
বাংলাদেশ বর্তমানে গভীর কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক চাপে রয়েছে
বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশ বর্তমানে গভীর কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক চাপে রয়েছে। ভারতের একের পর এক পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়াও ইউক্রেন ও মালয়েশিয়ার পদক্ষেপগুলো দেশের অর্থনীতি এবং পররাষ্ট্রনীতি নতুন সংকটে তৈরি করছে। এ সকল সংকট কাটিয়ে উঠতে না পারলে দেশের পররাষ্ট্রনীতি পিছিয়ে পড়াসহ অর্থনৈতিকভাবে সমস্যায় পড়বে বাংলাদেশ। এমনটিই মনে করছে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।
তাদের দাবি, বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ এটাকে সামনে রেখে ধীরস্থিরভাবে এগুতে পারলে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব বলেও মনে করেন তারা।
ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ নির্দেশনায় স্থলবন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশের বোনা কাপড়, পাট এবং সুতার তৈরি ৯টি পণ্যের আমদানি পুরোপুরি স্থগিত করেছে। এসব পণ্য স্থলবন্দর ব্যবহার করে পাঠানোর সুযোগ নেই। শুক্রবার এ সিদ্ধান্ত নেয় ভারত সরকার। যদিও সমুদ্র পথে নাভা শেভা বন্দর দিয়ে সীমিত আকারে এসব পণ্য প্রবেশের সুযোগ রাখছে ভারত।
এর আগে গত মে মাসে স্থলবন্দর দিয়ে তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য পণ্যের আমদানিতে প্রথম দফার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দেশটি। ফলে প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানির ওপর সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়। ভারতের এমন আচরণকে ‘শত্রুভাবাপন্ন’ বলছেন অনেক বিশ্লেষক। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণআন্দোলনের মুখে ভারত পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে দুই দেশের সম্পর্কে টানাপোড়েন বাড়তে থাকে বলে মনে করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাউথ এশিয়া উইংয়ের সঙ্গে মুটোফোনে যোগাযোগ করা হলে কল রিসিভ করেননি।
অন্যদিকে, রাশিয়া অধিকৃত ইউক্রেনীয় অঞ্চল থেকে বাংলাদেশে গম আসছে, এমন অভিযোগ তুলেছে কিয়েভ। ইউক্রেনের নয়াদিল্লি দূতাবাস থেকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একাধিক চিঠি পাঠিয়ে শস্য গ্রহণ না করার অনুরোধ জানানো হয়।
ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত ওলেকজান্ডার পলিসচুক রয়টার্সকে বলেন, এটি একটি অপরাধ। আমরা ইইউকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করব। বাংলাদেশের খাদ্য মন্ত্রণালয় অবশ্য দাবি করছে, যদি গমের উৎস ‘চোরাই’ প্রমাণিত হয়, তবে তা আমদানি করা হবে না।
এ ব্যাপারে পরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, এ বিষয়ে তারা অবগত রয়েছেন। আজ খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক হবে। সেখানে তথ্য উপাত্ত যাছাই করা হবে। সত্য হলে বাংলাদেশ সে ওয়েতে আগাবে।
কোনো সমস্যা হবে না কিনা জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, এটা বড় কোনো সমস্যা হবার কথা না। ইউক্রেন বরাবরই এমন করে থাকে। তাদের এ অভিযোগের ভিত্তিতে রাশিয়াও তাদের ফেইসবুক পেজে একটি বিবৃতি দিয়েছে সেটাও তো আপনাদের অজানা নয়।
মালয়েশিয়ায় আইএস সংশ্লিষ্টতা ও অবৈধ কার্যক্রমের অভিযোগে ৩৬ বাংলাদেশি প্রবাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এতে শ্রমবাজার ও রেমিটেন্সের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাউথ ইস্ট এশিয়া উয়িংয়ের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে ফোন রিসিভ করেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধাক্কায় বাংলাদেশি কর্মীদের নিয়োগ প্রক্রিয়া জটিল হতে পারে। এই বহুমুখী সংকটের প্রেক্ষাপটে সাবেক কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ সতর্কতা ও ধীরচিন্তায় পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, ‘সব পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশ চাপের মধ্যে রয়েছে সে কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে বাংলাদেশ নিজেদের মেধাকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে দক্ষতা ও কূটনৈতিক আলোচনার পরিবেশ তৈরি করতে পারলে এ সকল সমস্যার সমাধান নিশ্চিত করা যাবে।’ তবে এ সমস্যা শুধু এক পক্ষীয় তা নয়। প্রত্যেক দেশকেই স্ব স্ব অবস্থান থেকে ছাড় দেয়ার মন মানসিকতা নিয়ে এগুলেই কেবল সমষ্যা সমাধান সম্ভব।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন।
ভারতের ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘ভারত প্রতিবেশী দেশ। ভারত বাংলাদেশেরসহ প্রতিবেশী দেশ সম্পর্কে সজাগ দৃষ্টি রাখবে এটাই স্বাভাবিক। উভয় দেশের উচিত নিজ নিজ অবস্থান থেকে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা তৈরি করা।’
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের একটি মন্দির ভাঙার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করলেও দায়ভার অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপিয়েছে। অথচ বাংলাদেশের তরফ থেকে দ্রুত ও কার্যকর ব্যাখ্যা দিলে এমন পরিস্থিতি নাও হতে পারত।
তিনি আরও বলেন, আশার বিষয় হচ্ছে, ভারত বাংলাদেশের বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনায় রাজি হয়েছে। এখন বাংলাদেশ সে সময়টাকে দেশের স্বার্থে কাজে লাগাবে। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে উত্তেজনা প্রশমিত ও সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিভাগের (আইআর) এমিরেটস অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহম্মেদ বলেন, বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানো উচিত। সবদিক বিবেচনা করে সামনে এগুতে পারলে সমস্যার সমাধান সম্ভব।’ তিনি বলেন, বর্তমান সরকার কারও পক্ষ নিয়ে কিছু করা ঠিক হবে না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যে দুর্বলতা খোঁজে বের করা এবং তা সমাধান নিশ্চিত করা।
এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র (নির্বাহী পরিচালক) অর্থনীতিবিদ আরিফ হোসেন খান জনকণ্ঠকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কঠিন পরীক্ষা অতিক্রম করছে তা ঠিক। তবে সে পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠার মতো ক্ষমতা বাংলাদেশের রয়েছে।
বিশ্ব রাজনীতির এই অস্থির সময়ে বহুমুখী চাপ মোকাবিলায় বাংলাদেশের কূটনীতি ও বাণিজ্যকে আরও দূরদর্শী ও সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। না হলে অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জটিলতা আরও গভীর হতে পারে।
উল্লেখ্য, সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ভারতের মুখপাত্র বলেন, পারস্পরিক লাভজনক সংলাপের অনুকূল পরিবেশে বাংলাদেশের সঙ্গে স্বার্থসংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ে আলোচনায় রাজি ভারত।