ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৯ জুন ২০২৫, ১৬ আষাঢ় ১৪৩২

অচলাবস্থার অবসান চান ব্যবসায়ীরা ॥ প্রতিদিন ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার আমদানি- রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে ॥ সংবাদ সম্মেলনে দাবি

এনবিআরে শাটডাউন অশনি সংকেত

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ২৩:২৮, ২৮ জুন ২০২৫

এনবিআরে শাটডাউন অশনি সংকেত

অচলাবস্থার অবসান চান ব্যবসায়ীরা

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচির ফলে আমদানি ও রপ্তানি ক্ষেত্রে বিপর্যয় নেমে আসবে, যা হবে দেশের অর্থনীতির জন্য একটি অশনি সংকেত। কমপ্লিট শাটডাউনের ঘোষণায় দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী ও শিল্প উদ্যোক্তারা চরম উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এই আন্দোলনের কারণে প্রতিদিন প্রায় ২,৫০০ কোটি টাকার আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে উল্লেখ করে অচলাবস্থা নিরসনে আলোচনা করে দ্রুত সমাধান চেয়েছেন ব্যবসায়ী নেতারা। 
শনিবার রাজধানীতে একটি হোটেলে এনবিআরের বর্তমান অচলাবস্থা নিয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তারা এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন। তারা সমস্যা নিরসনে আর সময় ব্যয় না করে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের নেতৃত্বে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ যথা অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বিডা যৌথভাবে আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসা অতীব জরুরি বলে মনে করেন। একইসঙ্গে দেশের অর্থনীতির স্বার্থে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কলম বিরতি বা কমপ্লিট শাটডাউনের মতো কর্মসূচি প্রত্যাহার করে কাজে যোগদান করার আহ্বান জানিয়েছেন।
আন্দোলনের কারণে চলমান অচলাবস্থায় উদ্বেগ জানিয়ে ব্যবসায়ী নেতা ও বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, ‘চলমান অচলাবস্থার কারণে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তার সঠিক গুরুত্ব সরকার বুঝছে না। (আন্দোলনরতদের সঙ্গে) এই মিটিং মঙ্গলবার ডাকা হয়েছে কেন, আজই আলোচনা করে এর সমাধান হতে হবে।’
এনবিআর কর্মকর্তাদের ‘কমপ্লিট শাটডাউনের’ কারণে প্রতিদিন প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ আমদানি ও রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, চলমান স্থানীয় ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা চাপে আছেন। নতুন করে এনবিআরের অচলাবস্থার কারণে তাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে যাবে। এই সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী এ থেকে ফিরে আসা উচিত’।
ব্যবসায়ী নেতারা আন্দোলনরত এনবিআর কর্মকর্তাদের আজকের মধ্যে আন্দোলন প্রত্যাহার করার আহ্বান জানান। 
লিখিত বক্তব্যে বাংলাদেশ চেম্বার অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী বলেন, ‘সমস্যা নিরসনে মোটেও সময় ব্যয় না করে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের নেতৃত্বে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ অর্থাৎ অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) যৌথভাবে আন্দোলনরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসা জরুরি।’ এ সময় তিনি আন্দোলনরত কর্মকর্তাদের কোনো ধরনের পূর্বশর্ত ছাড়া কাজে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। 
ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশের (আইসিসিবি) সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘যেকোনো দেশের সরকারের সঙ্গে বেসরকারি খাতের মিথস্ক্রিয়া (ইন্টারেকশন) অতীব জরুরি। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সঙ্গে এ বেসরকারি খাতের সংলাপ কিংবা ইন্টারেকশন স্তিমিত।’
এনবিআর শাটডাউনের কারণে আমদানি-রপ্তানির ক্ষতির বিষয়টি উল্লেখ করে লেদার অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, ‘স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার আমাদের জন্য, বাংলাদেশের জন্য অপেক্ষা করবে না। যুদ্ধ ছাড়া কোন দেশের কাস্টমস বন্ধ থাকে, এটা আমাদের জানা নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘এনবিআরে অনেক সৎ অফিসার আছেন। বর্তমান সংস্কারের ফলে তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে, সেটি বলার অধিকার তাদের আছে। আমরা এনবিআরের সংস্কার চাই। তবে এনবিআরের অফিসারদের ভবিষ্যৎ কী, সে বিষয়টিও সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে।’
‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বর্তমান অচলাবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী ও শিল্প উদ্যোক্তাদের সংবাদ সম্মেলন’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে লিখিত বক্তব্য পড়েন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী (পারভেজ)। 
তিনি বলেন, এনবিআরের অন্তর্ভুক্ত দপ্তরগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কলম বিরতির পরিপ্রেক্ষিতে দেশের আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। ওই দপ্তরগুলোর কার্যক্রম সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চালু থাকায় প্রস্তুত/রপ্তানিকারকরা যথাসময়ে আমদানি করা কাঁচামাল খালাস করতে পারছেন না। ফলে দেশের রপ্তানিতে বর্ধিত লিড টাইম আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তা ছাড়া পোর্টে/বিমানবন্দরে আমদানি-রপ্তানিযোগ্য পণ্য পড়ে থাকার দরুন বৃষ্টি/রোদে নষ্ট হচ্ছে। আংশিক কর্মঘণ্টার কারণে এক কর্মদিবসের মধ্যে প্রত্যাশিত ইউপি পেতে ১০-১৫ দিন সময় লেগে যাচ্ছে। যাতে রপ্তানি বিলম্বিত হচ্ছে। 
সৃষ্ট জটিলতার কারণে কিছু কিছু বায়ার ইতোমধ্যে এয়ার শিপমেন্ট ও রপ্তানি আদেশ বাতিলের হুমকি দিয়েছেন। পাশাপাশি পোর্ট ড্যামারেজ নির্ধারিত রেটের চারগুণ হারে পরিশোধ করতে হচ্ছে, যা ‘কস্ট অব ড্রইং বিজনেস’ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বর্তমান জুন-জুলাই মাসে তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য, পাদুকা, সিরামিক, ফার্মাসিউটিক্যাল, এগ্রো প্রসেসিং, প্লাস্টিকসহ সব রপ্তানিমুখী শিল্পের অধিকাংশ কারখানায়ই আগামী শীত মৌসুমের পণ্য তৈরির জন্য চাপ রয়েছে। এই পিক সিজনে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট ও কাস্টমস হাউজের মতো গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলোর অচলাবস্থার কারণে সঠিক সময়ে পণ্য রপ্তানি করতে না পারলে বায়াররা ক্রয়াদেশ বাতিল ও ভবিষ্যতে নতুন ক্রয়াদেশ প্রদানে অনাগ্রহী হতে পারেন। 
আন্তর্জাতিক রপ্তানি বাজার কখনো বাংলাদেশের জন্য অপেক্ষা করবে না। এসব অর্ডার পার্শ্ববর্তী দেশে চলে যাবে, যা হবে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি অপূরণীয় ক্ষতি। এছাড়া উৎপাদিত পণ্য সঠিক সময়ে না পাঠাতে পারলে প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসায়িক ও আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী বলেন, জুন মাসেই ব্যবসায়ীদের ওপর বার্ষিক ব্যাংক ঋণের মুনাফা জমা দেওয়ার একটি চাপ থাকে। এই সময়ে এসব বিরোধের কারণে পণ্য রপ্তানি করতে না পারলে বায়ার কর্তৃক পেমেন্ট রিয়ালাইজেশন হবে না। ফলে ব্যবসায়ীরা একটি কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে। বর্তমানে দেশের রপ্তানিকারী শিল্প নানাবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। এমতাবস্থায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গৃহীত আন্দোলন বায়ারদের মধ্যে পুনরায় ইমেজ সংকট সৃষ্টি করবে, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, আজ থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অন্তর্ভুক্ত সব দপ্তরের কমর্কর্তা-কর্মচারীরা কমপ্লিট শাটডাউনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এই সময়ে ওই দপ্তরগুলোর কার্যক্রম বন্ধ হলে তা আমদানি ও রপ্তানিকারকদের ওপর বিপর্যয় নিয়ে আসবে, যা হবে দেশের অর্থনীতির জন্য একটি অশনিসংকেত। সুতরাং ওই আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট স্থবিরতা ও চলমান সংকট দ্রুততার সঙ্গে সমাধান করা অতীব জরুরি।
ব্যবসায়ীরা বলেন, বাংলাদেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায় একটি দক্ষ, হয়রানিমুক্ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ড গড়ার লক্ষ্যে এ সার্বিক সংস্কার বা আধুনিকায়নকে সমর্থ করে, যা দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যবসা ও আমদানি-রপ্তানিতে যথাযথ সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি ও রাজস্ব আহরণে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। তবে সে ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের অপসারণ কোনো মতেই কাম্য নয় এবং তা কোনো প্রকার সফলতা নিয়ে আসবে বলে আমরা মনে করি না।
উল্লেখ্য, শনিবার থেকে শুরু হওয়া এনবিআর কর্মকর্তাদের কমপ্লিট শাটডাউনের কারণে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। কেবল আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা কার্যক্রম সচল আছে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশের সব কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর অফিসেও সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সহ-সভাপতি মির্জা আশিক রানা বলেন, ‘কমপ্লিট শাটডাউন’-এর কারণে আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা বাদে সব কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআরের চলমান অচলাবস্থা নিরসনে মঙ্গলবারে বৈঠকে যোগ দেওয়ার প্রস্তুতির কথা জানিয়েছে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সভাপতি ও অতিরিক্ত কমিশনার হাসান মোহাম্মদ তারেক রিকাবদার।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা আলোচনায় বসতে চাই, মঙ্গলবারের বৈঠকে যোগ দিতে প্রস্তুত।’ তবে এখনো বৈঠকের জন্য কোনো আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ পাওয়া যায়নি বলেও জানান তিনি। বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়নি, তবে এনবিআরের ১৬ জন সদস্য অনানুষ্ঠানিকভাবে যোগাযোগ করেছেন।’
এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান খানকে অপসারণ দাবিতে শনিবার পূর্বঘোষিত পূর্ণ কর্মবিরতি এবং ‘মার্চ টু এনবিআর’ কর্মসূচি পালন করছে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ। এ মাসের শুরু থেকে আন্দোলনরত কর্মকর্তারা কর, ভ্যাট ও শুল্ক কার্যালয়গুলোতে কর্মবিরতি, অনশন ও মানববন্ধন করে আসছেন। ফলে এসব সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
গত ১২ মে সরকারের এক অধ্যাদেশ জারির পর এই আন্দোলন শুরু হয়। ওই অধ্যাদেশের মাধ্যমে এনবিআর ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতিনির্ধারণ বিভাগ এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।

আরো পড়ুন  

×