ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৫ জুন ২০২৫, ১ আষাঢ় ১৪৩২

সাহিত্য

সাহিত্য বিভাগের সব খবর

তোমাদের জন্য ছড়ার বই

তোমাদের জন্য ছড়ার বই

শিশুতোষ ছড়া, কবিতা, গল্প ও উপন্যাস সবখানেই তার উজ্জ্বল উপস্থিতি। তার লেখায় রয়েছে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য। বর্তমান সময়ে যারা শিশুসাহিত্য নিয়ে কাজ করছেন শিশুসাহিত্যিক হাসনাইন আহমদ তাদেরই একজন। শিশু-কিশোরদের জন্য ভাল লেখার অদম্য আগ্রহ তার মধ্যে প্রবল। দীর্ঘ বাইশ-তেইশ বছরের অধিক সময় ধরে নীরবে-নিভৃতে সাহিত্যচর্চা করে যাচ্ছেন; বিশেষ করে শিশুসাহিত্য। তার লেখা বিভিন্ন মাসিক পত্র-পত্রিকা থেকে শুরু করে সাপ্তাহিক ও জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। ‘মেঘ পাখি ও প্রজাপতির ছড়া’ তার প্রথম শিশুতোষ ছড়ার বই। বইটিতে মোট বিশটি ছড়া স্থান পেয়েছে। আলোচ্য ‘মেঘ পাখি ও প্রজাতির ছড়া’ বইয়ের কয়েকটি ছড়ার কিছু অংশ পাঠকদের জন্য উল্লেখ করা হল। ‘গ্রীষ্মতে’ ছড়ায় গ্রাম আর শহরের বাস্তব চিত্র অসাধারণ নৈপুণ্যে ফুটিয়ে তুলেছেন ছড়াকার। যেমন, ‘কড়-কড় গ্রীষ্মতে নেড়ে যায় কড়া/ টক্ টক্ রস্ রস্ মিষ্টিতে ভরা/ আম জাম থোকা থোকা, টক্ টক্ লিচু/ লাফ মেরে খাও পেড়ে, গাছ দেখে নিচু/ শহরের ছেলেদের এই সুখ নেই/ ওরা শুধু বাজারের কেনা ফলেতেই।’ বইয়ের প্রথম ছড়া হল ‘ছুটি’। ছুটির আমেজ শিশু-কিশোদের মনে  কিভাবে ধরা দেয়। তার একটি চিত্র তুলে ধরেছেন। যেমন, ‘আজকে আমার ছুটি/ সেই খুশিতে আনন্দে মন হেসেই কুটিকুটি/চোখ বুজে ফের ভাবিÑ/ বাবার কাছে করব আজই/মুক্তি পাওয়ার দাবি/ ইটের পাঁজর ছেড়ে/ ডাকছে শুনি বুনোপাতা/দু’হাত নেড়ে নেড়ে।’ ছড়া নির্মাণে অবাক করা মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন ছড়াকার এই ছড়াটিতে। যা যে কোন বোদ্ধা পাঠককে বিমোহিত করবে। এছাড়াও শিশু-কিশোদের আনন্দ দেওয়ার জন্য বেশকিছু ছড়া এ বইটিতে স্থান পেয়েছে। যেমন, ‘দাদির কাছে শুনছি বসে/ পুরান দিনের গল্প/ এই জামানায় সবই নাকি/ সেই তুলনায় অল্প। (পুরান দিনের গল্প)। ছোটদের কল্পনার রাজ্য অনেক বড়। নিজের মত করে কল্পনা করতে ভালোবাসে। কল্পনায় কতকিছু না ভাবে তারা। বইয়ের ‘হতাম যদি’ শিরোনামের ছড়াটিতে যেমনটি রয়েছেÑ ‘রঙধনুরা রঙ ধরে যে/ কোথায় তাদের দেশ/ ইচ্ছে করে তাদের খোঁজে/ চলতে নিরুদ্দেশ/ কোথায় তাদের ঘরবসতি/ কোথায় রঙের চিন/ খুঁজে পেতাম সবই আমি/ হতাম যদি জিন।’ যারা ছড়া লেখে বা লেখার ইচ্ছে আছে, তারাও এই বইটি পড়লে উপকৃত হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। লেখায় নতুনত্ব, বৈচিত্র্য ও আধুনিকতা এসব সব ছড়ার বইতে থাকে না। ফলে নতুন লেখক বিভ্রান্ত হয়। ‘মেঘ পাখি ও প্রজাপতির ছড়া’ একটি আধুনিক ছড়ার বই। লেখক মেধাবি, পরিশ্রমী এবং প্রতিশ্রুতিশীল। যেমন, ‘নারকেলের ওই পাতার ফাঁকে/ চাঁদের নীরব হাসি/ পিয়াল বনে আছড়ে পড়ে/ জোছনা রাশি রাশি।  ছড়াশিল্পী হাসনাইন আহমদ তাল-লয়-ছন্দ এবং অন্ত্যমিলের চমৎকার মেলবন্ধনে নির্মাণ করেছেন অসাধারণ সব ছড়া। ছোট-বড় সবাই বইটি পড়ে মুগ্ধ হবে। প্রখ্যাত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘ছোটদের সময়’ এই বইটি প্রকাশ করেছে। প্রচ্ছদ এঁকেছেন রজত। আর প্রতিটি ছড়ার সাথে সঙ্গতি রেখে অসাধারণ অলংকরণ করেছেন পার্বতী ঘোষ। বই এবং লেখক সম্পর্কে লিখেছেন বিখ্যাত ছড়াকার ও শিশুসাহিত্যিক আমিরুল ইসলাম। বইটির প্রথম প্রকাশ, অমর একুশে বইমেলা ২০২২। মূল্য ২০০ টাকা। বইটির ব্যাপক প্রচার-প্রসার ও পাঠকপ্রিয়তা কামনা করি। সেই সাথে ছড়াকার হাসনাইন আহমদের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা।

হারিয়ে যাওয়া হরিণ

হারিয়ে যাওয়া হরিণ

কলেজ রোডের শেষ মাথায় একটা আধা-ভাঙা বাড়ি, নাম ‘শিউলি নীড়’। এই বাড়ির নিচতলায় থাকে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র নাহিয়ান, সবাই ডাকে ‘নাহি’ নামে। হালকা পাতলা গড়ন, বুদ্ধিতে ঝাঁঝালো মরিচ। বয়স তেরো হলেও কথাবার্তায় যেন বিশ বছরের পুরনো মেজাজ! নাহির সঙ্গী দু’জন। ইমরান আর শ্রেয়া। ইমরান একটাই শার্ট পরে তিনদিন স্কুলে গেলেও দুনিয়ার খবর জানে খবরের কাগজের থেকেও বেশি। শ্রেয়ার কথা বললে আলাদা করে বলতে হয়। চুলে সবসময় দুটো পেনসিল গোঁজা থাকে। যেকোনও সময় কেউ যদি অঙ্ক না পারে, পেনসিলটা টেনে বের করে শ্রেয়া বলে, ‘আমি করে দিই।’ এই তিনজন মিলে একটা ক্লাব খুলেছে, ‘স্লিপার গ্যাং গোয়েন্দা ক্লাব’। নামটা এসেছে- কারণ সবাই ক্লাসে স্লিপার পরে আসে। বিকেলের দিকটা বেশ নিরীহ। নাহি বারান্দায় বসে চিপস খাচ্ছিল, হঠাৎ গেটের সামনে টিকটিক করে একটা শব্দ। নিচে নেমে দেখে- তিন তলার শম্পা আন্টি দাঁড়িয়ে, মুখ গম্ভীর। ‘নাহি, একটা ব্যাপার হয়েছে। তুমি গোয়েন্দা বলেই তো শোনালাম। আমাদের বাসার ট্যাক্সিডার্মি হরিণটা হারিয়ে গেছে!’ নাহি চোখ কুঁচকে বলে, ‘ট্যাক্সিডার্মি মানে?’ ‘মানে, মরার পর সংরক্ষণ করা হরিণ। তোমার আঙ্কেলের শখে কেনা ছিল। জিনিসটার দাম পঁচিশ হাজার টাকা!’ এই কথা শুনেই ইমরান বলে ওঠে, ‘মরা হরিণ হারায় কিভাবে? ও তো নড়তে পারে না!’ শম্পা আন্টি বলেন, ‘কাল  রাতে বারান্দায় ছিল। সকালে দেখি নাই।’ নাহি চিপসের টুকরো মুখে দিয়ে বলে, ‘মানে, চোর মরা হরিণ চুরি করেছে? বেশ মজার লাগছে।’ শ্রেয়া গম্ভীর, পেনসিল খুলে হাতে নেয়। ‘চুরি যেহেতু হয়েছে, রহস্যও আছে। কাজ শুরু করা যাক।’ বললো শ্রেয়া। প্রথমেই তারা ওঠে তিনতলায়। শম্পা আন্টির বারান্দা ঘেঁষে আছে পরের বিল্ডিংয়ের দেয়াল, যেটা সিমেন্টের পুরোনো প্যাচে ভর্তি। নাহি দেয়ালে আঙুল রাখে, ধুলা মোছে। ‘এখান দিয়ে কেউ আসা-যাওয়া করেছে। এটা পায়ে ঘষা দাগ।’ ইমরান মোবাইল দিয়ে ছবি তোলে। বলে, ‘এটা তো ঝুমঝুমি বিল্ডিং। ওই বাড়িতে তো একটাই ছেলে থাকে, তানভীর।’ শ্রেয়া বলে, ‘চলো, একবার কথা বলা যাক।’ তানভীর একাই থাকে, কারণ তার মা-বাবা বাইরে থাকেন বেশি। সে কম কথা বলে, তবে গেমিংয়ে ওস্তাদ। নাহি দরজায় নক করে, তানভীর দরজা খোলে, হাতজোড়া গেম কন্ট্রোলারে। ‘তুই কি কাল রাতে তিন তলায় গেছিলি?’ নাহি সরাসরি প্রশ্ন করে। তানভীর কাঁধ ঝাঁকে- ‘না, কেন?’ শ্রেয়া বলে, ‘তোর দেয়ালের ধারে পায়ের দাগ।’ তানভীর বিরক্ত হয়ে বলে, ‘আমি সারা রাত অনলাইনে ছিলাম। তবে আমি কাল রাতে একটা ছায়া দেখেছিলাম জানালা দিয়ে।’ ‘কী রকম?’ ইমরান আগ্রহে বলে। ‘ছায়াটা লম্বা ছিল, আর ওর পিঠে যেন কিছু ছিল। আমি ভাবছিলাম হ্যালুসিনেশন।’ রাতে নাহি, শ্রেয়া আর ইমরান ফের তদন্ত করতে বারান্দায় আসে। চাঁদের আলোয় নাহির চোখ পড়ে- একটা সাদা কিছু আটকে আছে পরের দেয়ালে। ‘ওইটা কি?’ শ্রেয়া পেনসিল দিয়ে দেখায়, ‘হরিণের লেজ!’ তারা নিচে নেমে দেয়াল টপকে পরের প্লটের ভেতর ঢুকে পড়ে। প্লটটা পরিত্যক্ত, কিন্তু হঠাৎ তারা দেখে, একটা হাফ ভাঙা শেডের নিচে হরিণটা দাঁড়িয়ে! নাহি হেসে ফেলে। বলে, ‘চোর যদি হরিণ রেখে পালায়, তবে এটা চুরি না, এটা পরিকল্পনা।’ পরদিন সকালে তারা ফের শম্পা আন্টির কাছে যায়। হরিণ ফেরত দিয়ে বলে, ‘এটা কোনো চোর নেয়নি।’ ‘তাহলে?’ শম্পা আন্টি চমকে ওঠেন। নাহি হাসে। ‘আপনার ছেলে, যে হোস্টেলে থাকে, কালকে সে এসেছিল, আপনি না থাকায় হরিণ দেখে ভয় পেয়ে বারান্দা থেকে নামিয়ে পাশের প্লটে রাখে।’ ‘তোমরা কীভাবে জানলে?’ আন্টি বিস্মিত। ইমরান বলে, ‘দেয়ালে পায়ের ছাপের পাশেই চিপসের প্যাকেট ছিল, আপনার ছেলেরই পছন্দের চিপস।’ শ্রেয়া বলে, ‘আর হরিণের গলায় আপনার ছেলের নাম লেখা স্টিকার ছিল, ভুলে রেখে গেছে।’ শম্পা আন্টি মাথা নাড়েন। ‘বাহ! তোমরা তো আসলেই ছোট গোয়েন্দা!’ ক্লাব রুমে ফিরে ইমরান বলে, ‘এইটা তো চুরির কেস না, ভয় পাওয়ার কেস!’ নাহি হেসে বলে, ‘কিন্তু রহস্য তো ছিল! আর আমাদের ক্লাবের নাম তো ‘স্লিপার গ্যাং’। আমরাই শহরের একমাত্র গোয়েন্দা যারা স্লিপার পায়ে রহস্য ধরতে পারি!’ তিনজন হাই ফাইভ করে। শ্রেয়া বলে, ‘পরের কেস কার জানি!’ আর বারান্দার কোণে পড়ে থাকে সেই পুরনো হরিণ, চুপচাপ, গম্ভীর, আর হালকা চিপসের গন্ধে ঘেরা।

ঈশপের চশমায়

ঈশপের চশমায়

ওরা তিন বান্ধবী। কিভাবে কিভাবে যেন ওদের মেলবোর্নে মিলন ঘটলো। ঈদের সকালেই গোসল সেরে নতুন পোশাক-আশাকে সজ্জিত হয়ে আতর লোবাননয় পারফিউম ঢেলে মৌ মৌসুবাসে বাতাস মোহিত করে ওরা প্রথমে গেল ঈদের নামাজে। তিনজনের একজন সদ্য বাংলাদেশ থেকে বেড়াতে এসেছে। ছোটবেলাতে কিছুদিন তিনজন একসাথে ময়মনসিংহে স্কুলে পড়েছিলো। বাকি দুজন এদেশে আছে অনেকদিন। তাদের সন্তানরাও ইউনিভার্সিটি শেষ করবে শীঘ্র। বাংলাদেশ থেকে আসা রাফিয়া নিঃসন্তান। বিশাল ট্রাভেল এজেন্সির মালিক নিজে। স্বামীও বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্ণধার। স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে প্রায় সব মহাদেশ ঘুরেছে বাকি ছিল অস্ট্রেলিয়া। এবার তাই অস্ট্রেলিয়া আগমন। রাফিয়ার ভাইয়ের বাসা থেকে তিন বান্ধবীর ঈদ আনন্দ ভ্রমণ শুরু। অন্য দুজন ডলি ও রওনক। তারা বললো -মেলবোর্নে ঈদ দেখাবো তোমাকে, কত মজার কাণ্ড দেখবে চল। প্রথম মসজিদ নাম দেওয়া এক বড় ঘরে নামাজ পড়তে গেল তারা। রাফিয়ার জন্য এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। সে গোড়া নয়। তবে মেয়েদের বসার জায়গাটা অস্বস্তিকর রকমের খোলামেলা লাগলো। রাফিয়ার মনে হলো মেয়েদের নামাজের জায়গা স্বতন্ত্র হলে শোভন হতো। খোলামেলা হওয়াতে পুরুষদের সবাই নয় কেউ কেউ মেয়েদের ঈদসজ্জার প্রদর্শনী দেখতেই বেশি মনোযোগী হলেন। ঈদ মেলা হলে বিষয়টা মানা যেতো হয়তো। নামাজ বলে কথা। মেয়েরা ব্যস্ত সাজসজ্জার সচেতন প্রদর্শনে। শিশু-কিশোর-পুরুষরা ব্যস্ত বিভিন্ন বাড়ি থেকে নিয়ে আসা মুখরোচক খাবার আস্বাদনে। বাংলাদেশে মসজিদে যাওয়া হয়নি কখনো এই অভিজ্ঞতা রাফিয়ার কাছে অভিনব। নামাজ শেষে পরিচিত বন্ধুবান্ধবের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো ওরা। রাফিয়া চুপচাপ দেখছে আর ভাবছে। আবহাওয়া চমৎকার, দিনটিও ছুটির। ঈদের নয় তবে সাপ্তাহিক ছুটির দিন। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাস্তায় গিজ গিজে ভিড় নেই, গাড়ি-বাসে ধুলার আস্তরণ নেই। এমন নির্মল পরিবেশে মনের আনন্দে চুটিয়ে ঈদ উৎসব উদ্যাপন করছে কিছু লোকজন। মিষ্টি ভাষী রওনক বললে ‘রাফিয়া কিছু বললে না যে,’ ‘কি বলবো বল?’ ডলি তখন অসহিষ্ণু গলায় বলে উঠলো ‘কেন নামাজ কেমন লাগলো?’ ‘নতুনরকম, আগে কখনো এমন দেখিনি তো’। রাফিয়ার গলার স্বর এমনি শান্ত ধীরস্থির শুনে বোঝার উপায় নেই মন্দ লেগেছে নাকি আনন্দ পেয়েছে।  তারপর তারা গেল একজনের বাড়ি ঈদ মোলাকাত করতে। সুন্দর লন বাগানসহ বড়সর বাড়ি। বাড়ির মেজবান হেনা অতিথিদের আন্তরিক উষ্ণতায় ভরিয়ে দিলো। নানা ধরনের টকণ্ড মিষ্টি ও ঝাল খাবারের এন্তার আয়োজন। খাবার দাবার রাখাও হয়েছে সর্বাধুনিক নানা আকারের শে^ত পাথরের মতো তৈজসপত্রে। হেনা নিজের হাতে এটা সেটা প্লেটে তুলে দিতে চাইছিল। ওরা তিনজন অনেক দোহাই, অনেক অনুরোধ উপরোধ শেষে হেনার অত্যাচারী আপ্যায়নের হাত থেকে রেহাই পেল। ডলি যদিও প্রত্যেকটি খাবারের পদ সম্পর্কে খুঁটিনাটি জিজ্ঞেস করলো। তারপরে হঠাৎ যেন আবিষ্কার করলো হেনা নতুন কিছু করে ফেলেছে এবার। তখনি সে ধরে বসলো ‘হেনা ব্যাপার কি বলতো, গতবার ঈদে সব পদ নিজের হাতে তৈরি করেছিলে, যারাই খেয়েছে কত সুনাম করেছে তোমার। এবার সব কিনে এনেছ মনে হচ্ছে’ মুখ ব্যাজার করে হেনা বললো ‘ঠিক ধরেছ, একটাও নিজের হাতে বানাইনি। রেস্টুরেন্টে অর্ডার দিয়ে সব বানিয়ে এনেছি’ তারপর দাঁতে দাঁত ঘষে বললো ‘নিন্দুকরা আর বলার সুযোগ পাবে না যে আমি কঞ্জুস, কিপ্টা টাকা বাঁচানোর জন্য নিজের হাতে খাবার বানাই সবসময়’ দম ফেলে প্রায় ভেজা গলায় আবার বললো হেনা ‘আমার রান্না মজা মজা বলে তারা খেয়েছে চেটেপুটে ঠিকই কিন্তু আমার আন্তরিক খাটনির জন্য কোথাও এতটুক ুপ্রশংসার বাক্য উচ্চারণ করেনি কেউ’ এই ফাঁকে রওনক রাফিয়াকে ফিস ফিসিয়ে জানালো যে চারপাশে হেনার নামে কিপ্টামীর বদনাম ডলিও ছড়িয়েছে। ডলিই ব্যথিত হেনাকে আলিঙ্গন আর আদর করে ওদের নিয়ে ঐ বাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি সটকে পড়লো।  গাড়িতে যেতে যেতে ডলিকে আশাহত মনে হলো। হয়তো বাকিপ্টা দর্নিামটা হেনার গা থেকে খসে পড়ার দুঃখে। এক সময়ে সে নিজেই যেন প্রাণ ফিরে পেল। এবার শুরু করলো খাদ্য নিয়ে আলোচনা। ‘দেশে কিন্তু ঘরে তৈরি নানা পদের খাবারের মাঝে বাড়ির কর্ত্রীর গুণপনা আর পরিবারের খান্দানিয়ানা দেখা যেতো, এখনো কি এমন হয় রাফি?’ রাফিয়া একটু সময় নিয়ে কথা শুরু করলো ‘হয়, আবার হয়ওনা’ ‘কি রকম বলতো?’ রওনকের কৌতূহলী জিজ্ঞাসা। ‘যেমন মেহমান ডাকলে মানুষ ঘরেও নিজের হাতে কিছু কিছু পদ তৈরি করে আবার বাইরে থেকেও দু’এক পদ কিনে আনে’ ‘বাইরে থেকে কি মিষ্টি টিষ্টি কিনে আনে?’ আবার ভাবলো রাফিয়া ‘এখন দাওয়াতে দেখি ঢাকা ক্লাবের আচার গোস্ত আর কস্তুরীর চিতল মাছের কাটলেট খুব আনিয়ে নেয়, মাছের ফিলেট রানèাও রেস্তোরা থেকে আনায় অনেকে’ ‘সবচেয়ে ভাল লেগেছে কোনটা?’ ডলির গোলগাল স্বাস্থ্যবতী সুখী চেহারাবলে দেয় তার খাদ্যাসক্তির কথা। প্রশ্নটাও তাই তার ‘শেষ দাওয়াতে সব খাইনি তো আর হরেকরকম পদ রাক্ষসও পারবে না সব খেতে, তাই কোনটার চেয়ে কোনটা ভালো বলতে পারবো না তবে ঘরে নিজের হাতে তৈরি ডিমের হালুয়া ছিল খুব ভাল; শক্ত দানা দানা নয় আবার জাফরান দেওয়াতে ডিমের গন্ধ ছিলনা একটুও’ ডলিবলে ‘একেই বলে খান্দানি ঘরোয়া রান্না! হেনার হাতের রান্না বেশ মজা।’ তারপর উষ্মা উগরে বললো ‘কম পদ করতি নিজের হাতে করতি মানুষ তৃপ্তি করে খেতো তা নয় পয়সার প্রদর্শনীর জন্য টেবিলের এ মাথা থেকে ও মাথা রেস্টুরেন্টের কেনা খাবারে বোঝাই; দেখেছ কিরকম অর্থের বড়াই!’ রাফিয়া অবাক হয়ে ভাবলো গত বছর নাকি এই ডলিই হেনাকে কিপ্টা বলে ওর যত্ন করে তৈরি শখের রান্নাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে, এবার করছে হেনার ধনদৌলত দেখানেপনার মুন্ডুপাত। রাফিয়া ভাবলো মানুষ বড় আজব জীব। রওনক বললো ‘এবার যে বাড়িতে যাবে সেখানে দেখবে খাবারের মাঝে শুধু দোকানের কেনা খাবার, সব দেশের খাবার পাবে ইন্ডিয়ান, গ্রিক, ইতালিয়ান, লেবানিজ, টার্কিশ সব রয়েছে... ‘কি করে জানলে?’ ‘গত ঈদে দেখলা মতো, জানমেয়েটা দুনিয়ার অলস আর আমড়াকাঠের ঢেকি; ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি আছে চাকরি করে এইটুকুই সার, হাতের কাজের বেলায় লবডঙ্কা’। যাকে রওনক আমড়াকাঠের ঢেকি আর কাজের বেলায় লবডঙ্কা বলেছে তার বাড়িতে আরেক চমক অপেক্ষা করছিল। বিরাট বিশাল বাড়ি নয়। তবে খুব ছিমছাম করে সাজানো। আসবাবপত্রে জৌলুস নাই তবে রুচির বিকিরণ আছে। ছোট্ট কয়েকটি মাত্র পর্সিলিনের টবে ছোট ছোট নানা ধরনের অর্কিড। বোঝাই যায় এ ধরনের জিনিস অনেক যত্ন আর ভালোবাসায় তৈরি। বাড়ির কর্ত্রী নওশাবা ছিপছিপে গড়নের নারী। মিষ্টিভাষী চটপটে স্বভাবের। তার খাবার টেবিলে একগাদা খাবারের সমারোহ নাই। তবে যাই আছে সব মনোলোভা। ঝালমিষ্টি-নোনতা সবই আছে তবে পরিমিত। উপচেপড়া খাবার দিনের শেষে বিনে যাবার দুর্ভাগ্যের কবলে পড়বে না। মিষ্টি খাবার জর্দা সেমাই, কাষ্টার্ড, কেক। নুনতা খাবার কাবাব, চিজ অন পটেটো, লুচি, আবার লাল আটার তৈরি লুচির আকৃতির হাতে গড়া রুটি। মোরগ পোলাও, ফ্রাইড রাইস ছিল। পাশেই কালো চোকৌ বাটিতে ইয়োগার্ত-মিন্ট (টকদই, পুদিনাপাতা, কাঁচামরিচ, চিনি, লবণ দিয়ে) সস। ঘি-মিষ্টির সাথে প্রশান্তি দেবে এই সস। নওশাবার ঈদ আয়োজন দেখে ডলি আর রওনক বিস্মিত। নওশাবা খাওয়ার জন্য জোরাজুরি করার মানুষ না। অতিথিদের রুচি ও পছন্দকে সম¥ান দেখিয়ে তাদের যার যা ভাল লাগে দেখে শুনে তুলে নেওয়ার অনুরোধ করলো। কাবাব, চিজ অন পটেটো আর ইয়োগার্ত-মিণ্টসস খুব চললো। রওনক ও ডলি বললো ‘দারুণ হয়েছে, রেসিপি দিও প্লিজ’ ‘রেসিপি দেব অবশ্যই তবে একটা জিনিসের মাপ বলতে পারবো না, যার উপরেই আসলে নির্ভর করে মজা সেটা আপনারা আন্দাজ মতো দেবেন’ রওনক জানার জন্য মরিয়া হয়ে বললো ‘সেটি কি বলতো ভাই?’ রহস্যের হাসি হেসেনও শাবা বললো ‘বলছি নামটা পরে তবে পরিমাপ পার্সন টু পার্সন ভেরি করবে কিন্তু’ ডলি এরই মাঝে নিচু গলায় রাফিয়াকে বললো যে নওশাবার সব সময় বাহাদুরী ফলানো চাই। গতবার একগাদা খাবার কিনে এনে করেছে পয়সার প্রদর্শনী এবার গাধার খাটুনী খেটে গুণের গরিমা দেখাচ্ছে।  রাফিয়া অবাক হলো দেখে যে ঈশপের চরিত্ররা আজও চারপাশে কেমন সুন্দর বেঁচেবর্তে আছে। এদের খুশি করতে গেলে জীবন বরবাদ হয়ে যাবে তবু এরা খুশি হবে না। ঈশপের গল্পের বুড়ো তার ছেলে আর গাঁধা তিনজন কি বিপদেই নাপড়েছিল চলার পথে সবার মন জুগিয়ে চলতে গিয়ে। “বুড়ো আর তার ছেলে যাচ্ছে সঙ্গে তাদের গাধাটিও রয়েছে। কিছু লোক বললো ‘বোকা কোথাকার! গাধার কাজ বোঝা টানা ওকে শুধু শুধু আরাম করিয়ে হাঁটাচ্ছে’। বুড়ো ছেলেকে গাধার পিঠে বসিয়ে চললো এবার। পথিকরা তখন বললো ‘বুড়ো মানুষটা কষ্ট করে হেঁটে যাচ্ছে জোয়ান ছোকরা কিনা আয়েস করে গাধার পিঠে বসে’। ছেলেকে নামিয়ে বুড়ো চড়ে বসলো। তখন আরেক দল বুড়োকেও টিটকারী দিল। তারপর ছেলেকেও টেনে তুলে পাশে বসালো লোকটি। এবার অন্য ক’জন বললো ‘দেখ কি নিষ্ঠুর ওরা! দুদুটো মানুষ গাধার পিঠে কেমন করে চড়তে পারলো’। মানুষকে খুশি করার জন্য বাপ-ছেলে এবার গাধাকে বেঁধে ছেদে কাঁধে নিয়ে চললো। সেতু পার হওয়ার সময়ে ভয়ে ছট্ফট্ করতে থাকা গাধা ছিট্কে পানিতে পড়ে তলিয়ে গেল।” গল্প থেকে বাস্তবে ফিরলো রাফিয়া রওনকের তাড়াতে। চলে আসার সময়ে দরজার বাইরে পা ফেলতে ফেলতে রওনক বললো ‘নওশাবা এবার তাইলে বল রেসিপির ঐ আইটেমের কিনাম?’ ‘এর নাম আন্তরিকতা।’

আত্ম-আবিষ্কারের সংগ্রাম

আত্ম-আবিষ্কারের সংগ্রাম

‘Untamed ’ মানে অদম্য। যিনি এখনো পোষ মানেননি। Stop pleasing, Start living। সঙ্গে যিনি অন্যকে খুশি না করে বাঁচতে শিখেছেন, বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছেন।  Untamed গ্লেনন ডয়েলের আত্ম-আবিষ্কার এবং মুক্তির দিকে যাত্রার এক গল্পের কথা। এ গল্প জীবনের গল্প, এ গল্প কখনো কখনো প্রতিদিনের গল্প।  বইটিতে আছে গ্লেননের জীবনের ব্যক্তিগত উপাখ্যান এবং প্রতিচ্ছবিগুলোর একটি সিরিজ। ডয়েল তার লেখার মধ্য দিয়ে সামাজিক প্রত্যাশা এবং তার ভেতরে বয়ে চলা অভ্যন্তরীণ বিশ্বাসগুলোর মধ্যে একটা অনুসন্ধান করে দেখেছেন- কি তাকে আটকে রেখেছে এবং কিভাবে তিনি শেষ পর্যন্ত এই সীমাবদ্ধতাগুলো প্রত্যাখ্যান করে একটি খাটি এবং পরিপূর্ণ জীবনযাপন করতে শিখেছিলেন। চারপাশের মিথ্যাকে অতিক্রম করে সত্যকে নিজের ভেতরে যেটুকু দেখতে পেয়েছেন, তার মধ্য দিয়ে বাঁচতে শিখেছিলেন। সেই বাঁচা এবং লড়াইয়ের কথাই ডয়েল Untamed এ বর্ণনা করে গেছেন। এ এক আত্ম-যুদ্ধ, এ এক নিজের সঙ্গে বাইরের যুদ্ধ, বাইরের সঙ্গে নিজের যুদ্ধ।  বইটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় অনেকগুলো দিকের মধ্যে একটি হলো ডয়েলের সততা। খাঁটি এবং মুক্ত। সাজানো পাকা হয়ে ওঠেনি সেই অর্থে কাঁচা। অসততাটুকুর মুখোশ পরেনি বলে সামাজিক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে গেলে মনে হয় দুর্বল। কিন্তু তিনি দেখিয়েছেন- নির্ভীকভাবে চললে যা অন্যের চোখে দুর্বল এবং কাঁচা, তার নিজের জন্য হয়ে ওঠে সবল এবং পাকা। জীবন পথে চলতে চলতে অ্যাডিকশন, বিশ্বাসঘাতকতা এবং শরীরের মধ্য দিয়ে কি করে কতগুলো কঠিন বিষয়কে মোকাবিলা করেছিলেন, সেগুলোকে নিজের অস্বস্তিকর অনুভূতির মধ্যে কিভাবে গভীরভাবে সম্পর্কিত করেছেন, তার এক সুনিপুণ বর্ণনা তিনি দিয়ে গেছেন বইটিতে।  লেখার প্রতি নিষ্ঠা, অনুভূতির প্রতি সততা এবং জীবনের প্রতি খাটি দৃষ্টি, এমন বিষয়গুলোই পাঠকদের সঙ্গে গভীর স্তরে তার একটি সংযোগ তৈরি করতে সক্ষম হয়। একজন সমাজকর্মী হিসেবে লেখক সত্তার পাশাপাশি নিজের অনুভূতির বয়ান দিতে গিয়ে তিনি কেবল নিজের জন্যই লেখেননি, অন্য হাজার হাজার নারীর জন্যও লিখেছেন, যারা এই ধরনের সমস্যাগুলোর সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত।  গ্লেনন ডয়েল একজন আমেরিকান লেখক, সমাজকর্মী এবং সমাজসেবী। তার বহুল পরিচিত বইয়ের মধ্যে ক্যারি অন, ওয়ারিয়র এবং লাভ ওয়ারিয়ার আন্তর্জাতিক বাজারে বেশ সুপরিচিত। বেশিরভাগ বইগুলোতেই তিনি অ্যাডিকশন, ট্রমা এবং সেখান থেকে কি করে বের হয়ে আসা যায়, এমন সব থিমগুলো নিয়ে কাজ করেছেন। একই সঙ্গে টুগেদার রাইসিং নামক একটি অলাভজনক সামাজিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। যারা পৃথিবীজুড়ে সামাজিক খাতে পরিবার এবং বিভিন্ন সম্প্রদায় যখন সংকটের মুখোমুখি হয়, তাদের বিভিন্ন ধরনের সহায়তা প্রদান করে এই প্রতিষ্ঠান। তার প্রতিষ্ঠান এবং লেখার মাধ্যমে তিনি মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং সামাজিক ন্যায় বিচার ও সমতার কথা বার বার বলেন। একজন ভালো বক্তা হিসেবে এবং ভালো লেখক ও সমাজকর্মী হিসেবে নিউইয়র্ক টাইমসের চোখে সময় সময়ে সেরা লেখকের তকমাও পেয়েছেন। তিনি একাধারে লেখক, সমাজকর্মী, কখনো প্রতিবাদকারী, অ্যাক্টিভিস্ট, কখনো একজনের স্ত্রী, কখনো কারো মা, কখনো প্রতিবাদী নারী, কখনো কেবল উচ্চ কণ্ঠে অন্যায়ের বিরুদ্ধে একজন মানুষ।  বইটি জুড়ে অনেকগুলো থিম রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম একটি থিম হলো বিভিন্ন উপায়ে সমাজ কি করে নারীদের গঠন এবং নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে, তার একটি চিত্র তুলে ধরা। সমস্যাগুলো বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেন- ব্যক্তিগতভাবে তিনি কিভাবে এবং সেই সঙ্গে অন্যান্য অনেক নারীরও কিংবা একজন মহিলার কেমন হওয়া উচিত, তার সঙ্গে একটি পূর্বনির্ধারিত ছাঁচে ফিট করার জন্য সমাজের যে চাপ এবং চাহিদা থাকে, তার বিপক্ষে তার সত্যিকারের আকাঙ্ক্ষা এবং চাহিদাগুলোকে সামনে এনে সামাজিক শর্তগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করে কিভাবে বাঁচতে হয়, তার এক দীর্ঘ সংগ্রামের কথা।  তিনি নারীদের ঐতিহ্যগত লিঙ্গ ভূমিকা মেনে চলার সামাজিক চাপ এবং সেই সঙ্গে নিজের চেয়ে অন্যের চাহিদাকে অগ্রাধিকার দেওয়া বিষয়ে সামাজিক দৃষ্টিকোণকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে নিজে কিভাবে সেই বিরক্তি এবং অপূর্ণতার অনুভূতি থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীনতা এবং মুক্তির পথে বাঁচতে শিখেছিলেন, বাঁচার পথ খুঁজে পেয়েছিলেন এবং সেই বাঁচার পথে অন্য নারীদেরও সংগ্রাম করার কথা বলেছেন।  ডয়েল আমেরিকার গ্রামীণ ভার্জিনিয়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। শহর থেকে দূরে গ্রামীণ পরিবেশে তার বড় হওয়া। তবে অন্য অনেক ব্রোকেন ফ্যামিলির মতো অ্যাডিকশন, মানসিক অসুস্থতা এবং ট্রমাসহ এমন কিছু সমস্যায় আক্রান্ত  পরিবারের পরিবেশে বড় হয়ে উঠেছিলেন। এতসব বাধা থাকা সত্ত্বেও তিনি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে পরবর্তীতে সামাজিক কাজে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।  নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে ডয়েল যুক্তি দেন যে, নারীদের কেবল নারী থাকার যে সামাজিক চাপ তা কি করে ব্যক্তিগত সুখের জন্য ক্ষতিকর হয় এবং সেটি যে সামগ্রিকভাবে সমাজের জন্যও ক্ষতিকর, তার কথা বলেন। নারীদের স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর এবং দৃষ্টিভঙ্গিকে দমিয়ে রাখার মাধ্যমে সমাজ তার জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের মূল্যবান অবদান এবং ধারণা থেকে সমাজকেই বঞ্চিত করে। জীবন পথে অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি নারীদের তাদের নিজেদের ইচ্ছাকে আলিঙ্গন করার জন্য এবং সামাজিক প্রত্যাশাগুলোকে প্রত্যাখ্যান করার আহ্বান জানিয়েছেন, যা তাদের আটকে রেখেছে সামাজিক বেষ্টনীতে। সেই বেষ্টন ভেঙে তাদের নিজেদের অদম্য করার এবং আরও খাটি জীবন উদ্যাপন করার আহ্বান জানিয়েছেন বইটিতে।  বইটির আরেকটি শক্তিশালী দিক হলো ডয়েল যেভাবে সেখানে ব্যক্তিগত আখ্যান এবং সামাজিক বিশ্লেষণকে একত্রিত করেছেন। তিনি দক্ষতার সঙ্গে তার নিজের অভিজ্ঞতা এবং বৃহত্তর সাংস্কৃতিক পর্যবেক্ষণের মধ্যে হেঁটে হেঁটে উভয়ের মধ্যে একটি সংযোগ তৈরি করেন এবং দেখান যে কিভাবে তার নিজের সংগ্রামগুলো এই বিস্তৃত বিষয়গুলোর প্রতিফলন করে। এই সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি তাকে তার সমস্যাগুলোর সমাধানের একটি সংক্ষিপ্ত এবং বহুমুখী দৃষ্টিভঙ্গি, সঙ্গে ব্যক্তিগত ও সামাজিক উভয় প্রকৃতির সম্ভাব্য সমাধানগুলোর একটি সংযোগ তৈরি করে আলোর পথ দেখায়। কিছু কিছু সমালোচকদের মতে বইটির একটি সম্ভাব্য সমালোচনা হলো যে ডয়েলের কিছু সমাধান এমন করে মাঝে মাঝে অত্যধিক সরল মনে হতে পারে পাঠকের কাছে। কারণ জীবন অনেক জটিল। যদিও তার এই সরলতার অন্তরালে থাকে মূল্যবান অন্তর্দৃষ্টির দিকে চোখ ফেরানো এবং সে অনুযায়ী পাঠকদের বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করেন। মাঝে মাঝে লেখার শৈলী সংবেদনশীল হলেও মনে হতে পারে, কিন্তু তিনি যে বিষয়গুলোকে অবলম্বন করে তার সেই আবেগ প্রবণতাকে বিশ্লেষণ করতে চেয়েছেন, সেগুলো উদ্দেশ্যমূলক হওয়ার পরিবর্তে বরং বিশ্লেষণের আলোকের কারণে সত্যিকার পরামর্শ হয়ে ওঠে।  সামগ্রিকভাবে Untamed একটি চিন্তা-উদ্দীপক এবং উৎসাহ দানকারী পঠন, যা অনেক পাঠকের মধ্যে আত্ম-বিশ্লেষণ এর সঙ্গে সঙ্গে অনুপ্রাণিত করে তাদের। তার সততা এবং গল্প বলার টেকনিক নারীদের সামাজিক নিয়ন্ত্রণ এবং সীমাবদ্ধতাগুলোকে প্রত্যাখ্যান করে একটি সরল, খাঁটি এবং সৎ জীবনযাপনে উৎসাহিত করে। যদিও কেউ কেউ তার লেখার স্টাইলটিকে মাঝে মাঝে খুব আবেগপ্রবণ বলে মনে করতে পারে, কিন্তু তিনি যে মেসেজটি দিতে চেয়েছেন, তার শক্তি এবং গুরুত্ব অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। 

বোহেমিয়ার স্ক্যান্ডাল

বোহেমিয়ার স্ক্যান্ডাল

‘এখনো জানি না। যথেষ্ট তথ্য নেই আমার হাতে। তথ্য ছাড়া আগেভাগেই কিছু ভেবে নেয়া ঠিক হবে না- তাতে ভুল হতে পারে।  কিন্তু এই নোট থেকে তুমি কী বুঝলে বলো তো?’    ‘ধনী ব্যক্তির লেখা।’ আমার বন্ধুর অনুকরণ করে ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করলাম। ‘দামি কাগজ দেখে তাই মনে হয়। কাগজটা একটু অন্যরকম, পুরু আর শক্ত।’ ‘হ্যাঁ অন্যরকম, এটাই আসল কথা।’ হোমস সায় দিল। ‘এদেশে তৈরি নয় কাগজটা। আলোর দিকে তুলে ধরো, দেখতে পাবে।’ তাই করলাম। দেখলাম কাগজের ভিতরে Eg P Gt এরকম কিছু লেখা। ‘কী দেখলে?’ প্রশ্ন করলো হোমস। ‘মনে হয় আমাদের কোনো কাগজ কোম্পানির মনোগ্রাম হবে।’ ‘মোটেও না। এই কাগজ এদেশে তৈরি নয়। Gt হচ্ছে ellschaftt শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ। P মানে পেপার। এবার দেখা যাক Eg…’’ বইয়ের তাক থেকে ইয়া মোটা একটা বই নামালো হোমস। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বললো, ‘দেখা যাক, কন্টিনেন্টাল গেজেটিয়ার কী লিখেছে। এই যে Eglow, Eglonitz...পেয়েছি Egria...জার্মানির বোহেমিয়ার একটা জায়গা- গ্লাস ফ্যাক্টরি আর পেপার মিলের জন্য বিখ্যাত। কী বুঝলে ওয়াটসন?’ খুশিতে চকচক করে উঠলো হোমসের চোখ। জোরে পাইপ টানতে টানতে নীল রঙের ধোঁয়া উড়াতে লাগলো সে। ‘বোহেমিয়ায় তৈরি এই কাগজ।’ ‘ঠিক। যে লোকটা লিখেছে সে জার্মান। নোট পড়েও কিছুটা বোঝা যায়। ফ্রেঞ্চ কিংবা রাশানরা এভাবে লেখে না। এখন দেখা যাক, বোহেমিয়ার মুখোশধারী জার্মান একটা লোক আমাদের কাছে কী চায়। ওই যে, সে এসে গেছে।’ বলতে বলতেই রাস্তায় ঘোড়ার খুরের খটাখট শব্দ আর চাকার আওয়াজ পাওয়া গেল। কোচোয়ান রাশ টেনে ধরেছে। ‘মনে হচ্ছে জোড়া ঘোড়ায় টানা ব্রুহাম,’ হোমস বললো। উঠে জানালা দিয়ে উঁকি দিল সে। ‘হ্যাঁ। দারুণ দুটো ঘোড়া। একটার দামই কমপক্ষে দেড়শ গিনি হবে। মালদার পার্টি, ওয়াটসন।’ ‘আমি বরং চলি তাহলে, হোমস।’ ‘চলি মানে? তোমাকে থাকতে হবে ওয়াটসন। তুমি ছাড়া আমি অচল। কেসটা ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে- মিস ক’রো না।’ ‘কিন্তু তোমার ক্লায়েন্ট যদি...।’ ‘ক্লায়েন্টকে নিয়ে ভেবো না। তোমার সাহায্য আমার দরকার। এই যে সে এসে গেছে। ইজিচেয়ারটায় আরাম করে বসো, ডাক্তার।’ সিঁড়িতে ভারি পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল, ধীরে ধীরে উঠে আসছে শব্দটা উপরে- করিডোর পার হয়ে দরজার ওপাশে এসে থামলো। তারপর জোরে জোরে নক। ‘ভেতরে আসুন।’ হোমস বললো। কমপক্ষে সাড়ে ছয় ফিট লম্বা একটা লোক ঘরে ঢুকলো। হারকিউলিসের মতো তার বুক, হাত আর দেহের গড়ন। দামি জমকালো পোশাক, এতটাই জমকালো যে ঠিক রুচিশীল বলা যায় না- দামি কোট, ক্লোক, ব্রুচ আর মূল্যবান পাথরে অর্থবিত্তের অশ্লীল প্রদর্শনী। পায়ে ফারের লাইনিং দেয়া একজোড়া বুট। মুখে মুখোস। মুখোসের আড়াল থেকে চিবুক ও মুখের যেটুকু অংশ দেখা যায়, তাতে দৃঢ়-সংকল্প গোঁয়ার টাইপ একটা মানুষ বলে মনে হয়। ‘আমার নোট পেয়েছেন?’ গম্ভীর কর্কশ লোকটার গলা। কথায় জার্মান টান। ‘আমি আসবো বলেছিলাম।’ একবার আমার দিকে একবার হোমসের দিকে তাকাচ্ছে সে। কার সঙ্গে কথা বলবে যেন ঠিক করতে পারছে না। ‘দয়া করে বসুন।’ হোমস বললো। ‘ইনি আমার বন্ধু ও কলিগ ডক্টর ওয়াটসন। আমি কার সঙ্গে কথা বলছি?’ ‘বোহেমিয়ার একজন নোবলম্যান, কাউন্ট ভন ক্রামের সঙ্গে কথা বলছেন আপনি। আপনার বন্ধু এই ভদ্রলোককে কি বিশ্বাস করতে পারি? নাহলে আপনার সঙ্গে একাকী কথা বলতে চাই আমি।’ চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। হোমস আমার হাত চেপে ধরলো, বসিয়ে দিল চেয়ারে। ‘কথা দুজনের সামনে বলতে হবে, নাহলে নয়।’ বললো হোমস। ‘আমাকে যা বলতে চান, ওনার সামনে নির্দ্বিধায় তা বলতে পারেন।’ কাউন্ট কাঁধ ঝাঁকালো। ‘তাহলে শুরু করা যাক।’ বললো সে। ‘বিষয়টি অতি গোপনীয়। যদি বলি এই মুহূর্তে এর ওপর নির্ভর করছে ইউরোপের ভবিষ্যৎ- তাহলে বেশি বলা হবে না। দুই বছর পর এই ঘটনা গুরুত্বহীন হয়ে যাবে। তাই আমি চাই দুটো বছর আপনারা গোপনীয়তা রক্ষা করবেন।’ ‘কথা দিচ্ছি।’ হোমস বললো। ‘আমিও।’ আমি বললাম। ‘মুখোস পরেই কথা বলতে হচ্ছে আমাকে।’ রহস্যময় আগন্তুক বলতে থাকলো। ‘যিনি আমাকে এই কাজে নিয়োগ দিয়েছেন, সেই সম্মানিত ব্যক্তি চান না আমার পরিচয় প্রকাশ পাক। আরেকটা কথা বলে রাখা দরকার- যে নামে আমি নিজের পরিচয় দিয়েছি, সেটা আমার আসল পরিচয় নয়।’ ‘আমি জানি।’  ‘বিষয়টা খুব স্পর্শকাতর। সেজন্যই এত গোপনীয়তা। যাতে ইউরোপের বিখ্যাত একটি রাজ পরিবার স্ক্যান্ডালের শিকারে পরিণত না হয়। আরও খুলে বলি- এর সঙ্গে জড়িত বোহেমিয়ার রাজ পরিবারের মান-সম্মান।’ ‘এটাও আমার জানা।’ অস্ফূট কণ্ঠে বললো হোমস। আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে চোখ বুঁজলো সে। আগন্তুক একটু অবাক চোখে হোমসের দিকে তাকিয়ে থাকলো। বোঝাই যাচ্ছে তার প্রখর বুদ্ধিমত্তায় লোকটা বিস্মিত হয়েছে। ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো হোমস তার বিশালদেহী ক্লায়েন্টের দিকে। ‘ইয়োর ম্যাজেস্টি, আমাকে সব খুলে বলুন।’ বললো হোমস। ‘তাহলে আমার পক্ষে সহজ হবে আপনাকে সহযোগিতা করা।’ লোকটা চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে উত্তেজিত ভঙ্গিতে ঘরময় পায়চারি শুরু করলো। হঠাৎ সে টান মেরে মুখোসটা খুলে ছুড়ে ফেললো মেঝেতে। ‘আপনি ঠিকই ধরেছেন।’ বললো সে। ‘আমিই রাজা। সত্য গোপন করে আর কী হবে।’ ‘নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই।’ মৃদুকণ্ঠে বললো হোমস। ‘আমি আপনাকে ঠিকই চিনতে পেরেছি।’ ‘বুঝতেই পারছেন।’ বললো রহস্যময় আগন্তুক, আবার চেয়ারে বসেছে সে, কপালে হাত বোলাচ্ছে। ‘এরকম কাজে আমি অভ্যস্ত নই। কিন্তু বিষয়টা এতই গোপনীয় আর সংবেদনশীল যে কারও উপর ভরসা করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাই নিজেই এসেছি ছদ্মবেশে, প্রাগ থেকে এতদূর- শুধু আপনার সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য।’ (চলবে...)

কেমন দিন কাটে জানতে বড় ইচ্ছে করে 

কেমন দিন কাটে জানতে বড় ইচ্ছে করে 

আমি পাহাড় দেখতে চাই না,আমি হিমালয় দেখতে চাই না। আমি দেখেছি তার অনুরাগ। আমি পথ হাটতে চাই না,দূরত্ব জানতে চাই না।  আমি জানতে চাই তার মনের খবর। কেমন দিন কাটে জানতে বড় ইচ্ছে করে। কেমন কাটে দিন,কেমন আছে গো সে।  বসন্তে কি আর তার কোকিলের গান ভালো লাগে। বর্ষায় কদম,শিউলি,বকুল,রজনী প্রভাতে পাখিদের কোলাহল। জানালার রড স্পর্শে এখনো কি তার সকাল সাজে। নানান বায়না আর দীর্ঘ অভিমানে এখনও কি তার দিন কাটে। ফাগুনের দিনে পূর্ণিমা রাতে,চাঁদের আলোয় হাতে হাত রেখে আজও কি হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়। নাকি সংসারের ঝড় জলোচ্ছ্বাসে ভয়াবহ দিন কাটে। নাকি বর্জন ঘরের নিত্য প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রের সাথে যুদ্ধ করে। পরাজিত সৈনিকের মত দিন কাটছে। বোধহয় ট্রাফিকের করা করি আইনে নগরকে যানজট মুক্ত রাখতে দিন কাটে। কেমন দিন কাটে জানতে বড় ইচ্ছে করে। আত্মশক্তি কর্মদক্ষতা মনুষ্যত্ব একাধারে ব্যয় হচ্ছে। এত এত কিছুর পরও কি অবহেলিত হৃদয়ে আগের মত। সখ সাদ আহ্লাদ আছে।  কেমন দিন কাটে জানতে বড় ইচ্ছে করে। অপূর্ণ যেন না থাকে হৃদয়ের সকল চাওয়া। যেমন ছিল দিন কাটানোর আবদার।