ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৭ জুলাই ২০২৫, ২ শ্রাবণ ১৪৩২

মধুসূদন দত্তের নাট্যসাহিত্যের আলোকিত ভুবন

সাগর জামান

প্রকাশিত: ১৮:০০, ১৭ জুলাই ২০২৫

মধুসূদন দত্তের নাট্যসাহিত্যের আলোকিত ভুবন

মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন একজন অগ্রসর কবি ও নাট্যকার। তার নাট্য সাহিত্যে সমাজ ও পরিপার্শ্ব চিত্রিত হয়েছে। মাইকেলের কবিতা, নাটক, তার ব্যঙ্গাত্মক সাহিত্য প্রহসন রচনার কারণে তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব মাইকেল আধুনিক নাট্যকার হিসাবে সমধিক পরিচিত। বাংলা সাহিত্য জগতে তিনি আবির্ভূত হন নাটক রচনার মাধ্যমে। নাট্যকার হিসেবেই শুরুতে মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্য জগতে আত্মপ্রকাশ করেন। পরবর্তীতে তিনি কবিতা রচনায় মনোনিবেশ করেছেন। কবিতার পাশাপাশি নাটক রচনার ক্ষেত্রে তার সপ্রতিভ উজ্জ্বল উপস্থিতি সবার মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে। তিনি একজন নাট্যকার হিসেবে খুব সহজে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। তিনি কবিতা রচনা করেও বাংলা সাহিত্যকে তিনি আলোকিত করেছেন। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে মধুসূদন আলাদা লৈখিকরীতি, নতুন নাট্য সাহিত্য ও কাব্য ভাবনা, বক্তব্য, ভাষাভঙ্গি দিয়ে স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করেন। তার রচনায় জীবন ঘনিষ্ঠতা ও প্রাণচাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যায়। তিনি গতানুগতিক ধারাকে পরিহার করে নতুন ধারা নির্মাণে ব্রতী হন। আলাদা পথে তিনি সাহিত্য সাধনায় অগ্রবর্তী থেকেছেন। তার রচিত নাটক গভীরতায় সম্প্রসারিত হয়েছে। মধুসূদন দত্ত
নাটক রচনার বিষয় বৈচিত্র্যে, বর্ণনার ও রূপব্যঞ্জনা নির্মাণে আধুনিক রূপায়ণ ঘটাতে পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়েছেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত অমিত্রাক্ষর ছন্দ ও সনেটের প্রবর্তক। তিনি স্বার্থক কমেডি ও ট্র্যাজেডি নতুন মাত্রা দিয়ে উজ্জ্বল প্রতিভার প্রমাণ দিয়েছেন। তার স্মরণীয় রচনা তাকে আদৃত করেছে। ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার কপোতাক্ষ নদের তীরে সাগরদাঁড়ি গ্রামে বিখ্যাত দত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম রাজনারায়ণ দত্ত। মাইকেলের পিতা ছিলেন জমিদার। তার মায়ের জাহ্নবী দেবী। মধুসূদনের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় মা জাহ্নবী দেবীর কাছে। জাহ্নবী দেবীর মুখে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ প্রভৃতি শোনেন ছেলেবেলায়। তেরো বছর বয়সে মদুসূদন দত্ত কলকাতা যান এবং স্থানীয় একটি স্কুলে কিছুদিন পড়াশোনার পর তিনি সে সময়কার হিন্দু কলেজে (বর্তমানে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন। তিনি বাংলা, ফরাসি ও সংস্কৃত ভাষায় শিক্ষালাভ করেন। এরপর তিনি কলকাতার বিশপস কলেজে অধ্যয়ন করেন। এখানে তিনি গ্রিক, ল্যাটিন ও সংস্কৃত ভাষা শেখেন। পরবর্তীতে আইনশাস্ত্রে পড়ার জন্য তিনি ইংল্যান্ড যন। 
তিনি বাংলা সাহিত্যের পাশাপাশি ইংরেজি সাহিত্যেও অসামান্য অবদান রাখায় বিশ্ববাসী এ ধীমান কবিকে মনে রেখেছে কৃতজ্ঞচিত্তে। পাশ্চাত্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ১৮৪৩ সালে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হন এবং মাইকেল উপাধি গ্রহণ করেন। ইংরেজি সাহিত্যে তাঁর কীর্তির যথাযথ মূল্যায়ন না হওয়ায় তিনি মনোক্ষুণ্ন্ন হয়ে পড়েন। ইংরেজি সাহিত্য থেকে দূরে সরে বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন। বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্তের কালজয়ী রচনাবলীর অন্যতম হলো মেঘনাদবধ কাব্য, ক্যাপটিভ লেডি, শর্মিষ্ঠা, তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য, কৃষ্ণকুমারী, বুড়ো শালিকের ঘাঁড়ে রোঁ, পদ্মাবতী, ব্রজাঙ্গনা কাব্য, বীরাঙ্গনা কাব্য, হেক্টরবধ, চতুর্দশপদী কবিতাবলী। 
১৮৫৯ সালে রচনা করেন পৌরাণিক নাটক শর্মিষ্ঠা। ১৮৬০ সালে রচনা করেন একেই বলে সভ্যতা, বুড়ো শালিকের ঘাঁড়ে রোঁ এবং পদ্মাবতী নাটক। পদ্মাবতী নাটকেই তিনি প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেন। এরপর ১৮৬১ সালে মেঘনাদ বধ মহাকাব্য, ব্রজাঙ্গনা কাব্য, কৃষ্ণকুমারী নাটক, ১৮৬২ সালে পত্রাকাব্য বীরাঙ্গনা এবং ১৮৬৬ সালে চতুর্দশপদী কবিতাবলী রচনা করেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক কবি হিসাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক তিনি। সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্য জগতে এক নতুন যুগের সূচনা করে। তিনি প্রথম মহাকাব্য ‘মেঘনাদ বধ’ রচনা করে তিনি বিশেষ পরিচিতি লাভ করেন। পাঠকদের কাছে ভীষণভাবে অভিনন্দিত হন। ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি মধুসূদন দক্তের ভীষণ আকর্ষণ ছিলো। ইংরেজি সাহিত্য অনুরাগী ছিলেন বলেই তিনি ইংরেজি ভাষায় কবিতা গল্প নাটক উপন্যাস রচনা করে খ্যাতি অর্জন করার বাসনা তার ছিলো। মধুসূদন দত্তের স্বপ্ন ছিলো ইংরেজি সাহিত্য রচনা করে শেক্সপিয়র, মিল্টনের মতো খ্যাতিমান হবার। কিন্তু ইংরেজি সাহিত্যে তার রচনা তেমন চমক সৃষ্টি করতে পারেনি। তখন তিনি ব্যর্থতা নিয়ে বাংলা সাহিত্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। আকস্মিকভাবেই বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তার বিচিত্র নাট্যসাহিত্যের কিছু নমুনা তুলে ধরার চেষ্টা করছি। পাইকপাড়ার রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় বেলগাছিয়ার বাগান বাড়িতে একটি নাট্যচক্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। রাম নারায়ণ তর্কাবত্নের রত্নাবলী ও নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করার দায়িত্ব মধুসূদন দত্তের উপর অর্পিত হয়। এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিলো মূলত ইংরেজ দর্শকদের চাহিদা বিবেচ্য নয়। 
১৯১৮ সালে মধুসূদন দত্ত প্রচলিত সংস্কৃত রীতির বাইরে গিয়ে শর্মিষ্ঠা নাটক রচনা করেন। পাশ্চাত্য সাহিত্যের সুর নতুনভাবে অনুরণিত হতে দেখা যায় মধুর সাহিত্যে। তিনি নাট্য সাহিত্যের নতুন ধারা আবিষ্কারে প্রয়াসী হয়েছিলেন। পাশ্চাত্য সাহিত্য থেকে উপাদান সংগ্রহ ও রূপান্তরের মাধ্যমে মাইকেল মধুসূদন তার রচনা দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে মহিমান্বিত করেছেন। ২৯৫৯ সালে মধুসূদন রচিত পদ্মাবতী নাটকটি গ্রীক উপাখ্যান অবলম্বনে রচিত হয়েছে। এই নাটকে প্রথম অমিতাক্ষর ছন্দের প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। পদ্মাবতী নাটকে নারীর সৌন্দর্যের ঈর্ষাকে তুলে ধরা হয়েছে। গ্রিক পুরাণের কাহিনী অবলম্বনে রচিত পদ্মাবতী নাটকে ভারতীয় পুরাণ এবং সমাজের নানা চিত্র পরিস্ফুট হয়েছে। রাষ্ট্রব্যবস্থা সমাজের বিরাজমান নানা অসঙ্গতি অনিয়ম ঘাত প্রতিঘাত বিদ্রোহ মাইকেল মধুসূদন দত্তের নাট্যসাহিত্যের মুখ্য প্রতিপাদ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। সামাজিক অনিয়ম দুরাচার তাকে ব্যথিত করেছে। তিনি এসব বিষয়কে কেন্দ্র করে তাই রচনা করেছেন সামাজিক রম্য রচনা, ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ ও বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো। মাইকেলের এ ধরনের রচনায় ইয়াং বেঙ্গলে উচ্ছৃঙ্খল যুবকদের বেপরোয়া জীবন যাপনের চিত্র উঠে এসেছে। বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো একটি ব্যঙ্গাত্মক রচনা। সংস্কারাচ্ছন্ন হিন্দু ধর্মের মানুষদের উদ্দেশ্যে বিদ্রƒপ প্রকাশ পেয়েছে মধুসূদনের এ ই রচনায়। মধুসূদন দত্ত অন্য সব কবি সাহিত্যাকদের থেকে নিজেকে স্বতন্ত্র অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ঘুণে ধরা সমাজে বাস করা করা কপট মানুষদের প্রতি শ্রদ্ধা রাখতে পারেননি মধুসূদন। চারপাশের নানা অনিয়ম বৈষম্য ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তিনি ঘৃণা প্রকাশে সচেষ্ট থেকেছেন মাইকেল তার সাহিত্য রচনার মাধ্যমে। শর্মিষ্ঠ মধুসূদন দত্তের প্রথম সার্থক নাটক। এই নাটকটি ১৮৫৯ সালের জানুয়ারি মাসে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। শর্মিষ্ঠা একটি পৌরাণিক নাটক। নাটকটি ভীষণভাবে চমক সৃষ্টি করে। পাঠক দর্শকদের কাছে প্রিয়তা পায়। সে কারণে এই নাটকটি বারবার সফলভাবে মঞ্চায়িত হয়। শর্মিষ্ঠার আখ্যান মহাভারতের আদিপর্ব থেকে নেওয়া হলেও নাটকের প্রয়োজনে কাহিনীতে বহু পরিবর্তন ঘটিয়ে তিনি পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। ত্রিকোণ প্রেমের এই নাটকে দেবযানির সঙ্গে যযাতির প্রেম বিয়ে ও সংসার জীবনের কাহিনী অন্তরঙ্গময় ভঙ্গিতে উপস্থাপিত হয়েছে। শর্মিষ্ঠার নির্বাসন জীবনের যাতনা পরবর্তীতে যযাতির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়ানো এবং সন্তান জন্ম দেওয়ার ঘটনার বর্ণনা মধুসূদন অসাধারণ দক্ষতায় দিয়েছেন। শর্মিষ্ঠা উপন্যাসে। হিন্দুপুরাণের কাহানী ধারণ করে এই নাটকে অগ্রযাত্রা সে কারণে বলা যায় যযাতির জরাগ্রস্ততা ও জরামুক্তি প্রসঙ্গের মাধ্যমে পার্থিব চাওয়া পাওয়ার বিপরীতে বৈরাগ্য সাধনা দিক এই নাটকে উন্মোচিত হয়েছে। সমাজের অবক্ষয়, অসঙ্গতি মধুসূদন তুলে ধরেছেন। যা বাংলা সাহিত্যে সেসময়ে নতুন মাত্রা যোগ করে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রহসন রচনার মাধ্যমে কৌতুক ও হাসি ঠাট্টার মধ্য দিয়ে সমাজের অবক্ষয় ও নানা অসঙ্গতি তুলে ধরেন অসাধারণ দক্ষতায়। প্রহসনকে বলা হয় নাটকের উপশাখা মধুসূদন দত্ত প্রহসন রচনায় অদ্বিতীয় ও তুলনারহিত।আর কেউ তার মতো সার্থক প্রহসন রচনা করেছে এমন খবর পাওয়া যায় না। মাইকেল মথুসূদন দত্তকে আথুনিক বাংলা নাটকের জনক বলা যায় দ্বিধাহীনভাবে। মাইকেলের সাহিত্য পাঠকদের বিপুলভাবে আকৃষ্ট করে। মধুসূদন দত্তেন প্রহসন “একেই কি বলে সভ্যতা” হলো দুই অঙ্ক বিশিষ্ট প্রহসন। এই প্রহসনে রয়েছে প্রতি অঙ্কে দুটি করে গর্ভাঙ্ক বা দৃশ্য। এর পটভূমি আধুনিক কোলকাতা।নববাবুরা পাশ্চাত্য প্রভাবিত হয়ে যে সব অপকর্ম করে তা তুলে ধরার উদ্দেশ্য নিয়ে রচিত এই প্রহসন। ইয়ংবেঙ্গল বা নববাবুদের চরিত্রের ত্রুটি উঠে এসেছে এখানে। কেবল মাত্র আড্ডার উদ্দেশ্য থেকে নববাবু ও তার বন্ধুরা মিলে ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী সভা’ নামে একটি ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে। এ ক্লাবে চলতো অবাধে মদ্যপান। এবং বারবণিতাদের নিয়ে চলতো অতিশয় নগ্ন মত্ততা। নবকুমারের বাবা গোঁড়া হিন্দু বৈষ্ণব। তিনি সবসময় ছেলেকে চোখে চোখে রাখতে চান। কিন্তু তার বন্ধু কালীনাথ ভালোমানুষীর অভিনয় করে নববাবুর বাবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে ওকে ক্লাবে নিয়ে যায়। নবকুমারের বাবার সন্দেহ থেকেই যায়। নববাবুর বাবা ওদের ওপর পূর্ণ আস্থা রাখতে পারে না। তাই তিনি সত্যতা যাচাইয়ের জন্য বৈষ্ণব বাবাজীকে ক্লাবের উদ্দেশে পাঠান। প্রহসনটিতে ব্যঙ্গাত্মক বর্ণনার মাধ্যমে মাইকেল মধুসূদন পথভ্রষ্ট নষ্ট যুব সম্প্রদায়ের প্রতি ধিক্কার জানিয়েছেন। 
মদের নেশায় মাতাল অবস্থায় নববাবুকে নিয়ে বৈদ্যনাথ বাড়ি ফেরার পর বাবা, মা, স্ত্রীসহ বাড়ির সকলে ছুটে আসে। নববাবু তখন মদের নেশায় অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতে থাকে। এ সময় স্ত্রী হরকামিনী ধিক্কার দিয়ে বলেন : ‘এমন স্বামী থাকলেই বা কি আর না থাকলেই বা কি। ঠাকুর ঝি! তোকে বলতে কি ভাই, এইসব দেখেশুনে আমার ইচ্ছে করে যে গলায় দড়ি দে মরি। ছি, ছি, ছি ! বেহায়ারা আবার বলে কি, যে সাহেবদের মতন সভ্য হয়েছি, হা আমার পোড়া কপাল! মদ খেয়ে ঢলাঢলি কল্লেই কি সভ্য হয়? একেই কি বলে সভ্যতা?’ ‘একেই কি বলে সভ্যতা’। এই প্রহসনে
মধুসূদন দত্ত শহরের সমাজজীবনের অবক্ষয় চিত্ররূপ নিপুণ কুশলতায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন। মধুসূদন দত্তের দুই অঙ্ক বিশিষ্ট নাটিকা বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। সমাজের বিপরীতমুখী বাস্তব চরিত্রকে অবলম্বন করে তিনি এই সার্থক প্রহসন রচনা করেছেন। সমাজের বিত্তবান এক বৃদ্ধ ভক্তপ্রসাদকে কেন্দ্র করে এর কাহিনী এগিয়ে গেছে। বৃদ্ধ বয়সে কাম প্রবৃত্তিতে আসক্ত মানুষের স্বরূপ এ রচনায় উন্মোচিত হয়েছে। মধুসূদন দত্ত দক্ষতার সাথে, চরিত্র নির্মাণ ও বর্ণনা মাধুর্যে তার এই রচনা আকর্ষণীয় করে তুলেছে। এই রচনার চরিত্রগুলো হচ্ছে,মূল চরিত্র 
ভক্ত প্রসাদ তার অনুচর গদাধর, দরিদ্র ব্রাহ্মণ বাচস্পতি, রায়ত হানিফ গাজি, হানিফের সুন্দরী স্ত্রী ফাতেমা, খল স্ত্রীচরিত্র পুঁটি আরও আছে পঞ্চী ও পঞ্চীর মা ভগি। প্রচণ্ড খরার কারণে ধান ভালো না হওয়ায় হানিফ গাজি ভক্ত প্রসাদকে কীভাবে খাজনা দিবে এ নিয়ে ভাবনায় পড়ে যায়। খাজনা কিছুটা মওকুফের জন্য সে গদাধরকে কাছে ডায়। ভক্ত প্রসাদ এ কথা শুনে ভীষণ ক্ষেপে যায়। এক পর্যায়ে গদা তার মনিবকে হানিফের সুন্দরী স্ত্রী ফাতেমার কথা বললে ভক্ত প্রসাদের রাগ কমে। সে ফাতেমার সঙ্গে কীভাবে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করবে সেই ফন্দি করতে থাকে। শুধু ফাতেমা তা নয় অনেকের প্রতিই তার কাম বাসনা জাগে। যেমন গ্রামের যুবতী মেয়ে পঞ্চীর ওপর তার কুদৃষ্টি পড়ে। এখানে ভক্ত প্রসাদের লাম্পট্য বহুগামিতার প্রকাশ ঘটেছে। ভক্ত প্রসাদ জানতে পারে তার ছেলে কোলকাতায় থেকে নাকি মুসলমান বাবুর্চির রান্না খায়। এ কথা জেনে ভক্ত প্রসাদ ভীষণ রেগে যেয়ে বলে ‘থু! থু! ‘হিন্দু হয়ে নেড়ের ভাত খায়’। রাম!রাম! থু!থু!’ তখন গদাধর স্বগত উক্তিতে বলে- ‘নেড়েদের ভাত খেলে জাত যায় কিন্তু তাদের মেয়েদের নিলে কিছু হয় না। বাঃ!বাঃ!’ অবশেষে ভক্ত প্রসাদ ফাতেমাকে ভোগ করার তীব্র লিপ্সা নিয়ে শিবমন্দিরের ভিতরে ঢোকে। তার কাছে দেবালয় বা ধর্ম বড় ব্যাপার নয় ভোগটাই আসল। তবে ভক্ত প্রসাদ ব্যর্থ হয়। হানিফ গাজি ও বাচস্পতির বুদ্ধি ও কৌশলের কাছে সে হেরে যাই। ফাতেমাকে ভোগ করতে পারে না ভক্ত প্রসাদ। ফাতেমা রক্ষা পায় ভক্ত প্রসাদের লালসা থেকে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত সমাজের নানা চিত্র গভীর মনোযোগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করে তার নাট্যসাহিত্যে তুলে ধরেছেন। তিনি নাটক রচনায় বিষয়-বৈচিত্র্য, বর্ণনারীতি ও চরিত্র নির্মাণে আধুনিক রূপায়ণ ঘটিয়েছেন। নাট্যসাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্বতন্ত্র উজ্জ্বল কণ্ঠস্বর চিহ্নিত করা যায় খুব সহজেই। 

প্যানেল/মো.

×