ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৩ জুলাই ২০২৫, ১৮ আষাঢ় ১৪৩২

সফলতার রহস্য, সময়কে শাসন করুন

মোঃ তানভীর হাসান, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, মঠবাড়িয়া, পিরোজপুর

প্রকাশিত: ০৮:২২, ২ জুলাই ২০২৫

সফলতার রহস্য, সময়কে শাসন করুন

সংগৃহীত প্রতীকী ছবি

আজকের দ্রুতগতির ও প্রতিযোগিতামূলক কর্মজগতে টিকে থাকা এবং সফলতার শিখরে পৌঁছানো অনেকটাই নির্ভর করে একটি অভ্যন্তরীণ দক্ষতার ওপর,তা হলো সময় ব্যবস্থাপনা এবং নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগের মাধ্যমে কাজের প্রতি সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দেখানো। শুধু কাজ করলেই হয় না, বরং কীভাবে সেই কাজ করা হচ্ছে, কতটা ফোকাস নিয়ে তা করা হচ্ছে সেটিই শেষ পর্যন্ত সাফল্য নির্ধারণ করে।

প্রত্যেক সফল মানুষের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, বড় কোনো কাজের জন্য শুধু মাত্র সময় বরাদ্দ করলেই হয় না, সেই সময়টিকে হতে হয় ব্যাঘাতহীন এবং চিন্তায় পূর্ণ মনোযোগের। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমরা যখন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে বসি, তখন সেটিতে পুরোপুরি মন বসাতেই প্রায় ত্রিশ মিনিট চলে যায়। আর মন একবার স্থির হলে, তখন পরবর্তী পঁয়ত্রিশ থেকে পঁচানব্বই মিনিটের মধ্যেই সেই কাজটি সুচারুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। এটি আমাদের মস্তিষ্কের কাজের ধরণ ও মনঃসংযোগের প্রাকৃতিক নিয়মেরই অংশ।

তবে আধুনিক জীবনে সময়ের সবচেয়ে বড় শত্রু হলো বিচ্ছিন্নতা ও বিরক্তি। নানান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ফোন কল, কিংবা অফিসের সহকর্মীদের হঠাৎ উপস্থিতি আমাদের মনোযোগ ভেঙে দেয়। অনেকেই এসব থেকে মুক্তি পেতে গিয়ে হতাশ হয়ে পড়েন। অথচ এই সমস্যার রয়েছে একটি কার্যকর সমাধান তা হলো,একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে সেটিকে ঘোষণা করে দেওয়া- এই সময়টুকু আমার কাজের জন্য, আমাকে বিরক্ত করবেন না। বিশ্বজুড়ে সফল ব্যক্তিরা অফিস কক্ষে Do Not Disturb বোর্ড ঝুলিয়ে নিরবচ্ছিন্ন কাজের সময় নিশ্চিত করেন। এই অভ্যাস একদিকে যেমন মনোযোগ ধরে রাখে, অন্যদিকে তৈরি করে শৃঙ্খলার এক অনন্য সংস্কৃতি।

আমার নিজের অভিজ্ঞতায় এমনই একজন হিসাবরক্ষকের কথা মনে পড়ে, যিনি বারবার কাজের মাঝে প্রতিবন্ধকতার কারণে সময়মতো রিপোর্ট জমা দিতে পারছিলেন না। আমি তাঁকে পরামর্শ দিই প্রতিদিন সকালের একটি নির্দিষ্ট সময় এবং দুপুরবেলার একটি সময় সম্পূর্ণভাবে নিজের কাজে নিবিষ্ট থাকার জন্য বরাদ্দ রাখতে এবং দরজায় 'বিরক্ত করবেন না' সাইন ঝুলিয়ে রাখতে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর কর্মদক্ষতায় দৃষ্টান্তমূলক পরিবর্তন আসে। তিনি পূর্বের ফেলে রাখা কাজগুলো শেষ করেন এবং প্রতিষ্ঠানের কাছে সময়মতো আর্থিক বিবরণীও দিতে সক্ষম হন।

সময়ের এমন সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা শুধু কর্মক্ষেত্রেই নয়, ব্যক্তিজীবনেও গুণগত পরিবর্তন আনে। বিশেষ করে যাঁরা সৃজনশীলতা বা উদ্ভাবনী চিন্তার সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের জন্য তো এটি আরও জরুরি। উদ্ভাবনী কাজের জন্য প্রয়োজন হয় গভীর ভাবনার, ধীর ও পরিকল্পিত চিন্তাশক্তির। অন্যদিকে, প্রশাসনিক বা কর্তব্যমূলক কাজের জন্য প্রয়োজন হয় দ্রুত সিদ্ধান্ত ও বাস্তবায়নের। এই দুই ধরনের কাজকে একসাথে করা মানেই দুটি কাজের প্রতি অবিচার করা। একজন পেশাদারকে অবশ্যই বুঝতে হবে কখন সে কোন ধরনের মানসিক অবস্থা বা চিন্তার স্তরে অবস্থান করছেন।

সাফল্য পেতে হলে নিজেকে নিজের সময়ের মালিক বানাতে হয়। একান্ত সকালের সময়টুকু যদি আপনি অন্যদের আগে অফিসে পৌঁছে কাজে লাগাতে পারেন, তাহলে আপনিই হতে পারেন বাকিদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি কার্যকর। দিনের মাঝখানের লাঞ্চ ব্রেকের সময়টিও হতে পারে একান্ত মনোযোগের জন্য আদর্শ সময়। আবার অফিস শেষে কিছু অতিরিক্ত সময় ব্যয় করে সারাদিনের কৃতকর্ম বিশ্লেষণ করলে বা অসম্পূর্ণ কাজগুলো সম্পন্ন করলে, তা আপনার সামগ্রিক সাফল্যকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে।

আমাদের সমাজে এখনও অনেকেই মনে করেন যে, সফলতা কেবল মেধার ফল। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সফলতা মূলত অভ্যাসের ফল। এবং সময় ব্যবস্থাপনা সেই অভ্যাসগুলোর মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী একটি। আপনি যদি প্রতিদিন নিরবচ্ছিন্নভাবে নির্দিষ্ট কিছু সময় শুধু নিজের প্রয়োজনীয় কাজের জন্য বরাদ্দ রাখতে পারেন—কোনো ফোন নয়, কোনো সামাজিক মাধ্যম নয়, শুধু নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগ—তাহলে আপনি অচিরেই অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে উঠবেন।

স্মরণ রাখতে হবে, আমরা সবাই সম্ভাবনাময়। প্রতিটি মানুষের মধ্যেই থাকে এক বা একাধিক সৃজনশীল গুণ। কিন্তু সেই গুণ বিকশিত হয় তখনই, যখন আমরা আমাদের সময়কে ছোট ছোট একক হিসেবে বিভক্ত করে, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে, মনোযোগ ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজে লাগাই।

আজকের এই প্রযুক্তিনির্ভর, বিচ্ছিন্নতায় ভরা, মনোযোগ-সংকটের যুগে, সময় ব্যবস্থাপনা ও একাগ্রতার গুরুত্ব আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বহুগুণ বেশি। যে ব্যক্তি সময়ের মূল্য বোঝে এবং সেটিকে পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করে, সেই-ই দীর্ঘ দৌড়ে জয়ী হয়। আর শেষ পর্যন্ত এই জয়ই হয়ে দাঁড়ায় তার জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য।

সাব্বির

×