ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৮ জুন ২০২৫, ১৪ আষাঢ় ১৪৩২

শহরের গলির নাম ধরে ব্যঙ্গের বুলেট ছুঁড়েছিলেন তিন তরুণ কবি

ঢাকা-ঢিক্কি: পুরান ঢাকাকে ঘিরে ব্যঙ্গ-ছড়ার দলিল

রিজওয়ান করিম, সিনিয়র ফটোসাংবাদিক, লেখক

প্রকাশিত: ১৮:৪২, ২৮ জুন ২০২৫; আপডেট: ১৮:৫০, ২৮ জুন ২০২৫

ঢাকা-ঢিক্কি: পুরান ঢাকাকে ঘিরে ব্যঙ্গ-ছড়ার দলিল

ছবি: সংগৃহীত

“ফাগুনের গুণে সেগুনবাগানে আগুন বেগুন পোড়ে...”
এই একটি চরণই বোঝাতে যথেষ্ট এই কবিতা আসলে রসের নামে এক ধরনের বিদ্রূপ, শহরের পাড়া-মহল্লার গায়ে মজা-মেশানো চাবুক। নাম ‘ঢাকা-ঢিক্কি’। রচনাকাল—১৯৩০।  রচয়িতা—বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত ও অজিত দত্ত। তিন তরুণ কবি, কলকাতায় অবস্থানরত, কিন্তু ঢাকাকে নিয়ে এমন একটি কবিতা রচনা করলেন, যা আজও বাংলা ব্যঙ্গকাব্যের ইতিহাসে এক অনন্য দলিল।

১৯৩০ সালের ঢাকা তখন ব্রিটিশ পরাধীন। শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, নাগরিক রুচিতে ঢাকা অনেকটাই পিছিয়ে। ঠিক সেই সময়, তরুণ ‘কালিদাস গাহিনী’ কবিতার নামে ঢাকাকে দাঁড় করালেন আয়নায়। তবে সে আয়না রুপালি নয়—তার গায়ে জং, চশমার কাচ ভাঙা, আর প্রতিবিম্বে মুখ বাঁকা।


‘ঢাকা-ঢিক্কি’ তাই শুধু কবিতা নয়, এ এক শহরের ব্যর্থতা ও ভণ্ডামিকে ঠোঁটকাটা কাব্যিক বিদ্রুপ।

এই ব্যঙ্গকবিতার সবচেয়ে চমকপ্রদ দিক হচ্ছে, পুরান ঢাকার প্রায় অর্ধশতাধিক জায়গার নাম নিয়ে কবিতায় তা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে এক ধরণের অনুপ্রাস আর স্যাটায়ারের ভেতর।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়:

‘ঠাঠারিবাজারে ঠাঠা ঠেকিয়াছে ঠিক’

‘উয়ারির কুয়ার ধুয়ায় চুঁয়ায় গুয়ার গুঁয়া’

‘মৈসুণ্ডির মুণ্ডে গণ্ডগোল’

‘টিকাটুলিতে টিকে টিকিট কাটে টিকটিকি’

শব্দের এমন ঘূর্ণি শুধু শব্দচাতুর্য নয়, এটি একটি নির্দিষ্ট শ্রেণি, সংস্কৃতি, এমনকি মানসিকতা নিয়ে ব্যঙ্গ।

এই কবিতায় আমরা দেখি ঢাকার গলির নামগুলো শুধু স্থানের প্রতিনিধিত্ব করছে না, বরং চরিত্রে পরিণত হয়েছে।
‘বংশালে’ বংশে শিক,
‘নারিন্দ্যা’ যেন গন্ধে অন্ধ,
‘বক্সীবাজারে’ বারবার নক্সা বানানো হচ্ছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
সব মিলিয়ে, যেন একটা অকার্যকর শহর, রঙিন অথচ ভিতরে ফাঁপা।

ঢাকা-ঢিক্কি আসলে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক বিশেষ জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। কারণ, এটি সাহিত্যে একটি জায়গাকে নিয়ে রীতিমতো গঠনমূলক ব্যঙ্গ রচনা। তখনকার সাহিত্যে যত ঢাকাকে গাওয়া হয়েছে প্রশংসায়, তার চেয়ে বেশি অনুপস্থিত থেকেছে একধরনের আত্মসমালোচনার দৃষ্টিভঙ্গি। এই কবিতা সেই শূন্যস্থান পূরণ করেছে।


বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত ও অজিত দত্ত—এই তিনজন কলকাতায় বসেই রচনা করলেন ঢাকার নামে এই কবিতাটি। কেউ কেউ বলেন, এটি এক চায়ের আড্ডায় জন্ম নেয়া চটুল সৃষ্টি; কেউ বলেন, এটি ছিল একেবারে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ। যাই হোক, কবিতাটি ছড়িয়ে পড়েছিল দ্রুত, মুখে মুখে। সাহিত্যপত্রে প্রকাশ হয়নি তখনই, কিন্তু এই কবিতার নামে ঢাকাকে ‘ঢিক্কার’ দেওয়া শুরু হয়েছিল।

সময়ের ব্যবধানে ঢাকাও বদলেছে, কবিতার গ্রহণযোগ্যতাও। আজ হয়তো কেউ একজন পুরান ঢাকার টিকাটুলির গলিতে হেঁটে চলেছে, পাশ দিয়ে যাচ্ছে রিকশা, চায়ের দোকানে বাজছে সিনেমার গান। সে জানেই না, এই গলিকে নিয়েই একসময় লেখা হয়েছিল‘টিকে টিকটিকি টিকিট কাটে টিকাটুলি’।

শুধু শহরের নয় মানুষের, ভাষার, সংস্কৃতির, এবং একটা সময়ের প্রতিচ্ছবি এই ব্যঙ্গকবিতা।
তাই হয়তো এখন বলাই যায় “ঢাকাকে গাল দিতে হয়, কারণ খুব ভালোবেসে ফেলেছি!”

‘ঢাকা-ঢিক্কি’ কবিতাটি মূলত মৌখিক ও পরোক্ষভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। কবিতাটি কোনও প্রকাশিত গ্রন্থে প্রথমদিকে ছাপা হয়নি। পরে কয়েকটি সাহিত্য সংকলনে এর খণ্ডাংশ প্রকাশিত হয়। বর্তমানে এটি বাংলা ব্যঙ্গসাহিত্যের পাঠ্যতালিকাতেও স্থান পেয়েছে। এবং বিভিন্ন সাহিত্যচর্চার দলিল ও সংকলনে এটি সংরক্ষিত রয়েছে।


সংযুক্ত কবিতা:

ঢাকা-ঢিক্কি

রচনাকাল: ১৯৩০ | রচয়িতা: বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত ও অজিত দত্ত

ফাগুনের গুণে 'সেগুনবাগানে' আগুন বেগুন পোড়ে,
ঠুনকো ঠাটের 'ঠাঠারিবাজারে' ঠাঠা ঠেকিয়াছে ঠিক;
ঢাকার ঢেঁকিতে ঢাকের ঢেঁকুর ঢিঢিক্কারেতে ঢোঁড়ে,
সং 'বংশালে' বংশের শালে বংশে সেঁধেছে শিক।

ভুয়া 'উয়ারির' কুয়ার ধুয়ায় চুঁয়ায় গুয়ার গুঁয়া,
বাছা 'এছাকের' কাছার কাছেতে কাছিমের কাছি আছে;
'চকের' চাকু-চাক্কায় চিকা চকচকি চাখে
চুয়া 'সাঁচিবন্দরে' মন্দোদরীরা বন্দী বান্ধিয়াছে।

পাষণ্ড ঐ 'মৈসুণ্ডির' মুণ্ডে গণ্ডগোল,
'সুত্রাপুরের' সূত্রধরের পুত্রেরা কাত্রায়,
'লালবাগে' লাল ললনার লীলাললিত-লতিকা-লোল

'জিন্দাবাহার' বৃন্দাবনেরে নিন্দিছে সন্ধ্যায়!

'বক্সীবাজারে' বাক্সে নক্সা মকশো একশোবার,
রমা রমণীরা 'রমনায়' রমে রম্যা রম্ভাসম;
'একরামপুরে' বিক্রি মাকড়ি লাকড়ি শুক্রবার,
গন্ধে অন্ধ 'নারিন্দ্যা' যেন বিন্দু ইন্দুপম।

চর্মে ঘৰ্ম্ম 'আৰ্ম্মেনিটোলা' কর্মে বৰ্ম্মাদেশ,
টাকে-টিকটিকি-টিকি 'টিকাটুলি' টিকার টিকিট কাটে,
'তাঁতিবাজারের' তোৎলা তোতার তিতা-তরে পিত্যেশ,
'গ্যাণ্ডারিয়ার' ভণ্ড গুণ্ডা চণ্ড চণ্ড চাটে॥

শিহাব

×