
ছবি: সংগৃহীত
গাজায় গণহত্যা থামছে না। এই যুদ্ধ শুধু বোমা ও গোলাবারুদের নয়, এটি চিকিৎসা ব্যবস্থাকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার যুদ্ধ। চিকিৎসকদের হত্যা করে গাজাকে এমন এক অবস্থায় ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, যেখানে সুস্থতা আর ফিরে আসবে না। ইসরায়েলের এই কৌশল যেন গাজার মানুষকে চিরতরে অসহায় করে দেওয়ারই একটি উপায়।
ডা. মারওয়ান আল-সুলতান ছিলেন গাজার অন্যতম সম্মানিত চিকিৎসক। তিনি ইন্দোনেশিয়ান হাসপাতালের পরিচালক এবং গাজায় বেঁচে থাকা দুইজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের একজন ছিলেন। জুলাইয়ের ২ তারিখে একটি বোমা সরাসরি তার ঘরে পড়ে। নিহত হন তিনিসহ তার স্ত্রী ধিকরা, মেয়ে লামিস, বোন আম্নেহ এবং জামাতা মোহাম্মদ। এই পরিবারটি গাজার একটি "নিরাপদ" এলাকায় আশ্রয় নিয়েছিল, যেখানে ইসরায়েলই তাদের যেতে বলেছিল। অথচ সেখানেই আঘাত হানে মৃত্যু। লুবনাহ, ডা. মারওয়ানের মেয়ে, রান্নাঘরে থাকার কারণে বেঁচে যান। তার তিন ভাই বাইরে থাকায় তারাও রক্ষা পান।
ডা. মারওয়ান মৃত্যুর আগের দিন ছেলেকে বলেছিলেন, যুদ্ধবিরতি হলে সবাই মিলে ঘরবাড়ি গড়ে তুলবেন, আবার হাসপাতাল চালু করবেন। সেই স্বপ্ন চিরতরে শেষ হয়ে যায় তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে। লুবনাহ চেয়েছিলেন, তার পরিবারই যেন যুদ্ধের শেষ শিকার হয়। কিন্তু তার সেই প্রার্থনাও বিফলে যায়।
জুলাইয়ের ৪ তারিখে নিহত হন ডা. মুসা হামদান খাফাজা। তিনি নাসের হাসপাতালের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তিনিও “নিরাপদ” এলাকায় পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেখানে একটি তাঁবু খাটিয়ে ছিলেন। সেই তাঁবুতে ইসরায়েলের বোমা পড়ে মৃত্যু হয় তার স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলের। বেঁচে যায় কেবল তার ছেলে আমর। ডা. মারওয়ান এবং ডা. মুসা—দুজনই যুদ্ধ চলাকালেও রোগীদের সেবা দিয়েছেন, কখনও পিছু হটেননি।
ডা. মারওয়ান ছিলেন ৭০তম এবং ডা. মুসা ৭১তম নিহত স্বাস্থ্যকর্মী, যারা মাত্র ৫০ দিনের ব্যবধানে প্রাণ হারান। অক্টোবর ২০২৩ থেকে এখন পর্যন্ত গাজায় অন্তত ১,৫৮০ চিকিৎসা কর্মী নিহত হয়েছেন। গড়ে প্রতি দুই দিনে পাঁচজন করে চিকিৎসক, নার্স, অ্যাম্বুলেন্স চালক বা অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী নিহত হচ্ছেন।
গাজায় একে একে ঝরে পড়েছে বহু বিশিষ্ট চিকিৎসক। কেউ কর্মস্থলে যাওয়ার পথে নিহত হয়েছেন, কেউ বন্দিদশায় নির্যাতনে প্রাণ হারিয়েছেন। এখনো প্রায় ১৮০ চিকিৎসক ইসরায়েলের হেফাজতে রয়েছেন। তাদের একজন হলেন ডা. হুসাম আবু সাফিয়া, কামাল আদওয়ান হাসপাতালের পরিচালক।
একের পর এক হাসপাতাল বোমার আঘাতে ধ্বংস হচ্ছে। অনেক হাসপাতাল রূপ নিচ্ছে গণকবরে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখন পর্যন্ত ৭৩৪টি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে আক্রমণের প্রমাণ পেয়েছে।
এই ধ্বংস কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটি পরিকল্পিত। এই ধরণের হত্যাকে বলা হচ্ছে "মেডিসাইড"—অর্থাৎ গাজার চিকিৎসা ব্যবস্থা ও সুস্থতার সক্ষমতাকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেওয়া। প্রতিটি চিকিৎসকের মৃত্যু মানে একটি সমাজের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা সেবার ভবিষ্যৎ ধ্বংস হয়ে যাওয়া।
ইসরায়েল বলছে, তারা হামাসকে নির্মূল করতে ও ৭ অক্টোবরের বন্দিদের ফিরিয়ে আনতে অভিযান চালাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। এই যুদ্ধ একটি জাতিকে মুছে দেওয়ার প্রচেষ্টা। একজন লেখক একে বলেছেন “আল-ইবাদাহ”—অর্থাৎ একটি জাতির সামাজিক, সাংস্কৃতিক, জ্ঞানচর্চা ও জীবনের ধারাবাহিকতা নিশ্চিহ্ন করার প্রক্রিয়া। আর চিকিৎসকদের হত্যা সেই ধ্বংসযজ্ঞের কেন্দ্রবিন্দু।
লুবনাহর স্বামী মোহাম্মদ, একজন সাংবাদিক, একসময় ইসরায়েলের কারাগারে দেড় বছর ছিলেন। সেখান থেকে ফিরে এসে বলেছিলেন, তিনি প্রার্থনা করতেন যেন মৃত্যুই আসে—কারণ বন্দিদশার ভয়াবহতা ছিল মৃত্যুর চেয়েও কঠিন। সেই স্বামীকেও হারিয়েছেন লুবনাহ।
এখন লুবনাহর প্রার্থনা শুধু একটি— যুদ্ধ থামুক। আর নয়। কিন্তু তার সেই আকুতি এখনও শুনছে না কেউ।
লেখক: একজন তৃতীয়–প্রজন্মের ফিলিস্তিনি শরণার্থী, বর্তমানে কানাডার ইউনিভার্সিটি অব আলবার্টায় রাজনৈতিক বিজ্ঞান বিভাগের ভিজিটিং প্রফেসর।
সূত্র: আল জাজিরা
এম.কে.