ভাষা হচ্ছে সংস্কৃতির প্রধান বাহন। মানুষের মনে স্বদেশ প্রেম ও চেতনা উৎসরণে ভাষা এক উল্লেখযোগ্য শক্তি। যুগে যুগে প্রবল প্রতাপশালী আগ্রাসী বৈদেশিক শক্তির আক্রমণে অনেকের মাতৃভাষা হারিয়ে গেছে। বিজয়ী প্রতাপশালীরা সব সময়ই তাদের ভাষা বিজিত জাতিগুলোর উপর চাপিয়ে দিয়েছে। এভাবে পৃথিবী থেকে অনেক ভাষা হারিয়ে গেছে। একটি ভাষার বিলুপ্তি মানে সভ্যতার একটি অমূল্য অংশ ধ্বংস হয়ে যাওয়া।
পৃথিবীর বিশ কোটিরও অধিক লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে। প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে বাংলা ভাষার জন্ম। অনেক বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে এ ভাষা সমৃদ্ধ হয়েছে।
বাংলা ভাষার ব্যাকরণগত সূক্ষ্ম বিচার বিশ্লেষণ এখানে উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য বাংলা ভাষার পরিবর্তন প্রবণতাকে রোধ করার প্রয়াস পাওয়া। এই পরিবর্তন প্রবণতাকে রোধ করতে না পারলে পরিবর্তন হতে হতে এককালে বাংলা ভাষা হারিয়ে যাবে, যেমন হারিয়ে যাচ্ছে পালি, সংস্কৃত, হিব্রু, ল্যাটিন ভাষা ইত্যাদি। ১৯০৭ সালে নেপালের রাজ দরবার হতে প্রাপ্ত পুঁথি আমাদের নিকট ‘চর্যাপদ’ নামে পরিচিত। এই চর্যাপদকেই বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন রূপে ধরা হয়। দ্বাদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত সময় কালকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মধ্যযুগ বলে ধরা হয়। রচিত হয় মঙ্গল কাব্য ও বৈষ্ণব পদাবলী।
ভাষা গতিশীল ও সদা পরিবর্তনশীল। একটি ভাষার অনেক আঞ্চলিক রূপ বা উপভাষা রয়েছে। এমনকি ব্যক্তি বিশেষের স্বভাষাও গ্রহণযোগ্য যার জন্ম মানুষের দীর্ঘ সময় ধরে বিশেষ বাচন ভঙ্গিতে কথা বলার চর্চার কারণে। ভাষা পরিবর্তনশীল এবং এর পরিবর্তন অনিবার্য ভাষার নমনীয়তা অন্য ভাষা থেকে পরিগ্রহণ এবং অন্য অসংখ্য ভাষার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকা একটি ভাষার অস্তিত্বকে দীর্ঘায়িত করে এবং তাকে অবলুপ্তি থেকে রক্ষা করে। আবার এ কথাও সত্যি একই ভাষা গোষ্ঠীর মধ্যেও সামাজিক শ্রেণি বিন্যাসের প্রভাবে ভাষাগত বিচ্ছিন্নতা বা বিভাজন ঘটতে পারে। তবে এর ব্যাপকতা অবশ্যই সংকীর্ণ পরিসরে হয়ে থাকে। যদি বিভিন্ন উপভাষা একই ভৌগোলিক সীমারেখায় কোনো একটি ভাষাগোষ্ঠীর সঙ্গে সহ-অবস্থান করে তবে এ ভাষাগুলো পরস্পরকে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রভাবিত করে সবগুলো ভাষাতেই কমবেশি পরিবর্তন আসে। এটি মূলত হয় পারস্পরিক সমঝোতা স্থাপনের প্রয়োজনে। বাংলা ভাষার আজকের রূপটা এই পরিবর্তনেরই ফলশ্রুতি।
ভাষা তার নিজস্ব গতিতে চলে। নদীর গতির সঙ্গে এর তুলনা করা হয়। অর্থাৎ নদী যেমন তার ইচ্ছামতো গতিপথ পরিবর্তন করে, ভাষাও তেমনি তার গতিপথ পরিবর্তন করে। দেশব্যাপী প্রতিটি গ্রামে আছে প্রাথমিক বিদ্যালয়, প্রতিটি বিদ্যালয়ে আছে একই রকম সিলেবাসের একই রকম বই-পুস্তক। আর আছে একই রকম প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক। এর ফলে, ধীরে ধীরে বাংলা ভাষার উপর আঞ্চলিক প্রভাব কমে আসছে অর্থাৎ বিভিন্ন অঞ্চলের একই বর্ণের বা শব্দের উচ্চারণের তারমতম্য কমে আসছে। এখন চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহে প্রভৃতি জেলার লোকদের কথাবার্তা থেকে বুঝা যায় না যে তারা বিভিন্ন জেলার অধিবাসী। এটা নিঃসন্দেহে আনন্দের কথা।
আমাদের ভাষার পরিবর্তন প্রবণতা বিভিন্ন ধরনের যথা- বর্ণের উচ্চারণের পরিবর্তন প্রবণতা। বর্ণের উচ্চারণ দুই প্রকার। দেখা যায় শুদ্ধ উচ্চারণ এবং বিকৃত উচ্চারণ। ‘অ’- শুদ্ধ উচ্চারণ ‘অ’ যেমন অশোক। বিকৃত উচ্চারণ ‘ও’ যেমন ওতি। ‘এ’ শুদ্ধ উচ্চারণ ‘এ’ যেমন এসো। বিকৃত উচ্চারণ ‘এ্যা’ যেমন এ্যাক। কেউ কেউ সত্য, লক্ষ্য, কল্যাণ ও বন্যাকে, - সোত্য, লোক্ষ্য, কোল্যাণ, বোন্যা, এমনতর উচ্চারণ করার পক্ষে মত দিয়ে থাকেন। তারা যুক্তি দেখান ‘দ্বিতীয়’ বর্ণে ‘য’ (য) থাকলে প্রথম বর্ণের উচ্চারণ করতেও সহগ করার প্রবণতা আসে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায় বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী কিছু এলাকা বাদে সমগ্র দেশটির গ্রামেগঞ্জে ও স্কুল কলেজে সকলেই সত্য, লক্ষ্য, কল্যাণ, বন্যা উচ্চারণ করে প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ। উচ্চারণ অভ্যাসের ব্যাপার। যে, যেটি অভ্যাস করে ফেলবে, সেটিই তার কাছে সঠিক মনে হবে।
প্রচলিত, প্রতিষ্ঠিত এবং শুদ্ধ বানানটিকেও পরিবর্তন করে ভিন্নরূপ দেয়া হচ্ছে। যেমন- শ্রণীকে শ্রেণি, কাহিনীকে কাহিনি, সুধীকে সুধি, গোষ্ঠীকে গোষ্ঠি, পদবীকে পদবি, শহীদকে শহিদ, আরবী কে আরবি লেখা হচ্ছে। বাংলা ভাষায় হ্রস্বই-কার ()ি এবং দীর্ঘ ঈ-কার (ী) নামে দুটি ধ্বনি প্রতীক আছে। বাংলা সহ প্রায় সব আধুনিক ভাষায় ঈ-কারকে স্ত্রী প্রত্যয় হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। এই প্রত্যয়টি দিয়ে পুংলিঙ্গ শব্দকে স্ত্রী লিঙ্গ করা হয়, যেমন- জনক-জননী, নদ-নদী, মানব-মানবা, নর্তক-নর্তকী, পতি-পত্নী, গুণবান-গুণবতী, রূপবান-রূপবতী, বুদ্ধিমান-বুদ্ধিমতী, বৈষ্ণব- বৈষ্ণবী ইত্যাদি।
বাংলা ভাষায় ঈ-কার দিয়ে অসংখ্য শব্দ লিখিত আছে। যেমন-জ্ঞানী, গুণী, ধনী, মানী, বিনয়ী, গৃহী, ত্যাগী, সুখী, দুঃখী, পাপী, তাপী, ভোগী, রোগী, লোভী, বিদেশিনী, কামিনী, বিনোদিনী, মায়াবিনী, করণীয়, বরণীয়, জাতীয়, ধর্মীয়, পূজনীয়, আত্মীয়, পালনীয়, শাস্ত্রীয়, লোভনীয়, জীবন, স্বাধীনতা, স্বীকৃত, সীমা, গভীর, পৃথিবী ইত্যাদি। সুতরাং ভাষা পরিবর্তনের বানানে ঈ-কারকে আমরা কখনই বাদ দিতে পারছি না। ‘ঈ’ কারকে যখন বাদ দেয়া যাচ্ছে না তখনতো সমতার প্রশ্নই আসে না। বলা হচ্ছে- বিদেশী, দেশী এবং তদ্ভব শব্দে ই-কার দিতে হবে। সেই নিয়ম পালন করতে গিয়ে এখন আমরা আরবীকে আরবি, শহীদকে শহিদ, লাইব্রেরীকে লাইব্রেরি, সরকারীকে সরকারি লিখছি। বাংলা ভাষার বানান সংস্কারের আমরা বিরোধিতা করছি না। কিন্তু যে বানানটি সাহিত্যে এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, তার পরিবর্তন করার কোন প্রয়োজন দেখি না।
বাংলা ভাষার পরিবর্তন প্রবণতার মধ্যে অভ্যাস, মানসিকতা এবং অনুকরণ প্রিয়তা কাজ করছে। আমাদের মুখের ভাষা চলতি ভাষা। অথচ আমাদের চলতি ভাষা নিয়ে আমরা গৌরব বোধ করি না।
সবশেষে একটি প্রশ্ন : কোনো একদিন আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলা কি হারিয়ে যাবে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে? না তা’ যাবে না।
আধুনিক প্রিন্ট, ইলেকট্রোনিক মিডিয়া সর্বোপরি তথ্য প্রযুক্তির যুগে চেষ্টা করলে কোনো ভাষাই হয়তো পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে না শেষ পর্যন্ত। তবে প্রতিনিয়ত নিয়মিত ভাষা চর্চার ব্যাপারটা অব্যাহত রাখতে হবে প্রতিদিন। ভাষা হলো বহতা নদীর মতো। তার মুখে পলিমাটি জমতে দেয়া যাবে না কোনো কিছুইতেই।