ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৫ জুলাই ২০২৫, ৩০ আষাঢ় ১৪৩২

প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ

নিয়ন্ত্রক সংস্থার অবহেলায় বিমা খাতে ফিরছে না শৃঙ্খলা

জাহিদুল ইসলাম্

প্রকাশিত: ০০:০৩, ১৫ জুলাই ২০২৫

নিয়ন্ত্রক সংস্থার অবহেলায় বিমা খাতে ফিরছে না শৃঙ্খলা

.

বিমা খাতে অনিয়মই যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এই আইন লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ (ইড্রা)। যা বিমা কোম্পানিগুলোর দুর্নীতিকে উৎসাহিত করছে। এতে শুধু কোম্পানির স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাই বিঘ্নিত হচ্ছে না, গ্রাহক প্রিমিয়ামের টাকাও অপব্যবহার হচ্ছে। রাষ্ট্রের এক শীর্ষস্থানীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, এসব অনিয়মের কারণে শুধু গ্রাহক স্বার্থই ক্ষুণ্ণ হচ্ছে না, বিমা খাতের শৃঙ্খলাও নষ্ট হচ্ছে।
এ ব্যাপারে বিমা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে বিধিমোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে নির্দেশনা দিতে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে। এই সুপারিশ সম্বলিত একটি প্রতিবেদন সম্প্রতি ওই গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টা কার্যালয়ে দাখিল করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা কার্যালয় অনিয়মে জড়িত কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে (এফআইডি) নির্দেশ দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন এই সমস্যা দূর করার জন্য জরুরি ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়োজন। অবশ্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইড্রা বিষয়টি স্বীকার করে বলছে, দেশের ১৯টি কোম্পানিতে এ ধরনের সমস্যা রয়েছে। তবে সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য বিমা প্রবিধানমালা সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, গত ৪ জুন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় হতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের (এফআইডি) সচিব নাজমা মোবারেকের কাছে এক চিঠি প্রেরণ করা হয়। এতে কয়েকটি বীমা কোম্পানি আইন ভেঙে সিইও’র চলতি দায়িত্ব পালন করছে উল্লেখ করে আইডিআরএ কর্তৃক পদক্ষেপ না নেওয়ার বিষয়ে রাষ্ট্রীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দেওয়া হয়। একইসঙ্গে এই প্রতিবেদনের পরামর্শের আলোকে এফআইডি পরবর্তীতে কি ব্যবস্থা নিয়েছে তাও জানাতে বলা হয়।
প্রতিবেদনে যে সব বিমা কোম্পানির কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে- গার্ডিয়ান লাইফ, সোনালি লাইফ, মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফ, কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্স ও রূপালি ইন্স্যুরেন্স। এই পাঁচ কোম্পানি দীর্ঘদিন ধরে সিইও নিয়োগে বিমা আইন লঙ্ঘন করছে। এক্ষেত্রে আইডিআরএ কর্তৃক একাধিকবার অর্থ জরিমানা করা হলেও বন্ধ হয়নি তাদের অপকর্ম। বরং গ্রাহক প্রিমিয়াম থেকে প্রাপ্ত অর্থের মাধ্যমে জরিমানা পরিশোধ করা হয়েছে। অর্থাৎ গ্রাহক স্বার্থে ক্ষতির পরিমাণ আরও বেড়েছে। অপরদিকে আইন অনুসারে প্রশাসক নিয়োগ দিতে গেলেও বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনের মুখে প্রশাসক সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে সংস্থাটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইডিআরএর এ ধরনের কার্যক্রম বীমা কোম্পানিগুলোর দুর্নীতিতে উৎসাহিত করছে। কোম্পানির চেয়ারম্যানরা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে নিজের স্বার্থরক্ষায় ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনকে সিইও পদে নিয়োগ/পুনঃনিয়োগ করছেন এবং ইড্রার অনুমোদন না নিয়েই তাদের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এতে কোম্পানির স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বিঘ্নিত হচ্ছে এবং প্রিমিয়ামের টাকা সঠিকভাবে ব্যবহৃত না হওয়ায় বিমা গ্রাহকদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। ফলে অন্যান্য ভালো কোম্পানিগুলোও এই উদাহরণ গ্রহণ করে অনিয়মে উৎসাহিত হচ্ছে।প্রতিবেদন হতে দেখা যায়, গার্ডিয়ান লাইফের সিইও শেখ রাকিবুল করিম ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি, সোনালি লাইফের মো. রফিকুল ইসলাম ২০২৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর, মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফের এসকে আব্দুর রশিদ ২০২৩ সালের ১ জুলাই, কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সের মোশাররফ হোসেন ২০২৩ সালের ১০ অক্টোবর এবং রূপালি ইন্স্যুরেন্সের ফৌজিয়া কামরুন তানিয়া ২০২৩ সালের ২ জানুয়ারি থেকে দায়িত্ব পালন করছেন।
গত জানুয়ারিতে আইডিআরএ গার্ডিয়ান লাইফ ও রূপালি ইন্স্যুরেন্সকে ৫ লাখ টাকা করে জরিমানা এবং ৬০ দিনের মধ্যে পূর্ণকালীন সিইও নিয়োগের নির্দেশ দেয়। তবে এখনো তা বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো আইন অমান্য করার সুযোগ পাচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বীমা আইন অনুসারে কোনো কোম্পানির সিইও পদ সর্বোচ্চ তিন মাস খালি রাখা যাবে এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে আরও তিন মাস বাড়ানো সম্ভব। এর পরও পূর্ণকালীন সিইও নিয়োগ না হলে আইডিআরএ প্রশাসক নিয়োগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব নিতে পারে। কিন্তু এই বিধান দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত হয়েছে। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোতে শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতা ব্যাহত হচ্ছে। তবে ইতোমধ্যেই কোম্পানিগুলোতে পূর্ণাঙ্গ সিইও নিয়োগে কার্যকর ভ‚মিকা নিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে ইড্রাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
গোয়েন্দা সংস্থার এই প্রতিবেদনটি দেশের বীমা খাতের দুর্নীতি ও প্রশাসনিক অনিয়মের বিরুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এই অনিয়ম অব্যাহত থাকলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যেতে পারে এবং বিমা খাতের দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হবে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিমা খাতের শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে আইডিআরএকে কঠোর মনোভাব নিয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে আইনের আওতায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে অবৈধভাবে পদে থাকা সিইওদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিতে হবে।
মূলত, দীর্ঘদিন যাবত শুধু সিইও চলতি দায়িত্ব নিয়েই বিমা খাতে সংকট তৈরি হয়নি। এরইসঙ্গে রয়েছে অনুমোদন ছাড়া বিমা কোম্পানির শাখা অফিস খোলা ও এর ব্যবস্থাপনা ব্যয়, বিমা কোম্পানির সিইওদের হুটহাট চাকরি থেকে অপসারণ, আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী আর্থিক প্রতিবেদন না করা, বিভিন্ন প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে আইডিআরএর পদক্ষেপ না নেওয়ার ব্যর্থতা। তবে বিমা খাতের জন্য যে সমস্যাটিকে সবচেয়ে বড় বিষয় বলে মনে করা হয় তা হলো দীর্ঘদিন যাবত গ্রাহক দাবি পরিশোধ না করা।
এ সব সমস্যা সমাধানে ইড্রা থেকে সবসময়ই সক্ষমতার ঘাটতির কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে আইন সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা। তবে খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা বলছেন, ইড্রার যে সক্ষমতা আছে তা দিয়েই বিমা খাতে পরিবর্তন সম্ভব। এক্ষেত্রে গ্রাহক দাবি পরিশোধের বিষয়টিকে তাদের সবার আগে প্রাধান্য দিতে হবে। কিন্তু তারা এর পরিবর্তে কোম্পানির ছোট ছোট কিছু বিষয়ে ফোকাস করে বড় করে তোলে। এক্ষেত্রে ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য থাকে কিনা, তা খোঁজ নিলেই হয়তো জানা যাবে।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে চতুর্থ প্রজন্মের এক জীবন বিমা কোম্পানির সিইও বলেন, ইড্রার সক্ষমতা বিমা খাতের জন্য অপরিহার্য, যদি কেউ অপব্যবহার না করে। আইডিআরএর এখন যে সক্ষমতা আছে সেটারই তারা অপব্যবহার করছে। যদি আরও ক্ষমতা পায় তাহলে প্রতিষ্ঠানগুলোকে পিষিয়ে মারবে। বিমা খাতের উন্নয়নে ইড্রাকে দাবি নিষ্পত্তিতে প্রাধান্য দিতে হবে। সেটা না করে তারা কোম্পানির ছোট-খাটো ভুলকে বড় করে তুলছে ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্যে।
তবে সামগ্রিকভাবে ইড্রার আরো ক্ষমতায়ন প্রয়োজন বলে করেন জেনিথ লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সিইও এবং বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরামের সেক্রেটারি এস এম নুরুজ্জামান। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, গ্রাহকের স্বার্থে দ্র‍ুত বিমা দাবি নিষ্পত্তিতে ইড্রার আরও সক্ষমতা প্রয়োজন। সার্বিকভাবে বিমা খাতের উন্নয়নের জন্য ৪/৫টি কোম্পানিসহ যে সব কোম্পানি বেশি সমস্যায়, তাদের অগ্রাধিকার দিয়ে সমাধান করতে হবে। সমস্যাযুক্ত কোম্পানিগুলো যদি দাবি পরিশোধ করে দেয় তাহলে এটা বিমা খাতে পজিটিভ ইম্প্যাক্ট তৈরি করবে।
তবে ইড্রার সক্ষমতা অর্জনে দুইটি বিষয়ে প্রাধান্য দিয়েছেন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স একাডেমির সিইও এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট ফর প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট (বিআইপিডি)’র মহাপরিচালক কাজী মো. মোরতুজা আলী, এসিআইআই। তিনি বলেন, ইড্রার সক্ষমতার ক্ষেত্রে কোথায় ঘাটতি আছে সেটা ইড্রাই ভালো বলতে পারবে। তবে একটা সমস্যা আমরা দেখছি, সেটা হলো- ইড্রা কোনো বিষয়ে অনুমোদন না দিলে বা কোনো পরিবর্তনের কথা বললে কোম্পানিগুলো আদালতে চলে যায়। পরে আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নেয়। তাদের আদালতে যাওয়ার অধিকার আছে, কিন্তু এই অধিকার আইডিআরএ’র দায়িত্ব পালনে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অর্থাৎ লেজিসলেটিভ পাওয়ার এবং কনস্টিটিউশনাল রাইট্স- এই দুইয়ের মধ্যে কনফ্লিক্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে আমরা শুনি যে, কোনো অপরাধের কারণে আইডিআরএ শাস্তি দিলেও শেষ পর্যন্ত তা টিকে না। এই সমস্যা দূর করতে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে ঠিক করতে হবে।
দ্বিতীয় বিষয়টি হলো স্পষ্টিকরণ বা স্বচ্ছতা। ইড্রা কোন কোম্পানির বিরুদ্ধে কোন আদেশ বা ব্যবস্থা নিলে, সেটা কেন নিয়েছে অথবা ব্যবস্থা না নিলে, কেন নেয়নি অর্থাৎ কোন সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে একটা স্পষ্টীকরণ থাকা দরকার। কিন্তু ইড্রা সেটা করছে না। তারা আইন মেনে কাজ করছে এতে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু কোনো বহির্শক্তি যেন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য জনসাধারণের উদ্দেশে প্রকাশ্য স্পষ্টিকরণ বা স্বচ্ছতার দরকার। তথ্যের অভাব যেখানে, সেখানেই বিভ্রান্তির সুযোগ থাকে।
প্রধান উপদেষ্টা কার্যালয়ের চিঠি এবং খাত সংশ্লিষ্টদের বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় আইডিআরএ মুখপাত্র সাইফুন্নাহার সুমি’র কাছে। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টা কার্যালয় থেকে আমাদের যে চিঠি দেয়া হয়েছে, আমরা তার জবাব দিয়েছি। মূলত ৫টি কোম্পানির চলতি দায়িত্বপ্রাপ্ত সিইও’র বিষয়ে বলা হয়েছে। কিন্তু আমাদের হিসেব মতে ১৯টি কোম্পানিতে এই সমস্যা আছে। সিইও নিয়োগের প্রবিধানমালা খুবই রেস্ট্রিকটেড হওয়ায় এই সংকট তৈরি হয়েছে। বর্তমানে প্রবিধানমালা সংশোধনের কাজ চলছে। ফলে আগামীতে এই সংকট কাটবে বলে মনে করছে আইডিআরএ।
কিন্তু সিইও’র চলতি দায়িত্ব সম্পর্কিত সমস্যা ছাড়াও বিমা খাতে বহুবিধ সমস্যা রয়েছে। এসব সমস্যা কেন দূর হচ্ছে না এবং ইড্রার সক্ষমতার অভাব কোথায় এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি লিখিত আকারে হোয়াটসঅ্যাপে প্রশ্ন দিতে বলেন। কিন্তু লিখিত প্রশ্ন দেওয়ার পর আর কোন জবাব দেননি। 

প্যানেল

×