
ইসরাইল-ইরান যুদ্ধ বন্ধ হলেও যে কারণে এই যুদ্ধের অবতারণা অর্থাৎ ইসরাইলি আগ্রাসন কর্তৃক নিরস্ত্র গাজাবাসীর ওপর বর্বর হত্যাযজ্ঞ এখনো চলমান। প্রতিদিনই অবুঝ শিশুসহ শত শত নিরীহ-নিষ্পাপ লোক মারা যাচ্ছে তাদের হামলায়। তারা মুসলিম এটাই তাদের একমাত্র অপরাধ। তাই তাদের মাতৃভূমিকে নিশ্চিহ্ন করাই এখন ইসরাইলের একমাত্র লক্ষ্য। এসব বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ দেখে খোদ ইসরাইলি এবং আমেরিকান সাধারণ নাগরিকও রাস্তায় নেমে এসেছে প্রতিবাদস্বরূপ। অনেক মুসলিম বিশ্ব এই হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে নৈতিক সমর্থন দিলেও একমাত্র ইরান সামরিক শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ইসরাইলির বিরুদ্ধে। অবশেষে যুদ্ধ বন্ধ হয়েছে এবং ইরানের জয় হয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে ইরানের এমন কি সামরিক শক্তি আছে যা দেখে ইসরাইল এবং তার মদদদাতা মার্কিন প্রশাসন যুদ্ধ বিরতিতে এগিয়ে এলো। সামরিক শক্তি পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার’র তালিকা অনুযায়ী বর্তমানে সামরিক শক্তিতে শীর্ষ দেশ হিসেবে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সবার শেষে ১৪৫ নাম্বার দেশ হিসেবে আছে ভুটানের নাম। এ তালিকায় ইরান সামরিক সক্ষমতার দিক থেকে ইসরাইলের তুলনায় তিন ধাপ এগিয়ে আছে। র্যাংকিংয়ে ইরানের অবস্থান ১৪তম আর ইসরাইলের অবস্থান ১৭তম।
প্রতিরক্ষা খাতে ইরান ও ইসরাইল দুই দেশই প্রচুর অর্থ ব্যয় করে। তবে বার্ষিক সামরিক বাজেটে ইরানের তুলনায় ইসরাইলের ব্যয় দ্বিগুণেরও বেশি। ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাজেট হলো ২৪৪০ কোটি ডলার। অন্যদিকে ইরানের বাজেট ৯৯৫ কোটি ডলার। এই র্যাংকিংয়ের ১৪৫ দেশের মধ্যে ইরান ৩৩ তম অবস্থানে আর ইসরাইল ১৯তম অবস্থানে রয়েছে। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার জানাচ্ছে, সৈন্য সংখ্যার হিসেবে ইসরাইলের চেয়ে এগিয়ে আছে ইরান। ইরানের নিয়মিত সেনা আছে ১১ লাখ ৮০ হাজার যেখানে ইসরাইলের সৈন্য ৬ লাখ ৭০ হাজার। এর মধ্যে ইরানের রিজার্ভ সৈন্য সংখ্যা সাড়ে তিন লাখ আর ইসরাইলের রিজার্ভ সেনা আছে ৪ লাখ ৬৫ হাজার। যুদ্ধবিমানের সংখ্যা দিয়েও ইরান এগিয়ে আছে ইসরাইলের তুলনায়। ইরানের মোট সামরিক বিমানের সংখ্যা ৫৫১টি আর ইসরাইলের আছে ৬১২টি। এর মধ্যে ইরানের যুদ্ধ বিমান আছে ১৮৬টি আর ইসরাইলের যুদ্ধবিমান আছে ২৪১টি। ইরানের অ্যাটাকিং বিমান সংখ্যা ২৩টি যেখানে ইসরাইলের আছে ৩৯টি। ইরানের পরিবহন বিমান আছে ৮৬টি ইসরাইলের আছে ১২টি। ইরানের প্রশিক্ষণ বিমান ১০২টি আর ইসরাইলের আছে ১৫৫টি। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইরানের হেলিকপ্টার আছে ১২৯টি আর ইসরাইলের ১৪৬টি। ৪৮টি অ্যাটাক হেলিকপ্টার নিয়ে ইরানের চেয়ে শক্তিশালী ইসরাইল। ইরানের অ্যাটক হেলিকপ্টারের সংখ্যা ১৩টি। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার’র তথ্য অনুযায়ী, ট্যাংক ও সাঁজোয়া যানের দিক থেকে ইসরাইলের চাইতে এগিয়ে আছে ইরান। ইসরাইলের ট্যাংক আছে ১৩৭০টি আর ইরানের ১৯৯৬টি। সাঁজোয়া যান আছে ইরানের ৬৫ হাজার ৭৬৫টি আর ইসরাইলের আছে ৪৩ হাজার ৪০৩টি। এছাড়া আর্টিলারি সক্ষমতায় এগিয়ে ইরান যেখানে তাদের রকেট আর্টিলারি এমএলআরএস এর সংখ্যা ৭৭৫টি এবং সেলফ প্রপেলড আর্টিলারির সংখ্যা ৫৮০টি। অন্যদিকে ইসরাইলের সেফল প্রপেলড আর্টিলারির সংখ্যা ৬৫০টি এবং এমএলআরএস বা রকেট আর্টিলারির সংখ্যা ১৫০টি। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার বলছে, নৌবাহিনীর শক্তির দিক থেকে এগিয়ে আছে ইরান। দেশটির ১০১টি যুদ্ধজাহাজ রয়েছে যেখানে ৭টি ফ্রিগেট এবং ২১টি টহল জাহাজ আর ইসরাইলের যুদ্ধজাহাজ সংখ্যা ৬৭টি। এর মধ্যে টহল জাহাজ আছে ৪৫টি এবং ইসরাইলের কোনো ফ্রিগেট নেই। সাবমেরিনের দিক থেকেও ইরান শক্তিশালী। দেশটির সাবমেরিন আছে ১৯টি যেখানে ইসরাইলের সাবমেরিন আছে ৫টি।
গত ১৩ জুন শুরু হওয়া ইসরাইলি আগ্রাসনে ইরানের সামরিক, পারমাণবিক ও আবাসিক এলাকা ১২ দিন ধরে লক্ষ্যবস্তু হয়। অব্যাহত হামলায় ইরানের নাতাঞ্জ, ফরদো ও ইসফাহান-এই তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় বিমান হামলা চালায়। জবাবে ইরানের ইসলামিক বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর অ্যারোস্পেস ফোর্স ‘অপারেশন ট্রু প্রমিজ-৩’ এর অংশ হিসেবে ২২ দফার পাল্টা অভিযানে প্রায় সাড়ে ৪শ ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরাইল অধিকৃত অঞ্চলে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি ঘটায়। অন্যদিকে মার্কিন বিমান হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরান কাতারের আল-উদেইদ মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে। এতে পশ্চিম এশিয়ার সবচেয়ে বড় মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতেও বেশ ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। এ হামলার জেরেই ২৪ জুন ট্রাম্প তড়িঘড়ি করে যুদ্ধবিরতি কার্যকরের ঘোষণা দেন। হামলায় ইরানে কমপক্ষে ৪৩০ জন নিহত এবং তিন হাজার ৫০০ জন আহত হয়েছে ষ আর ইসরাইল ২৫ জন নিহত এবং দুই হাজার ৫১৭ জন আহত হয়েছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ইরানের ক্ষতি হয়েছে ২৪ থেকে ৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ইরানের আনুমানিক ৩৮০ বিলিয়ন ডলার জিডিপির প্রায় ৬ দশমিক ৩ থেকে ৯ দশমিক ২ শতাংশের সমান।
ইরানের ওপর হামলার প্রথম সপ্তাহে ইসরাইল প্রায় ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করেছে। অর্থাৎ দৈনিক যুদ্ধ ব্যয় ৭২৫ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। এর মধ্যে আক্রমণাত্মক অভিযানের জন্য ৫৯৩ মিলিয়ন ডলার এবং প্রতিরক্ষা ও সংহতিকরণের জন্য ১৩২ মিলিয়ন ডলার খরচ করতে হয়েছে এই দুই মিত্রকে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের মতে, কেবল ক্ষেপণাস্ত্র-বিরোধী ব্যবস্থার জন্য ইসরাইলের প্রতিদিন ১০-২০০ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। কিংস কলেজ লন্ডনের সিনিয়র অধ্যাপক আন্দ্রেয়াস ক্রিগের মতে, অর্থনৈতিকভাবে আরও স্থিতিশীল হলেও ইসরাইল অক্ষত ছিল না। তিনি অনুমান করেন, ১১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ১৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে, যা দেশটির ৫৪০ বিলিয়ন ডলারের জিডিপির ২.১ থেকে ৩ দশমিক ৩ শতাংশের সমান। ক্রিগের মতে, ইরান এবং ইসরাইল উভয়ের তুলনায় ট্রাম্পের অপারেশন মিডনাইট হ্যামারের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ‘একটি ছোটখাটো আর্থিক ক্ষতি’ ভোগ করতে হয়েছে, যার পরিমাণ প্রায় ১-২ বিলিয়ন ডলার।
সুইডেনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা এসআইপিআরআইর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের নয়টি দেশের কাছে প্রায় ১২ হাজার ৫১২টি পারমাণবিক অস্ত্র আছে। দেশগুলো হলো- যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন, ভারত, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া এবং ইসরাইল। এই তালিকায় ইরানের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে পারমাণবিক অস্ত্র কখনোই ছিল না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন দাবি করেছে যে ইরান ইউরেনিয়াম দিয়ে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে। যাহোক, মার্কিন ও ইসরাইলি হামলা ইরানের পারমাণবিক অবকাঠামোকে দুর্বল করে ফেলেছে। তেহরানের তেল রপ্তানিতেও ব্যাপক ধস নামিয়েছে। জ্বালানি স্থাপনা এবং সামরিক অবকাঠামোর ক্ষতি ইরানের কাঠামোগত দুর্বলতাগুলোকে আরও গভীর করে তুলেছে, যার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব দেশটির অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার ওপর পড়ছে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে যুদ্ধের কারণে ইসরাইল এবং ইরান উভয় দেশের অবকাঠামো ভেঙে পড়া থেকে শুরু করে অর্থনীতি পর্যন্ত ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উভয় পক্ষই এখন এই সংঘাতের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করছে। এই সংঘাতের আগুন আবারও জ্বলে উঠতে পারে যে কোনো সময়।
লেখক : অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
প্যানেল