কবি জীবনানন্দ দাশের মতে, কবির মধ্যে বিরাজ করে কল্পনাপ্রতিভা। এই কল্পনাপ্রতিভার গুণেই কবির মধ্যে চিত্রকল্প বাসা বাঁধে। টুকরো টুকরো ছবি কবির কল্পনার রং-রেখায় একটা অর্থ দাঁড় করায়। মানে কবিতা হয়ে ওঠে চিত্রকল্পময় ও অর্থময়। এখানেই কবিতা কথা কয়। বাক্সময় হয়ে ওঠে।
কবি হাসান হাফিজ এই বাংলাদেশের মেঘনাপাড়ের কবি এবং চিত্রকল্পের কবি। কবি জীবনকে উপলব্ধি করেন, বুঝতে চান, ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে চান, স্পন্দনে অনুভব করেন, কারুময় করে তোলেন এই চিত্রকল্পের মারফতে। এদিক থেকে কবি শিল্পীর ভূমিকায় স্বচ্ছন্দ। শিল্পীর মতো অক্ষরের রং-রেখায় নিমগ্ন। বিশাল সংগ্রহের চিত্রকল্পের উপাদান কবি খুঁজে পেয়েছেন বাঙলার প্রকৃতি, সমাজ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য থেকে। কবি নগরে বসবাস করেন, নগরযন্ত্রণায় ছটফট করেন, নাগরিক ক্লেদের আঁধারে ডুবে ডুবে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন; কিন্তু চিত্রকল্প তুলে আনেন গ্রামবাংলার বিশাল উঠোন থেকে; আবাদ-বিবাদ থেকে, মেঠোপথ থেকে, ডোবানালা-নদনদী-বিলঝিল থেকে। কবির মৌলচেতনার মাঝে যেন গ্রামবাংলার শেকড় ও আবহ বিরাজমান।
প্রেম-কাম, প্রতিবাদ-দ্রোহ, স্মৃতি-নস্টালজিয়া, অবক্ষয়-ক্ষরণ, প্রকৃতি-নন্দন, আনন্দ-ব্যথা, নাগরিক সঙ্গ-নিঃসঙ্গতা, আত্মদ্বন্দ্ব, যন্ত্রণা-ক্লেদের বিষ পান করে কবি নীলকণ্ঠ হয়ে গেছেন। কখনো সুন্দরের ঘুড়ি ধরার জন্য কৈশোরের চাঞ্চল্য নিয়ে দিয়েছেন ছুট, কখনো মঙ্গলবোধে উজ্জীবিত হয়ে অসুন্দর-অকল্যাণের উচ্ছেদ চেয়েছেন। তবে কবি প্রধানত নারী ও প্রকৃতিপ্রেম, সমাজ ও স্বদেশবোধ, মানবিকতা ও নির্মমতাকে চিত্রকল্প-উপমা-উৎপ্রেক্ষা-প্রতীক-রূপকে ধারণ করেছেন।
কবি হাসান হাফিজ সত্তর দশকের কবি। সময়টা ক্রান্তিকালীন। জীবন ও সমাজ অসুস্থতায় ক্লান্ত-বিষাদগ্রস্ত-টালমাটাল। কবির প্রধান অবলম্বন চিত্রকল্প, সত্তরের জায়মান অন্ধকার ও সমূহ মানববিরোধী তৎপরতাকে কবি চিত্রকল্পে জীবন্ত রূপ দিয়েছেন। বিপুল প্রত্যাশা ও প্রায় শূন্য প্রাপ্তির হতাশায় কবির মন বিদ্রƒপে ভরে ওঠে:
তোমার টাঙ্গাইল শাড়ির পাড়ে
ফুলের মতো ফুটে আছে না পাওয়ারা
এবড়ো খেবড়ো কঙ্কালসার পদ্মার অহং
মিছিলের ক্রুদ্ধ ধ্বনিমালা
সবকিছু কেমন জ্বলছে
সবকিছু কেমন টলছে
সবকিছুই কী যেন বলতে চাইছে। [টালমাটাল মানচিত্র/ এখন যৌবন যার]
‘ঘুণ’, ‘মৃত্যু, নীলটিপ এবং কোকিল’, ‘২৪ ঘণ্টার বিরহ’, ‘জীবনে জীবনে’, ‘বিপক্ষে’, ‘যেয়ো না সুন্দর’ ইত্যাদি কবিতায় কবি আসলে একই সময়ের চালচিত্র ও মনের অসন্তোষ জানিয়েছেন বিচিত্র চিত্রকল্পে। জানিয়ে ক্ষান্ত বা নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকেননি। ব্যঙ্গ ও বিদ্রƒপ করেছেন, কখনো দ্রোহও করেছেন। এই তামসিক সময়ে কবি আশ্রয় খুঁজেছেন প্রিয়তমা নারীর আঁচলে। নারীকে পেতে চেয়েছেন যে কোনো মূল্যে। বিরাজমান হতাশায় হদিস করেছেন নারীতে মুক্তি ও শুশ্রƒষা। সত্তর দশকের কবিতার সাধারণ বৈশিষ্ট্য এরকমÑ যার চিত্রকল্প অমসৃণ, কর্কশ ও দহনস্পর্শী।
আমি বারবার এরকমই
ফিরে আসছি, মরছি, জš§াচ্ছি ফের
তোমার আয়ত চোখ থেকে
ফেরাব না চোখ, যতো প্টতি হোক। [রাখী তোমার মুখোমুখি/ এখন যৌবন যার]
কবি বৈরী আবহাওয়ায় নারীপ্রেমে প্রেমে ডুবতে ডুবতে এক সময় ডুবসাঁতার দিতে শুরু করেন। ভালোবাসার গভীরতা ও ব্যাপ্তি আরও বাড়তে থাকে ক্রমাগত। ফলে ‘এখন যৌবন যার’ থেকে কবি প্রস্থান করেন ‘ভালোবাসা, তার ভাষা’ গ্রন্থে। সেজন্য অনেকটা উš§াতাল ও উš§ত্ত আবেগের দিগন্তে অনুরাগের আবীর ছড়িয়েছেন শিল্পীর চড়া রঙে। তবে নারীর ভালোবাসার অমৃত শুধু পেয়েছেন তা নয়, সঙ্গে সঙ্গে কষ্টের বিষও পান করেছেন। এই অনুভবের নির্যাস ধরতে কবিকে মর্মস্পর্শী কিছু চিত্রকল্প আঁকতে হয়েছে।
ভালোবাসা অন্ধ এবং বধির বোবা
পদবিক্ষেপ টলোমলো শুধুই আঁধার
ছিন্ন রুমাল একলা চিঠি অনিদ্র রাত
ভালোবাসা তোমার তূণে বিদ্ধ হতেই
আমার জš§, টুকরো-টাকরা জীবনযাপন। [ভালোবাসা, তার ভাষা/ ভালোবাসা, তার ভাষা]
‘ভালোবাসা, তার ভাষা’ হাসান হাফিজের শ্রেষ্ঠ প্রেমের সংকলন। সম্ভবত সমগ্র কাব্যের মধ্যেও সেরা বই। এই বইয়েই কবির মৌলিক কণ্ঠস্বর ও কাব্যভাষার একটা আদল গড়ে ওঠে। কবিতার গড়নে ও স্পন্দনে আপন চিত্রকল্পের মেজাজ, সুর ও রূপে কবির কবিত্ব প্রকাশ পায়। কবিত্বের প্রশ্নে হাসান হাফিজ প্রথম কাব্যেই স্বীকৃতি পেয়েছেন। তবে কবির বিকাশের পথ ও পাথেয় বৈচিত্র্যে ভরপুর। কোনো এক রাস্তায় ও নদীতে কবি বেশি দিন হাঁটেননি ও সাঁতার কাটেননি। জীবনকে কবি বড় ক্যানভাসে ধরেছেন, কোনো একটি নির্দিষ্ট রঙে-রূপে বা রেখায় তাকে বিচার করা যায় না। কারণ কবি একই সঙ্গে জীবনের অমিয়-গরল পান করতে অভ্যস্ত।
ভালোবাসা, এবার তোমার সঙ্গে বোঝাপড়া
অবসান থরোথরো দুঃখ যন্ত্রণার
ভালোবাসা, এবার তোমার সঙ্গে অভিমান
পুরুষ্টু ধানের শীষে বৃষ্টির বিরহ
... ভালোবাসা, এবার তোমার সঙ্গে লেনদেন
চেখে দেখা জীবনের রক্তমাংস, অমিয়-গরল। [জীবনের অমিয়-গরল/ ভালোবাসা, তার ভাষা]
‘অমিয়-গরল’ ভরা বাস্তবের একটা বড় জায়গা তাঁর কবিতা জুড়ে আছে। কবি নানা পথে যেমন হেঁটেছেন, তেমনি নানা সুর ও জগতের চিত্রকল্প এঁকেছেন অক্ষরের বিচিত্র রঙে। সমাজ-রাজনীতির ভাঙচুর, পালাবদল, বিবর্তন ও রূপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে চলেছে তাঁর কবিতার রূপান্তর। এক্ষেত্রে কবি মানবিকতার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, বিপ্লবের ব্যর্থতা ও দীর্ঘশ্বাস ঝেড়ে ফেলে নতুন নির্মাণের পক্ষে সোচ্চার হয়েছেন। ‘অবাধ্য অর্জুন’ কাব্যগ্রন্থটি এদিক থেকে তাঁর সমাজ-রাজনীতির বোধ ও চেতনাকে স্পষ্ট করে।