ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৭ জুলাই ২০২৫, ২ শ্রাবণ ১৪৩২

উপন্যাস: ফিরে আসা ছায়া (পর্ব ৩)

মো. আইয়ুব মণ্ডল

প্রকাশিত: ১৪:৫৮, ১৭ জুলাই ২০২৫

উপন্যাস: ফিরে আসা ছায়া (পর্ব ৩)

ঢাকার বাতাসে ভোরের কুয়াশা তখনো গলে যায়নি। রাতের রোদের মতো টানটান অপেক্ষা করছে এক অজানা ভয়। রায়হানের ঘড়িতে তখন বাজে ১টা ৪৮ মিনিট।সামনে অপেক্ষা করছে সেই ডেভিল হাউস, পুরান ঢাকার ১৪ নম্বর গলির শেষ মাথায়, যেখানে আলো কম, নীরবতা গা ছমছমে, আর সময় যেন থমকে দাঁড়িয়ে আছে।

সে জানে, খামে লেখা ঠিকানায় যাওয়া মানে নিজের ছায়ার ভেতর ঢুকে পড়া।
তবু কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়ার জন্য মানুষের মাঝে এক ধরনের বিকার জন্মায়। রায়হান সেই বিকারের শিকার।

সে বেরিয়ে পড়ে।

১৪ নম্বর গলি পুরান ঢাকার একদম শেষ মাথা। প্রায় শতবর্ষ পুরোনো একদলা অন্ধকার। দেয়ালে শ্যাওলা, মাটিতে ভেজা কাদামাখা ইটের গন্ধ— যেন এই জায়গা একদিনের জন্যও জীবিত ছিল না।

সে হঠাৎ থেমে গেল।

সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা দালান— পাঁচতলা, জীর্ণ, জানালার কাঁচ ভাঙা, পেছনে পলিথিনে মোড়ানো ছাদ। দালানটা যেন তাকিয়ে আছে তার চোখের দিকে নির্বাক, অথচ কিছু বলার মতো।

প্রবেশপথে বড় করে লাল কালি দিয়ে লেখা: “শয়তানের আগমনস্থল। বাইরে থাকো।”

তবু রায়হান ঢুকল। ভেতরে প্রবেশ করতেই সে বুঝল এই বাড়ি নিঃসন্দেহে ফাঁকা নয়। কেউ আছে। কেউ সব জানে। কেউ দেখছে।

ভেতরে ঢুকে রায়হান হঠাৎ এক দেয়ালে চোখ আটকে গেল। সেখানে আঁকা এক বিশাল চিহ্ন— তিনটি চোখের প্রতিকৃতি, নিচে জ্বলন্ত আগুনের রেখা।
তার পাশে লেখা:

“যারা সত্য দেখে, তারা অন্ধ হয়ে যায়।
আর যারা চোখ বন্ধ রাখে, তারাই বেঁচে থাকে।”

হঠাৎ তার পায়ের নিচে কিছু একটা শব্দ করল।মাটির খালি ঘরের মেঝেতে ছিল লুকানো একটা দরজা। মাথা নিচু করে সে দরজাটা খুলতেই দেখতে পেল সিঁড়ি—
নিচে নেমে যাচ্ছে অন্ধকারের গহ্বরে।

রায়হানের গলায় শুকনো ঢোঁক গিলে সে নামতে লাগল। নিচে নেমে সে বুঝল, এটা স্রেফ বেজমেন্ট নয়। এটা যেন কোন কবরস্থান আর লাইব্রেরির মাঝামাঝি কিছু।

চারপাশে পুরনো ফাইল, অদ্ভুত ছবি, ছেঁড়া ডায়েরি। একটা দেয়ালে ঝুলছে কয়েকটা মানুষর মতো আকৃতি— চোখে কালো কাপড়, মুখে হাসির রেখা আঁকা।

তবে যা তাকে স্তব্ধ করে দিল, সেটা একটি ফ্রেম। তাতে ছিল তাসনিম হোসেনের ছবি, তার নিচে লেখা:

“শিকার নম্বর ৩৭
দেখেছিল সত্য, তাই ফিরতে পারল না।”

তার গা শিউরে উঠল। তাসনিমকে শুধু মেরে ফেলা হয়নি, তাকে বন্দী করে রাখা হয়েছে সময়ের ফ্রেমে— যেন সে হয়ে উঠেছে এক চিরস্থায়ী সতর্কবার্তা। সাথে ছিল আরও একটি ছোট চিরকুট:
“যদি তুমি পরবর্তী হতে না চাও, ফিরে যাও।”

রায়হান সেই মুহূর্তে একটি শব্দ শুনল।কোনো নারীর কণ্ঠ— নরম, যেন কষ্ট আর কান্না মিশ্রিত।

“তুমি কি জানতে চাও, রায়হান?
তুমি কি সত্যিই তৈরি?”

সে ঘুরে দেখল, কেউ নেই। তবে বাতাস ভারি হয়ে উঠছে, যেন কারও শ্বাস ফেলার শব্দও বাতাসে ছাপ রেখে যাচ্ছে।

ঠিক তখনই দেয়ালের এক কোণে দেখা গেল ঝাপসা সাদা পোশাকে এক নারী।
মাথায় চাদর, মুখ ঝাপসা, হাত বাড়িয়ে বলছে:

“তাসনিম আমি।
তুমি যে খুঁজছো, তার চেয়েও ভয়াবহ কিছু অপেক্ষা করছে।
সায়রা সে শুধু একটা নাম না।
সে একটা ছায়া,
যে কখনো আলোয় আসে না,
তবে একবার যার ছায়ায় ঢুকে পড়ো—
তুমি আর আগের তুমি থাকো না।”

রায়হানের ঠোঁট শুকিয়ে এল। সে বলতে চাইল, “তুমি কি মরেছো?” কিন্তু তার আগেই সেই নারী অদৃশ্য হয়ে গেল।

রায়হান দ্রুত উপরে উঠে আসে। বাড়ির ছাদে গিয়ে হাঁপাতে থাকে। তার মনে হচ্ছে, কারা যেন তাকে অনুসরণ করছে।

হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। অজানা নাম্বার।রিসিভ করতেই একটা কণ্ঠ বলল:

“তুমি এখনো সময় পাওনি, রায়হান।
তবে মনে রেখো, সায়রার সত্য জানতে গেলে
নিজের সত্য আগে দেখতে হবে।
আর সে সত্য বড় নির্মম।”

ফোন কেটে গেল।

রাত ৩টা ১২। রায়হান বাড়ি ফিরে এল। তবে এবার সে জানে, খেলা শুরু হয়ে গেছে।
এখন আর পিছনে ফেরা যাবে না। ডায়েরির পাশে রাখা এক চিরকুট তখনও তাকে খোঁচা দিচ্ছে:

“ডেভিল হাউজে প্রথম গেলে কিছু দেখা যায়।
দ্বিতীয়বার গেলে সবকিছু বদলে যায়।”

সানজানা

×