ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৭ জুলাই ২০২৫, ২ শ্রাবণ ১৪৩২

সজরায় মারিয়াম: সাহারার বুকে এক নিঃশব্দ প্রার্থনার ছায়া

জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান

প্রকাশিত: ০৮:৪৩, ১৭ জুলাই ২০২৫

সজরায় মারিয়াম: সাহারার বুকে এক নিঃশব্দ প্রার্থনার ছায়া

সময়ের ঘূর্ণিতে পৃথিবীর সবকিছু বদলায়—মানচিত্র, মুদ্রা, সভ্যতা, রাষ্ট্র। তবু কিছু জায়গা রয়ে যায় ঠিক তেমনি, এক নীরব আভায় জড়ানো। এমনই এক পবিত্র ছায়ার নাম সজরায় মারিয়াম—মিশরের কায়রোর মাতারিয়া অঞ্চলে দাঁড়িয়ে থাকা ইতিহাস, বিশ্বাস আর প্রার্থনার জীবন্ত প্রতীক।

এই গাছটি কেবল একটি বৃক্ষ নয়—এ এক সময়ের সাক্ষ্য, এক পলায়নের নীরব সহচর, এক মায়ের আশ্রয় ও এক নবজাতকের প্রাণরক্ষার আখ্যান।

দুই সহস্রাব্দ পূর্বের এক রাত্রি। ইহুদি রাজা হেরোদের আদেশে নবজাতকদের রক্তে ভেসে যাচ্ছে ভূমি।ভয়ংকর সেই সময়, যখন স্বপ্নের ভেতর দেবদূত জানিয়ে দিলেন, “পালাও। আশ্রয় খোঁজো।” যূসুফ (আঃ), মা মারিয়াম এবং শিশু ঈসা (আঃ) ছুটে এলেন মিশরের পথে। সাহারার শুষ্ক, রুক্ষ বাতাসের মধ্যে এক ক্লান্ত যাত্রার শেষে, তারা এসে দাঁড়ালেন এক বাগানে—সেখানে ছায়া দিচ্ছিল এক গাছ। সেদিনের সেই ছায়াই আজ ইতিহাসের বুক জুড়ে লিখে রেখেছে এক আশ্রয়-প্রার্থনার প্রতিচিত্র।

সেই গাছকেই আজ আমরা চিনি সজরায় মারিয়াম নামে—Virgin Mary’s Tree। প্রাচীন গাছটি বহু শতাব্দী আগে হারিয়ে গেছে, কিন্তু তার উত্তরসূরি আজও দাঁড়িয়ে, যেন দু’হাজার বছরের এক অতল কাহিনির ভার মাথায় তুলে রাখা এক নিঃশব্দ স্মারক।

গাছটির পাশে ছিল একটি ঝর্ণা। বিশ্বাস করা হয়, সেই ঝর্ণার জলে মা মারিয়াম ধুয়ে দিয়েছিলেন পথের ক্লান্তি, পান করিয়েছিলেন শিশুকে। সেই পানি আজো পূণ্য হিসেবে ধারণ করে স্থানীয়রা।

আজকের এই গাছ আধুনিক কায়রোর কোলাহলে এক টুকরো নীরবতা। প্রতিদিন সেখানে ভিড় করেন দর্শনার্থীরা—কেউ ধর্মীয় শ্রদ্ধায়, কেউ ঐতিহাসিক কৌতূহলে, কেউবা নিছক এক আধ্যাত্মিক প্রশান্তির আশায়। ছায়াটির নিচে দাঁড়িয়ে কারও মনে হয়, তিনি প্রার্থনার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন।
কারও চোখে ভেসে ওঠে ক্লান্ত এক মায়ের মুখ—শান্ত, অথচ দৃঢ়।

এই স্থান মিশরের 'Holy Family Trail'-এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। সরকারও পর্যটনের অংশ হিসেবে এটি সংরক্ষণ করছে, কিন্তু এই বৃক্ষের মানে সংখ্যায় নয়—তার গভীরতা লুকিয়ে মানুষের চেতনায়।

সজরায় মারিয়াম কোনো ধর্ম, গোষ্ঠী বা ভূখণ্ডের সম্পত্তি নয়। এটি একটি অনুভব— যেখানে ইতিহাসের সঙ্গে হৃদয়ের এক গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে।যেখানে নিঃশব্দ ছায়া হয়ে ওঠে ভাষাহীন আশ্রয়।
যেখানে সাহারার মাঝে জন্ম নেয় এক শীতলতা—শুধু একজন মা ও তাঁর সন্তানের ভালোবাসায়।


লেখক ও কলামিস্ট, শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়,কায়রো,মিশর
 

শেখ ফরিদ 

×