ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৭ জুলাই ২০২৫, ২ শ্রাবণ ১৪৩২

একটি অমরফুলের গল্প

প্রদীপ আচার্য

প্রকাশিত: ১৮:২৮, ১৭ জুলাই ২০২৫

একটি অমরফুলের গল্প

এক তরুণের হৃদয়-জমিনে ঝড় তোলে কিছু ধ্বনি, কিছু শব্দ। ধ্বনি আর শব্দের যূথবদ্ধতায় তরুণের মস্তিষ্কে সহসা আগুন লাগে। বাইরে থেকে টের পাওয়া যায় না কিছু। তরুণের মনে হয়, ক্রমশ ধোঁয়ায় ছেয়ে যেতে থাকে চারপাশ। ধোঁয়ার কুণ্ডলী ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে শূন্যে। শেষে পড়ে থাকে একমুঠো ছাই। ধ্বংসস্তূপের মতো। তরুণ সেই ধ্বংসস্তূপের ভেতর কিছু একটা সন্ধানরত অস্পষ্ট আরেক তরুণের মুখ দেখতে পায়। কী খোঁজে সে? প্রশ্ন করলে উত্তর মেলে, জানি না কী খুঁজি...!
এতটুকুই স্বপ্নে দেখে শরীফ। অনেকদিন পর আজ স্বপ্নটা আবার হানা দেয় তার ঘুমে। চোখ মেলে সে তাকায় সিলিংয়ের দিকে। বাইরের মৃদু আলোতে শোঁ শোঁ শব্দে ঘুরতে থাকা সিলিং ফ্যান চোখে পড়ে। আজ আর ঘুম আসবে না তার। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে শরীফ, ওয়াশরুমে যায়। ফিরে এসে পশ্চিমের জানালা খুলে পর্দা সরিয়ে দিতেই ঠান্ডা হাওয়ার পরশ এসে শীতল করে দেয় শরীর। সে বাইরে তাকায়। দেশে থাকতে মধ্যবসন্তের রাতের শেষে এতটা কুয়াশা হতে সে কখনো দেখেনি আগে। সে দেশ ছেড়েছে চব্বিশ বছর হলো। কতকাল পরে বসন্তের রাত শেষের এমন এক সময়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল তার। ঘড়ি দেখে শরীফ। সাড়ে চারটা প্রায়। মেজভাই কিছুদিন হল ফয়েজলেক সংলগ্ন এ জায়গাটিতে চারতলা বাড়িটি বানিয়েছে। মেজভাই পরিবারসহ তিনতলায় থাকে। বাকিটা ভাড়া। বিল্ডিংয়ের পেছনে, পশ্চিম দিকে অনেকখানি খালি জায়গা, গাছগাছালিতে ভরা, একটি কলাগাছের বড়সড় ঝোঁপ। আরো পশ্চিমে, অদূরেই পাহাড়ে শিরিষ গাছের সারি। তার দক্ষিণ দিকে নাকি একটা ছাত্রী হোস্টেল। আর পূবের দিকে গড়ে উঠেছে হাউজিং সোসাইটি। বিল্ডিংয়ের উত্তর দিকের সীমানা ঘেঁষে আরেকটা পাহাড়ের কিয়দংশ চোখে পড়ে। পাহাড়খেকোদের অস্তিত্বের জানান দিতেই যেন দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের এই ভগ্নাংশ। চট্টগ্রামে আজ শরীফের শেষ দিন। বিকেলের ট্রেনে ঢাকায় ফিরবে সে। সেখানে একদিন থেকেই ফিরে যাব অস্ট্রেলিয়া।
ভোরের আযানের ধ্বনি কানে আসে। জানালায় দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগে তার। শীতের কুয়াশা এখনো আঁকড়ে আছে বসন্তের ভোর। শীতসন্ন্যাসী ভ্রমণ শেষে ফেরার পথে নির্ঘাত কিছু কুয়াশা লুকিয়ে রেখে গেছে পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে। এখন সুযোগ পেয়ে তারা জড়িয়ে ধরেছে বসন্ত-ভোর। এই সময়েও তারা কেমন অহংকারী। এখানে-ওখানে তাদের জটলা। দলছুট এই কুয়াশা-দঙ্গলের মৃত্যু ঘটবে আর কয়েকদিন পরেই গ্রীষ্মের তীব্র রোদের তাণ্ডবে। মনটা হঠাৎ কেমন করে ওঠে শরীফের।
উত্তরের পাহাড়ের একদম ঢালুতে চোখ আটকায় সহসা। এখনো অন্ধকার কাটেনি। ভালো করে খেয়াল করে শরীফ। একজন মানুষের ছায়া চোখে পড়ে। শরীফ অবাক হয়। এমন জঙলা জায়গায় এত ভোরে মানুষ কী করে! তার কৌতূহল বাড়ে; শানিত হয় দৃষ্টি। আবছা অবয়ব দেখে মনে হয় কোনো তরুণ-ই হবে। ঝোপঝাড়ের আড়ালে উন্মুক্ত এই জায়গাটিতে ঢোকার নিশ্চয়ই কোনো পথ আছে। তরুণের ঘন কালো শরীরের ছায়ায় অস্থিরতার ছাপ। শরীফ দেখতে পায়, সেই ছায়াশরীর পকেট থেকে মোবাইল বের করে কাউকে ফোন দেয়। তিনতলার জানালায় যেখানে শরীফ দাঁড়িয়ে সেখান থেকে তরুণের অবস্থান ৩০ গজের কম হবে না। তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজে মনে হয় ফোন কল সফল হয়নি। তরুণ সম্ভবত মোবাইলে মেসেজ টাইপ করতে থাকে। যে পথে সে এসেছে সে পথের দিকেই বার বার তাকায়। তাহলে কি কারো আসার অপেক্ষায় আছে সে! কোনো নাশকতার পরিকল্পনা নেই তো তার! শরীফ যখন মনে মনে ভাবে মেজভাইকে ঘুম থেকে ডেকে তুলবে, তখনই অন্য কাউকে একই পথ দিয়ে অতি সাবধানী পায়ে ঢুকতে দেখে তার দৃষ্টিসীমার ভেতর। তরুণ এবার আড়াল থেকে বেরিয়ে ওপথে যেতে থাকে; ওদিক থেকে আসা মানুষটিও তার দিকেই আসতে থাকে অতি সন্তর্পণে। আবছা অন্ধকারে এমন মুহূর্ত শরীফের মস্তিস্কের কোষে ঘা দেয় জোরে, ভাবনাগুলো জট পাকাতে চায়। কুয়াশাঢাকা ভোরের ঝাপসা আলোয় খুব কাছাকাছি, মুখোমুখি দুজন তরুণ-তরুণীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শরীফ। বিষয়টা এবার খানিকটা পরিষ্কার হয় তার কাছে। তার অবস্থান থেকে সে দুজনের একপাশটা দেখতে পায়। তরুণীর মুখ কাপড়ে ঢাকা। পিঠময় ছড়িয়ে আছে একরাশ চুল। পাহাড়ের গায়ে আলো ফুটতে শুরু করে ধীরে। সে আলোয় দুজনের মাথার ওপর ক্লান্ত এক নিমগাছকে ভোরের হাওয়ায় তার পাতাগুলোকে মৃদু দোলাতে দেখে শরীফ। কুয়াশা সারারাত তার দাপট চালিয়েছে নিমগাছের শাখা-প্রশাখায়। গাছের কাঁচা সবুজ রঙের পাতা আর সদ্য ফোটা নীলচে ফুলগুলো ভিজে একাকার। শরীফের মনে হয় আকাশ ক্রমশ নেমে আসে কাছে; আরো কাছে। যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে তাকে। দুজন পরস্পরকে ব্যক্ত করে তাদের একান্ত অভিলাষ। তরুণ তার হাতের মোবাইলটি দেখাতে থাকে তরুণীকে। শরীফ দূর থেকে তাদের শরীরী ভাষা বোঝার চেষ্টা করে। পশ্চিমের পাহাড় থেকে ভোরের কাকগুলো তাদের কর্কশ ধ্বনিব্যঞ্জনায় আর ডানার ঝাপটায় কুয়াশার চাদর চিরে নিজেদের উপস্থিতির জানান দেয়, রাতের আঁধার মুছে আবাহন করে সূর্যের। তরুণটি আঙুলে আঙুল জড়াতে চায়। তরুণীর আড়ষ্টতা তখনো কাটেনি। তার একটা হাত অদৃশ্য। কিছু কি আছে সেই হাতে? এটাই কি প্রথম প্রেমালাপন তাদের? আনমনে ভাবে শরীফ। মুহূর্তটা কেমন মায়ায় গেঁথে ফেলে পুরো পরিবেশটাকে। প্রভাতের নব আলো তাদের জানান দেয়, এখানে মিথ্যে সামাজিকতার ভড়ং নেই; ভয় নেই হারিয়ে যাবার; ভয় কেবল বিলীন হবার। দুজনের মধ্যে হঠাৎ নেমে আসে নীরবতা। এই নীরবতার শুরু বা শেষ বলে হয়তো কিছুই নেই।
ধবধবে সোনালি রঙের এক সকাল নামে। কুয়াশাদল মাত্র বিদায় নেয়। চোখের ক্লান্তি জুড়োতে কচি কলাপাতা ব্যস্ত হয়ে ছড়িয়ে দিতে থাকে সবুজ রঙ। কোথা থেকে এক দমকা হাওয়া এসে হঠাৎ মৌনতা ভেঙে দিলে তরুণীর মুখ থেকে খসে পড়ে শুভ্র আবরণ। তার অদেখা অর্ধেক মুখে এসে পড়ে আলো। শরীফের ভেতরটায় প্রচণ্ড ধাক্কা লাগে। এ কী দেখছে সে!। বহুকাল আগে দেখা একান্ত আপন এক মুখ আজ এতকাল পরে আবার দেখে সে! এ-ও কি সম্ভব! নিশ্চিত হতে রুমের দরজা খুলে দক্ষিণের বারান্দায় যায় শরীফ। বারান্দা থেকে তরুণীর মুখ ভালো করে দেখে সে। অবিকল একই মুখ! কে এই তরুণী? 
নিমফুলের পাপড়ি থেকে খসে পড়া শিশির তরুণীর মুখে পড়লে সে হাত দিয়ে মুখটা মোছে, আচমকা কী ভেবে ওপরের দিকে তাকায় আর তার দৃষ্টি গিয়ে পড়ে শরীফের চোখে। সহসা সে কি লজ্জা পায়, না কি ভয়! বোঝে না শরীফ। তখনই খসে পড়া নেকাবটি আবার সে মুখে জড়ায়, কিছু একটা বলে তরুণকে। তরুণও মুখ ঘুরিয়ে শরীফকে দেখে এবার। তরুণী হঠাৎ দ্রুত হাঁটতে থাকে যে পথে সে এসেছিল সেই পথের দিকে।
তরুণও তার পিছু নেয়। শরীফের ইচ্ছে করে সে চিৎকার করে ওদের বলে, তোমরা যেয়ো না! তোমাদের অভিবাদন জানাতে আবার নামবে ভোরের কুয়াশারাশি!। যেয়ো না। একবার বলে যাও তোমাদের পরিচয়! কিন্তু নিজেকে তার বোবা মনে হয়, তার কণ্ঠে কোনো স্বর বাজে না আর। সহসা সে শুনতে পায় ভোরের হাওয়ায় বাজতে থাকা হাহাকারধ্বনি।
শরীফ ঘোরগ্রস্তের মতো তিনতলা থেকে নিচে নেমে আসে। দারোয়ানকে ফজরের নামাজ শেষ করে মসজিদ থেকে ফিরতে দেখে। তাকে ওদিকে যাওয়ার রাস্তা জিজ্ঞেস করলে সে পথ দেখিয়ে দেয়। উ™£ান্তের মতো অনেকটা দৌড়ে সেখানে গিয়ে দাঁড়ায় শরীফ। হারিয়ে যাওয়া যুগলকে এদিক-ওদিক খোঁজে। কোথাও দেখা যায় না তাদের। এমন-কি তাদের কোনো চিহ্নও চোখে পড়ে না তার।
কলাগাছের ঝোপে, নিমগাছে, কাছে বা অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ে বাজতে থাকা ভোরের পাখির কলতান থেমে যায় হঠাৎ, মুহূর্তে সেখানে নেমে আসে মৌনতা। নিজেকেই সহসা অপরাধী ভাবতে থাকে শরীফ। ভাবে এটা তারই বোকামির ফল। ঘাসের বুক তখনো শিশিরভেজা। অগত্যা শরীফের দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে যায় ভোরের বাতাসে। ফিরে যেতে থাকে সে। আচমকা নিচে ঘাসের ওপর চোখ আটকে যায় তার। দেখে একটি ফুল। এই ফুলের সঙ্গে তার প্রণয় হয়েছিল আটাশ বছর আগে।
সেদিন গ্রামের মেঠোপথে বিকেলের সোনালি আলোয় দুজন তরুণ-তরুণী হাঁটছিল। তীর্থের কাকের মতো তরুণ অপেক্ষা করছিল তরুণীর কাছ থেকে আকাক্সিক্ষত প্রতিউত্তরের। অপেক্ষা মাস পেরিয়ে বছর গড়ায়। হয়তো বিধাতার করুণায়ই হঠাৎ তরুণের অপেক্ষার অবসান হয়। সেদিন গ্রামের সেই পড়ন্ত বিকেলে মেঠোপথের পাশে ফোটা অমর গাছ থেকে তরুণী যত্ন করে একটি ফুল ছিঁড়ে তরুণের হাতে দিয়ে ইঙ্গিতে জানায় তার উত্তর। সেদিনের সেই সুখটুকুই তরুণের জীবনে আসা প্রেমের প্রথম অনুভব। অতঃপর যুগলজীবনের শত প্রতিশ্রুতির পরও শেষপর্যন্ত বিচ্ছেদ ঘটে সেই অসামান্য প্রণয়ের।
এত বছর পর আজ আবার শরীফ দেখে ঘাসের ওপর পড়ে থাকা সেই অমর ফুল! কে এনেছিল? নিশ্চয়ই সেই তরুণী? এতসব ফুল থাকতে কেন তার হাতেও অমর ফুল! পোড়ো জমি থেকে বেরিয়ে চারপাশটা দেখতে থাকে শরীফ। না। আশপাশে কোথাও অমর গাছ চোখে পড়ে না তার। তাহলে কোথা থেকে এল এই ফুল! আবার সে ফিরে যায় আগের জায়গায়। এতক্ষণ যা কিছু দেখল সে তা কি সত্যি, না কি তার ভেতরে বাস করা কোনো অতীত সুযোগ পেয়ে হামাগুড়ি দেয় তার মনে! ভাবনাটা পেয়ে বসে তাকে। কিন্তু তার সামনে, ঘাসের ওপর তখনো দিব্যি ফুটে থাকে একটি অমর ফুল! এই অমর ফুল তো মিথ্যে নয়, ভাবে সে আবার। তবে কি প্রকৃতিতে সবকিছুই থেকে যায় ভিন্ন ভিন্ন চৈতন্যরূপে; এ চৈতন্যের নামই কি তবে প্রেম! অমরফুলটিকে ঘাস থেকে তুলে হাতের তালুতে নিতেই বাতাসে ভেসে আসে বহুকাল আগের এক কথোপকথন,
- উত্তর দিতে এতটা সময় নিলে?
- আজ সম্ভবত পূর্ণিমা!
- তাতে কী? 
- নতুন চাঁদকেও অপেক্ষা করতে হয় পূর্ণিমার জন্য।
অন্যজন মনে মনে বলে, -কৃষ্ণপক্ষও গিলে খায় পূর্ণিমার আলো।
- চুপ কেন, কী ভাবছ?
- ভাবছি, অমর ফুলটা কী এক আকর্ষণে জড়ালো আমাদের!
 
কথোপকথনে সহসা হানা দেয় অন্য একটি বেসুরো কণ্ঠস্বর।
ভাইজান, এইখানে কী করেন?
মুখ ঘুরিয়ে মেজভাইয়ের বাড়ির দারোয়ানকে আবিষ্কার করে শরীফ। তাকে খুঁজতে এসেছে
বেচারা। অমরফুলটি আড়াল করতে করতে শরীফ বলে, জানলা দিয়ে জায়গাটা দেখে ভালো লাগল। তাই ঘুরতে বেরিয়েছি।
বলতে বলতে ঘরে ফিরে আসে শরীফ। মুখে অনেকক্ষণ পানির ঝাপটা দেয়। আর নিজের মনেই বিড়বিড় করে নিজেকে শোনায়, যতটুকু দেখলাম তা কোনো এক উপ্যাখ্যানের অসামান্য অংশবিশেষ, তার অপ্রকাশিত বেদনাটুকু নিয়েই এবার ফিরতে হবে প্রবাসে, সাথে অমরফুলের রং।

প্যানেল/মো.

×