ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৭ জুলাই ২০২৫, ২ শ্রাবণ ১৪৩২

১২ বছরের ছেলের কান্নায় কেঁপে উঠল আদালত, বাবার হেফাজত আদেশ ফিরিয়ে নিল সুপ্রিম কোর্ট!

প্রকাশিত: ১৪:২০, ১৭ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ১৪:২০, ১৭ জুলাই ২০২৫

১২ বছরের ছেলের কান্নায় কেঁপে উঠল আদালত, বাবার হেফাজত আদেশ ফিরিয়ে নিল সুপ্রিম কোর্ট!

ছবি: সংগৃহীত

বিচ্ছেদ হওয়া দম্পতির সন্তানের অভিভাবকত্ব নিয়ে আদালতের রায় কখনোই "কঠোর" বা "চূড়ান্ত" হতে পারে না, বরং সন্তানের সর্বোত্তম স্বার্থ বিবেচনায় আদালত তাদের আগের আদেশ পরিবর্তন করতেও সক্ষম—এ কথা জানিয়ে ১২ বছর বয়সী এক শিশুকে বাবার কাছে হস্তান্তরের রায় ফিরিয়ে নিল ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট।

বিচারপতি বিক্রম নাথ ও বিচারপতি প্রসন্ন বি বরালের বেঞ্চ জানিয়েছে, আগের অভিভাবকত্ব আদেশ শিশুটির উপর "বিপর্যয়কর প্রভাব" ফেলেছে এবং সে উদ্বেগজনিত সমস্যায় ভুগছে।

রায় অনুযায়ী, শিশুটির মা-বাবার বিয়ে হয় ২০১১ সালে এবং সে জন্মায় ২০১২ সালে। এক বছরের মাথায় তাদের বিচ্ছেদ ঘটে এবং শিশুটির অভিভাবকত্ব মায়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ২০১৬ সালে মা পুনরায় বিয়ে করেন। দ্বিতীয় স্বামীর আগের সংসারের দুটি সন্তান ছিল, এবং নতুন দম্পতির ঘরেও এক সন্তান জন্মায়।

পিতা আদালতে দাবি করেন, ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিনি জানতেনই না তার সন্তানের অবস্থান কোথায়। সেই সময় মা তাকে কিছু কাগজপত্রে সই করাতে যোগাযোগ করেন, কারণ তিনি ও তার দ্বিতীয় স্বামী সন্তানদের নিয়ে মালয়েশিয়ায় চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। তখনই তিনি জানতে পারেন, শিশুটির ধর্ম তার অজান্তে হিন্দু থেকে খ্রিস্টান হিসেবে পরিবর্তন করা হয়েছে।

এরপর তিনি ফ্যামিলি কোর্টে সন্তানের অভিভাবকত্বের আবেদন করেন, কিন্তু সেখান থেকে কোনো স্বস্তি পাননি। তিনি হাইকোর্টে আপিল করেন, যেখানে তার অনুকূলে রায় আসে। মা সুপ্রিম কোর্টে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন, কিন্তু ২০২৩ সালের আগস্টে তার আবেদন খারিজ হয়ে যায়।

পরে মা নতুন করে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানান, যেখানে তিনি বলেন, অভিভাবকত্ব পরিবর্তনের রায় শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের উপর "চরম নেতিবাচক প্রভাব" ফেলেছে। তার যুক্তিকে সমর্থন করে একটি ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়, যেখানে বলা হয়েছে, শিশুটি উচ্চমাত্রার বিচ্ছেদজনিত উদ্বেগে (separation anxiety disorder) ভুগছে।

আদালত জানায়, অভিভাবকত্ব নিয়ে আদেশ কখনোই "কঠোর" হতে পারে না, বরং তা "শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থে" পরিবর্তনযোগ্য হতে হবে। রায়ে বলা হয়, "সন্তানের কল্যাণই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যা বিভিন্ন কারণে পরিবর্তনশীল এবং কোনো নির্দিষ্ট ছাঁচে আটকে রাখা যায় না।"

আদালত উল্লেখ করে, শিশুটি যখন মাত্র ১১ মাস বয়সী তখন তার মা-বাবার বিচ্ছেদ হয় এবং এর পর থেকে শিশুটি খুব কমবারই বাবার সঙ্গে দেখা করেছে। “এই প্রেক্ষাপটে হঠাৎ করে অভিভাবকত্ব পরিবর্তনের মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া শিশুটির চেনা পরিবেশ ও মানসিক স্থিতিকে ভেঙে দেয়, যা সাধারণত ধাপে ধাপে পরিবর্তনের নীতির বিরোধী,” বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়।

আদালত শিশুটির মানসিক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে উল্লেখিত উদ্বেগ, আবেগ নিয়ন্ত্রণে সমস্যা এবং বিচ্ছেদ-ভীতির কথা তুলে ধরে জানায়, সিএমসি ভেলোরের মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা তাকে স্থিতিশীল ও আবেগগতভাবে সহায়ক পরিবেশে রাখার সুপারিশ করেছেন। “পরিবেশে হঠাৎ পরিবর্তন তার মানসিক স্বাস্থ্যের আরও অবনতি ঘটাতে পারে,” বলে সতর্ক করেন তারা।

আদালত জানায়, শিশুটি এখন কৈশোরের দ্বারপ্রান্তে এবং সে জন্মের পর থেকে মূলত মায়ের কাছেই মানুষ হয়েছে, যাকে সে তার “প্রধান অভিভাবক ও নির্ভরযোগ্য আশ্রয়” বলে মনে করে। “মনস্তাত্ত্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুঃসময়ে শিশুটি মায়ের কোলে আশ্রয় খোঁজে এবং তার উপস্থিতিকে শান্তিদায়ক বলে অনুভব করে।”

আদালত আরও জানায়, মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের সময় শিশুটির বয়স ছিল মাত্র চার বছরের কম। "এটি একটি সৌভাগ্যজনক দিক হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ শিশুটি ছোটবেলা থেকেই তার সৎ-পিতাকে পরিবারের অংশ হিসেবে দেখেছে এবং তাকে একজন গুরুত্বপূর্ণ পিতৃসত্তা হিসেবে গ্রহণ করেছে।" আদালতের মতে, সৎ-পিতাও শিশুটিকে আন্তরিক ভালোবাসা ও যত্ন দিয়ে আগলে রেখেছেন এবং তার শিক্ষাগত বিকাশে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন বলে আদালতসমূহে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

আদালত আরও উল্লেখ করে, শিশুটি তার সৎ ভাইকে আপন ভাই হিসেবেই দেখে এবং তার প্রতি গভীর ভালোবাসা দেখায়। “সুতরাং, এটি স্পষ্ট যে শিশুটি তার মা, সৎ ভাই ও সৎ-পিতাকে তার নিকটতম পরিবার হিসেবে দেখে এবং সেই পরিবেশে সে অত্যন্ত নিরাপদ বোধ করে। শুধুমাত্র পরিবারের কাঠামো আধুনিক বা ভিন্ন ধরনের বলেই তা খারাপ—এমন কোনো তথ্য রেকর্ডে নেই,” রায়ে বলা হয়।

তবে আদালত স্বীকার করেছে, শিশুর জীবনে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে চাওয়ার পিতার আকাঙ্ক্ষাও অস্বীকার করা যায় না। তাই মাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, শিশুর পিতার সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করতে হবে।

আদালত রায়ে বলেন, “এই রায়ের উপসংহারে উভয় পিতামাতাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি, সন্তানের পরিচর্যা তাদের প্রধান দায়িত্ব, যা পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের মাধ্যমে যোগাযোগ এবং এই ব্যবস্থার সুষ্ঠু বাস্তবায়নের মাধ্যমেই নিশ্চিত করা সম্ভব। অতীতের তিক্ততা যেন শিশুর মঙ্গলকে বাধাগ্রস্ত না করে, বিশেষ করে তার সংবেদনশীল মানসিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে।”

মা আদালতে অভিযোগ করেছিলেন, পিতা শিশুটিকে মায়ের কাছ থেকে আলাদা করার হুমকি দিয়েছিলেন, যা তার মানসিক অবস্থার আরও অবনতি ঘটায়। যদিও পিতা এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। আদালত বলেন, “দীর্ঘ অনুপস্থিতির পর পিতার সঙ্গে হঠাৎ করে সম্পর্ক গড়ে উঠবে—এমনটি প্রত্যাশা করা যায় না। একজন পিতার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক ধৈর্য, ক্রমাগত উপস্থিতি, দায়িত্বশীলতা এবং অগাধ ভালোবাসা, যত্ন ও সহমর্মিতার মাধ্যমেই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে।”

আবির

আরো পড়ুন  

×