ হতে না হতেই পথের মোড়ে হেডলাইটের আলো দেখা গেল। ছিমছাম চেহারার ল্যান্ডাউটা এসে দাঁড়ালো ব্রায়োনি লজের সামনে। গাড়িটা কাছে আসতেই রাস্তার ভবঘুরেদের মধ্যে থেকে একজন দৌড়ে এলো গেট খুলে দেওয়ার জন্য, দুটো পয়সা বখশিস পাওয়ার আশায়। তার আগেই আরেকজন এসে কনুইয়ের ধাক্কায় প্রথমজনকে হঠিয়ে দিল। দুজনের মধ্যে ঝগড়া লেগে গেল। দূরের গার্ড দুজনও এসে যোগ দিল- তারা একজনের পক্ষে, ওদিকে ছুরি-কাঁচিওয়ালাও যোগ দিল আরেকজনের পক্ষে। বেধে গেল তুমুল ঝগড়াঝাটি। একজন আরেকজনকে ঘুসি বাগিয়ে আক্রমণ করছে।
গাড়ি থেকে নেমে এসবের ঠিক মাঝখানে পড়ে গেলেন যাত্রী ভদ্রমহিলা। হোমস তাকে উদ্ধার করার জন্য ছুটে গেল। কিন্তু কাছাকাছি পোঁছেই সে একটা চিৎকার দিয়ে পড়ে গেল মাটিতে- মারমুখো একজনের ঘুসি লেগেছে তার মুখে। হোমসের নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে। এই দৃশ্য দেখে গার্ড দুজন পালালো একদিকে, বাকিরা আরেক দিকে।
সুবেশধারী যুবকেরা এতক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে ঘটনা দেখছিল। তারা এবার এগিয়ে এলো ভদ্রমহিলাকে আর আহত হোমসকে সাহায্য করার জন্য। ইরিন এডলার সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত উঠে যাচ্ছিলো- দৃশ্যটা আমার স্পষ্ট মনে আছে আজও- সিঁড়ির শেষ ধাপে উঠে সে ফিরে তাকালো, পেছনে সিঁড়িঘরের আলো- তার অপরূপ ফিগার স্পষ্ট ফুটে আছে সেই আলোতে।
‘ভদ্রলোক কী খুব বেশি আহত হয়েছেন?’ জিজ্ঞেস করলো ইরিন।
‘মরেই তো গেছে।’ এক সঙ্গে কয়েকজন বলে উঠলো।
‘না না, মরেনি। বেঁচে আছে এখনো।’ আরেকটা গলা শোনা গেল। ‘তবে হাসপাতালে নিতে নিতে বোধহয় শেষ হয়ে যাবে।’
‘ভদ্রলোকের সাহস আছে।’ জনৈক নারীকণ্ঠের মন্তব্য। ‘উনি বাধা না দিলে ভদ্রমহিলার ঘড়ি আর পার্স নিয়ে গুণ্ডারা পালিয়ে যেত। ওরা একটা ভয়ংকর গ্যাং। এই যে...ভদ্রলোক নিঃশ্বাস নিচ্ছে দেখতে পাচ্ছি।’
‘কিন্তু এখানে রাস্তার মাঝখানে তো একে ফেলে রাখা যায় না। ম্যা’ম ওনাকে কী ঘরের ভেতরে নেওয়া যায়?’ কেউ একজন প্রশ্ন করলো ইরিনকে।
‘অবশ্যই। ড্রইংরুমে এনে রাখুন। সোফায় শুইয়ে দিন। এই যে এখানে।’
হোমসকে ধরাধরি করে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো। সোফার উপরে শুয়ে আছে হোমস- এখান থেকে সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমি। ঘরের আলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুয়ে শুয়ে কী ভাবছে হোমস জানি না, কিন্তু অপরূপ রূপসী যে নারীর বিরুদ্ধে আমরা এইসব ষড়যন্ত্র আর অভিনয় করছি- সে পরম মমতায় আহত হোমসের সেবাযত্নের চেষ্টা করছে দেখে আমি মনে মনে ভীষণ লজ্জিত হলাম।
জীবনে এত লজ্জা আর কখনো পাইনি। কিন্তু এই মুহূর্তে যদি পিঠটান দিই তাহলে বন্ধু হোমসের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে- তা আমি করতে পারি না। মনটাকে শক্ত করলাম, পকেট থেকে স্মোক বোম বের করে হাতে নিলাম। নিজেকে এই বলে সান্ত¦না দিলাম যে ইরিনকে আমরা আঘাত করছি না, আহত করছি না- অন্যকে যেন সে আহত করতে না পারে সেই চেষ্টা করছি।
হোমস উঠে বসেছে, অভিনয় করছে যেন তার ভীষণ শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। একজন পরিচারিকা তাড়াতাড়ি এসে জানালা খুলে দিল। হোমস হাত তুলেছে। তার ইঙ্গিত পাওয়া মাত্র আমি বোমটা ছুড়ে দিলাম ঘরের ভিতরে, চেঁচিয়ে উঠলাম ‘আগুন! আগুন!!’ জানালা দিয়ে ঘন ধোঁয়ার কুণ্ডলি বের হচ্ছে। ভেতরে লোকজনের ছুটোছুটি দেখতে পাচ্ছি, একটু পরে হোমসের গলা ভেসে এলো- ‘সব ঠিক আছে, সব ঠিক আছে। আগুন লাগেনি, ফলস অ্যালার্ম।’
রাস্তায় ভিড় জমে গেছে, ভিড়ের মধ্যে দিয়ে আমি নির্দিষ্ট জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। মিনিট দশেক পরে হোমস চলে এলো, ওকে দেখে আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। মিনিট কয়েক নীরবে দ্রুত হেঁটে আমরা অন্য একটা রাস্তায় এসে পড়লাম- এই রাস্তাটা গেছে এজওয়ার রোডের দিকে।
‘ঠিকঠাক কাজটা করেছো, ডাক্তার।’ এতক্ষণে কথা বললো হোমস। ‘একদম ঠিকঠাক। এর চেয়ে ভালো আর কিছু হয় না।’
‘ফটোটা পেয়েছো?’
‘পাইনি, কিন্তু জানি কোথায় আছে ওটা।’
‘কীভাবে জানলে?’
‘বলেছিলাম না ইরিনই আমাকে দেখাবে? ঠিক দেখিয়ে দিয়েছে।’
‘কী বলছো, বুঝছি না কিছুই।’
‘আচ্ছা খুলে বলছি।’ হাসলো হোমস। ‘খুব সহজ ব্যাপার। রাস্তার লোকগুলোকে আমিই কাজে লাগিয়েছি, সেটা নিশ্চয়ই বুঝেছো।’
‘হ্যাঁ, সেটা বুঝতে পেরেছি।’‘
‘আমি আসলে আহত হইনি। আমার হাতে রং লুকানো ছিল। মারামারির মাঝখানে গিয়ে পড়ে যাই আমি, লাল রংটা কপালে চেপে ধরতেই সবাই ভাবলো আমার মাথা ফেটে রক্তারক্তি কান্ড ঘটে গেছে। ছুটে পালালো ওরা। এ সবই অভিনয়।’
‘সেটাও বোঝা গেছে।’
‘তারপর তো দেখলেই আমাকে বয়ে নিয়ে গেল ভেতরে। ইরিন নিজেই অনুমতি দিল। না দিয়ে তার উপায় কী? তো এভাবে ঢুকে গেলাম ড্রইংরুমে, যেখানে ছবিটা আছে বলে আমি অনুমান করেছিলাম। হয় ড্রইংরুমে নাহলে তার বেডরুমে। আমি নিশ্চিত হতে চেয়েছিলাম কোন ঘরে আছে ছবিটা। তারপর শ্বাসকষ্টের অভিনয়। জানালা খুলে গেল। তুমি সুযোগ পেয়ে গেলে বোম মারার।’
‘তাতে কী লাভ হলো?’
‘আরে এখানেই তো আসল ট্রিক। ঘরে আগুন লাগলে ঘরের মালিক কি করবে? প্রথমেই ছুটে যাবে তার সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটাকে বাঁচাতে, তাই না? এই ট্রিক আমি আগেও ব্যবহার করেছি। দেখেছি মা ছুটে যায় তার সন্তানকে বাঁচাতে, কুমারি মেয়ে ছুটে গিয়ে তুলে নেয় তার গহনার বাক্স। আমি জানতাম ইরিন ছুটে যাবে ফটোটাকে উদ্ধার করতে। কারণ এই মুহূর্তে এর চেয়ে মূল্যবান জিনিস তার কাছে আর কিছুই না।
তোমার আগুন আগুন চিৎকার সবার মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে। তাছাড়া ধোঁয়ায় ভরে গেছে ঘর। ইরিনের প্রতিক্রিয়া ছিল চমৎকার। সে দৌড়ে গেল তার গুপ্তধনের কাছে। ছবিটা আছে দরজার পেছনে ঘণ্টা বাজানোর দড়িটার ঠিক উপরে একটা স্লাইডিং প্যানেলের পেছনে। ছবিটা সে বের করতে নিচ্ছিলো, তার আগেই আমি চিৎকার দিয়ে জানিয়ে দিয়েছি আগুন লাগেনি, ভয়ের কিছু নেই। ধোঁয়ার ভিতর দিয়ে দেখতে পেলাম ফটোটা সে আবার আগের জায়গায় রেখে দিল- মেঝেতে পড়ে থাকা বোমের দিকে একবার তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। তারপর তাকে আর দেখিনি। একবার ভাবলাম এখনি ফটোটা নিয়ে যাই। কিন্তু ততক্ষণে কোচম্যান ঘরে ঢুকেছে- আমাকে বেরিয়ে আসতে হলো। আরেকটু ধৈর্য ধরতে হবে আমাদের।’
‘তাহলে এখন কী প্ল্যান?’
‘কাজ তো মোটামুটি শেষ। আগামীকাল রাজা মশায়কে নিয়ে এই বাড়িতে আবার আসবো আমরা। তুমি সঙ্গে থাকলে খুব ভালো হয়। আমরা গৃহকর্ত্রীর সাক্ষাৎ প্রার্থী হবো। ড্রইংরুমে বসে অপেক্ষা করবো। কিছুক্ষণ পর গৃহকর্ত্রী যখন ড্রইংরুমে ঢুকবেন, তখন সেখানে আমরাও থাকবো না, ফটোটাও থাকবে না। হিজ ম্যাজেস্টি নিজ হাতে নিজের ফটো উদ্ধার করবেন, সেটাই ভালো হবে।’
‘কটার সময় আসবো এখানে?’
‘সকাল আটটায়। তখনো গৃহকর্ত্রী বিছানায় থাকবেন। আমরা ফাঁকা ময়দান পাবো। যা করার ঝটপট করতে হবে ডাক্তার। কেননা বিয়ের পর গৃহকর্ত্রীর জীবনে নানারকম পরিবর্তন ঘটবে এখন, যে কোনো সময়। রাজাকে এখনই মেসেজ পাঠাতে হবে।’
আমরা বেকার স্ট্রিটে পৌঁছে গেলাম। দরজায় দাঁড়িয়ে আছি, হোমস চাবির জন্য পকেট হাতড়াচ্ছে। এমন সময় কে যেন আমাদের পাশ দিয়ে চলে গেল। যেতে যেতে বললো, ‘গুড নাইট, মিস্টার শার্লক হোমস।’
আশপাশে অনেক মানুষ। ওভারকোট পরা ছিপছিপে এক যুবককে দেখলাম দ্রুত চলে যাচ্ছে- মনে হলো সে-ই কথাটা বলেছে।
‘গলাটা খুব চেনা চেনা লাগলো।’ আধো অন্ধকার গলির দিকে তাকিয়ে কথাটা বললো হোমস। ‘ভাবছি...কে এই যুবক!’
তিন.
রাতটা বেকার স্ট্রিটে থেকে গেলাম। সকালে টোস্ট আর কফি দিয়ে নাস্তা করছি, এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে বোহেমিয়ার রাজা ঢুকলো ঘরে।
‘ফটোটা পেয়ে গেছেন সত্যিই?’ উত্তেজিত গলা তার।
‘এখনো পাইনি।’
‘পাওয়ার আশা আছে?’
‘আছে।’
‘তাহলে চলুন। আমি আর ধৈর্য ধরতে পারছি না।’
‘একটা ক্যাব ডাকতে হবে।’
‘ডাকতে হবে না। আমার ব্রুহাম সঙ্গেই আছে।’
‘তাহলে তো কথাই নেই। চলুন।’
‘ইরিন এডলার এখন বিবাহিতা নারী।’ হোমস বললো।
‘বিবাহিতা? কবে বিয়ে করলো?’
‘গতকাল।’
‘কাকে করলো বিয়ে?’
‘নর্টন নামে একজন ইংলিশ আইনজীবীকে।’
‘তাকে নিশ্চয়ই ভালোবাসে না ইরিন।’
‘আশা করি বাসে।’
‘আশা করেন? কেন বলুন তো?’
‘ইয়োর ম্যাজেস্টি, সে যদি নর্টনকে ভালোবাসে তাহলে আপনার দুশ্চিন্তার আর কোনো কারণ থাকে না। কেননা নর্টনকে ভালোবাসলে সে আর আপনাকে ভালোবাসবে না, সহজ হিসাব। আপনাকে ভালো না বাসলে আপনার ব্যাপারে তার আর মাথাব্যথাও থাকবে না।’
‘সত্যি কথা। তারপরও...আমার ভাবতে ভালো লাগে- বোহেমিয়ার রানী হলে তাকে দারুণ মানাতো।’ কথাটা বলে কেমন যেন হঠাৎ নীরব হয়ে গেল বোহেমিয়ার রাজা।
ব্রায়োনি লজের দরজা খোলা। বয়স্ক একজন মহিলা গৃহকর্মী দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়ির উপরের ধাপে। তার চোখেমুখে বিদ্রুপের হাসি। ব্রুহাম থেকে নেমে দাঁড়াতেই মহিলা বললো, ‘মিস্টার শার্লক হোমস নিশ্চয়ই?’
হোমস চমকে উঠলো। একটু অবাক হয়ে বললো, ‘হ্যাঁ, আমিই মিস্টার হোমস।’
‘আমার মিসট্রেস বলছিলেন আপনি আসতে পারেন। তিনি তার স্বামী সহ ইউরোপের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন সোয়া পাঁচটার ট্রেনে, চ্যারিং ক্রস স্টেশন থেকে।’
‘কী!’ থমকে দাঁড়ালো হোমস। হতভম্ব হয়ে গেছে সে। ‘আপনি বলছেন তিনি ইংল্যান্ড ছেড়ে চলে গেছেন?’
‘চলে গেছেন এবং আর ফিরবেন না বলে গেছেন।’
‘তাহলে আমার কাগজপত্র?’ হতাশ গলায় জিজ্ঞেস করলো রাজা। ‘সব নিয়ে গেছে নিশ্চয়ই?’
‘দেখা যাক।’ গৃহকর্মীকে পাশ কাটিয়ে ড্রইংরুমে ঢুকলো হোমস। পিছে পিছে আমি আর রাজা। ঘরের ভেতরে আসবাবপত্র সব এলোমেলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। শেলফের পাল্লা খোলা, ড্রয়ার বের হয়ে আছে- দেখে মনে হয় যাওয়ার আগে তাড়াহুড়োয় এইসব নাড়াচাড়া করেছে কেউ। কলিংবেলের দড়ির পেছনের স্লাইডিংয়ের কাছে দৌড়ে গেল হোমস। ভেতরে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনলো একটা ছবি আর একখানা চিঠি। ছবিটা ইরিন এডলারের, ইভনিং ড্রেস পরে আছে সে। চিঠির খামে শার্লক হোমসের নাম লেখা। খাম খুলে চিঠিটা বের করলো হোমস। আমরা দুজন হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। চিঠিতে লেখা-
‘মাই ডিয়ার মিস্টার শার্লক হোমস,
দারুণ দেখিয়েছেন। প্রথমে খুব অবাক হয়েছিলাম আমি। আগুন আগুন চিৎকার শোনার আগে পর্যন্ত বুঝতেই পারিনি ঘটনা কী। তারপর যখন বুঝতে পারলাম গুপ্তধনের জায়গাটা আপনাকে দেখিয়ে দিয়েছি, তখনই আমার ভুল ভাঙলো। অনেকদিন আগেই বন্ধুরা আমাকে সতর্ক করেছে। তাদের ধারণা ছিল- রাজা যদি কাউকে এ কাজের জন্য নিযুক্ত করে, তাহলে সেই যোগ্য ব্যক্তিটি হবেন আপনি। আপনার ঠিকানাও তারা আমাকে দিয়ে রেখেছে।
যা হোক, এতকিছুর পরেও সেদিনের সেই আহত দয়ালু পাদ্রিকে আমি এতটুকুও সন্দেহ করিনি প্রথমে। কিন্তু জানেন তো, আমি নিজেও একজন অভিনেত্রী। পুরুষের ছদ্মবেশ দেখে অভ্যেস আছে আমার। নিজেও আমি অনেক সময় পুরুষের ছদ্মবেশে চলাফেরা করি। এতে অনেকটা স্বাধীনতা পাওয়া যায়। ঘর ধোঁয়ায় ভরে গেলে আমি আমার কোচম্যানকে আপনার পাহারায় রেখে উপরে চলে গিয়েছিলাম। দ্রুত ছদ্মবেশ পরে নিই। যুবক সেজে যখন নিচে এলাম দেখি আপনি বেরিয়ে যাচ্ছেন।
আপনাকে অনুসরণ করে আপনার বাড়ি পর্যন্ত গিয়েছিলাম আমি। নিশ্চিত হতে চেয়েছিলাম যে সত্যিই সেলিব্রিটি মিস্টার শার্লক হোমস আমার বিষয়ে ইন্টারেস্টেড কিনা। তারপর বোকার মতো কাজটা করে ফেললাম- আপনাকে শুভরাত্রি জানালাম পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়। সেখান থেকে চলে গেলাম আমার স্বামীর বাসায়।
দুজনে মিলে প্ল্যান করলাম ইংল্যান্ড ছেড়ে চলে যাওয়াই ভালো হবে- কেননা আমাদের পিছে লেগেছেন বিখ্যাত ডিটেকটিভ মিস্টার শার্লক হোমস। আপনি এসে দেখবেন নীড় ফাঁকা, পাখি উড়ে গেছে। হ্যাঁ ছবিটার বিষয়ে বলি...আপনার ক্লায়েন্টকে জানাবেন তার দুশ্চিন্তার কিছু নেই। তার থেকে শ্রেয় একজন মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি আমি- আমিও তাকে ভালোবাসি।
রাজাকে বলবেন তিনি যে নারীকে দুঃখ দিয়েছেন, সে আর কখনো তাকে বিরক্ত করবে না। ছবিটা আমি রেখে দিলাম সাবধানতা হিসেবে, অস্ত্র হিসেবে- যাতে আমাকেও কেউ আর বিরক্ত না করতে পারে। আমার একটা ছবিও আমি দিয়ে গেলাম রাজাকে। আমার শেষ উপহার।
আপনার একান্ত-
ইরিন নর্টন এডলার
‘বাপরে! কী সাংঘাতিক মেয়ে?’ রাজা বলে উঠলো। ‘আগেই বলেছিলাম এ হচ্ছে ডাকিনি মেয়ে। রানী হলে দুর্দান্ত মানাতো তাকে। কিন্তু কী আর করা- সামাজিক দিক দিয়ে আমার লেভেলের নয় সে।’
‘হ্যাঁ ইয়োর ম্যাজেস্টি, যতটুকু চিনলাম তাকে, তাতে বলতে পারি এই নারী আপনার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন লেভেলের।’ হোমস বললো। ‘আমি দুঃখিত আপনার কাজটা ঠিকঠাক মতো করে দিতে পারলাম না।’
‘ঠিক মতোই করে দিয়েছেন।’ খুশি খুশি গলায় বললো রাজা। ‘এর চেয়ে ভালো সমাধান আর হতে পারে না। এই নারী তার কথা রাখবে আমি জানি। ছবিটা ইরিনের কাছে থাকা আর আগুনে পুড়ে শেষ হয় যাওয়া একই কথা। আমি নিশ্চিন্ত।’
‘শুনে খুশি হলাম ইয়োর ম্যাজেস্টি।’
‘আমিও সন্তুষ্ট আপনার ওপর। বলুন কীভাবে আপনাকে প্রতিদান দিতে পারি। এই আংটিটা যদি-।’ হাতের মূল্যবান পান্নার তৈরি আংটিটা খুলে হোমসের দিকে এগিয়ে দিল রাজা।
‘এর চেয়েও মূল্যবান একটা জিনি