ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৫ জুলাই ২০২৫, ৩০ আষাঢ় ১৪৩২

ফ্যাটি লিভারের ৭টি নীরব উপসর্গ, যেগুলো অনেক নারীরাই অবহেলা করেন

প্রকাশিত: ২১:৫৪, ১৪ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ২১:৫৫, ১৪ জুলাই ২০২৫

ফ্যাটি লিভারের ৭টি নীরব উপসর্গ, যেগুলো অনেক নারীরাই অবহেলা করেন

শরীরে কোনো বড় সংকেত নেই, তীব্র ব্যথা বা হঠাৎ অসুস্থতাও নয় কেবল কিছু হালকা পরিবর্তন, যেগুলো সহজেই স্ট্রেস, হরমোনের ওঠানামা কিংবা বয়স বাড়ার লক্ষণ ভেবে উপেক্ষা করা যায়। অথচ এই ছোট ছোট লক্ষণই হতে পারে ফ্যাটি লিভার রোগের সূচনা। বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে এই রোগটি বছরের পর বছর নিঃশব্দে এগিয়ে যেতে পারে এবং যখন ধরা পড়ে, তখন তা ভয়ানক পরিণতি ডেকে আনে।

ফ্যাটি লিভার বা হেপাটিক স্টিয়েটোসিস হলো এমন একটি অবস্থা, যেখানে যকৃতের কোষে অতিরিক্ত চর্বি জমা হতে থাকে। এটি অ্যালকোহলজনিত কারণেও হতে পারে, আবার ডায়াবেটিস, স্থূলতা বা কোলেস্টেরলজনিত সমস্যার কারণেও হতে পারে। যেহেতু শুরুতে এর কোনো লক্ষণ থাকে না, তাই অনেকেই বুঝে উঠতে পারেন না যে তাঁদের যকৃত ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

নারীদের ক্ষেত্রে ফ্যাটি লিভার কেন অবহেলিত?
অনেকেই মনে করেন, যকৃতের রোগ মানেই বেশি অ্যালকোহল খাওয়া পুরুষদের সমস্যা। কিন্তু নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ (NAFLD) আসলে নারীদের মাঝেও ব্যাপক হারে দেখা দেয়। হরমোনের পরিবর্তন, ওষুধ সেবন এবং জীবনযাত্রার ধরন এ রোগের অন্যতম কারণ। অথচ নারীদের শরীরে এ রোগের উপসর্গ এতটাই সূক্ষ্ম যে তা সহজেই চোখ এড়িয়ে যায়।

যে ৭টি উপসর্গকে অবহেলা করা ঠিক নয়
১. অব্যক্ত ক্লান্তি, ঘুমিয়েও নেই স্বস্তি

প্রতিদিনই আমরা কিছুটা ক্লান্ত থাকি, সেটি স্বাভাবিক। কিন্তু যদি আপনি রাতে ভালোভাবে ঘুমিয়ে উঠেও দিনের বেশির ভাগ সময়েই অবসাদগ্রস্ত থাকেন, তাহলে সেটা যকৃতের সংকেত হতে পারে। ফ্যাটি লিভারের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষণ হলো এই ক্লান্তি, যা কোনও কারণ ছাড়াই শরীরকে নিঃশেষ করে দেয়।

২. পেটের ওপর দিকে ভারি বা ফুলে থাকার অনুভব

হরমোনজনিত কারণে অনেক নারী সামান্য পেটফাঁপা অনুভব করেন। তবে যদি পেটের ডানদিকে (যেখানে লিভার থাকে) ক্রমাগত ভার বা চাপ অনুভূত হয়, তাহলে সেটি লিভার বড় হয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত হতে পারে। এটি অনেক সময় হজমের সমস্যার মতো মনে হয় বলে অনেকেই পাত্তা দেন না।

৩. ওজন না কমা বা হঠাৎ বেড়ে যাওয়া

সুস্থভাবে খাওয়া, নিয়মিত শরীরচর্চা করেও যদি ওজন কমে না বা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে যকৃতের কাজ ব্যাহত হচ্ছে। কারণ লিভার যখন নিজেই চর্বিতে পরিপূর্ণ থাকে, তখন আর অতিরিক্ত চর্বি পোড়াতে পারে না। ফলে ওজন কমানো আরও কঠিন হয়ে পড়ে।

৪. হালকা বমিভাব বা খাওয়ার পর অস্বস্তি

ফ্যাটি লিভারের ক্ষেত্রে অনেক নারীরই খাওয়ার পর হালকা বমিভাব, অস্বস্তি বা হজমে সমস্যা হয়, বিশেষ করে তেলে ভাজা বা ভারী খাবারের পর। কারণ যকৃত বাইল উৎপাদন করে চর্বি হজমে সাহায্য করে। যখন সেটি ঠিকমতো কাজ করে না, তখন হজমও ধীর হয়ে যায়।

৫. ঘাড় বা বগলে গাঢ় দাগ

ঘাড়, বগল বা কুঁচকিতে মসৃণ গাঢ় রঙের দাগ দেখা গেলে সেটি ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের লক্ষণ হতে পারে, যা ফ্যাটি লিভারের অন্যতম প্রধান চালক। এই দাগগুলোকে acanthosis nigricans বলা হয় এবং এটি অনেক সময় পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS) বা ডায়াবেটিসের পূর্ব লক্ষণ হিসেবেও দেখা যায়।

৬. মস্তিষ্কে ঝিমঝিম ভাব বা মনোযোগের অভাব

স্মৃতি বিভ্রাট, মনোযোগে ঘাটতি বা দিনভর “মাথা ঝিম ঝিম” করা এই সবকিছুর পেছনেও থাকতে পারে যকৃতের সমস্যা। যকৃত যখন শরীরের টক্সিন ঠিকমতো পরিষ্কার করতে পারে না, তখন সেগুলো রক্তে জমে মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলে।

৭. অনিয়মিত পিরিয়ড বা হরমোনের ভারসাম্যহীনতা

যকৃত শরীরে হরমোন নিয়ন্ত্রণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই যদি পিরিয়ড অনিয়মিত হয়ে যায়, বেশি ব্যথাযুক্ত বা ভারী হয় কিংবা ফার্টিলিটি সমস্যার সৃষ্টি হয়, তাহলে যকৃতের দিকে নজর দেওয়া উচিত। বিশেষ করে যাঁরা পিসিওএস বা থাইরয়েড সমস্যায় ভুগছেন, তাঁদের মধ্যে ফ্যাটি লিভারের সম্ভাবনা অনেক বেশি।

কেন নারীরা এসব লক্ষণ এড়িয়ে যান?
কারণ এই উপসর্গগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ছোটখাটো অস্বস্তির মতোই। অনেক নারী এগুলোকে বয়স, স্ট্রেস, হরমোন কিংবা খাদ্যাভ্যাসের দোষ দিয়ে মেনে নেন। কিন্তু এই ছোট ছোট সংকেতগুলো আসলে বড় অসুখের পূর্বাভাস হতে পারে।

কখন গুরুত্ব দিতে হবে?
শুরুর দিকে ফ্যাটি লিভার অনেকটাই নিরীহ। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি নন-অ্যালকোহলিক স্টিয়েটোহেপাটাইটিস (NASH), লিভারের ফাইব্রোসিস, সিরোসিস এমনকি লিভার ফেইলিওরেও গড়াতে পারে। ভালো খবর হলো, প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে এই রোগ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন সচেতনতা, কিছু জীবনযাপনে পরিবর্তন এবং সময়মতো চিকিৎসা।

কী খাবার বাড়ায় ফ্যাটি লিভারের ঝুঁকি?
চিনি, পরিশোধিত কার্ব, এবং স্যাচুরেটেড ফ্যাটযুক্ত খাবার যেমন মিষ্টি পানীয়, ডেজার্ট, সাদা পাউরুটি, প্যাকেটজাত স্ন্যাকস, ভাজাপোড়া, রেড মিট, ফাস্ট ফুড ও ট্রান্স ফ্যাটসমৃদ্ধ বেকড ফুড এসব ফ্যাটি লিভারের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। এমনকি মাঝেমধ্যে অ্যালকোহল খেলেও যকৃতের কোষে চর্বি জমতে শুরু করে। খাদ্যতালিকায় যদি ফাইবার ও প্রয়োজনীয় পুষ্টি না থাকে, তবে লিভার দুর্বল হয়ে পড়ে।


ফ্যাটি লিভার শরীরে উচ্চ শব্দে ঘোষণা দেয় না। এটি ধীরে ধীরে, নীরবে নিজের ছাপ রেখে যায় অবসাদ, হালকা অস্বস্তি, পিরিয়ডে অনিয়ম, বুদ্ধির ধোঁয়াটে ভাব কিংবা পেটের চর্বি দিয়ে। এসব উপসর্গ একা হয়তো সাধারণ মনে হবে, কিন্তু একত্রে এগুলো একটা গুরুত্বপূর্ণ গল্প বলে যেটা যকৃত বলতে চাইছে।

নারীরা বরাবরই অসুস্থতা সয়ে নেওয়ার শিক্ষা পেয়ে থাকেন। কিন্তু এই ছোট ছোট বার্তাগুলোর প্রতি মনোযোগ দেওয়াই হতে পারে ভবিষ্যতের বড় বিপদ ঠেকানোর চাবিকাঠি।

যদি এই উপসর্গগুলোর কোনোটি আপনার সঙ্গে মিলে যায়, তাহলে ভয় পাবেন না, তবে একে অবহেলা করাও ঠিক নয়। একটি সাধারণ লিভার আল্ট্রাসোনোগ্রাফি ও কিছু রক্তপরীক্ষা আপনাকে ভবিষ্যতের ঝুঁকি থেকে রক্ষা করতে পারে।

 


সূত্র:https://tinyurl.com/3p4jhbfm

আফরোজা

×