ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০১ মে ২০২৫, ১৭ বৈশাখ ১৪৩২

সাহিত্য

সাহিত্য বিভাগের সব খবর

হাটের হুল্লোড়ে ইংরেজি গ্রামার, যেখানে মিতুলের স্বপ্ন আর সুনীল স্যারের ভালোবাসা মিলেমিশে যায়

হাটের হুল্লোড়ে ইংরেজি গ্রামার, যেখানে মিতুলের স্বপ্ন আর সুনীল স্যারের ভালোবাসা মিলেমিশে যায়

পুইশুর প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক সুনীল কুমার বিশ্বাস রবি ও বুধবারে রাহুথোড় হাটে প্রায়ই আসতেন প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে। হাতিয়াড়ার এক ছোট ছেলে মিতুল প্রাইমারি স্কুলে পড়ে, ইংরেজি গ্রামার শেখার ইচ্ছা তার। মা-ও চান তার ছেলে লেখাপড়া শিখে মানুষ হোক। সুনীল বাবুর সঙ্গে দেখা করে বললেন, "কাকু, আমার মিতুলরে একটু ইংরেজি শিখাইয়া দাও।" তিনি বললেন, "মাগো, তোর ছেলের কষ্ট করে পুইশুর যাওয়ার দরকার নেই। আমি তো হাটবারে রাহুথোড় হাটে আসি। তোর ছেলে যদি এ সময়ে আমার কাছে যায়, তখনই তারে যা পারি শিখাইয়া দেবো।"

ভাষায় কবিতার নিজস্ব সৌরভ

ভাষায় কবিতার নিজস্ব সৌরভ

বাংলা সাহিত্যে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার দীর্ঘকাল ধরেই হয়ে আসছে। যেমন আধুনিক উপন্যাসে, নাটকে নির্বাচিত অঞ্চলের বিশিষ্টতা তুলে ধরার জন্য, ঐ অঞ্চলের আঞ্চলিক চরিত্র উপস্থাপন করার জন্য আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। আর বাংলা কবিতায় প্রাচীন সময় থেকেই লোকজীবনের কথা আঞ্চলিক ভাষায় উপস্থাপিত। যেমন, বৌদ্ধ সহজিয়াপন্থিরা যেদিন লোকসমাজের কাছে তথাগতের বাণী ও সাধনপ্রণালীকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য লোকসাধারণের ভাষায় নির্মাণ করেছিলেন চর্যাগীতি সেদিনই রচিত হয়েছিল বাংলা ভাষায় আঞ্চলিক ভাষার কবিতা। চর্যাপদের কবিদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন নিম্নবর্গের বা অন্ত্যজ ম্লেচ্ছ সম্প্রদায়ের মানুষ। বর্ণাশ্রম প্রথা ও অস্পৃশ্যতা উৎকটভাবে বিদ্যমান থাকায় অভিজাত শ্রেণির ঘৃণা ও অবজ্ঞার শিকার হয়েছিলেন তারা। এই অবজ্ঞা ও ঘৃণার কারণে তারা উচ্চবর্গের অভিজাতদেব ভাষাকে (সংস্কৃত ভাষা) বর্জন করে লোকসাধারণের অখ্যাত ভাষাকে তুলে ধরেছিলেন। চর্যাপদের অন্যতম একজন কবি কাহ্নপার একটি পদ থেকে জানা যায় সে-যুগে অন্ত্যজ শ্রেণির লোকেরা উচ্চবর্ণ ও ধনিক শ্রেণি অধ্যুষিত নগরে বসবাস করার অধিকার থেকেও বঞ্চিত ছিলেন। কাহ্নপা লিখেছেন,         ‘নগর বাহিরি রে ডোম্বী তোহারি কুড়িআ           ছোই ছোই জাহ সো বাহ্ম নাড়িআ ॥’ চর্যাযুগের এইসব তথাকথিত নিম্নবর্গ ও অন্ত্যজ শ্রেণির কবিরা সেদিন উচ্চবর্গের দেবভাষার অভিজাত বৃত্তের বাইরে বেরিয়ে না এলে আমরা আমাদের বহুসাধের  বাংলা ভাষাকে খুঁজে পেতাম না, পেতাম না আঞ্চলিক ভাষার বৈচিত্র্যময় সম্ভার। মধ্যযুগে ষোড়শ শতাব্দী অবধি মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল ও ধর্মমঙ্গলের মতন মঙ্গলকাব্যগুলিতে বা তারও আগে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে ও বৈষ্ণবপদাবলীতে এবং পরবর্তীকালের চৈতন্যজীবনী সাহিত্যে লোকসাধারণের চালচিত্র তাদের ভাষাবোধের গভীর ব্যঞ্জনায় পরিব্যাপ্ত হয়ে দেবতা-মাহাত্ম্য ও দেবকল্পের আশ্রয়ে কবিতার নির্ভার সত্তাকে প্রাণবন্ত করেছে। মঙ্গলকাব্যে কালকেতু-ফুল্লরার মতন অন্ত্যজ মানুষজনের সুখদুঃখ মাখা জীবনের জলছবিতে লোকমানুষের অবদমিত ধর্মীয় চেতনার স্ফূরণ ঘটেছে; যা মধ্য যুগের কবিতার বৈশিষ্ট্য হিসেবে সমালোচকদের কাছে চিহ্নিত। মধ্যযুগের দৈবী পরিমণ্ডলের কাব্যসাহিত্যে একমাত্র ব্যতিক্রম হলো সপ্তদশ শতাব্দীতে রচিত আরাকান রাজসভার কবি দৌলতকাজীর দসতী ময়নামতী’ বা ‘লোরচন্দ্রাণী’ এবং সৈয়দ আলাওলের দপদ্মাবতী’। মানবতাবাদের মহিমায় উজ্জ্বল এই কাব্য লোকজীবনের সংস্কৃতি ও ভাষা প্রয়োগে ঐশ্বর্যে মণ্ডিত। দেবদেবীর মাহাত্ম্য রচনার মধ্যযুগীয় বৃত্তের বাইরে হিন্দু মুসলিম সংস্কৃতির সমন্বয়ে এক নতুন ভাবচেতনায় নির্মিত হয় এই লোকজীবনের আখ্যান। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মঙ্গলকাব্যধারায় সর্বশেষ কবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর তাঁর দঅন্নদামঙ্গল’-এ দৈবী চরিত্রের লোকায়ত রূপ ফুটিয়ে তোলেন লোকভাষার ব্যবহারে। অন্নদামঙ্গলে লোকসাধারণের প্রতিনিধি ঈশ্বরী পাটনীর লোককণ্ঠে সাধারণ মানুষের চিরায়ত আর্তির কথা নিবেদিত হয়েছে দেবী অন্নদার কাছে, আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে’। লোককণ্ঠে আধুনিক বাংলা ভাষা নির্মিতর প্রথম প্রয়াস বলা যায় যাকে। এরপর শুরু হলো বাংলা আধুনিক কবিতার যুগ। ইউরোপীয় রোমান্টিকতার আবেগ ও নবজাগরণের প্রভাবে নতুন ধারার কাব্যরীতি এবং কাব্যচর্চার অঙ্গন থেকে বহুদূরে সরে গেলেন বাংলার প্রান্তিক মানুষেরা। এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তথা লোকমানুষের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা রবীন্দ্রনাথ অনুভব করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি ‘ঐকতান’ জানান: ‘কৃষাণের জীবনের শরিক যে জন,/ কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা করেছে অর্জন,/ যে আছে মাটির কাছাকাছি,/ সে কবির বাণী-লাগি কান পেতে আছি।/ সাহিত্যের আনন্দের ভোজে/ নিজে যা পারি না দিতে নিত্য আমি থাকি তারি খোঁজে।/ সেটা সত্য হোক,/ শুধু ভঙ্গি দিয়ে যেন না ভোলায় চোখ।/ সত্য মূল্য না দিয়েই সাহিত্যের খ্যাতি করা চুরি/ ভালো নয়, ভালো নয় নকল সে শৌখিন মজদুরি।’ উল্লেখ্য, এই ব্যাকুল আততি রবীন্দ্রোত্তর যুগের কবিদের স্পর্শ করেনি। ইউরোপীয় অস্তিত্ববাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং ব্যক্তিসত্তার একাকিত্বের বলয়ের বাইরে তারা বেরুতে চাইলেন না। তবে বিষ্ণু দে সাহিত্যে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারের পক্ষে সওয়াল করেছেন। লোকসংস্কৃতি ও আঞ্চলিক ভাষার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে একদা ‘নববাবুভাষা’ ছাড়ার ঘোষণা দেন তিনি: ‘রেখো না বিলাসী কোনো আশা, নববাবু ভাষা ছাড়ো মন.. গ্রামে ও শহরে পাবে কবিতার ভাষা।’ ত্রিশের দশকে আধুনিক বাংলা কবিতায় আঞ্চলিক ভাষার সৌরভ বিস্তারে অসামান্য অবদান রেখেছেন কবি জসীমউদ্দীন। তাঁর কবিতায় লোকজীবন ও সংস্কৃতি নিবিড় পরিচর্যায় আবহমানকালের ঐতিহ্যের নান্দনিক ভিত নিয়ে উপস্থিত। কবিতায় পরিবেশ ও সমাজচিত্র সাবলীল লোকশব্দের গাঁথুনির ভেতর সাধুরীতির কাঠামো অনুসৃত আধুনিক কথ্যরীতির নতুন একটি ধারা নির্মাণ করেছে। জসীমউদ্দীন যেন রবীন্দ্রনাথের ঐক্যতান’ কবিতার’ আর্তি শুনেছিলেন । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আহ্বানের উত্তরে তিনি জানান:  “অনন্তকাল যাদের বেদনা রহিয়াছে শুধু বুকে এদেশের কবি রাখে নাই যাহা মুখের ভাষায় টুকে সে ব্যথাকে আমি কেমনে জানাব? তবুও মাটিতে কান পেতে রহি কভু শোনা যায় যদি কি কহে মাটির প্রাণ” ।

কালো মেঘের ছায়া অরূপ তালুকদার

কালো মেঘের ছায়া অরূপ তালুকদার

লাল গেঞ্জি পরা ছেলেটির দিকে আমি তাকিয়েছিলাম ও আমার মতো আরও দুই একজন দেখছিল ছেলেটিকে। ছেলেটি রাস্তার পাশের ছোট্ট চায়ের দোকানটির সামনে দাঁড়িয়ে চা ওয়ালার সাথে কি নিয়ে যেন তর্কে জড়িয়ে গিয়েছে। কিছুটা দূর থেকে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না আসলে তর্কটা কি নিয়ে হচ্ছে! অমল আমার পাশে পাশে হাঁটছিল ও আমার দিকে একবার তাকিয়ে, একটু থেমে হাত ধরে টান দিল, কি দেখতেছেন, ওর মাথাটা একটু গরম আছে, একটু পরে সব ঠিক হয়ে যাবে-’ ছেলেটা কে? ওরে আপনি চিনবেন না। মাঝের চরের মর্জিনার পোলা, কয়েকদিন হয় এইখানে আসছে, দুই চার দিন পর আবার খুলনায় চলে যাবে, ও ওর বউ নিয়া ওইখানেই থাকে, বাপ নাই, সে মরছে সিডরে। এখানে এখন ওর মা একা থাকে, তাকে দেখবার জন্য মাঝে মাঝে আসে, টাকা পয়সা দিয়া যায়। সামনের দিকে পা বাড়াই ও সূর্যের আলোর তাপ বাড়ছে। ছায়ায় যাওয়া দরকার। সকালের দিকটা এরকম ছিল না। আবহাওয়া ছিল বেশ ঠান্ডা ও শান্ত পরিবেশে আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট বড় গাছ-গাছালির সবুজ পাতায় সকালের লালচে সূর্যের আলো ঝিলিক দিচ্ছিল ও তবে সে আলোয় তাপের আভাস ছিল। বোঝা যাচ্ছিল, সূর্য উপরে ওঠার সাথে সাথে ধীরে ধীরে তাপ বাড়বে ও কিছুদিন ধরে এমনটাই চলছে। গ্রামের বাড়িতে এসেছি দিন চারেক হলো। ভেবেছিলাম, গ্রীষ্মের দাবদাহ চলছে, এই সময়টা গ্রামীণ পরিবেশে কাটিয়ে গেলে ভালোই হবে। এখানে আসার পরে দু-তিন দিন বাড়ির আশপাশেই ঘোরাঘুরি করেছি। আজকে অমলকে নিয়ে চলে এসেছি নদী তীরবর্তী বন্দরের দিকে। কিছুটা দূরের আত্মীয় অমল আমাদের বাড়িতেই থাকে। আর অনেকদিন ধরে থাকার জন্য এদিকের সবকিছুই তার চেনা জানা হয়ে গেছে। বয়স তেমন বেশি নয়, তবে স্বভাবগতভাবে বেশ বুদ্ধিমান, চালাক চতুরও। ওই ছেলেটা কোথায় থাকে যেন বলছিলে? আমি অমলের দিকে তাকাই। ওই তো মাঝের চরে। নদীর ওপারের দিকে ইঙ্গিত করে অমল। বলে, অনেক আগে একবার গেছিলেন না ওই খানে, মনে নাই? অনেক দিনের ভুলে যাওয়া কিছু ঘটনার কথা হঠাৎ যেন মনের মধ্যে চলে আসে। তাইতো, দক্ষিণাঞ্চলের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সেই ভয়াবহ ‘সিডর’র ধ্বংসযজ্ঞের কথা তো এ অঞ্চলের মানুষ এখনো ভোলেনি। একটি বিদেশি বার্তা সংস্থায় কাজ করার সুবাদে সেবার সিডরের পরে আমিও তো একবার এখানে এসেছিলাম। সেটাই বা আমি ভুলে গেলাম কি করে! একটু দূরেই নদীর পাড়। তাই এ দিকে কোথাও না দাঁড়িয়ে সোজা চলে গেলাম নদীর পাড়ে। একটা গাছের ছায়ার নিচে গিয়ে দাঁড়ালাম। বেলা বেড়েছে। মাথার উপরের আকাশ থেকে যেন আগুনের হলকা নেমে আসছে। মাঝে মাঝে তার স্পর্শ পাওয়া যাচ্ছে। গরম হাওয়া উড়ে যাচ্ছে নদীর দিকে। প্রখর রৌদ্রের মধ্যে আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোর পাতার নিচে নাম না জানা কিছু পোকা এসে ছায়ায় লুকিয়েছে। সামনে কল কল ছল ছল শব্দে বয়ে চলেছে বলেশ্বর নদী। নদীতে তেমন ঢেউ নেই, কিন্তু স্রোত আছে বেশ। নদীর জলে ভেসে বেড়াচ্ছে কয়েকটা মাছ ধরার নৌকো। ডান দিকে কিছু দূরে বরগুনা শহর ও বাঁ দিকে কিছুদূর গিয়ে নদী বাঁক নিয়ে সোজা চলে গেছে উত্তর দিকে। মনে পড়ল, নদীর পাড়ে এখানেই ছিল লঞ্চঘাট। ছোটবেলায় এখান থেকে লঞ্চে উঠে বরিশালে যেতাম। সময় লাগতো দশ বারো ঘণ্টা। অমল আঙুল তুলে দেখালো, ওই যে দেখেন নদীর মাঝ বরাবর বড় একটা চরের মতন এলাকা, অনেক গাছপালা, বাড়ি ঘর দেখা যাইতেছে, ওইটাই মাঝের চর। চরের ওই পাশে নদী আছে, সিডরের পর নতুন কইরা গাছপালা জন্মাইছে। গাছপালা বড় হওয়ার জন্য ওই পাশের নদীটা এখান থিকা দেখা যাইতেছে না। একটু থামে অমল, পরে আবার বলে,আমার কিন্তু সব মনে আছে, আপনে সেইবার সিডরের কয়দিন পর ক্ষয়ক্ষতির খবর নিতে এইদিকে আইছিলেন না! ঠিক কিনা? এবার যেন পরিষ্কার মনে পড়ে গেল সব, সেদিন এক মাঝ বয়সী মহিলাকে ওখানে দেখেছিলাম আরো কয়েকজনের সাথে ওসে তার জীবনে ঘটে যাওয়া এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা বলছিল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। তার কথা শুনে, সেদিন ওখান থেকেই তার সেই ভয়ংকর অভিজ্ঞতার বিষয় নিয়ে রিপোর্ট করেছিলাম। মনের ভিতরে হঠাৎ কি হলো কে জানে, অমলকে বললাম, চল তো, মাঝের চরে যাই’ অমল তো অবাক, সে কি, এখন যাইবেন আবার ওই চরে? চারিদিকের কি অবস্থা দেখছেন? প্রচন্ড গরম, বৈরী আবহাওয়া, সব মিলিয়ে প্রতিকূল পরিবেশ, কিন্তু এসব দেখেও কিসের টানে কে জানে, অমলকে একটা নৌকা ডাকতে বললাম। আমার কথা শুনে আমার দিকে তাকিয়ে অমল কি মনে করলো, কে জানে! তবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে গজ গজ করতে করতে নদীর পাড় ঘেঁষে সামনে এগিয়ে  গিয়ে কয়েক মিনিট পরে ছোট একটা নৌকা খুঁজে নিয়ে এলো। মাঝির সঙ্গে দু’চারটা কথা বলে দুজনেই নৌকায় উঠলাম। মাঝিকে বললাম একটু তাড়াতাড়ি যেতে, কিন্তু প্রচন্ড স্রোতের কারণে সহজে এগোনো যাচ্ছিল না। ফলে চড়ে পৌঁছাতে বেশ কিছুটা সময় লাগলো। যখন মাঝের চরে এলাম তখন সূর্য একেবারে মাথার উপরে। নৌকা ছেড়ে উপরে উঠে এসে চারদিকে একবার তাকিয়ে দেখলাম। মনের মধ্যে এই চরের পুরনো যে ছবিটা ছিল, তার সঙ্গে এখনকার চেহারাটা যেন ঠিক মিলাতে পারছিলাম না। কারণ সিডর হয়ে গেছে সেই প্রায় ১৫ বছর আগে। এই সময়ের মধ্যে অনেকটাই পরিবর্তন হয়ে গেছে সবকিছুতে। তখন এখানে এত ঘর বাড়ি ছিল বলে মনে পড়ে না। বড় বড় গাছের চাইতে কলা গাছের সংখ্যাই ছিল যেন বেশি। এখন বেশ বড় বড় গাছপালা হয়েছে। কলা গাছ তেমন চোখে পড়ল না। নদী তীর থেকে গাছগাছালির আশপাশ দিয়ে ভেতরের দিকে চলে যাওয়া মাটির রাস্তাটা প্রায় তেমনি আছে, তবে কিছুটা যেন চওড়া মনে হল ওরাস্তার পাশ ঘেঁষে কিছু দোকানপাট বসেছে, ভালো ঘর বাড়িও উঠেছে কিছু। দুই একটা ঘরের পাশে গরু ছাগল রাখার ঘর তোলা হয়েছে দেখলাম। দুপুর হয়ে যাবার কারণে রাস্তায় তেমন লোকজন নেই ওমাথার উপরে ঝকঝকে নীল আকাশ যেন আগুন ঢালছে। ছিঁটে ফোঁটা মেঘ দেখা যাচ্ছে না কোথাও ওমনে হচ্ছে, বৃষ্টি আসতে আরো কিছু সময় লাগবে। রাস্তা ধরে কিছুটা এগিয়ে এসে একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে নিজেকে বড় বোকা মনে হলো। অমল কোন কথা বলছে না ও বুঝতে পারছি, মনে মনে সে বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে আছে আমার এই পাগলামি দেখে। আসলেই তো তাই, কি কারনে আর কিসের টানে হঠাৎ করে এই সময়ে এখানে আসার সিদ্ধান্তটা নিয়ে নিলাম, কে জানে! এখন কোথায় পাব আমি সেই মহিলাকে? তার নামটাও তো এই মুহূর্তে ঠিক মনে পড়ছে না ও মরিয়ম, মর্জিনা নাকি ফাতেমা, এমনি ধরনের একটা নাম বিদ্যুৎ ঝিলিকের মতো কখনো কখনো স্মৃতিতে উঠে আসছে। আর সেই কবে এখানে কোথায় দাঁড়িয়ে কথা বলেছিলাম, তাও তো ঠিক চিনতে পারছি না। এবার অনন্যপায় হয়ে অমলের শরণাপন্ন হলাম। আস্তে জিজ্ঞেস করলাম, এখানের কাউকে তুমি চেনো, অমল? অমল একটু নরম হলো যেন বলল, বন্দরে যাওয়া আসা করে এমন দু-একজনের নাম জানি, কিন্তু এখানে কে কোথায় থাকে জানি না। তবে ওই বাদশারে তো চিনি। একটু আগে যারে চায়ের দোকানে দেখলেন। বাদশা! বাহ, নামটা তো চমৎকার ও বললাম, ওদের ঘরটা খুঁজে পাওয়া যাবে? আপনে খারান, বলে অমল একটু দূরে একটা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন বয়স্ক মানুষের কাছে গিয়ে মিনিট দশেকের  মতো কথাবার্তা বলে ফিরে এসে বলল, ওই বাঁ দিকের চার পাঁচটা ঘর পরে যে ঘরটার পাশে দুইটা কলা গাছ দেখতেছেন, সেই ঘরটা বাদশাদের। সময় নষ্ট না করে গাছের ছায়ায় ছায়ায় আমরা চলে গেলাম বাদশাদের ঘরের দিকে। ঘরের সামনে গিয়ে ভেতরের দিকে উঁকি দিয়ে দেখলাম ভেতরে কেউ নেই। ঘরের পিছনের দিকে পাকের ঘরে কেউ থাকতে পারে, অমল বলে ওঠে, দেইখা আসি’ বলে ঘরের বাইরে কলা গাছের পাশ দিয়ে সে পিছনের দিকে চলে গেল। বেশি সময় নিল না, কিছুক্ষণ পরে ঘরের ভেতর দিয়েই আবার সামনে চলে এলো। পেছনে পেছনে এলো এক মহিলা। নেন কথা কন, এই হইল মর্জিনা ও বাদশার আম্মা।’ আমি তাকালাম মর্জিনার দিকে। বছর ১৫ আগে দেখা সেই মানুষটাই কি এই! মনে মনে সেদিনের সেই মর্জিনার সঙ্গে আজকের এই মর্জিনাকে মেলাবার চেষ্টা করি। কপালের ডানপাশে একটা কাটা দাগ ছিল যেন। লক্ষ্য করে দেখলাম, সেটাও আছে। ভাঙাচোরা শরীরে বয়সের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ও অযত্ন অবহেলা আর বয়সের ভারে কাহিল এক বৃদ্ধা যেন দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। জিজ্ঞেস করি, আচ্ছা, একটা কথা বলতো, সিডরের সময় তুমি এখানে ছিলে? মাথা কাত করে মর্জিনা, অর্থাৎ ছিল। সেই দিন সন্ধ্যার পর সিডরের পানি তোমাকে এক টানে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল এখান থেকে দশ পনেরো মাইল দূরে রামনার চরে? সেই চরে শেষ রাতে, একেবারে ভোরের দিকে তোমার জ্ঞান ফিরেছিল, সেই রকম ভয়ংকর ঘটনাই তো ঘটেছিল সেই দুর্যোগের রাতে? প্রশ্নটা শুনে চোখের ভুরু কুঁচকে যায় মর্জিনার ও বলে, ঘটছিল তো, কিন্তু হেতে কি? আমার কথা মনে পড়ে তোমার, আমার দিকে তাকাও? সিডরের তিনদিন পর তুমি তোমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে বলেছিলে না কেমন করে ঐদিন সন্ধ্যায় প্রথমে প্রচুর গরম হাওয়া আসে, তারপর ঠান্ডা বাতাস বইতে থাকে, সেই সঙ্গে হঠাৎ করে দক্ষিণ দিক থেকে শো শো শব্দে বিরাট একটা জলের ঢেউ প্রচন্ড বেগে এই চরের উপর আছড়ে পড়ে। তারপর পলকের মধ্যে কেউ কিছু বোঝার আগেই চরের সব কিছু ডুবিয়ে দিয়ে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। পরদিন তোমার জ্ঞান ফিরে আসে একটা নদী তীরে, রামনার চরে ও এসব কথা মনে পড়ে? এলোমেলোভাবে মাথা দোলাতে দোলাতে কোন কথা না বলে শুধু অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে মর্জিনা। হয়তো সেদিনের কথা মনে করার চেষ্টা করে। এখন তুমি কেমন আছো, মর্জিনা? আমি আবার বলি, থাক এসব পুরোনো কথা। কিন্তু এখন তোমার এই অবস্থা কেন? তোমার ছেলে বাদশা তখন ছোট ছিল, এখন তো বড় হয়েছে। শুনলাম বাদশা খুলনায় থাকে। ওর তো বাপও নেই, তুমি এখন ওর কাছে গিয়ে থাকো না কেন, তাহলে তো তোমার এত কষ্ট হয় না!’ প্রথমে বুঝিনি। আমার এই সমবেদনার ভাষাটুকু মর্জিনা কিভাবে নিল, সেটা বুঝতে পারলাম একটু পরে। ‘অর লগে কি জন্য থাকুম, হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে মর্জিনা, ও তো সংসারের শনি, অর জন্যই তো অর বাপটা মরছে, আমি কেন মরলাম না, হায় হায়, আল্লায় আমারে কেন নিল না...?’ এইটুকু বলতে গিয়েই যেন একেবারে ভেঙে চুরে যায় মর্জিনা। দীর্ঘদিন ধরে বুকের ভেতরে জমে থাকা দুঃখ কষ্ট আর ক্ষোভ যেন একসঙ্গে উঠে আসে বিকট চিৎকারের মধ্য দিয়ে। কোটরাগত চোখ আর ভাঙাচোরা মুখমন্ডল ভেসে যায় চোখের জলে। ঠিকভাবে যেন দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না মর্জিনা। আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে এক সময় দ্রুত ঘরের ভেতরে চলে যায়।

রক্তকরবীর ‘নন্দিনী’ এক মানবীর ছবি

রক্তকরবীর ‘নন্দিনী’ এক মানবীর ছবি

‘আজ আপনাদের বারোয়ারী সভায় আমার ‘নন্দিনী’র পালা অভিনয়’-এভাবেই রক্তকরবী নাটকটিতে রবীন্দ্রনাথ নন্দিনীকে উপস্থাপন করেছিলেন। আর বলেছিলেন ‘আমার এই পালাটি যাঁরা শ্রদ্ধা ক’রে শুনবেন তাঁরা জানবেন এটিও সত্যমূলক’। রক্তকরবী নাটকটিকে কেন তিনি শুধু ‘পালা’ বলে অভিহিত করেছিলেন সে প্রশ্ন অনেক বিদ্বজ্জনকেই ভাবিয়েছে। কিন্তু একটি নাটক শতবছর অতিক্রম করলেও আলোচনা-সমালোচনার জায়গা থেকে যে একটুও সরে যায়নি কিংবা উৎকর্ষতা ও মনোযোগ কোনটাই হারায়নি, এই বাস্তবতায় রক্তকরবী আজও প্রাসঙ্গিক। খুব সরলভাবে নাটকের ভাব ও বিষয়বস্তু যে সাধারণের জন্য একান্ত সহজবোধ্য, এখানে বিষয়টি তেমন নয়। এই নাটকটির প্রহেলিকা আচ্ছন্ন ভাবের আড়ালে এক চিরন্তন সত্য লুকিয়ে আছে। নাটকের প্রস্তাবনা অংশে রবীন্দ্রনাথ নিজেই লিখছেন ‘যেটা গূঢ় তাকে প্রকাশ্য করলেই তার সার্থকতা চলে যায়। হৃদপিণ্ডটা পাঁজরের আড়ালে থেকেই কাজ করে। তাকে বের করে তার কার্যপ্রণালী তদারক করতে গেলে তার কাজ বন্ধ হয়ে যাবে’। তিনি আরও লিখছেন ‘এইটি মনে রাখুন রক্তকরবীর সমস্ত পালাটি নন্দিনী বলে একটি মানবীর ছবি। চারদিকের পীড়নের ভিতর দিয়ে তার আত্মপ্রকাশ। ফোয়ারা যেমন সংকীর্ণতার পীড়নে হাসিতে অশ্রুতে কলধ্বনিতে ঊর্ধ্বে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে তেমনি’। নাটকের শেষটা যখন সংকীর্ণতার অন্ধকার থেকে ‘আচমকা আলোয়’ ভরে উঠে, সেই মুক্ত আলোকশিখা হাতে করেই এসেছিল নন্দিনী। কাজেই নাটকের শুরু থেকে শেষ দৃশ্য পর্যন্ত তাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে অন্যন্য চরিত্র, কাহিনী-সংলাপ, আর নাটকের ভাবটুকুও এগিয়ে নেয়ার সূত্রধর সে যেন একাই নন্দিনী। রবীন্দ্র সাহিত্য সমালোচক চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রক্তকরবী নাটকের আলোচনায় ‘রবি-রশ্মি’ গ্রন্থে লিখছেন ‘নন্দিনী জীবন-শ্রী প্রেম-কল্যাণময়ী-লক্ষ্মী লোভীকে সে লোভ ভোলায়, পণ্ডিতকে তাহার পান্ডিত্য ভোলায়। যে নারী সর্ম্পূণতার আদর্শকে পরিব্যক্ত করে, সে সকলের মধ্যকার সুপ্ত প্রাণকে জাগ্রত করে, প্রকাশ করে’। প্রাণের স্বাধীন সত্তা, মুক্তচিন্তা ও বন্ধনমুক্তি মানুষের চির আরাধ্য, সে সত্য ও সুন্দরের পূজারী, সংকীর্ণতা ও জড়ের বিরুদ্ধে চৈতন্যের বিজয়, এই চিরন্তন সত্য প্রতিষ্ঠার প্রতীক নন্দিনী। প্রেক্ষাপট একটি কাল্পনিক রাজ্য তার নাম যক্ষপুরী। এখানে স্বভাবতই একজন রাজা আছেন। যার নাম মকররাজ। তিনি তার রাজমহলের অর্গল বন্ধ করে রাখেন। বাইরের দেয়ালে একটিমাত্র জালে আচ্ছাদিত জানালা দিয়ে তিনি তাঁর ইচ্ছে বা প্রয়োজনমতো প্রজাদের সাথে কথাবার্তা বলেন। পৌরাণিক ভাবনার যক্ষরাজ কুবেরের স্বর্ণসিংহাসন আর তার বিপুল ঐশ^র্যমন্ডিত পাতালপুরী এটা নয়। তবে এখানে মাটির নিচে সোনার খনি। সেখানে তাল তাল সোনা সঞ্চিত আছে। তারই সন্ধান পেয়ে সুড়ঙ্গ কেটে সেই সোনা আহরণ করে চলেছে একদল পরিশ্রমী মজুর। নাটকে যাদের বলা হচ্ছে ‘খোদাইকর’। কিশোর, গোকুল, ফাগুলাল, বিশু এরাই রাতদিন খনি থেকে সোনা তুলে আনে। খোদাইকরেরা সারাদিন মদের নেশায় চুড় হয়ে থাকে। যক্ষপুরীতে মুনাফা অর্জনই যেন তাদের একমাত্র লক্ষ্য। দয়া-মায়া মানবিকতা এখানে উপেক্ষিত। রাজা প্রজাদের শোষণ করছে আর রাজভান্ডার সমৃদ্ধ করতে খনি-মজুরেরা যন্ত্রের মত সোনা তুলে চলেছে। এরাই উনিশ-বিশ শতকের শিল্পায়ন আর নগরায়নের দাপটে ভূমি আর কৃষিজীবন থেকে উৎপাটিত কৃষককূল কিংবা কৃষিমজুর। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন ‘কৃষিকাজ থেকে হরণের কাজে মানুষকে টেনে নিয়ে কলিযুগ কৃষিপল্লীকে কেবলই উজাড় করে দিচ্ছে। তা ছাড়া শোষণজীবী সভ্যতার ক্ষুধাতৃষ্ণা, দ্বেষহিংসা, বিলাসবিভ্রম, সুশিক্ষিত রাক্ষসেরই মত’। নাটকের প্রস্তাবনা অংশে রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলছেন ‘কর্ষণজীবী আর আকর্ষণ-জীবী এই দুই জাতীয় সভ্যতার মধ্যে একটা বিষম দ্বন্দ্ব আছে’। আবার বলছেন ‘কৃষি দানবীয় লোভের টানেই আত্মবিস্মৃত হচ্ছে। নইলে গ্রামের পঞ্চবটচ্ছায়াশীতল কুটির ছেড়ে চাষিরা টিটাগড়ের চটকলে মরতে আসবে কেন’। কর্ষণজীবী সেই উৎপাদক শ্রেণী যাদের শ্রমে-ঘামে সৃষ্টি হয় সম্পদ আর আকর্ষণ-জীবী তারাই যারা এই শ্রমের ’উদ্বৃত্ত মূল্যে’ ভাগ বসিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। শিক্ষা, মুক্তচিন্তা আর মানবিক জীবনবোধের যে সংস্কৃতি তার বিকাশের পথ তো সেখানে রূদ্ধ থাকবেই। তাই রবীন্দ্রনাথ লিখছেন ‘আমার নাটকও একইকালে ব্যক্তিগত মানুষের আর মানুষগত শ্রেণির’। শাশ^তকালের শ্রেণি বিভাজিত সমাজের এই অনিবার্য দ্বন্দ্বটিকে রবীন্দ্রনাথ এই নাটকে উপেক্ষা করতে পারেন নি। খনি মজুর ছাড়াও আছে ‘সর্দার’, তারা বহুদর্শী এরাই রাজার অন্তরঙ্গ পার্ষদ। এদের পরিকল্পনা আর তত্ত্বাবধানে খনি মজুরদের কাজে ফাঁক পড়বার কোন সুযোগ নেই। তাদের কারণেই রাজভান্ডার সম্পদে স্ফীত হতে থাকে। আর আছে ‘মোড়ল’ যারা একসময় খোদাইকর ছিল। যোগ্যতাগুণে তারা আজ মোড়লের পদলাভ করেছে। এরা কখনো কখনো কর্মকুশলতায় সর্দারদের ছাড়িয়ে যায়। রাজার অন্যায় কাজের ভার মূলত মোড়লদের হাতেই। পারিষদ আর আমলাদের চিরন্তন শীতলযুদ্ধ নাট্যভাবনায় উপেক্ষিত হয়নি। নাটকের একটি চরিত্র ‘গোঁসাইজি’। বলা হয়েছে ‘তিনি নাম গ্রহণ করেন ভগবানের কিন্তু অন্নগ্রহণ করেন সর্দারের’। যখনই মজুরেরা সর্দারদের কথার অবাধ্য হয় তখনই গোঁসাইকে পাঠানো হয় সেখানে তাদের ধর্মকথা শোনাবার জন্য। যেখানে গোঁসাই তেমন একটা সুবিধা করতে পারে না তখন সর্দারকে বলে সে পাড়ায় আরও কিছুদিন রাজার ফৌজ রেখে দিতে, ‘ফৌজের চাপে অহংকারটা দমন হয় তারপর আমাদের পালা’। খোদাইকর ফাগুলাল, সর্দারের উপস্থিতিতে গোঁসাইকে উদ্দেশ্য করে বলে ‘প্রণামী আদায় করতে চাও রাজি আছি, কিন্তু ভণ্ডামি সইবো না’। চিরকাল পুরোহিত শ্রেণি ধর্ম দিয়ে সাধারণকে ভুলিয়ে রাখতে চেয়েছে। প্রজাশোষণের হাতিয়ার হয়েছে। রবীন্দ্রভাবনায় এই নাটকে তা ঠিকই ধরা দিয়েছে। এই নাটকে একটি গৌণ চরিত্র অধ্যাপক, তত্বকথার আড়ালে যিনি রাজার সৃষ্ট ব্যবস্থা ও যক্ষপুরীর নিয়মের কাছে বাঁধা পড়ে রয়েছেন। অধ্যাপক নন্দিনীকে বলছে ‘আমরা নিরেট নিরবকাশ-গর্তের পতঙ্গ, ঘন কাজের মধ্যে সেঁধিয়ে আছি; আবার নন্দিনী অধ্যাপককে বলছেন তোমাদের খোদাইকর যেমন খনি খুদে খুদে মাটির মধ্যে তলিয়ে চলেছে, তুমিও তো তেমনি দিনরাত পুঁথির মধ্যে গর্ত খুড়েই চলেছ’। কিশোর নন্দিনীকে ভালোবাসে তাই অনেক অত্যাচার আর মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে নন্দিনীর জন্য খুঁজে আনে রক্তকরবী। কিশোর বলেছিল ‘একদিন তোর জন্য প্রাণ দেব নন্দিনী’। ফাগুলাল একজন খোদাইকর। ছুটির দিনে সে মদ চায়, তার স্ত্রী চন্দ্রা বলে গাঁয়ে থাকতে পার্বণের ছুটির দিনটা তো তুমি এভাবে কাটাতে না। ফাগুলাল বলে বনের পাখি ছাড়া পেলে উড়তে চাইবে কিন্তু খাঁচায় বাঁধা পাখি খাঁচার মধ্যে ছাড়া পেলে সে মাথা ঠুকে মরে। চন্দ্রা তাকে গ্রামে ফিরে যেতে বললে ফাগুলাল বলে ‘ঘরের রাস্তা বন্ধ, জান না বুঝি’? বিশু নন্দিনীকে ভালোবাসে। বিশু নন্দিনীকে বলছে ‘তুমি আমার সমুদ্রের অগম পারের দ্যুতি। যেদিন এলে যক্ষপুরীতে, আমার হৃদয়ে লোনা জলের হাওয়ায় এসে ধাক্কা দিলে’ নন্দিনীকে নিজের করে না পেয়ে সে একদিন গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছিলো যক্ষপুরীতে। এখন সে গান গায়। ‘মোর স্বপন তরীর কে তুই নেয়ে /লাগল পালে নেশার হাওয়া/ পাগল পরান চলে গেয়ে’। চন্দ্রা বলে ‘তোমার স্বপনতরীর নেয়েটি কে সে আমি জানি। তরী ডোবাবে একদিন বলে দিলুম তোমার সেই সাধের নন্দিনী’। চন্দ্রা বিশুকেও বলে গ্রামে ফিরে যেতে। বিশু উত্তরে জানায় ‘সর্দার কেবল যে ফেরবার পথ বন্ধ করেছে তা নয়, ইচ্ছেটা সুদ্ধ আটকেছে। আজ যদি-বা দেশে যাও টিকতে পারবে না, কালই সোনার নেশায় ছুটে ফিরে আসবে, আফিমখোর পাখি যেমন ছাড়া পেলেও খাঁচায় ফেরে’। এভাবেই রক্তকরবীর প্রায় সব চরিত্র বাঁধা পড়ে আছে যক্ষপুরীর যান্ত্রিক জীবন আর লৌহ যবনিকার আড়ালে। রঞ্জন নন্দিনীর প্রেমাস্পদ। সে এই নাটকের প্রতিবাদী সত্বা, সে স্রোতস্বিনী নদীর মতো। নাটকের এক পর্যায়ে প্রহরীদের হাতে বিশু বন্দী হয়। বন্দি হয় কিশোর। খনির মজুররা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে বন্দীশালা চুরমার করে ভেঙে ফেলতে এগিয়ে চলে কারিগরপাড়া থেকে সব মজুরেরা। এদিকে রাজাকে না জানিয়ে রঞ্জনকেও কৌশলে বন্দি করে সর্দারেরা। রক্তকরবীর রাজা চরিত্রটিকে একটু ভিন্নভাবে উপস্থাপনের প্রয়াস পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। রাজার মধ্যে সৃষ্টি করেছেন দ্বৈতসত্বা। বলছেন ‘একই দেহে রাবণ ও বিভীষণ। সে আপনাকেই আপনি পরাস্ত করে’। একই দেহে মানব ও দেব সত্বা। নন্দিনী যক্ষপুরী আসলে তার আবহ বদলে যাচ্ছে, তাই রাজা নন্দিনীর প্রতি কোন নিষ্ঠুরতা দেখাতে পারেননি। আবার নন্দিনী কোনো বিদ্রোহী নারীও নয়। প্রতিশোধ পরায়ণতা নিয়ে রাজাকে জয় করার বাসনা তার ছিল না। তার হাতে ছিল মুক্তজীবনের আলোকবর্র্তিকা। নন্দিনীর যেটুকু বিদ্রোহ তা যক্ষপুরীর অচলায়তন ভেঙে মুক্ত বাতাস বইয়ে দেয়ার জন্য বিদ্রোহ। রাজা নিজেকে পাহাড়ের চূড়ার মতো নিঃসঙ্গ বলেছেন। নন্দিনীর ভালোবাসার কাছে রাজা হার মেনেছিলেন। মিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন নন্দিনীর সাথে রঞ্জনের। শেষ পর্যন্ত রাজা তার প্রাসাদের দ্বার খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। রঞ্জনের মৃতদেহ মাটিতে পড়ে রয়েছে। নন্দিনীর মুখে রাজা জানলেন এই রঞ্জন। সর্দাররা রঞ্জনের পরিচয় গোপন রেখেছিল রাজার কাছে। রাজা অনুশোচনায় ভেঙে পড়লেন, ‘আমি যৌবনকে মেরেছি- এতদিন ধরে আমি সমস্ত শক্তি দিয়ে কেবল যৌবনকে মেরেছি। মরা যৌবনের অভিশাপ আমাকে লেগেছে’। ধ্বজাপূজার দণ্ড তিনি নিজ হাতে ভেঙে ফেললেন, ছিঁড়ে ফেললেন ওর কেতন। শেষতক রাজা বলছেন ‘এখনো অনেক ভাঙা বাকি, তুমিও তো আমার সঙ্গে যাবে নন্দিনী, প্রলয়পথে আমার দীপশিখা?’ নন্দিনী বলছে, ‘যাব আমি’। এদিকে কুন্দফুলের মালা বর্শার আগে বেঁধে সর্দার এগিয়ে আসছে। নন্দিনী বলছে ‘ঐ মালাকে আমার বুকের রক্তে রক্তকরবীর রং করে দিয়ে যাব’। এদিকে কারিগররা বন্দিশালা ভেঙে ফেলেছে। সবার কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে, নন্দিনীর জয়!

"গোলাপের কাঁটায় রক্তক্ষরণ"

আকাশের রাগী সূর্যটা মজিদ মিয়ার মাথার ওপর দাপিয়ে বেড়ায়। কপাল বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। মাজায় পেঁচানো গামছা খুলে ঘাম মুছতে থাকে। বুকে জমাট বেঁধে থাকা ঘন-নিঃশ্বাসকে কিছুটা বিশ্রাম দেয়। এতটুকু ক্লান্তি নেই। মুখে বিসমিল্লাহ বলে বাম হাতে লাঙ্গলের গুটি মাটিতে ঠেসে ধরে। বলদ দুটির শক্তি বাড়াতে হাঁক ছাড়ে। ‘আরে চল চল, হেই যা!’ এই বাক্যটি তার জীবন-জীবিকার সাথে মিশে আছে।  অন্যের জমিতে কামলা খেটে খেটে সময় ও শক্তি দুটোই শেষ হবার পথে। তবুও পূর্ব পুরুষের জীবিকার ধারা বদলাতে না পারার আপসোস তার রয়েই গেছে।  এ তল্লাটে মজিদ মিয়ার খুব কদর। সত্যিই হাতে জাদু আছে। তার চাষ দেয়া জমিতে ফসল ফলে দ্বিগুণ। নিজের এলাকা ছেড়ে সে কোথাও যায় না। এসব উঁচু জমিতে দীর্ঘদিন বন্যা না হবার কারণে মাটির উর্বরতা শক্তির হ্রাস পেয়েছে। আগের মতো ভাল পাট না ফলায় মালিকদের সে ধান রোপণের পরামর্শ দেয়। মজিদের কথায় মালিকেরা জমির সীমানা নির্ধারণ করে নতুন আল বাঁধে। স্যালো মেশিন বসায়। এসব জমিতে এখন প্রতিবছর কার্তিক সাইল, মধুসাইল, পরাঙ্গী ধানের বাম্পার ফলন হচ্ছে।  মজিদ মিয়া জমির আলের ওপর বসে বিশ্রাম নেয়। কপালে বাম হাতের চার আঙ্গুল ঠেকিয়ে সূর্যের গতিবিধি লক্ষ্য করে। সূর্যের অবস্থান দেখে সে সময় বুঝতে পারে। মাঠের অন্য চাষিরাও তার কাছে সময় জানতে দূর থেকে হাঁক ছাড়ে- ‘ও মজিদ ভাই,কতো বাজে?’ মজিদ মিয়া জগ উঁচু করে ঢক ঢক শব্দে পানি গিলে খায়। সে লক্ষ্য করে লাঙ্গলের জোয়াল টানতে টানতে দুটো গরুই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। মজিদের পানি খাওয়া দেখে ওরা জিহ্বা চেটে তৃষ্ণার্ত হবার ইঙ্গিত দেয়। সামনে ডোবার পানির দিকে ফ্যাল ফ্যাল চোখে চেয়ে থাকে। কিন্তু জোয়াল কাঁধে নিয়ে দু-কদমের বেশি এগোতে পারে না। মজিদ মিয়া বুঝতে পেরে জগের অবশিষ্ট পানি গরুর মুখ ফাঁক করে ঢেলে দেয়। সেই পানিতে ওদের গলা ভিজে মাত্র, কিন্তু তৃষ্ণা মেটে না।  চৈত্রের তাপে মাটি শুকিয়ে পাথর যেন! লাঙ্গলের তীক্ষ্ণ ফলা নরম মাটির তল খুঁজতে ভারি বেগ পেতে হয়। গরু নিজের কাঁধের ক্ষুদ্র জোয়ালকে পাহাড়সম ওজন মনে করে। লাঙ্গলের গুটি ঠেসে ধরতে ধরতে মজিদের কব্জি ব্যথা হয়ে আসে। তখন রাজ্যের রাগ ঢালে গরুর ওপর। ওদের আরও জোরে হাঁটার জন্য লেজে মোচড় দেয়। কঞ্চি দিয়ে আঘাত করে। মজিদ লক্ষ্য করে হালচাষের সময় বুড়ো গরুটা মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে যায়। কখনো ধপাস শুয়ে পড়ে। চোখ বেয়ে জল ঝরে। সঙ্গীর সাথে মুখ ঘষে কথা বলে। এদিকে বেলা মাথার উপর থেকে হেলে পড়ে। এসব তামাশা দেখার সময় মজিদের নেই। দিন শেষে ওদের কাছ থেকে কড়ায়-গণ্ডায় কাজের হিসেব মিলিয়ে নেয়াটাই তার কাজ। 

আশার ঘুড়ি

আশার ঘুড়ি

গাজা শহরের সরু গলি। সেখানে অনুচ্চ ভবনগুলোর ছাদে সূর্যের সোনালি আলো লুটোপুটি খাচ্ছে। দূরে তাকালে সাগর। তাতে নীল পানি এসে যেন পা ধুয়ে দিচ্ছে গাজার। বাইরে সরু গলিতে ছোট ছোট বাচ্চারা খেলা করছে। কোথাও একটু ফাঁকা জায়গায় তারা আনন্দে মেতে আছে। এরই মাঝে একটি ভবনের ছাদে ইউসুফ নামের একটি বালক দাঁড়িয়ে আছে। ঘরেই সে বানিয়ে নিয়েছে একটি ঘুড়ি। তা হাতে ধরা ইউসুফ। তার বয়স নয় বছর। তীক্ষè চোখ তার। মাথায় কোঁকড়ানো চুল। দোকানে পিতাকে কাজে সাহায্য করায় রুক্ষ হয়ে আছে হাত। ইউসুফ পুরনো প্লাস্টিকের ব্যাগ আর খবরের কাগজ দিয়ে বানিয়েছে তার ঘুড়ি। এর রং লাল, সবুজ, কালো আর সাদা। এই রং ফিলিস্তিনের। তাই এই ঘুড়িটি ইউসুফের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। স্কুল শেষে এবং কাজ শেষে প্রতিদিন ভবনের ছাদে ওঠে ইউসুফ। সেখানে দাঁড়িয়ে চারদিক তাকায়। দূরে ধুলোয় ঢাকা জায়গাগুলোতে ফুটবল খেলছে বাচ্চারা। কোথাও উড়ছে ফিলিস্তিনের পতাকা। আরও দূরে নীল সমুদ্র। বিশাল সেই সমুদ্রের বুক। কংক্রিটের ফাটল ধরা ছাদে পা ঠোকাঠুকি করে ইউসুফ। ঘুড়ি বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে দৌড় দেয়। নিচে উঠোন থেকে তার দাদু মায়াভরা কণ্ঠে বলে ওঠেন- আরও উপরে, হাবিবি। আরও উপরে। ঘুড়িটা আকাশকে ছুঁয়ে যাক! আকাশকে ইউসুফ খুব ভালোবাসে। তার কাছে একমাত্র মুক্ত, স্বাধীন জায়গা হলো ফিলিস্তিন আর ওই দূরের আকাশ। তাই ঘুড়ি হয়ে আকাশের খুব কাছে চলে যেতে চায় সে।   একটি সংকীর্ণ, ভাঙাচোরা এপার্টমেন্টে পিতামাতা, দুই বোন এবং দাদার সঙ্গে বসবাস করে ইউসুফ। প্রায়ই তার দাদা নানা গল্প করেন সবাইকে নিয়ে। অনেক আগে তাদের বড় বড় বাগান ছিল। জলপাই চাষ করতেন। গ্রামের পর গ্রাম ছিল। সবার মধ্যে ভালোবাসা ছিল। একের কষ্টে অন্যে এগিয়ে আসতেন। এখনো আসেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। যেকোনো মুহূর্তে ঠুনকো অজুহাতে গাজার ওপর বোমা হামলা চালানো হয়। তাতে নিহত হন নিরীহ মানুষ। ঘরবাড়ি, দালানকোঠা সব মাটিতে মিশে গেছে। চারদিকে শুধু হাহাকার। দাদুর এ গল্প শুনে চোখ ভিজে ওঠে সবার। এখন ইচ্ছে হলেই তাদের বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেয়া হয়। পানি থাকে না। ওষুধ থাকে না। খাবার থাকে না। মানুষের অতি দরকারি জিনিসের সরবরাহ নেই। চোখের সামনে কত মানুষ মারা যাচ্ছেন। এই যে হতাশা, এর পরেও ইউসুফ স্বপ্ন দেখে। তার স্বপ্নকে তো কেউ কেড়ে নিতে পারে না। তার স্বপ্ন ছিল ঘুড়ি নিয়ে। স্বপ্ন ছিল রকেট নিয়ে। এই রকেট দিয়ে কোনো হামলা নয়, মানুষ হত্যা নয়। সে স্বপ্ন দেখে রকেট নিয়ে চাঁদের দেশে পাড়ি দেবে। দেশ, জাতি ও মানুষের জন্য বিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করবে। ইউসুফ একজন ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়। এমন জিনিস বানাতে চায়, যা তার ঘুড়ির মতো ওড়ে। এমন জিনিস বানাতে চায়, যা সব কাঁটাতারের বেড়াকে অতিক্রম করবে। সব সীমান্তকে অতিক্রম করবে। উড়বে বিশ্বময়। কিন্তু গাজায় বসে এই স্বপ্ন দেখা ছিল অনেকটা অলিক কল্পনা। একদিন সকালে ইউসুফ তার স্কুলব্যাগ গোছাচ্ছে। ঠিক এ সময় মৃদু একটি গর্জনে দেয়াল কেঁপে ওঠে। ইউসুফ নিথর হয়ে পড়ে গেল। তার বোনেরা থরথর করে কাঁপতে লাগলো। বাইরে তখন সাইরেনের শব্দ। তার মা জোর গলায় চিৎকার করে বললেন- ঘরের ভিতর থাকো। জানালা থেকে একটু দূরে করিডোরে জড়ো হলো সবাই। ঠিক তখনই আকাশে যুদ্ধবিমানের শব্দ। তারপর আরেকটা শব্দ। আরেকটা শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে মাটি কেঁপে উঠলো। ইউসুফদের ছাদ থেকে উড়ে পড়তে লাগলো ধুলো। এভাবে কেটে গেল কিছু সময়। আসলে এই কয়েকটি মিনিটকে তাদের কাছে মনে হচ্ছিল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। চারদিকে নিস্তব্ধতা ফিরে এলো। পরের দিন তারা জানতে পারলো বাজারের সড়কটিতে বোমা হামলা চালানো হয়েছে। আবারও ইউসুফের স্কুল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ওই সপ্তাহে আর ঘুড়ি উড়াতে পারলো না ইউসুফ। ড্রোনে ভরে গেল আকাশ। পোকামাকড়ের মতো ড্রোনের গুঞ্জন শোনা যেতে লাগলো। প্রতিবেশী একটি বাড়ি মোমের মতো ধসে পড়ল। বাতাসে তখন ধোঁয়া। সবার মনে ভয় আর আতঙ্ক। সেই ধ্বংসস্তূপ সরাতে অক্লান্ত পরিশ্রম করলেন ইউসুফের পিতা। পাশাপাশি মসজিদ থেকে মানুষের মাঝে খাবার পৌঁছে দিতে লাগলেন। সেই কাজে সাহায্যের হাত বাড়াল ইউসুফও। স্বেচ্ছাসেবীদের কাছে পানির বোতল এগিয়ে দিতে লাগল সে। পুরানো কাপড় থেকে কাঁথা সেলাইতে মাকে সাহায্য করতে লাগলো। কখনো ঘুড়ি হাতে ছাদে উঠে যায়। যেন, সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছিল বাতাস। দূরে সমুদ্রের দিকে তাকালো ইউসুফ। ভাবতে লাগলো তার ঘুড়ি কি ওই ভারি মেঘের নিচ দিয়ে উড়ে যেতে পারবে? যদি কেউ এটাকে ভয়ানক কিছু মনে করে? তারা যদি মনে করে এই ঘুড়ির মাধ্যমে সে কোনো বার্তা পাঠাচ্ছে, তখন কী হবে। তবে তাকে ঘুড়ি ওড়াতেই হবে। হাতে ঘুড়ি ধরে দৌড় দিল। প্রথমে ঘুড়িটি কাঁপল। তারপর আস্তে আস্তে আকাশের ওপরে উঠে যেতে লাগল। আরও উপরে, আরও উপরে উঠে যেতে লাগল। সে ঘুড়ির সুতা ধরে টান দিল। তাতে সর্পিলভাবে, এদিক-ওদিক দুলে দুলে ঘুড়িটি উপরে উঠে যেতে লাগল। ইউসুফ কল্পনা করতে লাগল- ঘুড়িটি একটি মহাকাশযান। অজস্র তারার ভেতর দিয়ে তা ছুটে চলেছে। আর তা পরিচালনা করছে সে। এমন সময় কিছু একটা লক্ষ্য করলো সে। দেখলো আরেকটা ছাদ থেকে দ্বিতীয় আরেকটি ঘুড়ি বাতাসে নাচানাচি করছে। এর রং নীল আর সাদা। দেখতে পাখির মতো। বিস্ময়ে চোখ পিটপিট করলো ইউসুফ। যে ভবন থেকে ঘুড়িটি উড়ছে তা তো কয়েক সপ্তাহ ধরে ফাঁকা। সেখানে দাঁড়ানো একটি মেয়ে। দেখে মনে হয় তার বয়স ইউসুফের মতোই। তার পরনে ফ্যাকাশে সবুজ রঙের একটি পোশাক। বাতাসে উড়ছে তার স্কার্ফ। মেয়েটি তার ঘুড়ির সুতা ধরে আছে। ইউসুফকে দেখে হেসে দিল। জবাবে ইউসুফও হাসল। তারপর ঘুড়ির সুতা ধরে টান দিল। মাথা নিচু করে তাকে শুভেচ্ছা জানালো। একই কাজ করলো মেয়েটিও। এরপরই তাদের মধ্যে নীরব ভাষা বিনিময় হয়। তারা ঘুড়িতে লুপ সৃষ্টি করে। ডাইভ দেয়। দৌড়ায়। তাদের মধ্যে কোনো কথা হয়নি। শুধু অঙ্গভঙ্গি আর হাসি বাতাসে মিলিয়ে গেল। সেই হাসির রেণু যেন গাজার প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে দিল মৃদু বাতাস। এরপর প্রতিদিন বিকেলে যতক্ষণ আকাশ পরিষ্কার থাকে এবং ড্রোনগুলো দূরে থাকে, ততক্ষণ তারা ঘুড়ি ওড়ায়। ইটের দেয়ালে নানারকম আঁকিবুকি করে মেয়েটি। চক দিয়ে তার পাশে একটি শব্দ লেখা ছিল। তা দেখে ইউসুফ বুঝতে পারে মেয়েটির নাম আমিরা। দেয়ালে একটি হৃদয় আর একটি ঘুড়ির পাশে আরবিতে নিজের নাম লিখেছিল আমিরা। পরের দিন জবাবে নিজের ঘুড়িতে নিজের নাম লিখে আমিরাকে ইউসুফ জানালো তার নাম ইউসুফ। মাঝে মাঝেই তারা পানির ট্যাংকে নানারকম বার্তা লিখে রাখে। কখনো কাগজের ক্রেন, রকেট এঁকে রাখে। কখনো কাগজে মোড়ানো ক্যান্ডি বারের ছবি।   ইউসুফ জানতে পারে খালা ও এক ছোট ভাইয়ের সঙ্গে থাকে আমিরা। দুই বছর আগে রাতের বেলা তাদের বাড়ি ঘেরাও দেয় শত্রুপক্ষ। সে অভিযানে তারা আমিরার পিতামাতাকে হত্যা করে। কখনো স্কুলে যেতে পারেনি আমিরা। তবে সে অনেক বই পড়ে। তার কাছে কয়েক ডজন বই আছে। তা পড়ে পড়ে নিজে পাইলট হওয়ার স্বপ্ন দেখে আমিরা। এ কথা জানার পর একদিন আমিরাকে চিঠি লেখে ইউসুফ। তাতে জানতে চায়- তুমি পাইলট হতে চাও? কিন্তু এখানে তো মেয়েরা বিমান চালায় না। ‘আমিই হবো প্রথম’, বলল আমিরা। ‘আমি পাইলট হয়ে তোমাকে আমার বিমানে চড়াবো।’ একদিন সকালে আবার আকাশে গর্জন শুরু হলো। জোর থেকে জোরে হতে লাগলো সে শব্দ। একটানা শব্দ। সেদিন আর কেউ ঘুড়ি উড়াতে যায়নি। এর পরের সপ্তাহে যুদ্ধ শুরু হয় সীমান্তের কাছে। আবার বোমাবৃষ্টি। আবার ভবনগুলোর জানালা ভেঙে যায়। ধসে পড়ে অনেক ভবন। মারা যায় ইউসুফ-আমিরা বা তার চেয়েও কম বয়সী অনেক শিশু। তিনদিন বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তারা। পরিস্থিতি একটু শান্ত হলে ছাদে ওঠে ইউসুফ। চারদিকের বাতাস কেমন যেন গুমোট মনে হয় তার কাছে। পাশের সেই ভবনে আমিরা নেই। তার নীল ঘুড়িটিও নেই। আমিরার জন্য প্রতিটি দিন অপেক্ষায় থাকে ইউসুফ। কিন্তু চারদিকে যেসব ছাদ দেখা যায়, সেখানে নেই আমিরা। সব ফাঁকা। তারপর এক সন্ধ্যায় আকাশ কমলা রং ধারণ করলো। ইউসুফ দেখতে পেল একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে একটি ছোট্ট শিশু। শিশুটি পিছনের দিকে তাকিয়ে তার ছোট্ট হাতে কিছু একটা ধরে আছে। তার দিকে চোখ টিপে তাকালো ইউসুফ। দেখলো সেটা ছিল কাগজে তৈরি একটি ক্রেন। সে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল। তার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। দরজাটি অর্ধেকটা ভাঙা। সে নেমে যাওয়ার সময় সিঁড়িতে মচমচ শব্দ হলো। ছাদের ওপরে ছোট্ট শিশুটি এককোণে কিছু একটা ইশরা করেছে। ভাঙা পানির ট্যাংকের পাশে কাপড়ে বাঁধা ছোট্ট একটি নোটবুক আর একটি ঘুড়ি। এসব আমিরার। নোটবুকটিতে বিভিন্ন জিনিস আঁকা- বিমান, পাখি, তারকা আর একটি গল্প। নির্ভেজাল ও পরিষ্কার আরবিতে লেখা- আমার নাম আমিরা। আমি উড়তে চাই। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা এতে তার স্বপ্ন, ভয় আর স্মৃতিকথা লেখা। ইউসুফকে নিয়েও লিখেছে- ইউসুফ এত ভালো ঘুড়ি উড়ায়। অন্য কেউ তার মতো ঘুড়ি ওড়াতে পারে না। এমনিতে আকাশ থাকে নিঃসঙ্গ, একা। কিন্তু ইউসুফ যখন ঘুড়ি ওড়ায় আকাশ তখন আর একা থাকে না। আকাশের সঙ্গী হয়ে ওঠে তার ঘুড়ি। শেষ পৃষ্ঠায় আমিরা লিখেছে- যদি আমি চলে যাই, কথা দাও তুমি আমাদের দুটো ঘুড়িই উড়াবে। কথা দাও তুমি মনে রাখবে আকাশটাও আমাদের।

ফুজান

ফুজান

যেই ভুল করে গন্ধম ফল খেয়ে আদম আর হাওয়া পৃথিবীতে পদচিহ্ন রেখেছিল, সেই চিহ্ন ধরেই ফুজান হেঁটে চলছে, আমরাও চলছি। ফুজান আমাদের কোথায় নেবে জানি না। তবু তাকে অনুসরণ করছি। ফুজানের পিছু চলার মজাই এটা। সবকিছুতে একটা রহস্য রহস্য ভাব থাকে। অনেকক্ষণ ধরে হাঁটছি। আমাদের ফেলে অনেকটা এগিয়ে গেছে ঐ যে ঐ দীর্ঘদেহী নারী, তাকে আমরা ফুজান বলে ডাকি। ছোটবেলায় ফুপু ডাক বের হওয়ার আগে ফু করে হাওয়া ছাড়তে হতো অনেকটা, ফুপুর ‘ফু’ জোরালো হয়ে ওঠে ‘পু’ টা হাওয়া হয়ে যেতো। আর তাই ফুপুজান ডাকটা হয়ে যেতো ফুজান। এখন ফোকলা দাঁত নেই কারও, তবু ফুজান ডেকে আমরা প্রাণে আরাম পাই। ফুজান শুধু আমার বা ওর একার ফুজান না, হলাইজানা গ্রামের চুমকি, ছিমকি, বুলবুলি, বীনা, লিপি, সাজ্জাদ, ফারুক, কাদের, শফি সবার ফুজান। আমাদের ফুজানের নাম হাওয়া বিবি। আমাদের কারও বাড়ির কোনো মুরুব্বিই চায় না আমরা ফুজানের সঙ্গে কথা বলি বা ফুজানের পিছু পিছু ঘুরি। কিন্তু ফুজান আমাদেরকে টানে। তার কথা, স্পর্শ, হাসি সবকিছু আমাদের সবাইকে একেবারে টেনে ধরে রাখে। তাই যে যতই না করুক না কেন, আমরা কখনো ফুজানের পিছু ছাড়ি না। সবচেয়ে রহস্যময় ফুজানের হাসি। হাসলে তার পান খাওয়া দাঁতের সারির প্রায় সবই দেখা যায়, আবার কী যেন কী একটা দেখা যায় না। পিছু ফিরে ঠিক তেমনি করে হেসে ঠোঁটের ফাঁকে বিড়ি গোঁজে ফুজান। পেশাদারিত্বের সঙ্গে ধোঁয়া ছেড়ে মানুষটা সামনে এগোয়। আমরাও এগোই। সামনে দীপ রাজার দীঘি। দীঘির আধ খাওয়া নামের মতো দীঘিরও একই অবস্থা। সন্দ্বীপ রাজার নাম কালে কালে দীপ রাজা হয়ে গেছে আর দীঘি হয়ে গেছে পুকুর। রাজা রাজ্য ছেড়ে ওপারে চলে যাওয়ার পর দীঘিটা খতিয়ানে সরকারি খাস সম্পত্তি হিসেবে রেকর্ড হয়েছে। অনেক বছর হলো প্রামাণিকরা দীপ দীঘি লিজ নিয়েছে। বছর বছর মাছ ছাড়া হচ্ছে দীঘিতে। এই বছর বিষ দিয়ে কারা যেন দীঘির মাছ মেরে ফেলেছে। আমরা দেখেছি বড় বড় রুই, কাতলা, তেলাপিয়া ভেসে উঠেছিল। ছেলেপেলেরা টানাটানি করছিল মাছ নেওয়ার জন্য, প্রশাসনের লোকেরা কাউকে একটা মাছে হাত লাগাতে দেয়নি। ওদের কথামতো কামলারা জাল টেনে মাছ তুলে মাটিতে গর্ত করে পুঁতে ফেলেছে। পরে অজ্ঞাতনামা আট দশজনের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে ছোট প্রামাণিক। মামলার তদন্ত চলছে, কারও নাম এখনো সামনে আসেনি, কেউ ধরাও পড়েনি। ছোট প্রামাণিকের নিজের নামেও একই ধরনের মামলা আছে। গত আষাঢ়ে হিন্দুপাড়ার রিপন সাধুর আম বাগানের দুশ’ চারা এক রাতের মধ্যে কেটে নিয়েছিল কারা যেন। রিপন সাধু পরের দিন থানায় ছোট প্রামাণিকের নামে এজাহার দিতে গিয়েছিল। থানা মামলা নেয়নি। পরে আদালতে গিয়ে মামলা করে রিপন সাধু নালিশে লিখেছে, ঐ আম বাগানের সীমানা নিয়ে গণ্ডগোল বাঁধায় দেওয়ানী আদালতে মামলা করেছিল রিপন সাধু তাই ক্ষিপ্ত হয়ে রাতের আঁধারে ছোট প্রামাণিক গাছগুলো কেটে ফেলেছে। এরপর আদালতে আত্মসমর্পণ করে অনেক টাকা খরচ করে বড় উকিল ধরে জামিন নিয়েছে ছোট প্রামাণিক। এসব নিয়ে হলাইজানা গ্রামে অশান্তির শেষ নেই। শত অশান্তির মাঝেও দীপ রাজার দীঘির পাড়ে এসে দাঁড়ালে শান্তি শান্তি লাগে। ফুজান দীঘির ঘাটলায় নেমে পানি ছুঁয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা এতক্ষণ খেয়াল করিনি ফুজান কুলি করে মুখ ধুয়ে নিচ্ছে। এরপর আঁচলের খুঁট থেকে একটা পান তুলে মুখেও দিয়েছে। বুঝি বিড়ির গন্ধ দূর করতে চায় ফুজান। আরও বুঝতে পারি, ফুজান কোথায় যাবে। ফুজান প্রামাণিক পাড়ার দক্ষিণমুড়া কবরস্থানের দিকে যাচ্ছে। এখানে আগেও এসেছি আমরা। ফুজানের পিছু পিছু। অবশ্য কবরস্থানের ভাঙাচোরা গেটের সামনেই থামতে হয়েছে। নারীদের এই কবরস্থানে ঢুকতে দেওয়া হয় না। কমিটির অনুমোদন নেই। ফুজান অবশ্য না শোনার মানুষ না। তবু এই নিষেধাজ্ঞা ফুজান শোনে। কারণ যার কবরের জন্য এখানে ফুজান আসে তার কবরটা কবরস্থানের একেবারে পশ্চিম সীমানা ঘেঁষা। আর সীমানার বাঁশের বেষ্টনীও আধভাঙা। চাইলেই কবরের কাছাকাছি দাঁড়ানো যায়। এই কবরে কোনো ফলক নেই। শুধু নজর আন্দাজেই আমরা বুঝে নেই ঐখানে ফুজানের মায়ের কবর। হাত বাড়ালেই কবর সংলগ্ন সফেদা গাছটা ছোঁয়া যায়। গাছটা ছুঁয়েই আমাদের শরীর শিরশির করে। ফুজানেরও হয়তো একই হাল হয়। সে শব্দহীন কাঁদে খানিকক্ষণ। আমরা তাকে থামানোর চেষ্টা করি না। ফুজান তার মায়ের জন্য কাঁদবে, আমরা থামানোর কে? তবু ফুজান থামে। আমাদের হাত ধরে বলে, ‘চল যাই।’ ‘কই যাইবা?’ ‘রাজার দীঘিত।’ ‘ক্যান? আবার বিড়ি খাইছো নি?’ আমাদের কথার ঠেসে ফুজান শব্দ করে হাসে। পুকুরের পানি টলমল টলমল ঝলমল ঝলমল করে। থেকে থেকে বুড়বুড়ি ওঠে পানিতে। একটা, দুটা মাছ এখনো আছে নাকি! মাথা উঁচু করে দেখার চেষ্টা করি। একটা মাছও সাঁতার কাটে না। মনে আফসোস জাগে। ‘প্রামাণিকগো ছাড়া মাছগুলারে কোনো শয়তানরা যে বিষ খাওয়ায় মারলো!’ ‘মারছে ভালা করছে।’ ফুজানের উত্তরটা এত অপ্রত্যাশিত ছিল যে আমরা ঘাটলার ধারে এসে হোঁচট খাই। ফুজান আমাদের হাত ধরে টান দিয়ে দাঁড়ায়। ‘ঐ মাছ আমি মাগনা দিলেও খাই না। রাজাকারগো পাইলাপুইষা বড় করা মাছ, আমার ঘিন্না লাগে।’ ফুজানের মুখচোখ বিকৃত হয়ে ওঠে। তরতর করে ঘাটলার সিঁড়ি ধরে নামে ফুজান। ফের অনেকটা সময় নিয়ে কুলি করে, মুখ ধোয়। আমরা সমস্বরে জানতে চাই, ‘ও ফুজান, পানিতে ঘিন্না লাগে না?’ ‘দুরো যা, এই দীঘি রাজার দীঘি, পানিও রাজার। এই দীঘির পানি মিঠা, খাইয়া দ্যাখ। আমার মা কইছে, রাজা রাজ্যের পাইক পেয়াদা দিয়া মনকে মন গুড়, চিনি ঢালছে এই পানিতে।’ আমরা ফুজানের আজগুবি গল্প শুনে হাসি। তারপর সুরেলা কণ্ঠে জানতে চাই, ‘তোমার মায়ের নামটা কী গো ফুজান?’ ফুজান হেসে উঠে বলে, ‘আমার মায়ের নামটি মা লো আমার মায়ের নামটি মা।’ আমরা এবার দুলে দুলে হাসি আর ফুজানের ঢঙে আবৃত্তি করি, ‘আমার মায়ের নামটি মা, তাহার নেই কো তুলনা।’ ॥ দুই ॥ ফুজানকে ঘরে দেখছি না। কোথায় গেল সকাল সকাল? ঘরে তো নেই। ঘরটা কেমন যেন, নিঃসঙ্গ, রূঢ়, দমবন্ধ করা। এই  ঘরে চার দেওয়ালই আছে শুধু আর কিছু নেই, ফুজানের মা বেঁচে থাকতেও আসতাম এখানে। মা-মেয়ের সংসারও নিস্তরঙ্গ ছিল। ওদের দুজনকে একঘরে বলা যেত না তবু কেমন যেন সতর্কতা ছিল সবার। এই ঘরে দাবি-দাওয়া নিয়ে হুট করে কেউ ঢুকতো না, এখনো ঢোকে না। আমরা ফুজানের ঘর দেখি। দেখি ফুজানের একটা ছোট ঘর আছে, বর নেই। শুনেছি অনেক অনেক বছর আগে ফুজানের একবার গায়ে হলুদ হয়েছিল। কাঁচা হলুদ আর মেহেদি পাতা বেটে হাওয়া বিবির মা হাওয়া বিবির গায়ে হলুদের আয়োজন (এরপর ১১ পৃষ্ঠায়)  করেছিল। ঐ আয়োজনে তেমন কোনো অতিথি আসেনি। তবু মা- মেয়ের হাসিতে ঝলমল করে উঠেছিল এই ঘরদোর। পরের দিন শুক্রবার বরযাত্রী আসার শুভদিন ছিল। কিন্তু হাওয়া বিবির শরীরে হলুদ ছুঁইয়ে গোসল করানোর আগে অশুভ সংবাদটা এসেছিল। বরপক্ষ বিয়ে ভেঙে দিয়েছিল। এরপর হাওয়া বিবির মা মেয়েকে বিয়ে দিতে কতজনের কাছে যে গেছে। পাত্র পায়নি। একবার এক সত্তর বছরের বুড়ো হাওয়া বিবিকে দ্বিতীয় বিবি করতে রাজি হয়েছিল, হাওয়া বিবি রাজি হয়নি। মায়ের সঙ্গে কাজিয়া-ফ্যাসাদ করে সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যাবে কোথায়? বাপ মরা মেয়ের তো মা-ই সব। ঐ মেয়ের বাপই বা কে? ঐ প্রশ্ন তুললে হাওয়া বিবির মা ঝিম ধরে থাকতো বহুক্ষণ। হাওয়া বিবিও ঝিম ধরে থাকে। ঝিম ধরা ফুজানকে আমরা খুঁজে পাই দীপ রাজার দীঘির ধারে। ফুজান মানুষটাই এমন। দীঘলে পাথালে মানুষটা যেমন আসমান ছুঁই ছুঁই তার মেজাজ-মর্জিও তেমন আসমানের মতো থৈহীন। যখন যা মন চায় করে, যেখানে মন চায় যায়। কোনো শিকল নেই পায়ে। এমন একটা শিকলহীন জীবনের জন্য কত তড়পাই আমরা আর ফুজান তড়পায় নিজের স্বাধীনতার বাড়াবাড়ির জন্য। পান খাওয়া দাঁতের হাসি দেখলে বোঝার উপায় নেই ঐ স্বাধীনতাই ফুজানের পায়ের বেড়ি। একা ঘরে স্বাধীন থেকে থেকে ফুজান যখন হাঁপিয়ে ওঠে তখনই সে এমন করে ঘর ছাড়া হয়। ঘর ছেড়ে দীপ রাজার দীঘির ঘাটলা ছাড়া আর যাবে কোথায়? দীঘিটা প্রামাণিকদের ভিটা থেকে অনেকটা দূরে। একসময় এই দীঘি হলাইজানার সব মানুষের ছিল। ছোট প্রামাণিক লিজ নেওয়ার পর থেকে মালিকানা বদল হয়েছে। দীঘির মাছ মরে যাওয়ার পর পাহারাও জোরদার হয়েছে। পাড় থেকে গজ শ’ দূরে একটা টঙঘরে দুজন দশাসই পাহারাদার থাকে, আশপাশে কাউকে দেখলে লাঠি হাতে তেড়ে আসে। আজ আমাদের দেখে ওরা উসখুস করছিল। তখনই বুঝেছি ফুজান এখানে আছে। ফুজানকে দেখলে পাহারাদাররা চুপসে যায়। একদিন ফুজানকে ঘাটলায় নামতে দেবে না বলে ওরা লাঠি হাতে তেড়ে এসেছিল। ফুজান সপাটে বুক চাপড়ে ‘আয় দেখি আমারে সরা’ বলতে বলতে ঘাটলায় শুয়ে পড়েছিল। আজও ফুজান শুয়ে আছে। আমরা কাছে এগিয়ে দেখি ফুজানের বয়সী চোখ দুটি ভেজা। কানের দুপাশে পানি গড়ানোর চিহ্ন লেগে আছে। মুখটিতেও যন্ত্রণার ছাপ। ফুজানের পাশে বসে চমকে উঠি। তার শরীরের দুপাশে ছড়ানো হাত দুটির আঙুলগুলো রক্তাক্ত, আঙুলের ভাঁজে ভাঁজে কাচা ক্ষত। এমন ক্ষত ফুজানের হাতে আগেও দেখেছি। কী হয়েছে জানতে চাইলে ফুজান উত্তর না দিয়ে রহস্যময় হেসেছে। মাকে, বাবাকে প্রশ্ন করলে ধমক শুনেছি, শুনেছি, যুদ্ধের কালে নষ্ট হয়েছে ফুজানের মা, ফুজানের জন্মেরও ঠিক নেই। অমন বেজন্মা মেয়েমানুষের সঙ্গে না মেশাই ভালো। আমরা তবু ফুজানের সঙ্গে মিশি, মিশে মিশে ঢল বৃষ্টিতে ভেজা মাটি-কাদার মতো মাখামাখি হয়ে যাই। ফুজানের রক্তমাখা হাতে শান্ত চুমু খেতে খেতে জানতে চাই, ‘ফুজান তোমার কী হইছে?’ সত্যি সত্যি আজ কী যেন হয়েছে ফুজানের। ফুজান বিড়বিড় করছে। নিজেকে ভাঙছে। কাঁপছে। কাঁদছে। থই পাচ্ছি না কোনো। মনে হচ্ছে কেউ আমাদের দীপ রাজার দীঘির কেন্দ্রে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আমাদের পায়ের নিচে জল কিছু নেই। ও জলও দাপুটে, থির হতে দিচ্ছে না। ছলবল ছলবল করে অতলে টেনে নিতে চাইছে। ফুজানই আমাদের টেনে তোলে। নরম স্বরে শোনায় ফুজানের মায়ের কিসসা। যেই কিসসার সঙ্গে জলেরই মিতালি। ‘পাকিস্তানি মিলিটারিরা, রাজাকারের বাচ্চারা আমার মায়ের হাত পা বাইন্ধা এই দীঘিত ফালায় রাখতো। মায়ের আঙুলের চিপায় চিপায় ইটের টুকরা রাইখা চাপ মারতো, বেয়োনেট দিয়া সমানে খোঁচাইতো। আহারে...শইলের বেদনায় আমার মায় চিক্কুর পাইড়া কত কানছে! কোনো জালিম আমার মায়ের কান্না শোনে নাই...মা, ও মা রে...আমারে একলা ফালায়ে কই গেলি মা...’ উদলা আকাশের নিচে হাওয়া কাঁপে থরোথরো। হাওয়া বিবিও কাঁপে। কাঁপতে কাঁপতে উঠে বসে আমাদের এক ঝলক দেখে নেয়। তারপর দীঘির দিকে মুখ করে বসে। ‘বড় প্রামাণিক ছিল শান্তি কমিটির মেম্বার। আমার মারে ওই বড় প্রামাণিকই টাইনা ক্যাম্পে তুলছিল। একমাস বিশ দিন ছিল মা ক্যাম্পে। আমি তখন আছিলাম আসমানের ম্যাঘ। মা কানলেই ম্যাঘ থেইকা পানি হইয়া টুপুরটুপুর পড়তাম।’ আসমানে সাদাকালো মেঘ ভাসে। আমাদের চোখে ভাসে দীপ দীঘির জল। আমাদের মনে পড়ে যায়, এখনও অনেকেই ফুজানকে দেখে খিকখিক করে হাসে আর বলে, ‘এ্যাই দ্যাখ দ্যাখ ওর বাপ না মিলিটারি, দ্যাখোস না কেমন শরীর স্বাস্থ্য। বাঙালির বীজে জন্ম না।’ আমরা ফুজানের হাতের আঙুলে হাত বুলাই। স্পর্শে স্পর্শে বেদনার ঢল নামে। ফুজান গুমরে ওঠে। আমরা ক্ষীণ স্বরে বলি, ‘একটু ধোঁয়া খাইবা ফুজান?’ ফুজান হাসে। এই হাসি দীপ রাজার দীঘির জলের মতো সবুজ। আমরা ফের হেঁয়ালিভরে জানতে চাই, ‘তোমার মায়ের নাম কী গো ফুজান?’ ফুজান হেসে উঠে বলে, ‘আমার মায়ের নামটি মা লো আমার মায়ের নামটি মা।’ আমরা এবার দুলে দুলে হাসি আর ফুজানের ঢঙে আবৃত্তি করি, ‘আমার মায়ের নামটি মা, তাহার নেই কো তুলনা।’

চর্যাপদে বাংলার সমাজচিত্র

চর্যাপদে বাংলার সমাজচিত্র

চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। এই পদসমূহ বাংলাসাহিত্যের মূল্যবান আধ্যাত্মিক সংগীত সমষ্টি। এগুলোর সঠিক বয়স আজ পর্যন্ত নিরুপন করা সম্ভব না হলেও এসব যে বাংলা সাহিত্যের আদি সম্পদ, একথা সকল ভাষা পণ্ডিতরাই স্বীকার করেছেন। ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে মহামহোপাধ্যায় শ্রী হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবারের পুথিশালা থেকে এর মূল পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করেন। পাণ্ডুলিপিতে এর নাম ছিল ‘চর্যাচর্য বিনিশ্চয়’। কিন্তু শাস্ত্রী মহাশয় গ্রন্থটির নাম দেন ‘হাজার বছরের পুরান বাংলাভাষার বৌদ্ধ গান ও দোহা’। বলাবাহুল্য, এই সংগীতগুলো বৌদ্ধ আধ্যাত্মিক ভাবাপন্ন বিধায় শাস্ত্রী মহাশয গ্রন্থখানির অনুরূপ নামকরণ করেন। পরে ডক্টর প্রমোদচন্দ্র বাগচী চর্যাপদের অনুবাদের যে সংকলনটি নেপাল থেকে সংগ্রহ করেন, তাতে মোট ৫১টি সম্পূর্ণ পদ ছিল। এরপর আর নতুন কোনো সন্ধান পাওয়া না যাওয়ায় চর্যাপদের মোট সংখ্যা এটাই বলে পণ্ডিতরা ধরে নিয়েছিলেন। অবশ্য অনেক পরে ডক্টর শশীভূষণ দাসগুপ্ত, ডক্টর আর্নল্ড বাকে প্রমুখ পণ্ডিতবর্গ আরও কিছু চর্যাপদের সন্ধান পেলেও ভাব এবং ভাষার দিক দিয়ে সেগুলো পূর্ব সংগৃহীত সমূহের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়ায় সেগুলোকে খাঁটি চর্যাপদ বলে মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি; বরং ওগুলো চর্যাপদের অনুসৃষ্ট বলে বিশ^াস করা হয়েছে। চর্যাপদগুলো কাব্যাকারে রচিত। এগুলোর রচয়িতা হিসেবে যাঁদের নাম পাওয়া গেছে তাঁদের মধ্যে ভুসুকুপাদ, কাহ্নপাদ, সরহ পাদ, কলম্বপাদ, চাটিলপাদ, শান্তিপাদ, লুইপাদ, শবরপাদ, গুন্ডরীপাদ, মহীধরপাদ, বীনাপাদ, আর্যদেবপাদ, ঢেন্ডনপাদ. দারিকপাদ, আড়কপাদ, ধামপাদ, তান্তীপাদ, কক্কুরীপাদ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। পদের রচয়িতা বলে এঁদের নামের সঙ্গে ‘পাদ’ শব্দটি যুক্ত হয়েছে। আগেই বলা হয়েছে, চর্যাপদগুলো বৌদ্ধদের অধ্যাত্ম সংগীত সমষ্টি। এ সব সংগীত ইহকালের সমস্যা সংকুল জীবনযাত্রা এবং তা থেকে নির্বানলাভ পূর্বক মহাপ্রভুর সঙ্গে মিলনের আকাক্সক্ষা এবং তার উপায় বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু উল্লেখ্য যে, তা সরাসরিভাবে বর্ণনা না করে বিভিন্ন রূপকের মাধ্যমেই বলা হয়েছে। আর এই রূপক সমূহের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে তৎকালীন বাংলাদেশের এক নিখুঁত প্রতিচ্ছবি। চর্যাপদে তৎকালীন বাঙালিদের যাতায়াতের জন্য প্রধান বাহন হিসেবে নৌকার ব্যবহার ছিল। বহুসংখ্যক পদে নৌকার নামোল্লেখ এবং এর ব্যবহারিকতার বর্ণনা রয়েছে। অনেক সময় দূরের যাত্রাপথে উজানগুণ টেনে নিয়ে নৌকা চালানো হতো। সে সময় নৌপথে দস্যুর ভয় ছিল। এমন একটা বর্ণনা আছে নরহপাদের ৩৮ সংখ্যক পদেÑ ‘কাএ নাবড়ি খানটিমন কাড় আল। সদগুরু বঅনে ধর পতবাল ॥ চীঅ থির করি ধরহুরে নাঙ্গ। আল উপাএ পারদ জাই ॥ নৌবাহী নৌকা টানই গুণে। মেলি মিন সহজে জানই আনত ॥ বাটত ভএ খান্ট বি বলআ। ভব উলোলে সরবি বেড়িয়া ॥ ফুল লই ঘরএ সোন্ত উজাই সর ভনই গঅনে সমাই ॥’ অর্থাৎ কায়ারূপ নৌকাতে মনবৈঠা ও সদগুরু বচনরূপ হাল ধরো। চিত্ত স্থির করে হাল ধরো। অন্য উপায়ে পারে যাওয়া যাবে না। নৌবাহী গুণে নৌকা টানে। সহজে মিলে যাও, অন্যপথে যেও না। পথে ভয়। দস্যু বলবান। তবে সমুদ্রের উল্লাসে সবই বিনষ্ট। সরহ বরলন, কূল ধরে খরস্রোতে উজান বেয়ে চললে (নৌকা) গগণে প্রবেশ করে। সাধারণত ডোম্বীরা কিছু পয়সার বিনিময়ে পারাপার করত। আবার অনেক সময় বিনে পয়সাতেও। পয়সা হিসেবে কড়ি, বুড়ির উল্লেখ আছে। যেমনÑ ‘কবড়ী লেই, কবড়ী নলেই কুচ্ছেল পর করেই।’ (ডোম্বীপদ : ১৪ সংখ্যক) অর্থাৎ ডোম্বী কড়িবুড়ি না নিয়ে স্বেচ্ছায় নৌকা পার করে দেয়। চর্যার বিভিন্ন পদে নৌকার বিভিন্ন অংশ এবং সরঞ্জামের উল্লেখ আছে। যেমনÑ  কেড় আল-দাঁড়, পতবাল-হাল, পুলিন্দা-মাস্তুন, মাঞ্জ-লুই ইত্যাদি। অনেক ক্ষেত্রে পারাপারের মাধ্যম হিসেবে ভেলাও ব্যবহৃত হয়েছে। শান্তিপাদের ১৫ সংখ্যক পদে আছেÑ ‘মাআ মোহ সমুদারে অন্তন বুঝসি যাহ্ াআগে ন বন ভেলা দীসইÑ ভান্তি ন পুছসি নাহা ॥’ অর্থাৎ মায়ামোহ রূপ সমুদ্রের অন্ত বুঝে না, গভীরতা বুঝে না। সামনে নৌকা বা ভেলা কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ছোট নদী পারাপারের জন্য গাছ কেটে জোড়া দিয়ে সাঁকো তৈরি করা হতো। চাট্টিলাপাদের ৬ সংখ্যক পদে আছেÑ ‘ভবনই গহন গম্ভীরে বেগে বাহি। দু অন্তে চিখিল মাঝো থাহি ॥ ধামাথে চটি সবঙ্কম গঢ়ই । পারগামী লোঅ ভির তরই ॥ ফাড়ি মোহ তরু পাটি জোড়িঅ। অদঅ দিঢ়ি টাঙ্গি নিবানে কোড়িঅ ॥’ অর্থাৎ গহন ও গভীর ভবনদী বেগে বয়ে যাচ্ছে। এর দুধারে কাদা, মাঝখানে থই নেই। ধর্মসাধনার জন্য সাঁকো বানালেন (যাতে) পারগামী লোকেরা নির্ভয়ে পার হতে পারে। মহীতরু চিরে পাটি জোড়া দেওয়া হল। বর্তমানের মতো প্রাচীন বাঙালি সমাজেও অতি ধুমধামের সঙ্গে বিবাহকার্য সমাধা হতো। বর ঢাক-ঢোল, কাসি-ঘণ্টা ইত্যাদি বাজিয়ে বিয়ে করতে কনের বাড়িতে যেত। বিয়েতে যৌতুকপ্রথা ছিল। নববধূর বাসর যাপনের ব্যবস্থাও ছিল। কৃষ্ণপাদের ১৯ সংখ্যক পদে আমরা দেখিÑ ‘ভব নির্বানে পড়হ মাদলা। মন পবন বেনি করন্ড ফাসালো ॥ জয় জয় দুন্দহি সাছ উছলিআ। কাহ্ন ডোম্বি বিবাহে চলিলা ॥ ডোম্বি বিবাহিয়া আহারিউ জাম। জউতুকে কিঅ অনুত্তর ধাম ॥ অহনিশি ফুরআ প্রসঙ্গে জাইি। জেইনি জালে রঅনি পোহাই ॥ ডোয়ী এর সঙ্গে জো জোই রও। খনই দূরে ছাড়ই সহজ উন্মত্ত ॥’ অর্থাৎ ভব নির্মাণকে পটই ও মাদল, মন-পবনকে করন্ড ও ফাঁসি করা হল। দুন্দুভি শব্দে জয় জয় শব্দ উছলে উঠল। কাহ্নপাদ ডোম্বিকে বিয়ে করতে চললো। ডোম্বীকে বিয়ে করে জন্ম নাশ করল। যৌতুক হিসেবে পেল অনত্তর ধাম। দিনরাত সুরভ প্রসঙ্গে যায়। যোগিনী জালে রাত্রি পোহায়। ডোমীর সঙ্গে সঙ্গে যে যোগী অনুরক্ত, সে সহজও হয়ে ক্ষণমাত্রও ডোম্বীকে ছেড়ে যায় না। এপর স্বামীর সঙ্গে বধূ চলে আসতো স্বামীর বাড়িতে। শ^শুর-শাশুড়ি, ননদের সঙ্গে একই সংসারে সে ঘর করত। অসতী বধূর কথাও উল্লেখ আছে কুক্কুরিপাদের ২ সংখ্যক পদে+ ‘ছিবসহি বহড়ী কাউহি ডর ভাই। রাতি ভইলে কামরু ছাই ॥’ অর্থাৎ রাতে বধূ ঘরে ভয়ে ভীতা, রাতে সে কামরূপে যায়। এমন অসতী বধূকে কড়া শাসনে রাখার জন্য কড়া শাশুড়ির উল্লেখ আছে। মেয়েরা খোঁপা বাঁধত। নূপুর  (নেউর), মুক্তহার (মতিহার), কর্ণদুল (কানেরু) ইত্যাদি অলংকার ব্যবহার করত। শবরীপাদের ২৮ সংখ্যক পদে দেখা যায়, আধুনিককালের উপজাতিদের মতো প্রাচীনকালের অনেক বাঙালি নারীরা ময়ূরপুচ্ছ পরিধান করত। চর্যাপদ থেকে যতদূর জানা যায়, তাতে মনে হয় তখনকার বাঙালিদের প্রধান খাদ্য ছিল ভাত, মাছ এবং মাংস। তারমধ্যে হরিণের মাংসই ছিল প্রধান। অনেক চর্যাপদে গাভী-বলদের কথাও উল্লেখ আছে। গাভী দোহনের কথা আছে ঢেন্ডনপাদের ৩৬ সংখ্যক পদে। দুধ থেকে মাখন তোলার উল্লেখ আছে কাহ্নপাদের ৪২ সংখ্যক পদে। তাতে মনে হয় দুধ এবং মাখনও তারা খেত। মদ তাদের অত্যন্ত প্রিয় পানীয় ছিল। মদ্যপানের জন্য তারা শুড়িখানাতেও যেত। বিরুবাপাদের ৩ সংখ্যক পদে আছেÑ ‘এক সে শুন্ডিনি দুই ঘরে সান্ধই। চী অন বাকলও বনুনী বান্ধই ॥ সহজে থির থির করি বারুনী সান্ধ। জে আজরামের ছোই ছোই কান্ধ ॥ দশমি দুঅরেত চিহ্ন দেখিআ। আইল গরদেক আপনে বাই আ ॥ চউশঠী ঘড়িএ দেউ পসারা। পইবেন গরাহক নাহি নিসারা ॥ এক ঘড় লী সরুআ নালে। ভনন্তি, বিরুআ থির করি চালে ॥’ অর্থাৎ এক শুড়িনী দুই ঘরে প্রবেশ করে। চিকন থাকলে বারনী  (মদ) বাধে। সহজে স্থির করে বারনী চোলাই কর, যাতে তুমি অজয়-অমর এবং দৃঢ় হতে পার। দশম দুয়ারে চিহ্ন দেখে গ্রাহক নিজেই চলে এলো। চৌষট্টি ঘোড়ার পসরা (মদের) দেওয়া হল। গ্রাক ঢুকলো, তার আর নিষ্ক্রমণ নেই। একটি ছোট ঘড়া, সরু নল। বিরুবা বলছে, স্থিরভাবে চাল দাও। চর্যাপদে বিভিন্ন গৃহজীবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। এদের মধ্যে শিকারি মাঝি, নর্তকী, গায়ক, বেদে, কাপালিক, পসারি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ভুসুকুপাদের ৬ এবং ২৩ সংখ্যক হরিণ শিকারের উল্লেখ আছে। সাধারণত ডোম্বীরাই নৃত্য-গীতে বিশেষ পারদর্শী ছিল। তাদের এ পারদর্শিতার কথা ভুসুকুপাদের ১০ সংখ্যক পদেÑ ‘একসো পদমা ছৌষট্টি পাখড়ী। তা চড়ি নাচই ভোয়ী বাইড়ি।’ অর্থাৎ অর্থাৎ এক পদ্ম। তাতে চৌষট্টি পাপড়ি। তাতে চড়ে ভোয়া বেচারি নাচে। নাচ-গানের সঙ্গে অনেক বাদ্যযন্ত্রও বাজানে হতো। এগুলোর মধ্যে একতারা, বীণা, বাঁশী, ঘণ্টা, মাদল, গোপীযন্ত্র ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। অনেকে তুলাধুনার কাজ করত। জাতিভেদ প্রথা তখনও ছিল। সমাজে ডোয়ারীই ছিল সর্বনিম্ন জাতের। কিন্তু তারাই ছিল সর্বগুণে গুণান্বিত। নাচ-গান ছাড়াও তারা তাঁত বুনত, চাঙারি তৈরি করে বিক্রি করত এবং নৌকা চালাত। নিম্নশ্রেণিভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও এসব গুণের জন্য তারা উচ্চশ্রেণির কাপালিক ব্রাহ্মণদেরও কাম্য ছিল। কাহ্নপাদের ১০ সংখ্যক পদে আছেÑ ‘নগর বাহিরিরে ডোম্বী তোহেরি কুড়িআ। ছোই ছোই জাহসো বামহন নাড়িআ ॥ আলো ডোম্বী তো এ সম করিব মো সাঙ্গে। নিঘিন কাহ্ন কাপালি, জোই লাঙ্গে ॥’ অর্থাৎ নগরের বাহিরে ডোম্বী তোমার কুঁড়েঘর। তুমি নেড়া ব্রাহ্মণকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাও। ওগো ডোম্বী, আমি তোমাকে সঙ্গী করব। আমি নিঘৃণ, উলংগ লাগী কাহ্ন কাপালিক। এই ডোম্বীরা নিচুজাতের হওয়াতে এ ঘরের মধ্যে বসবাস করার অধিকার তাদের ছিল না। তাই তারা নগরের বাইরে যেয়ে কুঁড়েঘরে বাস করত। উপরোক্ত চর্যাপদটি এ তথ্য আমরা জানতে পারি। সমাজে চন্ডাল নামে আর একটি নিচু সম্প্রদায় ছিল। অপরদিকে সবরি নামে একটি উচ্চসম্প্রদায় বর্তমান পর্বতের ওপর মহাসুখে বসবাস করত। শবরপাদের ২৮ সংখ্যক পদে আমরা দেখিÑ ‘উষ্ণ উষ্ণ পাবত তহি বসই সবরি বালী। মোরঙ্গী পীচ্ছ পরিবহান সবরী গীবত গুঞ্জরী  মালী ॥ উমত সবরো পাগল সবরো মা কর গুলি গুহারী। তোহারী নিঅ ঘরিনী নামে সহজ সুন্দরী ॥ নানা তরুবর শৌললরে গঅনত লাগেলী ডালী। এ কেলী সবরী এ বনহিগুই কর্ণ কুন্তল বজ্রধারী ॥ তিআ ধাড খাঁট পড়িলা সবরো মহাকুহে সেজি ছাইলি। সবরো ভুজঙ্গ নইরা মনি দারী পেখরতি পোহাইনি ॥ হিঅ তাঁবোলা মহাকুহে কাপুর খাই। মুন নৈরামনি কণ্ঠে লইআ মহাকুহে রাত পোহাই ॥’ অর্থাৎ উঁচা উঁচা পর্বত, সেখানে সবরী বালিকা বাস করে। সে ময়ূরপুচ্ছ পনিধান করে। সবরীর গলায় গুঞ্জরীমালা। উন্নত সবর, পাগল সর্বর, গোলমাল করো না। তোমার নিজ গৃহিণী সহজ সুন্দরী। নানা তরু মুকুলিত হল। আকাশে লাগল ভালো। কণ্ঠ কুন্তল বজ্রধারী সবরী একা এই বনেবিহার করে। তিন ধাতুর খাটপালংক হল। সবর মহাসুখে শয্যা বিছাল। সবর ভুজঙ্গ নৈরামনি রমন প্রেমে রাত কেটে গেল। হৃদয় তাম্বলে মহাসুখে কর্পূর খায় এবং শূন্য নৈরামনিকে কণ্ঠে নিয়ে মহাসুখে রাত্রিযাপন করে। বলাবাহুল্য, জীবনযাত্রার এ চিত্রের সঙ্গে বর্তমান সমাজচিত্রের অনেকখানি মিল রয়েছে। বর্তমানকালের মতো তখনও ব্রাহ্মণরা পূজাঅর্চনার কাজে রত থাকত। তারা বেদ পাঠও ও হেসে প্রদান করত। কাপালিকেরা গলায় হাড়ের মালা, কানে কুন্তল এবং পায়ে মল পরিধান করে গায়ে ছাই মেখে উলংগ অবস্থায় থাকত। কাহ্নপাদের ৪০ সংখ্যক এবং ভুসুকুপাদের ২১ সংখ্যক পদ থেকে আমার জানতে পারি যে, প্রাচীন বাঙালি সমাজেও গুরু-শিষ্য প্রথা প্রচলিত ছিল। তৎকালীন সমাজে শবদাহের উল্লেখ আছে শবরপাদের ৫০ সংখ্যক পদে। চিত্তবিনোদনের জন্যনয়বল বা দাবা খেলার প্রচলন ছিল। কাহ্নপাদের ১২ সংখ্যক পদে এ খেলার বিবরণ নিম্নরূপÑ ‘করুণা পীঢ়িহি খেলছ নঅবল। সদুগুরু বোহে জিতেল ভববল।। ফটিউ দুআ আদেসিরে ঠাকুর। উআরি উএসে কাহ্ন নিঅড় জিনউর ॥ গহিলে তেলিআ বড়িআ মরাড়িউ। গঅবরে তোলিআ পাঞ্চজনা খেলিউ ॥ অবস করিআ ভববল জিত্তা ॥ ভনই কাহ্ন আমহে তলি দাহ দেহুঁ চৌষটঠী কোঠা গুণিয়া   লেহু’

শীর্ষ সংবাদ:

যেই সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবে তারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে: আমীর খসরু
জামায়াত নেতারা রাজাকার হলে পাকিস্তানে গাড়ি বাড়ি থাকতো : শামীম সাঈদী
এনসিপির সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পৃক্ততা নেই- উমামা ফাতেমা
‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে আটকদের অধিকাংশই ভারতীয় মুসলমান
ইয়েমেনে হামলা চালিয়েই সাগরে ডুবে গেল মার্কিন সর্বাধুনিক যুদ্ধবিমান
জামিন পেলেননা তারেক রহমানের খালাতো ভাই তুহিন
লন্ডনে আজ আর্সেনাল পিএসজি মহারণ
১৭ অভিনয়শিল্পীর নামে মামলা, তালিকায় আছেন নুসরাত ফারিয়া-অপু বিশ্বাস-ভাবনাসহ অনেকেই
১০০ টাকা মূল্যমানের প্রাইজবন্ডের ১১৯তম ড্র অনুষ্ঠিত হবে আগামীকাল
স্বর্ণের দাম, রেকর্ড উচ্চতা থেকে পতনের পথে
কুমিল্লায় পুলিশ-সেনাবাহিনীর চাকরির নামে প্রতারণা: দালালসহ ১৩ জন গ্রেফতার
১২ বছর বয়সী ছেলে শিক্ষার্থীকে বলাৎকারের অভিযোগে ৩ মাদ্রাসা শিক্ষক গ্রেফতার