ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

সাহিত্য

সাহিত্য বিভাগের সব খবর

নিজেকে জানো

নিজেকে জানো

নিজেকে জানা মানে নিজের অস্তিত্বের গভীরে প্রবেশ করে নিজের সত্তাকে উপলব্ধি করা। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তেই আমরা নানা পরিস্থিতির মধ্যে পড়ি, যেখানে নিজেদের পরিচয়, চাওয়া এবং বিশ্বাসগুলোকে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়। এমন সময়ই আমাদের ভেতরের মানুষটিকে জানা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এটা আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং জীবনের পথে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। নিজেকে জানার প্রথম ধাপ হলো নিজের ভেতরের প্রশ্নগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া। আমরা কী চাই, কীভাবে আমাদের ভালো লাগে এবং কোনো কাজ আমাদের সুখ এনে দেয়Ñ এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শিখতে হবে। অধিকাংশ সময় আমরা জীবনের চাহিদা মেটাতে এতটাই ব্যস্ত থাকি যে নিজেদের প্রকৃত ইচ্ছাগুলো চাপা পড়ে যায়। কিন্তু সময় নিয়ে নিজের সঙ্গে কথোপকথন চালিয়ে যাওয়া, নিজের চিন্তা ও অনুভূতিকে বোঝার চেষ্টা করাই প্রকৃত জ্ঞানের পথ। মানুষের মন নানা জটিলতায় ভরা। আমাদের চিন্তা এবং আবেগগুলো কখনোই একমুখী নয়। আনন্দ, দুঃখ, রাগ, হতাশাÑ এসব অনুভূতি আমাদের প্রতিদিনের সঙ্গী। কিন্তু এই আবেগগুলো কোথা থেকে আসছে এবং কেন আসছে, তা বোঝার চেষ্টা করতে হবে। আবেগের ওপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করলে আমরা জীবনের বড় সমস্যাগুলোকেও ঠান্ডা মাথায় সমাধান করতে পারি। নিজেকে জানার আরেকটি দিক হলো নিজের সীমাবদ্ধতা এবং সক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন হওয়া। আমরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো ক্ষেত্রে দুর্বল। এই দুর্বলতাগুলোকে অস্বীকার করার বদলে সেগুলোকে মেনে নেওয়া এবং উন্নতির জন্য কাজ করা গুরুত্বপূর্ণ। একইভাবে নিজের শক্তি ও প্রতিভাকে কাজে লাগানোও গুরুত্বপূর্ণ। যখন আমরা আমাদের ক্ষমতা সম্পর্কে নিশ্চিত হই, তখন আমাদের আত্মবিশ্বাস অনেকখানি বেড়ে যায়। নিজেকে জানার আরেকটি উপায় হলো অন্যদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কগুলোর বিশ্লেষণ করা। আমরা কীভাবে কথা বলি, অন্যের সঙ্গে আমাদের আচরণ কেমন, এবং তাদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিÑ এসব বিষয় আমাদের ব্যক্তিত্বের অনেক দিক প্রকাশ করে। নিজের সম্পর্কগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করলে আমরা বুঝতে পারি, কোন জায়গায় আমাদের পরিবর্তন প্রয়োজন এবং কোন জায়গায় আমরা ইতিবাচক। মানুষের জীবনে মূল্যবোধ এবং বিশ্বাস বড় ভূমিকা পালন করে। এগুলো আমাদের জীবনের দিকনির্দেশনা দেয়। কিন্তু কখনো কখনো আমরা এমন কিছু করি যা আমাদের বিশ্বাসের সঙ্গে মেলে না। এর ফলে মানসিক অশান্তি তৈরি হয়। তাই নিজেদের মূল্যবোধগুলোকে পুনরায় যাচাই করা জরুরি। এগুলো আমাদের জীবনকে আরও সহজ এবং সুন্দর করে তুলতে সাহায্য করে। নিজেকে জানার জন্য আমাদের প্রয়োজন নীরবতা এবং ধ্যান। দিনের শেষে নিজেকে কিছুটা সময় দেওয়া এবং নিজের ভেতরের মানুষটির সঙ্গে কথা বলাÑ এই অভ্যাস জীবনে অনেক পরিবর্তন আনতে পারে। নিজের চিন্তাগুলোকে গুছিয়ে নেওয়া, সেগুলো বিশ্লেষণ করা এবং অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে পারলেই আমরা জীবনে এগিয়ে যেতে পারি। জীবনের প্রতিটি চ্যালেঞ্জ আমাদের ভেতরের মানুষটিকে আরও ভালোভাবে চেনার সুযোগ দেয়। কখনো কখনো আমরা ব্যর্থ হই, কখনো আবার সাফল্য পাই। এই মুহূর্তগুলোই আমাদের শক্তি এবং দুর্বলতাগুলোকে আরও পরিষ্কারভাবে দেখায়। ব্যর্থতার মাধ্যমে আমরা নিজেদের নতুন করে চিনি এবং সাফল্যের পথে এগিয়ে যাওয়ার দিকনির্দেশনা পাই। নিজেকে জানার সবচেয়ে বড় উপকার হলো, এতে আমরা জীবনের উদ্দেশ্য এবং মানে খুঁজে পাই। জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্তের পেছনে আমরা যে কারণগুলো খুঁজে পাই, সেগুলো আমাদের আরও সুসংগঠিত করে তোলে। আমরা অন্যের স্বীকৃতির ওপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজের ওপর নির্ভরশীল হতে শিখি। এই আত্মবিশ্বাস এবং স্বনির্ভরতা আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। নিজেকে জানা মানে শুধু নিজের ভালো দিকগুলো দেখা নয়, নিজের ভুলগুলোও মেনে নেওয়া। আমাদের মধ্যে যে অপরিপূর্ণতা রয়েছে, সেটি গ্রহণ করাই হলো প্রকৃত আত্মজ্ঞান। এই গ্রহণযোগ্যতার মাধ্যমেই আমরা আরও বিনয়ী এবং সহনশীল হতে পারি। জীবনের এই যাত্রায় নিজেকে জানা একটি চলমান প্রক্রিয়া। এটি কোনো এক দিনের কাজ নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এবং নিজের প্রতি ধৈর্য রেখে আমরা নিজেদের আরও গভীরভাবে জানতে পারি। নিজেকে জানার এই চর্চা আমাদের জীবনকে আরও অর্থবহ করে তোলে। তাই, প্রতিদিন একটু সময় নিজের জন্য বরাদ্দ রাখুন এবং নিজের ভেতরের মানুষটিকে জানার চেষ্টা করুন। এতে শুধু আপনার জীবনই নয়, আপনার চারপাশের মানুষগুলোর জীবনও সমৃদ্ধ হবে।

কেঁদেও পাবে না তাকে

কেঁদেও পাবে না তাকে

‘ফালগুন বিকেলে বৃষ্টি নামে। শহরের পথে দ্রুত অন্ধকার। লুটোয় পাথরে জল, হাওয়া তমস্বিনী; আকাশে বিদ্যুতজ্বলা বর্শা হানে ইন্দ্রমেঘ;/ কালো দিন গলির রাস্তায়। কেঁদেও পাবে না তাকে অজস্র বর্ষার জলাধারে...’ [বৃষ্টি] বাংলা কবিতাসাহিত্যে পঞ্চপাণ্ডব ও তিরিশের কবিদের ভূমিকা অনুস্বীকার্য। বিশেষ করে, আধুনিক কবিতায় নতুনত্ব আনার ক্ষেত্রে পঞ্চপাণ্ডবের অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। রবীন্দ্রবলয় থেকে বেরিয়ে এসে কবিতায় নতুন স্বর সৃষ্টি করেছেন তাঁরা। এ সময়ের অনেক কবিরই ইংরেজি সাহিত্য স¤পর্কে ধারণা ভালো ছিল; চর্চাও করতেন। ফলে, বিদেশীসাহিত্যের প্রভাব রয়েছে তিরিশের কবিদের, পঞ্চপাণ্ডবের। পঞ্চপাণ্ডবের একজন হচ্ছেন কবি অমিয় চক্রবর্তী। আজকের আলোচনা তাকে নিয়েই। ফলে, তাঁর জনপ্রিয় ও বহুল পঠিত একটি কবিতাংশ দিয়েই শুরু করেছি। অমিয় চক্রবর্তী (জন্ম: ১০ এপ্রিল, ১৯০১ - মৃত্যু : ১২ জুন, ১৯৮৬) বাংলা সাহিত্যের শীর্ষস্থানীয় আধুনিক কবি। তিরিশের দশক এবং বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ,  সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও বিষ্ণু দের সঙ্গে কবি অমিয় চক্রবর্তীর নামও আবশ্যিকভাবে চলে আসবে। অমিয় চক্রবর্তীর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ১৫টি। তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই ‘কবিতাবলী’(১৯২৪)। অন্যান্য গ্রন্থ : উপহার (১৯২৭), খসড়া (১৯৩৮), এক মুঠো (১৯৩৯), মাটির দেয়াল (১৯৪২), অভিজ্ঞান বসন্ত (১৯৪৩), পারাপার (১৯৫৩), পালাবদল (১৯৫৫), ঘরে ফেরার দিন (১৯৬১), হারানো অর্কিড (১৯৬৬), পু®িপত ইমেজ (১৯৬৭), অমরাবতী (১৯৭২), অনিঃশেষ (১৯৭৬), চলো যাই (১৯৬২), সাম্প্রতিক (১৯৬৩) উল্লেখযোগ্য। গদ্যগ্রন্থ : চলো যাই  ১৯৬২ এবং সাম্প্রতিক  ১৯৬৩। ইংরেজি ভাষায় রচিত ৯টি গ্রন্থ রয়েছে : ঞযব উুহধংঃং ধহফ ঃযব চড়ংঃ-ডধৎ অমব রহ চড়বঃৎু (অক্সফোর্ড ১৯৩৮); গড়ফবৎহ ঞবহফবহপরবং রহ ঊহমষরংয খরঃবৎধঃঁৎব (কলকাতা ১৯৪২); অসরুধ ঈযধশৎধনধৎঃু রহ ঊহমযষরংয ঞৎধহংষধঃরড়হ (ঝধহঃরহরশবঃধহ ১৯৯০) উল্লেখযোগ্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অমিয় চক্রবর্তীর কবিতার মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছিলেন ‘অনুভূতির বিচিত্র সূক্ষ্ম রহস্য’, বিশ্বসাহিত্যের ¯পর্শ। তাঁর কবিতায় আবেগের সঙ্গে মিশে গেছে মননশীলতা। অমিয় চক্রবর্তী অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে ডি.ফিল. ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত হাওয়ার্ড, বস্টন প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক প্রাচ্য ধর্ম ও সাহিত্য বিষয়ে অধ্যাপনা করেন। বিশ্বের নানান দেশে নানাবিধ তিনি ভ্রমণ করেন। ফলে, এ কারণে কবি ইয়েটস, জর্জ বার্নাড’শ, আলবার্ট আইনস্টাইন, রবার্ট ফ্রস্ট, আলবার্ট সোয়ইটজর, বোরিস পান্তেরনাক, পাবলো কাসালস প্রমুখ বিশ্ববরেণ্য লেখকদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে এবং মধুর স¤পর্ক গড়ে ওঠে। শিক্ষকতা ও কর্মসূত্রে বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন কবি অমিয় চক্রবর্তী।  এর প্রভাব তাঁর অনেক কবিতায় দেখা যায়। পর্যটনস্থানকেন্দ্রিক অনেক কবিতা রয়েছে। তাঁর কবিতায় আন্তর্জাতিক বিশ্বপরিবেশের অনেক ভৌগোলিক স্থানের নাম, বর্ণনা ও চিত্র লক্ষ্য করার মতো। এই কারণে কবির ভ্রামণিক কবিতার বেশিরভাগই অনন্য হয়েছে। এমন একটি কবিতাংশ তুলে ধরার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। তাঁঁর ‘ওক্লাহোমা’ কবিতা থেকে- ‘সাক্ষাত সন্ধান পেয়েছ কি ৩-টে ২৫শে? বিকেলের উইলো বনে রেড এরো ট্রেনের হুইসিল শব্দ শেষ ছুঁয়ে গাঁথে দূর শূন্যে দ্রুত ধোঁয়া নীল; মার্কিন ডাঙার বুকে ঝোড়ো অবসান গেলো মিশে।। অবসান গেল মিশে।। মাথা নাড়ে ‘জানি’ ‘জানি’ ক্যাথলিক গির্জাচূড়া স্থির, পুরোনো রোদ্দুরে ওড়া কাকের কাকলি পাখা ভিড়; অন্যমনস্ক মস্ত শহরে হঠাৎ কুয়াশায় ই¯পাতি রেলের ধারে হুহু শীত-হাওয়া ট’লে যায়...’

বন্ধু

বন্ধু

ভোরবেলা। সূর্য্য সবে উঠি উঠি করছে। লন্ডনে ভোর হয় কিছুটা দেরিতে। মানুষ, বিশেষত বাঙালিরা বিছানা ছেড়ে ওঠে আরো দেরিতে। এ দেশবাসী যখন ওঠার প্রয়োজন হয়, তখনি ওঠে। হাড় কাঁপানো শীতেও তাদের ভোরে উঠবার অভ্যেস আছে। তাদের জন্মই তো শীতের দেশে। তারা ভোরে উঠে নিজেদের কার নিয়ে অফিসে চলে যায়। তাদের কাছে শীত-গ্রীষ্ম দুটোই সমান। বাঙালিদের কাছে লন্ডনে যখন তুষার পড়ে তখন মনে হয় শুধুই বিছানা। বিছানা ছাড়া সুখের স্থান আর কিছুই যেন নয়। গভীর রাত পর্যন্ত রেস্তরাঁয় কাজ করে গভীর  রাতে বাসায় ফিরে কোনোরকমে কাপড় বদলিয়ে বিছানায় গেলেই পরম প্রশান্তি। বেশিরভাগ ডিনার রেস্তরাঁয়ই সেরে আসে। একইভাবে বাঙালি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আর রেস্তরাঁগুলো একটু দেরিতে খোলে। যারা বিলেতি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে বা ভোরে উঠে বিশ^বিদ্যালয়ে যায় তারা ব্রিটিশ রেস্টুরেন্টেই হয়ত একটি স্যান্ডউইচ গলধঃধারণ করে এক কাপ কফি খেয়েই ক্লাসে ঢুকে পড়ে। পরে হয়ত এগারোটায় একটি ফুল লাঞ্চ করে। এখানে এগারোটাতেই বাঙালিদের লাঞ্চের পর্ব শুরু হয়। ইংরেজরা একটা বা দেড়টাতে লাঞ্চ করে তা সে শীতেই হোক বা বসন্তে। আজ সে একটু সকাল সকাল ঘুম ছেড়ে বিছানা থেকে উঠেছে। কিচেনে এসে খাঁটি ব্রাজেলিয়ান কফিপট থেকে দুই চামচ কফি নিয়ে কুকারের গরম পানিতে ছেড়ে দিল। তারপর তিন মিনিট পর নামালো। ফ্রিজ থেকে কিছুটা লিকুইড দুধ নিয়ে কাপে ছেড়ে দিয়ে দেড় চামচ চিনি নিয়ে চামুচ দিয়ে চিনিটা নাড়তে নাড়তে সোফায় এসে বসল। তার বিছানায় সাব্রিনা ঘুমুচ্ছে। দু’জনেই গতরাতে এক বিছানায় ঘুমিয়ে ছিল। বাসায় একটি শোবার ঘর ছাড়া কিচেন আর এই বসবার ঘর। শোবার ঘরে এ্যটাচ্ড বাথরুম রয়েছে। এছাড়া আলাদা আর কোনো ঘর নেই। সদ্য বিয়েওয়ালা এক ব্রিটিশ কর্মজীবী পরিবারের একটি সেমি-ডুপ্লেক্সের দোতলায় সে এই বাসাটি ভাড়া নিয়েছে। পড়াশুনার পাট চুকিয়ে সে এখন একটি ব্রিটিশ মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছে। বেতন মোটামুটি ভালো। ইচ্ছে করেই এখনো বড় বাড়ি নেয়নি। আগের বাসাতেই থেকে গেছে। সাব্রিনাকে সে প্রথম দেখে বাংলা থিয়েটারে। সেদিন বিকেল চারটায় বাংলা থিয়েটার মঞ্চে কাজী নজরুলের নারী কবিতাটি আবৃত্তি করছিল সাব্রিনা। খুবই সুন্দর আবৃত্তির কণ্ঠ। আবৃত্তিও করছিল খুবই সুন্দর। মুখস্থ ছিল। আবৃত্তি যখন করছিল, তখন দুই হাত, শরীরও আবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলিত হচ্ছিল। আর মঞ্চের গ্যালারি থেকে বিভিন্ন রঙের আলো প্রক্ষেপ হচ্ছিল। সে কাজী নজরুলের ওপর লিখে নিয়ে যাওয়া একটি প্রবন্ধ পাঠ করেছিল। সেদিনই তার সঙ্গে চোখাচোখি হয়। সামান্য হাই, হ্যালো হয়। এরও প্রায় সাত দিন পর লন্ডনের বাংলা মার্কেটের চিংড়ি দোপেঁয়াজা হোটেলে আলাপটা যেন একটু জমে। সে রাত দশটার দিকে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া চিংড়িতে বেশ মজা করে ভাত খাচ্ছিল। এমন সময় হাই শুনে মাথা তুলে তাকাতেই দেখল সেদিনের তরুণী। হাই! আমি সাব্রিনা! মনে আছে সেদিনের বাংলা থিয়েটারে? সে বলে ওঠে, ইয়েস ইয়েস মিস . . . সাব্রিনা! -এন্ড আই অ্যাম জুয়েল। জুয়েল আহমেদ। -থ্যাংক ইউ মিস্টার জুয়েল আহমেদ। ক্যান আই সিট হিয়ার অন দিস এম্পটি চেয়ার? -ইয়েস। সিয়োর। প্লিজ। -আমি রাতের ডিনার করব। আজ কেন যেন রাঁধতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আমি হ্যাম্পশায়ার ইউনিভার্সিটিতে থার্ডইয়ার অনার্সে কম্প্যারেটিভ লিটারেচার পড়ছি। বলেই সে দুই চেয়ারের বাঙালি রেস্টুরেন্টটির ছোট টেবিলটায় জুয়েলের সম্মুখে বসল। -বান্ধবীরা মিলে এসেছিলাম এদিকটায়। ওরা বন্ধুদের নিয়ে পাশের ইংরেজি রেস্টুরেন্টে চলে গেল। আমার ইংরেজি খাবার এখনো অভ্যেস হয়নি। সামনে চিংড়ি দোপেঁয়াজা হোটেল নাম পড়েই ঝটপট ঢুকে পড়লাম। ‘ও মাগো! কী শীত!’ বলে সাব্রিনা দুই হাতে তালু ঘষা শুরু করল। এমন সময় অর্ডার নিতে আসা মেয়েটিকে সে বলল, সেম লাইক দিস। চিংড়ি কারি এন্ড রাইস। বেয়ারার চলে যেতেই সাব্রিনা বলল, ইদানীং লন্ডনে শীতে আর্লী ইভিনিংয়েই তুষার পড়া শুরু হয় দেখছি। আগে তো মিডনাইট বা লেটনাইটে তুষার পড়ত।    তারা দু’জনেই খাবার শেষ করে ধুমায়িত কফি নিয়ে বসল। সাব্রিনা বলল, বাইরে তো এই সাত সন্ধ্যায় রীতিমতো তুষার পড়ছে। বাসায় যেতে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড পর্যন্ত যেতে আমাকে রীতিমতো হাঁপিয়ে যেতে হবে এই তুষারের ভেতর। ঠিক আছে, অসুবিধে নেই, আমি আপনাকে আমার গাড়িতে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড বা বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে দেব, ডোন্ট ওরি। -গ্রান্ড থ্যাংকস। সে রাতে এর পরে আর খুব বেশি কথা হয়নি। কিন্তু গত সন্ধ্যেয় আবার যখন সাব্রিনার সঙ্গে ট্রাফালগার স্কয়ারে দেখা হয় দুজনের সেদিন যেন অন্যরকম লাগছিল তাকে। জিনসের লং প্যান্ট, সোয়েটার, সোয়েটারের ওপর লম্বা একটি ওভারকোর্ট। পায়ে জুতো। বলতে গেলে ঠান্ডাকে বাধা দেওয়ার কোনো কার্পণ্যই রাখেনি সাব্রিনা। কপালে ছোট্ট একটি সবুজ টিপ মনে হচ্ছিল সারা রেস্টুরেন্টতে একটি বিশাল বাংলাদেশের পতাকা টাঙিয়ে রেখেছে। তবু সে মাঝে-মধ্যেই দুই হাতের তালু ঘষছিল। জুয়েল ভাবল, আশপাশে মার্কেট থেকে উলেন এক জোড়া হ্যান্ড গ্লাভস্ কিনে এনে তাকে দেবে কী না। কিন্তু তার আগেই সাব্রিনা বলে ওঠে, বসতে পারি এই খালি চেয়ারটায়? কোন বন্ধু আসবে বুঝি? আপাতত আমার কোন বন্ধু হয়নি। তুমি আমার বন্ধু হবে? এক নিশ^াসে সাব্রিনা বলে ফেলে। -বন্ধু? হ্যাঁ বন্ধু। কেন, ছেলেবেলায় স্কুলে তোমার কোনো বন্ধু ছিল না? -ছিল। তবে এই প্রবাসে ... জুয়েল সাব্রিনার এতোগুলো কথায় হকচকিয়ে যায়।   -এই প্রবাসে আমিই না হয় তোমার বন্ধু হলাম, তুমি আমার বন্ধু হবে। খুবই স্বাভাবিকভাবে বলে সাব্রিনা। এতো শান্ত, নির্বিগ্ন-চিত্তে সাব্রিনা কথা বলতে থাকে যে জুয়েলও কোনো কিছুতে না বলতে পারে না, হ্যাঁ-ও বলতে পারে না।    -এই তিন বছরে লন্ডনে বন্ধু পাতাবার একজনকেও বুঝি খুঁজে পাওনি? -বছর তিনেক পড়াশুনা, লাইব্রেরি আর এক্সাম নিয়ে খুবই ব্যস্ত ছিলাম। ওদিকে তাকাবার কোনো সময়ই পাইনি। তাছাড়া এসব দেশে বন্ধু করা মানেই রিস্ক। -কেন, কিসের রিস্ক? -পুরুষদের রিস্ক না থাকলেও মেয়েদের পুরুষবন্ধু বানানো আসলেই রিস্ক, যদি সে বিশ^াসী বন্ধু না হয়। -অথচ মাত্র এই কয় মাসে আমাকে বিশ^াসী বন্ধু মনে করে ফেললে? -আমার মন-প্রাণ তোমাকে বিশ^াস করতে চাইছে যে! -বেশ। -থ্যাংক ইউ। আজ থেকে আমরা এই লন্ডন শহরে বন্ধু হলাম। স্রেফ বন্ধু, আর কিছু না। তুমি আমাকে বিশ^াস করে বন্ধু ডাকবে। আমিও তোমাকে বন্ধু বলে যা মনে আসবে, সে গল্পই শোনাব তোমাকে। জুয়েল তাকিয়ে থাকে সাব্রিনার দিকে। কি সুন্দর সহজ-সরল কথা। কি সুন্দর সাবলীল ব্যবহার। কি সুন্দর টানা টানা চোখ। আর সেই চোখে বসে আছে এক বাঙালির বিশ^াসভরা দৃষ্টি।        হঠাৎ জুয়েলের চিন্তা থামিয়ে দিয়ে সাব্রিনা বলে, আচ্ছা ডিয়ার, কী খেলে শরীরটা একটু গরম গরম লাগবে? শীতে আমরা বাড়িতে হাঁসের গোশ খেতাম। এখানে কোথাও হাঁসের গোশ রান্না হয় তা তো জানিনে। ল্যাম্বের গোশ পাওয়া যায় ? ... -আছে, ওয়ারউইক রোডে, মিউজিয়াম রোডে, থেমসের তীরের একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে। আজ অনেক রাত হয়ে গেছে, সড়কেও তুষার জমতে শুরু করেছে, আর একদিন নিয়ে যাব। -আচ্ছা জুয়েল, আজ আমি একটু স্কচ হুইস্কি খাই, কিচ্ছু হবে না। -সাব্রিনা, তুমি মানে হুইস্কি ... -আরে কিচ্ছু হবে না। আর মাথা যদি একটু ঘোরেও, তুমি তো আমার বিশ^াসী বন্ধু আছো, আমার রেসিডেন্টে পৌঁছে দেবে। আমার হোস্টেলের মেয়েরা কতো খায় এসব! -না না। তোমাকে আমি ওটি খেতে অনুমতি দেব না। -আরে ধেৎ! আমি কি নেশা করার জন্য পান করছি, না কী উল্লাস করার জন্য? আমি তো কিছুই করছিনে, সামান্য একটু টেস্ট করছি মাত্র। জুয়েল বেশ কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকে। কিছু পরে ওয়েটারকে ডেকে মিডিয়াম এক বোতল স্কচ হুইস্কি আনতে বলে রেস্টুরেন্টের ভেতর কেবিনের মতো ঘেরা একটি রুমে আসে সাব্রিনাকে নিয়ে। -এখানে কেন? এটা বাঙালি হোটেল কাম রেস্টুরেন্ট। এখানে এ দেশে সব বাঙালি ক্লায়েন্ট আসে। বিদেশীরাও আসে। বাঙালিরা যদি দেখে ওপেনলী ওয়াইন খাওয়া হচ্ছে তাহলে তারা এখানে আসা ছেড়ে দেবে। তাই কিছুটা আড়ালে এখানেই বিক্রি ও পানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। জানোই তো এ দেশ সেক্যুলার দেশ। হঠাৎ ঘরের ভেতর থেকে জোরে ‘জুয়েল’ ডাক শুনে তার চিন্তার সূত্র কেটে যায়। কখন যে তার কফি শেষ হয়ে গেছে খেয়ালও করেনি। ঘরে ঢুকেই দেখে সাব্রিনা ব্ল্যাংকেটটি বুক পর্যন্ত ডেকে রেখে বিছানায় বসে আছে। সে ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে সাব্রিনা ভয়ার্ত চোখে বলে উঠল, কাল রাতে কী হয়েছিল জুয়েল? -ও কিছু না, তুমি সামান্য বেশি পান করেছিলে তো, তাই? -ঠিক ঠিক বলো জুয়েল! -কী আর হবে? যা হবার তা-ই হয়েছে। বলে মুচকি হেসে সে বিছানায় পাশে বসে ওর কাঁধদুটো দুই হাত দিয়ে ধরে। এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে দিয়ে বলল, না। তুমি ঠিক ঠিক বলো। -যা হবার তা-ই হয়েছে সাব্রিনা। বিধির বিধান কে খণ্ডাতে পারে? -না। তুমি মিথ্যে বলছ, ঠিক ঠিক বলো, গর্জে ওঠে সাব্রিনা। সাব্রিনা যখন উন্মাদের মতো বলল, তুমি ঠিক ঠিক বলো জুয়েল, তখন জুয়েল তার দু’হাত দিয়ে সাব্রিনার দুই কাঁধ ঝাঁকি দিয়ে বলল, কাল রাতে কিচ্ছু হয়নি। কোন কিছুই হয়নি। আমি গাড়ি থেকে তোমাকে ধরে এনে কেবল ওভারকোর্টটি খুলে, জুতোগুলো খুলে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছি। রাতে তুমি জেগে উঠলে যেন তোমাকে বাথরুমে নিয়ে যেতে পারি তাই সারারাত এ বিছানায়ই কাটিয়ে দিয়েছি। আর কিচ্ছু হয়নি। এবার সে সাব্রিনার চুই চিবুক ধরে হিস্ হিস্ করে বলে উঠল, আমি জানি একটি মুসলিম মেয়ের কাছে তার সতীত্ব কতো মূল্যবান সম্পদ। কাল রাতে কোনো কিছুই হয়নি। তুমি আমার ঘরে অতিথি। আমি স্বপ্নেও আমার ঘরে আসা মেহমানের সঙ্গে কখনো এমনটি করতে পারি না তুমি যা শঙ্কা করছো। আমি ফান করছিলাম মাত্র। প্রায় ক্রুদ্ধস্বরে সাব্রিনা বলল, আর কখনো আমার সঙ্গে তুমি এরকম ফান করবে না। -ঠিক আছে, আর করবো না। তুমি আমার বন্ধু। তুমি আমাকে বিশ^াস করবে, আমিও তোমাকে বিশ^াস করব, এটাই আমাদের সম্পর্ক। অন্য কিছু নয়। সাব্রিনা অচমকা জুয়েলকে জড়িয়ে ধরে। মুখে বলে, কখনো তুমি আমার সঙ্গে আর এমন ফান করবে না। -আচ্ছা বেশ, আর কখনো করবো না। কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপচাপ একইভাবে বসে রইল। বোধহয় লন্ডন যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন এ বন্ধুত্বও বেঁচে থাকবে।

বাংলা ভাষা ও বানানের পরিবর্তন

বাংলা ভাষা ও বানানের পরিবর্তন

ভাষা হচ্ছে সংস্কৃতির প্রধান বাহন। মানুষের মনে স্বদেশ প্রেম ও চেতনা উৎসরণে ভাষা এক উল্লেখযোগ্য শক্তি। যুগে যুগে প্রবল প্রতাপশালী আগ্রাসী বৈদেশিক শক্তির আক্রমণে অনেকের মাতৃভাষা হারিয়ে গেছে। বিজয়ী প্রতাপশালীরা সব সময়ই তাদের ভাষা বিজিত জাতিগুলোর উপর চাপিয়ে দিয়েছে। এভাবে পৃথিবী থেকে অনেক ভাষা হারিয়ে গেছে। একটি ভাষার বিলুপ্তি মানে সভ্যতার একটি অমূল্য অংশ ধ্বংস হয়ে যাওয়া। পৃথিবীর বিশ কোটিরও অধিক লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে। প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে বাংলা ভাষার জন্ম। অনেক বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে এ ভাষা সমৃদ্ধ হয়েছে। বাংলা ভাষার ব্যাকরণগত সূক্ষ্ম বিচার বিশ্লেষণ এখানে উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য বাংলা ভাষার পরিবর্তন প্রবণতাকে রোধ করার প্রয়াস পাওয়া। এই পরিবর্তন প্রবণতাকে রোধ করতে না পারলে পরিবর্তন হতে হতে এককালে বাংলা  ভাষা হারিয়ে যাবে, যেমন হারিয়ে যাচ্ছে পালি, সংস্কৃত, হিব্রু, ল্যাটিন ভাষা ইত্যাদি। ১৯০৭ সালে নেপালের রাজ দরবার হতে প্রাপ্ত পুঁথি আমাদের নিকট ‘চর্যাপদ’ নামে পরিচিত। এই চর্যাপদকেই বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন রূপে ধরা হয়।  দ্বাদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত সময় কালকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মধ্যযুগ বলে ধরা হয়।  রচিত হয় মঙ্গল কাব্য ও বৈষ্ণব পদাবলী। ভাষা গতিশীল ও সদা পরিবর্তনশীল। একটি ভাষার অনেক আঞ্চলিক রূপ বা উপভাষা রয়েছে। এমনকি ব্যক্তি বিশেষের স্বভাষাও গ্রহণযোগ্য যার জন্ম মানুষের দীর্ঘ সময় ধরে বিশেষ বাচন ভঙ্গিতে কথা বলার চর্চার কারণে। ভাষা পরিবর্তনশীল এবং এর পরিবর্তন অনিবার্য ভাষার নমনীয়তা অন্য ভাষা থেকে পরিগ্রহণ এবং অন্য অসংখ্য ভাষার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকা একটি ভাষার অস্তিত্বকে দীর্ঘায়িত করে এবং তাকে অবলুপ্তি থেকে রক্ষা করে। আবার এ কথাও সত্যি একই ভাষা গোষ্ঠীর মধ্যেও সামাজিক শ্রেণি বিন্যাসের প্রভাবে ভাষাগত বিচ্ছিন্নতা বা বিভাজন ঘটতে পারে। তবে এর ব্যাপকতা অবশ্যই সংকীর্ণ পরিসরে হয়ে থাকে। যদি বিভিন্ন উপভাষা একই ভৌগোলিক সীমারেখায় কোনো একটি ভাষাগোষ্ঠীর সঙ্গে সহ-অবস্থান করে তবে এ ভাষাগুলো পরস্পরকে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রভাবিত করে সবগুলো ভাষাতেই কমবেশি পরিবর্তন আসে। এটি মূলত হয় পারস্পরিক সমঝোতা স্থাপনের প্রয়োজনে। বাংলা ভাষার আজকের রূপটা এই পরিবর্তনেরই ফলশ্রুতি। ভাষা তার নিজস্ব গতিতে চলে। নদীর গতির সঙ্গে এর তুলনা করা হয়। অর্থাৎ নদী যেমন তার ইচ্ছামতো গতিপথ পরিবর্তন করে, ভাষাও তেমনি তার গতিপথ পরিবর্তন করে। দেশব্যাপী প্রতিটি গ্রামে আছে প্রাথমিক বিদ্যালয়, প্রতিটি বিদ্যালয়ে আছে একই রকম সিলেবাসের একই রকম বই-পুস্তক। আর আছে একই রকম প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক। এর ফলে, ধীরে ধীরে বাংলা ভাষার উপর আঞ্চলিক প্রভাব কমে  আসছে অর্থাৎ বিভিন্ন অঞ্চলের একই বর্ণের বা শব্দের উচ্চারণের তারমতম্য কমে আসছে। এখন চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহে প্রভৃতি জেলার লোকদের কথাবার্তা থেকে বুঝা যায় না যে তারা বিভিন্ন জেলার  অধিবাসী। এটা নিঃসন্দেহে আনন্দের কথা। আমাদের ভাষার পরিবর্তন প্রবণতা বিভিন্ন ধরনের যথা- বর্ণের উচ্চারণের পরিবর্তন প্রবণতা। বর্ণের উচ্চারণ দুই প্রকার। দেখা যায় শুদ্ধ উচ্চারণ এবং বিকৃত উচ্চারণ। ‘অ’- শুদ্ধ উচ্চারণ ‘অ’ যেমন অশোক। বিকৃত উচ্চারণ ‘ও’ যেমন ওতি। ‘এ’ শুদ্ধ  উচ্চারণ ‘এ’  যেমন এসো। বিকৃত উচ্চারণ ‘এ্যা’ যেমন  এ্যাক। কেউ কেউ সত্য, লক্ষ্য, কল্যাণ ও বন্যাকে, - সোত্য, লোক্ষ্য, কোল্যাণ, বোন্যা, এমনতর উচ্চারণ করার পক্ষে মত দিয়ে থাকেন। তারা যুক্তি দেখান ‘দ্বিতীয়’ বর্ণে ‘য’ (য) থাকলে প্রথম বর্ণের উচ্চারণ করতেও সহগ করার প্রবণতা আসে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায় বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী কিছু এলাকা বাদে সমগ্র দেশটির গ্রামেগঞ্জে ও স্কুল কলেজে সকলেই সত্য, লক্ষ্য, কল্যাণ, বন্যা উচ্চারণ করে প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ। উচ্চারণ অভ্যাসের ব্যাপার। যে, যেটি অভ্যাস করে ফেলবে, সেটিই তার কাছে সঠিক মনে হবে। প্রচলিত, প্রতিষ্ঠিত এবং শুদ্ধ বানানটিকেও পরিবর্তন করে ভিন্নরূপ দেয়া হচ্ছে। যেমন- শ্রণীকে শ্রেণি, কাহিনীকে কাহিনি, সুধীকে সুধি, গোষ্ঠীকে গোষ্ঠি, পদবীকে পদবি, শহীদকে শহিদ, আরবী কে আরবি লেখা হচ্ছে। বাংলা ভাষায় হ্রস্বই-কার ()ি এবং দীর্ঘ ঈ-কার (ী) নামে দুটি ধ্বনি প্রতীক আছে। বাংলা সহ প্রায় সব আধুনিক ভাষায় ঈ-কারকে স্ত্রী প্রত্যয় হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। এই প্রত্যয়টি দিয়ে পুংলিঙ্গ শব্দকে স্ত্রী লিঙ্গ করা হয়, যেমন- জনক-জননী, নদ-নদী, মানব-মানবা, নর্তক-নর্তকী, পতি-পত্নী, গুণবান-গুণবতী, রূপবান-রূপবতী, বুদ্ধিমান-বুদ্ধিমতী, বৈষ্ণব- বৈষ্ণবী ইত্যাদি। বাংলা ভাষায় ঈ-কার দিয়ে অসংখ্য শব্দ লিখিত আছে। যেমন-জ্ঞানী,  গুণী, ধনী, মানী, বিনয়ী, গৃহী, ত্যাগী, সুখী, দুঃখী, পাপী, তাপী, ভোগী, রোগী, লোভী, বিদেশিনী, কামিনী, বিনোদিনী, মায়াবিনী, করণীয়, বরণীয়, জাতীয়, ধর্মীয়, পূজনীয়, আত্মীয়, পালনীয়, শাস্ত্রীয়, লোভনীয়, জীবন,  স্বাধীনতা, স্বীকৃত, সীমা, গভীর, পৃথিবী ইত্যাদি। সুতরাং ভাষা পরিবর্তনের বানানে ঈ-কারকে আমরা কখনই বাদ দিতে পারছি না। ‘ঈ’ কারকে যখন বাদ দেয়া যাচ্ছে না তখনতো সমতার প্রশ্নই আসে না। বলা হচ্ছে- বিদেশী, দেশী এবং তদ্ভব  শব্দে ই-কার দিতে হবে। সেই নিয়ম পালন করতে গিয়ে এখন আমরা আরবীকে আরবি, শহীদকে শহিদ, লাইব্রেরীকে লাইব্রেরি, সরকারীকে সরকারি লিখছি। বাংলা ভাষার বানান সংস্কারের আমরা বিরোধিতা করছি না। কিন্তু যে বানানটি সাহিত্যে এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, তার পরিবর্তন করার কোন প্রয়োজন দেখি না। বাংলা ভাষার পরিবর্তন প্রবণতার মধ্যে অভ্যাস, মানসিকতা এবং অনুকরণ প্রিয়তা কাজ করছে। আমাদের মুখের ভাষা চলতি ভাষা। অথচ আমাদের চলতি ভাষা নিয়ে আমরা গৌরব বোধ করি না। সবশেষে একটি প্রশ্ন : কোনো একদিন আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলা কি হারিয়ে যাবে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে? না তা’ যাবে না। আধুনিক প্রিন্ট, ইলেকট্রোনিক মিডিয়া সর্বোপরি তথ্য প্রযুক্তির যুগে চেষ্টা করলে কোনো ভাষাই হয়তো পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে না শেষ পর্যন্ত। তবে প্রতিনিয়ত নিয়মিত ভাষা চর্চার ব্যাপারটা অব্যাহত রাখতে হবে প্রতিদিন। ভাষা হলো বহতা নদীর মতো। তার মুখে পলিমাটি জমতে দেয়া যাবে না কোনো কিছুইতেই।

রোকে ডালটন এর দুটি কবিতা ভাষান্তর

রোকে ডালটন এর দুটি কবিতা ভাষান্তর

রোকে ডালটন লাতিন আমেরিকার  অন্যতম শক্তিশালী বিপ্লবী কবি, যাঁকে চে গুয়েভারার পরেই স্থান দেয় লাতিন বিশ্ব। তাঁর জন্ম ১৯৩৫ সালে, সালভাদরের এক উচ্চবিত্ত পরিবারে। ১৯৫৫ সালে তিনি কম্যুনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। ১৯৫৯-৬০ এ কৃষক অভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশ নিতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন। তাঁর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে  স্বৈরাচারী একনায়ক সরকার। কিন্তু অদ্ভুতভাবে ফাঁসির দিনেই সেই স্বৈরশাসকের পতন ঘটে, আর তিনি বেঁচে যান। ১৯৬১ তে দেশত্যাগ করে মেক্সিকো চলে যান।  সেখানেই তাঁর কাব্যপ্রতিভার বিকাশ ঘটে। এরপর তিনি চলে যান কিউবা এবং লাতিন আমেরিকার একজন অন্যতম প্রধান বিপ্লবী কবি হয়ে ওঠেন। কিউবা থেকে যান প্যারাগুয়ে, সেখানে তাঁর রাজনৈতিক বক্তৃতা অনেককে চমৎকৃত করে। ১৯৬৫ তে ফিরে আসেন দেশে। সশস্ত্র বিপ্লবে অংশ নিয়ে আবার গ্রেপ্তার হন। তাঁর মৃত্যু হয় ১৯৭৫ এর ১০ মে, বিপ্লবীদের মধ্যে চলা এক আন্তঃসংঘর্ষে।

ভাষ্যগুলো ভাষা হোক

ভাষ্যগুলো ভাষা হোক

কবি মতিন বৈরাগী ঊনআশি-তে পা ফেলেছেন। মাথা থেকে চুল অপসৃত প্রায় এবং যা কিছু অবশিষ্ট, এখনও অশেষ, সাদা রঙের শুভ্রতায় অমলিন। ততোধিক তিনি তরুণপ্রাণ এবং তরুণাভিমুখী, নিরহংকার এবং হৃদয়াবেগে পরিপূর্ণ একজন মানুষ; সহসা সাক্ষাৎ থেকে একান্ত আপন করে নিতে পারেন নিমিষেই। কোনো অনুরোধ ব্যতিরেকে, নিজস্ব তাগিদে হঠাৎ কোনো তরুণের কবিতা নিয়ে লিখে তাক লাগিয়ে দিচ্ছেন সেই তরুণ কবিকেই; কেননা তিনি জানেন কবিতা এক প্রবাহ যাকে সঞ্চারিত করে দিতে হয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। আজীবন মানুষের সংগ্রামের সঙ্গে, দেশের নানাবিধ সংকট ও উত্থান-পতনের সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়ে মানুষের মুক্তির কথা ভেবেছেন এবং সম্পৃক্ত থেকেছেন। যে পথে মানুষের সাম্য প্রতিষ্ঠা হতে পারে বলে বহুকালব্যাপী পৃথিবীর একটা আদর্শ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে এসেছে, আজ পরিবর্তিত সময় ও পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে এখনও আস্থা রাখেন তাতে। তাঁর কবিতা তাই ব্যক্তিদীর্ণ অনুভবের থেকে এসে সামষ্টিকতায় ছড়িয়ে যায় এবং তা কোনোভাবেই নয় স্লোগানের সাময়িকতায়; বরং এক অন্তর্লীন কাব্যবোধের বোঝাপড়ায়, অনেক নিরাভরণ কিন্তু গভীরতায় লীন। কবি বৈরাগী লিখছেন তাঁর ‘আজকের বিপন্ন দিনে’ কবিতায় : আজকের এই বিপন্ন দিনে সীমাহীন সমুদ্র-তীরে যখন দাঁড়িয়ে খুঁজছো কখন হারিয়েছে দিনের সূর্য তখন উচ্ছ্বসিত জলরাশির ক্রুদ্ধ গর্জন পাতালের শতকোটি নাগ দিচ্ছে ছোবল তটরেখায় তোমার দু’পায়ে নিস্তরঙ্গ জীবনে বুঝি দিতে চায় অন্য এক ভাষা আবেগ সৌরভ তখন শতাব্দীর অন্ধকারে তুমি নৈঃশব্দের ঘরে দাঁড়িয়ে  তোমার সমুখে অথৈ সাগর-জলের ক্রুদ্ধ গর্জন, ভাবছো  দেখছো আকাশ! ‘উচ্ছ্বসিত জলরাশির ক্রুদ্ধ গর্জন পাতালের শতকোটি নাগ’-এর ফণায় এই বিপন্ন সময়কে তিনি উপমিত করছেন, যখন বিপন্নতার বোধ সংক্রামিত হওয়ার আগে প্রকৃতির এক ভয়ংকর সুন্দর রূপকেও আমরা প্রত্যক্ষ করি বিস্ময়ে। অবশ্য তিনি আর রূপকের মধ্যে থাকেন না শুধু আরো বেশি স্পষ্টতায় চলে আসেন যখন একই কবিতায় বলেন : এমনো দিনের অন্ধকারে কতো জলজ প্রাণীর কঙ্কাল শামুকের মাছেদের কিংবা হাঙরের, পাখিদের মানুষের আদিতম উৎসের ধরিত্রি মাতার পাঁজরে  চেয়ে চেয়ে দেখো বুঝি! দেখিবারে পাও! [...] মানুষের সময় কাটে শাসক-শোষকের লোভ আর লুটমত্ত মচ্ছবে প্রতারণায় ক্ষত-বিক্ষত হয় জোৎস্নার মিহিন শরীর কালের দুষ্ট-চক্র রাষ্ট্র প্রতিদিন কাড়ে মানুষের ভালোবাসা, ভালো সে আশা আলো ফোটে না যে পৃথিবী কাঁদে হৃদয় ফাটানো চিৎকারে মানুষ জাগে না ‘জলজ প্রাণীর কঙ্কাল’ চিত্রবন্ধে যে অনুক্ত হিংসা ও আক্রমন চিহ্নিত হয়, তা স্পষ্ট হয়ে যায় শাসক-শোষকের লোভ আর লুটমত্ত মচ্ছবে ক্ষতবিক্ষত জ্যোস্নার মিহিন শরীরের রূপকল্পে এসে। এভাবে প্রাকৃতিক সম্মোহনের মধ্য দিয়ে তিনি আজকের বিপন্ন দিনের গল্প শোনান পাঠককে। এর থেকে তিনি মানুষের মুক্তি চান। মানুষের অন্তরে যে ভাষ্যগুলো অবরুদ্ধ হয়ে আছে তার মুক্তি চান তিনি। বলেন তিনি ‘ভাষ্যগুলো ভাষা হোক’ কবিতায় : কান্নাগুলো বাতাসে ছড়িয়ে দাও, আত্মা হয়ে উঠুক, বজ্র হোক বিক্রমে, মেঘ হোক আকাশের, তুমুল তুফান উঠুক করোটির ভাঁজে, অনন্ত এক ইচ্ছে ডানা মেলুক সপ্তরথের চাকা জাগরণ জাগরণ বলে চিৎকার উঠুক তারস্বরে, আর আবদ্ধ হৃদয় মুক্ত হোক এই মুক্তি শুধু জাগতিক অর্থেই নয়, সামাজিক-রাষ্ট্রিক শোষণ বঞ্চনা থেকেই শুধু নয়; আরো বৃহত্তর পরিসরে মানুষের আত্মিক মুক্তির কথাও বলেন তিনি যখন উল্লেখ করেন একই কবিতায় পৃথিবীর পরম মানবসত্তা, মহাপ্রাণ বুদ্ধকে : অনন্ত এক ইচ্ছের মতো একই লোহুরং একই প্রাণমন থেকে আবার জন্মাক মহাবুদ্ধ এক রাতে পৃথিবীর সকল ক্রন্দন হোক জাগরণ সঙ্গীত ভেসে যাক কপট মুখগুলো আলোর বন্যায় ১৬ নভেম্বর ছিল কবি মতিন বৈরাগীর জন্মদিন। তাঁর জন্মদিনে, তাঁর একান্ত প্রার্থনার মত আমরাও বলি কপট মুখগুলো আলোর বন্যায় ভেসে যাক এবং অন্ধকার ভেদ করে জেগে উঠুক করুণালেখন মহামতি বুদ্ধের মুখ। ওম শান্তি!

ঝুলবারান্দায়  ইসরাইল-ফিলিস্তিন 

ঝুলবারান্দায়  ইসরাইল-ফিলিস্তিন 

অফিস ডে অফ আজ । বেলা করে ঘুম থেকে ওঠেন রাহাত। নাস্তা করে সাদিয়ার তৈরি করা লম্বা ফর্দ নিয়ে সাপ্তাহিক কেনাকাটা করতে বেরিয়ে যান। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে দুই হাতে থলে ভর্তি সওদা নিয়ে ঘামে জবজবে শরীর নিয়ে বাসায় ফেরেন। ডবল ফ্যান চালিয়ে জামা-কাপড় ছাড়তে ছাড়তে গামছা দিয়ে ঘাম মোছেন। সাদিয়া থলে রেখে ঠান্ডা জল দিয়ে লেবুর শরবত বানিয়ে আনেন। এক নিঃশ্বাসে শেষ করে খাটের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে থাকেন রাহাত। টিভি রুমে ততক্ষণে দুই ভাই-বোনের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।  আমি দেখছিলাম, তুমি রিমোট নিলে কেন? সারাদিন তুই দেখবি নাকি? বাবা বলেছে না একসঙ্গে মিলেমিশে দেখতে? তোর সঙ্গে ওই ছোটদের কার্টুন আমি দেখব নাকি? তুমি বুঝি বড় হয়ে গেছ? আর বড়রা কি কার্টুন দেখে না। বাবা-মাও তো মাঝে মাঝে কার্টুন দেখে। তুমিও তো মাঝে মাঝে দেখো।  তাতে কি, এখন আমি দেখব না। গুরুত্বপূর্ণ খেলা চলছে। আমি এখন খেলা দেখব। হয় আমার সঙ্গে খেলা দেখ, নয়তো পুতুল খেল গিয়ে। না আমি কার্টুন দেখবো। রিমোট দাও বলছি। না দেবো না। রিমোর্ট নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু হলে সাদিয়া কিচেন থেকে চিল্লাচিল্লি শুরু করেন, টিভি বন্ধ কর বলছি, কাউকে টিভি দেখতে হবে না।  পরিস্থিতি ভয়ানক দেখে রাহাত নিজেই বিছানা ছেড়ে উঠে আসেন।  এই গরমে কী শুরু করেছ তোমরা? দুদিন আগে কী বোঝালাম তোমাদের? বলেছি না একসঙ্গে মিলে মিশে টিভি দেখতে হয়, একে অপরকে ছাড় দিতে হয়। ভাই-বোন হয়ে যদি একে অপরকে ছাড় দিতে না পারো তাহলে অন্যকে কীভাবে ছাড় দেবে?  বাবার কথার উপর কথা বলে না কেউ, মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকে।  রাহাত বলেন, রিমোট কই?  শুদ্ধ কেড়ে নেওয়া রিমোট শরীরের পেছন থেকে সামনে আনে। দাও, আমার কাছে দাও। এখন তোমাদের টিভি দেখতে হবে না। খেলো গিয়ে।  ছলছল চোখে দুজনেই ঝুলবারান্দায় চলে যায়। এই বারান্দাখানিই এখন ওদের যাবতীয় খেলা ও অবকাশ কাটানোর আশ্রয়।  ঋদ্ধ বলে, তোমার জন্যই কার্টুন দেখতে পারলাম না। বাবা টিভি দখলে নিয়ে নিলো, তাতে তোমার কী লাভ হলো? অন্তত আমার সঙ্গে বসে বসে কার্টুন দেখতে পারতে? যাও এখন বাবার সঙ্গে বসে বসে টক-শো দেখো, আর যুদ্ধের খবর দেখো।  তোর অই ন্যাকা ন্যাকা কার্টুনের চেয়ে যুদ্ধের খবরও অনেক ভালো। আমার সঙ্গে যদি খেলা দেখতি বরং তোর জন্য ভালো হতো, খেলার ফাঁকে ফাঁকে কার্র্টুনও দেখতে পারতি।  বাবা টিভির ভলিউম বাড়িয়েছে। বারান্দা থেকে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।  ঋদ্ধ চোখে-মুখে অভিমান ধরে ভাইকে বলে, বাবা তো টিভি দেখছে, আমরা এখন কী করবো, বলো?  শুদ্ধ বলে, আমাদের মাঠ আছে যে খেলবো? নানুবাড়ি কত সুন্দর মাঠ, ছুটিতে সেখানেও যাওয়া হলো না।  হই-হুল্লোড় করতে করতে পাশের ফ্ল্যাট থেকে আসে মুগ্ধ ও চয়ন। শুদ্ধ-ঋদ্ধ’র সঙ্গে অবসরে প্রায়ই ওরা খেলতে আসে। সেই কখন থেকে এ বাসায় আসার জন্য মায়ের কাছে বায়না ধরেছেÑ অবশেষে মা আসতে দিলো।  খেলার সাথীদের আগমনে নিমেষেই শুদ্ধ-ঋদ্ধ বাবার রিমোট কেড়ে নেওয়ার বেদনা ভুলে যায়। ওরা আনন্দে মেতে ওঠে।  টিভি রুম থেকে বাবার কণ্ঠ ভেসে আসেÑ তোমরা আস্তে কথা বলো।  বারান্দা থেকে শোনা যাচ্ছে বাবা টিভির ভলিউম আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন।